সুখের আগে অ
ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ১ ফ্লাশিং এর লাস্টস্টপে এসে ট্রেনটা থেমে গেল। প্ল্যাটফর্ম ভর্তি অসংখ্য…..
পর্ব-২
হৃদিতার ফোন এলো সন্ধ্যার দিকে। আজ ভোররাতে নরসিংদীতে পৌঁছেছে সিজার। এসে ঘন্টাখানেকের রেস্ট নিয়ে তারপর ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো অফিসের কাজে। ও একটা খ্যাতনামা কোম্পানীতে কাজ করে। ইংল্যান্ডের কোম্পানী, বাংলাদেশে ব্যাবসা করছে। সিজার এখন পনেরো দিন থাকতে হবে ঢাকায় আর পনেরো দিন নরসিংদীতে। নরসিংদীতে ওদের কোম্পানীর নিজস্ব গেস্ট হাউস আছে। সেখানেই উঠেছে সিজার । পাশের রুমে উঠেছে ওর দুই কলিগ। ওরা স্বামী – স্ত্রী নয় তবু একরুমে আছে। কে কি ভাবছে পরোয়া করছে না। মেয়েটি ডিভোর্সি,ভারতীয়। ওদের কোম্পানীতে কাজ করছে বছর দুই হলো আর ছেলেটি আমেরিকান। দেশে ওর সংসার আছে। সিজার ওদের দিকে তাকিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। এভাবে যদি হৃদিতাকে নিয়ে সে এখানে থাকতে পারতো। আশেপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ এতো চমৎকার যে মন আপনিতেই রোমান্টিক হয়ে ওঠে। এমন পরিবেশে আসলে হৃদিতা আরও রোমান্টিক হয়ে উঠতো। সিজারের তাতে খুব সুবিধা হতো। সারাদিন হৃদিতার চিন্তা মাথায় ঘুরেছে আর এখন হৃদিতা ওর ফোনের ওপ্রান্তে। ফোন ধরে সিজার বলে,
-হ্যালো! সুইট সুইট!
হৃদিতার হাসি ভেসে আসে,অনেকটা কাঁচের চুড়ির রিনিঝিনির মতো সেই হাসির শব্দ। সে বলে,
-হুম, আমার নাইস নাইস ফ্রেন্ড। তুমি ঠিক আছো? পৌঁছেছিলে ঠিকমতো?
-হ্যাঁ রে । তোর কন্ঠ হেব্বি লাগে তো ফোনে। আগেও শুনেছি। কিন্তু নরসিংদীর আলো – বাতাসে শুনতে অন্যরকম লাগছে। এই জায়গাটা খুব মিঠা জানিস, তোর কন্ঠস্বরের মতো।
-তুমি আমায় কি বলছো! তোমার ভয়েস তো অনেক সুন্দর। বাপি আর মাম্মিও বলে।
-তোর আর আমার মধ্যে অনেক মিল, খেয়াল করেছিস?
-যেমন?
-যেমন ধর এই কন্ঠস্বর। আমি গান – আবৃত্তি এসব করতাম একসময়। আমার কন্ঠ, চর্চা করা কন্ঠ। তাই হয়তো ভালো শোনায়। কিন্তু তুই তো এসব করিস না, তবু তোর কন্ঠও কতো চমৎকার শোনায়, যদি জানতিস!
-এটা কোন কথা হলো? পৃথিবীতে এমন অনেক মেয়ে পাবে যাদের কন্ঠ খুব সুন্দর। তাই বলে সবাই তোমার মতো হয়ে গেলো?
-শুধু কন্ঠ নয়, তুই দেখতেও আমার মতো।
-হি হি, কি যে তুমি বলো!
-হি হি করার মতো কিছু হয়নি। আমি সিরিয়াস। তুই এক্ষুনি আয়নার সামনে দাঁড়া। দ্যাখ তোর চোখ, ঠোঁট সবার আমার মতো। বিশেষ করে হাসিটা। তুই ছেলে হলে আমার মতোই দেখতে হতি। আরও অনেক মিল আছে, বলবো?
-বলো।
-তুই বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে, আমিও আমার বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। তোর দুইটা ছোট ভাই আছে। আমার দুইটা ছোট বোন আছে।
-আর?
-তুই সিঙ্গাড়ার পাগল। আমিও। তোর আর আমার অধিকাংশ প্রিয় খাবার এক। তুই চিজ পছন্দ করিস?
-এমা! ছিঃ বিশ্রী গন্ধ লাগে।
-আমারও। তোর আর আমার প্রিয় গান, মুভি, সব প্রায় এক, তাইনা?
-আরে! তাইতো!
