নেশা (পর্ব – ৬)

শাপলা জাকিয়া
উপন্যাস, ধারাবাহিক
Bengali
নেশা (পর্ব – ৬)

হৃদিতার দাদা বাড়িটা চারতলা । এই চারতলা বাড়ির তিনতলার উত্তরদিকের ফ্ল্যাটটাতে হাসান এসে উঠেছে। হাসান এ বাড়ির ছোট ছেলে ।হাসানের বৌ কনা তার গুলশানের বিলাসবহুল বাড়ির বেশির ভাগ ফার্নিচারই আনতে পারেনি এখানে । এই ছোট ফ্ল্যাটে সেসবের জায়গা হবে না । নিজেদের শখের ফার্নিচার সহই ওদের গুলশানের বাড়িটা ভাড়া দিয়েছে এক ব্রিটিশ ভদ্রলোককে । ভাড়াটিয়া বছর পঞ্চাশের এ্যান্থনি। সে সিজারের কলিগ । সিজারইই দুপক্ষের হয়ে সব ব্যাবস্থা করে দিয়েছে।

পুরান ঢাকার এই ছোট ফ্ল্যাট কণা এর মধ্যেই বেশ যত্ন করে সাজিয়েছে । কিছু মানুষ থাকে তারা যেখানে , যেভাবেই থাকুক না কেন সাজিয়ে গুছিয়ে থাকবে । কনা সেই দলের । এখনকার ফ্ল্যাটে গুলশানের ফ্ল্যাটের মতো জৌলুষ নেই কিন্তু স্নিগ্ধতা আছে ।

কনার বয়স হয়েছে যদিও। তবু একদা ধনী ব্যাবসায়ীর সুন্দরী বৌ হিসাবে তার জৌলুষও কম নয় । স্বামীর অসুস্থতা আর ব্যাবসায়িক ক্ষতির ধকল ওর চোখে-মুখে ছাপ ফেলেছে কিছুটা । দৃষ্টিতে ক্লান্তি জমেছে সেইসাথে চোখের নিচে চওড়া কালি । ঝলমলে চুলগুলি আগের চেয়ে বিবর্ণ।

তবু কনা প্রথমবারের মতো আজ সিজারকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করলো । সিজার নিজেও আগেভাগে টের পায়নি যে ব্যাপারটা ঘটবে । ও টের পেলো তখন, যখন কনার খুব কাছে বসে সে কনাকে এম ,বি, এর কিছু বিষয় বোঝানো শুরু করলো ।

তখন সকাল এগারোটা । হাসান নাস্তা সেরে আবার ঘুম দিয়েছে ওষুধের প্রভাবে। তাকে এখনও নিয়ম করে কড়া ডোজের ওষুধ খেতে হয় । কনার বড় মেয়ে হৃদিতা এখন সিজারের বাসায় আর ছোট দুই ছেলে স্কুলে । একটা নিরিবিলি ঠান্ডা রুমে সোফায় পাশাপাশি বসে আছে সিজার আর কনা । একটু আগে অসাধারণ স্বাদের এক শরবত দিয়ে সিজারকে আপ্যায়ন করেছে কনা। কনার রকমারি রান্নাবান্নার শখ। দুই রকমের মজাদার স্ন্যাকসও ছিল শরবতের সাথে। ছোট বোনের স্বামীকে যথাযোগ্য আপ্যায়নে কমতি রাখেনি সে।

সিজার আর কনা যে সোফাটায় বসে আছে তার সামনের টেবিলটায় কনার ল্যাপটপ খোলা । বইপত্র ছড়ানো রয়েছে । সিজার পড়া বোঝানোর সাথে সাথে আন্দাজ করার চেষ্ট করছে কনা কোন ব্র্যান্ডের পারফিউম মেখেছে । কিন্তু নামটা ধরতে পারছে না । কয়েকবার নাক টেনে গন্ধ নিয়ে সিজার হাল ছেড়ে দিলো । গন্ধটা খুব পরিচিত কিন্তু নাম মনে পড়ছে না। হঠাৎ মনে পড়লো এই একই পারফিউমের গন্ধ সে হৃদিতার কাছ থেকে পেয়েছে!

