নেশা (পর্ব- ৩)

শাপলা জাকিয়া
উপন্যাস, ধারাবাহিক
নেশা (পর্ব- ৩)

পরদিন সন্ধ্যায় সিজার ইচ্ছা করে হৃদিতার ফোন ধরলো না। ঠিক করলো, আগামীকালও ধরবে না। গতকালের টুইনের গল্পটা হৃদিতা ভালো করে হজম করুক আগে । একটু সময় নিক। তাছাড়া কাল সিজারকে নিজের ভাঙ্গা প্রেম কাহিনী শোনাতে চেয়েছিলো নিশ্চয় হৃদিতা। হয়তো বলার সবরকম প্রস্তুতি নিয়েই ফোন করেছিলো। কিন্তু সিজারের কথার তোড়ে ওর সব প্রস্তুতি ভেসে গেছে। কিছুই বলা হয়ে ওঠেনি। বলার জন্য হৃদিতা এখন অস্থির হয়ে আছে। এই অস্থিরতাটা জমুক। সিজারকে যেন ওর কখনও সহজলভ্য বলে মনে না হয়। মানুষ যা সহজে পায়, তাকে দামি মনে করে না।

মোবাইল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে সিজারের মুখটা খুশি খুশি হয়ে ওঠে। টেন মিসড কল। সব হৃদিতার। মেয়েটা চূড়ান্ত অস্থির হয়ে উঠেছে। কালও যখন ফোন ধরবে না, কি করবে হৃদিতা?

এসব যখন ভাবছিলো সিজার, তখনই ফোন আসে তাপস হালদারের। সিজারের সাথে পরিচয় অফিস সূত্রে। ওদের কোম্পানীতে নানা প্রয়োজনীয় জিনিস সাপ্লাই করে বছর পঁয়ত্রিশের এই তাপস । ম্যানেজার হিসাবে সিজারের  ছাড়পত্র পেলে তবেই সে সাপ্লাই দিতে পারে। তাই সিজারের খাতির তাপসের কাছে অনেক বেশি। প্রায় এটা, ওটা উপহার পাঠায় সে সিজারের জন্য। এখন একরকম বন্ধুত্বের সম্পর্কই তৈরি হয়ে গেছে। এবার সিজারকে নিজের বাড়িতে দাওয়াত করেছে তাপস । ফোন করে এখন সে কথাটাই মনে করিয়ে দিলো।

সিজার তাপসকে আশ্বস্ত করে যে, সে আসবে। তারপর ভালো করে লোকেশনটা জেনে নিয়ে অফিসের গাড়িতে রওয়ানা হয়।

আধা ঘন্টার মধ্যে গাড়িটা এই বাংলো টাইপ বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বয়স্ক দাড়োয়ান পরিচয় জেনে গেট খুলে দিতেই ড্রাইভার গাড়িটা ভিতরে ঢুকিয়ে নিলো । সেখানে তাপস কে দেখতে পেয়ে চট করে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে সিজার। এগিয়ে এসে সিজারের সাথে করমর্দন করতে করতে তাপস বলে,

-আমার কি সৌভাগ্য! অবশেষে আপনি এলেন। ড্রাইভার কে চলে যেতে বলি? কাল ভোরে আমার ড্রাইভার আপনাকে দিয়ে আসবে, কেমন?

-আরে না, কি বলেন! আমি রাতেই ফিরে যাবো।

-রাতে ফিরে কি করবেন? সেই তো ফাঁকা গেস্ট হাউস। তাছাড়া রাতের রাস্তা ঠিক নিরাপদ নয়। গত সপ্তাহেই ডাকাতি হলো। আজ রাতটা থাকুন না আমাদের সাথে। একটা রাতই তো!

অগত্যা সিজার রাজি হয়। ড্রাইভারকে বিদায় করে তাপসের সাথে নুড়ি বিছানো পথ পেরিয়ে বাড়ির ভিতরে এসে ঢোকে।

ঘরে ঢুকতেই সিজার দেখে আরও জনা দুই ভদ্রলোক বসে রয়েছেন। দুজনের হাতেই গ্লাস, তাতে রঙীন পানীয়। সফট ড্রিংকস নয় সেটা বোঝা যাচ্ছে, কারণ মাঝখানের সেন্ট্রাল টেবিলে বেশ কয়েকরকমের ওয়াইনের বোতল সাজানো।

সিজার প্রশ্ন করে,

-পার্টি না কি? কোন উপলক্ষ্য?ফোনে বলেননি তো!

