নীরা এবং

কুম্ভকর্ণ
গল্প
Bengali
নীরা এবং

শুক্রবারের সন্ধ্যা। মুম্বাই রাস্তার জনস্রোত ঠেলে ট্যাক্সি থেকে যখন নামলাম তখন তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। এয়ারপোর্টের এন্ট্রান্স গেটের সামনে আসতে আসতেই বেশ খানিকটা ভিজে গেলাম। ভেবেছিলাম সিগারেট এ সুখটান মেরেইএয়ার পোর্টে ঢুকবো-বৃষ্টিটা সব ভন্ডুল করে দিলো।ঝা চক চকে এয়ারপোর্ট,মায়াবী শহরের মায়াবী এয়ারপোর্ট। কিয়স্ক থেকে বোর্ডিং পাসটা প্রিন্ট করে একটু দাঁড়ালাম।সামনের বিশাল ডিসপ্লে তে ফ্লাইটের সময়সূচি গুলোপৌনপনিক ভাবে পাল্টে যাচ্ছে। আমার কলকাতার ফ্লাইট নম্বারটির পাশেটি জ্বল জ্বল করছে “ডিলেইড”। একটাছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিকিউকিটি চেক ইন করলাম। বিমান কোম্পানির লোকজনের সাথে কথা বলে মনে মনে একটা অংক কষে নিলাম, কোলকাতায় নামতে দশটার হবে না। ওয়েদার ফোরকাস্ট বলছে কোলকাতায় হালকা বৃষ্টিহচ্ছে। দীপক মানে আমার ড্রাইভার কে ফোন করে ছুটি দিয়ে দিলাম। বেচারা নতুন বিয়ে করেছে এমন বরষার দিনেএকটু ছুটি দিলাম। নীরা বলতো,বরষার জল এক দারুন গুন আছে-জলটা মানুষের মনটা গলিয়ে দেয়, আর তখন ইমনের ভালোবাসা গুলো ভেসে ওঠে। সত্যিকথা বলতে কলকাতায় ওলা উবের আসার পর ফ্লাইট ডিলে হলেও তেমনআর গায়ে লাগে না। খুব ক্ষিদে পেয়েছে। ফুড কোর্ট থেকে খাবার নিয়ে বসলাম একটা চেয়ার দখল করে। সবাই যেযার মুঠোফোনে ব্যস্ত- আশেপাশে তাকানোর সময়ের নেই। আমিও মুখ গুজলাম নতুন ম্যাগাজিনে।

চারিদিকে এখন সকাল-

রোদের নরম রং শিশুর গালের মতো লাল;

অনেক বছরের পুরানো কণ্ঠে বহুবার শোনা কবিতা শুনে একটু চমকে উঠলাম।

-বসতে পারি এখানে? হিয়া বললো।

-না বললে কি বসবি না? আর রাতে সকালের কবিতা পড়ছিস?

সময়ের সাথে সাথে হিয়া অনেক পাল্টে গ্যাছে। একটু মোটা হয়েছে, ঠোঁট টা লুকিয়েছে গাঢ লিপস্টিকে। কোমর পর্যন্তচুলটা এখন কাঁধ অবধি এসে ঠেকেছে। জিন্স, প্যান্টে বেশ মানিয়েছে-যাকে বলে একটা আলগা চটক।

-জানিস তো আমি পরিস্থিতি অনুযাযী কথা বলতে পারি না। পরের লাইনগুলো মনে আছে?

-মাঠের ঘাসের ’পরে শৈশবের ঘ্রাণ-

পাড়াগাঁর পথে ক্ষান্ত উৎসবের এসেছে আহ্বান।

পরের লাইন দুটো আপন মনেই বললাম।

-এইতো সব মনে আছে। শালা মনে হয় বিশ বছর বাদে দ্যাখা হোলো।

-বলছিস, বিশ সাল বাদ? হেসে বললাম।

-বম্বে তে অফিসের কাজ?

সন্মতির মাথা নেড়ে বললাম – তুই?

-আমারও একই।  তা সংসার কেমন সামলছিস? নিজে কিছু করিস নাকি সবটাই নীরার উপর বডি ফেলেছিস?

হেসে ফেললাম,বললাম

-টিপিকাল বাঙালী। দ্যাখা হতে না হতেই হেঁসেলের খবর। বুঝলি এখন সব কিছু করতে পারি। একদিন তুই আর সব্যআমার বাড়ি আয় নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াবো।

-আমি একা গেলে নীরা তোকে বকবে নাকি? হাসতে থাকলো হিয়া। হাসলে হিয়ার গালে টোল পড়ে খুব সুন্দর লাগেতাকে মনটা হালকা লাগে। নিজেকে সামলে নিলাম।

-তোরা আসবি আমার বাড়িতে কেউ আপত্তি করবে ক্যানো?

একটু থেমে হিয়া বললো

-আমি সিঙ্গিল মাদার। দশ বছর আগে আমাদের ডিভোর্স হয়ে গ্যাছে সকাল।

আমি চুপ করে গেলাম। হিয়া নিজের প্লেটে চামচটা দিয়ে আঁকিবুকি কাটছে।

-কিছু বলবি না?

