পবিত্র অসমতা

ফারজানা নীলা
ছোটগল্প
Bengali
পবিত্র অসমতা

আমার এই চব্বিশ বছর জীবনে খুব ভয়াবহ রকমের প্রয়োজন না থাকলে কখনই ভোরে উঠি নি। আজ খুব ভোরে ঘুম ভাঙল। বর্ণনাতীত ভালো লাগার একটি সূক্ষ্ম অথচ তীব্র অনুভূতি আমাকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখল। আমার পুরো শরীর জুড়ে এক নতুন আবেশ অনুভূত হচ্ছে। আমার আশেপাশের চিরচেনা প্রত্যেকটি বস্তু থেকে পবিত্র আলোর দ্যুতি বের হচ্ছে। আমার গায়ের সাথে লেপটে থাকা এই পোশাককে মনে হচ্ছে শুভ্রতার রঙ্গে আচ্ছাদিত। আমার শরীর আজ নবজাগরণ পেয়েছে। একে আমার সদ্য জন্মানো শরীর বলে মনে হচ্ছে। যে শরীরের প্রতিটি অঙ্গে প্রতিটি লোম কুপে প্রতিটি মাংসের ভাজে এক নরম কোমল স্নিগ্ধ টলমলে কিন্তু এলোমেলো ভয়ংকর বিধ্বংসী ছোঁয়া লেগে আছে। এই অনুভূতির নাম আমি জানি না। তবে এই অনুভূতিই সবচেয়ে চরম অনুভূতি। সবচেয়ে সত্য। সবচেয়ে উজ্জ্বল। সবচেয়ে দীপ্তিময়। এর চেয়ে বড় সত্য আমার জীবনে নেই। সূর্যের আলো যেমন প্রতিদিন তার চিরসত্য শুভ্রতা দিয়ে অন্ধকার দূর করে, তেমনি এই সত্য আমার জীবনের শুভ্র চিরসত্য।

আমি বারান্দায় গিয়ে বসলাম। গরমকাল তবুও কিছুটা শীত শীত করছে। আশেপাশের ধূসর রঙ খুব ধীরে ধীরে কিন্তু নির্ভুল ভাবে সোনালি হতে লাগলো। হঠাৎ একটি বিল্ডিঙের জানালায় সোনালি আলোর তলোয়ার ফালি করে কেটে দিলো। সেই ফালি করা জানালা থেকে তির্যক স্বরনালী আভার ঝিকিমিকি বের হতে লাগলো। আকাশে কিছু পাখি উড়ে গেলো। সোনালি আলো তলোয়ার তাদেরও ফালি করে কেটে দিলো। পাখি গুলোর ডানা থেকে স্বরনালী আভা খসে খসে পড়ছে। আমার বিল্ডিঙের পাশেই একটি অনেক বড় গাছ আছে। গাছের নাম জানি না। সেই গাছ আজ সোনালি হয়ে গেলো। ডালের ফাঁকে ফাঁকে পাতাগুলোকে সোনালি আলোর তলোয়ার কোমল ভাবে ফালি করে কেটে দিচ্ছে। আমি মন্ত্র মুগ্ধের মতো এসব দৃশ্য দেখতে লাগলাম। সমস্ত মহাবিশ্বকে আমার অকল্পনীয় সুন্দর মনে হচ্ছে। আমি মদ পান না করেই নেশাগ্রস্থ হয়ে গেলাম। আমার চেতনা ফিরল যখন সোনালির আলোর এক ফালি আলো আমার মুখে এসে পড়লো।

