প্রেম ও দ্রোহের চিঠি
উলোট পূরাণ প্রেমঝিরি,, ‘তোমার আমার গল্পগুলো পথ হারাবে বসন্তের ধূলোয়….’ কত বছর আগে তুমি আমাকে…..
একসময়ে দূরের মানুষের সঙ্গে আনন্দ, দুঃখ ভাগ করার পদ্ধতিটা আজ বয়সের ভারে ঝুকে পড়েছে। বিয়ের খবর, মৃত্যুর খবর,বিজয়া হোক বা প্রেম জানানো, সবই তার কাজ ছিলো। সেই চিঠি আজ আমাদের এই সুপারফাস্ট যুগে বড্ড বেমানান। তবু তাকে সামনে রেখে একটা প্রচেষ্টা।
এই ডিজিটাল যুগে খবরের কাগজে যে বিজ্ঞাপনটি লুপ্তপ্রায় সেটি হলো পত্রমিতালির অনুরোধ। ভাষা, বর্ণ ইত্যাদির তফাৎ সত্বেও দু’জন মানুষের ভাব বিনিময় হতো শুধুমাত্র চিঠির মাধ্যমে। সেই বিনিময়ের কিছু স্মৃতি তুলে ধরার চেষ্টায়…!
কলকাতা
প্রিয় ভূমিসুতা,
কেমন আছো? কাকু, কাকিমা কেমন আছেন? চিনতে পারছো? তোমাদের সাথে বেড়াতে গিয়েছিলাম। প্রায় প্রতিবছরই এই ট্রাভেল এজেন্সির সাথে বেড়াতে যাই। ট্যুর থেকে ফিরে সবাইকে চিঠি দেওয়াটা আমার একটা বদঅভ্যাস বলতে পারো। সবাই উত্তর দেয় না। তবু অভ্যাসটা ছাড়তে পারিনি। কেউ কেউ উত্তর দেয়। তখন বেশ ভালো লাগে। আশারাখি তুমি উত্তর দেবে।
যাই হোক কেমন ঘুরলে জানিও। তোমার সাথে বিশেষ কথা হয়নি সারা ট্যুরে। ফটোগুলো ডেভেলপ করালে? অনেক ছবি তুলেছো দেখেছি। ডিজিটাল ক্যামেরার এই সমস্যা যত খুশি ছবি তোলো। হলফ করে বলতে পারি ছবি বাছতে বসলে ২৫-৩০ টার বেশী ছবি পাবে না। কোনো জিনিস বেশী থাকলে তার গুরুত্ব কমে যায়। আগে যখন ৩৬টার ক্যামেরার রিল ছিলো। তখন আমরা চেষ্টা করতাম মনের সবচেয়ে কাছাকাছি মুহুর্তগুলো বন্দি করতে। বেড়িয়ে এসেই ছবি ডেভেলপ করার তাড়াহুডো। এখন ক্যামেরা থেকে ল্যাপটপ, সেখান থেকে পেনড্রাইভ, পেন ড্রাইভ থেকে ছাপাখানায়। অনেকটা পথ, ততদিনে অনুভুতিগুলো রোজকার রুটিন শুষে নেয়। আমি তাই এই ঝামেলাগুলো রাখিনা। যা থাকবে মনে মনে। একটা দুটো মুহুর্ত ছাড়া কিছুই থাকে না মনে, এটাও সত্যি।
কাকুর কাছে শুনেছিলাম এই মাসে তোমার রেজাল্ট। তুমি তো সিভিল ইজ্ঞিনিয়ারিং নিয়ে পড়ছো। দারুণ, মানুষের বাড়ি বানানোর স্বপ্নের তোমরা কারিগর। আশাকরি তোমার রেজাল্ট ভালো হবে।
ভালো থেকো। চিঠি দিও।
ইতি,
আর্যদা
বাঁকুড়া
শ্রদ্ধেয় আর্যদা,
আপনার চিঠি পেলাম। ভারি অদ্ভুত, আপনার বদঅভ্যাসটা ইমেলের যুগে চিঠি! যুক্তিটাও বেশ মজাদার – “প্রতিটি চিঠির সাথে প্রেরক আর গ্রাহক দুজনেরই অপেক্ষা মিশে থাকে। ইমেল করলে তো ঝুপ করে চলে গ্যালো সব”। হা-হা-হা, দারুণ যুক্তি। অনেকদিন পর বাংলা লিখতে বসলাম। হাতের লেখা যা হচ্ছে… বুঝতে পারলেই হয়।
ভালোই ঘুরলাম। আপনার মতো প্রতিবছর বেড়ানোর সুযোগ আমাদের হয় না। তবে দু’তিন বছরে একবার বেড়ানো হয়। এই ট্রাভেল এজেন্সির সাথে এবারই প্রথম। বেশ ভালোই। আপনার ক্যামেরায় ফটো তোলার যুক্তি মানা গেল না। কোনো কিছু বেশী থাকলেই যে তার গুরুত্ব কমে যায় সেটা মনে হয় ঠিক নয়। সেটা নির্ভর করে তার ওপর যার কাছে সেটা আছে। ছবিগুলো প্রিন্টে গেছে পুরো ৫০টা। পুরানো অ্যালবাম দেখার নেশা আছে আমার। বেশ লাগে কত স্মৃতি উসকে দেয় ছবিগুলো।
বাবা মা ভালো আছেন। রেজাল্ট পিছিয়ে গেছে হয়তো পরের মাসে। ভালো থাকবেন। আর কে কে চিঠির উত্তর দিলো জানাবেন।
ইতি,
ভূমিসুতা।
ট্রাভেল এজেন্সির সাথে গ্রুপে বেড়াতে গিয়ে সহযাত্রিদের ঠিকানা নেওয়াটা একটা অতি পরিচত ঘটনা। একসাথে সবাই মিলে খেতে বসা, গল্প গুজব বা হজমের ওষুধ কিংবা বাসে সামনের সিটে বসা নিয়ে মন কষাকষি সবকিছু নিয়েই যেন একটা একান্নবর্তী পরিবার হয়ে ওঠে খুব অল্পদিনেই। তারপর হাওড়া বা শিয়ালদহে নেমে যে যার বাড়ি যাবার সময় ‘যোগাযোগ’ রাখার অঙ্গীকারগুলো কিছুদিনেই আউট অফ সিলেবাস হয়ে যায়। তবু এতোকিছুর মধ্যেও কিছু যোগাযোগ থেকেই যায়, চিঠির মাধ্যমে…।
