নেশা (পর্ব-৫)

শাপলা জাকিয়া
উপন্যাস, ধারাবাহিক
Bengali
নেশা (পর্ব-৫)

হৃদিতার জীবনে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। তার বাবা খরচ কমানোর জন্য ওদের গুলশানের বাড়িটা ভাড়া দিয়ে দিয়েছেন। আপাতত পুরান ঢাকায় ওর দাদা বাড়িতে এনে ওদের তুলেছেন। ছোট দুই ভাইকে গুলশানের স্কুল থেকে নিয়ে এসে ওয়ারীর একটা স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। হৃদিতা সবে ও লেভেল শেষ করে এ লেভেল শুরু করেছে । কলেজ না গেলেও চলে কিন্তু কোচিং করতে হয় তাকে কয়েকটা জায়গায়। ওয়ারি থেকে প্রতিদিন গুলশান যাওয়া বেশ ঝকমারি ব্যাপার । তাই সিজার হাসানকে বললো,

-হৃদিতা আমার বাড়ি থেকে পড়াশোনাটা করুক । আমি ভাববো আমার একটা মেয়ে নয়, দুইটা মেয়ে।

হাসান আজকাল সিজারকে দেখলেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। কৃতজ্ঞতায় চোখ ভিজে ওঠে। সিজারের এই কথায় সে শক্ত করে সিজারের হাত চেপে ধরলো। দুঃসময়ে মানুষের মনটা খুব আশ্রয় খোঁজে। যে কোন একটা খড়কুটো পেলেই তাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। অন্তত মানসিক সাপোর্টটা চায়। সিজার শুধু খড়কুটো নয়, যেন ত্রাণবাহী নৌকা, উদ্ধারকারী নৌকা হয়ে এসেছে হাসানের জীবনে। হাসানের বৌ কনা বলে,

-সিজার ! তোমার মতো ভালো মানুষ আজকের দুনিয়ায় হয় না, জানো ?

সিজার বলে,

-মেজ আপা! মানুষ তো মানুষের জন্যই। আমার এরকম কিছু হলে আপনারা কি আমার পরিবারের পাশে দাঁড়াতেন না ? আমি জানি দাঁড়াতেন। আপনারা যা করতেন, আমিও তাই করছি। এর বেশি কিছু নয়। প্লিজ এভাবে বলবেন না। আচ্ছা, আপনি তো এম, বি, এ শুরু করেছিলেন, সেটার কি হলো?

-করছি তো। কিন্তু হাসানের অসুস্থতার কারণে অনেক ক্লাস মিস গেলো। তুমি তো এম, বি, এ করেছো। খুব ভালো রেজাল্ট হয়েছিলো তোমার শুনেছিলাম। কয়েকদিন এসে আমায় একটু দেখিয়ে দাও না ভাই।

-নিশ্চয়! হাসানের ব্যাবসার কাজে এখন আপনাকে অংশগ্রহন করতে হবে। এম, বি, এ টা করা থাকলে কাজ বুঝতে সুবিধা হবে আপনার। আমি তো নরসিংদীতে  যাবো আরও এক সপ্তাহ পর। হাসানের জন্য লম্বা ছুটি নিয়েছি এবার। এর মধ্যে যে কোন একদিন আসতে পারি।

-পরশু পারবে?

-ওকে, পরশু হতে পারে।

সেদিন হাসানের বাড়ি থেকে ফেরার সময় সিজার আর মিতা হৃদিতাকে সাথে করে ওদের বাড়ি নিয়ে এলো। গেস্ট রুমটা খালি পড়ে আছে। সেখানে অনান্য আসবাবপত্রের সাথে একটা পড়ার টেবিল সেট করলো মিতা। তারপর সেই ঘর বরাদ্দ করা হলো হৃদিতার জন্য।

আজকাল হৃদিতার চোখেও সিজার হাসানের মতো কৃতজ্ঞতার ছায়া দেখতে পায়। সিজারের  দিকে তাকালে হাসান আর হৃদিতা দুজনের চোখেই ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা আলো হয়ে জ্বলে।

হৃদিতাকে বাড়িতে আনার পরদিনই সিজার ওকে একা পেয়ে গেলো। মিতা সকাল সকাল বের হয়েছে ছেলে – মেয়ে দুইটাকে নিয়ে। ছেলেকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে তারপর মেয়েকে পৌঁছে দেবে কোচিং এ। ছেলে মেয়ের স্কুল আর কোচিং শেষ হলে তবে ফিরবে মিতা। ফিরতে ফিরতে দুপুর দুটো বাজবে। কাজের বুয়া রান্নাঘরে ব্যাস্ত। ড্রইং রুমে হৃদিতাকে সোফায় বসে মোবাইল নাড়াচাড়া করতে দেখে সিজার ওর পাশে গিয়ে বসলো। বললো ,

– কি রে? বাড়িতে ফোন করেছিস আজ? সব ঠিক আছে?

– হুম

– বাড়ির জন্য মনখারাপ?

উত্তরে হৃদিতা মৃদু হাসে শুধু। তাকে বিষন্ন দেখায়।

সিজার বলে,

– আজ কোচিং নেই?

