পদযুগলে লালপদ্ম

ইসরাত জাহান
ছোটগল্প
Bengali
পদযুগলে লালপদ্ম
সবে চাকরিতে যোগদান করেছি। কর্মস্থল বগুড়া। যোগ দিয়েই জানলাম রাজশাহীতে নতুন শাখা অফিস খুলছে প্রতিষ্ঠান। একসঙ্গে চারটি শাখা হচ্ছে বিভিন্ন থানায়।  প্রধান কার্যালয়ে জানালাম আমি রাজশাহীর যে কোন শাখায় বদলি নিতে চাই। তাতে আমার বাড়িতে যাতায়াত সহজ হবে। প্রতিষ্ঠান আমার চাওয়াকে সম্মান জানালো। দু’ মাস পর বদলির চিঠি এল। বোয়ালিয়া শাখায়। বোয়ালিয়া থানার অন্তর্গত উপশহরের তিন নম্বর সেক্টরে অফিস।
তিন নম্বর সেক্টরেই সাতষট্টি নম্বর বাড়ি আমাদের। চারতলা বাড়ির নিচ তলায় ছেলেদের আবাসন ব্যবস্থা। দোতলায় মেয়েদের। তিনতলা ও চারতলা বাড়ির মালিক তাঁর পরিবার নিয়ে থাকেন। ভীষণ সুন্দর বাড়ি। ছাদে নানারকম ফুল-ফলের গাছ। বড় বড় টবে লাগানো মাধবীলতার ঝাড় চারতলা বেয়ে দোতলার বারান্দায় ঝুমকোর মতো দোলে বাতাসে। দোতলার খোলা বারান্দায় দাঁড়াতেই তাল গাছের ফাঁক দিয়ে চাঁদ দেখা যায় সহসাই। সাথে নাকে আসে মাধবীলতার ঘ্রাণ।
পাশেই রাজশাহী সেনানিবাস। রোজ সকালে জওয়ানদের দৌঁড় ঝাপ শুধু দেখি তা নয় আমরাও দৌঁড়াই তাদের অনুকরণে। নতুন শাখা বলে কাজের চাপ নেই একেবারেই।
এক সন্ধ্যায় জোনাল ম্যানেজার বললেন, আগামী কাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অফিস করবেন। তারপর খেয়ে সবাই বেরিয়ে পড়বেন যতদূর চোখ যায়, যতদূর মন চায়। পুরো রাজশাহী শহর ও গ্রামের আনাচে-কানাচে চিনে নেবেন। এটাই আপনাদের কাজ। আমরা বিশজনের দল। মোটামুটি কাছাকাছি বয়স বলে সবাই সবার সাথে আলাপে স্বচ্ছন্দ। রোজ বিকেলে মনের আনন্দে ঘুরি। কখনও পদ্মার চরে ধূলো মাখি ইচ্ছেমত। কখনও নৌকায় চেপে চলে যাই দূরের ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি। কখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলা মাঠে পা ছড়িয়ে ঝালমুড়ি খাই। কখনও আবার চলে যাই বিমানবন্দরের আশেপাশের গ্রামে।  বিমানের ওঠানামা দেখি আর শব্দের সাথে কথা বলি। চিড়িয়াখানার বাঘ সিংহরা রীতিমত বিরক্ত যেন আমাদের ঘনঘন যাতায়াতে। বরেন্দ্র জাদুঘরের মুর্তিগুলো অবশ্য আমাদের দেখে মুর্তির মতোই ঠাঁই দাঁড়িয়ে কিংবা বসে অথবা শুয়ে থাকে। তেরখাদিয়ার খ্রিস্টান পল্লীর সাপ্তাহিক মিলনমেলায় আমাদের কুড়িজনের উপস্থিতি আর মিষ্টির ভাগ বসানোতে কেউ তো অখুশি হয়ই না বরং সেখানকার স্কুল কলেজে পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা আমাদের বন্ধু হল খুব তাড়াতাড়ি। কখনও আবার সপুরাতে শাড়ির দোকানে সিল্কের কাপড়ে হাত দিয়ে রেশম পোকার অবদান অনুভব করি।
আম বাগানে ও চলে যাই ঝড় আসবার চিঠি পেলেই। ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে কুড়িয়ে আনা আম আবাসিকের খালা আচার করে দেন আমাদের গুষ্টি কিলিয়ে কিলিয়ে। তাতে অবশ্য আমাদের কিছুই এসে যায় না বরং বয়েই যায়। আর বকুল ফুলের মালা গাঁথা? সে তো রোজকার রোজনামচা। উপশহরের পথে পথে বকুল গাছ। সারা বছর নাকি ফুল থাকে কোন না কোন গাছে। রোজ ভোরে বকুল ফুলের মালা গেঁথে বিছানায় বালিশের পাশে রেখে দিই। অফিসে যাওয়ার সময় হাতে জড়িয়ে নিই সাজের অনুসঙ্গ হিসেবে।
সত্যিই কর্মজীবন এত মধুর হয়? না হতে হয়? না বিশ্বাসযোগ্য?
