প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নীরা বার বার ফোন করছে আর পায়চারি করছে রাস্তায়। বাইরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। দুর্ভাবনায় কাতর হয়ে মনে মনে আল্লাহকে ডাকছে। প্রার্থনা করছে ও যেন ফোন ধরে! ধরছে না তো! রাত দেড়টা বেজে গেছে। কোথায় আটকে রইল মেয়েটা! খোদা, আমার মেয়েটা ভালো আছে তো? সব খারাপ বিপদের চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে একসঙ্গে। কী হবে! ভেবে কূল পায় না নীরা কার কাছে যাবে, কাকে ফোন দিলে সঠিক খবর জানা যাবে। এরই মধ্যে দুবার রাইহা যে দোকানে কাজ করে, ঘুরে এসেছে সে জায়গা। সব সুনসান নীরব। ফেব্রুয়ারি মাসের ঠাণ্ডায় এমনিতেই হাঁটা খুবই কষ্টকর। তারওপর গতকাল বেশ স্নো পড়েছে। এদিকের ডানকিন কফিশপ ছাড়া মোটামুটিভাবে সব দোকানের শাটার টানা। হুক্কা শপগুলো থেকে তরুণ প্রজন্মের গলার আর মিউজিকের আওয়াজ আসছে। আবহাওয়া শীত না গরম তাতে তারুণ্যের কী আসে যায়!
বাসা থেকে এই দোকানে হেঁটে আসতে নীরা একটু সময় নিল। রাস্তার দুপাশে এখনো জমে থাকা তুষার। হাঁটার গতি কি স্বেচ্ছায় কমিয়ে দিল, নাকি গায়ের সব শক্তি হারিয়ে ফেলায় অস্তে হাঁটছিল সে জানে না! রাতের নিউইয়র্কের ব্যস্ত রাস্তায় হাইস্পিডে গাড়ি চলছে, নীরা দুই পাশে হাঁটছিল দেখতে দেখতে। দেশে থাকলে কি এমন একা একা হাঁটতে সাহস পেত! দেশে নীরা ড্রাইভার ছাড়া কখনো বের হয়নি। এ দেশে কারও কাছে যাপিত জীবন বড্ড বেশি অহংকারী. কারও কাছে বেঁচে থাকাটাই বড় চ্যালেঞ্জ। দুই ধরনের মানুষই সব জায়গাতে আছে। এইসব এলোমেলো ভাবনায় আটকে যায় নীরা।
১৯ বছরের মেয়ে রাইহাকে খুঁজে চলছে সে। ও জানে এখানে মেয়েদের অবাধ স্বাধীনতা। মোটামুটিভাবে মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই এ দেশে পাড়ি জমিয়েছিল সে। নীরা জানে আমেরিকার সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি, তবে এ দেশের জনগণ আমাদের সাপোর্ট করছে। জাফর ইকবাল স্যারের একটা লেখায় নীরা পড়েছে এই দেশটি যেহেতু নিজের দেশের মানুষকে ভালোভাবে দেখেশুনে রাখে, তাই থাকার জন্য আমেরিকা চমৎকার একটা জায়গা। সারা পৃথিবী থেকে সব দেশের মানুষ সেখানে গিয়ে এটাকে একটা ‘মিনি পৃথিবী’ বানিয়ে ফেলেছে। এই দেশে কেউই বিদেশি নয়। তাই থাকার জন্য, লেখাপড়া বা গবেষণা করার জন্য আমেরিকার কোনো তুলনা নেই।
একুশ ব্লক হাঁটতে হয়। রাইহা টাকা বাঁচাতে প্রতিদিন হেঁটে কাজ করতে আসে। খুব বেশি স্নো থাকলে ট্রেন নেয়। এই মেয়ে বারে বা হুক্কাশপে টাকা নষ্ট করতে যাবে? যেতেও তো পারে! কে জানে হয়তো এরই মধ্যে কোনো বন্ধুর সন্ধান সে পেয়েছে। নীরা মোবাইলে দেখল রাত বাজে দুইটা। কোনো সমাধান খুঁজে পায় না। কোনো বিপদে পড়ল নাকি মেয়ে? এখানকার মুক্ত সামাজিক জীবনাচারের উন্মুক্ত হাতছানিতে মানুষ বদলে যায়। ও তো বাচ্চা মেয়ে! কেন শুনবে পরিবারের কথা। ভেতরে ভেতরে নীরা ভয়ে কাঁপতে থাকে। কারণ, নীরা শুনেছে আমেরিকায় দেশীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ধারণ ও লালন করা প্রায় অসম্ভব। এ কথা মনে রেখে মেয়েটা বাঙালিদের সঙ্গে বড় হবে আশা করেই হিলসাইডের বাঙালিপাড়াতে বাসা নিয়েছে নীরা।
প্রবাসীদের জীবন কেমন কাটে তা দেখতে দেখতে দুই মাসেই নীরার স্বামীর পকেট শূন্য হতে থাকে। বুঝতে পেরে নীরা কাজ নিয়েছে কাপড়ের দোকানে। সকাল দশটা থেকে রাত ৯-১০টা বেজে যায় কাজ শেষ করে বাসায় ফিরতে। মেয়েটাও একই সময়ে ফেরে। তারপর মা-মেয়েতে কাজের-অকাজের সব ধরনের গল্প করে। তারা মা-মেয়েতে খুব ভালো বন্ধু। সব ধরনের গল্প করে তারা। পরের সেশনে মেয়ে কলেজে ভর্তি হওয়ার আশা। ভালো রেজাল্ট করা রাইহার ইচ্ছে আইটি নিয়ে পড়ার।
ফোন বেজেই চলেছে, ধরছে না কেন? কী করতে পারে সে, এর মধ্যে আবার কোনো ছেলেবন্ধু পেয়ে গেল নাকি কে জানে? পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে এখানে অনেকে নিজেকে বদলে ফেলে। রাইহার তেমন কিছু তো চোখে পড়েনি। তাহলে? নীরার মনে এসব প্রশ্ন তৈরি হয়। এরই মধ্যে একজন ফোনটা রিসিভ করল। ছেলের গলা, সঙ্গে লাউড মিউজিক শোনা গেল।
হ্যালো হ্যালো! আমার মেয়ে কোথায়?