আমি কিছুটা তেজ ফিরে পেলাম। যেন স্বপ্ন থেকে জেগে উঠেছি। হঠাৎ আমার বুক কেঁপে উঠলো। অজানা আশঙ্কায় আমার হৃৎপিণ্ডে হাতুড়ির বারি অনুভব করলাম। আমি ঘড়ি দেখলাম। সবেমাত্র পৌনে ৬টা। মাত্র তিন ঘণ্টা হয়েছে! এই তিন ঘণ্টা আমি বেঘোরে ঘুমিয়েছি! তিন ঘণ্টার আগে পুরো একটি সন্ধ্যা, পুরো একটি রাত আমি স্বর্গরাজ্যে বিচরণ করেছি! সেই সন্ধ্যে ৭ টা থেকে আমি আমার রক্তে আগুনের তেজ অনুভব করেছি! আমি বাস্তবতা ভুলে ছিলাম। যদি অবাস্তব এমন মধুর পরম পবিত্র টলমলে কিন্তু কঠিনতম ভাবে বিধ্বংসী হয় তবে আমি বার বার এই অবাস্তবের কাছে ফিরে যেতে চাই।
আমি বের হয়ে গেলাম। গাড়ি সোজা বনানী গিয়ে থামালাম। লিফটে চড়ে কলিংবেল বাজানোর আগ মুহূর্তও পর্যন্ত মনে হচ্ছিলো আমি যেন শতাব্দি ধরে হেঁটে যাচ্ছি। হয়তো সর্বোচ্চ সাত মিনিট হবে। কিন্তু এই ক্ষীণ সময়কে মনে হচ্ছিলো যেন সাত শতাব্দী। অবশেষে দরজা খুলল। এক মানবী আমার সামনে দাঁড়িয়ে। মানবী আমাকে দেখে বিন্দুমাত্রও বিচলিত হল না। তাকিয়ে থাকলো ক্লান্তিহীন ভাবে। যেন যুগান্তর ধরে আমরা এভাবেই তাকিয়ে আছি একে অপরের দিকে। পাশের ফ্ল্যাটের দরজা খোলার আওয়াজে আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম। আমি তড়িৎ বেগে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমার মানবীর উপর। উন্মাদের মতো চুমু খেতে থাকলাম। বাহুতে তাঁকে পিষ্ট করতে থাকলাম। শরীরের যত শক্তি আছে ততটাই দিয়ে আমি তাঁকে আমার মাঝে মিশিয়ে ফেলতে চাইলাম। মানবী কিছুটা কুঁকড়ে গেলো। কিন্তু ছাড়িয়ে নিতে চাইলো না। সে ভেঙে চুড়ে যাচ্ছে। গলে গলে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। আমার প্রতিটি চুম্বন প্রতিটি স্পর্শ তাঁর শরীরের যে জায়গায় পড়ে সে জায়গায় আমি তাঁর কম্পন অনুভব করি । মাঝপথে আমি কয়েকটি কালচে লাল চিহ্ন খুঁজে পাই তাঁর দেহে যা আমি বিগত রাতে অঙ্কন করেছিলাম। সেই কালচে লালে আমি মমতার হাত বুলাই। আমি আরও হিংস্র হয়ে গেলাম। আমার হিংস্রতা তাঁকে আরও ব্যাকুল করে তুলল। আমাদের চরম ব্যকুলতা যখন সাময়িক ভাবে কিছুটা শান্ত হয়, তাঁর গালে আমি কিছুটা নোনতা স্বাদ পাই। বুঝলাম চোখ দিয়ে তাঁর জল গড়াচ্ছে। । আমাকে খামছে ধরল। তাঁর বাহুবন্ধনে আমি কামনার চাইতে আকুলতা অনুভব করলাম তীব্র ভাবে।

আকুলতা …… বিষাদময় আকুলতা। অস্পষ্ট স্বরে সে বলে উঠলো , “যেও না কখনো”
আমি স্পষ্ট স্বরে বললাম, “আমি বেঁচে থাকতে চাই। সুন্দর পৃথিবীতে আমি সুখী মানুষ হয়ে বাঁচতে চাই। আমার সুখ তুমি”
“সুখ, দুঃখ কোনটিই মানুষের হাতে নেই। আমারও সুখ তুমি। কিন্তু তুমি আমার নও”
“তবে আমি এখানে কেন, তোমার চোখে জল কেন”
“সহসা বিচ্ছেদ হবে। এ তারই আভাস”

