প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
আলেক্সান্ডারপ্লাটৎজে তখন মিষ্টি রোদ; মেঘের আড়ালে সূর্য হেয়ালি করছে; কফিশপে লোকজনের আনাগোণা বাড়ছে। একটা ঢাউস নীল ছাতার নীচে হামাগুড়ি দিচ্ছে উইকএন্ডের আলস্য। সামনে এক অশীতিপর তরুণ শাদা শার্ট পরে কুটুর কুটুর করে গল্প করছে তার কাছাকাছি বয়েসের তরুণীর সঙ্গে। লাল টুকটুকে লিপস্টিকে একটা লাইলাক স্কার্টে বেশ মানিয়েছে অশীতিপর তরুণীকে।
এপাশটায় আরেকটা টেবিলে কবি বসে আছে জুটিয়েটের সামনে। জুলিয়েট কটাক্ষ করে বলে, কবি তুমি যে প্রায়শই বলো বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। তা সামনের ওদের চেয়েও কী তোমার বয়স বেশী!
কবি মুচকি হাসে। তারপর ফস করে একটা সিগ্রেট ধরায়। চশমার মাঝে আমুদে চোখ তার; শিশুর মতো খুশী উজাড় করে দেয়া দৃষ্টি।
– শোনো জুলিয়েট, আটঘরিয়ার সবুজ গাছ গাছালী ঢাকা গ্রামে সেই কোনকালে দেখেছি, বুড়ো বুড়ি একসঙ্গে বসে হুঁকো খাচ্ছে আর কুটুর কুটুর করে গল্প করছে। তাদের মতো তারুণ্য আর আমরা পেলাম কোথায়! কঠিন কঠিন বই-পুস্তক পড়ে আমরা এমন বেদনাবিলাসী হলাম যে জুলিয়েটকে সামনে বসিয়েও ঠিক সেই প্রেমাষ্পদ রোমিও হতে পারলাম না!
জুলিয়েট হাসে। সেই হাসিতে আকাশের মেঘ সরে যায়; রেস্তোরার পিয়ানোতে বসে সেবাস্টিয়ান বাখ বাজাচ্ছে কেউ। কবিতারা হামাগুড়ি দিয়ে মস্তিষ্কের রিডে চাপ দিতে থাকে নোটেশান দেখে দেখে। চট করে স্মার্ট ফোনে ভেসে ওঠা কীবোর্ডের রিডে স্পর্শ করে তুমুল পদ্যে মেতে ওঠে। রেস্তোরার পিয়ানোর রিডে পিয়ানিস্টের আঙ্গুলগুলোর মতোই কবির আঙ্গুলগুলো সবুজ আউশের ক্ষেতের মৃদু হাওয়ার মতো থিরথির করে কাঁপতে থাকে।
জুলিয়েট হাসি হাসি মুখে কবির শেষ মুচকি হাসির অপেক্ষা করতে থাকে। কবিতাটা শেষ হলে যে হাসিটা আপনা আপনি ফুটে ওঠে কবির ঠোঁটে; গোঁফের রহস্যে। কবির এই গোঁফটা সত্তর দশকের সাম্যভাবনার তরুণদের সিগনেচার মার্ক। সেই সময়ের সামাজিক অসাম্যে রাগান্বিত তরুণেরা; এখনো গোঁফের আড়ালে লুকোনো রাগ নিয়ে ধনতন্ত্রের দাপট দেখে। ইরাকে নারী নেতৃত্বে সাম্যধারার দল অনেকগুলো আসন জিতলে কবি সেদিন জুলিয়েটকে বলেছিলো আজ খুব ভালো ওয়াইন খাওয়াবো তোমাকে। আর তোমার জন্য বানাবো উচ্ছে-আলু ভাজা, মশুরির ডাল, কষানো ভেড়ার মাংস। তুমি শুধু ভাত রাঁধবে।
জুলিয়েট বলেছিলো, এতো ঝামেলায় যেওনা। চলো বাইরে কোথাও খেয়ে নেবো। কবি মাথা নেড়ে বলেছিলো, উঁহু ইরাকের মতো একটা মুসলিম দেশে নারী নেতৃত্বে একটা সাম্যবাদি দলের উত্থান ঘটেছে। তাই নারী হিসেবে তোমার এ ট্রিট প্রাপ্য। কবি যে কাজটাই করে শিল্পের সাধনার মতো করে। রান্নার সময় যে গভীর মনোযোগে তিন আঙ্গুলে নানারকম মশলা ছড়িয়ে দেয়, সে যেন ঠিক কবিতা লেখার সময় কলমে অথবা কীবোর্ডে নড়ে ওঠা আদুরে আঙ্গুলগুলোর মতো।
