নেশা (পর্ব- ১)

শাপলা জাকিয়া
উপন্যাস, ধারাবাহিক
নেশা (পর্ব- ১)

পর্ব- ১

সিজার তাকিয়ে আছে হৃদিতার দিকে। একই সাথে বন্ধুর মেয়ে আবার বৌ এর বড় বোনের মেয়ে হৃদিতা । ওর নিজের মেয়ের বয়সীই হবে। ষোল বা সতেরো। তবু কি ভীষণরকম নারী হয়ে উঠেছে। প্রতিটা ভংগীতে হৃদিতা সাংঘাতিক আবেদনময়ী হয়ে ওঠে । সিজার লুকিয়ে লক্ষ্য করে। নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছে,যেসব মেয়েদের তীক্ষ্ণ স্বরে চিৎকার দেয়ার স্বভাব এরা খুব ভালো প্রেমিকা হয়, খুব আবেদনময়ী হয়। পুরুষকে মাতাল করে দিতে পারে। কেনো এরকম তার কোন কারণ অবশ্য সিজার জানে না। হৃদিতা মেয়েটাও এমন। ভয় পেলে অথবা খুশী হলে মেয়েটা তীক্ষ্ণ স্বরে চিৎকার করে ওঠে। সিজারের মনটা তখন কেমন খাই খাই করে হৃদিতার জন্য। এই মেয়েটা একদিন কারো প্রেমিকা হবে, সেই পুরুষ জানবে হৃদিতা কেমন প্রেমিকা। কিন্তু সে জানবে না। সিজারের হৃদয় চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। কি দরকার ছিলো ওর হৃদিতার খালু হওয়ার। আজকাল আয়নার দিকে তাকালে মনটা খারাপ হয়, বুড়িয়ে যাচ্ছে। যদিও শরীরটা টানটান এখনও। অতিরিক্ত মেদ নেই কোথাও এই চল্লিশেও। তবু চেহারায় নায়কসুলভ ভাবটা কমে এসেছে। আজকালকার যুবকদের হারিয়ে হৃদিতাকে কি সে পাবে?

সিজারের খুব আনন্দ হয়েছিলো যখন বৌ মিতার মুখে শুনেছিলো এরমধ্যেই হৃদিতার একটি ছেলের সাথে প্রেম হয়ে আবার সেটা ভেঙ্গেও গেছে। সিজারের মেয়ে তনুর কাছে বলেছে হৃদিতা। তনু বলেছে মিতাকে। সিজার ভাবছে এই সুযোগ। সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার পর মানুষের মন নরম কাদামাটির মতো থাকে। তখন তার মনে ছাপ ফেলা সহজ হয়। সিজার হৃদিতার মনে ছাপ ফেলতে চায়। মাটি রেডি। শুধু সিজারের পা ফেলার অপেক্ষা…

সিজার যখন হৃদিতাকে নিয়ে এসব ভাবছে তখন হৃদিতা হঠাৎ কাছে এসে বললো,

-সিজার! আমায় বেড়াতে নিয়ে যাবে? আমার মনটা খুব খারাপ।

সিজার উত্তরে হৃদিতার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসে। সেই হাসির অর্থ হৃদিতা করতে পারে না। কাছে এসে হাত ধরে ঝাঁকায়,

– কি হলো, বলো? নিয়ে যাবে?

হৃদিতা ছোটবেলা থেকেই সিজারের খুব ন্যাওটা ছিলো। এখনও আছে। সিজার যে কোন আসরের মধ্যমনি হয়ে ওঠে সহজেই। সে বাচ্চাদের আসর হোক বা বড়দের। হৃদিতার বাড়ি পাশেই। সে সুযোগ পেলেই তার এই মিতা খালার বাড়িতে চলে আসে। হয় সিজারের সাথে নতুবা সিজারের মেয়ে তনুর সাথে সময় কাটিয়ে যায়। সিজারকে নাম ধরে ডাকা ওর ছোট বেলার অভ্যাস। কখনো আংকেল বা খালু বলেনি। বড় হয়েও এই অভ্যাস সে বহাল রেখেছে। পরিবারের মুরব্বী স্থানীয়রা প্রবল আপত্তি করেছেন। কিন্তু তাতে করে বিশেষ লাভ হয়নি। প্রকাশ্যে নাম ধরে না ডাকলেও আংকেল বলে না কখনো। আর একা পেলে সবসময়ই সিজার বলে। এ ব্যাপারে হৃদিতার ভাষ্য হচ্ছে – সিজার আমার আংকেল নয়, বন্ধু। বন্ধুকে তো নাম ধরেই ডাকবো!