আমি থমকে গেলাম। আমার গলায় যেন কিসের এক তীব্র চাপ অনুভব করলাম। বুকের টিপ টিপ যেন থেমে গেলো। আমি হাত পা নাড়াতে চাইলাম। পারলাম না। যেন আমি অজীবন পঙ্গু। আমার এই অবস্থা থেকে সেই মুক্তি দিলো। আমাকে টেনে তাঁর বুকে নিয়ে গেলো। আমি কোমল প্রশান্তি অনুভব করলাম। আমার মাথায় সে পরম মমতায় বিলি কেটে দিতে লাগলো।
“ঘুমাও, বড্ড চঞ্চল তুমি”
আমি চোখ বন্ধ করলাম। অসম্ভব ক্লান্ত লাগছে নিজেকে। আমি আমার সুখের বুকে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম ভেঙে আমি প্রথম দেখি তাঁকে। স্নিগ্ধ শান্ত কোমল টলমলে নরম গভীর দৃঢ় এবং পরম মমতাময়ী।
যেভাবে মমতায় আচ্ছাদন করে আমাকে ঘুম পারিয়েছিল সেভাবে আবার ধীরে ধীরে জাগিয়ে তুলল। আমাকে গোসল করাল। আমি তাকিয়ে থাকলাম তাঁর দিকে যেন চোখের দৃষ্টি শুধু তাঁর জন্যই। আমাকে চা বানিয়ে দিলো। আমি তাকিয়ে থাকলাম তাঁর দিকে, আমি কথা বলতে চাইলাম। কিন্তু একটি শব্দও বের হল না মুখ দিয়ে। যেন আমি আজন্ম মূক। আমার জামা কাপড় ঠিক করে দিয়ে মাথা আঁচড়িয়ে দিয়ে আমাকে আবার বুকে জড়িয়ে ধরল। এবার আমার ভেতরে বজ্রপাত হল। নিজেকে সীমাহীন অসহায় মনে হল। এই, এখানে, এই পরিবেশে, এই সুখের ছায়াতলে, এই তুলনাহীন সময়ে, এই পবিত্র ভালোবাসার বিরামহীন স্পন্দনে তাঁকে জড়িয়ে ধরা ছাড়া আমি আর কি করতে পারি!

আমাকে জড়িয়ে ধরেই সে দরজার কাছে নিয়ে আনে। দরজা খুলে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। আমি নিজেকে ভাবনা শূন্য মনে করলাম। ঠিক এই মুহূর্তে আমার কি যেন বলার কথা। আমি কিছুই বলতে পারলাম না । নীরব নিশ্চুপ বিহ্বল ক্লান্ত দুঃখী মন নিয়ে আমি মাথা নিচু করে বের হয়ে গেলাম। বের হয়ে একবার দাঁড়ালাম। পিছন থেকে বলে উঠলো “ভালো থেকো”

আমি বধির হয়ে চলে আসলাম। সোজা আমার বাসায় আমার রুমে গিয়ে আমি এমন শান্ত ভাবে বসে রইলাম যে আমাকে দেখলে যে কেউ বলবে আমার জীবন খুব স্বাভাবিক আছে।

না , আমি স্বাভাবিক নেই। দু মাস আগে থেকেই আমি স্বাভাবিক নেই। দু মাস আগে থেকেই আমি ভেতরে অসংখ্যবার ভাঙতে থাকি। ভেতরে গুড়ো হয়ে আমার আমিকে বার বার জোড়া লাগাই। যে মুহূর্তে আমি তাঁকে দেখতে পাই সেই মুহূর্ত থেকে আমি ধীরে ধীরে মৃত্যুমুখে পতিত হই।
সেইদিন সেই মুহূর্ত আমার জীবনের পরম মুহূর্ত। দুপুরে টিএসসি মোড়ে যখন রেজা, আমার বন্ধু তাঁর অ্যান্টির সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়। খুব সাদামাটা ছিল সেই পরিচয় পর্ব। কিন্তু আমার ভেতরে কি যেন ভেঙে যায়। আমি মুহূর্তে মুহূর্তে সেই ভাঙ্গনের আওয়াজ পাই। হাস্যউজ্জ্বল এক পঁয়ত্রিশ ঊর্ধ্ব রমণী আমাদের বন্ধু মহলের সাথে খুব ভালোভাবে মিশে যায়। আমরা এক সাথে আড্ডা দেই, ঘুরি,এক সাথে তর্কে মেতে উঠি দেশ ধর্ম রাজনীতি ধর্ষণ নিয়ে। কখনো তাঁর গাড়িতে বা আমার গাড়িতে আমারা অনেক দূরে চলে যেতাম। তিনমাসের বাংলাদেশ ভ্রমণে এসে টানা দুমাস আমাদের সাথেই থেকেছে সর্বক্ষণ। আমার ভেতরের ভাঙ্গনের আওয়াজ পাই তখনই যখন সে হেসে উঠে আমার সামনে। যখন সে হাসতে হাসতে আমার উপর পরে যায়, যখন সে আমার হাত ধরে। যখন সে হাসতে হাসতে হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে হাসি থামিয়ে দিতো। আমি বুঝতে পারতাম ভাঙ্গন তবে সে পাশেও হচ্ছে। এখানে সে একাই থাকে। তাঁর মেয়ে থাকে অস্ট্রেলিয়াতে। বিয়েচ্ছেদ হয়েছে ৬ বছর। সেখানেই চিরস্থায়ী। মাঝে মাঝে বাংলাদেশে আসা হয়। গতরাত ছিল তাঁর চলে যাওয়া উপলক্ষে আমাদের সবাইকে খাওয়ান। সবাই ছিলাম আমরা। প্রাণবন্ত, আড্ডায়, খাওয়ায় মত্ত। আমি বিমর্ষ চোখে তাঁর চোখে কিছু খুঁজতে থাকি। খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ পেয়ে যাই। ঠিক তখনই দুজনের চোখ এক সাথে কিসের নেশায় যেন স্থির হয়ে যায়। আমি পান করছিলাম। কিন্তু এক বিন্দুও নেশা হচ্ছিলো না। কিন্তু যেই আমি তাঁর চোখে দেখতে পেলাম আমার মতই বিষণ্ণতা আমি নেশায় মত্ত হয়ে গেলাম। এক আদিম নেশার মত্ততা আমাকে ছেয়ে রাখল। খাওয়া এবং পান শেষে ড্রাইভে বের হওয়ার কথা। সবাই গেলো । সে গেলো না। শরীর খারাপ বলে সবাইকে বিদায় জানালো। আমার কাছে এলো যখন কিছুই বলল না। না বিদায় না আহবান। না কোন বাধন না কোন বিচ্ছেদ। শুধু দৃষ্টি বিনিময় ছাড়া কোন শব্দও উচ্চারণ করলাম না।
বাসা থেকে আসছি বলে গাড়ি ঘুড়িয়ে আবার তাঁর বাসায় এলাম। রাত তিনটে পর্যন্ত আমি ডুবে ছিলাম তাঁর মাঝে।