প্রিয় ভূমিসুতা,
তোমার চিঠি পেলাম। দু’জন উত্তর দিয়েছে এখনও। তুমি আর রোমেল। রোমেলকে চিনতে পেরেছো? সেই পাকা ছেলেটা, সারা ট্যুরে বকর বকর করে মাথা খারাপ করেছিলো। মুখে শুধু পাকা পাকা কথা। কতই বা বয়স হবে ১৫ বা ১৬? সিমলার ম্যালে লুকিয়ে সিগারেট টানছে, আমাকে দেখে বলে ‘দাদা চলবে?’। হা-হা-হা। ব্যাটা দারুণ লিখছে।
যা দেখলাম চিঠি আসতে এখন আর বেশী সময় লাগে না। আগে তো দেখতাম বিয়ে হয়ে যাবার পর বিয়ের কার্ড বাড়ীতে পৌঁছাতো। সুকান্ত বাবুর ‘রাণার’ এখন বেশ গতিময়।
রেজাল্ট বেরানোটা পিছিয়ে যেতে একটু হতাশ হলাম। টেনশন হচ্ছে নাকি? এর পর কী করবে? পড়াশুনা না চাকরি? দুর, কত প্রশ্ন করছি।
তবে আমাদের পড়াশুনায় এই নম্বর ব্যাপারটা কেমন কেমন যেন। পরীক্ষার দিন যার যত বেশী মনে থাকবে সেই বাজীগর। কে জানে সেটাই সঠিক হয়তো। মেধা আর মনে রাখার ক্ষমতা কী এক? দেখলে আবার সেই প্রশ্ন! ছাড়ো।
চিঠিটা যখন তোমার কাছে যাবে ততদিনে স্মৃতি, মানে ফটোগুলো চলে আসবে। মানে আরও একবার ফটোগুলোর সাথে ঘুরতে বেড়িয়ে পড়বে। দারুণ!
কলকাতায় শীত পড়ছে ধীরে ধীরে। ছাতিম ফুলগুলো রাতে তাদের উপস্থিতি জানাচ্ছে।
ভালো থেকো তোমরা। কাকু কাকিমাকে প্রণাম জানিও। পারলে উত্তর দিও।
আজ উঠি।
ইতি,
আর্যদা
শ্রদ্ধেয় আর্যদা,
রেজাল্ট বেরিয়েছে,পাস করেছি ভালোভাবেই। এবার চাকরির চেষ্টা। সেটা না পেলে বেশ অসুবিধায় পড়তে হবে। আপনার শিক্ষা নিয়ে উপলব্ধিটা খুব সত্যি। এই শিক্ষা আমাদের শুধু উত্তরটা শেখায়, প্রশ্ন করতে নয়। অষ্টাদশ দশকে ব্রিটেনের শিল্প বিল্পবের পর তাদের শ্রমিক রোবট দরকার ছিলো। তাই তারা প্রশ্নহীন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে। সেটাই আমরা বহন করে চলেছি। বেশী বলে ফেললাম মনে হয়।
ফটোগুলো এসেছে। গ্রুপ ফটোতে আপনাকে আবিষ্কার করা গেছে। রোমেলকে মনে আছে। পাকা হলেও ছেলেটা ভালো। রোটাং পাসে ওই পাহাড়ে মায়ের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। রোমেল অরণ্যদেবের মতো উদয় হয়ে মাকে নীচে বাসে নিয়ে যায়। আমাকে কি বললো জানেন? “দিদি চাপ নিও না, আমি মাসীমাকে গ্যারেজ করে আসছি, তোমরা এনজয় করো”। কী ভাষা! গ্যারেজ। আমি আর বাবা এখনোও ওটা নিয়ে খুব হাসা হাসি করি। দেখি একবার ফোন করবো রোমেলকে।
এখানে বেশ শীত পড়েছে। এই সময়টাই ভালো। গরমে খুব জলকষ্ট। কলকাতায় বসে আর কী বুঝবেন! আপনি কি চাকরি করেন?
আমার প্রণাম নেবেন। বাড়ির বড়দের আমারদের প্রণাম জানাবেন। ভালো থাকবেন। যোগাযোগ রাখবেন।
ইতি,
ভূমিসুতা
প্রিয় ভূমিসুতা,
প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি উত্তর দিতে দেরী হলো বলে। জেনে ভালো লাগলো তুমি খুবভাবে পাশ করেছো। তবে চাকরির জন্য কেন এত তাড়াহুড়ো? আরো পড়াশুনা করো, তারপর নয় চাকরি বাকরি করা যেত। তোমার পড়াতে ভালো লাগে না? আমার তো বেশ লাগে। সুযোগ থাকলে আমি মাস্টারি করতাম। সব ভালো ছাত্রছাত্রীরা চাকরি করলে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে তৈরী করবে কে? দেখবে একদিন সব বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হন্যে হয়ে শুধু মাস্টার খুঁজবে। সরকার যদি একটা নিয়ম করে সব ভালো ছাত্র বা ছাত্রীকে পাঁচ বছরের জন্য প্রাইমারি স্কুলে পড়াতে পাঠায়, বেশ হয়। আর কিছু না হোক দেশের মানুষের অবস্থাটা বুঝতে শিখবে। বেশী বলে ফেললাম নাকি? কে জানে!