সময় ফুরিয়ে চোখের পলকে চার মাস পেরোলো। জোনাল ম্যানেজার বলে দিয়েছেন সামনের মাস থেকেই পুরোদমে অফিসের কাজ শুরু হবে। বর্ষাতি দিন চলে গিয়ে কুয়াশার চাদরে মুড়ি দিয়ে শীত আসি আসি করছে। বিলসিমলা, ছোট বনগ্রাম বড় বনগ্রাম, গ্রামের মাঠগুলোতে সর্ষে গাছে হলুদ ফুলের গুচ্ছরিতা উঁকি দিচ্ছে একটু একটু করে। মন খারাপ করা উদাসীনতা ঘিরে ধরে কখনও কখনও।
এক বিকেলে চলে যাই শাহমখদুম বিমানবন্দর ছাড়িয়ে দূরের কোন গ্রামের বিস্তৃত সর্ষের মাঠে। হলুদিয়া হলুদ গালে মাখব বলে।  মাঠের পর মাঠ শুধু হলুদ ফুল আর ফুল। মিষ্টি গন্ধে বাতাস এখানে মাদকতা ছড়ায় মাতাল হয়ে। মাঠের মাঝে মাঝে ছোট ছোট কুঁড়েঘর। এই কুঁড়েঘর গুলোকে বলে দুবাল বাড়ি। দূরদুরান্ত থেকে কৃষকেরা এসে কয়েক দিন অথবা কয়েক মাস এখানেই থাকে। সারাদিন মাঠে কাজ করে সন্ধ্যায় কুঁড়েঘরের সামনে কুপির আলোয় চাল ডাল ফুটিয়ে খেয়ে নিয়ে ঘুম দেয় ক্লান্তিতে। কেউ আবার পরিবার নিয়ে ও এসেছে এখানে।
হলুদ ফুলের গুচ্ছ চুলে গুঁজে আমি দৌড়াই মাঠের আল ধরে সহকর্মীদের শত বারণ উপেক্ষা করে। ভাবি আর তো মাত্র ক’টা দিন তারপর নিয়মিত অফিস। কাজের চাপ। জানি না জীবনে আর কখনও এত আনন্দ নিয়ে দৌড়াতে পারব কিনা। ভাবতে ভাবতেই বাতাসের সাথে কথা বাজে রিনরিন।
আপনে দৈড়ে কৈ যান?
অবাক কান্ড! কে কথা বলে? বাতাস না সর্ষের ভূত?
থেমে যাই এক লহমায়।
সর্ষে ক্ষেতের ভেতর থেকে মাথা তুলে দাঁড়ালো এক কিশোরি।
লাল জমিনে নীল পাড় শাড়ি পরিহিত, মাথায় ঘোমটা। লাল টুকটুকে শাড়ির মোহে হলুদ যেন মাতোয়ারা।
আমি শুধাই কে গো তুমি?
সে বলে,
আমি পদ্ম গো! বৈতা শাক তুলি।
তার হাতে এক ডালা সবুজ বৈতা শাক। দূরে আঙুল উঁচিয়ে বলে,
ঐ যে ঐ দুবাল ঘরে থাকি।
আপনে যাইবেন আমার ঘরে?