কনার সঙ্গ উপভোগ্য হয়ে উঠলো সিজারের কাছে শুধু এই হৃদিতা- হৃদিতা সুবাসটার জন্য ।

পড়াশোনা যা কিছু দেখানোর , দেখানো শেষে সিজার যখন পুরান ঢাকার সেই চারতলা বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এলো, তখন তার পকেটে কনার ইমেল এ্যাড্রেস আছে । কনার ডাইরির এক পাশে সেটা লেখা ছিল । সিজার কনার চোখ এড়িয়ে নিজের মোবাইলে সেটা তুলে নিয়েছে । তার একটা প্ল্যান আছে ।

প্ল্যানটা ভাবতেই ওর শরীর কেমন শিরশির করে উঠলো ! একজন সুন্দরী মহিলার সান্নিধ্যে কাটলো সারাটা দিন । এভাবে কনার এতো কাছাকাছি বসে আস্ত একটা দিন কাটানোর সুযোগ সিজার এর আগে কখনও পায়নি। সিজার মৃদু হেসে বিড়বিড় করে কনা ও হৃদিতার উদ্দেশ্যে- একই সাথে মা ও মেয়ে ! তোমরা দু’জন অপ্রতিরোধ্য !

তবে সিজার জানে তাকে দুজনের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে হবে । সে হৃদিতাকেই বেছে নেবে ঠিক করলো । হৃদিতার ব্যাপারটা অনেকদূর এগিয়ে এনেছে সে । মাঝরাস্তায় ছেড়ে দেয়ার মানে হয় না । কনাকে সে একটা টোকা দেবে । টোকা দিয়ে দেখবে কনা কি করে।

বাড়িতে ফিরে নিলয় রহমান নামে একটা ফেইক ইমেইল বানালো সিজার  । তারপর সেই ইমেইল থেকে একটা মেইল পাঠালো কনার ইমেইলে । মেইলে লেখা আছে- “ সিজার রহমান ইজ অপারেটিং এ বিগ কিস! ”

কনা এই মেইলটা পড়ার সময় ওর সিজারের কথা মনে পড়বে । ওর আলাদা করে মনে পড়বে যে, সিজার একজন পুরুষ মানুষ এবং চুমু –টুমু খাওয়ার মতো ব্যাপারগুলি একজন পুরুষ মানুষ হিসাবে নিশ্চয়ই সিজার তার জীবনে পালন করে ।

কনা এরকম করে ওকে নিয়ে ভাববে ,শুধু এটুকু আনন্দের জন্যই সিজার এই মেইলটা পাঠাচ্ছে। এই মেইল না পেলে, সিজারও যে চুমু খেতে পারে সেটা হয়তো কোনদিন কনা ওর চিন্তাতেও আনতো না ।

বলা যায় না , আগ্রহী হলে কনা হয়তো একটা রিপ্লাইও দিয়ে দিতে পারে ওকে । তখন কি করবে সিজার ? কনার সাথে চালিয়ে যাবে ? আচ্ছা সে পরে দেখা যাবে। ফেইক ইমেইল আইডি তৈরি থেকে শুরু করে মেইল পাঠানোর সময় পর্যন্ত সিজার একটা অদ্ভুত আনন্দে ডুবে থাকলো । আহা নিষিদ্ধ কাজের যে নেশা , তা কোন পুরানো দামি ওয়াইনও তৈরি করতে পারে না । তবে একটা সমস্যা যে ওর মাথায় উঁকি দিচ্ছে না , তা না। আজ সিজার কনার বাসায় এসেছিলো আর আজই এমন একটা মেইল গেলো কনার কাছে। কনা যদি সিজারের ব্যাপারে আগ্রহী না হয় তাহলে তো সিজারকে খুব খারাপ ভাববে । কি অজুহাত দেবে তখন ও ? সিজার মনে মনে উত্তর গুছিয়ে রাখে ।

সিজারকে বেশি অপেক্ষা করতে হয় না । পরদিনই কনা ফোন করে মিতাকে । মিতা সিজারের  সামনে এসে কেঁদে ফেলে ,একরকম চিৎকার করে বলে,

-ছিঃ সিজার ! তুমি এতো নীচ ! তুমি মেজআপাকে এমন নোংরা মেইল পাঠিয়েছো?