এবার বিলম্বের কারণটা জানাই। আমি একটি প্রাইভেট ফার্মের সাধারণ করণিক। আমাদের কোম্পানিতে বিরাট এক কাজ চলছে নামকুমে। বাপরে কী অদ্ভুত ঠাণ্ডা! সারাদিন মিঠেকড়া রোদ, আর সন্ধ্যা হলেই কাঁপুনি। ঠাণ্ডা যেন মাথা চেপে ধরে। একবার যদি সে তোমায় ভালোবেসেছে তাহলে আর রক্ষে নেই। তবে আমাদের গেস্টহাউসটা কিন্তু দারুণ! সকালবেলা সামনে উঠোনজুড়ে নানা ফুলের মেলা। সোনু মানে আমাদের রাঁধুনির অদ্ভুত গানের গলা। সকালবেলায় সুন্দর মেঠো সুরে গান গায়। শব্দের মানে বুঝিনা, তবে সুরটা দারুণ। মানুষের সব হতাশা শুষে নিতে পারে এমন সুর। ঠিক যেন কাদাজলে একটুকরো ফিটকিরি। পরেরবার গেলে ভাষার নামটা জেনে আসবো। রোমেলের চিঠি এসেছে। ব্যাটাকে উত্তর দিতে হবে।
আমার বাড়িতে কেউ বড় বা ছোটো নেই, সব সমান। চাকরির জন্য কলকাতায় আসার প্ল্যান থাকলে জানিও। কাকু কাকিমাকে প্রণাম জানিও। শুভেচ্ছা নিও।
ইতি,
আর্যদা
পুনশ্চ: মানুষের কষ্ট বুঝতে হলে তাকে সেখানে যেতে হয়না ভূমি। শুধু উপলব্ধিটা থাকতে হয়। বাঁকুড়ার শীত বা গরমের কষ্টটা কলকাতায় বসে বোঝা যায়। আর এটা ভাইসে-এ-ভার্সা। ভালো থেকো।
-আর্য।
শ্রদ্ধেয় আর্যদা,
চিঠি আসতে দেরী হচ্ছে দেখে ভেবেছিলাম ‘পথিক পথ হারিয়েছে’!এখন দেখছি পথিক আবাক বেড়াতে গিয়েছিলেন। ভালোই আছেন মশাই। পায়ে যেন সরষে রয়েছে। আপনার ‘সব সমান’ বাড়ির লোকটা কিছু বলেন না?
গানটা নামকুম শুনেছেন যখন, ভাষাটা মুন্দারি হতে পারে। পরেরবার জেনে আসবেন মনে করে।
চাকরীটা খুব দরকার আমার,আর্যদা। ছোট থেকেই অনেক কষ্টে মানুষ হয়েছি। যৌথ পরিবার থেকে আমরা যখন বেরিয়ে এলাম তখন আমার বয়স পাঁচ। দিনটা আজও খুব স্পষ্ট। খুব ভোরবেলায়, চুপিচুপি। আমার বাবা বাড়ির বড়ো ছেলে, নিজের মায়ের সিদ্ধান্তকে মাথা পেতে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলো বাড়ি থেকে। বিশাল বাড়ি ছেড়ে এক কামরার বাড়ি। তখন বাবার বিশেষ কিছু আয় নেই। একটা ছোট দোকান সেটাই সম্বল। পড়াশুনায় খারাপ ছিলাম না। আজ যেখানে আছি সেটা পুরোপুরি মায়ের চেষ্টা। থাক লিখতে বসলে পুরো একটা উপন্যাস হয়ে যাবে। এই মফস্বলে পাস করা আইবুড়ো মেয়ে বসে থাকা মানে জানেন? পাড়ার লোক কথা বলে পাগল করে দেবে বিয়ের জন্য। মা আর কতোদিন আড়াল করবে? একটা চাকরি নিয়ে বাঁকুড়া ছাড়তে চাই খুব তাড়াতাড়ি। তবে আমি ফিরে আসবো এখানেই। হয়তো শিক্ষক হিসাবেই…। ভূমিসুতাদের শিক্ষক হিসাবে…লড়াই করা শেখাতে।
বেশী বলে ফেললাম, তাই না?
এতো কথা আপনাকে বলা উচিত হলো কীনা জানি না। বিব্রত হলে মাফ করবেন। রোমেলের সাথে দু’একবার যোগাযোগ হয়েছে। রোমেলের জ্যাঠামশাই কোনো এক সিভিল ফার্মে বড় পোস্টে আছে। বায়োডাটা পাড়াতে বললো নিজে থেকেই। দেখা যাক, যদি ডাক আসে কলকাতায় যাবার একটা চান্স আছে।
আপনার মতো উপলব্ধি আমার এখনো আসেনি, যে এখানে বসে কলকাতার কোনো মেয়ের জীবন সংগ্রাম বুঝতে পারবো। হয়তো বয়স বা অভিজ্ঞতা কোনোটাই পর্যাপ্তভাবে নেই।
ভালো থাকবেন। চিঠি দেবেন। আর আমাকে ভূমি বলতে পারেন। ওটা আমার যদিও ডাকনাম নয় তবু বেশ লাগে।
ইতি,
ভূমিসুতা
পুনশ্চ: চিঠিটা লেখার পর, বার কয়েক পড়লাম। বিশ্বাস করতে সত্যি অসুবিধা হচ্ছে সম্পূর্ণ অপরিচিত একজনকে, কাউকে না বলা কথাগুলো বলে ফেললাম। আবার বলছি, বিব্রত হলে মার্জনা করবেন।
-ভূমি
আর্য আর ভূমিসুতার বেড়াতে গিয়ে আলাপ দু’জনের। আলাপ বলা ভূল হবে, তারা ছিলো সহযাত্রি। বেড়িয়ে আসার পর যে যার নিজস্ব কাজে ব্যস্ত দুজনে। তবু চিঠির মাধ্যমে নিজের অনুভূতির আদান প্রদান…।
প্রিয় ভূমি,
আশাকরি ভালো আছো। তোমার আর কাকীমার জীবনযুদ্ধকে কুর্নিশ করতেই হবে। তবে চাকরি পাওয়াটা যুদ্ধের শেষ নয়, নতুন যুদ্ধের সুচনামাত্র। যুদ্ধটা চলুক সমাজটা পাল্টানোর জন্য।
আমাদের সবার জীবনই একটা একটা উপন্যাস। কতো ইচ্ছা, ব্যর্থতা, ভালোবাসা সব গোপনই থেকে যায়। আমার মা বাবা মারা গেছেন দশ বছর হলো। আর যে ছিলো কাছে সেও দুরে চলে গেছে বছরচারেক হলো। তুমি প্রাপ্তবয়স্ক, আশাকরি বুঝতে পারছো। এখন শুধু আমি আর তার স্মৃতি। স্মৃতি জিনিসটা কিন্তু দারুণ ভূমি। না আমি স্মৃতিকে আঁকড়ে রাখিনি যত্ন করে সঙ্গে রেখেছি। পিছুটানহীন এক মানুষ আমি, যার কোনোকিছুর প্রতীক্ষা নেই, কারুর অপেক্ষাতেও নেই। দারুণ আছি ভূমি, দারুন। রীণার মানে তার কথা অন্য একদিন বলবো। না বিশেষভাবে বহন হয়নি আমাদের। তবু মানসিকভাবে এক ছিলাম অনেকটা সময়। দুঃখটা সততই সুখের। আমি কিন্তু বেশ দুঃখবিলাসী। একা একা দুঃখ পেতে বেশ লাগে।
তোমার জীবনসংগ্রাম আরও জানার আগ্রহ থাকবে। যদি বিশ্বাস করো। ভয় নেই ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে’ কেউ আমাদের চিঠিটি নিয়ে বসবে না। তখন হয়তো সম্পর্কগুলো প্রি-প্রোগ্রাম থাকবে। কথাবার্তাতে শব্দসংখ্যার লিমিটেশন থাকবে। কে জানে!