সময়ের বিবর্তন দেখে আমি বিধ্বস্ত বিহ্বল হতবাক। এক রাত আমি স্বর্গরাজ্যে সুখে আত্মহারা ছিলাম।আর তার পরের রাতে আমি নরকে প্রবেশ করছি। অনন্ত নরক। যে নরকের কোন শেষ নেই। যেভাবে গ্রন্থে বর্ণিত নরকের কোন শেষ নেই।
আমি একের পর এক সিগারেট শেষ করি। যেন সিগারেটই আমার একমাত্র খাদ্য। আমি টানা ২৪ ঘণ্টা শান্ত স্থির কিন্তু ভেতরে এক ঘূর্ণিঝড় নিয়ে বসে থাকি।
রেজার ফোনে আমি কিছুটা বিচলিত হই। সবাই যাচ্ছে তাঁকে সিঅফ করার জন্য। আমি যাওয়ার মতো সাহস পেলাম না। হঠাৎ তাঁর কল আমাকে পাগল করে দেয়। কম্পিত হাতে আমি মুঠোফোনটি কানে লাগাই। “যাচ্ছি”

এই একটি শব্দ আমার ভেতরে গতি সঞ্চার করে। আমি মরিয়া হয়ে তীব্র বেগে গাড়ি ছুটিয়ে এয়ারপোর্টে যাই। ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়িয়ে আছে আমার মানবী। আমি নিস্পলক চোখে তাঁকে দেখতে থাকি। তাঁর চোখে একবার বা শেষবার চোখ রাখার জন্য আমি ব্যাকুল হই। অবশেষে মানবী আমার দিকে তাকায়। আমি চূড়ান্ত পর্যায়ে ভেঙে যাই। ভেতরটা আমার ধ্বংস হয়ে যায়। এক অমানুষিক চিৎকার আমার গলায় উঠে আসে। আমি দমন করতে চাই। তাঁর ছলছল চোখে হালকা মিষ্টি হাসি আমাকে বিমর্ষ করে আরও শতগুণ। অবশেষে মানবী মিলিয়ে যায়।

আমি বের হয়ে আসি। তীব্র ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। আমি রাস্তায় তীক্ষ্ণ তির্যক বেগে নেমে আসা বৃষ্টি দেখতে থাকি। আমার ভেতরের অমানুষিক চিৎকারটি এবার জল হয়ে আমার চোখ দিয়ে নিচে নামতে থাকে।

ফারজানা নীলা। গল্পকার, নারী ও প্রাণি সংরক্ষণ অধিকারকর্মী।  

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