কে আপনি? মোবাইল আপনার কাছে কেন? আমার মেয়েকে দিন। রাইহাকে দিন প্লিজ।
একসঙ্গে একাধিক প্রশ্ন করে নীরা উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছে।
মিউজিকের জন্য কিছুই শোনা যাচ্ছিল না। একটু পর খেয়াল করল ফোনের লাইনটা কাটা এবং সুইচ অফ করা। আকাশ-পাতাল দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। বাসস্ট্যান্ডে বসে চিৎকার করে কাঁদতে থাকল।
কী করবে এখন। এ দেশে তো কেউ নাই। দু-একজন পরিচিত থাকলেও এত রাতে কল দেওয়া যাবে না। মেয়েদের বাবা দেশে গেছে, ওকে তো কল দেওয়া যাবেই না। কান্নাকাটি করে এ দেশ সে দেশসহ চৌদ্দগুষ্টিকে ফোন দেবে। সবার কাছে সাহায্য চাইবে। কেউ সাহায্য তো দূরের কথা উল্টো কথা জোড়াতালি দিয়ে বড় করবে। এমন এমন গল্প সাজাবে যে দেখা যাবে রাহাত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। থাক কাউকে বলবে না। নীরা ঠিক করে ফেলে।
দেশে নীরার চারজনের পরিবার হলেও দেবর-ভাশুর নীরার ভাই-বোন সবার সংসার মিলে তারা কাছাকাছিই থেকেছে। মোটামুটিভাবে সব দিন হইহুল্লোড়ের মধ্যে বাচ্চারা বড় হয়েছে। দেশে এখন আর যৌথ পরিবার নেই। সবার একক পরিবার। কেউ কেউ এক সন্তান নিয়ে মাইক্রো পরিবার বানিয়ে নিয়েছে। ওখানে দাদা-দাদি, নানা-নানিদের মেহমান হিসেবে ধরা হয়। একক পরিবারগুলোর মানুষগুলো হয়ে ওঠে স্বার্থপর। নিজ নিজ চিন্তায় ব্যস্ত। অনেক ক্ষেত্রে নিষ্ঠুর ও বর্বর বটে!