রোমেল তার শেষ চিঠির সাথে আমাদের একটা গ্রুপ ফটো পাঠিয়েছে। বেশ সুন্দর একটা ফ্রেমে বাঁধিয়ে। বসার ঘরের রীণার ফটোর পাশে রেখেছি। এইবারের ঘুরতে যাওয়াটা সত্যি খুব ভালো এক স্মৃতি। ফটোতে তোমার উপস্থিতি নামমাত্র, একদম পেছনে।
আশাকরি খুব তাড়াতাড়ি তুমি ভালো কিছু পেয়ে যাবে। এই ভূমিসুতার লড়াই আরো প্রচুর ভূমিসুতার লড়াইকে উৎসাহ দেবে। তোমার উপলব্ধিগুলো তাদের পাথেও হবে। একটা অনুরোধ, চাকরিটা পেয়ে সব ভুলে যেও না ভূমি। তোমার মোতো সমাজ শিক্ষকদের দরকার খুব এই সমাজে। তোমার সাফল্য মন থেকে কামনা করি।
ভালো থেকো।
ইতি,
আর্যদা
প্রিয় আর্যদা,
পরের সপ্তাহে কলকাতা। জানিনা আমি না আমার চিঠি, কে আগে পৌঁছাবে। ইন্টারভিউ আছে পার্কস্ট্রিটে, বাবা সঙ্গে যাবে হয়তো। না এটা রোমেলের রেফারেন্সে নয়। যদি পেয়ে যাই, তাহলে আপনাকে এক হাঁড়ি রসগোল্লা। কেসি দাসের, নাকী আমাদের গাঁয়ের মধু কাকা দোকানেরটা পছন্দ করবেন? তবে কুরিয়ারে রসোগোল্লা পাঠানো যায় কীনা খবর নিতে হবে।
কাল রাত থেকে এখানে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। কলকাতায়ও হচ্ছে শুনলাম, খবরে। সারারাত ধরে টালির চালে নানান শব্দের জলতরঙ্গ। মেঘমল্লার হতে পারে। না রাগ সম্বন্ধে কোনো ধারনা নেই। গান শেখার খুব ইচ্ছে ছিলো। না সেটা বরপক্ষের সামনে গাওয়ার জন্য নয়, নিজের জন্য। হোলো না, যাক ‘সব পেলে আবার ব্যর্থ জীবন’। ছোটথেকেই বুঝে গিয়েছিলাম আমাদের সীমাবদ্ধতা। জন্মদিন ম্যাগি আর পায়েস আমার কাছে গ্রান্ডহোটেলের ভোজ ছিলো। বুঝতে অসুবিধা হলেও আলাদা মাস্টারমশাই এর কথাও কোনোদিন বলিনি। বললে ব্যবস্থা হোতোই, কিন্তু হয়তো বাবার ওষুধ কম কেনা হতো বা মা আরও দুটো বেশী ছাত্র পড়াতেন। তার থেকে দু’দশটা নম্বর কম পেলাম নাহয়। মা দাওয়ায় বসে পড়াতো আর আমি ঘরে বসে। মার এক ছাত্র ছিলো অঙ্কুর। আজ থাক তার কথা।
আর্যদা আমি কি তোমার মোতো দুঃখবিলাসী?
রীণাদির ব্যাপারটা জেনে খারাপ লাগলো। মাফ কোরো কিন্তু পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়নি। বলবে কীনা সেটা তোমার ব্যাক্তিগত ব্যাপার। তবে বিশ্বাস করতে পারো।
আর্যদা তুমি বই পড়ো? আমার খুব নেশা, মার খুব নেশা। বাঁকুড়া টাউন লাইব্রেরির দারুণ কালেকশান। দারুণ লাগে। আজ উঠতে হবে। প্রনাম নিও।
ইতি,
ভূমি
পুনশ্চঃ এই দেখ, আপনাকে ‘তুমি’ লিখে ফেললাম। মার্জনা করবেন।
পুরানো স্মৃতি বা অনুভূতিগুলো নিমেষে চালান হচ্ছে দু’জনের মধ্যে। কথা বলার থেকে চিঠি আরও বেশী জোরালো সেতু যোগাযোগের। হাতের লেখা দেখেই মানুষের মানসিক অবস্থা বোঝা যায়। এই সুখটা ফোন বা মেসেজ দিতে অক্ষম…। চলুক তাই এই অনুভূতির কলম…।
প্রিয় ভূমি,
তোমার চিঠিটা পেয়ে বুঝলাম দুটো ব্যাপারে আমার পদোন্নতি হয়েছে। এক,’শ্রদ্ধেয়’ থেকে ‘প্রিয়’; দুই,’আপনি’ থেকে ‘তুমি’ এবং দুটোই স্বতস্ফুর্তভাবে। চালিয়ে যাও ভূমি। এটাই চলুক, মনে করার তো কিছু নেই।
এই সপ্তাহে কোনদিন আসছো জানতে পারলে এক তোড়া ‘অভিনন্দনের গোলাপ’ নিয়ে হাওড়ায় হাজির হতাম। ইন্টারভিউর জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা। জানিনা ঘটনা ঘটে যাবার পর (চিঠিটা যখন পাবে তখন তুমি হয়তো আমার শহর ছেড়েছো) শুভেচ্ছা কাজ করে কীনা! চাকরিটা হলে শুধু মধুকাকার রসোগোল্লাতে হবে না। পাত পেড়ে লুচি আর মাংস খাবো। অনেকদিন বাড়ির রান্না খাই না। আমার দু’বেলার খাবার কেয়ার অফ দীনুদার হোটেল।