– একটা আছে। বিকেলে।

– শোন! মন খারাপ করিস না। সময় একরকম থাকে না। সময় বদলায়। এটা পৃথিবীর নিয়ম। পৃথিবীতে বাস করলে এই নিয়ম মেনে নিতে হবে আমাদের। আশার কথা হচ্ছে, নিয়মানুযায়ী এই খারাপ সময়টাও চলে যাবে। তখন আবার আসবে ভালো সময়। খারাপ সময় আসলে কি করতে হয় জানিস? অপেক্ষা করতে হয়। নানান কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখে খারাপ সময়টাকে দ্রুত পাড় করে দিতে হয়।

হৃদিতা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

– এতো খারাপ সময় না আসলে কি হতো না!

সিজার বলে,

– শোন! সময়টা আরও খারাপ হতে পারতো। হাসান বেঁচে আছে এখনও, এটাই তো বিরাট সৌভাগ্যের! তুই টেনশন করবি বলে আগে তোকে জানায়নি। থাইল্যান্ডে তোর বাবার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছিলো। আমি প্রতিদিন প্রার্থনা করতাম হাসানের জন্য। মনে মনে তোকে সাথে নিতাম। অপারেশনের পর ডাক্তাররা বলেছিলেন,এতো জটিল অপারেশন সাকসেসফুল হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো মাত্র টেন পার্সেন্ট। এ ধরনের পেশেন্টদের নাইন্টি পার্সেন্টই নাকি অপারেশনের ধকল নিতে পারে না। হাসানের সফল অপারেশন আর এতো দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠা একটা মিরাকল। এই মিরাকল কেনো হয়েছে জানিস? কারণ তোর আর আমার শক্তি এখন একসাথে কাজ করছে। তোর কি এখন বিশ্বাস হয় যে, আমি তোর টুইন? না কি আরও প্রমাণ চাইবি? শোন তুই যতো অবিশ্বাস করবি প্রকৃতি ততো অঘটন ঘটিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করবে সত্যটা। তুই আমাকে হান্ড্রেড পার্সেন্ট বিশ্বাস করিসনি। তাই তোর বাবার অসুস্থতা, আর সুস্থ হয়ে ওঠার ঘটনার মধ্যে দিয়ে প্রকৃতি প্রমাণ করার চেষ্টা করলো যে আমি তোর টুইন। দ্যাখ, প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ চলে না। প্রকৃতির চাওয়া দেয়ালের মতো সামনে এসে দাঁড়ায়। তুই যতোই তলোয়ার নিয়ে দেয়ালের সাথে যুদ্ধ করিস না কেনো, লাভ নেই। প্রকৃতির সিদ্ধান্ত মানুষকে মেনে নিতে হয়। প্রকৃতি চায় তুই আর আমি এক হই। আমাকে বিশ্বাস কর।

হৃদিতা অসহায় গলায় বলে,

-আমি তো বহুবার বললাম। তোমাকে আমি চোখবুজে বিশ্বাস করি।

-না, করিস না। করলে আমার অফিসে ওইভাবে শ্রমিক আন্দোলন হতো না, তোর বাবা অসুস্থ হতো না। তুই বিশ্বাস করিসনি। তোর অবচেতনে কোথাও না কোথাও একটু অবিশ্বাস ছিলো। তাই এই বিপদ গুলি আসলো। আমি তোর আর আমার যৌথ শক্তি দিয়ে দুইটা বিপদই মোকাবেলা করে জিতলাম। প্রতিবার যে জিতবোই, তার কোন গ্যারান্টি নেই। নাও জিততে পারি। তুই মনে আর কোন রকম অবিশ্বাসকে জায়গা দিস না, প্লিজ। তোর যখনই মনে হবে আমি তোর টুইন না, তুই সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে কথাটাকে লাল কালি দিয়ে কেটে দিবি। তাহলে আর খারাপ কিছু হবে না। এখনি কর। চোখ বন্ধ করে দ্যাখ, তোর সামনে একটা সাদা বোর্ড। বোর্ডের ওপর লেখা –সিজার আর হৃদিতা পরস্পরের টুইন। কথাটায় লাল কালি দিয়ে টিক চিহ্ন দে। এরপর নিচের দিকে তাকা। দ্যাখ , সেখানে লেখা আছে- সিজার আর হৃদিতা পরস্পরের টুইন নয়। কথাটা লাল কালি দিয়ে কেটে দে। এবার চোখ খোল।

হৃদিতা চোখ খুলে ঝলমলে গলায় বললো,

-মনে মনে কতো কিছু করা যায়, তাইনা ? আমার কাছে খুব ইন্টারেস্টিং লাগলো ব্যাপারটা।

সিজার বললো,

-তুই চাইলে আমার মনের ভিতরটা দেখতে পারিস, আমি তোর মনের ভিতর ঢুকেছিলাম।

-সত্যি? কি দেখলে তুমি? আমার মনের ভিতরটা কেমন?

