প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
মোবাইল স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নিচের দিকে নেমে গেল। আমার পা দুটো কাঁপছে, পিপাসা লাগছে খুব, দু’ কান দিয়ে যেন ধোঁয়া বেরুচ্ছে অবিরাম। আমি খুব ঘামছি। মনে মনে নিজেকে অটোসাজেশন দিতে লাগলাম, “আমি শান্ত, আমি স্থির।”
*
মাস ছয়েক হল আমার হাসবেন্ড বদলী হয়েছে চিটাগাং। সরকারী চাকুরী। সপ্তাহ শেষে শুক্র শনি দুদিন সরকারী ছুটি। প্রতি বৃহিস্পতিবার অফিস শেষে বাসায় চলে আসে। দু’দিন থেকে শনিবার সন্ধ্যায় আবার ট্রেনে উঠে চিটাগাং এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। ও চলে গেলে কেমন যেন শূন্য শূণ্য লাগে। ছেলে দুটো বড় হয়ে গেছে। একজন ক্লাশ এইট আর একজন ক্লাশ টেন এ পড়ছে। স্কুল থেকে ফিরে কোচিং, এরপর বাসায় টিচার এসে পড়িয়ে যায়। সেও চিটাগাং। আমার আর কিছু করার থাকে না। গল্পের বই পড়ার নেশা নেই। নামায, দোয়া-দরুদ আর কত পড়া যায়! ক্রাইম পেট্রোল আর জি সিনেমা দেখে দেখে সময় কাটাই। মাঝেমধ্যে ওর খোঁজ খবর নিই।
*
আমার এই একাকীত্ব দেখে সে আমাকে একটি স্মার্ট ফোন কিনে দেয়। এরপর ফেসবুকে একটি আইডি খুলে দেয় “সবিতা হক” নামে। কিভাবে পোস্ট, ট্যাগ, শেয়ার, ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতে হয় তা শিখিয়ে দেয়।
বাচ্চারা স্কুলে চলে যাওয়ার পর সময় আর কাটতেই চায় না। টিভিতেও মন বসে না। অতঃপর মোবাইলে ফেসবুক খুলে বসি। ওরে বাবা! এ রাজ্যের যেন কূলকিনারা নেই। এর থেকে তার আইডি, তার থেকে ওর আইডি। বানরের ডাল থেকে ডালে লাফানোর মত আমিও এই আইডি থেকে সেই আইডিতে ঘুরতে লাগলাম। মেসেঞ্জারে কত মেসেজ!!! আমার সাথে পরিচিত হতে চায়। আমিও চ্যাটিং করতে করতে টাইপিং এ এক্সপার্ট হয়ে গেলাম।
*
একদিন একটা দুষ্টবুদ্ধি মাথায় খেলল। “জলে ছায়া” নামক একটা ফেইক আইডি খুলে ফেললাম। এই আইডিতে যারাই আমাকে রিকুয়েস্ট পাঠাচ্ছে বাছ বিচার ছাড়াই একসেপ্ট করে নিচ্ছি। “আদিত্য আদি” নামের একটি আইডি একসেপ্ট করার পর আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে একটা মেসেজ পাঠাল।
– “জলে ওই ছায়াটি কার জানতে পারি?”
– “অবশ্যই, ওটি আমার অন্তরের”।
– “ওটি কি শুধু আপনিই দেখেন? নাকি অন্য কেউ চাইলেও দেখতে পারে?”
– “মন দিয়ে দেখতে চাইলে ঠিক দেখতে পারা যাবে।”…………
এভাবে প্রায় প্রতিদিন চ্যাটিং হচ্ছে। আমার সময় যেন উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে। এরপর আদি’র সাথে যেটা চলছে বলা যায় ষোল-বিশের প্রেম। আমি ভালো আছি কিনা, গোসল, নামায হল কি না, খেয়েছি কিনা সব দিকেই ওর নজর। আমিও তার সব জানতে চাই। সত্যিই নিজেকে একেবারে ষোল বছরের তরুণী মনে হচ্ছে। আমার হাসবেন্ড তো কখনো এমন ভালোবাসে নি!!!
অবস্থা এমন হল আমার হাসবেন্ডের সাথে এক ভীষণ দূরত্ব তৈরি হয়ে গেল। খুব দরকারে ওকে ফোন দিই, ওর খাবার দাবারের সব খবরাখবর নেয়া একেবারেই কমে গেল। আমি রীতিমত আদিত্যের প্রেমে পাগল।
একদিন ও আমাকে বলল আমার ছবি পাঠাতে। আমি প্রথমে রাজী হইনি, পরে ওর পিড়াপীড়িতে অন্য আইডি থেকে একজন সুন্দরী রমণীর ছবি পাঠালাম। ছবি দেখে আদিত্য বিশাল এক কবিতা পাঠিয়ে দিল। কবিতা পড়ে আমি অভিভূত। শুক্র শনিবার সে বাসায় থাকে বলে চ্যাটিং বন্ধ থাকে সেই সাথে যেন আমার নিঃশ্বাসও বন্ধ হয়ে যায়। আমি আদি’র সাথে কোন যোগাযোগ করতে পারি না। মনে হয় অন্ধকারে বসে আছি। খুব কমই যোগাযোগ হয়। ওয়াশরুমে মোবাইল নিয়ে ঢুকি, কখন যে ঘন্টা পার হয়ে যায় সে আর খেয়াল থাকে না। সে অবশ্য আজকাল খুব লিবারেল। কেননা সারাক্ষণ ফেসবুক নিয়েই আছে। সকালের খাবার দুপুরে দিলেও মুখে কোন রা নেই। বাচ্চারা কোচিং এ। দু’ জন দু’ রুমে বসে মোবাইল নিয়ে টেপাটেপি করি। আমারটা সাইলেন্ট করে রাখি। যদি ওর চোখে পড়ে বিপদের শেষ নেই।
*
সে থাকে রংপুর। একটা প্রজেক্টে কাজ করে। ঢাকায় মিরপুরে বাসা। স্ত্রী গৃহবধূ, একমেয়ে এক ছেলে । আমার বাসা কলাবাগান। কিন্তু আমি বলেছি উত্তরা। আমরা দু’জন দু’জন কে দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে আছি। এভাবে প্রায় তিন মাস পার হয়ে গেল। আমার ভেতর যে এত ভালোবাসা লুকিয়ে ছিল তা দেখে আমিই অবাক। আজকাল নিজের খুব যত্ন নিচ্ছি, দু চার লাইন কবিতাও লিখছি। ভালোবাসার কি অদ্ভুত শক্তি!! একজন মধ্যবয়সী গৃহবধূকেও কবি বানিয়ে ফেলে!!!