রীণা যখন ছিলো তখন নানা পদের আবেদন ছিলো। আর এখন সেই আবেদনগুলো ফল্গুধারা, শুধু নিজের কাছেই। রীণা আমার স্কুলের বন্ধু সুমন্তের বোন। আমার থেকে বছর পাঁচেকের ছোট হবে। দুজনেরই বাড়িতে মোটামুটি সব জানতো। আমার মান মাঝারি হলেও রীণার বাড়িতে তেমন কোনো আপত্তি ছিলো না। সুমন্তের বাবার হালকা প্রতিরোধ ছিলো আমার মান নিয়ে। সুমন্ত শুধু বলেছিলো,”বাবা তুমি না সাম্যবাদে বিশ্বাসী, রবীন্দ্রনাথ পড়ো। সেখানে মানুষের মান বিচার করার ক্ষমতা মানুষকে দিয়েছে কি? এতো গাদা গাদা বই পড়ে লাভ কী হল বাবা!” ব্যাস বাস্তিল দূর্গের পতন, কাকুর সামন্য প্রতিরোধ চূর্ণ। এ সবই রীণার কাছ থেকে শোনা। কী ভালো ছিলো দিনগুলো।
রীণা সাহিত্যের ছাত্রী। শক্তি, সুনীল, জীবনানন্দ, মার্ক্স, নন্দন চত্বর, কফি হাউস… আরো কতো কী! আমার প্রত্যেক জন্মদিনে দুটো করে বই ধরা-বাঁধা। বাণী বসুর ‘একুশে পা’র পর সেই তালিকা আর এগোয়নি। বই পড়াটা এখন আমার কাছে বলতে পারো তার সাথে একটু আগোছালো খুনসুটি। এখন প্রতি জন্মদিনে আমি চারটে বই কিনি। দুটো আমার দুটো রীণার…। মাঝে মাঝে সুমন্ত ফোন করে। বলে “স্মৃতি আঁকড়ে আর কদিন আর্য?” তারে বলি আঁকড়ে কোথায় স্মৃতি তো আমার সঙ্গে।
আর লিখতে পারছিনা ভূমি। মনটা খুব ভার। ভালো থেকো…।
ইতি,
আর্ষ মিত্র।
প্রিয় আর্যদা,
তোমার শহর আমাকে খালি হাতে ফেরায়নি। ইন্টারভিউের ফাইনাল রাউন্ডের জন্য সামনের মাসের ১৫ তারিখে মুম্বাই যাবো। যদি সময় হয় হাওড়ায় এসো। আরও অনেককিছু দিয়েছে তোমার কল্লোলিনী। তোমার আর রোমেলের মতো বন্ধু। রোমেলের বাড়ি গিয়েছিলাম। খুব আদুরে ছেলে, কিন্তু বখাটে নয়। তোমাদের সাথে মিশে কোলকাতা সম্পর্কে ধারনাটা পাল্টেছে। এখন বুঝি, আগে থেকে কোনো কিছুর ধারণা করা ঠিক নয়। এটা আমার নতুন উপলব্ধি বলতে পারো।
তোমার চিঠির শেষের দিকের হাতের লেখা দেখে বোঝা যায় তুমি রীণাদিকে কত ভালোবাসতে। কিছু অক্ষর দেখলাম জলে ভিজে বেশ ঘোলাটে। তুমি এখনও কাঁদো আর্যদা? তোমাদের শেষের দিনগুলো আন্দাজ করি, কিন্তু স্পষ্ট নয়। যদি বলতে চাও বলতে পারো, মনটা হালকা হবে। বইটা পড়ে যেও। এখন কী পড়ছো জানিও।
কতবার ভেবেছি তোমার ফোন নম্বর চাইবো। কিন্তু পরে ভাবি এটাই বেশ। কথার ভারে মনের অনুভূতি স্থূল হয়ে যায়। অনুভূতির অগ্ন্যুৎপাত কলমেই ভালো। কী বলো! চাকরি পেলে তোমাকে আর রোমেলের বাঁকুড়ায় নিমন্ত্রণ থাকবে। আবশ্য তোমাদের এখানে আসার জন্য ভুমি একটা চাকরি কারণ নাও হতে পারো। এমনিই চলে এসো। লালবাঁধ, বিষ্ণুপুর বা ডোকরা সবই তোমাদের জন্য।
তোমার একখানা ছবি উদ্ধার করেছি। খাজিয়ারের সেই সবুজ গালিচায়। এখন দেখছি কোনো কিছুর গুরুত্ব সেটা সময়ের ওপর নির্ভর করে। সেদিনের যেটা গুরুত্বহীন আজ সেটা অন্যরকম। ছবিটা তোমায় পাঠালাম। তোমার টেবিলে এর ঠাঁই জুটবে কীনা জানা নেই।
এখন তোমার মন ভার, তাই আমারটা না হয় পরে শুনলে…।
ভালো থেকো।
ইতি,
ভূমি
পুনশ্চঃ ১৫ তারিখ সকাল আটটা ট্রেনের রাইট টাইম হাওড়ায়। বড় ঘড়ির তলায় দেখা হলে মন্দ লাগবে না। ফোন নম্বর দিলাম না। ফোন যখন ছিলো না, তখনও মানুষ দেখা করতো। তাই না?
