ইমন কল্যাণ
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
সিজার বলে,
-এমন করে কাঁদিস না তো । খুব খারাপ লাগছে ।
এ কথায় হৃদিতা বলে ওঠে ,
-তোমরা সবাই আমায় কি পেয়েছো বলতো ? যার যেমন করে খুশি কষ্ট দিয়ে যাচ্ছো !
-আচ্ছা ,তোকে আর কে কে কষ্ট দিচ্ছে ?
-কে, কে দিচ্ছে না ,তাই বলো । বাপি আর মাম্মি সারাক্ষণ খুঁত ধরে বেড়াচ্ছে । কেনো আমি এটা করিনা , কেনো ওটা ওমন করে করি । তাদের অভিযোগের অন্ত নেই। একটু ভালোবেসে বললেও পারে । শুধু বকাবকি । আর সাদাব যেটা করলো , সেটা যদি জানতে ।
-এই সাদাবটা কে ?
হৃদিতা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে । তারপর যখন কথা বলা শুরু করে তখন ওর গলাটা খুব কোমল শোনায় । যেন কথাগুলি বলতে ওর খুব কষ্ট হচ্ছে ।
-সাদাব আমার ফ্রেন্ডের ফ্রেন্ড । আমি ওকে ফ্রেন্ড হিসাবেই নিয়েছিলাম কিন্তু ও জানায় যে ও আমাকে ভালোবাসে । আমি ওর কথায় রাজি হই নাই । কিন্তু ফোনে কথা বলতাম । একসময় আমারও ওকে ভালো লাগতে শুরু করে । কিন্তু পরে জানতে পারি ,ও নাকি বাজি ধরে আমার সাথে প্রেম করতে এসেছিলো । বাজিতে জিতে বন্ধুদের সাথে পার্টিও করেছে । আমি জানতে পারার পর ওকে খুব বকি । ও বলে , বাজির ব্যাপারটা সত্যি । কিন্তু এখন আমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসে ফেলেছে । সাদাবকে আমি আর একবিন্দু বিশ্বাস করিনা । ফোনে ব্লক করেছি। তবু নানা নাম্বার থেকে ফোন করতে থাকে । তুমি ভাবতে পারো, আমার ফিলিংস নিয়ে কেউ এভাবে খেলেছে ?
-না, আমি ভাবতে পারছি না । কি ভয়ংকর সাহস ছেলেটার ! আমাকে ওর নাম্বারটা দিস । আমি কথা বলে নেবো । তুই এতোদিন বলিস নাই কেনো আমাকে ? এসব ফাজিলগুলিকে একদম পাত্তা দিবি না ।
-না, না ! তুমি এসবে জড়িও না । ব্যাপারটা চুকেবুকে গেছে ।
-শিওর ?
-হুম ।
-তবে প্রমিজ কর , আর কোনদিন তুই সাদাবের কথা ভেবে মন খারাপ করবি না । তোর মন খারাপের দিন শেষ । এখন মন খারাপের দিন শুরু সাদাবের । তোর মতো এতো চমৎকার একটা মেয়ের ইমোশন নিয়ে ও খেলেছে , অবহেলার শাস্তিটা এখন সাদাবের পাওনা।
হৃদিতা উত্তরে কিছু না বলে হাসে শুধু । সিজার বলে ,
-হাসলে হবে না । তুই প্রমিজ কর ।
-ওকে বাবা ! প্রমিজ । তোমাকে বলে হালকা লাগছে । এইজন্য তোমাকে আমার সবকিছু বলতে ইচ্ছা করে । তোমাকে বললে আমি ভারমুক্ত হই । দেখো এই ঘটনাটা বাপি বা মাম্মিকে বললে তুলকালাম করতো । অথচ তুমি আমায় বুঝলে , বকলে না । লাভ ইউ সিজার ।
-লাভ ইউ টু হৃদিতা । এবার তোকে একটা ঘটনা বলি ?
-বলো ।
-আজ অফিসে একটা গোলমাল চলছিলো ।শ্রমিকরা তাদের কিছু দাবী আদায়ের জন্য গত ছয়মাস ধরেই আন্দোলন করছে । একজন বেশি বাড়াবাড়ি করায় তাকে চাকরিচ্যুত করা হয় আজ । জানতে পেরে শ্রমিকরা একেবারে ক্ষেপে ফায়ার হয়ে যায় । তাদের কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছিলো না । কয়েকজন কর্মকর্তা তাদের সাথে কথা বলতে গিয়ে আরও ক্ষেপিয়ে দেন । এই অবস্থায় আমি নিজে থেকেই শ্রমিকদের সাথে আলোচনায় বসতে চাই । সবাই বলে দুঃসাহস হয়ে যাচ্ছে , তবু আমি যাই । কেনো জানিস ?
