নিঃসঙ্গতা

ফারজানা নীলা
গল্প
Bengali
নিঃসঙ্গতা

“কেমন আছো?

“তুমি চিনতে পেরেছ আমাকে?

“তুমিও চিনতে পেরেছ”

“আমার চেনা উচিত হয় নি, কিন্তু চিনেই ফেললাম”

এ কথা শুনে  জয়ের চেহারা মলিন দেখায়।  মলিন চেহারা দেখে আমার একটু আনন্দ হয়। নিস্তব্ধতা ভেঙে সঙ্কোচে আড়ষ্টতার সাথে সে’ই বলে “ চলো কোথাও বসি। যদি তাড়া না থাকে তোমার,  বসবে? চোখে মুখে আকুলতা উপচে পড়ে তাঁর।   তাঁর  আহ্বানে আমার সাড়া দিতে ইচ্ছে করে।কিন্তু বলি উল্টোটা, “ যেতে হবে, কাজ আছে”

শুনে মুখ কাল হয় জয়ের। তাঁকে আমি ভাঙতে দেখি। যা আমাকে সুখ দেয়।

“ফোন নাম্বার রাখো, যদি কখনো ইচ্ছে করে ফোন দিয়ো”

আমি ফোন নাম্বার নেই। কিন্তু আমারটি দেই না। আমার ইচ্ছের উপরে নির্ভর করবে তাঁকে ফোন দেওয়া।

আজ বিকেলে একটি শপিং মলে হঠাৎ আমি থমকে গিয়েছিলাম। আমার সামনে অন্যজনও থমকে গিয়েছিল। জয়,  এগিয়ে এসে প্রথম কথা বলে। এত বছর পর সে আমাকে চিনতে পেরেছে, আমিও তাঁকে চিনতে পেরেছি। তাঁর  আওয়াজ শুনতে পেরে আমার ভেতরে ঝড় বয়ে যায়। ক্রমান্বয়ে ভাঙতে থাকি। অনেক কষ্ট করে নিজেকে খুব শক্ত রাখি।

ইদানিং অফিসে আমি অলস ভাবে সময় কাটাতে থাকি। কোন কাজেই মন দিচ্ছি না। অনেকেই এসে জানতে চায় শরীর খারাপ কিনা। যতটা না জানতে চায় তার চেয়ে বেশি দেখতে আসে আমাকে। যাদের কারো কারো দিনে একবার আমাকে না দেখলে রাতে ঘুম হয় না। আমি ভেতরে ভেতরে হাসি। তাদের জন্য হাসি ছাড়া আমার দেওয়ার কিছু থাকে না। তাদের সঙ্গ আমার ভালো লাগে না। যতটুকু কাজের জন্য দেওয়া প্রয়োজন সেটা ছাড়া আমি খুব কৌশলে তাদের এড়িয়ে যাই। তাদের আমাকে নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ। কেন আমি বিয়ে করি নি? কেন আমি একা থাকি ইত্যাদি ইত্যাদি। সব প্রশ্নের একটাই উত্তর। হাসি। যা পেয়ে সবাইকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। এদের মধ্যে সবাই যে ওই একটি চিরাচরিত উদ্দেশ্য নিয়ে আমার কাছে আসে তা কিন্তু না। কেউ আসে যাদের চোখে  সত্যি আমার জন্য অনুভূতি দেখি। মাঝে মাঝে আমার এটা ভালো লাগে। ইচ্ছে করে আমারও ভেতরে কোন অনুভূতি জেগে উঠুক। কারো জন্য একটু উন্মাদ হই। রক্তে হাহাকার দেখা দিক। কাউকে দেখে বুকের কম্পন বেড়ে যাক। কাউকে খুব কাছে পাওয়ার জন্য শরীরে আগুন জ্বলুক। কিন্তু আমি পারি না। নয় বছর ধরে আমি কারো জন্য অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারি নি। কারো জন্য আমার ভেতরে অস্থিরতা জাগে নি। তবে মাঝে মাঝে শরীরে অস্থিরতা জেগেছে। তবে সেটা নির্দিষ্ট কোন পুরুষের জন্য না। সহজাত প্রবৃত্তির অংশ হিসেবে আমার শরীরেও কামনা জাগে। অনেকবার ভেবেছি এই কামনা কোন পুরুষ দিয়েই  নিবারণ  করবো। কিন্তু প্রতিবারই আমি ব্যর্থ হয়েছি। কোন পুরুষের কাছে আমি পা বাড়াতে পারি নি। মনের অনুভূতি জাগাতে পারি নি বলে শরীরটাকে কাউকে দিতে পারি নি। অগত্য নিজেকে দিয়েই নিবারন করতে হয়