হাওড়া স্টেশনের বড়ঘড়ি। প্রচুর অপেক্ষার সাক্ষী। চিঠির হাত ধরে কিছু বেড়ে ওঠা সম্পর্কের দেখা হলো বড়ঘড়ির নীচে…। দেখা যাক এবার তাদের সময় নতুন দেশের হদিস দেয় কীনা… অবশ্যই চিঠির মাধ্যমে।
প্রিয় ভুমি,
তোমার মুম্বাই যাত্রা সফল হোক। ১৫ তারিখে দেখা হচ্ছে তাহলে। ভালো করেছো ফোন নম্বর দাওনি বলে। কথায় অনুভূতিগুলো তলিয়ে যায়, ভেসে থাকে শুধু একঘেঁয়ে দাবিসমূহ। এই বেশ, কোনো দাবি নেই; যেটুকু আসছে সেটা পুরোটাই অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তি। তোমার দেয়া ফটোটা পড়ার টেবিলটায় জায়গা পেয়েছে রীণার ছবির পাশে, দু’জনকে বেশ মানিয়েছে।
আগের চিঠিটাতে একটু বেশী আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। বহুদিন পর, মুখোশটা ঝপ করে খসে গিয়ে কালশিটে হৃদয়টা বেরিয়ে পরেছিলো। ভয় নেই সামলে নিয়েছি। সম্পর্কের শেষ পরিণতি জানতে চেয়েছো তুমি। রীণা আর নেই। না সে আর কোনোদিন ফিরবে না। রোড অ্যাক্সিডেন্ট, আধঘন্টা রাস্তায় এমনি পড়ে ছিলো কেউ এগিয়ে আসেনি। এই কল্লোলিনী তোমায় যেমন ভরসা দিয়েছে, আমার ভরসা কেড়ে নিয়েছে। রসায়নের সমীকরণের মতো সাম্যতা বজায় রেখে চলেছে যুগ যুগ ধরে। দূর্ঘটনার আগেরদিন অনেকক্ষণ একসাথে ছিলাম। হাতে হাত ধরে অনেকটা পথ হেঁটেছিলাম। তারপর কফি হাউস ঘুরে রীণাকে যখন ওদের বাড়ির সামনে ড্রপ করলাম কী অদ্ভুতভাবে তাকিয়েছিলো আমার দিকে। “আর্যদা আমায় তুমি ভুলবে না তো?” বলে একছুটে বাড়ির ভিতরে। না আমার উত্তরটার সে আর অপেক্ষা করেনি। তারপর তাকে যখন দেখলাম তখন সে সাদা কাপড়ে পরিপাটি করে মোড়া। কী শান্ত মুখখানি, কোনো অনুযোগ নেই। ব্যস্ত শহর যে তাকে এড়িয়ে গেল সেটা নিয়েও নেই।
তুমি নিয়তিতে বিশ্বাস করো ভুমি? আমার এইসব বিশ্বাসে টোল খেয়েছে। না আমার আর কোনো কিছুতেই বিশ্বাস নেই।
ভালো থেকো। বড় ঘড়ির তলায় তোমার নতুন সময় শুরু হোক। চিন্তা নেই, তুমি সফল হবেই।
ইতি,
আর্যদা
আর্যদা,
মুম্বাই থেকে লিখছি। সিলেকশন হয়ে গেছে। এখানে ছয়মাসের ট্রেনিং তারপর পোস্টিং। কোম্পানির গেস্ট হাউসে উঠেছি, দু’কামরার ঘর, বসার ঘর আর রান্নাঘর। সামনে বিশাল ব্যালকনি, সেখান থেকে আরব সাগরটা দেখা যায় খুব স্পষ্ট। দীঘায় বে অফ বেঙ্গল দেখেছি, মনে হয় সব সাগরের জলের রং আলাদা। তাদের দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ, উল্লাস ভিন্ন। ঠিক যেন মানুষের মতো। অন্য ঘরটায় যে মেয়েটি থাকে, সে নর্থবেঙ্গলের। নামে তোমার সাথে মিল আছে, আর্যমা। জীবনে এই প্রথম নিজের জন্য আলাদা ঘর পেলাম। এক রাজ্য থেকেও আমরা বেশ আলাদা। মনে হয় কমন স্বার্থ ছাড়া সব মানুষই আলাদা। বেশ মিশুক মেয়েটা, রান্নার হাতটাও বেশ, কিন্তু বড্ড ঝাল খায়।
তোমায় দেখলে বোঝা যায় না তোমার মনে দুঃখ এতো খরস্রোতা। তোমার গিফ্টটা দারুণ ছিলো। বালির ঘড়ি, তিল তিল করে নিজে ঝরে পড়ে আমাদের বোঝাচ্ছে যে আমরাও আমাদের চরম সত্যের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি। এটা তুমি রীণাদির জন্য কিনেছিলে? হয়তো তোমার শেষ গিফ্ট যেটা কোনোদিন দেওয়া হয়নি। বিব্রত করলে মার্জনা কোরো।
তোমাকে বলা হয়নি ওইদিন আমার জন্মদিন ছিলো। সবার অজান্তে একটা অপ্রত্যাশিত উপহার বেশ লাগলো। একটা খবর নিতে পারো রোমেলের কী হয়েছে। ওকে বেশ অন্যরকম লাগলো, অসুস্থ হবে হয়তো।
বাড়িতে ব্যাগ গোছানোর সময় অঙ্কুরের চিঠিগুলো হাতে এলো। আমার সমবয়সী, মায়ের কাছে পড়তে আসতো। কলকাতার ছেলে, বাবার বদলী চাকরির সুবাদে বাঁকুড়াতে এসেছিলো। দারুণ আবৃত্তি করতো। ১৫-১৬ বছরে প্রেমে পড়ার জন্য আর বেশী কারণ লাগে নাকী আর্যদা? মেয়ের পরিবর্তন মায়ের বুঝতে সময় লাগেনি। তারপর যা হবার তাই হোলো। ওই একটা ব্যাপারে আমার মাকে খুব অপমানিত হতে হয়েছিলো। অন্য কোনোদিন বলবো পুরোটা।
নতুন ঠিকানাটা দেওয়া রইলো। ভালো থেকো।
ইতি,
ভুমি
রুটিন কাজের চাপে সূক্ষ্ম অনুভুতিগুলো আজ দিশেহারা। তবে সময় পেলেই সেগুলো জেগে ওঠে নিজের উদ্যোগে। তার বহিঃপ্রকাশের বাহন এখানে চিঠি। চিঠি মানে কিছু ‘আলফাজ’… মনের কোণে পড়ে থাকা কিছু শব্দ, অনুভূতির সরণী ধরে চলে আসা কিছু শব্দ।
প্রিয় আর্যদা,
অনেকদিন তোমার কোনো চিঠি নেই। শরীর খারাপ? নাকী আমার কোনো ধৃষ্টতা হয়েছে?
জানিও প্লিজ। রোমেলের সাথে মাঝে মাঝে কথা হয়, সত্যি বলতে তোমার কথা ওকে জিজ্ঞাস করতে সংকোচ হয়, যা পাকা ছেলে। এখন মনে হচ্ছে তোমার ফোন নম্বরটা থাকলে বেশ হতো, অন্তত একটা খবর নিতে পারতাম। ধুমকেতুর মতো হঠাৎ গায়েব এক্কেবারে!