সিজার আকাশ থেকে পড়ার ভান করে বলে,

-এসব কি বলছো ? আস্তে কথা বলো । পাশের ঘরে হৃদিতা আছে, ছেলেমেয়েরা আছে । প্লিজ মিতা । কি হয়েছে শান্ত হয়ে আমায় খুলে বলো।

-শান্ত ? এই কথা শোনার পর তুমি কি করে আশা করো যে আমি শান্ত থাকবো ?

-ওকে আমি তবে মেজ আপাকে ফোন করে জেনে নিচ্ছি । তুমি প্লিজ ততোক্ষন চিৎকার করবে না । আমাকে ব্যাপারটা বুঝতে দাও ।

সিজার দ্রুত কনার নাম্বারে ডায়াল করে । স্পিকার লাউড করে রাখে যাতে ওদের আলাপচারিতা মিতা শুনতে পায় ।

-হ্যালো, মেজ আপা ! কি হয়েছে আমি কিছু বুঝতে পারছি না । আমাকে বলুন তো ।

-আর বলো না ভাই একটা বাজে মেইল আসছে । তোমার নাম নিয়ে লেখা ।

-কি লেখা ?

কনা উত্তর দিতে একটু অস্বস্তি বোধ করছে বুঝা যায় । সে চুপ করে আছে । তারপর বলে,

-আমি কথাটা মিতাকে বলেছি । ওর কাছ থেকে শুনে নিও ।

-মিতা রেগে টং হয়ে আছে আপা । ওর সাথে এখন কথা বলাই মুশকিল । আপনি আমাকে বলুন ।

কনা ধরা গলায় বলে,

-লেখা আছে, সিজার রহমান ইজ অপারেটিং এ বিগ কিস !

মিতা সিজারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ফোনের আলাপচারিতা সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। সিজার তাই কথাটা শুনেই মুখে বিরক্তি আর বিস্ময়ের ছায়া ফুটিয়ে তোলে। কিন্তু ওর মনে তখন খুশির ফোয়ারা । আহা ! কনার কন্ঠে কথাটা শুনতে কতো সুখ লাগলো ওর । এই সুখ ও নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে তৈরি করেছে । এখন তা উপভোগ করলো ওর কান । নিজের পিঠ নিজেই মনে মনে চাপড়ায় সিজার । তারপর লজ্জা পেয়েছে এমন গলায় বলে,

-ছিঃ ছিঃ মেজ আপা এই মেইল আমি আপনাকে মরে গেলেও পাঠাতে পারবো না । আমি পাঠায়নি । আচ্ছা বলুন তো ,এটা কি আমার ইমেইল এ্যাড্রেস থেকে গেছে ?

-না , নিলয় রহমান নামের একটা এ্যাড্রেস থেকে এসেছে । আর আমি জানি তো এটা তুমি পাঠাও নাই । মিতার সাথে আমি ব্যাপারটা শেয়ার করলাম মাত্র । তোমাকে বলতে নিষেধ করেছিলাম । ও তাও ঝামেলা করছে ? কি আশ্চর্য! ওকে ফোনটা দাও তো ।

সিজার বলে,

আমার মনে হচ্ছে আপনাদের পরিবারের সাথে আমার এই ঘনিষ্ঠতা কারও পছন্দ হচ্ছে না । সেদিন আপনাদের বাড়ি আমি অনেকটা সময় ছিলাম । এটা কেউ নোটিশ করেছে । সেই এই মেইল পাঠিয়েছে আপনাকে । যার কাছে আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস আছে , এবং আপনার বাড়িতে কে যায়, কে আসে ,সেসব খবরও আছে। কে হতে পারে , আপনার শ্বশুর বাড়ির কেও নয় তো ? একটু সাবধানে থাকবেন মেজ আপা । আমি মিতাকে ফোন দিচ্ছি ।