শিক্ষা-দীক্ষায় উচ্চশিক্ষিত হয়। তবে মানবিকতায়, নৈতিকতা বোধের ক্ষেত্রে এসব পরিবারের সন্তানগুলো একেবারেই আনাড়ি হয়ে থাকে। নীরা গ্রামের বাড়িতে যৌথ পরিবারে বড় হয়েছে। তাই তার চোখে যৌথ পরিবার ও একক পরিবারের পার্থক্য সহজেই চোখে পড়ে। শহরের পরিবারগুলো পরস্পর পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। যোগাযোগ, সৌহার্দ্য, সহযোগিতা, সামাজিক ক্ষেত্রগুলোতে এদের ভূমিকা তেমন একটা উল্লেখযোগ্য নয়।
শহরের এরকম পরিস্থিতিতেও রাইহা সবার মাঝেই বড় হয়েছে। দেখতে সুন্দর-স্মার্ট মেয়ে রাইহা। চালচলনে এখানকার বাঙালি মেয়েদের চেয়ে বেশ আলাদা। দেশের ইংরেজি মাধ্যমে পড়া হলেও বাঙালিয়ানা আছে তার মধ্যে। এখানে এসে সাদা-কালো বাঙালি ইন্ডিয়ান এদের সঙ্গে এই কদিনের মধ্যেই সহজে মিশে গেছে। তবে মানুষ সহজেই বুঝতেই পারে ও অন্য মেয়েদের চেয়ে আলাদা।
নীরারা এসেছে মাত্র ছয় মাস। বিদেশে পরিবারের সব সদস্যই স্বপ্নচারী হয়ে ওঠে, এটা নীরা জানে। তাই মেয়ে দুটোকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে। পজিটিভ স্বপ্ন। পড়ালেখা করে ওপরে ওঠার স্বপ্ন। আমেরিকার সব ভালোকে সুন্দর করে গ্রহণ করতে হবে। এদের সুযোগ থেকে কাজে লাগিয়ে তোমাদের মেধাকে শাণিত করতে হবে। আমরা এখানে এসেছি উন্নত সার্টিফিকেট নিয়ে বড় কিছু করার উদ্দেশ্য নিয়ে।
প্রায় প্রতিদিনই তারা মা-মেয়েতে এসব গল্প হয়। এসব এলোমেলো ভাবতে ভাবতেই রাত চারটা বেজে গেল, মেয়ে তো এল না। ভোর হতে চলেছে। কী করবে এখন নীরা? ও যে এখনো তার ঘরের সামনে বাসস্টপেজে বসে আছে। ছোট মেয়ের সকালে স্কুল। তাই বাসায়ও যাওয়া দরকার। নীরা অবশ শরীর নিয়ে বাসার দিকে হাঁটতে শুরু করল। খুব সাবধানে দরজা খুলে ছোট মেয়েকে দেখল ঘুমে। ও কিছুই টের পায়নি।
সময় যত যাচ্ছে, নীরার দীর্ঘশ্বাস ততই গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে।
যে কোনো পরিবারের মায়ের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। শিশু জন্ম থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠা পর্যন্ত মায়ের প্রভাব বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং মাকে হতে হবে শিক্ষিত, মার্জিত রুচির অধিকারী, সহনশীল, বিবেকবান, সংস্কৃতিমান, সর্বোপরি আদর্শ মা। নীরা নিজেকে আদর্শ মা মনে করে। নামাজ পড়ে মেয়ের বিপদমুক্তির জন্য প্রার্থনা করে। মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা যায় যেসব ছেলেমেয়ে মা-বাবার পর্যাপ্ত আদরযত্ন পায় না, তারা প্রায়ই কুসঙ্গে পড়ে মাদকাসক্ত হয়। নীরা মনে মনে ধরেই নিয়েছে রাইহা অন্যায় কিছু করার আগে একটিবার ভাববে। অমন খারাপ কিছু হলে নীরা টের পেত। ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত শরীর নিয়ে বাইরের রুমে সোফায় বসল সে।
ঠিক পাঁচটায় মনে হলো বাসার সামনে একটা গাড়ি থামল। রাইহা নিশ্চয়ই! তবে কার সঙ্গে কার গাড়িতে আসছে। নীরার দৌড়ে গেটে যাবার কথা ছিল, কিন্তু ও গেল না। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বসে রইল।
ঠক ঠক পায়ের শব্দ, হ্যাঁ রাইহা আসছে। পায়ের শব্দেই ও মেয়েকে চিনেছে। চুপচাপ সোফায় বসে রইল। রাইহা খুব সাবধানে বাইরে থেকে চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে এল।
মা-মেয়েতে চোখাচোখি হলে রাইহা চোখের ভাষায় বুঝিয়ে দিল ও জানত মা এমনই বসে থাকবে। জুতা খুলে এসে মায়ের কোলে মুখ গুঁজে বসল। নীরা ভাবছে কোথায় ছিল তার মেয়ে। কখন কীভাবে কার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে সামাজিক জীবন বিপর্যস্ত করে তুলছে? তবে সব প্রশ্ন চেপে যায়। বলে না কিছুই। নীরার নাড়িছেঁড়া প্রথম সন্তান। নীরা ভাবে এভাবে মেয়েকে শেষ হতে দেবে না। হোক না তাদের বাপ একটু বেখেয়ালি। আমি আমার মেয়েদের বাপ-মা হব।
আমি দেখে রাখব। দুজনে চুপ। বীভৎস নীরবতা। দম আটকে আসা চিৎকার করে কান্না চেপে যায় নীরা। দুজনে অপেক্ষায় আছে কে আগে কথা বলবে। কারো গায়ে শক্তি নেই একটি টুঁ শব্দও বলার মতো। নীরা চোখের পানি আটকে রাখে। মেয়ে ফিরে আসছে এতেই শান্তি!
এা, আমি খুব ক্লান্ত একটু ঘুমিয়ে নিই? পরে সবকিছু তোমাকে বলব।
আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দাও।
নাহ্ ও কোনো নেশা করেনি। তাহলে কার সঙ্গে ছিল?