জুলিয়েটের মাঝে মাঝে বিস্ময়বোধ হয়। এতো কোমল মনের মানুষ; যে কীনা হো হো হাসিতে মন্থর সময়ে গতিসঞ্চার করতে পারে; পার্থিব জটিলতায় না গিয়ে সহজ মানুষ হয়ে রয়ে গেলো; তার মাঝে এতো দ্রোহ এলো কোত্থেকে। কেন সে তার খুব ভালোবাসার সমাজের কুসংস্কার আর বক-ধার্মিকদের ভণ্ডামির বিরুদ্ধে তীব্র প্রত্যাখানের কবিতা লিখে নির্বাসন দণ্ড বয়ে বেড়ালো সারাজীবন! সেও তো দিব্বি পারতো অন্য কবিদের মতো মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে সুবাতাস সভার একজন হতে। এ প্রশ্ন জুলিয়েট কখনো কবিকে করেনি। কারণ এ প্রসঙ্গটা এলে কবি দপ করে নিভে যায়। তাই অপেক্ষা করে, কবি নিজেই যা বলে, যেসব স্মৃতিকথায় স্পর্শ রেখে সে তার ফেলে আসা অল্টারনেটিভ রিয়ালিটি শৈশব-কৈশোর-যৌবনের গল্প করে; তা থেকে জুলিয়েট বুঝতে চেষ্টা করে কবির দ্রোহের কারণগুলো।
কবি প্রায়ই বলে, ছোট বেলায় খুব পরমতসহিষ্ণু সমাজেই জন্মেছিলাম। ঈদে-পূজায় একসঙ্গে হল্লা করে বেড়াতাম আমরা; কে হিন্দু-কে মুসলমান তা মনেও আসেনি। আর আসবেই বা কী করে; যে জনপদে বাউলেরা একতারা-দোতারা বাজিয়ে মানব-প্রেমের গান গেয়ে বেড়াতো; তাতে মানুষকে আলাদা করে দেখার তো প্রশ্ন ওঠেনা। সেই আমি বড় হবার সময় দেখলাম শাসকগোষ্ঠী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিষিদ্ধ করার মতলব নিয়ে ঘুরছে। তুমিই বলো কবির কী কোন হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান পরিচয় থাকে? কবির পরিচয় তো থাকে কবিতায়। সেখানে সে নিজেই তার আত্মপরিচয় খুঁজতে থাকে। আর রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম জীবনধারার মানুষ। ওদিকে আমার বাড়ীর কাছেই কুষ্টিয়ার শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ অনেক সময় কাটিয়েছেন। সেইখানে লালনের আখড়াও আছে। বাউল সান্নিধ্যে রবীন্দ্রনাথ মনের মানুষ খুঁজেছেন। এ হতে পারে মায়ের মাঝে, প্রেমিকার মাঝে, নিজের মাঝে, মানুষের মাঝে কিংবা প্রকৃতির মাঝে মনের মানুষ খোঁজা। সেই মানুষটাকে পট করে হিন্দু বলে নাকচ করে দেবার যে সংকীর্ণ মন, এর বিরুদ্ধে আমরা লড়েছি।
পরে দেশটা স্বাধীন হলে ভাবলাম; এবার বুঝি কাঠমোল্লাদের হাত থেকে সমাজ মুক্ত হবে; আবার ফিরে আসবে আমার নরম পললের বাউল সমাজ; পরমতসহিষ্ণুতার নবান্ন। কিন্তু তা আর হলো কই! তোমাদের ইউরোপের অন্ধকার যুগে চার্চের কাঠ-যাজকেরা যেমন মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতায় নাক গলাতো; ঠিক সেরকম কাঠ-মোল্লারা ব্যক্তিজীবনে-সমাজে-রাষ্ট্রে নাক গলাতে শুরু করলো। অথচ স্বাধীন দেশের রাজনীতিতেও তাদের না চটানো আর খুশী করে রাখা, মুখ দিয়ে মাথায় তোলার আয়োজন দেখে বিরক্ত লাগতো। অন্ধকার যুগে ইউরোপের চার্চ যেমন কারো ওপর ক্রুদ্ধ হলে তাকে ‘উইচ’ বলে উইচহান্টিং করতো; ঠিক তেমনি আমার একটা কবিতার ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে মসজিদের কাঠমোল্লারা আমাকে ‘কাফের’ বলে মুণ্ডু কর্তনের হুমকি দিলো। সরকার আমার পক্ষে এতোটুকু লড়াই না করে মোল্লাতোষণের জন্য আমাকে প্লেনে উঠিয়ে অনেকটা নো-ম্যান’সল্যান্ডে নামিয়ে দিলো। মবকে তুষ্ট করার এই ভিলেজ পলিটিক্স আমার মাতৃভূমিকে অন্ধকার যুগে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকলো।