অফিসের একটি ফোন করতে গিয়ে হঠাৎ জয়ের নাম্বারে চোখ আঁটকে যায়। কিছুক্ষণের জন্য বুক আমার থেমে যায়। এখনো এই নামটি দেখলে আমি অস্বাভাবিক হই? আশ্চর্য, এতো বছর আমি তাঁকে নিয়ে ভাবি নি। কখনো তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টাও করি নি। পরিপূর্ণ ভাবে তাঁকে আমি ত্যাগ করেছিলাম। কখনো এও ভাবি নি সে থাকলে আমি সুখি হতাম, সে থাকলে জীবন পূর্ণ হতো। ছেড়ে যাওয়ার পর আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তাঁকে নিয়ে কখনো আক্ষেপ করবো না। এই জীবন আমার। সম্পূর্ণ ভাবে আমার। একে আমি আমার নিজের ইচ্ছের মতো সাজাব, গড়বো, পরিবর্তন করবো। এই প্রতিজ্ঞার একদিনও নড়চড় হয় নি।

শুধু প্রথম তিন মাস আমি মৃত ছিলাম। রক্ত মাংসের শরীরে আমি জীবন্ত লাশ ছিলাম। আমার স্বাভাবিক কোন অনুভূতি কাজ করতো না। শুধু বুকে এক তীব্র ব্যথা অনুভব করতাম। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হতো। স্থির হয়ে থাকা কাকে বলে ভুলে গিয়েছিলাম। অবিরত তার ফিরে আসার অপেক্ষায় আমি ভয়ংকর রকমের অস্থির হয়ে থাকতাম। রাতে আমি ঘুমাতে পারতাম না। একটু তন্দ্রা আসলেই আহত পশুর মতো গোঙাতে থাকতাম। বুক ফেটে যেতো। সন্ধ্যেবেলায় নিঃশব্দে নির্মম আর্তনাদ করতাম।

অবশেষে আমি নিজেই উঠে দাঁড়াই। কারো সাহায্য আমি নেই নি। শুধু নিজেকে একটি প্রশ্নই করি, “ যে আমাকে কোন কারণ ছাড়া কিছু না বলে চলে যেতে পারে তার ফিরে আসার জন্য কেন অপেক্ষা ? যে আমাকে কোন অপরাধ ছাড়াই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে তার জন্য কেন হাহাকার?
সেই থেকে আমি নিজেকে গড়ে তুলতে শুরু করি। সম্পূর্ণ মনোযোগ থাকে আমার স্বাবলম্বী হওয়াতে। উঠে পড়ে রাত দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমি এমন অবস্থান তৈরি করি যেখানে আমার একটি শক্ত পরিচয় থাকে, সাথে থাকে কিছু ক্ষমতা। একটি জীবন চেয়েছিলাম  যেখানে আমার স্বাধীনতায় কেউ কখনো কোন রকমের হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। কাউকে আমার জীবনের অংশ বানাবো না। আমি শুধু নিজেকে নিয়েই বাঁচবো।  এর জন্য সবচেয়ে কষ্ট দেই আমার মাকে। তার কোন কান্না কোন অনুনয় আমাকে গলাতে পারে নি। আমার একটাই জবাব ছিল তাঁকে দেওয়ার মতো “ আমার জীবনে এমন কোন অভাব নেই যা পূরণের জন্য আমাকে বিয়ে করতে হবে”