নীরা মেয়েকে নিজের চেয়ে বেশি বিশ্বাস করে। কোনো প্রশ্ন করল না। মাথায় হাত বোলাতে থাকল মেয়ের। বুকে জড়িয়ে ধরে মেয়েকে বোঝার চেষ্টা করল নীরা।
সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়ল মা-মেয়ে।
দুজন ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত মানুষের ঘুম।
ছোটমেয়ে রাইসাও বড় হচ্ছে। ওকে নিয়েও ভয় বাড়ছে নীরার। মানুষের নৈতিক আদর্শ, মূল্যবাধ, শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ মনস্তাত্ত্বিক বিকাশের মূল জায়গাটি হলো তার পরিবার। অথচ নীরা ছোট মেয়ের জন্য পরিবারের সংগঠনটাই দিতে পারছে না। নীরাকে কাজ করতে হয়। রাইহাও কাজ করে। পারিবারিক পরিবেশ তাহলে রাইসা পাবে কী করে? তাহলে শুধু নৈতিকতার বক্তৃতায় কি রাইসা সঠিক শিক্ষা পাবে? কী জানি কী হয় এই ভয় পেয়ে বসেছে নীরাকে। সামাজিক ও পারিবারিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির চর্চার যথাযথ ক্ষেত্র রাইসার জন্য নীরা তো একেবারেই তৈরি করতে পারেনি। একা বড় হওয়া বাচ্চাদের নানা রকম সামাজিক-সাংস্কৃতিক এমনকি মানসিক সমস্যাও দেখা যায়। এই শহরের পরিবেশে সামাজিক-সাংস্কৃতিক চর্চার শিক্ষাব্যবস্থা খুবই দুর্বল।
পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে রাইসা। ওকেও দশ ব্লক হেঁটে হিলের ওপরের স্কুল যেতে হয়। পড়াশোনা করতে ভালোবাসে। খুবই লক্ষ্মী মেয়ে। সাবধানে ঘুম থেকে উঠে মা আর বোনকে একসঙ্গে ঘুমাতে দেখে একটুও অবাক হয়নি। এক সঙ্গে তারা প্রায়ই ঘুমায়। এ দেশে আসার পর তারা ছোট বাসায় থাকে। তাই এক রুমে সোফা, টিভি আর অন্য রুমে দুইটা খাট। নিজে নিজে স্কুলের জন্য তৈরি হয়। অল্প পানিতে নুডলস-ডিম এক সঙ্গে দিয়ে স্যুপের মতো বানিয়ে খাওয়া মা তাকে শিখিয়ে দিয়েছে। চুলা জ্বালাতেই নীরা ক্লান্ত চোখে রাইসার দিকে তাকাল। মা-মেয়েতে চোখাচোখি হলো। রাইসা হাসিমুখে বলল, মা তুমি চেয়ে চেয়ে দেখো আমি নুডলস-স্যুপ বানাতে পারি।
সাবধানে করো মা।
নীরা আবারো ভাবনায় ঢুকে পড়ে। এখন শুধু আকাশ-সংস্কৃতি ও বিশ্বায়নের সম্প্রসারণের যুগ। বাঙালি পরিবার ও সংস্কৃতির চর্চাবোধটা রক্ষা করা এ দেশে অসম্ভব।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য পরিবারেরও দায়িত্ব অনেক। রাইসাকে এর কিছুই নীরা দিতে পারবে না। রাইসাদের বসবাসের ক্ষেত্রটি হতে হবে অবশ্যই মানবিক। নীরা চেষ্টা করছে দুটো মেয়েকেই এসব শেখানোর। দেশের সমাজ আজ বিভ্রান্ত। মূল্যবোধের মড়ক ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। পত্রিকায় দেখা যায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামাজিক অপরাধ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।
নীরা রাইহাকে সাবধানে সরিয়ে নিজে উঠে বসে। রাত জাগার ক্লান্তি এখনো শরীরজুড়ে।
ভাবছিল আজ রাইসাকে স্কুলে দিয়ে আসবে। মেয়েকে নাশতা তৈরি করে দিতে চাইল। মুখ ধুয়ে আসতেই নীরা দেখতে পেল রাইসা নাশতা তৈরি করে খাচ্ছে। তার প্রিয় খাবার এক বাটি পানিতে নুডলস আর ডিম।
নীরা ছোট মেয়ের মাথায় চুমু খেল।
চলো আজ আমিও যাই তোমার সঙ্গে।
চলো, বলেই জ্যাকেট, জুতা, কানটুপি পরে মা-মেয়ে বের হয়ে গেল। বের হবার সময় রাইহাকে একবার দেখে নিল। মরার মতো ঘুমাচ্ছে। ঘুমাক, মন ভরে ঘুমাক। সময় নিয়ে কাল রাতের ঘটনা শোনার অপেক্ষায় থাকল নীরা।
