ভালোবাসার মুখোমুখি
একটি শ্রুতিনাটক ভালোবাসার মুখোমুখি (এই নাটকের তিনটি চরিত্র –প্রতিষ্ঠিত লেখক বাবা নশ্বর সরকার, মা…..
চরিত্র
মহিম রায় – ধনী ব্যবসায়ী, গ্রামে প্রচুর সম্পত্তি। চাষ, মুরগি পালন, পশু পালন চর্চা করেন
হেমাঙ্গিনী- মহিম এর স্ত্রী
সঞ্চারী – মহিম ও হেমাঙ্গিনীর বড় মেয়ে, বিবাহিতা, বিদেশে থাকে
চকোরী- মহিম ও হেমাঙ্গিনীর ছোট মেয়ে, বিবাহযোগ্যা
রজত – সঞ্চারীর বর
বংশীধর – অধ্যাপক, সঞ্চারীকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক
প্রথম দৃশ্য
মহিমের অন্দরমহলের বসার ঘর। সঞ্চারী আর হেমাঙ্গিনীর মধ্যে কথা হচ্ছে | |
হেমাঙ্গিনী | তুই এতদিন পরে এলি, মাত্র এই কটা দিনের জন্য? একটা মাস ও তো পুরো নয়। আর কটা দিন থেকে যা না। আমি বলবো জামাইকে? |
সঞ্চারী | ও বাবা। ওসব ভুলে যাও। এই কটা দিন যে ম্যানেজ করা গেছে সেটাই অনেক। তোমার জামাই তো বলেই দিয়েছে, অল্প দিন ছুটি, যত ইচ্ছে বাপের বাড়ি থাকো। |
হেমাঙ্গিনী | বড় বুঝদার ছেলে। তা সে আসবে কবে? তোকে রেখে সেই যে গেলো, আর তো দেখাই নেই তার |
সঞ্চারী | আরে বাবা আসবে। তার ও তো বাপের বাড়ি বলে একটা জিনিষ আছে। ও দিকটা সামলে নিক আগে। পারলে আজ সন্ধ্যেয় আসবে বলেছে। |
হেমাঙ্গিনী | তোকেও তো ও বাড়ি যেতে হবে, সেটা কবে? |
সঞ্চারী | মা, তুমি ওসব চিন্তা ছাড়ো তো, আমার সময় মতো যাব। আমাদের মধ্যে কথা হয়েই আছে। বাপ ৭০%, শ্বশুর ৩০% – যার যার তার তার। |
হেমাঙ্গিনী | উদ্ভট সব কথা তোদের। ওরকম হয় নাকি? তোর শাশুড়ি কী ভাববেন? |
সঞ্চারী | সে রজত ম্যানেজ করবে। এত দুর থেকে এসেছি এই কদিনের জন্য, নিজের বাবা মা বোন কে একটু বেশী সময় দেবো না? |
হেমাঙ্গিনী | দেখ যা ভালো বুঝিস। বোনের সঙ্গে একটু বরং সময় বেশী দে, বুঝিয়ে বল যে বিয়ের বয়স হয়েছে সেটা যেন এখন মাথায় রাখে। |
সঞ্চারী | চকোরী তো ঝানু মেয়ে। বুঝিয়ে বলতে হবে কেন? কিছু হয়েছে নাকি? |
হেমাঙ্গিনী | না সেরকম কিছু না, কিন্তু খালি পড়াশুনো করলেই তো হবেনা, বিয়ে করে সংসার-ধর্ম তো করতে হবে। |
সঞ্চারী | কেন? বিয়ে করবে না বলছে নাকি? |
হেমাঙ্গিনী | না, তা ঠিক নয়, কিন্তু ওসব কথা কানে তোলেনা খুব একটা। এখন তো বলছে রিসাচ – ফিসাচ কীসব করবে। |
সঞ্চারী | তা করুক না। বিয়ের সঙ্গে তার কী? বাবা কী বলছে? |
হেমাঙ্গিনী | তোর বাবা!!!! মেয়ের বিয়ের কথা তাকে বলে কোন লাভ আছে? তার মাথায় এখন একটাই জিনিষ ঘুরছে – “ রঘুনাথ্পুর বার্ষিক গবাদি পশু প্রতিযোগিতা” – তাতে রাজমহিষী প্রাইজ না জেতা পর্য্যন্ত অন্য কোন কথা তোর বাবার মাথায় ঢুকবে না |
সঞ্চারী (হেসে) | রাজমহিষী?? মানে – বাবার ঐ নতুন আমদানি করা মোষটা? নামটা ঘ্যামা দিয়েছে কিন্তু.. |
হেমাঙ্গিনী (ব্যঙ্গ করে) | তোর বাবার সামনে ওরকম মোষ মোষ বলিস না। আদর করে নাম দিয়েছে রাজমহিষী। সেই নামেই নাকি তাকে ডাকতে হবে। গা জ্বলে যায় |
সঞ্চারী | ছাড়ো না, – খেত, খামার, গরু, মোষ নিয়ে বাবার পাগলামি তো চিরকালের। |
হেমাঙ্গিনী | না রে, এবার যেন মাথায় একেবারে বায়ু চড়ে গেছে। সারাদিন খালি রাজমহিষী আর রাজমহিষী। পারলে চব্বিশ ঘন্টাই গোয়ালে কাটায়। আর মোষটাও হয়েছে তেমনি; তোর বাবা আর হেড মুনীশ গোপীরাম ছাড়া কারুর হাতে খাবে না। ন্যাকামি দেখলে শিং ধরে ঠাস করে একটা চড় মারতে ইচ্ছে করে। |