মিতা ফোন ধরতেই কনা বলে ওঠে,

-তুই কিরে ? আমি তোকে বললাম , সিজারকে বলবি না। আর তুই এটা বলে আবার অশান্তি শুরু করেছিস ওর সাথে ? তোর বুদ্ধিশুদ্ধি কি কোনকালে হবে না ? সিজারের মতো ভালো ছেলে কটা হয় বলতো ? এই মেইল আমার শ্বশুর বাড়ির কেউ শয়তানি করে পাঠিয়েছে নিশ্চয়। সিজার আমাদের এতো সাহায্য করছে এটা অনেকেরই পছন্দ না এই বাড়িতে। সিজারকে সরাতে পারলে আমি আর হাসান সাহায্যের জন্য হাসানের দুই ভাই এর পায়ে ধরবো , এতে ওদের ইগোর খুব আরাম হবে । তাই এসব চাল চেলে সিজারকে দূরে সরানোর চেষ্টা করছে । আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন যে কি পাজীর পাজী তুই তো জানিস না । থাইল্যান্ডে গিয়ে হাসানের ট্রিটমেন্ট করিয়ে এনেছে সিজার । ওতোগুলি টাকা ওদের সিজারকে দিতে হয়েছে । বুক ফেটে মরে যাচ্ছে সব । শোন ! তুই এটা নিয়ে সিজারের সাথে একদম ঝামেলা করবি না । বুঝলি ?

মিতা কনার কথা বুঝেছে । সে চোখের পানি মুছে সিজারকে সরিও বলেছে । কিন্তু সমস্যা হচ্ছে , হৃদিতা আগের মতো সিজারের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে না । হৃদিতা কি ঘটনাটা জেনে ফেললো ? না কি সিজার ওকে সেদিন ড্রইংরুমে ওভাবে জড়িয়ে ধরায় ও সিজারকে ঘৃণা করতে শুরু করেছে ?

রাতে খাওয়ার টেবিলে হৃদিতাকে ভালো করে খেয়াল করলো সিজার । মেয়েটা আগের চেয়ে অনেক শান্ত আর পরিণত আচরণ করে । হয়তো বাবার এই আকস্মিক অসুস্থতা আর আর্থিক ধস ওকে পরিণত আর শান্ত আচরণ শিখিয়ে দিয়েছে । কিন্তু আরও একটা ব্যাপার সিজারের  চোখে পড়লো। ওকে খুব লজ্জা পাচ্ছে হৃদিতা । সিজারের চোখের দিকে চোখ রেখে কথা বলছে না । এটা কেনো করছে, লজ্জাই তো? না কি সন্দেহমিশ্রিত ঘৃণা থেকে দূরত্ব তৈরি করার চেষ্টা করছে হৃদিতা সিজারের সাথে?

পরবর্তী কয়েকদিন হৃদিতাকে একা পেলো না সিজার । হৃদিতাও একদিনের জন্য ওর সাথে গল্প করতে এলো না । এদিকে নরসিংদীতে যাবার সময় হয়ে এসেছে । ছুটি শেষ । অবশেষে হৃদিতার মনের কথা না জেনেই আগামী পনেরো দিনের জন্য ঢাকা ছেড়ে সিলেটের পথে রওয়ানা হলো সিজার ।

সিলেটে এসে হৃদিতাকে ফোন করলো না ও । যদিও পাগলের মতো অপেক্ষা করলো হৃদিতার ফোনের । মেয়েটার মনের অবস্থাটা জানা খুব জরুরী । কিন্তু সিজার কিছুতেই আগে ফোন করবে না । হৃদিতার কাছে এই স্টেজে হ্যাংলা হওয়া যাবে না কিছুতেই।

অবশেষে সিজার সিলেটে আসার চারদিন পর হৃদিতার ফোন এলো ।

সিজার ওর গলার স্বর যতোদূর সম্ভব নির্লিপ্ত রেখে জানতে চাইলো,

-কিরে , কি খবর ? ভালো আছিস তোরা ? হাসান কেমন আছে ?

