পত্রকথন

তৌহিদ জামান
পত্র সাহিত্য
Bengali
পত্রকথন

মানুষটাকে ভালোলাগার অনেক অনেক কারণ রয়েছে। তার গুণের কথা বলে শেষই করা যায় না। কিন্তু একটা ত্রুটিও তার আছে; এই দশ বছরে তা খুঁজে পাওয়া গেল!

তার এই ত্রুটির কারণে বেশকিছুদিন মন খারাপের রাজ্যে ঘোরাঘুরিও হয়েছে। মোদ্দাকথা তিনি বিষয়টি তুবড়ি মেরে উড়িয়ে দেন!

এই মানুষটা তাকে স্বপ্ন দ্যাখা শিখিয়েছেন; শিখিয়েছেন জীবনের মানে। প্রাক্টিক্যালি হাতেকলমে বুঝাতে সক্ষম হয়েছেন- কীভাবে টপকাতে হয় দুর্বিষহ সময়!

মানুষটা তাকে অনেক অনেক বেশি ভালবাসে, পাল্টা জবাবও পেয়েছেন!

মানুষটার গুণবিচারের এই সময়কালে হঠাৎ করেই তার সেই ত্রুটি ধরা পড়ে যায় তার কাছে। এতোদিন পর ফের মনে পড়ে যায়।

হ্যা, মানুষটা চিঠি লেখেন না। তাকে বারবার বলা হলেও তিনি তা এড়িয়ে যেতেন সযতনে…এই করোনাকালে দু’বছর আগের একখান পত্র টেবিলের ড্রয়ার সাফ করতে গিয়েই বের হয়ে পড়ে।

***

১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

প্রিয়,

আজ আমার চিঠি লেখার সময় হলো। তুমি কতোবার আমাকে একটা চিঠি লেখার অনুরোধ করেছো। কিন্তু নানা অজুহাতে আমি বারবার এড়িয়ে গেছি। হয়তো ভেবেছো, আমি ইচ্ছে করেই তোমার কথা রাখিনি। কিন্তু না। আমি আসলেই ভুলে গেছিলাম।

আজ লিখতে বসেছি ঠিকই; কিন্তু হাত কাঁপছে। দুচোখ দিয়ে অঝোরধারায় পানি পড়ছে। লিখতে পারছি না।

বুকের ভেতরটা কেমন দম মেরে আছে। ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পারলাম- তোমার অসুস্থতার কথা। সেই থেকে আমি কী করবো, কী করা উচিৎ- কিছুই বুঝতে পারছি না। তোমার প্রিয় একজন মানুষের কাছে ফোন করে নিশ্চিত হই। জানতে চেষ্টা করি, তোমার অবস্থা সম্পর্কে। কিন্তু তার কথা কিংবা কণ্ঠস্বরে তোমার অসুস্থতার তীব্রতা সম্পর্কে কিছুই বুঝতে পারছি না।

তোমার বন্ধুদের একের পর একটা স্ট্যাটাস আমাকে দিশেহারা করে দিচ্ছে। আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়ছি। বুঝতে পারছি না, কখন কী হয়ে যায়। সবার লেখায় সে কী উৎকণ্ঠা!

আমার বুকের ভেতরে কী চলছে- নাইবা বললাম।

এই শোনো, আমি আর পারছি না। আমার সাথে একটু কথা বলবে? আজ সারাদিন কতকিছুই না ঘটে গেলো। তোমাকে কিছুই শেয়ার করতে পারছি না।  জানো না, তোমাকে শেয়ার না করলে আমার কী অসহায় লাগে?

তুমি কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?

শোনো এমন কাজ যদি করো, আমি কিন্তু থাকতে পারবো না।  তুমি আমার আগে কোথাও যেতে পারবে না।  আমি তোমার আগেই মরবো- এটাই ফাইনাল!

কদিন ধরেই তুমি বেশ উল্টাপাল্টা কথা বলছিলে। প্রথমদিকে তেমন সিরিয়াস মনে হয়নি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, তুমি আমাকে কতটা ভালবাসো।

তোমাকে জিজ্ঞেস করলেই বলতে- বাঁচবো না সোনা! এখন বুঝছি, তোমার বেশ বাড় বেড়েছিল তখন!

