নিজেকে উদযাপন করি

সাজ্জাদ সাঈফ
কবিতা, প্রবন্ধ
Bengali
নিজেকে উদযাপন করি

আমাকে বিব্রত করা তীব্র দুইটা বিষয় হইলো লেখক হিসেবে চিকিৎসাপেশার যাপন-সংঘাত আর সাহিত্যিক হিসেবে আমার ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে ঘোলা-পানিতে মাছ শিকারের প্রয়াসগুলি এবং তা ছাত্র বয়সে প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতির ইতিহাস থাকা সত্বেও।

চিকিৎসা ‘পেশা’ হিসেবে যে অনুধ্যান দাবী করে আমি এর কোনোটাকেই হেয় করে আগাইনি, এই সত্যের ভিতর দিয়েই আমি লেখালেখির সাধনযজ্ঞকে যাপনাংশ করার ঝুঁকিতে ধাবিত হয়েছি বরাবর আর ধর্মের বেলায় আমার পোশাকি ধর্ম ইসলাম আমাকে কখনোই সাম্প্রদায়িক বা গোড়া করে তুলতে পারে নাই আমার সচেতন ও সজ্ঞান প্রয়াসেই।

এইবার আসি ‘কি জন্য কবিতা লিখছি?’ প্রসঙ্গে-

এই প্রশ্নের মুখে পড়ে নাই এমন কবি বিশ্ব সাহিত্যেই নাই আসলে, সেই প্রেক্ষিত বিচারে আত্মদর্শনের বিষয় চলে আসে, চলে আসে আত্মতত্ত্বও। কবিতাকে আমি ব্যক্তিক দিক হতে প্রথমত পাঠ্য ও শ্রাব্য হিসেবেই দেখি আসলে, দৃশ্য হিসেবেও। সেই সৌন্দর্যপ্রয়াস হিসেবে কবিতাকে প্রেমের বহুদর্শী যৌবন মনে করেই এগিয়েছি আসলে। এই দর্শন সকলের সমান হবে তা ভাবি না বটে, এইদিক হতে ওয়াল্ট হুইটম্যানের ‘সং অফ মাইসেফ’  হতে আমাকে নিতে হয়েছে কিছু হাইপোথিসিস-

‘আমি নিজেকে উদযাপন করি এবং নিজেই গান করি,
এবং আমি যা অনুমান করি আপনি তা ধরে নেবেন,
ভালো প্রতিটি পরমাণু আমার হিসেবে আপনার জন্য।’

এই হলো আমার কবিতাকেন্দ্রভাব, যদি কবিতা না লিখি সে ক্ষেত্রে কি হবে আমি বরং সে-ই বলি কিছু উপায়ে…

না লিখে আমি স্নানের কথাও ভাবতে পারিনি শুরু অব্দি, যে স্নান আনে সতেজতা। না লিখে আমি নিজেকে প্রকাশ করতে জানি না যেমন ঠিক তেমন জানি না নিজেকে বাস্তবজন্ম ও স্মৃতি-প্রবঞ্চনা হতে লুকোতেও। যদি না লিখি, কবিতা আমাকে মাটিচাপা নিঃশেষবোধে তাড়া করে আসলে, তাড়া করে আত্মবিস্মরণের ব্যথা…

একইভাবে কবিতা পড়াটাও। জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ সাহিত্যের ছাত্রও ছিলেন যা তাঁদের কাজের কন্টিনিউটিকে ইম্প্রেস করেছে, এই জায়গাটা কো-ইনসিডেন্ট হলেও ভাষার প্রতি মমত্ব আসলে স্বতঃপ্রণোদিতই, আর যেমন আর সব কবির রকম সকম। ওই যে বললাম কবিতাকে প্রথমতঃ দৃশ্য-শ্রাব্য-পাঠ্য হিসেবেই দেখে আসছি বরাবর। পড়তেই ভালো লাগা হেতু ফার্স্ট প্রায়োরিটি হিসেবে কবিতার চেয়ে বিজ্ঞান ও ইতিহাসই পছন্দ যদিও, কবিতা পড়বার সময় আমি নিজেকে বোধ করি অনন্যোপায়।

আদর্শবোধের দিক হতেও সমাজকর্মীর বোধকে প্রশ্রয় দিই নিজের ভিতরে, প্রায় সবাই একমত হবেন আমরা চলমান সময়ে আদর্শহীন অনুষঙ্গে আসক্ত জনপদ দেখে যাচ্ছি দিনকে দিন, একেও ব্যক্তিক ক্ষরণের জায়গা হিসেবেই দেখতে আমাকে কবিতা-ই ইনসিস্ট করে, পাঠ্য হয়ে, লেখ্য হয়েও। আপাতত এ-ই আমার সাথে কবিতার সম্পর্কের মোদ্দাকথা।