বাইরে হিম শীতল বাতাসে চোখে পানি এসে গেল। রাইসা জোরে জোরেই হাঁটছে আর বলছে তাই তো তোমাকে সঙ্গে আনতে চাই না। তুমি সঙ্গে আসলে আমার ক্লাসে দেরি হয়ে যায়। তুমি বেশি স্লো হাঁটো।
আচ্ছা, তুমি দৌড়ে যাও আমি একটু তোমার স্কুল পর্যন্ত হেঁটে আসব।
রাইসা দৌড়ে নীরাকে হাত নেড়ে স্কুলে ঢুকে যায়।
নীরা হাঁটার গতি আরো কমিয়ে দিল। এখন সকাল সাতটা। আজ কাজে যাবে না। তাই মালিককে ফোন করতে হবে। ছুটি কাটালে একটু আগেই ফোনে জানিয়ে দিতে হয়, যাতে দোকানমালিক অন্য মেয়েদের ডেকে নিতে পারে। নীরা করপোরেট জব করত। এখন সে ডেইলি কামলা। কাজ করলে টাকা, না করলে নাই। দোকান মালিককে এখানে সবাই ভাইয়া সম্বোধন করে, তাই নীরাও ভাইয়াই ডাকে। কাজের জন্য নানা ধরনের জায়গায় খোঁজ করতে হয়। সবাই পরে জানাবে বলে বিদায় করে। এই ভদ্রলোক নীরার পড়াশোনা আর দেশের যোগ্যতার কথা শুনে সোজাসুজি জানিয়ে দেয় তার কোনো লোকের আপাতত দরকার নেই। নীরা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে দিতে অভ্যস্ত। তাই মোটামুটিভাবে বুঝতে পেরেছিল এই লোকটির তাকে দরকার। পরে হয়েছেও তাই। তবে কাজের শর্ত ছিল বাকি অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত মেয়েদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে হবে। নীরা শর্ত পূরণ করেছে। তাই অন্যরা দৈনিক বেতন ৫০-৬০ ডলার পেলেও নীরাকে রোজ ৮০ ডলার দেওয়া হয়।
নীরা জানে ভাইয়া তার বাচ্চাদের স্কুলে নামিয়ে দিতে যায়। বড়লোক হলে এখানেও অনেকেই বাচ্চাদের প্রাইভেট স্কুলে পড়ায়। যদিও এ দেশে পাবলিক বা প্রাইভেট স্কুলে পড়ে আলাদা সার্টিফিকেট নিয়ে আলাদা কিছু করার সুযোগ নেই। এ দেশে চাকরিতে এসবের বালাই নেই। রেজাল্ট ভালো করে নিজেদের আপডেট রেখে যে যে লাইনে পড়তে চায় সেদিকে ফোকাস করলেই ভালো জব পাওয়া যায়। নীরার দোকান মালিকের ছেলে-মেয়ে প্রাইভেট স্কুলে পড়ে। তাদের স্কুল সকাল আটটার দিকে শুরু হয়।
ভাইয়াকে ফোনে জানিয়ে দেয় আজ শরীরটা ভালো না, তাই কাজে যেতে পারবে না।
এখন ঘরে গেলে রাইহার ঘুম ভেঙে যেতে পারে। তাই ভাবল বাসায় না গিয়ে বাংলাদেশি দোকানে বসে চা খাবে আর মেয়ের জন্য নাশতা নিয়ে যাবে।
নীরা হাঁটতে থাকে। আজকের ঠাণ্ডাটা গায়ে মাখবে ঠিক করল। বেশ কিছুক্ষণ সুন্দর সুন্দর বাড়িগুলোর সামনে হাঁটল। রাতে মেয়ে কোথায় ছিল, কেমন ছিল, ভাবতে ভাবতে দেশীয় রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়ল। এখানে ভালো চা পাওয়া যায়, সঙ্গে পুরানো খবরের কাগজ। এখানে ডেইলি পত্রিকা বের হয় না। সব কটি সাপ্তাহিক আর সবগুলো কাগজ একই নিউজ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে লেখে। এ দেশে একটা পত্রিকা বের হতে হতে দেশে হাজারটা তাজা খবর চলে যায়। তবু নীরা এক কাপ চা নিয়ে বসে আর পুরোনো পত্রিকা নিয়ে পড়ার চেষ্টা করে। নাহ্ আজকে এসব হবে না। আরেক কাপ চা আর পরোটা-সবজি ভাজি নিয়ে বাসার দিকে হাঁটতে থাকে। বেশ ঠাণ্ডা।
এ দেশে বাংলাদেশের মতো ছয় ঋতুর দেখা মেলে না। চারটি ঋতুর দেশ নামে পরিচিত এই দেশ। রাতে ঘটনাটা না ঘটলে নীরা আরো কিছু সময় বাইরে ঠাণ্ডা গায়ে মাখত। নাহ্ এবার বাসায় যাই। ওমা একি! রাইহা তো উঠে গেছে। বাথরুমে বেশ সময় নিয়ে সে গোসল করছে। মনে হয় কাজে চলে যাবে, তাই উঠে পড়েছে।
নীরা তার টেবিলে নাশতার বক্স রেখে শরীর এলিয়ে দিল বিছানায়।
একটু পরে রাইহার ডাকে উঠে বসল নীরা।
মা আসো নাশতা খাই।
চলো খাই।
তুমি রুটি না পরোটা?