হা হা করে হাসে তাপস,

-আরে না, সেরকম কিছু নয়। আপনি ভাববেন না। এই তিন চারজন বন্ধু মিলে একটু একসাথে সময় কাটানো। ভাবলাম আপনি একা একা গেস্ট হাউসে পড়ে থাকেন। এখানে আসলে ভালো লাগবে। আসুন পরিচয় করিয়ে দেই।

তাপস বাকি দুই ভদ্রলোকের সাথে সিজারের পরিচয় করিয়ে দিলো । দুজনই ব্যবসায়ী মানুষ। একজন সিজারের বয়সীই হবে। অপর জনের বয়স বেশ কম। পঁচিশের বেশি হবে না।
সোফায় গা এলিয়ে বসতেই সিজারের হাতে ওয়াইনের গ্লাস ধরিয়ে দেয় তাপস। টেবিলে রাখা স্ন্যাক্সের প্লেটটা এগিয়ে দিতে দিতে বলে,

– ঢাকা থেকে আরও তিনজন অতিথি আসবে । প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। ওরা এলে আসরটা জমে যাবে দেখবেন!

কথাটা বলে চোখ টেপে তাপস। কেনো, সেটা সিজার ঠিক আন্দাজ করতে পারে না।

টিভিতে এখন ক্রিকেট খেলা চলছে। সবার মনোযোগ সেদিকেই। সিজার ঘরের চারপাশে তাকায়। ঘরটা অপরিষ্কার নয় কিন্তু খুব এলোমেলা করে সাজানো সবকিছু। কোন পরিবারের গোছানো ড্রইং রুম বলে মনে হচ্ছে না। হয়তো এখানে তাপসের পরিবার থাকে না। এটা তার আমোদ প্রমোদের জায়গা। সিজার প্রশ্নটা করতেই তাপস বলে,

-একদম ঠিক ধরেছেন। এখানে থাকা হয়না। ঐ মাঝে মাঝে আসি আরকি।

ইন্টারকম বাজতেই সেটা ধরতে চলে গেলো তাপস। কিছু নির্দেশ দিয়ে সিজারের কাছে ফিরে এসে বললো,

-এসে গেছে। যাকে পছন্দ হয় বলবেন। একদম সংকোচ করবেন না।

দরজা ঠেলে যে তিনজন ঢুকলো, তারা তিনজনই নারী। জিনস আর টিশার্ট পড়া। বয়স বিশ একুশ হবে। পথের ক্লান্তি সত্ত্বেও তাদের রূপসী দেখাচ্ছে। ওরা হাসিমুখে ঘরের সবাইকে হাই, হ্যালো করলো। সিজার ঘাড় নাড়লো তার উত্তরে।

তাপস বললো,

-তোমাদের টায়ার্ড দেখাচ্ছে। ভিতরে যাও, ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নাও। এ বাড়ির সবকিছু তো তোমাদের চেনা। আমরা আছি এখানে। ওয়েট করবো তোমাদের জন্য।

মেয়ে তিনটি হাসিমুখে চলে গেলো। ওদের গমন পথের দিকে জ্বলজ্বলে লোভী চোখে তাকিয়ে আছে এ ঘরের পুরুষেরা। তাপস গলা নামিয়ে ফিসফিস করে সিজারকে বলে,

– কাকে পছন্দ বলুন? আগে আপনি নেবেন তারপর আর সবাই।

সিজার বলে,

-আমি এসবে ঠিক অভ্যস্থ না !

