নো করোনা টেস্ট নো ক্রাই

মাসকাওয়াথ আহসান
রম্য রচনা
Bengali
নো করোনা টেস্ট নো ক্রাই

বিমানবন্দরে নামতেই সাদা পোশাকের পুলিশেরা তাকে ঘিরে ধরে।

একজন জিজ্ঞেস করে আপনি কী মি করোনা!

করোনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, কেন ভাই অটোগ্রাফ নেবেন নাকি!

এক পুলিশ মুঠো বাগিয়ে করোনার চোয়াল বরাবর ঘুষি দিয়ে বলে, খুব সেলিব্রেটি হইছো। চলো তুমার সেলিব্রেটি হওয়ার শখ মিটাইতেছি।

কয়েকজন পুলিশ করোনাকে জোর করে মাইক্রোবাসে তোলে। তারপর চোখ বেঁধে ফেলে। মাইক্রোবাস চলতে থাকে। রেডিওতে
‘কোথাও করোনা নেই’ সম্পর্কে সংবাদ সম্মেলন প্রচারিত হচ্ছে।

এক পুলিশ প্রশংসা করে, ‘কোথাও করোনা নেই’ কথাগুলি শুনলে সুমিষ্ট লাগে।

আরেক পুলিশ বিজ্ঞ অভিমত দেয়, ঠিকই আছে; কিন্তু ভয়েস শুইনা সুশীল সুশীল লাগে। পাল্টাইয়া কোন সহমতজাদারে নিয়া আইলে আরো সুমিষ্ট হইবো।

করোনাকে একটা সেফ হাউজে আটকে রাখা হয়। নভোচারীর মতো পোশাক পরে একজন বড় কর্মকর্তা আসে। মুচকি হেসে করোনাকে বলে, আমাদেরকে যদি চীন কিংবা ইটালির পুলিশ ভেবে থাকেন; তাহলে ভুল করবেন। স্রেফ গুম করে দেবো আপনাকে।

করোনা আমতা আমতা করে বলে, কিন্তু কেবল আমাকে গুম করে কী লাভ। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। মানুষ কিন্তু করোনায় মরবে।

কর্মকর্তা ধমক দিয়ে বলে, মাইন্ড ইয়োর ল্যাঙ্গুয়েজ। দরকার পড়লে সর্দি-জ্বরে মরবে; শ্বাস কষ্টে মরবে। কিন্তু করোনায় মরবে না। কারণ আমরা করোনাকে আটক করেছি।

করোনা সাবধান করে, করোনা কিন্তু পুলিশ-পুলিশ দেখবে না। তার চোখে সব মানুষ একই। পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত ভাইরাস হচ্ছে মানুষ।

কর্মকর্তা ফিরে গিয়ে সহমতজাদা ভি আই পিদের কাছে করোনার এই মারমুখী মনোভাবের কথা জানায়।

এক ভি আই পি ঠাট্টা করে বলে, করোনা আমাদের চেনেনি। আমরা অলরেডি পিপিই, ভেন্টিলেটর সবই জোগাড় করেছি। সপরিবারে আমরা এখন করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রস্তুত।

করোনার সঙ্গে সমঝোতা করতে সহমতজাদাদের একটি দল নভোচারীর পোশাক পরে সেফ হাউজে আসে। করোনা বসে টিভির
‘কে এই করোনা’ শীর্ষক টকশোগুলো দেখছে আর হাসছে।

এক সহমতজাদা অশ্রুসজল হয়ে বলে, করোনা ভাই আপনি এতো নিষ্ঠুর কেন! ঐ দিকে এতো শখের সেকেন্ড হোমগুলি তছনছ করে দিলেন; এখন আবার ফার্স্ট হোমে আইলেন, দিলে একটু কী দয়া হয় না!

করোনা হাসতে হাসতে বলে, আমার সম্পর্কে কিছুই না জেনে এতো কিছু বলছে কী করে টকশোজাদারা। এরা তো বিরল প্রতিভা। চীন,ইটালি, ফ্রান্স, স্পেনের লোকের প্রতিভা অনেক কম।

এক সহমতজাদা বলে, করোনা মহোদয়, প্রতিভার আর কী দেখছেন, প্রতিভা দেখতে হইলে ফেসবুকে যান।

করোনা সহমতজাদাকে প্রশ্ন করে, যেখানে হাসপাতালেই ডাক্তারের জন্য পর্যাপ্ত পিপিই নেই; সেখানে আপনি পিপিই পরে ঘুরছেন কেন?