তুমি আমাকে কেন এতো ভালবাসো?

আমি তোমাকে শান্ত করতে কথা কথা বলেছি। তুমি কেবলই রাগ করেছো। গতকালও রাগ করে ইনবক্সে কথা না বলে “বাই” লিখে দিলে!

পরে ফোন দিয়ে একটু আদর করে দিলে তোমার অভিমান কিছুটা কমলো!

কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, আমার আচরণে তুমি কষ্ট পেয়েছিলে। আর সেকারণেই অসুস্থ হয়ে পড়েছো।

আমাকে এভাবে আর কষ্ট দিও না সোনা, প্লিজ! আমি আর পারছি না।

কোনও স্মৃতিই ভুলতে পারবো না।  এসব ভোলা যায় না, সম্ভব না। তেমনি তোমাকে ছাড়া আমার এই পৃথিবীর কোনোকিছুই ভাল লাগবে না।

বিশ্বাস করো, তোমাকে কোনও রকম অবহেলা করিনি।

তুমি সুস্থ হও, প্লিজ! দেখো, আর কখনো তোমার সাথে খারাপ আচরণ করবো না।

আমি যদি সত্যিকার অর্থে তোমাকে ভালবেসে থাকি, তবে তুমিও আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। এটা আমার বিশ্বাস।

তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি।

তোমারই

***

মানুষটার চিঠি এমনই! মানুষটা তার বুকের ভেতরের স্পন্দন কতই না সহজে সাদাকাগজে কালো কালির হরফে সাজিয়ে রেখেছেন!

অথচ, বলতেন- আমি চিঠি লিখতে জানিনে!

মানুষটার চিঠির কী জবাব দিয়েছিল লোকটি আজ আর মনে করতে পারে না। সে বিস্মৃত হয়। স্মৃতির গহ্বরে হাতড়ে কেবল খুঁজে পায় মুগ্ধতা।

মুগ্ধতার কোনো রঙ হয়?

কী জানি- ঠোটের কোণে হাসি ঝিলিক মেরে ওঠে। লোকটা হাতড়ে হাতড়ে মরে…

লোকটা জ্যোছনার আলোয় স্নান সেরে ওঠে, তার গোটা দেহাবয়বে আনন্দের ফল্গুধারা ঝরে পড়ে।

লোকটি শুধোয় মানুষটাকে, অ্যাতো ভালবাসেন… আপনার চেয়ে আরও বেশি গভীরতার মানুষ যদি পায়, দুপ করে চলে যাবে…

মানুষটা বলেন, প্রেম করার মানুষ তো অলিতে গলিতে পাওয়া যায়, রাস্তার মোড়ে মোড়েও। কিন্তু অ্যামন একটা মানুষ পাবা না; যে মানুষটা তোমার ব্যক্তিগত, যাকে কোনো রকম সংকোচ ছাড়াই দাবি করা যাবে- এইটা আমার মানুষ, আমার একান্ত ব্যক্তিগত মানুষ!

বিস্মিত হয় লোকটি; অ্যাতো গভীরতা তার …

শুধোয়- কেন অ্যাতো আপন মনে হয়?

শান্ত কিন্তু চোখা দীপ্ত জবাব দেন মানুষটি : সারাদিনের মন খারাপ, ভালো লাগা, ভালো থাকা সব এক নিঃশ্বাসে কোনো সংকোচ ছাড়াই বলা যায়,  একটা লম্বা শান্তির শ্বাসও নেওয়া যায়!

কী অ্যামন পেয়েছেন মানুষটা তার কাছে? কী আকাঙ্ক্ষা?

: পরাণের মানুষটা পাশে থাকুক অথবা না থাকুক, অন্তত ভরসা দেবে, আমি আছি, হ্যাঁ আমি আছি!

ভালোবাসা আর ভালো থাকার জন্য অ্যামন একটা মানুষ সবারই প্রয়োজন।

তৌহিদ জামান। লেখক ও সাংবাদিক। জন্ম, বাংলাদেশের যশোর জেলায় ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল। পড়াশুনো সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত রয়েছেন প্রায় ২০ বছর। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থায় প্রকল্পভিত্তিক কাজ করেছেন। ছাত্রাবস্থায় প্রগতিশীল বাম ছাত্র সংগঠনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন।...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