-কি বলবো বল? তোর জীবন, তোর সিদ্ধান্ত। ঠান্ডা পানীয়টাতে চুমুক দিয়ে বললাম।

-একদম।হিয়া হাসতে থাকলো।

একটু অবাক হলাম। একুশ বছর আগে এই একই উত্তরে হিয়া প্রতিক্রিয়া অন্যরকম ছিলো।

মনে হয় চল্লিশ বছর বয়সের পর মানুষ অনেক পাল্টে যায়। তার আনন্দ, রাগ, ইচ্ছা, অভিমানের বহি:প্রকাশ গুলোপাল্টে নেয়। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালাম।

-একটা সিগারেট খেয়ে আসি বুঝলি।

হিয়া হাসতে হাসতে বললো

-এখনও তোর পালানো স্বভাবটা তোর গ্যালোনা।

কথাটা গায়ে মাখলাম না। স্মোকিং রুমে সিগারেট খেলাম দুটো কারনে এক হিয়াকে ফেস করাটা বেশ মুশকিল, দুইপুরানো কথা আমাকে খুব বিরক্ত করে। অনেক কষ্টে সব ভুলেতে চেয়েছি। তাই একই শহরে থেকে কোনো বন্ধুর সাথে যোগাযোগ রাখিনি। হিয়ার ব্যাবহার সত্যি আমাকে অবাক করেছে। আমি ভাবতে পারিনি সে কোনোদিন আমারসাথে কথা বলবে! সে কি বুঝতে চাইছে আমি কতটা সুখে আছি। তার কি অন্যের সুখ খোঁজার রোগ সংক্রমণিত হয়েছে নাকি বয়সের সাথে সাথে সব অনুযোগ বিস্মৃত হয়েছে।

সিগারেট শেষ করে এসে দেখলাম-হিয়া একইভাবে বসে আছে।

-চল ফ্লাইটের টাইম হয়ে গ্যালো। বললাম।

হিয়া বেশ অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। চোখের ভাষা খোঁজার অভ্যাসটা অনেকদিন আগেই লুপ্ত হয়েছেআমার।

একটু শ্বাস ছেড়ে হিয়া বললো-চল।

আমরা দুজনেই সিট অ্যাডজাস্ট করে পাশাপাশি বসার অনুরোধটা কাউকেই করলাম না। নিজেদের সিটে গিয়ে বসে পরলাম।

ফ্লাইট ছাড়লো। উইন্ডো সিট থেকে বৃষ্টিস্নাত মুম্বাই শহর। আরব সাগরের পাশের রাস্তার আলো গুলো মনিহারেরমতন লাগছে। আস্তে আস্তে সবকিছুই চলে গ্যালো মেঘের আড়ালে। ঠিক যেন বিশ বছরের ঝলমলে স্মৃতী গুলোচলে গিয়েছিলো ব্যাস্ততার আড়ালে। হিয়ার হাসি যেন এক দমকা বাতাস, সব সরিয়ে স্পষ্ট করে দিয়েছে..।

ভীড়ে ঠাসা লোকাল ট্রেন।

কলেজ।

কফি হাউস।

ধর্মঘট।

হিয়ার হাসি।

রাস্তায় পড়ে থাকা মণিরুলের লাশ।

নীরা..

এবং আমি…

(২)

ঘটনা ক্রম গত শতাব্দীর শেষ দশক।

আমি সকাল মিত্র। সবে মাত্র উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে কোলকাতার কলেজে ভর্তি হয়েছি। শহরের ছেলে মেয়েদেরকাছে আমি মফস্বল শহর বারুইপুরের দোখনো মাল। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের এক মুখ চোরা সন্তান। কিছুদিন কলেজ যাবার পর বুঝলাম কলেজ স্টুডেন্ট বললে ট্রেনে টিকিট লাগে না কিংবা ট্রেনের কামরার মধ্য কিছু মানুষের নিজস্ব এলাকা থাকে-যেখানে ভীড়ের মধ্যেও তারা কাপড় পেতে তাস খেলতে পারে… ভুল তাসে খেউড় দিতে পারে অথবা দেশলাই কাঠি দিয়েও জায়গা রাখতে  পারে। এ সব যে মানিয়ে নিতে পারবে সেই হবে সিকান্দার আর যে মানাতে পারবে না সে হবে “বাল,এবং তার অবশ্যই খুব জটা হয়েছে”! আমি অবশ্য এখনও সিকান্দার হতে পারি নিতবে খুব দ্রুত মানিয়ে নিচ্ছি। নিম্নমধ্যবিত্ত দের রক্তে আছে মানিয়ে নেওয়া। বিরক্ত লাগলেও দাঁত কেলিয়ে থাকি।

কলেজে আমার বন্ধু বলতে মণিরুল-খুব ভালো ছেলে এবং বেশ বড়লোক। বড় লোক বাড়ির ছেলের জন্য আমার কলেজটি যেন বড্ড বেমানান। কথাটা একদিন বলেই ফেললাম

-মনি, তোকে কলেজে ইক্কেবারে মানাইছে নারে।

হেসে ফললো মণিরুল তারপর বললো

-উচ্চ মাধ্যমিকের আগে টাইফয়েড হয়-রেজাল্টটা ভোগে চলে যায়। আব্বু চাইলে পলিটিকাল ইনফ্লুয়েন্স খাটিয়ে ভালো কলেজে দিতে পারতো-দিলো না।

-তুই কিছু বলিস নি?

-হ্যাঁ বলেছিলাম। জানিস তো আব্বু বললো বুঝলি মণি নিজের হাতে ভাত খাবার মজাই আলাদা। অন্য কেউ খাইয়েদিলে পেট ভরে ঠিক কিন্তু তৃপ্তি আসে না।

-আফশোস হয় না তোর?

-প্রথমে হোতো, এখন আর হয় না। এখন ভাবি এখানে না আসলে জানতে পারতাম না কত প্রতিকুল অবস্থারমধ্যেও মানুষ ছুটে চলেছে, আনন্দের সাথে ছুটছে।

-ভাই এগুলোকে সহজ ভাষায় বালপনা বলে।

হেসে ফেললো মণিরুল।

-সমাজের কিছু মানুষ নয় বালই থাকলো, সকাল।

একটু থেমে বললো

-চল আজ  কফি হাউস থেকে ঘুরে আসি।

-দুর শালা, কে ডি র ইংলিশ ক্লাস আছে। বছরের শেষে অ্যাটেনডেন্সের জন্য কেস খাবো নাকি?