একটা সময় আমি একা থাকতে চাইতাম। সেই চাওয়াটা এতই প্রবল ছিল আজ আমি সত্যি একা থাকি। আমার আশেপাশে কোন আপন মানুষ নেই। যারা আছে তাদের আমি পরিচিত বলতে পারি, আপন নয়। নিজেকে সবকিছু থেকে এতই গুটিয়ে নিয়েছি যে আজ আমার বন্ধু বলেও কেউ নেই। আমার যে বন্ধু ছিল না তাও কিন্তু না, এক সময় সবই ছিল, বন্ধু আড্ডা, উচ্ছলতা প্রানবন্ততা সজীবতা উদ্যমতা আবেগ ভালোবাসা । খুব সাধারণ ছিল না চিন্তা ভাবনা। আট দশ জন থেকে আলাদাই ছিলাম। বাকিরা যা চায় আমি তা খুব কমই চাইতাম। সবচেয়ে বড় চাওয়া ছিল স্বাধীনতা। মুক্ত হতে চেয়েছিলাম, উড়তে চেয়েছিলাম, দূরে যেতে চেয়েছিলাম, আবার কাছেও আসতে চেয়েছিলাম। কাছে আসা ছাড়া বাকি সবই করতে পেরেছি।

সমাজের ভয়ংকর দৃষ্টিও ছিল আমার উপর। নারী শব্দটির সাথে স্বাধীনতা যে যায় না। নারী কখনো একা থাকতে পারে না। তার স্বামী লাগে, সন্তান লাগে। একটি সংসার লাগে। এসব ছাড়া নারী অপ্রয়োজনীয়। এসব ছাড়া নারী অসম্পূর্ণ। এসব ছাড়া নারী মূল্যহীন। কিন্তু আমি জানতাম আমি মানুষ। আমার একটি আলাদা স্বতন্ত্র সত্ত্বা আছে। যে সত্ত্বার জন্য স্বামী সংসার সন্তান মুখ্য নয়। এসব ছাড়াও জীবন সম্ভব, সুন্দর, সাবলীল, সক্রিয় এবং উপভোগ্য।

প্রতিটি ধাপে আমার জন্য প্রশ্ন ছিল। চেনা জানা সুসম্পর্কীয় দূসম্পর্কীয় কাছের দূরের আত্মীয়,পাশের বাসার বৃদ্ধ বৃদ্ধা, নিচের তলার আঙ্কেল, মুদির দোকানদার, মুরগিওয়ালা, মাছওয়ালা, বাসার দারোয়ান সবার একই প্রশ্ন। আমারও দুটি উত্তর। এক আমার হাসি, দুই আমার পেশাগত পরিচয়। দ্বিতীয়টার জন্যই আমি এদের সবাইকে অতিক্রম করতে পেরেছি। অতিক্রম আমাকে এখনো করতে হয়। আমৃত্যু হয়তো আমাকে অতিক্রম করেই যেতে হবে।

বিভিন্ন বাক্যবাণ যখন আমাকে জর্জরিত করতে পারে নি তখন আমার মাকে জর্জরিত করেছে। মাকে এসব থেকে মুক্তি দিতেই অনেকটা জোর করেই ভাইয়ার কাছে কানাডায় পাঠিয়ে দিলাম। আমি রয়ে গেলাম একা। সম্পূর্ণ একা।

সেইদিন সেই শপিংমল থেকে আসার পর আমার ইচ্ছে করে নি জয়ের সাথে যোগাযোগ করতে। আজ ইচ্ছে করছে তাঁকে ফোন দিতে। আমি ইচ্ছেটি পূরণ করি। অপর পাশে আমি তীব্র খুশি অনুভব করি। সে হয়তো ভেবেছিল আমি তাঁকে ফোন করবো না। কথা বলার সময় আমার বুক কাঁপতে থাকে। নিজের হৃৎস্পন্দন নিজেই শুনতে থাকি।

 “ভাল?”