দুটোই মা-মেয়ে ভাগ করে খেতে থাকে।
কেউ রাতের কথা বলছে না। জড়তা ভেঙে কে আগে কথা বলবে তা ঠিক করতে পারছে না, তাই দুজনেই চুপচাপ।
নাশতা শেষ করে রাইহা চা দিল, নিজেও খেল।
নীরা বলল, আজ আমি ছুটি কাটাব। তুমি কি এখনই বের হবে?
মা, আমি আর ওই কাজে যাব না।
হঠাৎ কী হলো? কেন যাবে না?
কাল রাতের কথা শুনতে চাও? শুনতে চাও ওই লোক কী কী করেছে?
নীরার শরীর আবারও কাঁপতে শুরু করে। তারপর ও স্বাভাবীকভাবেই বলল, বলো কী হয়েছে!
মা, আমি ওই লোকের সঙ্গে কাল নাইট ক্লাবে গিয়েছি। ড্রিঙ্ক দিয়েছিল, তবে সে যেন না দেখে এমন ভাবে ফেলে দিয়েছি।
ডান্স করেছি। সে আমাকে চুমু খেয়েছে।
নীরা যা ভেবেছিল তার চেয়েও বেশি কিছু হয়েছে, সেটা নিশ্চিত হয়ে গেল।
তুমি কি দুই বাচ্চার বাপ লোকটাকে পছন্দ করো?
নাহ্ করি না।
তাহলে গেলে কেন?
উনি আমার সঙ্গে ব্ল্যাকমেইল করেছেন।
কেমন করে করল। এসব তো এক দিনে তৈরি হয় না। তুমি যেতে না চাইলে পুলিশ কল দিতে। এ দেশে মেয়েদের একটা কলে যেকোনো ছেলের জীবনযাপন কঠিন হয়ে যায়।
মা মন দিয়ে শোনো…কাল সকাল থেকেই উনি আমার মোবাইলটা দেখি বলে নিয়ে নিয়েছে। সারা দিন অনেক অনুরোধ করেও ফোনটা ফেরত পাইনি। আজকে পে ডে ছিল বলে আমিও বেশি জোর দিই নাই। দোকান বন্ধ করে সব মেয়েকে বেতন দিয়ে গাড়িতে তাদের বাসায় নামিয়ে দিয়ে উনি আমাকে নিয়ে নাইট ক্লাবে চলে যান। এর ফাঁকে উনি আমার মোবাইল থেকে আমার খুবই ব্যক্তিগত গোপনীয় কিছু ছবি তার মোবাইলে নিয়ে নেন। ছবিগুলো আমাকে ক্লাবে গিয়ে দেখিয়েছে।
কী বলছ এসব? আমাকে ফোন দিতে পারতে। ছবিগুলো কেমন?
আমি তোমাকে ফোন দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু উনি তোমাকে ভালো করে চেনেন। বলেছে মাকে জানালে সব ছবি তার বন্ধুদের দিয়ে দেবে এবং ছবিগুলো ভাইরাল করে দেবে। তাই ভয়ে তোমাকে কল দিই নাই।
ছবিগুলো কার সঙ্গে তোলা?
মা কারো সঙ্গেই না।
তাহলে কী আর ভাইরাল হবে, চলো এখনই পুলিশ স্টেশন চলো। কমপ্লেইন করতেই হবে।
মা ওগুলো আমার ন্যুড ছবি।
কী? ন্যুড ছবি?
না মানে পুরোপুরি ন্যুড না। বিকিনি পরা।
কোনো রকম ইতস্ততা ছাড়াই রাইহা সবকিছু বলতে থাকে।
কে তুলল, কবে তুলেছ, আর কেনই-বা তুলেছ?