-হতভাগা এখনও বুঝলি না অ্যাটেনডেন্সের জন্য ক্লাস নয় ইউনিয়ন করতে হয়..চল.. তোকে আজ একজনের সাথেআলাপ করাবো।

কফি হাউসে আলাপ হোলো নীরার সাথে। খুব সুন্দর দেখতে নীরাকে। লম্বা, মুখটা পান পাতার মতন, ঠোঁট দুটো যেনযত্নে বানানো, নাকে একটা ছোট্ট তিল। একবার তাকালে চোখ সরানো মুশকিল।

কবিরাজি, ব্ল্যাক কফি অর্ডার দিলো মণিরুল।

-তা আমার গার্ল ফেন্ড কে কেমন লাগলো?

একটু অবাক হয়ে তাকালাম মণিরুলের দিকে।

নীরা বললো

-কি ভাবছেন? মুসলিম ছেলের হিন্দু গার্লফেন্ড কি করে হোলো?

মণিরুল সিগারেটের ধোয়া ছেড়ে বললো

-সকাল, ধর্মটা শাসকের এক শোষণ যন্ত্র। সুনীল ডাট যদি নার্গিসকে বিয়ে করলে সমাজের অসুবিধা নেই কিন্তুসকাল মিত্র যদি রুকসারা কে বিয়ে করে সবাই ছি ছি করবে। আসলে সব নিয়মই মধ্যবিত্ত দের জন্য। উচ্চবিত্ত এবং নিম্নবিত্তরা অনেক উদার এবং স্বাধীন।

মণিরুলকে বেশ অচেনা লাগছে। তারপর তারা দুজনে কত সব আলোচনা করলো। বুঝতে পারছি মণিরুল রাজনৈতিক ভাবে ভীষণ সচেতন। পাক্কা দু’ঘন্টা বাদে আমরা যখন উঠছি

-নীরা, আজ  সকাল কিন্তু খুব বোর হোলো।

নীরা হেসে বললো, কি সকাল মণি সত্যি বলছে নাকি?

কি উত্তর দেবো,সত্যি আমার খুব বিরক্ত লেগেছে।

-আচ্ছা পরেরদিন আমি আমার বান্ধবী নিয়ে আসবো। ভারি মিষ্টি দেখে। হেসে বললো নীরা।

(৩)

মণিরুলের সাথে বেশ কয়েকবার তার পার্টি ক্লাসে গেলাম। সবাই বেশ মিষ্টি মিষ্টি করে দিন বদলের কথা বলে। আমার মনে মনে বেশ হাসি পায়। সবাই কিন্তু মুগ্ধ হয়ে শোনে, কেউ কেউ আবার নানা প্রশ্নও করে। আমি যেতাম দুটোকারনে- এক, নীরাকে দেখতে পাবো; দুই,মণিরুলের সাথে থাকলে নিখরচায় ভালো ভালো রেস্টুরেন্টে খাওয়ার সুযোগ থাকে। তবে কিছুদিন পরে বুঝলাম মণিরুলেরও একটা মিহি স্বার্থ আছে। সে সারাজীবন শহরে মানুষ, এমন কিকোনো দিন লোকাল ট্রেনেও সে ওঠেনি। তাই ও আমার চোখ দিয়ে মফস্বল দেখতে চায়- আমাদের সুখ, দুঃখ, সন্ধ্যকালীন লো ভোল্টেজ, জলে সেঁকো বিষ সব কিছু। মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগতো, কিন্তু মুখে কিছু বলতামনা। এইভাবে চলতে থাকলো বেশ কয়েক মাস। তারপর মণিরুলের পার্টি ক্লাস আমার জীবনকে এক আজানা রাস্তায় চালোনা করলো।

হিয়া সেন।

পার্টি ক্লাসে ও হাল যে আমার মতন বুঝতে পারতাম। মধ্যমগ্রাম না হৃদয়পুর থেকে আসে। নীরার মতন উজ্জ্বল নয়তবু আলাদা করে উপস্থিতি আমি টের পাই। আমার মতন ই চুপচাপ,মনে কোনো প্রশ্ন নেই। আসলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের প্রশ্ন নয় উত্তর শেখায়। হলফ করে বলতে পারি A for বললে নব্বই শতাংশ লোক Apple বলবে, কারণ আমরা উত্তরটা শিখেছি- A for Apple,B for Ball,C for Cat!

প্রায়ই মানিকতলার পার্টি ক্লাস শেষে দুজনে বাস ধরে শিয়ালদায় আসি। ওর সাথে কথা বিশেষ বলি না-সত্যি কথা বলতে মেয়েদের সাথে কথা বলতে ভয় লাগে। একদিন শিয়ালদা ফ্লাই ওভারের নীচে তুমুল বৃষ্টিতে দাড়িয়ে আছি

-লস্যি খাবে? হিয়া বললো।

অবাক হলাম, তার থেকেও বেশী দুশ্চিন্তায় পড়লাম মানিব্যাগে কতটাকা পড়ে আছে? না হলে ব্যাগের এর্মাজেন্সি ফান্ডে হাত পড়বে।

-চলো আমি খাওয়াচ্ছি। হিয়া হয়তো বুঝতে পেরেছে।

পৌরুষে আঘাত লাগলেও, জীবনে প্রথমবার এক অচেনা নারীর সঙ্গের লোভটা ছাড়তে পারলাম না।

-তুমি এখানে ক্যানো আসো সকাল? খুব সহজ প্রশ্ন তবু কিছুক্ষণ ভেবে বললাম

-এমনি আসি, ভালো লাগে তাই।

-কাকে ভালো লাগে নীরাকে? হাসতে হাসতে বললো হিয়া।

-না বললে মিথ্যা কথা বলা হবে।

জোরে জোরে হাসতে থাকলো হিয়া। হাসলে হিয়া গালে একটা টোল পড়ে, খুব সুন্দর দ্যাখায় তখন। হিয়া মনে হয় ব্যাপারটা বোঝে, তাই সব সময় একটা হাসি হাসি মুখ করে রাখে।

-তুমি ক্যানো আসো হিয়া?