-আরে ধুর! অভ্যাস কি কেউ জন্ম থেকে করে নিয়ে আসে নাকি। ও করতে করতে অভ্যাস হয়ে যায়।

-কিছু মনে করবেন না তাপস, আমি এখন গেস্ট হাউসে ফিরতে চাই।

-ওহ! আমি ভেরি সরি সিজার সাহেব। আপনাকে বোধহয় বিরক্তই করে ফেললাম। ঠিক আছে কোন অসুবিধা নেই। আপনি পাশের ঘরে গিয়ে আরাম করুন। খানা ওখানেই পাঠিয়ে দিতে বলি। কথা দিচ্ছি কেউ আপনাকে বিরক্ত করবে না। আপনি এই রাতে যাবেন না প্লিজ। রাস্তা নিরাপদ নয়। সকালে আমার ড্রাইভার আপনাকে পৌঁছে দেবে।

সিজারকে একটা অল্পবয়সী ছেলে এসে পাশের একটা রুমে রেখে গেছে। ঘরটা আরামদায়ক। এসি চলছে। নরম গদির বিছানা। একটু পর ছেলেটা খাবার দিয়ে যেতেই সিজার খেয়ে শুয়ে পড়লো। ও ঘর থেকে নারী – পুরুষের হাসির শব্দ ভেসে আসছে।

সিজার দুটো কারণে ওদের সাথে যোগ দিচ্ছে না। প্রথমত ও তাপসকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এটা কোন টোপ হতে পারে। ভিডিও ফুটেজ নিয়ে পরে ব্ল্যাকমেইল করে সবসময় ওর মাল নিতে বাধ্য করবে। তাছাড়া কোনভাবে জানাজানি হলো পরিচিত মহলে ওর মান – সম্মান নিয়ে টানাটানি পড়ে যেতে পারে। সিজারকে সবাই ভদ্রলোক বলেই জানে।

আর দ্বিতীয়ত হচ্ছে, এই মেয়েগুলির সাথে সিজার কোন মজা পাবে না। ওর শুধু শরীরে হয়না, সাথে মন লাগে। এইসব মেয়েরা যেটা করবে, সেটা হলো অভিনয়। অভিনয় সিজারের ভালো লাগে না। ও খুব জেনুইনের ভক্ত। সিজারের পছন্দের নারীকে প্রেমকাতর হয়ে ওর কাছে আসতে হবে। তবেই গ্রহন করবে সিজার। প্রয়োজনে সেই নারীর মধ্যে ছলে বলে প্রেম জাগাবে ও। তারপর অপেক্ষা করবে তার পরিপূর্ণ সমপর্ণের। একজন আকুল প্রেমিকা যে প্রেম দিতে পারে, তা লাখ টাকায় কেনা সুন্দরীও দিতে পারবে না।

এসব ভাবতে ভাবতে সিজারের খুব ঘুম পাচ্ছিলো । বেশ কিছু ওয়াইন পেটে গেছে। চনমনে হয়ে ওঠার স্টেজ পার হয়ে এখন প্রচন্ড ঘুম ওকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে।

কতোক্ষণ ঘুমিয়েছে জানেনা সিজার। ঘুম ভাঙ্গলো কারও স্পর্শে। ঘুমাতে যাওয়ার আগে রুমের লাইট নেভাতে ভুলে গেছিলো, সেই আলোয় দেখলো ওর পাশে একটি মেয়ে শুয়ে আছে। সিজার লাফ দিয়ে উঠে বসলো। রুমে সিসি টিভি লাগানো আছে কি না কে জানে! সিজারকে লাফ দিয়ে উঠে পড়তে দেখে মেয়েটিও উঠে বসলো। কিছুটা অপ্রস্তুত গলায় বললো,

-সরি! কিছু মনে করবেন না। রুমের দরজা খোলা ছিল। আলো জ্বলতে দেখে ভাবলাম ঢুকি। আসলে জার্ণি করে ঢাকা থেকে এসেছি তো, খুব টায়ার্ড লাগছে। আমার একটু ঘুমানোর খুব দরকার। অন্য রুমগুলি সব বুকড্। ড্রইং রুমও।

সিজার বললো,

– কোন অসুবিধা নেই। আমি তো এতোক্ষণ ঘুমালাম। এবার আপনি ঘুমান।

-আর আপনি?

-নতুন জায়গায় আমার ঘুম হয়না। এতোক্ষণ ঘুমিয়েছি এই অনেক।

-আপনি তাপস বাবুর গেস্ট?

-জী।

-তবে আমাদের সাথে জয়েন করলেন না যে?

-আমি ঠিক অভ্যস্থ না এসবে।

-সত্যি! অবাক লাগছে! আপনার মতো পুরুষও আছে!

