না বলা কথা

সানিয়া আজাদ
অণুগল্প, পডকাস্ট
Bengali
না বলা কথা

কতদিন পর সুজাতার মুখোমুখি হবো আমি? পঁচিশ বছর? ত্রিশ বছর? নাকি কয়েক যুগ? ক্যালেন্ডারের পাতা হিসেব করলে হয়তো পঁচিশ বা ত্রিশ বছর হতে পারে, কিন্তু আমার মনের না দেখা অতৃপ্তি হিসেব করলে কয়েকযুগ হয়ে যাবে। আবার স্মৃতির পরত হিসেব করলে মনে হবে এইতো সেদিনের কথা!

 

গল্পটির অডিও এখানে শুনুন:

সুজাতা আমার প্রতিবেশী, বয়সে আমার চেয়ে সাত বছরের ছোট। একেবারে বাচ্চা বয়স থেকে তাকে দেখে আসছি। ঘন কালো এক মাথা চুল পনিটেইল করে পিছনে স্কুলব্যাগ জড়িয়ে এক টাকা দামের মালাই আইস্ক্রিম খেতে খেতে গুটি গুটি পায়ে যখন স্কুল থেকে ফিরত আমার তখন স্কুলে যাওয়ার সময়। আইসক্রিম খাওয়ার সময় ওর সমস্ত মনোযোগ নিবদ্ধ থাকত আইসক্রিমের ওপর, অন্য কোনদিকে যেন খেয়াল করার সময়ই নেই। সরকারি প্রাইমারি স্কুলে সকাল দশটা থেকে সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত ক্লাশ নেওয়া হয় ওয়ান আর টু, এরপর ওয়ান, টু’র ছুটির পর শুরু হয় ক্লাশ থ্রি থেকে ফাইভ এর ক্লাশ যার সময় দুপুর বারোটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত। আমি অনেকটা বড় হয়েই স্কুলে গিয়েছি। আমি যখন ক্লাশ ফোরএ সুজাতা তখন ক্লাশ টুতে। ওটুকু বয়সেই ওকে দেখলে আমার ভেতরে এমন এক আশ্চর্য অনুভূতি হতো যা কাউকে বলা যেতো না। এই অনুভূতির কী নাম সেটা তখনো বুঝি নি, কিন্তু ব্যাপারটা যে নিতান্তই ব্যাক্তিগত সেটা বুঝার বয়স হয়েছিল। ওর সাথে কথা বলার নানা চেষ্টা করে যেতাম। পাশাপাশি বাড়ী হওয়াতে আর দুজনেরই যে বয়স তাতে কথা বলাটা দোষের কিছু ছিল না। কিন্তু ওই যে বললাম এক আশ্চর্য অনুভূতি, সে জন্য কারো সামনে স্বাভাবিক কথাও স্বাভাবিক মনে হত না। একা পেলেই কথা বলার চেষ্টা করে যেতাম।

– কী ব্যাপার, এই ঠাণ্ডায় আইসক্রিম খাচ্ছ, যে ঠাণ্ডা লেগে যাবে না?

– না

– কেন লাগবে না?

– বাড়ীতে গিয়ে গরম পানি খাব। ঠাণ্ডা গরম কাটাকাটি।

– আমি হাসি। আজকে ক্লাশে সব পড়া ঠিকমত পেরেছ?

– হু

– কী পড়িয়েছে?

– ২ এর নামতা।

– তুমি মুখস্ত পার?

– হু

এমনি সব স্বাভাবিক কথা। কিন্তু আমার বুকে হাতুড়ি পেটার শব্দ পেতাম। খুব ইচ্ছে হতো সুজাতার বুকে কান লাগিয়ে শুনতে ওর বুকেও কোন হাতুড়ি পেটার শব্দ হয় কী না। কিন্তু ওতো বাড়ী যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়তো, হাতুড়ি পেটার কোন লক্ষণই দেখা যেতো না। বাড়ীতে গিয়ে হয়তো স্কুল ব্যাগটা টেবিলে রেখেই টিভির রিমোটকন্ট্রোল দিয়ে সিএন চ্যানেলে টম এন্ড জেরি দেখতে বসে যাবে। আর আমি? ক্লাশে সেকেন্ড ব্যাঞ্চের শেষে বসে সুজাতাকে ভোলার জন্য গোফরান স্যারের অংক ক্লাশে মনোযোগ দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে যেতাম আর বড় বড় গুণ ভাগ নির্ভুলভাবে করার চেষ্টা করতাম।

আমার চোখের সামনে সুজাতা পেন্সিল ছেড়ে বলপেন ধরল, ফ্রক ছেড়ে থ্রি-পিস পরা শুরু করল। বাচ্চা থেকে কিশোরী হল, কিশোরী থেকে যুবতী হল। আমার বুকে হাতুড়ি পেটা বেড়ে যেতেই থাকল নিরন্তর। কিন্তু সে আওয়াজ আমি ছাড়া কেউ শুনে না, এই হাতুড়িকে সঙ্গী করে আমিও একসময় কলেজ শেষ করে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। যখন বাড়ী আসি ওর সাথে আমার দেখা হয়, কথা হয় হাতুড়ি পেটার শব্দও শুনি কিন্ত সাহস করে ওকে সেই শব্দ শোনাতে পারি না। পাছে আমায় ফিরিয়ে দেয়, সেই ভয়ে বলা হয়ে উঠে না। আমি আমার হাতুড়িকে বুকে বয়ে আবার ইউনিভার্সিটিতে ফিরে আসি।

