পাগল
চৌদ্দ পনেরো বছর আগের কথা; আমি বসে আছি একটি দোকানে, দোকানটি মূলত আমাদেরেই। দোকানের সামনে…..
তারপর শুধু নিস্তব্ধ হয়ে ওঠা বাকি ছিল। অমন ঘৃণার প্রবাহে চোখ আটকে গেলে, এইটুকুই ভেসে উঠতে পারতো মনে। উঠেছিলও তাই, তবে অনেকটা পরে। স্তম্ভিত হয়ে যাওয়া নিজেকে একটু সময় তো দিতেই হয়! ততক্ষণে একটা অকারণ হিমরাত্রি গ্রাস করতে শুরু করেছে চারপাশ। আর ভেসে উঠেছে, শেষের বিস্ময়চিহ্নটি। যেহেতু বিস্ময়কে নিয়েই যাবতীয় বিস্ময়! কেন-না রাগ, ক্ষোভ ইত্যাদি পরিচিত ও সহনীয় শত্রুর নাম। এমনকি ক্রোধও। আর যদি অভিমান হয়, সে তো আদতে বিষাদমধুর! এ-যাবৎ বিদ্রুপ ও উপহাসের ধারাবাহিকতায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠা ছিল। কিন্তু এইসব বিদ্বেষবাক্য! এমন ঘৃণার প্রাবল্য! এইসব আসলে যা, পরিভাষায় তার নাম ‘বিলো দ্য বেল্ট’। হ্যাঁ, আঘাতের কথাই বলছি।
বিদ্বেষের ডালপালা যেখানে এতটাই, সেখানে কোনো স্তোকবাক্য মানায় না। স্তুতিবাক্যও নয়। আশপাশে টুকরো-টাকরা ছড়িয়ে আছে যে-সব কৃতজ্ঞতামুখর বাক্যবিন্যাস, তাদের কোথাও আসলে কোনো ঋণী মন লেগে নেই। থাকতেই যে হবে, এমন মাথার দিব্যি অবশ্য কেউ দেয়নি! কিন্তু ঋণ ও কৃতজ্ঞতা নিয়ে ওই যে নিত্য বিজ্ঞাপন, শব্দদুটি তার কারণেই এখানে ঘোরাফেরা করে খুব। অথচ তারা আদৌ এখানে নেই! থাকলে, এমন কুৎসিত শব্দসমগ্রের জন্ম হয় না। আসলে এখানে যা আছে, তাকে শঠতা ও দ্বিচারিতা বলে। অতএব এরপরে এখান থেকে শব্দদুটিকে মুক্ত করে দেওয়া ভালো। আমি অন্তত আমার তরফ থেকে, আরও ঠিকঠাক বললে, আমার মুহূর্তদের তরফ থেকে মিথ্যার এই আবরণকে ঋণমুক্ত করে দিলাম। সুতরাং আত্মমাহাত্ম্যের প্রচারটুপি থেকে একটি পালক কমে গেল। তাতে টুপির কোনো ক্ষতি হলো না অবশ্যই। কারণ টুপি তার অঙ্গসজ্জার বাকি, পুরোনো ও সদ্যোজাত, পালকগুলিকে নিয়ে থাকতে পারবে একইরকম উচ্চকিত। আর আমার পালকটি যেমন বিজনস্বভাবী, খুব ধীর কিন্তু নিশ্চিত লয়ে একদিন ঠিক চলে যাবে বিস্মৃতির আড়ালে। প্রেম ও যুদ্ধের মতো সংঘর্ষময় যাপনে নিজেকে সামান্য সুবিচার দেওয়ার জন্য, এইটুকু ব্যবধান তো রচনা করাই যায়!
এরপরে এখানে আর একটি বাক্যও লেখা উচিত ছিল না। এমনকি, একটি শব্দও না! কিন্তু আততায়ী অক্ষরমালা যদি প্রেমিকার সাজানো হয়, তাহলে সামান্য জবাব তারা তো দাবি করতেই পারে! যাকে ন্যায্য এবং নির্ভেজাল জবাব বলা যায়। না-হলে, নীরবতাকে পলায়ন ভেবে উৎকট উৎসবে মেতে উঠবে কথার খেলাপি মনুষ্যজগৎ। তাছাড়া, আমার পথও যদি অন্যান্য পথের মতোই পাথর বলে চিহ্নিত হয়ে যায়, তখন তার কিঞ্চিৎ পাথুরে জবাবও তো জায়েজ! কোনো এক সুনীল-কবিতায় যেমন লেখা হয়েছিল ‘সখী, এবার স্পষ্ট করে কথা বলার দিন এসেছে / দু’পাঁচ বছর বাঁচবো কিনা কেউ জানি না—‘, তেমন ভাবনাতেই সময়ের গায়ে লিখিত হয়ে যাক এইসব নীরব অক্ষর।
প্রজাপতিদের রঙের বাহার থাক আর না-থাক, বাগানে গিয়ে কেউ বিষাদ খোঁজে না। আমিও খুঁজিনি। কারণ, আমি কাব্যিক তঞ্চকতা চিনি। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে আদুরে ভাইয়েরা কল্লোলিনীর বুকে এসে যে-সব বাঁদুরে কুৎসা ছড়িয়ে যায়; সেইসব কানে গেলে বোঝা যাবে, চটুলহাতের কেমন প্রসাধনে হৃদয়ের অন্ধকার ঢেকে রাখে উদাসী রূপটান। তেমন অন্ধকারের কিন্তু কোনো নিজস্বী হয় না, জান-এ-বাহার! অতএব, তোমার মুখে দুঃখ খোঁজার উর্বর বাহানা আমি কোনোদিন রাখিনি।
এই কেজো দুনিয়ায় কে কার প্রদর্শনী করে, আর কে যে কাকে বিখ্যাত করে, এইসব কুটিল প্রশ্নের আসলে কোনো একমাত্রিক মীমাংসা নেই। শুধু মনে রাখা ভালো, প্রদর্শনীর চিন্তা ছিল না বলেই বহু সচিত্র উপকরণ গভীর-গোপন রয়ে গেল এখানে। তবে তেমন উপকরণ কিন্তু লোকজন পুষতে শিখেছে বেশ! উত্তর থেকে দক্ষিণে আক্ষরিক অর্থেই যে-সব প্রদর্শনীতে ডাকাডাকি হয়, সেখানে লালিত্যের ঢালাও বিস্তারের আগে সতর্কতার ভীষণ প্রয়োজন তাই। আমি ব্যবহার করলাম না মানেই যে অন্য কেউ কখনও করবে না, তেমনটা তো নয়! বোধহীন বিদ্বেষী আবহ নিয়ে রঙিন জলজীবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা একটি মাছ অজান্তেই কোনো মোলায়েম বঁড়শিতে বেকায়দা গেঁথে গেলে, তার আর বাঁচার রাস্তা থাকে না নিশ্চিত!