“এতদিন পর কল করতে ইচ্ছে করল শেষে?” উচ্ছ্বাস অপর পাশে।

“না করলে ভাল হত”

নিস্তব্ধতা অপর পাশে।

“রেখে দিবো?”

“না” আকুলতা অপর পাশে।

“চুপ করে আছ”

“কেমন আছ, তুমি?”

“বেশ আছি”

“হ্যাঁ তোমাকে দেখেই বুঝেছি, বেশ ভালই আছ” ক্ষীণ দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ পাই যেন অপর পাশ থেকে।

“খারাপ থাকবো আশা করেছিলে?”

“ না ঠিক তা না”

আমার ইচ্ছে করে ওর কাঁচুমাচু  মুখটি একবার দেখি।

“সন্ধ্যায় ব্যস্ত না থাকলে এসো আমার বাসায়, আবার দেখে যেও কেমন আছি আমি”

জয়ের কণ্ঠে খুশির চিৎকার শুনতে পাই। তাঁর অভাবিত কল্পনাকে সত্যি করে দিয়ে আমার সুখ লাগে।

অফিস ছুটির অনেক আগে আমি বাসায় ফিরে যাই। এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় বসি।  কয়েকটি ছন্নছাড়া গাছ কিছু মানুষ কয়েকটি বিল্ডিং দেখা যায়। অলসভাবে কিছু খুঁজতে থাকি। চোখে পড়ে এক দম্পতি। পুরুষটি বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচে তাকিয়ে আছে। নারীটি চা খাচ্ছে। আমি আমার পাশের খালি চেয়ারে তাকাই। এখানে এখন কেউ থাকলে কি আমি সুখি বোধ করতাম? কেউ যদি আমার পাশে বসে জিজ্ঞেস করতো কেমন আছি, ভালো লাগতো আমার? নাকি কেউ আমার দিকে না তাকিয়ে নিচে তাকিয়ে থাকতো তখন আমার কোন অনুভূতিই হতো না? যেমনটি এই নারীর হচ্ছে না। এই  যে আমি একা চেয়ারে বসে আছি এতে আমার এতো নিঃসঙ্গ লাগছে কেন? এই নিঃসঙ্গতার সাথে আমি বছরের পর বছর বসবাস করছি। এই নিঃসঙ্গতা আমার চিরচেনা। এই নিঃসঙ্গতার  চেয়ে  কি কারো উপস্থিতি বেশি উপভোগ্য  হতো? আমি বুঝতে পারি না। প্রশ্ন খুঁজতে থাকি।

আমি উঠে গোসল করি অনেক সময় নিয়ে। মরিয়ম, যে আমার বাসার সব কাজ করে দেয়। তাঁকে ডেকে কিছুক্ষণ কথা বলি।

“তোমার বাচ্চারা কেমন আছে?

“ভালো আছে আপা। ছোটটার জ্বর ভালো হইছে।

“বড়টা স্কুলে যায় ঠিক মতো?