-ভালো । তুমি ভালো আছো ?

-হুম।

হৃদিতা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে । সিজারও কিছু বলে না । হৃদিতার মনের গতি এখনও টের পায়নি ও। চুপ করে থাকাটাই ভালো ।

অগ্যতা লজ্জা লজ্জা গলায় হৃদিতা বলে,

-জানো সেদিন তোমার মনটা আমি দেখতে পেয়েছিলাম।পরে রুমে গিয়ে প্র্যাকটিস করেছি, তুমি যেভাবে শিখালে ।

সিজারের মনটা খুশিতে নেচে ওঠে । যাক , হৃদিতা ওকে সেদিন জড়িয়ে ধরাটাকে প্র্যাকটিসের অংশ হিসাবেই নিয়েছে । সিজার নিজের আনন্দকে লুকিয়ে মিথ্যা ব্যাস্ততা দেখায় । বলে ,

-সুইট ! সুইট ! আমার একটা জরুরী কাজ এসে পড়েছে রে। আমি তোকে একটু পরে ফোন দেই ?

হৃদিতার গলা হতাশ শোনায় । অনেক জড়তার পাহাড় ডিঙ্গিয়ে আজ সিজারকে ফোন করেছে সে বোঝা যাচ্ছে। এই হঠাৎ বাঁধা ওর ভালো লাগে না । হৃদিতা বলে ,

-কতোক্ষণ পর ?

-এই ধর বিশ মিনিট ।

বিশ মিনিট পাড় হয়ে চল্লিশ মিনিট হয়ে গেলো। সিজার ইচ্ছা করেই ফোন করলো না হৃদিতাকে । আরেকটু অপেক্ষা করুক হৃদিতা । ও বুঝুক সিজারকে চাইলেই পাওয়া যায় না । অপেক্ষার পর অবশেষে সিজারকে যখন পাবে হৃদিতা, সে সময়টা তখন ওর কাছে অনেক দামি হয়ে উঠবে।

পঞ্চাশ মিনিটের মাথায় হৃদিতাই ফোন করলো সিজারকে,

-তুমি আমায় কল করবে বলে করলে না কেনো , বলো তো ?

-ওহো সরি রে ! কাজের চাপে একদম ভুলে গেছিলাম ।

-ঠিক আছে , তুমি ভুলেই থাকো । আমি রাখছি ।

-এই না, রাখিস না , প্লিজ ! তোর সাথে ম্যালা কথা আছে ।

হৃদিতা রাগ করে ফোন কেটে দিয়েছে । সিজার এবার হৃদিতাকে কল করতে থাকে । একবার, দুইবার তিনবার। হৃদিতা ধরে না । চতুর্থবারের বার ধরে । অভিমান মেশানো কান্নায় ওর গলা থমথম করছে । সিজার মনে মনে ভাবে, এই তো, এখনই সময়। হৃদিতার মনের মাটি এখন তৈরি । পরিকল্পিতভাবে হৃদিতার মধ্যে কান্নার মতো তীব্র আবেগ তৈরী করতে পেরেছে সিজার। আবেগে হৃদিতা এখন ভিজে নরম । এখনি ওকে ছেনে হাতের পুতুল বানানোর কাজ শুরু করতে হবে ওকে ।

সিজার বলে ,

-সুইট ! সুইট! রাগ করিস না । আয় কাছে আয় । ছোটবেলায় তোর কান্না পেলেই তুই আমার কাছে আসতিস মনে আছে ? আধো আধো গলায় বলতিস- সিজার ! আমার কান্নায় আদল আদল কলে দাও ।তখনও ‘র’ কে ‘ল’ বলতিস,এতো ছোট। আমি তোর চোখে হাত বুলিয়ে বলতাম আদল …আদল । সাথে সাথে তুই শান্ত হয়ে যেতিস ।

হৃদিতা মন খারাপ ভুলে হাসতে হাসতে বলে ,

-আমি ছোটবেলা থেকেই তোমার খুব ন্যাওটা ছিলাম না ?