-কেনো ?
-কারণ, আমি জানি আমার কাছে যা আছে তা এদের কারও কাছে নেই । আমি চাইলে এটা ম্যানেজ করতে পারি । আমি নিজের রুমে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে থাকলাম । তারপর মনে মনে তোকে আমার কাছে নিয়ে আসলাম । তোর হাতটা শক্ত করে ধরলাম । তারপর চোখ খুলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম শ্রমিকদের সামনে।তুই বিশ্বাস করবি না , আমাকে দেখেই সবাই হৈচৈ বন্ধ করে শান্ত হয়ে তাকালো । আমাকে বলতেই হলো না যে, চুপ করো তোমরা , আমার কথা শোন ।
ওরা শান্ত হওয়াতে আমার বিশ্বাস আরও জোরদার হলো । আমি ধীরে ধীরে ওদের বোঝাতে শুরু করলাম । আর কি আশ্চর্য ! ওরা আমার কথা মেনে নিয়ে কাজে যোগ দিলো । অথচ একটু আগে আমার এই কথাগুলি অন্যরা বলে গেছে । তারা এরকম রেসপন্স তো পাই-ই নি , উল্টো শ্রমিকদের রোষানলে পড়ে গেছিলো । এটা কি করে সম্ভব হলো জানিস ? শুধু তোর জন্য !
-তুমি মনে মনে আমার হাত ধরলে আর তাতেই এমন ম্যাজিক হয়ে গেলো ! কি আশ্চর্য!
-আশ্চর্যের এখন যে কতোকিছু ঘটবে ! তুই শুধু দেখে যা । আমরা দুজন ,দুজনকে পেয়ে গেছি। এখন শুধু ম্যাজিক হবে, ম্যাজিক । দেখবি তুই দিন দিন আরও সুন্দর হবি । তোর মনের ইচ্ছাগুলি একে একে পূর্ণ হতে শুরু করবে । আর আমারও । আমরা এখন একটি যৌথ শক্তি ।
-আমিও যদি তোমার হাত মনে মনে ধরে কিছু করি , তাহলে কি আমিও সাকসেসফুল হবো ?
-হবি । তবে আরও একবছর পর । তোর যখন আঠারো হবে তখন । এখন তো সতেরো চলছে, তাইনা ?
-হুম ।
-গত দুইদিন তোর ফোন ধরি নাই । আমার খুব কষ্ট হয়েছে তোকে এভাবে কষ্ট দিতে । এখন থেকে তাই দুইবেলা ফোন করার পারমিশন দেয়া হলো । খুশি তো? কাল সকালে আমায় ফোন করে ঘুম ভাঙ্গাবি । পারবি ?
-খুব পারবো । কখন ফোন করতে হবে বলে দাও ।
-ভোর ছয়টা ।
-ওকে , ডান !
কিন্তু হৃদিতা ফোন করলো রাত দুইটায় । ফোন করেই হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে যেটা বললো, সেটা হলো ওর বাবা হঠাৎ করে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে । প্রচন্ড মাথাব্যাথা থেকে অজ্ঞান হয়ে গেছে ।
হৃদিতার বাবা হাসান সিজারের পুরানো বন্ধু । সিজারের আগেই বিয়ে করেছিলো সে কনাকে,অর্থাৎ মিতার বড় বোনকে । হাসানই আলাপ করিয়ে দিয়েছিলো সিজারকে নিজের শ্যালিকা মিতার সাথে । প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়েছিলো মিতা । সিজারের দিক থেকে অতোটা না হলেও অমত ছিলো না । হাসান সব জানতে পেরে নিজেই ঘটকালি শুরু করে । সিজারের মা-কে জানায় । তিনিও পছন্দ করেন মিতাকে। বিয়ে হয়ে যায়।
হাসানের সাথে সিজারের ঘনিষ্টতা তাই বাড়ির বাকি আরও দুই জামাই এর চেয়ে বেশি । হাসানের ইদানিং ব্যবসায় বেশ লস চলছে । একেবারে আকাশ থেকে মাটিতে পড়ার মতো অবস্থা । হয়তো মানসিক চাপ নিতে পারেনি । তাই এই হঠাৎ শারীরিক বিপর্যয় । কে যানে , হয়তো স্ট্রোক ! সিজারের অন্তত তাই মনে হয় । সে হৃদিতার কাছে জানতে চায় ,
-তোর চাচাদের জানিয়েছিস ?