“ জি আপা, ভালোই পড়াশুনা করতাছে”

“ ভালো, কিছু লাগলে চেয়ে নিয়ো।

ওকে আজ ছুটি দিয়ে দেই। জয় আসলে যেন শুধু আমি আর জয় ছাড়া তৃতীয় কোনও ব্যক্তি না থাকে। মরিয়ম চলে যাওয়ার পর একা ঘরে আমার নিঃস্ব লাগে। কয়েকদিন ধরে সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখ খুলতে ভয় লাগে। বস্তু ছাড়া কোনো প্রানের অস্তিত্ব খুঁজে পাই না রুম জুড়ে। একটি প্রাণের অভাব আমাকে ইদানীং তাড়া করে ফিরছে।  

জয় আসতে এখনও অনেক সময় বাকি। আমি মরিয়মের কথা ভাবি। তাঁর  একটি স্বামী আছে, দু’টি সন্তান আছে। স্বামীটি তাকে মারধোরও করে না। যখনই তাকে দেখি মুখে হাসি লেগে থাকে। দেখতে আমার ভালো লাগে। সুখি মানুষ আমাকে সুখি করে। নিজেকে আমি মরিয়মের জায়গায় কল্পনা করি। আমারও যদি একটি স্বামী থাকতো দুটি সন্তান থাকতো তবে কি আমিও মরিয়মের মতো সুখি হতাম? আমার মুখেও এমন হাসি লেগে থাকতো? এই নিঃসঙ্গতা তখন কি থাকতো না? এখন যেমন আছি, যখন যা খুশি করতে পারি , যেখানে খুশি যেতে পারি , কোন বাধা নেই, কোন পিছুটান নেই। সেটা কি স্বামী সন্তান দিয়ে পূরণ হয়ে যেতো?

 “আমি কি একটি স্বামীর অভাব বোধ করছি? সন্তানের অভাব বোধ করছি? মা হওয়ার সাধ জেগেছে? নয় মাস পেটের ভেতরে কোন মানুষের অস্তিত্ব অনুভব করতে ইচ্ছে করছে? যে নিঃসঙ্গতাকে আমি এতো বছর ধরে সঙ্গী করে রেখেছি তাকে কি এখন আর ভালো লাগে না? পুরনো হয়ে গেছে? নতুন কিছু চাই?

 আমি বুঝতে পারিনা। প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকি।

সন্ধ্যায় একটি নীল শাড়ি পরি। নীল জয়ের পছন্দের রঙ। সম্পূর্ণ ফাঁকা বাসায় আমি জয়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। বহুদিন পর আমি এমন উত্তেজনা অনুভব করি। আমার ভালো লাগে।

জয়কে দেখে আমি আগের মতই মুগ্ধ হচ্ছি, যেমনটা আগে তাঁকে দেখলে প্রতিবারই হতাম। আমার নয় বছর পুরনো অনুভূতি আবার আগের মতো নাড়া দিচ্ছে আমাকে, আমি এতেই বিহ্বল হয়ে পরি। যতটা সম্ভব আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকি। এই সময়কে আমার নয় বছর আগের সময় বলে মনে হয়। যেখানে আমার পুরো অস্তিত্ব জুড়ে শুধু জয়ই ছিল।

খাওয়া শেষে তাঁকে আমি আমার বেডরুমে নিয়ে যাই। আমি আর স্থির থাকতে পারিনা। জড়িয়ে ধরি তীব্র আবেগ দিয়ে। আমার পুরো শরীর কাঁপতে থাকে। এতো জোরে বুকে কম্পন বেড়ে যায়, যে মনে হচ্ছে এখনই বন্ধ হয়ে যাবে। তাঁকে আমার সবশক্তি দিয়ে ঝাপটে ধরি। আমার গাল বেয়ে জল গড়াতে থাকে। আমি বাধা দিইনা। অনেকদিন আমার চোখ শুকনো ছিল। আজ ভেজাতে ইচ্ছে করছে। এতো বছরের জল আজ সব বের হয়ে যাক।

জয়ের বাহুবন্ধনে আমি যখন মুষড়ে ছিলাম তখনই সে বলে উঠে,

“আমার তোমাকে কিছু কথা বলা উচিত”

“আমার শোনা উচিত না”

“প্লীজ আমাকে বলতে দাও, কেন আমি চলে গিয়েছিলাম”

“আমি এখন শুনতে চাই না, সেই সময় আমি পার করে এসেছি”