–করোনা মহোদয় আপনার দোয়ায় আমি একজন ভি আই পি।

করোনা তির্যক হাসি হেসে বলে, ভি আই পি মানে হলো ভেরি ইনফেক্টেড পারসন।

সহমতজাদারা ভয় পেয়ে মুখ শুকনো করে বসে থাকে।

করোনা ফেসবুকের নিউজ ফিড দেখতে দেখতে বলে, একট জিনিস এইখানে বিচিত্র। মানুষ মরতে মরতেও শো-অফ করা আর কৃতিত্ব জাহিরের নেশা ছাড়তে পারে না।

এক সহমতজাদা বলে, অন্তত গরীব-মানুষগুলির মুখের দিকে তাকাইয়া আপনি বিদায় হন মাননীয় করোনা।

করোনা কটাক্ষ করে বলে, এই গরীবগুলোকে নিয়ে মায়া-দয়ার কথা বলাটা তোমাদের ব্যবসা। প্রতিদিনই তো নানাভাবে গরীবকে মারছো তোমরা।
আর করোনা মারলে দোষ! গরীব করোনায় মরেনা, গরীব মরে ক্ষুধায়; আর তোমাদের গরীব মারার সিস্টেমের চাকার নীচে পড়ে। গরীবকে গালাগালি আর ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করার জিকিরই তো চলছে তোমাদের সহমতজাদা মহলে।

এক সহমতজাদা অভ্যাস বশত বলে, আমরা দরিদ্রের হার কমিয়েছি।

করোনা ধমক দেয়, তা তো দেখতেই পাচ্ছি; গাড়ি থেকে ভি আই পি টাকা ছুঁড়ে দিলে, গরীবেরা তা নিয়ে কেমন কাড়াকাড়ি করে। গরীবদের এতো তুচ্ছ করো কেন হে! ভুলে যাও কেন তুমিও কিছুকাল আগে গরীব ছিলে; তারপর গরীবের সম্পদ লুন্ঠনের সিস্টেমে ভি আই পি হয়েছো। আজ রাজকীয় পিপিই পরার সৌভাগ্য অর্জন করেছো। যা বুঝলাম মনটা আসলে খুব গরীব তোমাদের।

এক সহমতজাদা সাহস সঞ্চয় করে বলে, যারা কাজ করে, তাদেরই ভুল হয় করোনা স্যার।

করোনা হাসে, কাজ কতো করো তা তো হাসপাতালগুলোর হাল দেখে বোঝাই যাচ্ছে।

সহমতজাদা যুক্তি দেখায়, ইউরোপের হাসপাতালের হালও তো দেখলাম করোনা স্যার। আপনার সামনে সবাই অসহায়। আমি বুঝিনা বিদেশী দূতেরা কেন স্বদেশে ফিরে গেলো! কিসের আশায়।

করোনা বলে, যারা ফিরে গেছে, তাদের টেস্ট করবে, আক্রান্ত হলে বাঁচানোর শেষ চেষ্টাটুকু অন্তত হাসপাতালগুলো করবে। যারা মারা যাবে তারা অন্তত জানতে পারবে করোনায় মারা গেছে। করোনায় ঠিক কতজন মারা গেছে, এটুকু তথ্য ওদের ইতিহাসে থাকবে। আর যাই হোক করোনার তথ্য গুম করবে না ওরা।

করোনা গুন গুন করে গান করে, নো করোনা টেস্ট নো ক্রাই।

মাসকাওয়াথ আহসান। লেখক, শিক্ষক ও সাংবাদিক। 'শিল্পের জন্য শিল্প নয়, সমাজ-রাজনৈতিক উত্তরণের জন্য শিল্প' এই ভাবনাটিই মাসকাওয়াথ আহসানের লেখালেখির প্রণোদনা। নাগরিক বিচ্ছিন্নতার বিচূর্ণীভাবনার গদ্য ‘বিষণ্ণতার শহর’-এর মাঝ দিয়েই লেখকের প্রকাশনার অভিষেক ঘটে। একটি পাঠক সমাজ তৈরি হয় যারা নাগরিক জীবনের...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