হৃদিতা শরীরে বড় হয়েছে কিন্তু সিজারের জন্য ওর মনটাকে সেই শিশুবেলার মতো করেই একজায়গায় ধরে রেখেছে। ছোটবেলায় কোলে এসে বসে থাকতো, এখন গায়ের সাথে গা লাগিয়ে বসে। সিজার ইচ্ছে করলেই সরে বসে হৃদিতাকে বৃঝিয়ে দিতে পারে যে এটা উচিত নয়। কিন্তু  সিজার সেটা করে না। বরং হৃদিতার শরীরের বদলে যাওয়া সুবাসটা নেয়। ওর শরীরে এখন আর শিশু- শিশু সুবাস নেই। সুবাসও বলে দেয় হৃদিতা নারী হয়ে উঠেছে। হৃদিতার শরীরের নিজস্ব সুবাস আর প্রসাধনীর সুবাস একসাথে মিলেমিশে সিজারের নাকে এসে লাগে। সিজার মাঝে মাঝেই চোখ বন্ধ করে ফেলে বিবশ ভালো লাগায়। ও মনে মনে তখন হৃদিতাকে নিয়ে ফ্যান্টাসিতে আক্রান্ত হয়। সিজারের মন তখন হৃদিতাকে আর নিজের মেয়ের বয়সী ভাবতে পারে না। হৃদিতা সেই সময়টায় ওর কাছে একজন পরিপূর্ণ নারীর রূপ পায়, যার নেশা সিজারকে বুঁদ করে ফেলে। পাশে বসে থেকেও হৃদিতা কিছু টের পায়না। তখন আশেপাশে মেয়ে তনু থাকে বলে হয়তো দৃশ্যটা কারও চোখেও লাগে না। ওদের পাশাপাশি বসে থাকাটা নারী- পুরুষের সম্পর্কের দিকে আঙ্গুল না তুলে, মানুষের পারস্পরিক স্নেহ- ভালোবাসার সম্পর্কের দিকে আঙ্গুল তোলে। শুধু সিজার জানে, এই পাশাপাশি বসে থাকা ওরজন্য কতোটা রোমাঞ্চকর। আজকাল হৃদিতাকে নিয়ে দিবাস্বপ্ন বাড়ছে তার। এজন্য অবশ্য ওর কোর অনুতাপ নেই। ওর কাছে হৃদিতা এখন এই পৃথিবীর একজর সুন্দরী নারী, যে সিজারকে  চুম্বকের মতো টানে। এটুকুই মনে রাখতে পছন্দ করে ওর মন। আর কিছু জানতে চায় না। হোক সে মেয়ের বয়সি, সম্পর্কে ভাগ্নি। সম্পর্ক তো মানুষ বানিয়েছে নিজের প্রয়োজনে। সিজারও সম্পর্ক বানাবে নিজের প্রয়োজনে। হৃদিতার সাথে তার খালু- ভাগ্নির সম্পর্ককে অস্বীকার করে নারী- পুরুষের প্রেমের সম্পর্ক গড়বে। নিজের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় সিজার। এরকম চ্যালেঞ্জ সে এর আগেও করেছে নিজেকে। একবার এক অন্তরঙ্গ বন্ধুর বৌকে নিজের প্রেমিকা বানিয়েছিলো। তারপর জিতে যাওয়ার খুশিতে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়েছিলো মনে মনে। পৃথিবীর কেউ জানতে পারেনি। এবারও পারবে না। ওর এবারের টার্গেট হৃদিতা।

হৃদিতার হাত ধরে পাশে বসায় সিজার। তারপর বলে,

-মিতা আর তনুকে বল রেডি হতে। সবাই মিলে যাই।

কিন্তু মিতা আর তনু রাজি হলো না। কাল তনুর এক্সাম আছে। সিজার তাই হৃদিতাকে নিয়েই বের হলো। গাড়ি ড্রাইভ করছিলো ও নিজেই। হৃদিতা বিষন্ন মুখে বসে আছে পাশের সিটে। সিজার অনুমান করতে পারছে হৃদিতা কেন বিষন্ন। তার প্রেম ভেঙ্গে গেছে। সিজার মনে মনে হাসে। তার নিজের মেয়ে তনু পড়াশোনা ছাড়া কিছু বোঝে না আর হৃদিতা এই বয়সেই একটা প্রেম করে আবার তা ভেঙ্গে যাওয়ার কষ্ট সামলাচ্ছে। এই মেয়ে চূড়ান্ত রোমান্টিক স্বভাবের হয়েছে। একে জয় করা সহজ হবে। বুদ্ধি করে যে কোন একটা ফাঁদ বানিয়ে হৃদিতাকে আটকে ফেলা যাবে প্রেমের সম্পর্কে। এমনিতে হৃদিতার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করতে চাইলে ও নিশ্চয় ক্ষেপে উঠবে। কিন্তু একবার প্রেমের টোপ গেলাতে পারলে ও নিজেই হয়তো এ ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠবে। সিজার গাড়ী চালাতে চালাতে ভাবতে থাকে হৃদিতার জন্য কোন টোপ সবচেয়ে ভালো কাজে দেবে।

কিছুক্ষণ পর গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়লো বনানি রেল ক্রসিং এর আগে। রাস্তায় জ্যাম। সেলিম হৃদিতার দিকে তাকিয়ে বললো,

-তোর চুলগুলি এতো বড় কেনো রে?

