প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
শীতের সন্ধ্যাটা বিষন্নতায় ভরা। মনখারাপ করা একরাশ যন্ত্রণার বিতান। এমনিতে শীতের দিনে সূর্যের দেখা পাওয়া ভার। পাঁচটা বাজলেই ঘন অন্ধকার নামে। দিনের শুরু হতে-হতে সূর্যটা হঠাৎ করে পালিয়ে যায়। শীত-আকাশের গুরুগাম্ভীর্যতায় কখন সকাল; কখন দুপুর; কখন সন্ধ্যা- কিছুই বোঝা যায় না। বিকেল তো খুঁজেই পাওয়া যায় না! এতো ছোট দিন যে; সময়ের সাথে আর তাল মেলে না। কানাডার শীতটাই এমন! সবকিছু এলোমেলো করে দেয়, এলোমেলো করে মনের গতিবিধি; বৈকল্য এসে ভর করে তাতে।
মিতুল মন খারাপ করে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। আজ কাজ থেকে একটু আগেভাগেই চলে এসেছে। জামান আসবে আরো ঘন্টাখানেক পরে। বসার রুমে এসে সোফায় হেলান দিয়ে অলসভঙ্গিতে ল্যাপটপটা কোলে নিয়ে বসে। ল্যাপটপ খোলা মানেই; ফেইসবুক খুলে বসা। হোমপেজ দেখছে আর ইনবক্সে কিছু ম্যাসেজের রিপ্লাই দিচ্ছে। অনাহুত সব প্রশ্ন ইনবক্সজুড়ে। জবাব না দিলেও এমনকিছু এসে যায় না। আজ কী মনে করে মিতুল অনেকের কথার জবাব দিয়ে যাচ্ছে। এমনকী মিসেস শরিফ; যাকে মিতুল সবসময় এড়িয়ে চলে- তার ম্যাসেজের উওরও দিচ্ছে। মিসেস শরিফ মিতুলদের আশেপাশে কোথায় যেন থাকেন। নিজ থেকেই তার তথ্য জানিয়েছিলেন। নিজেকে সেলিব্রেটি মনে করেন। কোনো একসময় বাংলাদেশ বেতারে গান করতেন । এখন শীতদেশে এসে বরফে জমে গেছেন; তাই কণ্ঠে গান আর আসে না। মিতুল তার সাথে কী কথা বলবে খুঁজে পায় না। কেমন একটা সঙ্কোচ কাজ করে। অথচ আজ তার কী হলো, কথার পৃষ্ঠে কথা বলেই যাচ্ছে!
–শুভ সন্ধ্যা মিতুল। কেমন আছো?
–শুভ সন্ধ্যা আপা। ভালো আছি। আপনি?
–আমি ভালো আছি। কী করছো সন্ধ্যায়?
—কিছু না আপা। জামানের অপেক্ষা করছি।
–ও আচ্ছা। একদিন আসো না- আমরা কোথাও কোনোএক কফিশপে বসি!
–ঠিক আছে , আমি জানাবো আপনাকে।
–তুমি কখন ফ্রি থাকো?
—ফ্রি নেই আপা; এমনকী ছুটির দিনও ঠিক নেই।একেক সপ্তাহে একেকদিন ছুটি থাকে। যারজন্য অনেককিছুর সাথে আমি তাল মেলাতে পারি না।
–তাহলে তোমার পরের ছুটিটা কবে?
এমন প্রশ্নে মিতুল ধাক্কা খেলো। এতো দ্রুত মহিলা দেখা করতে চাচ্ছে কেন? মিতুলের আর ভালোলাগছে না কথা বলতে। তাই দ্রুত লিখলো,
–আমার হাতে এখনো পরের সপ্তাহের সিডিউলটা আসেনি। আসলে জানাবো। এখন যাই আপা। জামান চলে আসবে । আমাদের রাতের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। ভালো থাকুন।
—ঠিক আছে। ভালো থেকো।
মিতুল সাথেসাথেই ল্যাপটপটা বন্ধ করে দিলো। মিসেস শরিফ ফেইসবুকে বন্ধু হওয়ার পর থেকেই সবসময় মিতুলের খবর নিচ্ছে। মিতুলও ভদ্রতাবশতঃ জবাব দিয়ে যায়। কিন্তু মিসেস শরিফের এই গায়েপড়ে আদরের ভাবটা মিতুলের ভালোলাগে না। একই এলাকায় থাকে, তারওপর বিশাল সেলিব্রেটি , যারজন্য মিসেস শরিফকে ফেবু থেকে আনফ্রেন্ড করতে পারছে না, আবার না হিতে বিপরীত হয়ে যায়। তাই কালেভদ্রে হাই হ্যালো করে চুপচাপ পড়ে থাকে মিতুল।
রাতে- মিসেস শরিফের বিষয় নিয়ে জামানের সাথে মিতুল গল্প করলো।
–জানো, উনি বাংলাদেশ বেতারে গান গাইতেন।
–ভালো তো।
–আমার সাথে দেখা করতে চান।
—দেখা করো! তাতে সমস্যা কী!
