প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
বিগতযৌবনা, স্থূলকায় কবি-পত্নীর বর্তমান চেহারার সাথে তার যৌবনের ছবিগুলি বার বার মিলিয়ে দেখছিলাম আমি। আমার বিশ্বাস করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল ছবির এই ছিপছিপে, দীঘল-কেশী, আকর্ষণীয় তরুণীটি আমার সামনে বসে আছেন তার বিশাল, ক্রমবর্ধমান শরীর আর অনুজ্জ্বল অপ্রতিভ চেহারা নিয়ে। তার প্রায় সাদা হয়ে আসা দীর্ঘ কেশের সামান্য অবশিষ্টগুলি একটা সরু ল্যাত ল্যাতে অবিন্যস্ত বেণী হয়ে ঝুলে আছে ছড়ানো পিঠের ওপর। ভারি ফ্রেমের চশমার আড়ালেও তার চোখদুটিতে আমি স্পষ্টত টের পাচ্ছি মহাকালের অবসাদ । বড় অকালে বুড়িয়েছেন তিনি।
আর দু’দিন বাদে বছর পেরুবে নিরুদ্দেশ হয়েছেন দেশের সেরা কবি। প্রথম দেড়-দুমাস খুব লম্ফ-ঝম্প করেছে দেশের পুলিসবিভাগ। তারপর আর সব চাঞ্চল্যকর খুন এবং গুমের ঘটনার মতোই কবির নিরুদ্দেশ হবার ঘটনার তদন্তও অমীমাংসিত কেস হিসেবে নথিবদ্ধ হয়ে পড়ে আছে, ধুলোর মিহি আস্তরণে ঢাকা পড়েছে ধূসর ফাইলটি। দেশের পত্র-পত্রিকাগুলির গোল্ডফিশের মত ক্ষণস্থায়ী স্মৃতিতেও বিস্মৃত হয়েছেন কবি।
দু’বছর হলো কাজ করছি একটা বাংলা দৈনিকে, গতকাল পত্রিকার সম্পাদক তার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হিমশীতল কক্ষটিতে ডেকে বরাবরের মতই অনেকটা ফিস ফিস করে বললেন, যাও তো ভাই, কবি-পত্নীর একটা সাক্ষাৎকার করে আনো, কবির নিরুদ্দেশ হবার একবছর পূর্তিতে ছাপতে হবে। তার গলার স্বর, শরীরের অঙ্গ-ভঙ্গি, বলবার ধরন দেখে মনে হলো যেন বা কোন গোপন, অশালীন, অপরিচ্ছন্ন কাজের ভার চাপাচ্ছেন আমার ওপর। কেমন একটা অশ্লীল, কুৎসিত, অসভ্য আনন্দে চক চক করছিলো তার কুতকুতে ধূর্ত চোখ দু’টি। আমি বেরিয়ে আসার আগমুহূর্তে পেছন থেকে ডেকে একটা চোখ টিপে দিয়ে বললেন, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, রাজনীতি, সামাজিক অবস্থা, অবৈধ প্রেম সবকিছু মিলিয়ে টিলিয়ে বেশ জমজমাট একটা জিনিশ চাই কিন্তু, আমার!