মা মাথা ঠাণ্ডা করো। আমি সব বলছি। এখানে এসে আমি একটা বিখ্যাত অ্যাড ফার্মের সঙ্গে কাজ করতে চেয়েছিলাম। তাদের সঙ্গে গিয়ে নানান লোকেশনে এই ছবিগুলো তুলেছি। তবে প্রায় অনেক শহরে যেতে হবে বলে আর তাদের সঙ্গে কাজ করিনি। তা ছাড়া বাবা বেশিরভাগ সময় দেশে থাকে, তুমি আর রাইসা একা হয়ে পড়বে বলে আর ফাইনাল কন্ট্রাক্টে সাইন করিনি।
নীরার পুরো শরীর অবশ হয়ে আসছিল। এত দূর! তার এই বাচ্চা মেয়েটা এত দূর কখন গেল? কবে গেল। নীরা কিছুই জানল না। কিছুই টের পেল না। কেমন অবলীলায় রাইহা সব বলে যেতে থাকল, যেন তেমন কিছুই হয়নি। নীরার বিশ্বাস ভঙ্গ হলো। মেয়ের সম্পর্কে অনেক কিছুই সে জানে না। মনে হলো মাথায় বজ্রপাত হলো। হঠাৎ করেই রাইহাকে তার বেশ বড় মনে হলো। রাইহার কথায় নীরা বিপদে পড়ার আভাস পেল।
নীরা শুনেছে দেশে ছেলে-মেয়ে বা প্রাপ্তবয়স্ক নতাঁরীর বিশেষ মুহূর্তগুলোও তারা নিজেরাই ক্যামেরাবন্দী করে নিপুণ কৌশলে। প্রয়োজনে তা ব্যবহার করে ব্ল্যাকমেইলও করে থাকে। এসব ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী বাটপার চক্র। ফলে প্রতারিত ব্যক্তির নিঃশব্দে আত্মসমর্পণ ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।
তাহলে কি নীরার মেয়ের সঙ্গেও এ রকমই কিছু শুরু হয়েছে? কী করবে এবার? কারো সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত? তার উকিল ব্রায়ানকে ফোন দিল। উনি বাঙালি কমিউনিটি মানুষদের ভালো করে চেনেন, তাই তার পরামর্শ হলো আগে ওই লোকের সঙ্গে দেখা করে কথা বলা। আরো কয়েক জায়গায় ফোন দিতে গিয়েও দিল না। মনে মনে ঠিক করল আগে ওই লোকের সঙ্গেই দেখা করবে। তাই আগে রাইহার সঙ্গে আরো কথা বলা দরকার আছে।
রাইহা নাশতা করে আবার ঘুমাতে গেল। আপাতত কথা বলা হলো না। অনেকটা সময় রাগে নিজের অজান্তেই নিজের হাত কামড়াতে থাকে। তাহলে কি নীরার মেয়ে সোনার হরিণের পেছনেই ছুটছে? এমন শিক্ষা সে তো দেয়নি।
নীরার কাছে যে জীবন পানসে রাইহার কাছে তা রোমাঞ্চকর। এখানের অতিমাত্রায় স্বাধীনতাই কি এর জন্য দায়ী। তাহলে কী হবে? সব বুদ্ধি-পরামর্শ কিছুই কাজে এল না। তাহলে কি থেমে গেল নীরার স্বপ্নের জীবনের সোনালি অধ্যায়ের যাত্রা? তবে পুরো বিষয়টাই নির্ভর করছে ব্যক্তিবিশেষের ওপর। ব্যক্তিজীবনের দৃষ্টিভঙ্গি ও তার মানসিকতার ওপর। রাইহা বলেছে ও চেয়েছিল বিখ্যাত মডেল হতে, ফিরে এসেছে মা-বোনের কথা ভেবে। তার মানে কি এখনো সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি।
নীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাইহা জেগে উঠলেই পুলিশ স্টেশনে যাবে। তাদের কাছে সাহায্য চাইবে।
নীরার ভাবনায় নানান বিষয় যোগ হতে থাকে, আচ্ছা রাইহা রেপড হয়নি তো? যদি হয়েও থাকে ও তো গোসল করে ফেলেছে। সব আলামত তো নিজের হাতেই ধুয়েমুছে দিয়েছে। নাকি এখানে ও কোনো লুকোচুরি খেলা আছে।
এরই মধ্যে ছোট মেয়ে বাসায় চলে এসেছে। পুরোনো খাবার ফ্রিজ থেকে বের করে গরম করে দুই মেয়েকে নিয়ে খেতে বসল।
রাইসা তার স্কুলের গল্প বলল। নীরা দেখতে থাকে তাদের দুজনকে। একপর্যায়ে তাদের থামিয়ে দিল। রাইসা তুমি কি জানো তোমার আপুর অ্যাড ফার্মের কাজ করার কথা?
দুজনে চোখাচোখি করল। মনে হলো ছোটটা বড়টার কাছ থেকে অনুমতি নিল।
রাইসা জবাব দিল, হ্যাঁ আমি জানি। কয়েকবার আমি ওর শুটিং দেখতে গিয়েছি।
নীরা আর ভাবতে পারছিল না। আমাকে তোমরা বলোনি কেন?