-হুম ।

-জানো, তোমাকে আমার সুপারম্যান মনে হতো । মনে হতো তুমি যে কোন সমস্যা সমাধান করে দিতে পারো ।

-হা হা হা ! এখন কি মনে হয় ?

-এখনও তাই মনে হয় । তুমি আমার বাবার পাশে আমাদের পাশে তো সুপারম্যান হয়েই দাঁড়িয়ে আছো। আমি মানুষ চিনতে ভুল করিনি সিজার।

-হা হা হা ! কি পাকা পাকা কথা , সে মানুষ চিনে ফেলেছে ! তুই কবে এমন বুড়ি হয়ে গেলি রে হৃদি ?

অনেক অপেক্ষার পর সিজারকে পেয়ে হৃদিতার মুখে কথার খই ফুটছে । হৃদিতা বলে ,

-শুধু বাস্তবে নয় । মনে মনেও আমি তোমার ওপর খুব নির্ভরশীল । তোমাকে সব না বললে আমার ভালো লাগে না । তুমি পাশে থাকলে মনে হয়, কোন ভয় নেই ।

-এরকমই হওয়ার কথা ,তুই তো আমার টুইন।

-হুম । কিন্তু কি জানো ,সেদিন তোমার মনটা আমি দেখতে পেলাম কিন্তু কোন রং দেখতে পারছিলাম না । যা দেখছিলাম সব ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট ।

-তোর ভিজুয়ালাইজেশন ক্ষমতা কম আছে হৃদিতা । এটা বাড়াতে হবে ।

-এটা কিভাবে বাড়াবো ?

-শিখবি আমার কাছ থেকে ?

-হু ।

-ঠিক আছে । আজ থেকে তবে ক্লাস শুরু । ওকে ?

-ওকে ।

-ধরে নে তুই আর আমি সিজার আর হৃদিতা না । আমরা দুইজন সমবয়সী দুইজন গ্রামের ছেলে । গরীবের ঘরের ছেলে । খালি গা , খালি পা । একটা প্যান্ট পড়া শুধু । চোখ বন্ধ কর । দেখতে পাছিস ?

-পাচ্ছি ।

-তোর প্যান্টের রং কি ?

-কোন রং দেখতে পারছি না ।

-আচ্ছা । শুরুতে রং দেখতে অসুবিধা হতে পারে । কোন অসুবিধা নাই । পছন্দমতো একটা রং ধরে নে । কি রং ঠিক করলি ?

-নীল ।

-ওকে । আর আমার প্যান্টের রং হলো সবুজ । ঠিক আছে ?

-ঠিক আছে ।

-কল্পনা কর গ্রীষ্মকালের ভর দুপুর । প্রচন্ড গরম । আমরা দুজন কারও গাছ থেকে পেয়ারা চুরি করে খেতে খেতে আসছি । গরম কালে কখনও গ্রামে গেছিস ?

-হুম । একবার ।

-তবে তো কল্পনা করতে পারছিস গরমটা ।

-পারছি ।

-ধরা যাক , তোর নাম ঝন্টু আর আমার নাম মন্টু ।এখন একটা ঝোপের কাছে এসে আমি তোকে বললাম –ঝন্টু ! চল আমরা হিসি করি তারপর সেইটা দিয়ে কাটাকুটি খেলি ।

হৃদিতা চিৎকার করে ওঠে,

-ছিঃ তুমি কি নোংরা !