প্রসঙ্গত বলি-

‘যে কোনো কবির কবিতায় মুখ্য উৎস তাঁর নিজেরই জীবন, কোনো কবিই তাঁর সমকাল-সমকালীন রাজ-সমাজ-আর্থ ঘটনা ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকতে পারেন না, না-চিন্তায় এবং লেখায়’

পঞ্চাশের পরে – ওমর শামস

একজন কবি কেন কবিতা লেখেন? এই প্রশ্নের অনেক উত্তরই রয়েছে, তবে উত্তর তো বক্তব্যমাত্র, আর সেই বক্তব্যের সমান জোরালো প্রভাবক হলো কবি/লেখকের নিজ জীবনের সারাৎসার, নিজ সময়ের বহমান বাস্তবতা, চিন্তার বহুরৈখিক ছাপ। আর আমি লিখি আমাকেই বের করে আনতে জাগতিক শৃঙ্খল হতে, জাতীয়তাবাদের তীব্র সংগ্রামের আপাত সাফল্যের পর সমগ্র দুনিয়া প্রতিরক্ষা ও নয়া উপনিবেশের নামে নয়া যে ফ্যাসিবাদে ব্যতিব্যস্ত এর ছোবল হতে গোটা দুনিয়াতেই মজদুরেরা আরো নেমে যাচ্ছে দারিদ্রসীমার এবং বণিকেরা আরো বেশি লুটেরা হচ্ছে এমনকি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, অর্থনীতি, আইনব্যবস্থা সমস্তকেই জিম্মি করে। আর সারা দুনিয়াতে আমরা এমন কোনো লেখককে দেখাতে পারি না যিনি এই পরিস্থিতি হতে মুক্ত।

শিল্পে যত নন্দনকলার প্রসারই ঘটুক না কেনো এতে করে গণমানুষের পক্ষে স্পষ্ট কোনো শিল্প ধারণা অনুপস্থিত, যারপরনাই আমি সত্যি লেখকসমাজের আত্মম্ভরিতাকে ঘৃণা ও তিরস্কার করি এবং তাদের স্রেফ আত্মকেন্দ্রিক নন্দনের ঘোর বিরোধী। অত্র লেখার শুরুতে ফিরে যেতে হচ্ছে প্রাসঙিকভাবেই। যারা বঙ্গদেশে শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত নিজের প্রতিষ্ঠা নিয়ে ও নিজ নিজ গোষ্ঠীকেও এইরূপ ব্যস্ততায় অভ্যস্ত করার পক্ষে, আমার লেখার সমস্ত সদিচ্ছাই তাদের গাত্রদাহেরও কারণ বিধায় অসাম্প্রদায়িক-মানবিক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখাওয়ালাদের দ্বারা নিজ নিজ গ্রুপিং-সুবিধা আদায় করতে না পারার আক্রোশেই তাদের সমস্ত প্রোপাগান্ডা। এসব কার্যকলাপ আমার চিন্তাতেই আসে নাই বা আনতে পারি নাই বিধায় মাটি ও মানুষ নিয়েই লেখায় অনবরত থাকার উদ্দেশ্য আমার বহাল বিগত প্রায় দুই যুগ হতেই।

মোটকথা যা দাঁড়ালো তা সংক্ষেপে এই যে আমি ব্যাকডেটেড উপায়েই মাটিগন্ধী কিছু লেখার স্বীয় প্রলোভনে সহস্র চড়াই উৎরাই মোকাবিলা করে মাটিতেই আছি, মানুষেই আছি, সৃজন-প্রয়াসে আছি। লিখছি। একাকী। একান্তে।

সাজ্জাদ সাঈফ। কবি ও চিকিৎসক। জন্ম- জুন ১৯৮৪, বাংলাদেশের ঢাকায়। পেশাগত জীবনে তিনি সাইকিয়াট্রিক অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাবিউজ ম্যানেজমেন্ট ফিজিশিয়ান। পাশাপাশি সম্পাদনা করেন 'নীহারিকা' (রম্যপত্রিকা) 'ঈক্ষণ' (ছোট কাগজ), 'ক্ষেপচুরিয়াস ওয়েবজিন' (সহ-সম্পাদক)। তিনি 'কবি নেবে যীশুর যন্ত্রণা' কাব্যগ্রন্থের জন্য বঙ্গভূমি বর্ষসেরা কবি-২০১৯ সম্মানে...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ঝরা পাতা

ঝরা পাতা

  চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..