চিত্র: রিয়া দাস

এভাবেই দিন চলে যাচ্ছিল। বিপত্তি বাধল মায়ের একটা ফোনে। মা ১৬ ই ডিসেম্বর আমাকে বাড়ীতে থাকতে বলল। যেভাবেই পারি আমি যেন চলে আসি। সুজাতার বিয়ে, বর প্রবাসী। আমেরিকায় থাকে। বিয়ের পূর্বেই অর্থাৎ এনগেজমেন্টের পরপরই সুজাতার প্রয়োজনীয় সব পেপারস দূতাবাসে জমা দেওয়া হয়েছিল। তাই বিয়ের পরই সে ভিসার জন্য দূতাবাসে দাঁড়াবে। ভিসা পেলেই চলে যাবে। তাই আমি যেন শেষবারের মতো দেখতে আসি। মার ফোন পেয়ে আমি তো হতভম্ব। আমার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত যেন নিচে গড়াতে থাকল, পা দুটো অবশ লাগতে লাগল। কীভাবে যে কয়েকদিন পার করেছিলাম আমি বলে বুঝাতে পারবো না। আমি বাড়ী যাবো না বলেই মনস্থির করলাম। নিজের হাতে সীতা বিসর্জন করার সাহস আমার ছিল না। আমি পালিয়েই রইলাম।

সুজাতা দেশে এসেছে। এর মাঝে আরো কয়েকবার সে এসেছিল। আমি সামনে যাই নি। যখনই ওর কথা উঠে ঘড়ির কাঁটার টিক টিক শব্দের মত আমার বুকের হাতুড়ি পেটাও বিরামহীনভাবে চলে। ওর সামনে দাঁড়ানোর সাহস আমার হয় নি। কিন্ত এইবার এড়ানোর সুযোগ নেই। চাচীর শরীর খারাপের খবর শুনে সে এসেছে। আজ সকালেই চাচীর মৃত্যুর সংবাদ শুনলাম। তাই বাড়ী যেতেই হবে। যেতে যেতে কতো টুকরো টুকরো স্মৃতি যে মনের মধ্যে ভেসে উঠতে লাগল!

বাড়ী ভর্তি লোকজনের মধ্যে আমার দু’চোখ খুঁজে বেড়াতে লাগল সেই মুখটি। কী জানি মধ্যবয়সী রমণীর মুখে আমি আমার সেই সুজাতার মুখ খুঁজে পাব কীনা। কিছুক্ষণ পরেই প্রতীক্ষার অবসান হলো। সুজাতা আমায় ডেকে পাঠালো। আমি ঘরে ঢুকেই থ মেরে গেলাম। একী দেখছি! সুজাতা এখনো বিশ বছরেই আটকে আছে! আমার কল্পনার সুজাতা এখনো সেইরকমই আছে! চমক ভাঙলো সুজাতার ডাকে। পঁয়তাল্লিশ বছরের সুজাতার মুখশ্রী অবিকল চাচীর চেহারা। একটু আগে যাকে দেখে চমকিত হয়েছিলাম সে সুজাতার মেয়ে সিফাত। এই সুজাতাকে দেখে আমার মনের গভীরে সুরক্ষিত সুজাতার কিছুই মিল খুঁজে পেলাম না। একটু মুটিয়ে গেছে, মাথার সামনের দিকের চুলগুলো পাতলা হয়ে এসেছে। এই প্রথম আমার বুকের ভেতরের হাতুড়িটাকে চুপচাপ থাকতে দেখলাম। সুজাতা তার মেয়ে সিফাতকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। সিফাত পুরোই আমার কল্পনার সুজাতার কপি শুধু চুলটা আধুনিক ছাঁচে ছাঁটা। আমাকে সালাম দিয়ে পাশে এসে বসল। আমি সুজাতাকে দেখছিলাম আড়চোখে।

আশ্চর্য! এই প্রথম আমার বুকের ভেতরের হাতুড়ি যেন চিরনিদ্রায় শায়িত হল, চেষ্টা করেও এর কোন অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম না।

বুঝলাম – সুজাতার সাথে আমার দেখা না হলেই ভাল হতো। এতোদিনের সঙ্গীটাকে আর হারাতে হতো না।

সানিয়া আজাদ। গল্পকার।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

দৌড়

দৌড়

একবার এক দৌড় প্রতিযোগিতায় কেনিয়ার হয়ে দৌড়চ্ছিলেন আবেল মুতাই। খুবই ভালো দৌড়াচ্ছিলেন তিনি। সবাইকে পেছনে…..