–নাহ, মানে মহিলার আদিখ্যেতাটা একটু বেশি কিনা! তাই কেমন যেন লাগছে।
—সে তোমার ব্যাপার। এখন ঘুমপাচ্ছে, ঘুমাবো। সকালে উঠে আবার কাজে দৌড়াতে হবে। বলেই জামান বিছানায় চলে গেলো। সেইসাথে মিতুলও বিছানায় এলো।
মিতুল সুন্দরী স্মার্ট বিদুষী মেয়ে। একসময় গানে কবিতায় উচ্ছল-চঞ্চল জীবন ছিল তার। বিয়ের পর জামানের সাথে কানাডায় এসে জীবনের পট পুরোপুরিভাবে বদলে গেলো। জামানের সাদাসিধে জীবনের সাথে খাপখাওয়াতে গিয়ে নিজের ভালোলাগা অনেককিছু থেকে সরে এসেছে। দুজনের সংসার টানতেই তাদের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। সারাদিন কাজ সেরে বাসায় এসে সংসারের কাজ করে একটু আরামের জন্য গা এলিয়ে দেওয়াতেই যত স্বস্তি এখন। জামানের সাথে সুন্দর খাপখাইয়ে নিয়েছে। দুজনেই সময় করে একসাথে বাইরে বের হয়, গ্রোসারি করে কিম্বা কখনো দাওয়াতের ঢেঁকিগিলে। সবই চলছে নিয়মের বেড়াজালে।
সকালে ঘুম থেকে উঠতেই বালিশের নিচে রাখা ফোনটা টিং করে বেজে উঠলো। মিসেস শরিফের ম্যাসেজ, ‘ শুভ সকাল।’ প্রতিউত্তর ‘ শুভ সকাল’ লিখে তড়িঘড়ি বিছানা থেকে নেমে কাজে যাওয়ার জন্য মিতুল প্রস্তুতি নিতে লাগলো। কপালে কুঁচকানো ভাব অর্থাৎ বিরক্তিরভাব নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে। মিসেস শরিফের সকাল সকাল এই আদিখ্যেতা মিতুল আর নিতে পারছে না। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে সব কাজশেষে ঘুমের আগে ল্যাপটপ নিয়ে বসা মিতুলের একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ফেইসবুক খুলতেই মিসেস শরিফের ম্যাসেজ পেলো। মিতুলের ঠিকানা জানতে চেয়েছে। মিতুল ঠিকানা দিবে কী দিবে না; ভাবতে ভাবতে ঠিকানাটা দিয়ে দিলো। এই ভেবে দিলো; যদি বাসায় আসতে চায় আসবে, সেই ভালো। তারপর আর কোনো কথা নয়। সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখবুজে আসছে দেখে মিতুল শুয়ে পড়লো।
পরেরদিন কাজ থেকে আসার পরেই বিল্ডিংয়ের নিচে বাজ থেকে কেউ একজন কল করছে। বাসার ফোনে রিং বাজতেই মিতুল ফোনটা তুলে পরিচয় জানতে চাইলে- ওপাশ থেকে বললো, ‘তোমার আপা মিসেস শরিফ আমাকে পাঠিয়েছেন।’ মিতুল একটু অবাক হয়ে নিচের দরজা খুলে দিলো। ভদ্রলোক ওপরে আসতেই মিতুল প্রায় হতভম্ব হয়ে গেলো। সুঠামদেহী ভদ্রলোকটি বেতের এক বিরাট ঝুড়ি মিতুলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন’ তোমার আপা রান্না করে তোমাদের জন্য পাঠিয়েছে।’ মিতুল কী বলবে বুঝতে পারছে না, শুধু আমতাআমতা করে বললো, ‘ আপার এসবের দরকার ছিল না।’ ব্যাগটা হাতে নিয়ে বললো, একটু কি বসবেন?