-আশ্চর্য ! এখানে নোংরামীর কি দেখলি? ব্যাপারটা তো তুই আর আমি করছি না । করছে গ্রামের সাত বছরের দুইটা বাচ্চা ছেলে। বাচ্চা ছেলেরা এমন করে ।

-নাহ ! এটা বাদ । অন্যকিছু বল ।

-ওকে । তোর চোখ খুলিস নিতো ? খুলবি না । তাহলে আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে ।

-খুলি নাই । বন্ধ আছে ।

-গুড । এবার তুই আমাকে বললি , মন্টু ! চল্ আমরা সামনের পুকুরটায় গোসল করি । আমি রাজি হলাম । তারপর দুজনেই শরীরের একমাত্র কাপড়টা খুলে রেখে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম ।

-তুমি আবার বাজে কথা বলছো ?

-বাজে কথা হবে কেনো । আরে ! আশ্চর্য তো। এটা তো সিজার আর হৃদিতা নয় যে সুইমিং কস্টিউম পরে সুইমিং পুলে নামবে । সাত বছরের বাচ্চা দুইটা ছেলে । তুই এক কাজ কর, শরীরে কোন কাপড় নেই এই ব্যাপারটা স্লিপ করে যা। তুই ভাব প্রচন্ড গরমে হীম শীতল ঠান্ডা পানিতে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়লাম । আমাদের শরীর –মন জুড়িয়ে যাচ্ছে । নাকে পানির একটা মন কেমন করা গন্ধ এসে লাগছে । বাতাস গাছের জংলী সুবাস এনে আমাদের মাখিয়ে দিয়ে যাচ্ছে । তুই পানিতে একটা ডুব দিয়ে আমার পায়ের নিচে সুড়সুড়ি দিয়ে এলি । এবার আমি তোকে তাড়া করছি । তুই সাঁতরে পালাচ্ছিস । আর হি হি করে হাসছিস ।আমি তোর পিছন পিছন সাঁতরাচ্ছি তোকে ধরবো বলে । এসব ভাব । আমরা যে পানির নিচে দুজনাই ন্যাংটাপুটু,এটা ভুলে যা ।

-হৃদিতা ফোনের ওপাশে হি হি করে হেসে ওঠে। যেন সে সত্যিই সিজারের বর্ননা মতো ওর পায়ে সুড়সুড়ি দিয়ে পালাচ্ছে আর সিজার ওকে ধরতে তাড়া করেছে ।

সিজারের খুব সুখ লাগে । এই ধাপটা চমৎকার ভাবে শুরু হলো । যেহেতু প্রথম দিকের ধাপ, হৃদিতার সাথে খুব সাবধানে খেলতে হবে । এমন কোন কথা বলা যাবে না । যাতে হৃদিতা  নিজেকে গুটিয়ে ফেলে । সভ্য থাকতে হবে ওকে । অসভ্য হওয়ার ধাপ এখনও আসে নি ।
এরপর একদিন ও আর হৃদিতা কল্পনায় মা আর ছেলে হবে । সিজার ছেলে আর হৃদিতা মা । একদিন হবে দুই বোন । নারী জীবনের সকল কথা তারা বলবে সেদিন মনখুলে । সেদিন যদি হৃদিতা মন খুলে সব বলে তবে পরদিন হবে প্রেমিক-প্রেমিকা । এই পর্বে যদি কেল্লা ফতে হয় তবে তার পরদিন স্বামী আর স্ত্রী হবে ওরা কল্পনায় । সিজারের সব ধাপ ভাবা আছে । হৃদিতা ফোন রেখে দেয়ার পর সিজার গান ধরে –

এসো ,এসো আমার ঘরে এসো। আমার ঘরে …।

 

চলবে…

শাপলা জাকিয়া। লেখক ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। পৈত্রিক নিবাস কুষ্টিয়া হলেও স্কুল ও কলেজ জীবন কেটেছে নারায়ণগঞ্জ শহরে। নারায়ণগঞ্জ সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেন। বর্তমান নিবাস ঢাকা। যুক্ত ছিলেন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতায়। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন দৈনিক যুগান্তরে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ- খুন...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