পরদিন ভোর হতেই রুমে নাস্তা দিয়ে গেলো সেই অল্পবয়সী ছেলেটা। সিজার ওর রুমের মেয়েটির সাথে নাস্তা সারলো। চলে আসার আগে মেয়েটি বললো, যদি অনুমতি দেন আপনাকে একটা সালাম করতে চাই। তারপর অনুমতি না নিয়েই ঝপ করে ওকে কদমবুসি করে ফেললো। সিজারের বেশ ভালো লাগলো ব্যাপারটা। নিজেকে মহান হিসাবে সে উপস্থাপন করতে পেরেছে। এই গল্পটা হৃদিতার সাথে করতে হবে। নারী – পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে কোন গল্প এখনও হৃদিতার সাথে করা হয়নি। অথচ আলাপ আলোচনায় এ ব্যাপারটা আনা খুব জরুরী। ওকে এসব প্রসংগ তুলে সুড়সুড়ি দিয়ে কাজ আগিয়ে নিতে হবে। এসব কথায় হৃদিতা কেমন রেসপন্স করে তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে!

পরিকল্পনা অনুযায়ী পরদিনও হৃদিতার ফোন ধরলো না সিজার। ধরলো তারপরের দিন। ‘হ্যালো ‘বলতেই ফোনের ওপারে আছড়ে পড়লো হৃদিতার কন্ঠস্বর,

-তোমার কি হয়েছে? আমি এতোবার ফোন করছি তোমায়! তুমি কেনো ধরছো না আমার ফোন?

হৃদিতার কন্ঠস্বরে কান্নার আভাস। হৃদিতা আবার বলে,

-আমি খালামনির কাছে তোমার কথা জানতে চেয়েছিলাম। খালামনি বললো তুমি নরসিংদীতে  ভালো আছো। ফোন করেছিলে। তবে আমার ফোন কেনো ধরছো না?

হৃদিতা এবার পুরোপুরি কেঁদে ফেললো। এটাই চেয়েছিলো সিজার। ও চেয়েছিলো, ওর জন্য হৃদিতার মনে প্রচন্ড আবেগ সৃষ্টি হোক। তবেই হৃদিতার মন তৈরি হবে। সেই আবেগে ভেজা, মনের নরম মাটিতে সিজার তার নেশার চারাগাছটি সহজে রোপন করতে পারবে তাহলে। সিজার বললো,

– ইচ্ছা করেই ফোন ধরিনি। তোকে টুইনের গল্পটা বলে ফেলে খুব অনুতাপ হচ্ছিলো রে। কেন যে বলতে গেলাম! তুই হয়তো বিশ্বাসই করিসনি এতোবড় সত্যটা।

-অন্যকেউ বললে বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু তোমার সব কথা আমি চোখ বুজে বিশ্বাস করি সিজার। তুমি আমার অসম্ভব প্রিয় একজন মানুষ।

সিজারের কাছে হৃদিতার এই কথাটি স্বর্গীয় বাক্য বলে মনে হয়। আনন্দে চুপিচুপি শিষ বাজায় ওর মন।

শাপলা জাকিয়া। লেখক ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। পৈত্রিক নিবাস কুষ্টিয়া হলেও স্কুল ও কলেজ জীবন কেটেছে নারায়ণগঞ্জ শহরে। নারায়ণগঞ্জ সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেন। বর্তমান নিবাস ঢাকা। যুক্ত ছিলেন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতায়। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন দৈনিক যুগান্তরে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ- খুন...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

প্যাটাক্যুয়রিক্যাল নাইটশোয়ে আপনাকে স্বাগতম (পঞ্চম পর্ব )

প্যাটাক্যুয়রিক্যাল নাইটশোয়ে আপনাকে স্বাগতম (পঞ্চম পর্ব )

ইংরেজি ভার্সান এখানে >>> Welcome to the Pataquerical Night Show (Episode-5) পূর্ববর্তী পর্ব এখানে>>> শেষ…..

প্যাটাক্যুয়রিক্যাল নাইটশোয়ে আপনাকে স্বাগতম (৪র্থ পর্ব)

প্যাটাক্যুয়রিক্যাল নাইটশোয়ে আপনাকে স্বাগতম (৪র্থ পর্ব)

ইংরেজি ভার্সান এখানে >>> Welcome to the Pataquerical Night Show (Episode-4) পরবর্তী পর্ব পড়ুন এখানে>>>>…..