হৃদিতা মুখ না ঘুরিয়েই বললো,

-কেনো? তাতে কি সমস্যা?

সিজার বললো,

-সমস্যা তো আছেই। দেখলেই মনে হয় ধরি। আমার বড় চুল খুব পছন্দ। বিশেষ করে লম্বা বেনী। দেখলেই ধরতে ইচ্ছা করে।

হৃদিতা এবার সিজারের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো। তারপর বললো,

– মিতা খালামনির অনেক বড় চুল ছিলো, তাইনা?

-হুম।

-তুমি একবার বলেছিলে তোমাকে ভালোবাসে তার প্রমাণ খালামনিকে দিতে হবে। খালামনি তার ইয়া বড় চুলগুলি কেটে তোমাকে দিয়ে দিয়েছিলো । সো সুইট! তোমরা প্রেম করে বিয়ে করেছিলে, জানি। কি লাকি তোমরা!

হৃদিতা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে। তার বোধহয় আবার তার ভেঙ্গে যাওয়া প্রেমের কথা মনে পড়েছে। সিজার বলে,

-তোর কেনো মন খারাপ বলবি?

-বলা যাবে না, সিক্রেট।

-আচ্ছা, সামনা সামনি বলতে না পারলে ফোনে বল। ফোনে মুখ দেখা যায় না বলে লজ্জা লাগে না। আমাকে বল। আমি তোকে হেল্প করতে পারবো, বলবি?

হৃদিতা এক মুহূর্ত ভেবে রাজি হয়। তারপর বলে,

-তোমায় কখন ফোন করবো?

-কাল রাতে করিস। আজ রাতে অফিসের কাজে নরসিংদী যাবো। পনেরো দিন ওখানেই থাকবো। রাতের দিকে কোন কাজ থাকবে না। তখন করিস।

হৃদিতা ঘাড় নাড়ে। মেয়েটা সরল। চট করে সিজারের কথা মেনে নেয়। হয়তো ছোটবেলা থেকেই সিজার ওর সাথে বন্ধুর মতো আচরণ করেছে বলে। সিজারের মন আসন্ন ফোনালাপের কল্পনায় মেতে ওঠে। হৃদিতাকে সে ঘায়েল করবে ফোনে। আগামী পনের দিন সে হৃদিতার জন্য মনে মনে বরাদ্দ করলো।

কিছুক্ষণ এদিক – ওদিক ঘোরাঘুরি শেষে হৃদিতাকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে এসে বসেছে সিজার। নানারকম গল্পগুজব করে ইতিমধ্যেই হৃদিতাকে উৎফুল্ল করে তুলেছে ও। সিজার  জানে, কারও মন জয় করতে হলে তাকে হাসাতে হয়। হাসি মানে হচ্ছে একই সাথে শরীর আর মনে সৃষ্ট এক গভীর আলোড়ন। এই আলোড়নে মনের কবাট খুলে যায়। মানুষ তখন সহজ হয়ে ওঠে। নিজেকে প্রকাশ করে ফেলে। যে মানুষটি তাকে হাসির মতো সুখ দিচ্ছে, তাকে নিজের অজান্তেই আপন ভাবতে শুরু করে। তার সংগ উপভোগ করতে শুরু করে। তবে হাসির নামে ভাঁড়ামি করা যাবে না। যা করতে হবে স্মার্টলি করতে হবে।

হৃদিতা হাসতে হাসতে বললো,

-সিজার! প্লিজ এবার থামো। নাহলে আমি ড্রিংকসটা খেতে পারবো না।

সিজার তাই আর কোন কথা বললো না। সে হৃদিতার ড্রিংকস শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলো। তারপর হৃদিতাকে বললো,

-তোর স্ট্রটা দিবি?

-নাও

নিজের গ্লাসের স্ট্রটা তুলে ফেলে হৃদিতার ব্যবহার করা স্ট্রটা নিজের ড্রিংকসে ডুবালো সিজার। তারপর মুখ লাগিয়ে টানতে শুরু করলো।

হৃদিতা অবাক হয়ে বললো,

-এমা! তুমি আমার এঁটো স্ট্র দিয়ে খাচ্ছো কেনো?

সিজার বললো,

-ফোনে বলবো।

 

 

চলবে…

শাপলা জাকিয়া। লেখক ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। পৈত্রিক নিবাস কুষ্টিয়া হলেও স্কুল ও কলেজ জীবন কেটেছে নারায়ণগঞ্জ শহরে। নারায়ণগঞ্জ সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেন। বর্তমান নিবাস ঢাকা। যুক্ত ছিলেন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতায়। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন দৈনিক যুগান্তরে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ- খুন...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