*
অবশেষে আমরা ঠিক করলাম আমরা দেখা করব। ২৫ শে ডিসেম্বর বড় দিনে “পিজা হাট” এ সন্ধ্যা ছটায়। আমি ওর প্রতি এতই দূর্বল হয়ে পড়েছি যে ওই দিন কি করে বাসা থেকে বেরুব তা না চিন্তা করেই হ্যাঁ বলে দিলাম। অথচ মহা সমস্যায় পড়লাম। সরকারি ছুটির দিন বলে সেও বাসায়। কিন্তু বরাবরের মত ভাগ্য এতই ভালো যে ওই দিন নাকি তার কোন এক কলিগের বিয়ে। আমায় সকাল সকাল বলল -” সবিতা, সন্ধ্যায় আমার এক কলিগের বিয়ে। রাতে আসতে দেরী হতে পারে। তুমি খেয়ে নিও।”
আমি বললাম -” কতদিন পার্লারে যাই না, চেহারা দেখে তো তোমার চেয়েও বুড়ো লাগে। ওদের বাসায় রেখে আমিও একটু পার্সোনা থেকে ঘুরে আসি বিকেলে?”
– “যেও, তবে রাত করো না বেশি”। আমি সহজেই ছাড়পত্র পেয়ে বেশ খুশি।
*
সকাল সকাল রূপচর্চার প্রস্তুতি শুরু করে দিলাম। উপটান, মধু মেখে পনের মিনিট ওয়াশরুমেই কাটালাম। ওর ধাক্কাধাক্কিতেই বের হলাম। তারও প্রস্তুতি দরকার, সেও তো সন্ধ্যায় বিয়েতে যাবে। চুল কাটিয়ে কাল রং করে এসেছে। মুড খুব ভালো, গুনগুন করে গান গাইছে। ওয়াশ রুমে ঢুকল। নিশ্চয় আধ ঘন্টার আগে বের হবে না।
*
আমি ডাটা অন করে খুব আবেগ নিয়ে জানতে চাইলাম “কি করছ জানু”? অনলাইন এক্টিভ কিন্তু উত্তর নেই। আবার লিখলাম “খুব ব্যস্ত বুঝি নিজেকে নিয়ে?” নিরুত্তর। আমি মেসেজ পাঠাতেই থাকলাম। একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম – ওর মোবাইলেও প্রচুর মেসেজ আসছে। যত বার মেসেজ পাঠাচ্ছি ওর মোবাইল থেকে পক পক শব্দ হচ্ছে। আমি আবার মেসেজ পাঠালাম, আবার শব্দ, আবার মেসেজ, আবার শব্দ…..। কৌতূহলী হয়ে ওর মোবাইলটা হাতে নিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার পায়ের তলার মাটি সরে গেল – “আদিত্য আদি”।
আমি কি চিৎকার করব? ওকে ডাকব? এক ভয়ংকর সত্যের সামনে দাঁড়িয়ে এখন। নিজের মনকে বুঝালাম, আমিও সমান দোষী। তারচেয়ে বরং চেপে যাই সংসারের শান্তির জন্য। আমি অনেক ভেবে সর্বশেষ লিখলাম – “অনেক দিনের এক অদেখা অধ্যায় আজ শেষ হতে চলল। এর পর কি হবে যদি দু’জন দু’জনকে আরো পছন্দ করে ফেলি।
যদি আরো কাছে আসতে চাই? আমাদের ভুলের জন্য শাস্তি পাবে আরো ছয়টি প্রাণ। এই বয়সে এমন পাগলামি মানায়? তারচেয়ে সংসারে দু’জনই মনোযোগ দিই, ভুলে যেও অদেখা এই আমাকে”
*
বুঝলাম সংসারের বয়স বেশি হলেই স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা শেষ হয়ে যায় না। এটা গ্লাসের নীচে জমে থাকা তলানির মতো। প্রয়োজন একটু উষ্ণতা, পানিতে চামচের নাড়া। তাহলেই ভালোবাসা দ্রবীভূত হয়ে জীবন হয়ে উঠবে শরবতের মতো মজাদার পানীয়।
*
মেসেজটি পাঠিয়ে আইডি ডিএক্টিভ করে দিলাম। বুজলাম, তলানিতে চিনি যখন রয়ছেই শুধু চামচ দিয়ে নাড়াতে হবে এই আমাকেই।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..