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন লিখছি এইসব জটিলতর প্রদাহ! এমন প্রেমজ আততায়ী হানার মুখের উপর নিরুত্তর শীতল ঔদ্ধত্য ছুঁড়ে দেওয়া কাম্য ছিল শুধু। কিন্তু ওই যে পলাতক বলে চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা! অথচ তেমন করে পৃষ্ঠপ্রদর্শনের প্রতিভা অনায়ত্ত রয়ে গেল আজও! তাই বলে রাখা যাক, ফেরারি বাতাস যদি দিন-মাস-বছরের হিসেব কষে মাপতে যায় প্রেমের গভীর; সে তো বিচিত্রগামিনীই হবে! একথা আর ফলাও করে বলার কী আছে! এও কি আদৌ স্পন্দিত বক্ষে গর্বিত হওয়ার মতো কোনো বিষয়! আরও বলে রাখা যাক, অক্ষরের মারপ্যাঁচে ভাসিয়ে দেওয়া ভারসাম্য-খেলার মুখোশ আমাকে আর প্রভাবিত করে না অনেকদিন। ফেলতে পারে না ধন্দেও!
আসলে আমাদের কথা বলার পাতাগুলো, দাঁড়াবার জায়গাগুলো অনেকাংশেই এক। কাছাকাছি থাকা মানুষেরা যেমন দাঁড়ায়। একথা আগে কখনও মনে আসেনি, অন্তত এইভাবে। প্রাণঘাতী আক্রমণের পরে মনে এল, এবং মনে হলো, এবার নিশ্চুপে একটু সরে দাঁড়ানোই ভালো। অনুগ্রহ করে একে পলায়ন ভাববেন না জানেমন, আত্মত্যাগ ভাবুন। সময়ের বিরূপতায় এখন আমার আর কোনো গন্তব্য নেই। একটা কথা আপনি খুব ঠিকঠাক বলেছেন, সম্ভবত অজান্তেই! আমি হয়তো খুব দ্রুত শেষ করে ফেলেছিলাম ঈশ্বরীনির্মাণ। অথচ হাওয়া বদলে গেলে, সে নিজের মহিমা রক্ষা করতে পারে কিনা, তেমন পরীক্ষা কাম্য ছিল আগে।
তবুও স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আততায়ীও কখনও কোথাও নিয়তির মতো হয়ে উঠতে পারে। শ্বাসের মতো জরুরি। মৃত্যুর মতো অনিবার্য। এবং হ্যাঁ, ঈশ্বরীর মতো আরাধ্যা। যদিও প্রকৃতিবিরুদ্ধ, তবুও এতটাই ঘটে যেতে পারে! নাব্যদেশ থেকে কৃষ্ণগহ্বর পর্যন্ত ঢালু রাস্তার ওই আশ্চর্য ঘ্রাণের দিব্যি, প্রতিবার এই সন্ধানী ঠোঁটের উচ্চারিত প্রতিটি শব্দই নিখাদ সত্যি। হয়তো এই জন্মের জন্য আর নয়। কারণ, আবার সুনীল-রঙের সেই কবিতা থেকে বলি, ‘আমি তোমার অধর থেকে ওষ্ঠ তুলে তাকিয়ে দেখি মুখের দিকে/ তুমি তোমার কোনো কথাই রাখোনি’। তবুও সন্ধানী এই ঠোঁট জন্মান্তরে আবার জেগে থাকবে। এইটুকু কথা তো দেওয়াই যায়। এতটাই কথা দেওয়া যায়! কিন্তু আপাতত, নিস্তব্ধতা দীর্ঘজীবী হোক!
চৌদ্দ পনেরো বছর আগের কথা; আমি বসে আছি একটি দোকানে, দোকানটি মূলত আমাদেরেই। দোকানের সামনে…..
১৮ মার্চ ২০১৯ মধ্যরাত! চারদিক অন্ধকারে ঢেকে আছে শুধু বাড়ির চারিপাশে বিদ্যুতের বাল্বগুলো জ্বলছে তাদের…..
জোছনা করেছে আড়ি আসে না আমার বাড়ি গলি দিয়ে চলে যায়, গলি দিয়ে চলে যায়…..
পাঠকদের প্রায় জনেই হয়ত জানেন, সমকাম কি ? সমকামী কারা ? সমকামীর প্রকারভেদ, কেন…..