-স্বপ্ন শুনতে, যদিও জানি এ স্বপ্ন কোনোদিন পূর্ণ হবে না তবু শুনতে বেশ লাগে।

-স্বপ্ন দেখলেই হয় না, সেটা সফল করতে একটা পরিবেশ তৈরী করতে হয়। এরা স্বপ্ন সফল হলে কি হবে সেটা বলছেকিন্তু পরিবেশ তৈরী করার ব্যাপারে কনফিউসড।

-বাহ তুমি খুব সুন্দর কথা বলোতো?

-হিয়া আমার ওজন বেড়ে যাবে,এতো গ্যাস দিও না।

-চারিদিকে এখন সকাল—

রোদের নরম রং শিশুর গালের মতো লাল;

কার লেখা জানো?

-না না সাহিত্যে আমার বিদ্যে বলতে ইস্কুলের টেক্সট বই।

হিয়া ব্যাগের ভিতরটা হাতরে একটা বই বার করে আমার হাতে দিলো “ধূসর পান্ডুলিপি” জীবনানন্দ দাশ, এনারলেখা।

-ও এঁনার রুপসি বাংলা সিলেবাসে ছিলো বটে, বড্ড কঠিন বাদ দিয়েছিলাম।

-এখন পড়তে পারো, পরীক্ষার জন্য না এবার নিজের জন্য পড়ো দেখবে ভালো লাগবে।

বই টা একটু উল্টে পাল্টে দেখলাম। জানি কিছু বুঝবো না তবু নিলাম। নীরা না হোক হিয়াই হোক।

-বই টা কিন্তু ফেরৎ যোগ্য।

-অবশ্যই। আমি জানি বই,বউ,ক্যাসেট কাউকে দিলে ফেরৎ আসে না। তুমি নিশ্চিন্তে থেকো।

বৃষ্টি থেমেছে দুজনে দুদিকে চলে গেলাম। মনটা বেশ ভালো লাগছে।

(৪)

কিছু দিন মধ্যই আমার হিয়ার মাঝে এলো হিয়া। কয়েকমাসের মধ্যেই অনেক লেখকেই পড়লাম-নিজের জন্য। দারুণ উপলব্ধি, মনে হয় আমার প্রিয় সুনীল বাবু কিংবা শক্তি বাবু যেন আমার জন্যই লিখেছেন। আমি যেন  একআজানা প্রতিযোগিতায় নেমেছি, হিয়ার “প্রিয় বন্ধু” হয়ে ওঠার জন্য। হিয়াকে উপহার দিতে ইচ্ছে করে ভীষণ ভাবেনিজের উপার্জনে। টিউশানির পয়সায় হিয়াকে প্রথম উপহার দিলাম সবিনয় নিবেদন। বুদ্ধ বাবু যেন তার প্রেমিকহৃদয়টা নিংড়ে লিখেছেন। মণিরুল,নীরা এখন একটু বেশী দুরে চলে গ্যাছে। মণিরুলকে আজকাল চিনতে কষ্ট হয়। মাঝে মাঝেই উধাও হয়ে যায়। ফিরে এসে বর্ধমান, বীরভূম জেলার প্রান্তিক মানুষদের কথা বলে-মিথ্যা বলবো নাআগের মতন বিরক্তি লাগে না।

হিয়া বলে “বই পড়লে মনের ভিতরের অনেক সূক্ষ্ন অনুভুতি পুষ্টি পেয়ে তর তর করে বেড়ে ওঠে। অনেক রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে চোখের কোণ আর্দ্র হয়। তখন বুঝবে তুমি প্রেমিক হয়ে উঠছো, আর ভালো প্রেমিক না হলে ভালো মানুষ হতে পারবে না।” জীবনটা চলছে দারুণভাবে- যেন কিশোর কুমারের রোমান্টিক ক্যাসেট। তবে মনের ভিতর একটা ভয়ও সমান্তরালভাবে চলছে-ক্যাসেটের রিল জড়ানোর ভয়।

আমাদের পাড়ায় একজনের বাড়িতে ফোন আছে- মণ্ডলবাড়ি। চাকরি পাওয়া কিংবা বাড়িতে নতুন অতিথি আসারখবর আসতো ডাকে কিন্তু দু’সংবাদ আসতো ফোনে। মানুষ খারাপ খবর মনে হয় তাড়াতাড়ি ছড়াতে চায়। ছোটনমানে মন্ডল কাকুর ছেলে এক ছুটে গিয়ে সঠিক বাড়িতে গিয়ে খবর দিয়ে আসে। এক সন্ধ্যাবেলায় ছোটনের ডাক এলো আমাদের বাড়িতে।

-পাপু দার ফোন। ফোনটা ধরে আছে মেয়েটা, পাপুদার সাথেই কথা বলবে।

মফস্বল শহরে অন্যের বাড়িতে মেয়ের ফোন আসা আনবিক বোমা বিস্ফোরণের চেয়ে কম কিছু নয়। মনে মনেঅজুহাতের বর্ণনা সাজাতে থাকলাম। না কিছুই সাজাতে হোলো না।

হিয়ার ফোন। এক্ষুনি মোমিনপুর যেতে হবে। মণিরুলের কথা বাড়িতে জানতো। মা যে দু একবার ওর সাথে মিশতেনিষেধ করেনি তা নয়। তবু খবরটা শোনার পর পাঁচশ টাকার নোট বার করে দিয়ে বললো-দরকারে খরচ করিস।

বারুইপুর থেকে ট্রেনে বালিগঞ্জ সেখান থেকে অটো করে পৌঁছালাম মোমিনপুরে মর্গে। পার্টির বেশ কয়েকজন,মণিরুলের বাড়ির লোকজন, হিয়া এবং নীরা। নীরা কাছে গেলাম, চোখে এক ফোঁটা জল নেই, হেসে বললো

-অ্যক্সিডেন্টের পর রাস্তার উপর তিন ঘন্টা পড়ে ছিলো, পুলিশ ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি। এই দেশের লোকদেরজন্য আমরা এতো ভাবতাম? এরা এসবের যোগ্য সকাল?