কেমন যেন ঘোর লাগে আমার। আমি চলি পদ্মের পেছনে পেছনে পা ফেলে। একটু দূরের দুবাল ঘরের সামনে এসে পদ্ম বলে,
আইসেন আমার ঘরে।
ছোট্ট ঘর। আসবাব নেই কিছুই।  মাদুর পাতা। তার উপর দুটো বালিশ। কয়েকটি হাতে সেলাই করা কাঁথা ভাজ করা। পাশেই চটের উপর দুটো টিনের হাড়ি, দুটো টিনের থালা,  একটি টিনের গ্লাস। একটি জগ ও আছে সেটিও টিনের এবং একটি মাটির কলসি। মাটির একটি উনুন ও আছে। উনুনের পাশে শুকনো খড়ি সাজানো।
আইজ বৈতা শাকের ঘন্ট রাইধব  সাথে আউশ চাইলের ভাত।
এই বলে পদ্ম শাক কুটতে বসে গেলো মাদুরের উপর দু’পা ছড়িয়ে। পদ্ম কথা বলে বিরামহীন। সে বলে যায়,
এই সর্ষের ক্ষেতে আমি ও আমার স্বামী কাজ কইরতি আইছি। সারাদিন ক্ষেতের দেখশোন করি। রাত জাইগি পাহাড়া দিই। সর্ষে ফুল থাইকি ফল হইবি। তারপর সেইগুলোক টিনের ডেরামে বাইরে বাইরে সর্ষে বাইর কইরি এক্কেরে মহাজনের ঘরে তুইলে দিইয়ে তারপর ছুটি।
আরো লোকজন আইছে। সবাই মিইলে মিইশে কাজ করি।
পদ্ম কথা বলেই চলেছে। আর আমি কথা শোনার চেয়ে দেখি বেশি পদ্মের পা দুটো। যা এই পরিবেশে বড্ড বেমানান নয় বরং অকল্পনীয়।
দশটি আঙুলের নখ লাল টুকটুকে নেইলপলিশে রাঙানো। এক একটি আঙুল যেন এক একটি লালপদ্মের পাপড়ি।
আমার চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে পদ্ম লজ্জা পেয়ে বলে,
তানি ( পদ্মের স্বামী)পাশের হাট থাকি আনি দিইছেন।
তিনি কোথায়?
তানি দূরের পুকুরে ডুব দিইবার গেইছেন।
পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবি ডুবি করছে।
আমি উঠে বলি,
পদ্ম যাই।  আবার কোন একদিন আসব। মাঠের ওপারে সবাই অপেক্ষা করছে নিশ্চয় এতক্ষণ আমার জন্য।
পদ্মের মন বুঝি খারাপ হয়! আমাকে এগিয়ে দিয়ে যায় অনেক দূর।
বলে, আবার আইসবেন গো।
আমি গভীর আদরে বলি,
আসব পদ্ম।
আবার দৌড়ে ফিরি সহকর্মীদের ভিড়ে। ফিরেই তো বকুনি শুনি সকলের।
এমন করে কেউ দৌড়ে একা একা অত—দূর— যায়?
আমি হাসি ভুবনডাঙার হাসি।
এক ঝাঁক সন্ধ্যা মালতির মতো দল বেঁধে ফিরি আবাসিকের নিয়মের কাছে।।
আবাসিকে ফিরেই খবর পেলাম আমি সহ ছয়জনের বদলির নির্দেশ এসেছে। আমার বদলি হয়েছে ঢাকায়। দুদিন পরেই যোগদান করতে হবে প্রতিষ্ঠানের ধানমন্ডি শাখায়।
মন খারাপ হল খুব। শুধু আমারই নয় অফিসের সবার। চার মাস এক সাথে হৈচৈ করে কাটানো সময়গুলো ব্যথা হয়ে বুকে জমাট বাঁধছিল বারবার।
কেন এমন হয়? কেন ছেড়ে যেতে হয় এত দ্রুত?
নিয়ম মতো রাত আসে আবার চলে ও যায়।
ভোর আসে স্নিগ্ধ সতেজ ঠান্ডা বাতাসে মিশে।
মন খারাপের বারতা নিয়ে
বকুল কুড়োতে আমি ও আসি রোজকার মতো। যদিও বকুল ফুল আগের মতো ফোটেনা বা ঝরে না এখন। তবে একেবারেই ছেড়ে গেছে তাও নয়। সব গাছের গোড়াতেই দু চারটি ফুল পাওয়া যায়। তাই নিয়েই তৃপ্ত আমার মন।
বকুল কুড়োতে কুড়োতে কথপকথন ও সেরে নিই বকুল গাছ গুলোর সাথে।
বলি, কাল তো আমি চলে যাব।
তোমাদের সাথে আবার দেখা হবে কিনা জানি না।
তোমরা কি আমাকে মনে রাখবে? নাকি ভুলেই যাবে রোজকার ঝরা বকুলের মতো?