-তোর মনের ভিতরটা তোর বাইরের রূপের চেয়েও সুন্দর। চোখ বন্ধ করার পর আমি যখন তোর মনটা দেখতে চাইলাম। তখন দেখলাম আলোকিত একটা পথ। আমি সেই পথে গেলাম। একটা খুব ছায়া ছায়া, শ্যাওলা রঙ্গা সবুজ জায়গায় এসে থামলাম। মধুর এক অপার্থিব সুর বাজছিলো সেখানে। পায়ের নিচের ঘাসগুলি মখমলের মতো নরম। আর কি আরামদায়ক ঠান্ডা একটা বাতাস চারদিকে। সেইসাথে নাকে এসে লাগলো মন আকুল করা এক সুবাস। এটাই তোর মন। তোর মনটা বড় সুন্দর রে।

-তুমি কি করে এমন দেখতে পাচ্ছো?

-তোকে টুইনের ব্যাপারটা জানানোর পর থেকে আমার এই আধ্যাত্মিক শক্তিটা আমি পেয়েছি হৃদিতা। এই ধরনের ক্ষমতা আমার বাবারও ছিলো। বাবা বলেছিলেন, আমার টুইনকে আমি খুঁজে পেলেই আমারও এই ক্ষমতা হবে।

-আমি কারও মন দেখতে চাইলে পারবো?

-একটু সমস্যা আছে। সেটা হলো আমার ওপর আমার বাবার প্রভাব আছে বলে আমি সহজে পারছি। তাছাড়া আমার বয়স চল্লিশ হয়ে গেছে। একটা মানুষ সম্পূর্ণ পরিপূর্ণতা পায় চল্লিশ বছর বয়সে। আমাদের নবীজীও কিন্তু নবুয়ত পেয়েছিলেন চল্লিশ বছর বয়সে। আধ্যাত্মিক ক্ষমতা জোরদার হওয়ার জন্য এই বয়সটা খুব জরুরী। আঠারো হলেও মোটামুটি হয়। তোর সবে সতেরো। আমার বাবার কাছ থেকে এসব তথ্য জেনেছি আমি। তবে একটা উপায় আছে।

-কী উপায়?

-আমি যদি তোকে স্পর্শ করি তবে তোর শক্তি আস্তে আস্তে বাড়ার কথা।

এই কথায় হৃদিতা একটু চমকে তাকায়। ও একটা উঠতি বয়সি মেয়ে। কোন পুরুষ স্পর্শ করতে চাইলে ওর মনে সন্দেহ উঁকি দেবেই।

সিজার তাই দ্রুত বলে,

-ভয় পাস না! তুই আমার হাতটা ধর। আর কিছু না। এবার চোখ বন্ধ কর। ধীরে ধীরে দম নে, ধীরে ধীরে দম ছাড়। দশবার। নিঃশ্বাস নিবি নাক দিয়ে কিন্তু ছাড়বি মুখ দিয়ে। অনুভব কর, তোর শরীর হালকা হতে শুরু করেছে। প্রতিটা  প্রশ্বাসের সাথে তোর মনের যাবতীয় কষ্ট, সন্দেহ বেরিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথে প্রকৃতি থেকে আধ্যাত্মিক শক্তি তোর শরীরে প্রবেশ করছে। একই সাথে আমার শরীর থেকে আধ্যাত্মিক শক্তি তোর শরীরে প্রবেশ করছে। এখন নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হতে দে। মনে কর তোর শরীরটা বালুর তৈরী। কোথাও থেকে প্রচন্ড বাতাস আসছে। সেই বাতাসে তোর শরীরের সমস্ত বালুকণা চারিদিকে বিচ্ছিন্ন হয়ে উড়ে যাচ্ছে। তোর শরীর বলতে এখন আর কিছুই নেই। এখন আছে শুধু তোর মন। কোন রাস্তা কি দেখতে পারছিস?

হৃদিতা খিলখিল করে হেসে উঠে চোখ খুলে ফেলে,

-ধুর! আমাকে দিয়ে হবে না। কোন রাস্তা দেখিনা তো।

সিজার আচমকা হৃদিতাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। তারপর দীর্ঘ চুমু খায় ওর কপালে।

হৃদিতা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকে সিজারের মুখের দিকে, যখন সিজার ওকে তার শক্ত আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে।

সিজার বলে,

-খুব ভালো করে ছুঁয়ে দিয়েছি। এবার নিজের রুমে গিয়ে প্র্যাকটিস কর। কি হয়, আমাকে জানাস। আর মনে রাখবি, একদম সন্দেহ করবি না আমাকে। সন্দেহ করলেই কিন্তু তোর বা আমার পরিবারে বিপদ নেমে আসবে।

শাপলা জাকিয়া। লেখক ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। পৈত্রিক নিবাস কুষ্টিয়া হলেও স্কুল ও কলেজ জীবন কেটেছে নারায়ণগঞ্জ শহরে। নারায়ণগঞ্জ সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেন। বর্তমান নিবাস ঢাকা। যুক্ত ছিলেন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতায়। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন দৈনিক যুগান্তরে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ- খুন...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