চুপ করে থাকলাম, মনে মনে ভাবলাম যোগ্য তো কেউ হয় না যোগ্য করার জন্য পরিবেশের তৈরী করতে হয়। নতুনবাইপাস দুপুরে রানওভার হয় মণিরুল প্রায় দেড় ঘন্টা বাদে পুলিশ খবর পায় তারপর সন্ধ্যায় হাসপাতলে নিয়ে যেতে মারা যায় মণিরুল। মনে মনে ভাবছিলাম, কত কষ্ট পেয়েছে মণিরুল, হয়তো একসময় সে নিজের মৃত্যুওকামনাও করেছে প্রাণপণে। সত্যি কি আমারা মণিরুলের যৌথ খামারের যোগ্য?

মাঝরাত নাগাদ মণিরুল এলো সাদা কাপড়ে মুড়ে। সামলানো মুশকিল তবু নিজেকে সামলে নিলাম। তারপর মণিরুলের বাড়িতে গেলাম সেখান থেকে কবরস্থানে। ঘটনা গুলোতে নীরাকে অস্বাভাবিকরকম স্বাভাবিক লাগলো।

পরেরদিন সকালে খুব কাছের এক বন্ধুকে হারিয়ে ফিরলাম বাড়িতে।

মণিরুল আমার স্বাভাব ছিলো, ওর মৃত্যুর পর সবকিছুর মধ্যেই তাকে কে খুঁজে বেড়াতাম। মানুষের ক্ষত কিংবা নিজের স্বভাব ভুলে যাবার মোক্ষম ওষুধ-সময়। সময় মানুষকে সব ভুলিয়ে দ্যায়। হিয়া, গ্রাজুয়েশনের পরীক্ষা, টিউশানি, চাকরির চিন্তা সব ভুলিয়ে দিলো।

নীরাও কোথায় যেন উধাও হয়ে গ্যালো। কলেজ, পার্টি ক্লাস, কফি হাউস থেকে হারিয়ে গ্যালো নীরা। তারপর আস্তেআস্তে আমার মন থেকে উবে গ্যালো সে।

অন্ধকারে হাতড়ে চলা কিছু হারানো শব্দ
অন্তমিলের ছুতোয় ভুলতে বসা কিছু গদ্য
সময়ের মাঝে ভুলে যাওয়া প্রিয় বন্ধুর হাসি
টাটকা বর্তমান ছাড়া সবই কিছুই শীতল, বাসি।

(৫)

গ্রাজুয়েট হলাম। পাড়ার দাদাকে ধরে একটা চাকরিও জুটলো। বিখ্যাত ফার্মা কোম্পানীর সেলেস-এ। পোস্টিং-মেচেদা, মেদিনীপুর। বারুইপুর থেকে মেচেদার দূরত্ব বেশ অনেকটা-তাই আপাতত আমি মেচেদাবাসী-বাড়ি ছেড়ে প্রথমবার।

বাগনান..

দেউলটি…

কোলাঘাট….

মেচেদা….।

দেউলটি এবং কোলাঘাটের মাঝে এক বিশাল নদ-রূপ নারায়ণ। হাওড়া এবং মেদিনীপুর জেলাটাকে আলাদা করেছে।

আমার মেস থেকে রূপনারায়ণ নদটা খুব কাছে। বর্ষাকালে দেখলে ভয়ে বুক শুকিয়ে যায়। আমার মনে পৃথিবীর প্রলয় বা ভয়ঙ্কর যা কিছু তারা সবাই পুরুষ। দামোদর, রূপনারায়ণ কিংবা অজয় নদ বর্ষায় তিনজনই ভয়ঙ্কর। নদীর একটা মায়া মমতা আছে, কিন্তু নদগুলো যেন পিশাচ, সর্বগ্রাসী। আমার মেসের আর একটি বৈশিষ্ট্য আছে-আমারজানলাটা দিয়ে দেখা যায় কে.টি.পি.পি তাপবিদ্যুত কেন্দ্রের ছয়টা চুল্লি, যারা নিজেরা সারাদিন জ্বলে সারা বাংলাকে আলো দ্যায়। সারা ঘর জুড়ে ফ্লাই অ্যাশ,  পুকুরগুলোতে ফ্লাই অ্যাশে মৃত মাছ,নিশ্বাসে ফ্লাই অ্যাশ সঙ্গে হাঁপানির উপহার। তবু মানব সভ্যতার নিরিখে এসবই তুচ্ছ এবং সামান্য।

হিয়া পড়াশুনার পাশাপাশি একটা চাকরি পেয়েছে। অফিস পুরবী সিনেমার কাছে। প্রতি শনিবার হাওড়া থেকে চুয়াল্লিশ নম্বর বাসে চেপে পুরবী সিনেমার কাছে নামতাম। দুজনে সূর্ষ সেন স্ট্রিট ধরে হাঁটতাম। সন্ধ্যাবেলাতে এইরাস্তায় হাঁটতে বেশ লাগতো। চুপ করে, হাতে হাত ধরে। মনে হয় স্পর্শের মধ্যে দিয়েই আমাদের ভাব আদান প্রদানহতো। এটাই রুটিন ছিলো- কিন্তু সব রুটিনই এক ঘেয়ে যায় মনে হয়।

মার্চের শেষ সপ্তাহ। জেলাতে কোম্পানির ‘খাটিয়ে’ ছেলে বলে নামও হয়েছে খানিকটা। হিয়াকে ফোন করে (অফিসেরফোন) জানিয়ে দিলাম এই সপ্তাহে শনিবার রুটিনের ছুটি-এ সপ্তাহে আর বাড়ি ফিরছি না-কোম্পানির ইয়ার এনডিং চলছে। শনিবার অনেক রাত অবধি কাজ করতে হোলো।

পরদিন রবিবার পুরোটাই আগে থেকেই সাজানো ছিলো। সকালে জামা-কাপড় কাচা,   দুপুরটা রেস্টুরেন্টে এ তারপর মানসী সিনেমা হলে ইভনিং শো। সময়টার তাল কাটলো মেসে ফেরার সময়- ট্রেকার ধরবো বলে মেচেদা স্টেশনের সামনে লাইন দিয়েছি।

-সকাল মিত্র?