শীতল, নিস্তব্ধ, অন্ধকার বাড়িটিতে এসেছি অনেকক্ষণ। কবি-পত্নীর সাথে ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম কবির পড়ার ঘর, লেখার টেবিল, পুরণো আমলের ইজি চেয়ার, দেয়ালে ঝোলানো ছবি, অপ্রকাশিত কবিতার পাণ্ডুলিপি। কবিতা আমার কোনদিন ভাল লাগেনি। দু’চারবার চেষ্টা করে পরে আর কখনো করিনি। কিন্তু আজ এখানে দেশের সেরা কবির কবিতাময় ঘরগুলিতে হাঁটছি, ঘুরছি, দেখছি আর আমার মস্তিষ্কের নিউরনগুলিতে খুব করে জেঁকে বসছিল, একটিমাত্র শব্দ – কবিতা। তিনি হাঁটছিলেন, কথা বলছিলেন, খানিকটা থেমে আবারো বলছিলেন। তার একঘেয়ে, ধীর লয়ের, একটানা বর্ণনা ঘরের জমাট বাতাসের সাথে মিশে একরকমের অশরীরি গাম্ভীর্যে মুড়িয়ে রেখেছে চারপাশ। এবার তিনি একটা লম্বা সময়ের বিরতি নিলেন। তার যৌবনের সৌন্দর্যের প্রামাণ্য দলিল একটা পুরণো, মলিন ছবির অ্যালবাম আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে উঠে গিয়েছিলেন অন্য কোনো ঘরে, একটা ট্রেতে করে দু’কাপ চা নিয়ে এসে আবারো শুরু করলেন।
“সে ছিল ঝকঝকে, প্রাণোচ্ছল, তেজোদৃপ্ত এক তরুণ। সমকালীন রাজনীতি নিয়ে তার আগ্রহের সীমা ছিলোনা। আমি তাকে দেখতাম মিছিলে, প্রতিবাদে, জনসভায়, তার বলিষ্ঠ কণ্ঠের ভাষণ শুনে শুনে এক-একদিন আমি নেশাচ্ছন্ন হয়ে পড়তাম। সে কবিতা লিখতো, কবিতা পড়তো। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বছরেই আমরা একে অপরের প্রেমে পড়ি। আমি প্রেমে পড়ি ওর গভীর কালো চোখ দুটির, ওর ভরাট কণ্ঠের, ওর চারপাশ সচকিত করা অট্টহাসির আর ওর কবিতার।একেকদিন ওর ভরাট কণ্ঠের কবিতা শুনতে শুনতে আমার বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতো, বলা নেই কওয়া নেই রাত্রি এসে হানা দিতো সন্তর্পণে। আর ও ভালোবাসতো আমার দীর্ঘ কেশ, উজ্জ্বল ত্বক আর ওর প্রতি আমার অপরিসীম, অবিরাম মুগ্ধতাকে। কলেজে ওর চাকরিটা হতেই বিয়ে করে ঘর বাঁধলাম আমরা।”
একটু থেমে আবার শুরু করলেন, “হ্যাঁ, বিয়ের পর এক ছাদের নীচে আমরা কাটিয়েছি দীর্ঘ সতেরটি বছর। আমাদের কোন সন্তান হয়নি, আমি সন্তান ধারণে অক্ষম ছিলাম। কিন্তু আমাদের দুজনের কেউই কখনো একটি সন্তানের অভাব অনুভব করিনি। যদিও একটা সময় আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়লাম, নিরুত্তাপ দাম্পত্য আর নিয়ম মাফিক যৌনতায়। তবুও আমরা বোধ হয় ভালোই ছিলাম। হ্যাঁ, নির্ঘাত ভালো ছিলাম। আমি ওকে নিয়ে আর ও কবিতা নিয়ে।” তারা সত্যি ভালো ছিলেন কীনা সেই বিষয়ে একটুখানি সন্দেহ তার কণ্ঠে, দৃষ্টিতে আমি লক্ষ করলাম, নিমিষেই সেটা কোথায় মিলিয়ে গেলো। কিন্তু এবার আমার সন্দেহ হলো, তবে কী নিরুত্তাপ একঘেঁয়ে দাম্পত্য, একটি সন্তানের আকুতি, বিগতা যৌবনা অনাকর্ষণীয় স্ত্রী এগুলোই কবির নিরুদ্দেশ হবার পেছনের কারণ? তিনি স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছেন কোন অচেনা শহরে, অজানা জনপদে- গোপনে ঘর বেঁধেছেন কোন চিরযৌবনা তরুণীর সাথে আর ক্লান্তিহীন রতিক্রিয়ায় মগ্ন হয়ে আছেন একটি স্বাস্থ্যবান, হাস্যোজ্জ্বল শিশুর পিতা হবার আশায়।
আমার অর্বাচীন লাগাম ছাড়া ভাবনার রেশ টেনে দিয়ে আবার শুরু করলেন, একটু আগে যেখানে থেমেছিলেন সেখান থেকে, ঠাণ্ডা নির্লিপ্ত নিরাবেগ কণ্ঠে। এবার তার সম্বোধনে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ করলাম।