-জানিয়েছি । ছোট চাচা রওয়ানা হয়েছেন । এসে বাবাকে ক্লিনিকে নিয়ে যাবেন । ওই তো এসে গেছেন । আমি রাখি । তুমি দোয়া করো ।
-তুই কিচ্ছু ভাবিস না হৃদিতা । আমি এক্ষুনি রওয়ানা হচ্ছি । আসছি আমি ।
নিয়ম অনুযায়ী নরসিংদীতে আরও দশ দিন থাকার কথা । ও ঢাকায় গেলে যার এখানকার দায়িত্ব নেয়ার কথা তাকে জরুরী অবস্থা দেখিয়ে খবর দিয়ে এনে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয় সিজার । ছেলেটি অল্প বয়সী ,চাকরিতেও সিজার জুনিয়র । পাশে কোম্পানীর কোয়ার্টারে থাকে । এতো রাতে ডাকার জন্য অসন্তুষ্ট কিনা বোঝা যাচ্ছে না । রফিক তার মুখ হাসি হাসি করে রেখেছে । সিজার প্রয়োজনীয় কয়েকটি মেইল সেরে অফিসের গাড়িতেই বেড়িয়ে পড়ে ।
গাড়িতে থাকতেই মিতার ফোন আসে। জানায় হাসানের কথা । সিজার মিতার কাছে সত্য লুকায় না। বলে যে, হৃদিতা ফোন করেছিলো , তাই ঢাকায় ফিরে আসছে সিজার । মিতা বিস্মিত হলেও খুশি হয় । তার পরিবারের কারও জন্য সিজার এতোটা নিবেদিতপ্রাণ, ভাবতে ওর ভালো লাগে,শান্তি লাগে ।
ঢাকায় ফিরে হাসানের প্রায় সব রকম দায়িত্ব নিয়ে নিলো সিজার । হাসানের দুই ভাই থাকলেও তাদের তেমন একটা জড়ালো না কিছুতে । হাসানের স্ট্রোক হয়নি । তার ব্রেণ টিউমার ধরা পড়েছে। অপারেশন জরুরী । সিজার পরিবারের সবাইকে বুঝালো, বাংলাদেশের চিকিৎসায় তার আস্থা নেই । ইন্ডিয়া নয়, সে হাসানকে থাইল্যান্ডে নিয়ে যেতে চায় । প্রথমেই আসলো টাকার কথা । হাসানের যা ব্যাবসার অবস্থা এখন , তাতে করে এতো টাকা সে দিতে পারবে না এই মুহুর্তে । হাসানের দুই ভাই টাকা দিতে চাইলো কিন্তু তারা বললো , অবস্থা ভালো নয় । এখন রুগীকে নিয়ে টানাহেচড়া না করে বাংলাদেশেই যা করার করা হোক । কিন্তু সিজার মানলো না। সে বললো,
– টাকা আপাতত আমি হাসানকে দিচ্ছি । হাসান বা তার ভাইরা যখন পারে শোধ করবে। কোন তাড়া নেই।
কয়েকদিনের মাথায় কনা ও হাসানকে নিয়ে সিজার রওয়ানা হলো থাইল্যান্ডে । অনেকগুলি টাকা সে এখানে ইনভেস্ট করছে শুধু হৃদিতার জন্য । হৃদিতা সম্পর্কে ওর ভাগ্নি। তার ওপর মেয়ের বয়সি। হৃদিতার সাথে ওর ঠিক প্রেমের সম্পর্ক যায় না । হৃদিতার মন চট করে সেটা নিতে পারবে না । তাই অন্য যে কোন নারীর চেয়ে হৃদিতা কঠিন টার্গেট । ওর বাবার জন্য সিজার কিছু করে দেখাতে পারলে হৃদিতার মনটা অনেক বেশি নরম হয়ে পড়বে। তাছাড়া হৃদিতা ওকে ভালোবাসে । শ্রদ্ধা, মুগ্ধতা আর সরলতা মেশানো ভালোবাসা । এটাকে কাম আশ্রিত ভালোবাসায় রূপান্তরিত করতে হবে । কিভাবে করবে সিজার ভেবে রেখেছে । মাঝখান থেকে হাসানের এই অসুস্থতা ওর জন্য খুব সহায়ক হলো । টাকার জন্য ভাবছে না সিজার। ওটা ফেরত পাবে, ও জানে । হাসানের ব্যাবসার অবস্থা ইদানিং খারাপ হলেও ওর পৈত্রিক সম্পত্তি অনেক । অবশ্য হাসানের খারাপ কিছু হয়ে গেলে ও খুব বিপদে পড়বে । সেই ভয়ে পিছিয়ে যেতে রাজি নয় সিজার । ঝুঁকি না নিলে কখনও বিজয় আসে না ।