প্রথম মাসের মাইনে পেলাম। অনেক অনেক টাকা। বাবাকে টাকা পাঠিয়ে দিলাম জীবনের প্রথম উপার্জন। বাবার তো কথা আটকে যাচ্ছিলো। হয়তো চোখও ভিজে গিয়েছিলো। তুমি ঠিকই বলো, ফোনে অনুভুতিগুলো বোঝা যায় না। আর এই অনুভূতিটাই আমাদের জীবজগৎ থেকে আলাদা করেছে। এখানে ট্রেনিং ভালোই হচ্ছে। কুড়িজনের ব্যাচ ভারতের নানা শহর থেকে। কী অদ্ভুত দেশ, সব মানে সবকিছু আলাদা তবু এক অদৃশ্য সুতো দিয়ে বাধা রয়েছি আমরা। সুধীর নামের এক মারাঠি ছেলের সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম, আমাদের ব্যাচের সবার নিমন্ত্রণ ছিলো। কী বিশাল বাড়ি, কত লোকজন বাপরে! সুধীরের মা দারুণ গান গায়, আমার সাথে দারুণ জমেছে। গানটা এখন শিখলে কেমন হয় বলতো? নাকী বয়স হয়ে গেছে? জানিও কিন্তু।
আর্যদা জানোতো এখানে যারা এসেছে তাদের মধ্যে শুধু আমার পারিবারিক অবস্থা ভালো নয়। মাইনে হবার পর আর্যমা জোরকরে কিছু ভালো জামা কেনালো, এত দামী জামা আমি আগে কোনোদিন পরিনি। কেমন একটা হীনমন্যতা কাজ করছে। আর্যমা আর একটা কাণ্ড ঘটিয়েছে, অঙ্কুরকে খুঁজে বার করেছে। ওকে সবটা বলা ঠিক হয়নি মনে হয়। আজ সব বলবো না।
চিঠি দিও প্লিজ। ভালো থেকো।
ইতি,
ভুমি
প্রিয় ভুমি,
সরি সরি সরি…। প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এই বিলম্বের জন্য। নামকুমে ছিলাম আর তোমার নতুন ঠিকানাটাও এখনো মুখস্থ হয়নি। তুমি ঠিকই বলেছিলে, গানটা মুন্দারি ভাষার। সোনুর সাথে তার গ্রামে গিয়েছিলাম। এই জটিল শহর তাদের এখনও গ্রাস করতে পারেনি। ওরা আমাদের কাছে খুব বোকা। সরলতার প্রতিশব্দ কি বোকা? এর উত্তরটা জানা নেই আমার। দুটো চিঠি মিলে অনেক প্রশ্ন আছে দেখলাম, তাই একে একে উত্তর দিলাম।
হ্যাঁ উপহারটা রীণার জন্যই ছিলো। বালির ঘড়িটা তার জন্যই ছিলো। বালি বা সময় কিছুই তালু বন্ধ করে রাখা যায়না। যেমন রীণাকে আমি ধরে রাখতে পারিনি। প্রতিটি জীবন ছুটে চলেছে মৃত্যুর জন্য, শুধু সময়ের অপেক্ষা।
স্বেচ্ছায় অনেকদিন পর কাউকে কিছু দিলাম, তোমার পছন্দ হয়েছে জেনে ভালো লেগেছে।
রোমেল ভালোই আছে, অনেকদিন ফোন করা হয়নি বটে। দেখি দু’এক দিনেই দেখা করে নেবো। তুমি ফিরলে দু’জনে একবার কব্জি ডুবিয়ে খেতে যাবো তোমার দোরে। আর্যমার কাছ থেকে ঝাল ঝাল লৈটা মাছটা রাঁধা শিখে নিও পারলে, নর্থ বেঙ্গল স্পেশাল।
গানটা শিখতে পারো। শেখার আবার বয়স হয়? রায়চাঁদ বড়াল নাকি চল্লিশের পর গান শিখেছিলেন। শখ থাকাটা খুব ভালো, সবাই ছেড়ে দিলেও সে তোমার কাছে থাকবে, তোমার মতো করে। শখের দাবি দাওয়া খুব সীমিত, শুধু একটু যত্ন; ব্যাস।
তোমার মতো মেয়ে হীনমন্যতায় ভুগছে ভাবলে রাগ হয়। তুমি তোমার যোগ্যতায় তাদের সঙ্গে আছো। তাদের মতো সুযোগ পেলে তুমি আরও দূরে যেতে তাই না? রোমেলের জ্যাঠার সুপারিশে যে তোমার চাকরিটা হয়নি তাতে মনে মনে বেশ খুশী হয়েছি। সারাজীবনের তোমাদের লড়াইটার যেন অকাল মৃত্যু ঘটতো। বেশী বলে ফেললে মার্জনা কোরো।
অঙ্কুর পর্বটা মনে হয় তুমি ভুলতে পারোনি। অবশ্য প্রথম প্রেম গুটিবসন্তের দাগের মতো চলে গেলেও দাগটা রেখে যায়। নতুনভাবে যেগাযোগ করতে চাও নাকি? আমার মন্তব্য করাটা ঠিক নয়, কারণ আমি পুরো ব্যাপারটা জানি না।
ভালো থেকো। চিঠি দিও।
ইতি,
আর্যদা
পুনশ্চঃ সুধীরকে বাংলাটা চটপট শিখিয়ে নাও। বাংলা আর মারাঠি ভাষায় অনেক মিল আছে শুনেছি।
প্রিয় আর্যদা,
খুব ভালো লাগলো তোমার চিঠি পেয়ে। আর একমাস, তারপর বাড়ি ফিরবো। আমার পোস্টিং কলকাতাতেই হবে। আর্যমাও আমার সাথে পোস্টিং পেয়েছে। ওরও কলকাতায় খুব ভয়, আমার মতো। এটা কেন আর্যদা? তোমাদের কেন সবাই ভয় পায়?