—না, আজ না। তোমার আপার সাথে এসে বসবো। বলেই চলে গেলেন। মিতুল খাবারগুলো টেবিলে রেখে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে। সাথেসাথে ল্যাপটপ খুলে মিসেস শরিফকে থ্যাংক্স জানালো। মিসেস শরিফ প্রতিউত্তরে লিখলেন, ‘খেয়ে জানাবে, কেমন লাগলো।’
ঘরে ঢুকে জামান টেবিলের ওপর এতো খাবার দেখে, “হলিমলি” বলে চিৎকার করে উঠলো। ‘এতো খাবার কেন?’ প্রশ্ন করেই মিতুলের দিকে তাকিয়ে থাকলো। সব বৃত্তান্ত শুনে বললো, ‘ ভালই তো। চলো খেয়ে নিই।’ এদিকে মিতুল মিসেস শরিফকে নিয়ে ভাবতে বসে গেছে। মহিলা বোধহয় সত্যিই মিতুলকে স্নেহ করেন। সবসময় একটা কথা বলেন, তার মেয়ে থাকলে মিতুলের সমান হতো। যাইহোক, একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে মিতুল ঘুমিয়ে পড়ে।
বেশ কদিন পর আবার মিসেস শরিফ ম্যাসেজ পাঠান, “তুমি ফ্রি থাকলে চলো- একটা কফিশপে বসি। আর তোমার নাম্বারটা দাও।’ কিছু না ভেবেই মিতুল নাম্বার দিয়ে বলে, ‘ ঠিক আছে, আসেন। আমাদের বিল্ডিংয়ের কাছেই আছে টিম হর্টন। ওখানে আসতে পারেন।’
—ঠিক আছে, আধাঘণ্টা পর সেখানে আসো।
মিতুল আজ কাজে যায়নি বিধায় দেখা করার সুযোগটা পেলো। আধাঘণ্টার মধ্যে প্রস্তুত হয়ে পায়েহেঁটে টিম হর্টনে চলে যায়। সেখানে গিয়ে দেখে শরিফ সাহেব আর মিসেস শরিফ বসে আছেন। মিতুলকে দেখে দুজনই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। মিসেস শরিফ বললেন, চলো আমরা একটু দূরে কোথাও গিয়ে বসি।’ মিতুল কিছু বলার আগেই মিসেস শরিফ তার হাত ধরে টেনে নিয়ে গাড়ির কাছে নিয়ে বললেন,’তুমি সামনের সিটে বসো।’ মিতুল তড়িঘড়ি করে বললো, ‘ না না, তা কেমন করে হয়! এটা ভালো দেখায় না।’ মিতুলকে একরকম ধাক্কা দিয়েই গাড়ির সামনের সিটে বসিয়ে দিতে-দিতে বললেন, ‘ কিচ্ছু হবে না। তোমার ভাইয়ের পাশে বসো।’
মিতুল পুরোপুরি ভড়কে গেলো। বুকটা ধড়ফড় করে কাঁপছে। শরিফ সাহেব নানাধরনের গান বাজিয়ে মিতুলকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। কিন্তু মিতুলের কিছুই ভালোলাগছে না। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর মিসেস শরিফ একটা মলের কাছে গিয়ে বললেন,’ এখানে একটু দাঁড়াও। আমি যাবো আর আসবো।’ মিতুল ভেতরে ভেতরে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠছে। মুখে কিছু বলছে না দেখে শরিফ সাহেব মিতুলের ঊরুর ওপর হাত রেখে মৃদুমৃদু চাপ দিচ্ছে। মিতুল পুরো অপ্রস্তুত হয়ে চিৎকার করলো। বললো, ‘ আপনারা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? আর আমার গায়ে হাত দিবেন না প্লিজ।’ শরিফ দুহাত বাড়িয়ে মিতুলকে জড়িয়ে ধরতে যাবে; ঠিক তখনই মিতুল গাড়ির দরজা খুলে সজোরে দৌড় দিলো। দৌড়াচ্ছে তো দৌড়াচ্ছেই; প্রাণপণ ছুটছে। যখন এক পুলিশের গাড়ি এসে মিতুলের পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, ” ডু ইয়ো নিড হেল্প?” ঠিক তখনই মিতুল সম্বিত ফিরে পেলো। পুলিশ আবার বললো,’ আর ইউ ওকে?’ মিতুল বললো,’ আই গট লস্ট, আই ডোন্ট নো; হাউ ডু আই গো হোম?’
মিতুলকে পুলিশের গাড়ি বিল্ডিংয়ের কাছে নামিয়ে দিয়ে গেলো। দৌড়ে ঘরে ঢুকে দেখে জামান তখনো আসেনি। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে- হাফছাড়লো মিতুল। কত্তবড় সাঙ্ঘাতিক এক ব্যাপার !তাহলে মিশেস শরীফ বদ উদ্দেশ্যেই মিতুলের কাছে এসেছিল। কত বিচিত্র এই পৃথিবী! মানুষ চেনা ভার। এতো আদরের নিচেও কত কালিমা।
প্রথমেই ল্যাপটপ নিয়ে ফেইসবুক থেকে মিসেস রশিদকে ব্লক করলো, সেইসাথে ফোন থেকেও তার নাম্বার ব্লক করলো। মনেমনে ঠিক করলো, জামানকে এসবের কিছু বলবে না, যেমনটি বলেনি পুলিশকে। শুধুমাত্র ঝামেলা এড়ানোর জন্য এই পন্থা অবলম্বন। কিন্তু বিষয়টা কী হলো! কী চেয়েছিল মিসেস শরিফ? ভাবতেই ঘৃণায় গা-গুলিয়ে আসছে। ছিঃ!
এই ভিনদেশে মানুষের আদিখ্যেতা আর কখনই মিতুলকে টানেনি। মিসেস শরিফের সাথে তিনমাসের অভিজ্ঞতায় মিতুলের পুরো পৃথিবী বদলে যায়। বদলে যায় বিশ্বাসের বহর। যার সবটুকুই ছিল অনাহূত বিড়ম্বনা।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..