লাইনের পিছন থেকে ডাকটা এলো।

ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম..

নীরা…!

(৬)

নীরা কেটি পিপি টাউনশিপে থাকে তার মামাদের সাথে। আমি, নীরা এবং বহ্নি (নীরার মামাতো বোন) এক সাথে ট্রেকারে উঠলাম।

-কেমন আছো নীরা?

-দারুণ আছি। তুমি এখানে?

গত দু-তিন বছরের কথাগুলো দু’মিনিটে সারলাম। কলেজ, চাকরি, কোলাঘাটের মেস সবই কিছু বললাম। ঘটনাক্রমে মণিরুল, হিয়া দুজনকেই এড়িয়ে গেলাম সাবধানে। এই কছর সে কি করেছে কোথায় ছিলো কিছুই জিজ্ঞাসা অবশ্য করলাম না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই নীরা স্টপ এলো ট্রেকার থেকে নেমে পড়লো দুজনে। নীরা বললো

-অসুবিধা না থাকলে সামনের রবিবার একবার আমাদের বাড়িতে এসো।

-না না অসুবিধার কি আছে।

-ফোন নাম্বারটা রাখো, এক বার জানিয়ে দিও।

মেইন রাস্তা থেকে টাউনশিপের রাস্তাটা একটু নীচুতে। সেই দু-রাস্তার মাঝখানের রাস্তাটা ঢালু। সোডিয়ামের হলুদ আলোতে ভেজা, রক্ত পলাশে ঢাকা রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে এগিয়ে গ্যালো নীরা।

পরের রবিবারের সন্ধ্যায় গেলাম নীরার বাড়িতে। হালকা জলযোগের একটু হাঁটতে বেরোলাম দুজনে। পরিপাটি টাউনশিপ। পাকা পিচ রাস্তা, দুধারে গাছগুলো মাখামাখি করে রাস্তাগুলো এক আলো আঁধারির সৃষ্টি করেছে।

টাউনসিপের মধ্যেই এক মিনি মার্কেটে বসলাম দুজনে। খাবারের অর্ডার দিলাম। নীরবতা ভাঙলো নীরাই

-সকাল জিঞ্জাস করবে না এতোদিন কোথায় ছিলাম?

-না।জেনে কিছু লাভ আছে?

নীরা মনে হয় একটু হতাশ হোলো। বললো

-সত্যি তো তোমার কি লাভ। আমি তো এখন অনেক দুরে চলে গেছি।

-না তা কেন? তোমরা দুজনেই আমার কাছে ছিলে নীরা। কিন্তু সব পুরানো স্মৃতি মনে রাখতে নেই।

-মণি এভাবে চলে যাবে ভাবতে পারিনি।

এর কোনো উত্তর নেই আমার কাছে।আমার হাত দুটো ধরে নীরা বললো

-সকাল, তুমি কি বিশ্বাস করো আমার জন্য মণির মৃত্যু হয়েছে?

-ধুর কি সব বলছো, তুমি কেন দায়ি হবে?

-তবে কেন সবাই বলতো? আমি ওকে শুধু মানুষের কষ্টটা বুঝতে বলেছিলাম। বলতে পারো আমার জন্য ওর রাজনীতিতে আসা।

-তার সাথে মণির মৃত্যুর কি সম্পর্ক? অবাক হয়ে বললাম।

-কিন্তু ওর বাড়ির লোক যে বললো আমি নাকি মণিকে খেয়েছি।

-নীরা শোক মানুষকে বদলে দ্যায়।

-আমি কিন্তু অনেকের মৃত্যুর কারন। জীবনে অনেককে খেয়েছি।

আমি ভাবতে পারিনি নীরার মতন একজন প্রগতিশীল মেয়ে এভাবে কথাগুলো বলবে। সময় হয়তো সব মানুষকে পাল্টে দ্যায়।

-তুমি আমার সাথে দ্যাখা কোরো না.. তুমিও হয়তো?

-আমি এসব মানি না নীরা। দ্যাখা করাটা তোমার ব্যাপার, আমার কোনো অসুবিধা নেই।

খাওয়া দাওয়া শেষে নীরাকে তার কোয়ার্টারে পৌছে দিলাম। মনটা বড্ড ভারী হয়ে গ্যালো। নীরা অনেকদিন বাদে সবকিছু যেন উসকে দিলো।

বহ্নির অনুরোধে একদিন তাকে ফোন করলাম। শুনলাম নীরার জীবনের অনেক ইতিহাস। জন্মের পর পর নীরা তারমা হারিয়েছে। মাধ্যমিকের সময় তার প্রিয় দাদা সুইসাইড করে। তারপর মণিরুল..এতোগুলো মৃত্যু সে মেনে নিতে পারেনি। সব মৃত্যুর পিছনে কারণ হিসাবে নিজেকেই দায়ি করতে থাকে। মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে, সুইসাইডের চেষ্টা করে। পরিস্থিতি সামাল দিতে নীরাকে ভর্তি করতে হয় মানসিক হাসপাতালে। তিন মাস আগে ছাড়া পেলেও তার ওষুধ চলছে, হয়তো চলবে সারা জীবন। বহ্নি বললো, মেচেদায় আমার সাথে দ্যাখা হবার পর নীরার কিছু বদল এসেছে, সে যেন বাঁচতে চাইছে।

সপ্তাহের শেষে হিয়ার সাথে দ্যাখা করলাম। নীরার ঘটনাক্রমগুলো সব খুঁটিয়ে বললাম। হিয়া প্রথমে কিছুক্ষণ উৎসাহ নিয়ে শুনলো, তারপর ব্যাপারগুলো নিয়ে তার শীতলতা আমাকে অস্বস্থি বাড়ালো।

মার্চের পর প্রমোশন পেলাম। সঙ্গে কলকাতা বদলির চিঠি। কিন্তু বদলিটা নিলাম না। হয়তো নীরার জন্য…

(৭)