অঙ্কুরের সাথে আবার সম্পর্ক? না সেটা কোনোদিন সম্ভব নয়। আর ওর এখন একজন স্টেডি গার্লফ্রেন্ড আছে। আর্যমা আবিষ্কার করেছে। না থাকলেও হোতো না। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক চার মাসের। খুব ভালোবেসেছিলাম জানোতো। তখন অনেক চিঠি লিখতাম। নানা ধরনের কোট্ দিয়ে বুদ্ধবাবু বা সুনীলবাবুর নানা উপন্যাস থেকে। মা বুঝতে পেরে বারণ করেছিলো। কিন্তু কে কার কথা শোনে। একদিন ওদের বাড়িতে ওসব জানলো। তারপর টিউশনির মাইনে মা’কে দিতে এসে তার শ্রদ্ধেয় পিতৃদেব বললো, ”মফস্বলে ছেলে ধরা থাকে জানতাম, আজ স্বচক্ষে দেখলাম”। কি অপমান! মা শুধু আমায় জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলো। সেই চোখের জলের দাগ আমার গায়ে এখনও ফোস্কার মোতো দগদগে হয়ে লেগে আছে। ওই ঘটনার পর অঙ্কুর আমাকে দেখলে, না তাকিয়ে সোজা চলে যেত। একটাই কষ্ট ওকে যোগ্য জবাবটা দিতে পারলাম না। অনেকদিন পর পুরানো কথাগুলো আবার মনে পড়ে গেল।
সুধীরের মায়ের কাছে গান শিখবো না। আর ছেলেধরা হবার ইচ্ছে নেই। যদিও সুধীরের প্রতি আমার কোনো ফিলিংস নেই। তবু আমার মন যে চায় না। আর্যমাও তাই বললো, তুমি কী বলো? অনেক কষ্টে আজ এইটুকু আসতে পেরেছি, আর না। আর তাই রোমেলের রেফারেন্সে যে আমার চাকরিটা হয়নি তাতে আমিও তোমার মতো খুশী। এইজন্যেই তোমাকে আমার দারুণ লাগে। আমাদের ভাবনাগুলোতে অনেক মিল রয়েছে।
তোমায় একটা কথা বলবো? হাতের মুঠোটা এবার খুলে দাও। বুকভরে শ্বাস নাও, নতুনভাবে শুরু করো আবার। তুমি পারবে। আর রীণাদি তো তোমার সাথে আছেই, তবে ভয় কী!
আজ ভুমি দুঃখবিলাসী। হা-হা। ভালো থেকো।
ইতি,
ভুমি
পুনশ্চঃ তোমার পরিবর্তনটা কিন্তু আমি মন থেকে চাই। কিছু মনে কোরো না।
প্রিয় ভুমি,
হাতের মুঠোটা খোলার চেষ্টা করছি। অনেক বছরের জং পড়ে আছে, একটু সময় লাগবে। চিন্তা নেই, পারবো হয়তো। ভুমি, আমি খুব সাধারণ মাপের ছেলে। নতুন সম্পর্কে যেতে বেশ ভয় লাগে। সুযোগ আসেনি, সেটা বললে মিথ্যা বলা হবে। রীণার স্মৃতি আর আমার ভয়, এই দু’য়ে মিলে মনটা বেঁধে রেখেছিলো। কিন্তু কিছুদিন সে বিদ্রোহ শুরু করেছে। কিছুই শুনতে চায় না। হাওড়ার বড় ঘড়িটা যেন আমার জীবনকে নতুন জোনে এনে দিয়েছে। বলতে পারো আমার ভয়ের জন্যই আমার চিঠির গতি খানিকটা শ্লথ ছিলো। তোমার কাছে বলতে লজ্জা নেই ভয়টা আর নেই, কিন্তু তার স্মৃতিটা তো আমৃত্যু। তবে সেই অনুভূতি বোঝার জন্য উদারতা দরকার তেমন মানুষের সন্ধান পেয়েছি। কী যেন লিখেছিলে? আমাদের ভাবনায় অনেক মিল আছে। তুমি প্রাপ্তবয়স্ক তবু কিছু সিদ্ধান্ত একা নিতে নেই, ভালোলাগা অচেনা পথে চলার আগে বাবা মার সাথে অবশ্যই পরামর্শ করো। সফলতা মানুষকে স্বার্থপর করে দেয়। তোমার কিন্তু অনেক দায়িত্ব, এবং সেগুলোকে আমি সম্মান করি।
একটা কথা বলতে পারি, অঙ্কুর তোমার বন্ধু ছিলো। বন্ধুত্বটা অনেকটা সমুদ্রের মতো, একই সমুদ্রে জলের রঙ বা চরিত্র সব আলাদা। তেমন বন্ধুত্ব শুধু বন্ধু, ভালো বন্ধু বা প্রেমিক। অঙ্কুরকে ভালো বন্ধু ভেবে ভুলে যেও। কষ্টটা কম পাবে।
ফোন নম্বরটা নীচে দিলাম, ফোন করতেও পারো; আবার নাও পারো। উত্তর যাইই হোক চিঠি দেওয়া বন্ধ কোরো না। রবি ঠাকুরের লেখা দিয়ে আজ শেষ করবো-
জাগিবে একাকী তব করুণ আঁখি,
তব অঞ্চলছায়া মোরে রহিবে ঢাকি।
মম দুঃখবেদন মম সফল স্বপন
তুমি ভরিবে সৌরভে নিশীথিনী-সম।
ভালো থেকো। কোলকাতা হয়তো তোমার কেড়ে নেবে অনেক কিছু, ফিরিয়ে দেবে এমন কিছু; যেটা অনেককিছুকে ভুলিয়ে দেবে।
ইতি,
আর্য।
শোনা যায় একমাস পর হাওড়ায় দু’জনের দেখা হয়। রোমেলকে নিয়ে আর্য বাঁকুড়াও যায় ভুমির বাড়িতে। পরের ঘটনাগুলো আর এই শহর মনে রাখেনি, সে আবার নতুন কোনো আর্য, ভূমিসুতার গল্প বুনতে চলেছে…
উলোট পূরাণ প্রেমঝিরি,, ‘তোমার আমার গল্পগুলো পথ হারাবে বসন্তের ধূলোয়….’ কত বছর আগে তুমি আমাকে…..
নতুন কোনো ভাবছি যখন পা বাড়াবো নতুন কোনো সড়কে, সামনে এক নারী এসে…..
মানুষটাকে ভালোলাগার অনেক অনেক কারণ রয়েছে। তার গুণের কথা বলে শেষই করা যায় না। কিন্তু…..
রবি, তোমাকে পত্র দিবো বলিয়া বহুবার মন স্থির করিয়াছি। অথচ সংসারের নানাবিধ কাজে অকাজে সে…..