“আমি দুই সপ্তাহ পর জাপান চলে যাবো, ওখানেই থাকি আমি। দেশে এসেছি তিন মাস। প্লীজ আমাকে বলতে দাও কেন এমন করেছিলাম। ক্ষমা চাইতে দাও”

“আমি অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি”

“তবুও…

আমি তড়িৎ বেগে জয়ের ঠোঁটে চুমু বসিয়ে দেই। দুজনের নিঃশ্বাসের ভারী আওয়াজ ছাড়া পুরো রুম জুড়ে আর কিছু থাকে না। আমরা উন্মাদ হয়ে যাই। আদিম উন্মাদনায় একে অপরের ভেতরে ডুবে যাই।

অনেকদিন পর একটি সকাল আমি পাই যখন আমি চোখ খুলে ভয় পাই না। আগের মতো সব কিছু পরিচিত মনে হয়। আমি ভেতরে সুখ অনুভব করতে থাকি। চঞ্চল হতে থাকি। জয় ঘুম ভেঙে বের হওয়ার আগ পর্যন্ত অনেকভাবেই কিছু বলতে চায়। আমি কোন সুযোগ দেই নি তাঁকে। আমার কিছু শুনার দরকার নেই। কোন কারণ জানার প্রয়োজন নেই । কেন ছেড়ে গেছে সে, বিয়ে করেছে কিনা বাচ্চা আছে কিনা, কিছুই আমার জানার যোগ্য না। কোন কারণ আমার জীবনকে পরিবর্তন করতে পারবে না আর। যে রূপে একে সাজিয়েছি সেই রূপ থেকে বের হতে চাই না। জয়কেও আমি সব সময়ের জন্য চাই না। সে এসেছিলো কিছু মুহূর্তের জন্য। সেই মুহূর্ত উপভোগ্য ছিল, আনন্দদায়ক ছিল, সুখকর ছিল, অকল্পনীয় ছিল। জীবনে কিছু স্মৃতি দরকার যা বহন করতে ইচ্ছে করবে আজীবন। গতরাতে আমি তেমনি একটি স্মৃতি পেয়েছি। এর চেয়ে বেশি আমি চাই না।

জয়কে নামিয়ে দিয়ে আমি অফিসের জন্য রওনা দেই। ওর চেহারা দেখে বুঝছি ও ভেতরে বিধ্বস্ত । হাহাকার করছে, কিছু একটা ভেঙে গেছে তাঁর। কীসের আঘাতে যেন সে কষ্ট পাচ্ছে। তাঁর করুণ মলিন অপরাধীর মতো চেহারা দেখে আমি কষ্ট পাই। কিন্তু আমার করার কিছুই থাকে না। আমি গাড়ি চালিয়ে দূরে সরে যাই। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ভেতরটা আমার হীম হয়ে মুষড়ে যায়।

এরপর জয় অনেকবার ফোন করেছে। ধরি নি। জাপান যাওয়ার দিনে সে একটি এসএমএস পাঠায়। চলে যাচ্ছে সে। আমি ফোন করি তাঁকে।

“ভালো থেকো। তোমার প্রতি কোন অভিযোগ নেই আমার”

“তোমাকে আমি এখনো ভালোবাসি” দোমড়ানো মোচড়ানো কণ্ঠ থেকে জয় বলে উঠে।

“আমিও বাসি” মুখ ফসকে বলে ফেললাম নাকি ইচ্ছে করেই বললাম বুঝি নি।

আর কিছু বলার বা বলতে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম না। সংক্ষেপে বলি- “রাখি”

চোখের কোণে একটু জল উঁকি দেয়। মুছে ফেলি। চোখের জল, সে যতই ধীরে পড়ুক আর দ্রুত, তাকে মুছে ফেললেই মিলে যায়।

ফারজানা নীলা। গল্পকার, নারী ও প্রাণি সংরক্ষণ অধিকারকর্মী।  

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..