-তুই – আমি কথাও বলি একরকম করে, তুই যদি কখনও রেকর্ড করে শুনিস, দেখবি শুনতে একরকম লাগছে।
হৃদিতা ঝলমলে গলায় বলে,
-এই জন্যই তো তোমায় আমি এতো পছন্দ করি ওস্তাদ!
সিজার হাসতে হাসতে বলে,
– না গুরু, তুমি এইজন্য পছন্দ করো না। পছন্দ করার কারণ আরও গভীর।
-কি কারণ?
-এখন বলা যাবে না, তোর বয়স মাত্র সতেরো। আরও বড় হ, পরিণত হ, তখন বলবো। এই ধর তোর বয়স যখন ত্রিশ হবে তখন বলবো। ততোদিনে আমিও বুড়ো হবো। তখন বললে তুই আমাকে বুঝতে পারবি কিন্তু এখন বললে ভুল বোঝার সম্ভাবনা আছে।
– না, না! হবে না! প্লিজ! প্লিজ! তুমি এক্ষণ বলো! প্লিজ! আমি কিচ্ছু ভুল বুঝবো না। তুমি জানো আমি তোমাকে চোখ বুজে বিশ্বাস করি।
– সেটা জানি। আমি বলতে পারি কিন্তু একটা শর্ত আছে। তুই কথাগুলি কাউকে বলতে পারবি না।
-বলবো না, প্রমিজ।
সিজার কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকে তারপর যখন বলতে শুরু করে ওর গলা খুব সিরিয়াস শোনায়। সিজার গম্ভীর সুরেলা গলায় থেমে থেমে বলতে থাকে যেন প্রতিটা শব্দ খুব গুরুত্বপূর্ণ,
-কাল নরসিংদী আসার পথে সারারাত নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করেছি। কথাটা তোকে বলবো কি বলবো না এই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না । তোর বয়স কম, হয়তো বুঝবিই না। হেসে উড়িয়ে দিবি। কিন্তু তারপর মনে হলো এতোবড় সত্য তোকে জানাবো না! যদি কাল মরে যাই, তুই তো কোনদিন জানবি না।
এবার হৃদিতার গলাও সিরিয়াস শোনায়,
-কি কথা বলো তো। তুমি ভেবো না আমি সিরিয়াসলি
নেবো।
-জানিরে, ওটুকুই ভরসা। তারপরও সবশুনে তোর যদি কথাটা বিশ্বাস না হয়, তুই সত্যটাকে ছুঁড়ে ফেলতে পারিস। ছুঁড়ে ফেললেই কিন্তু সত্যটা বদলে যাবে না। সত্য, সত্যই থাকবে।
হৃদিতা এবার অস্থির হয়ে ওঠে। অসহিষ্ণু গলায় বলে,
– আহা! বলো তো তুমি। আমি বিশ্বাস করি তোমার সব কথা।
-আমার বাবা খুব সৎ মানুষ ছিলেন। এটা সবাই জানে। যেটা জানে না সেটা হলো তিনি সাধু মানুষও ছিলেন। এমনকি তাঁর কিছু আধ্যাত্মিক ক্ষমতাও ছিলো। এই গোপন ক্ষমতার কথা বাবা লুকিয়ে রাখতেন বাইরের লোকজনের কাছ থেকে । আমাদের বলতেন, তোরাও কাউকে বলবি না। আমরা বলতাম না। আমি তোর মিতা খালামনিকেও কখনও কিছু বলিনি। আজ তোকে বলছি। বাবা অনেকের অতীত, বর্তমান ও ভবিষৎ দেখতে পেতেন। আমরা বহুবার প্রমাণ পেয়েছি। একজন মানুষ তার পূর্বজন্মে কি রূপে ছিল তাও বুঝতেন বলে দাবি করতেন। তো আমার এই রহস্যময় বাবা তাঁর মৃত্যুর আগে আমায় কিছু কথা বলে গেছেন। বাবা যখন মারা যান, তখন আমি ক্লাস টেনে পড়ি। অসুস্থ অবস্থায় বাবা একদিন আমায় ডাকলেন, বললেন,
-ঘরের দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে আমার পাশে এসে বসো।
আমি তাই করলাম। বাবা বললেন,