হিয়া আর আমার সম্পর্কটা নিয়ে নীরাকে অনেকবার বলার চেষ্টা করেছি। বলতে পারিনি। জানিনা সেটা নীরামানসিক অবস্থার ভয়ে নাকি তাকে হারানোর ভয়।

মেস মাসে মেসবাড়িটা ছাড়লাম। নতুন বাড়ি ভাড়া নিলাম। দু কামরার ঘর। দুজন বাসিন্দার ঘর। আমি এবং আমার এক কলিগ। যেদিন আমি নতুন বাসায় এলাম, নীরা এসেছিলো। ঘরের পর্দা, বেডসিট, তোয়ালে সবই কেনা হোলোনীরা পছন্দ অনুযাযী। সবকিছু মেটাতে সন্ধ্যা হয়ে গ্যালো।

-চলো নীরা তোমাকে বাড়ি দিয়ে আসি।

একটু চুপ থেকে নীরা বললো।

-কাল অফিসের ছুটি নিতে পারবে সকাল?

-নিতে পারি কিন্তু ক্যানো নেবো? হেসে বললাম।

-চলো কাল সকালে দীঘা যাবো।

চুপ করে গেলাম। এই প্রস্তাবটা আশা করিনি।

-ভয় নেই তোমায় রেপ করবো না। হাসতে থাকলো নীরা।

-না সে ঠিক আছে..যা গরম। লোকে না বিরল জীব বলে খাঁচায় ভরে দ্যায়।

নীরা কি যেন ভাবলো, তারপর বললো

-তাহলে একটা শর্ত যাওয়া হবে- আজ রাতে যদি বৃষ্টি হয় কাল সকাল ন’টায় গাড়ি নিয়ে তোমার বাড়ির সামনে।

আকাশের দিকে তাকালাম। ভেড়ার লোমের মতন তারা ঠাসা আকাশ। কিছু বললাম না শুধু একটু হাসলাম।

বৃষ্টি শুরু হোলো মাঝ রাত থেকে অঝোর ধারে। যেন কারুর অদৃশ্য আদেশ পালন করছে। সকালেও আকাশের মুখভার। ঠিক নটার সময় গাড়ি নিয়ে হাজির সামনে ড্রাইভার বহ্নি এবং বান্ধবী সোমদত্তা এবং পিছনের সিটে নীরা।

মুচকি হেসে বললো

-শুভ সকাল, ওয়েদারটা কেমন সেট করলাম। কথায় কথায় তমলুক, নন্দকুমার, কাথি চলে গ্যালো। গাড়িটা থামলো দীঘায় নয়, অপেক্ষাকৃত জন বিরল শঙ্করপুর সৈকতে। সমুদ্রের সামনে নাকি মানুষের মন উদার হয়ে যায়। হালকা বৃষ্টি পড়ছে মাঝে মাঝে, সামনে ধুসর বিশাল সমুদ্র, সঙ্গে এলোমেলো বাতাস। নীরার বিলাসী চুল গুলো বার বার তারমুখে এসে পড়ছে। বিরক্ত না হয়ে নীরা তাদের সরিয়ে দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে তাদের অধিকারের সীমা।

-চলো একটু হেঁটে আসি। নীরা বললো।

পাশাপাশি হাঁটছি। ঢেউগুলো আমাদের ধুয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে। বৃষ্টি আরম্ভ হোলো। এবার একটু জোরে।

-চলো নীরা, তুমি ভিজে যাবে। আমার দিকে তাকিয়ে বললো

-ওই দ্যাখো একটা ঝিনুক। সমুদ্রটা ওকে এখানে রেখে চলে গ্যাছে। কিন্তু দ্যাখো ও এখানেই বসে আছে যদি আবার ফিরিয়ে নিয়ে যায়। হয়তো একটু অভিমানী। কিন্তু সমুদ্র এক বার আসলেই আবার ফিরে যাবে। আমিও ফিরতে চাই সকাল। শেষ ইচ্ছে টুকু দিয়ে ফিরতে চাই সকাল।

একটু থেমে বললো-চলো ফিরে যাই। তুমি একদম ভিজে গ্যাছো।

-না থাক ফিরে কি হবে বরং আজ একটু বৃষ্টিতে ভিজি। বললাম।

-গোগ্রাসে ছুটে চলা এক শহর/বৃষ্টি স্নাত তার রাস্তাঘাট, ডহর/Raincort এ লুকিয়েছি অনেক ইচ্ছে সুপ্ত/হাঁটা হয়নি যেপথ, কথাও রয়েছে অব্যক্ত।

-মণির লেখা। বললাম।

নীরা প্রবল চিৎকার বললো

-আমি মণিকে মারিনি সকাল..আমি কাউকে মারিনি..।

 ইতস্তত ভাবটা কাটিয়ে নীরারে জড়িয়ে ধরে বললাম-আমি জানি তুমি কাউকে মারোনি নীরা।

ঠোঁটটা ছোয়ালাম ঠোঁটে। কিছু থমকে সাড়া দিলো নীরা।

চুম্বনের স্বাদ জানি না, তার ঘনত্ব ও জানা নেই। সমুদ্রের নোনতা বাতাস, বৃষ্টির জল, চোখের জল, নীরার ঠোঁট যেন মিলে মিশে একাকার। কেমন একটা যেন ঘোরের মধ্য রইলাম।

ঘোরটা কাটলো, ভীষণ একটা অপরাধবোধ কাজ করছে মনের মধ্যে। স্থির করলাম, হিয়ার সাথে আমার সম্পর্কটা নীরাকে জানাতেই হবে। আমি এটা দুজনের সাথেই অন্যায় করছি। আমি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি নীরা কাছে অপরাধ স্বীকার করার জন্য। আমি জানিনা এর প্রতিক্রিয়া কি হবে- তবু আমাকে বলতেই হবে।