ভাগ্য সিজারের সহায় ছিলো । হাসানের অপারেশন ভালোভাবে হয়ে যাওয়ার পর ও বিপদমুক্ত হতেই হাসানক আর কনাকে নিয়ে দেশে ফিরে আসলো সিজার । শ্বশুর বাড়িতে ওর অবস্থান এখন হিরোর মতো । মিতারা চার বোন । চার জামাইএর মধ্যে সিজারের যে কোন তুলনা হয় না সেটা সবাই প্রায় একবাক্যে স্বীকার করে নিলো । হাসান সিজারের হাত ধরে বললো,
-তুই আমার বন্ধু না রে , তুই আমার বাবা ।
কথাটা বলতে গিয়ে আবেগে কেঁদে ফেললো হাসান ।
সিজার বললো,
-হুম বাবাই তো ! তোর ডায়াপার পর্যন্ত আমাকে চেঞ্জ করতে হয়েছে বিপদে পড়ে । শালা ! তোর তো সব দেখে ফেলেছি ।
হাসান লজ্জা পেয়ে হেসেছে । সিজারের হাত ধরে বলেছে ,
-আমার মায়ের পেটের ভাইও এতোটা করেনি রে ।
হাসানের ভাইরা খুব বিরক্ত হয়েছে । তাদের কথা হচ্ছে বাংলাদেশে অপারেশন করালেই হতো। শুধু শুধু এতোগুলি টাকা থাইল্যান্ডে গিয়ে খরচ হলো । যেহেতু তাদের বাবা জোড় দিয়েছেন টাকাগুলি অবিলম্বে সিজারকে ফিরিয়ে দিতে তাই তারা সব টাকাই সিজারকে দিয়ে দেবে । তবে সিজার যেটা করেছে সেটা বাড়াবাড়ি ।
এসব শুনে মিতা খুব রেগে গেলো । বললো,
-হাসান ভাই এর ভাইগুলি কি অকৃতজ্ঞ দেখো। তুমি এতো করলে তাও তোমার দোষ ধরছে । এবার আমি ওদের কঠিন কিছু কথা শোনাবো ।
সিজার মিতাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
-একদম না । হাসান কষ্ট পাবে । আমি যা করেছি আল্লাহর খুশির জন্য করেছি । এটার জন্য কোন কথা তুমি বলো না ।
মিতা সিজারকে আরও শক্ত আলিঙ্গনে বেঁধে ফেলে বললো,
-তুমি কি সিজার ? এসব কথা শুনেও তোমার রাগ হচ্ছে না ? তুমি কি মানুষ না ফেরেশতা ?
সিজার তখন মনে মনে কল্পনা করছে এই আলিঙ্গনটা মিতার নয় হৃদিতার । হৃদিতার এমন একটা আলিঙ্গনের জন্য সে এতসব করেছে । কোথায় হৃদিতা? এবার ওকে একটু একলা পাওয়া বড্ড দরকার সিজারের।
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
পরিচ্ছেদ ৫ আকাশে এখন আর মেঘ নেই। হাওয়া হচ্ছে।কদিন পরেই বর্ষা নামবে।একদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে…..
পরিচ্ছেদ ৪ ভোর হয়ে আসছে।রাতে ভালো ঘুম হয়নি।ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে আসছে।এরকম…..
পরিচ্ছেদ ৩ শীত শেষ হয়ে আসছে।রাঙ্গালীবাজনা ঢোকার মুখের রাস্তাগুলো পলাশ ফুলে ভরে গেছে।অথচ ঠান্ডাই।…..