-শোন, তুমি আমার ছেলে। আমার আধ্যাত্মিক ক্ষমতার কিছু অংশ তোমারও পাওয়ার কথা। কিন্তু তুমি পাওনি। কেনো পাওনি জানো? কারণ তুমি পরিপূর্ণ নও। আগের জন্মে তুমি একটি বৃহৎ শক্তি হিসাবে এই ব্রক্ষ্মান্ডে ছিলে। যখনই মানুষ রূপ পেলে তখন তোমাকে দুই টুকরা করা হলো। এক টুকরা হলে তুমি। আরেক টুকরা হচ্ছে আরেকজন মানুষ। তারও এই পৃথিবীতে আসার কথা মানুষ রূপে। হয়তো সে এসেছে। কিংবা আসবে। তোমার সেই টুইনের সাথে তোমার এই পৃথিবীতেই দেখা হবে। তোমার তাকে চিনে নিতে হবে। যদি চিনে নিতে পারো তবে তার সাথে একাত্ম হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। তোমাদের এই একাত্মতা তোমাদের পূর্বজন্মের সব শক্তি ফিরিয়ে দেবে। তোমার আধ্যাত্মিক ক্ষমতা আমার চেয়েও অনেক বেশি হবে। তুমি তোমার টুইনকে খুঁজতে চেষ্টা করো।
বাবার সেই কথাগুলি সারাজীবন আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়েছে। কতোজনকে আমার টুইন ভেবে এগিয়ে গেছি, তাররপর হতাশ হয়ে অনুভব করেছি সে আমার টুইন নয়। বাবা বলেছিলেন, সঠিক টুইন কে, তা আমার মনই আমাকে বলে দেবে। একবার মনে হয়েছিলো, আমার বন্ধু হায়দার আমার টুইন। কলেজ লাইফে সবাই বলতো আমরা একরকম দেখতে। দুজনেই লম্বা , একই রকম গঠনের । প্রাণবন্ত ছিলাম দুজনেই। পরীক্ষার রেজাল্টও হলো একরকম। কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে মনে হলো হায়দার আমার টুইন না। কিছুতেই মন সাঁই দিলো না । তারপর নিজের ছেলে হলো। মনে হলো, ও বোধহয় আমার টুইন। ওর সাত বছর বয়স পর্যন্ত এরকমই মনে হয়েছিলো। কিন্তু পরে বুঝলাম ও না। এখন আসল কথা বলি, আমার খুব স্ট্রংভাবে মনে হয় যে তুই আমার সেই টুইন!
হৃদিতা একরকম চিৎকার করে বলে ওঠে,
-ও, এম, জি!! কি বলছো!
সিজার তরল গলায় বলে,
-মাই ডিয়ার টুইন! আমি ঠিকই বলছি। তুই আমার টুইন বলেই আমাকে এতো পছন্দ করিস, আর আমিও তোকে। তুই বুঝতে না পারলেও, তোর মন ঠিকই আমাকে চিনেছে। তাই তুই কোনদিন আমাকে আংকেল বলিসনি। সিজার বলেছিস, বন্ধু বলেছিস। একটু ভেবে দ্যাখ, ঠিক বলছি কি – না?
-ঠিকই বলছো। আমি তোমাকে অনেক পছন্দ করি, অনেক শ্রদ্ধা করি। তুমি আমার অনেক প্রিয় একজন মানুষ। আমার কতো মনে হয়েছে, তুমি কেনো তনুর বাবা হলে, কেনো আমার বাবা হলে না। অথবা তুমি আমার বোন হতে পারতে। আমি মনখুলে তোমার সাথে গল্প করতে পারতাম, আরও বেশি ঘুরতে পারতাম। দেখো না, সেদিনই মা বলছিলো-তুই সিজারের আশেপাশে এতো ঘুরঘুর করিস নাতো। বড় হচ্ছিস! মাকে বলে দেই টুইনের ঘটনাটা? তাহলে মা আর তোমার কাছে যাওয়ার জন্য রাগ করবে না।
-একদম না। তুই প্রমিজ করেছিস,কাউকে বলবি না ।
-ওকে।
-আর শোন, আমি তোর খালু না, বাবাও না, বোনও না। আমি তোর টুইন রে পাগলী!
কথাটা বলে সিজার ফোন রেখে দেয়। অনেক টেনশনের পর তার এখন শান্তি লাগছে। রেজাল্ট মনে হয় ভালোই আসবে। তার বানানো টুইনের গল্পটা হৃদিতা হেসে উড়িয়ে দেইনি। এবার পরের ঘুটি চালতে হবে।
ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ১ ফ্লাশিং এর লাস্টস্টপে এসে ট্রেনটা থেমে গেল। প্ল্যাটফর্ম ভর্তি অসংখ্য…..
ইংরেজি ভার্সান এখানে >>> Welcome to the Pataquerical Night Show (Last Episode) পূর্ববর্তী পর্ব এখানে>>>…..
ইংরেজি ভার্সান এখানে >>> Welcome to the Pataquerical Night Show (Episode-5) পূর্ববর্তী পর্ব এখানে>>> শেষ…..
ইংরেজি ভার্সান এখানে >>> Welcome to the Pataquerical Night Show (Episode-4) পরবর্তী পর্ব পড়ুন এখানে>>>>…..