মে মাসে আমার জন্মদিন। ছোট থেকে কোনোদিন কেক পর্যন্ত কাটিনি। এই প্রথম বার। নিমন্ত্রিত বলতে- হিয়া আসবে কলকাতা থেকে, নীরা, বহ্নি এবং আমার অফিসের কয়েক জন। হিয়া নামটা শুনে নীরার কোনো প্রতিক্রিয়া আন্দাজকরতে পারলাম।

জন্মদিনের সন্ধ্যা বেলা। হিয়া আমার জন্য নতুন জামা কিনেছে। কলিগদের বিভিন্ন উপহার। কেক কাটার সময় আগত নীরা কিংবা বহ্নির কারুর দ্যাখা নেই। অনুযোগী মনে কেক কাটলাম। ঝড়ের গতিতে বহ্নি ঢুকলো বাড়িতে।

-সকাল দা, তুমি আমাদের বাড়িতে যেতে পারবে? দিদি ভাই এর খুব শরীর খারাপ। তোমার কথা খুব বলছে।

কিংকর্তব্যবিমূঢ কথাটি বইতে পড়েছিলাম, আজ উপলব্ধি করলাম।

বহ্নির পৌনপনিক অনুরোধ না রেখে উপায় ছিলো না। হিয়ার দিকে তাকালাম।

বললো-

-তোমার এখনই যাবার দরকার আছে সকাল?

-মানুষের জীবন কি এই উৎসবের থেকেও কি জরুরি?

-তা ঠিক। একটু দাঁড়াও আমি রেডি হয়ে আসছি। আমাকে স্টেশন অবধি এগিয়ে দাও।

মেচেদা স্টেশনের সামনে হিয়া একটা হলুদ খাম বার করে আমার হাতে দিয়ে বললো-সময় নিয়ে পড়ো।

নীরার বাড়ি পৌঁছলাম। গভীর ঘুমে আছন্ন। ঘুমের ওষুধের আবেশ। হালকা আলোতে নীরাকে খুব স্নিগ্ধ লাগছে। কতক্ষণ নীরা পাশে তার হাত দুটো ধরে বসেছিলাম জানিনা। অনেক রাতে বাড়ি ফিরলাম। সাজানো বাড়িটা কে দেখে বিরক্ত লাগছে। ঘটনারক্রমে পকেটের হিয়ার চিঠির কথাটা ভুলেই গেছিলাম। পড়তে বসলাম চিঠিটা

প্রিয় সকাল,

আজ আমি এখানে থাকবো বলে এসেছিলাম। তুমি বলোনি তাও। রাতে পরার পাজামা, জামা নিয়ে এসেছিলাম। সকালের দাঁত মাজার ব্রাশ ছিলো সাথে। ভেবেছিলাম তোমার সাথে সারা রাত গল্প করবো। এই দিনটার জন্য মা এরকাছে দরবার করেছি গত দু মাস থেকে। কিছু মনে কোরো না সকাল তুমি কিছুটা হলেও পাল্টে গ্যাছো। বলছি না তুমিখারাপ হয়ে গ্যাছো। খারাপ ভালো তো আপেক্ষিক। তুমি লক্ষও করোনি আমি তোমার দেওয়া শাড়িটা পরে এসেছিলাম। তুমি মেচেদা স্টেশনে যদি একবার বলো-হিয়া চলো একসাথে নীরার বাড়ি যাবো। আমি তোমার সাথেচলে যাবো। আর যদি কিছু না বলো তাহলেও যাবো, তোমার জীবন থেকে। মন বলছে দ্বিতীয়টাই হবে। নীরা কেতোমার দরকার। তুমি খুব ভালো ছেলে সকাল। নীরাকে নিয়ে ভালো থেকো।

ইতি

হিয়া

চিঠি পড়লাম বেশ কয়েকবার। পরদিন ভোর বেলাতেই ছুটে গেলাম হিয়া’র বাড়িতে। দ্যাখা করলো না হিয়া। পর পর পাঁচদিন গেলাম। তারপর সপ্তাহে একদিন… পনেরোদিনে একদিন..মাসে একদিন…। না হিয়া আর দেখাই করলো না। ছয় মাস পরে শুনলাম হিয়ার বিয়ে ঠিক। কলেজে এক সাথে পড়তো সব্যসাচী।

 নীরা মানসিক হাসপাতলে ভর্তি। প্রতি রবিবার নিয়ম করে দ্যাখা করতে যেতাম। দুজনে পাশাপাশি হাঁটতাম অনেকক্ষণ ধরে। একদিন বললো

-আমি আর ফিরতে পারবো না সকাল। সব ঝিনুক সমুদ্রে ফেরত যায় না।

(৮)

প্লেনটা শব্দ করে নামলো কলকাতায়। ফিরে এলাম নিজের মধ্যে। বিমানবন্দরের বাইরে দাড়িয়ে। মনটা যবুথবু। উবেরবুক করবো ভাবছি। একটা গাড়ি এসে দাঁড়ালো।

-উঠে পড়। আমি পাটুলি যাবো। তোকে কোথাও ছেড়ে দিচ্ছি।

দুজনেই চুপচাপ। গাড়িটা রুবির সিগনাল ক্রশ করতেই বললাম

-এবার নামবো।

-নীরা কে কেমন দেখতে হয়েছে রে? একটা ফটো ও দ্যাখালি না।

-একইরকম আছে বাইশ বছরের তরুণী।

-ইয়ার্কি মারছিস?

-তোর সাথে কি ইয়ার্কির সম্পর্ক আমার? একটু থেমে বললাম

-মৃত মানুষের বয়স, রূপ সব এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকে।

-মানে? নীরা..

-ভাই গাড়ি সাইড করুন, নামবো।

হালকা বৃষ্টি, এলোমেলো হাওয়া হচ্ছে। একটা সিগারেট ধরালাম। পিছনে ভেসে উঠছে

মানসিক হাসপাতাল..

নীল পোশাক..

সিলিং..

নীরা..

এবং

মেঝের ব্যবধানে ঝুলতে থাকা আস্ত শরীরটা।

কুম্ভকর্ণ (ছদ্মনাম)। লেখক। জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। পেশায় প্রকৌশলী।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..