জুলিয়েট কবির হাত ধরে বলে, আমি কী তোমার মনের মানুষ নই; তুমি কী নোম্যান’সল্যান্ডে আছো। কে জানে হয়তো অন্ধকার সমাজ থেকে নির্বাসিত হয়েই তুমি একজন কবির বসবাস উপযোগী স্বাধীন সমাজ পেয়েছো। এখানে তো তোমার ব্যক্তিস্বাধীনতায় কেউ নাক গলাচ্ছে না।
কবির চশমায় বাষ্প জমে। মায়ের স্পর্শ মিস করি। ভাইয়েরা মিলে হৈ-হুল্লোড় করে রাতের খাওয়াটা একসঙ্গে খাওয়াটা মিস করি, ইছামতী নদীটাকে মিস করি।
জুলিয়েট কবির গালে আলতো চুম্বন দিয়ে বলে, মায়ের স্পর্শ হাওয়ায় থাকে; হাওয়ায় ভেসে ভেসে সে স্পর্শ ঠিকই পৌঁছে যায় এই নোম্যান’সল্যান্ডে ঠিক তোমার ঠিকানা খুঁজে।
কবি জুলিয়েটকে বলে না যে ওর এ কথাটা ঠিক। জ্বর হলে মা ঠিকই কপালে হাত রেখে বলে, তোর গা তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। ওঠ বাবা কিছু খেয়ে নে। নইলে শরীর দুর্বল হয়ে যাবে। উঠে একগ্লাস গরম দুধ খেয়ে আবার শুয়ে পড়লে, জ্বরের ঘোরে অনুভব করে মা গায়ের ওপরে কম্বলটা তুলে দিয়ে বলে, এখন একটু ঘুমিয়ে নে। কলিং বেলের শব্দে দরজা খুললে দেখা যায়, পাশের এপার্টমেন্টের সোফিয়া খালা এক বাটি স্যুপ হাতে দাঁড়িয়ে। মা যে কত রূপে আসে সে সব রহস্যের কথা জুলিয়েটকে বলা যাবে না।
কবি রহস্যের হাসি হেসে বলে, ঠিক আছে তোমার একথাটা মেনে নিলাম। আর হাউশ করে বিয়ার পানের সময় ফোনটাকে লাউড স্পিকারে রেখে ভাইদের সঙ্গেও না-হয় তুমুল আড্ডা দিয়ে নেয়া গেলো; কিন্তু ইছামতী নদীটি কোথায় পাই বলো।
জুলিয়েটের ঠোঁটের ওপরের তিল হেসে ওঠে। চট করে হ্যাভারশেকে একটা আকাশের রঙ –এর তোয়ালে ঢোকাতে ঢোকাতে বলে, চলো তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাই। দুজনে একটা ট্রামে করে পৌঁছে যায় কোয়েপিনিকে যেখানে স্প্রি নদীটি মিলেছে দাহমে নদীর সঙ্গে। জুলিয়েট বালিকার মতো আনন্দে নদীতে ঝাঁপ দেয়, হাসতে হাসতে বলে, তুমি তো জানোই আমি ভালো সাঁতার জানিনা। তুমি তো ভরা বর্ষায় ইছামতী সাঁতরে পার হওয়া লোক; কৈ এসো আমাকে রেসকিউ করো!
কবি ভয় পেয়ে বলে, কী দস্যি মেয়েরে বাবা; এসব ছেলে মানুষি কেন যে করো!
– কেন তুমিই না বলো, আটঘরিয়ায় বুড়োবুড়িকে হুঁকো খেয়ে কুটুর কুটুর করে গল্প করতে দেখেছো; তা এসো আমরা স্প্রি নদীতে সাঁতার দিতে দিতে গল্প করি।
কবি বলে, কিন্তু এটা তো ইছামতী নয়!
– এটা তোমার ইচ্ছামতী নদী।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..