ঝরা বকুলগুলোও আজ কেমন ন্যাতান্যাতা।
বোধকরি আমাকে বিদায় দিতে ওদেরও ক্ষরণ হচ্ছে খুব গভীরের সঙ্গোপনে।
সেনানিবাসের জওয়ানরাও রোজকার দৌড়ে পা মেলাতে শুরু করেছে। ফুল কুড়োনো শেষ হলে আবাসিকের পথে হাঁটি।। সামনেই একটি পুলিশ ভ্যান দাঁড়িয়ে। পাশে কয়েকজন পুলিশ। কথা বলছেন জওয়ানদের সাথে। এক পুলিশ বলছেন,
তেরখাদিয়ার ড্রেনের পাশে পরে ছিল লাশটি।
মনে হচ্ছে শ্বাসরুদ্ধ করে মারা হয়েছে।
তবে আশেপাশের কেউ চেনে না।
আপাতত বেওয়ারিশ হিসেবে থানায় নিয়ে যাচ্ছি।
আমি পাশ কেটে চলে যেতে চাই। কারণ মৃতদের এক আশ্চর্য শক্তি আছে যা জীবিত কে বুঝিয়ে দেয় তুমি কত পরাজিত জীবনের কাছে।
এই মুহূর্তে আমার নিজেকে সেই পরাজিতই মনে হচ্ছে।
একদম ভ্যানের কাছে এসে আমার পা আর চলছে না।
এক চুম্বুকের আকর্ষণ টানছে বারবার। টানছে পুলিশ ভ্যানের মেঝেতে শোয়ানো পাটিতে মোড়ানো অথচ নগ্ন দুটো পা।
এ তো সেই পা!
লাল টুকটুকে নেইলপলিশে রাঙানো লালপদ্মের পাপড়ির মতো দশটি আঙুল।
এ তো পদ্মের পা!
না না তা কি করে হবে?
পদ্ম কে আমি গত গোধূলির আলোতে দেখে এসেছি স্বলজ্জ হাসিতে সুখি সুখি গৃহ কোনে। এ পদ যুগল পদ্মের হতে পারে না। কিছুতেই না!
আমি ঘামছি। আমার হাতের ঝরা বকুল ঝরে গিয়ে আবার ও লুটিয়েছে মাটিতে।
পুলিশ ভ্যানটি চলে যাচ্ছে সাঁ সাঁ করে পিচ ঢালা পথ মাড়িয়ে।
এখন আমি পদ্ম ফুলের লাল পাপড়ির মতো নেইলপলিশে রাঙানো আঙুলগুলো দেখতে পাচ্ছি না। দেখতে পাচ্ছি গাড়ির দুলুনিতে দুলছে দুটো পায়ের তালু। যেন নেড়ে নেড়ে জানান দিচ্ছে,
কিচ্ছু পারবে না তুমি।
কিচ্ছু পারবে না।
সরে যাও তুমি আমার থেকে দূরে,  আরো দূরে।।
আমি তবুও এগোতে যাই পুলিশ ভ্যানের দিকে।
কি আশ্চর্য! আমার পা দুটোতে পেরেক পোঁতা?
খুব চেষ্টা করছি কিন্তু নড়তে পারছি না এক বিন্দুও।
অথচ আমাকে যেতে হবে গোধূলির আলোতে দেখা সুখি সুখি গৃহকোনে পদ্মের কাছে।
যেতেই হবে আমাকে।
কিন্তু কী করে?
পেরেক পোঁতা পা স্থবির শরীরে নিশ্চল। অথচ তীব্র উড়ালিয়া মন পদ্মের পায়ে ভীষণ ভালোবেসে স্বলজ্জ লাল পদ্ম ফোঁটা দেখব বলে।

ইসরাত জাহান। কবি। জন্ম বাংলাদেশের পাবনা জেলার ঈশ্বরদী। বর্তমান নিবাস ঢাকায়। তেরোবছর বয়স থেকে লেখালিখি শুরু। লেখা শুরু করেছিলেন দৈনিক বাংলার বাণীর মাধ্যমে। তারপর দৈনিক আজকের কাগজে নিয়মিত লেখালিখিতে ছিলেন। এরপর হঠাৎ করে বারোবছর লেখালিখি থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন। প্রকাশিত বই: 'তোমার...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