“তিনি ছিলেন এক মহান কবি। অর্থ, সাফল্য, স্বীকৃতির পেছনে ছুটতে দেখিনি আমি তাকে কোনদিন। তার কবিতার বইগুলি প্রকাশিত হয়েছিলো আমারই ইচ্ছায়, উদ্যোগে। দেশের সেরা কবির তকমা নিয়েও তিনি ছিলেন বৃক্ষের মতো স্থবির, অচঞ্চল আর নিরাসক্ত। তার প্রথম প্রেম কবিতা, দ্বিতীয় প্রেম আমি আর এর পর তৃতীয় কেউ তার জীবনে আসেনি, সেভাবেই জেনেছি আমি।”
একটু থেমে আবার শুরু করলেন, “স্বার্থের রাজনীতি, দলাদলি, কোন্দল, ভক্ত-অনুসারীদের পদস্খলন, সতীর্থদের বিশ্বাসঘাতকতা- তিনি আর পেরে উঠছিলেন না। সেই অস্থির সময়ে একমাত্র কবিতাই ছিলো তার বাঁচার প্রেরণা। রাজনীতি থেকে সরে এলেন, দীর্ঘ দিনের ভক্ত সাথীদের থেকেও আলাদা হয়ে নিজেকে-আবদ্ধ করলেন চার দেয়ালের মাঝে। প্রেম, প্রকৃতি, বিপ্লব আর বিদ্রোহে আর বেশী শাণিত, ক্ষুরধার হলো তার পঙক্তিমালা। আর সহস্র বছর অপেক্ষা করে থাকলেন তিনি জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতাটি লিখবার জন্য।”
“নিরুদ্দেশ হবার ক’মাস আগে তিনি পাহাড়ে গিয়েছিলেন, একাকী। এরকম তিনি যেতেন, কখনো-সখনো। ফিরে এলেন তপ্ত শরীর আর শীতল রক্তাভ একজোড়া চোখ নিয়ে। দীর্ঘ জ্বরে একবারের জন্যেও তাকে প্রলাপ বকতে শুনিনি আমি। সুস্থ হবার পর আবার লিখতে বসলেন। কিন্তু তার লেখার টেবিলের চারপাশে জমতে থাকে ডায়েরির ছেড়া পাতা, সেগুলো ভরা থাকতো এলোমেলো শব্দ আর অগোছালো লাইনে, তার লেখা একটিও নতুন কবিতা আমি পড়িনি, আর কোনদিন।
কবিতা লিখতে না পারার অসহ্য যন্ত্রণায় তাকে আমি বোবা পশুদের মতো গোঙাতে দেখেছি, এক-একটি দীর্ঘ রাত তিনি কাটিয়ে দিতেন- একাকী বারান্দায় বসে, পোড়া সিগারেটের অসমাপ্ত টুকরোগুলি সাক্ষী হয়ে থাকতো তার নির্ঘুম নিঃসঙ্গ রাত আর লিখতে না পারার অব্যক্ত যন্ত্রণার। কোন অযৌক্তিক ভয় কিংবা ক্ষণিক স্খলনের অনুতাপ বা কোন অপারগতা নাকি সম্পুর্ণ ভিন্ন কিছু ছিল সেই যন্ত্রণার উৎস – আমার জানা হয়ে ওঠেনি। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে কিছু যেন বলতে চাইতেন আমাকে, আবার কী ভেবে চুপ হয়ে যেতেন। এরপর একদিন মাঝ রাতে স্লিপিং পিলের নিশ্চিন্ত আচ্ছন্নতা থেকে জাগিয়ে তুললেন আমাকে” – আচমকা থেমে গেলেন কবি-পত্নী।
আমার ভেতরে একটা অসহ্য, উৎকট কৌতূহল শেষটুকু জানবার জন্য। আমাকে বুঝতে পেরেই তিনি আবার শুরু করলেন –
“সেদিন মাঝরাতে আমাকে জাগিয়ে কবি বললেন, কবিতা আমাকে ছেড়ে গেছে, আমি বুঝি আর কোনদিনও একটিও কবিতা লিখতে পারবো না- আর কী যেন বলতে গিয়ে আচমকাই থেমে গেলেন। পুরণো আমলের সিলিং ফ্যানের ঘটাং ঘটাং আওয়াজ তার নীরবতাকে আরও বেশী বাঙময় করে তুললো। আর পরদিন তিনি নিরুদ্দেশ হলেন, তার অন্তর্ধানের প্রকৃত কারণ আমার অজানাই থেকে গেলো।”
কবির নিরুদ্দেশ হবার একবছর পূর্তিতে প্রকাশিত কবি-পত্নীর সাক্ষাৎকারটি চারদিকে বেশ আলোড়ন তুললো। সেই হলদে সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্র, সমাজ,রাজনীতি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, অবৈধ প্রেম, কষ্ট কল্পিত অন্তর্ধানের সম্ভাব্য কারণসমূহ – কোন উপাদানের ঘাটতি আছে – পাঠকের এ’জাতীয় অভিযোগ উত্থাপনের কোন অবকাশই রইলো না।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..