বললে তুমি বকা দেবে তাই।
ওকে। এনাফ হয়েছে। চলো তৈরি হও পুলিশ স্টেশনে চলো। দুজনে আবার চোখাচোখি করল।
নীরা চিৎকার করে উঠল, পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তৈরি হয়ে নাও।
এখানে এত শীত যে এক মিনিটের জন্য হাতমোজা ছাড়া বাইরে থাকলে রক্ত বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই তৈরি হতে সময় লাগল। মেয়েদের বাবা দেশে। ওর আসতে আরো মাস চারেক লাগবে। তিনজন মহিলা আমেরিকার পুলিশ স্টেশনে যাবে। নিয়ম অনুযায়ী জিপ কোড মতো যার যার বাসার অবস্থানমতো এলাকায় পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের শিশু ও যৌন নির্যাতন আইন দেশটির শিশু সুরক্ষা নীতিগুলির অংশ হিসাবে কার্যকর করা হয়েছে। নাবালিকাকে যৌন নির্যাতনের জন্য কাউকে দোষী সাব্যস্ত করতে হলে তার বয়স ষোলো বছরের কম হতে হবে। রাইহার বয়স ঊনিশ চলছে। তাহলে কী করতে হবে নিশ্চয়ই পুলিশ বলে দেবে। অপরাধী দোষী সাব্যস্ত হলে ফৌজদারি শাস্তির মধ্যে জেল, জরিমানা, যৌন অপরাধী হিসেবে তার নাম আজীবন নিবন্ধিত হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে অপরাধীর চাকরি বা ব্যবসা-বাণিজ্য করা সমস্যা হয়ে যায়।
তারা তিনজন পুলিশ স্টেশন ঢুকে জানাল কমপ্লেইন করতে আসছি। কর্মরত পুলিশের প্রশ্ন, অভিযোগ করবেন, না কেস করবেন? নীরা বুঝতে পারল না কী করবে। বলল আগে আমাদের কথাগুলো শোনেন তারপর যেটা করা লাগবে পরামর্শ দেবেন।
পুলিশ প্রশ্ন করলেন, আপনারা তিনজনই কি ভিকটিম?
রাইহা উত্তর দিল, না সে একাই ভিকটিম। আমরা তার মা ও ছোট বোন। পুলিশ রাইহার আইডি দেখল। বলল তোমার মেয়ের বয়স আঠারোর বেশী। তোমরা অপেক্ষা করো। রাইহাকে আলাদা করে অন্য রুমে নিয়ে গেল। নীরা মেয়েকে বোঝাল কোনো কিছু লুকাবে না, সব সত্য ঘটনা খুলে বলবে।
প্রায় এক ঘণ্টা পরে পুলিশসহ রাইহা বের হয়ে আসে। নীরা তাদের কাছে জানতে চাইলে পুলিশ অ্যাডাল্ট মেয়ের প্রাইভেসি নষ্ট হবে বলে কিছুই জানাল না। নীরার মনে হলো রাইহা সব ঘটনা বলেনি বা লেখেনি। কিছু লুকিয়েছে।
মোটামুটিভাবে মন খারাপ করে বের হয়ে বাসায় আসে।
নীরার মনে হলো জ¦র আসছে। বাইরে তুষার পড়ছে। মাঝে মাঝেই তুষার বৃষ্টি হয়। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাইরে তাকাতেই দেখা যায় চারদিকে শুভ্র তুষারে রাস্তাঘাট, বাড়িঘর সাদা চাদরে ঢাকা।
আজ নীরা কাজে যাবে। মেয়েদের নিয়ে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। সামনে আরো খারাপ কিছু দেখার অপেক্ষায় নিজেকে তৈরি হতে হবে। এই ভেবে গা ঝাড়া দিয়ে বিছানা ছাড়ল। এমনিতেই তুষার দেখতে খুবই ভালো লাগে কিন্তু আজ নিজের জীবনের মতো দুর্বিষহ লাগছে। মেয়েদের রুমে দুটাকে একবার দেখে নীরা কাজে নেমে গেল। মনে মনে ঠিক করল এ তরী বাইতে হবে। থেমে গেলে চলবে না।
এভাবে চলতে থাকে কয়েক মাস। মাটির বুকে একটু-আধটু বরফের অস্তিত্ব থাকা অবস্থায়ই ছোট ছোট নরম লাল, নীল, হলুদ রঙের ফুল শীতের কঠিন আবরণ ফুঁড়ে উঁকি দিয়ে স্বাগত জানায় বসন্তকে। নীরা তার জীবনের বসন্তের জন্য অপেক্ষায় থাকে। মেয়েদের সঙ্গে সাবধানে কথা বলে। কথোপকথন নেতিবাচক না ইতিবাচক হচ্ছে সেদিকে নজর দিতে হবে। কারণ এই কথোপকথনের মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিত্বের ধরন নির্ভর করবে বলে নীরা বিশ্বাস করে। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে কত বেশি পরিবর্তন এসেছে! নীরা ভাবল, নিজের পরিবার থেকে নিয়ে আসা মূল্যবোধ ও বিশ্বাস মেয়েদের ওপর প্রয়োগ করছে যা কিনা এই সমাজের সঙ্গে মিলছে না। এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে কূল-কিনারা খুঁজে পায় না। এদেশে যতটা সময় ধরে বাস করছে তাতে নিজের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে বাস্তবতার এই টানাপড়েন থেকে বের হবার সহজ উপায় খুঁজে পায় না। মেয়েদের ওপর নিজের চাওয়া আর চাপিয়ে দেয় না। কী আর করা! নির্লিপ্ত ভাবে দিন পার করতে থাকাটাকেই যে নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েছে নীরা।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..