সঞ্চারী (হাসে) | তুমি রাজমহিষীর ওপর খুব চটেছ দেখছি। |
হেমাঙ্গিনী | না – ওর ওপর চটবো কেন? অবোলা প্রানী। তোর বাবাই তো তাকে মাথায় তুলেছে। গবাদি পশু প্রতিযোগিতায় প্রাইজ পেয়ে সে নাকি আমাদের মুখোজ্জল করবে। আর এদিকে মেয়ের বিয়ে ঠিকমতো না হলে কার কী উজ্জ্বল হবে সে দিকে কোনো খেয়াল নেই। |
সঞ্চারী | আহা শোনো শোনো মা, অত রেগো না। চকোরীর ব্যাপারে আমি না হয় বাবার সঙ্গে কথা বলবো। তার আগে একটা জিনিষ বলো তো – ও কি নিজে কিছু ঠিক করে ফেলেছে? মানে কাউকে পছন্দ টছন্দ হয়? জানো কিছু? |
হেমাঙ্গিনী | বলা মুশকিল। ছেলে বন্ধু তো দু চারটে আছে। তাদের কাউকে তো পাত্তা দেয় বলে মনে হয় না। বংশীধর বলে একটা ছেলে চকোরীকে খুব পছন্দ করে, কিন্তু মেয়ে তো তাকেও নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরায়। |
সঞ্চারী | নামটা শুনলে তো নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাতে ইচ্ছে করবেই মা। সে যাই হোক, বংশীধর ছেলে কেমন? |
হেমাঙ্গিনী | ছি ছি, নাম নিয়ে ওরকম বলিস না, ভক্ত বৈষ্ণববাড়ির ছেলে, তাই অমন নাম। ছেলে খুব ভালো। জেলা কলেজে প্রফেসর। ভদ্র সভ্য – আমার তো বেশ পছন্দ, কিন্তু মেয়ের মতি গতি তো কিছু বুঝতে পারিনা। তাই বলছিলাম যে তুই আর জামাই মিলে চকোরীকে একটু বোঝা। |
সঞ্চারী | কলেজ থেকে ফিরবে কখন সে? |
হেমাঙ্গিনী | এসে যাবে, সময় হয়ে গেছে। |
দরজার পাশ থেকে গলা খাঁকারির আওয়াজ হয়। হেমাঙ্গিনী মাথায় ঘোমটা তুলে দেয় । | |
হেমাঙ্গিনী | কে -এ -এ? |
বংশীধর | কাকীমা। আমি বংশীধর। |
হেমাঙ্গিনী আর সঞ্চারী মুখ চাওয়া–চাওয়ি করে। সঞ্চারীর মুখে উত্তেজিত হাসি। হাত নেড়ে বংশীধরকে ভেতরে ডাকতে বলে। | |
হেমাঙ্গিনী | এসো বাবা, ভেতরে এসো। |
বংশীধর ভেতরে ঢোকে। | |
বংশীধর | ভালো আছেন কাকিমা? (সঞ্চারী কে দেখে থেমে যায়) ওঃ – সরি। আমি বিরক্ত করলাম না তো? |
হেমাঙ্গিনী | না না, সেকি? এসো আলাপ করিয়ে দি। আমার বড়মেয়ে, সঞ্চারী। তুমি আগে দেখনি। বিলেতে থাকে, অনেকদিন পরে এলো। |
বংশীধর | (বিগলিত হেসে) হ্যাঁ শুনেছিলাম, দিদি আসবেন। |
বংশীধর এগিয়ে এসে প্রনাম করে। সঞ্চারী বাধা দেয় না, উপভোগ করে। বোঝা যায় বংশীধরকে তার ভালো লেগেছে। | |
সঞ্চারী | থাক থাক। বোসো |
বংশীধর হেমাঙ্গিনীকেও প্রনাম করে চেয়ারে বসে। | |
হেমাঙ্গিনী | চকোরীর মুখে শুনলাম তোমার চাকরি নাকি পার্মানেন্ট হয়েছে। |
বংশীধর | আজ্ঞে হ্যাঁ, গত সপ্তাহেই চিঠি পেয়েছি। |
হেমাঙ্গিনী | খুব ভালো খবর। মিষ্টিমুখ না করে যাবে না। (সঞ্চারীর দিকে তাকিয়ে) তুই তাহলে ওর সঙ্গে কথা বল। আমি চা- জলখাবারের বন্দোবস্ত করি। চকোরীরও তো আসার সময় হল। |
হেমাঙ্গিনীর প্রস্থান | |
সঞ্চারী | তোমাকে ভাই তুমি করেই বলছি। |
বংশীধর | হ্যাঁ হ্যাঁ প্লীজ। |
সঞ্চারী | মা তোমার কথা বলছিল একটু আগেই |
বংশীধর (উৎসুক) | তাই নাকি? কী বলছিলেন? |
সঞ্চারী | শোন বংশী, সোজাসুজি বলেই ফেলি। মা বলছিল – তোমার নাকি চকোরীকে পছন্দ। কথাটা কি ঠিক? |
বংশীধর (হেসে) | আপনারা দুই বোন-ই বেশ স্পষ্টবক্তা |
সঞ্চারী | একটু বেশী স্ট্রেট – ফরোয়ার্ড হয়ে গেলাম? কী করবো বলো? হাতে সময় কম, তিন সপ্তাহের ছুটি নিয়ে এসেছি। তাই তাড়াহুড়ো করছি। কিছু মনে করলেনা তো? |
বংশীধর | একটুও না দিদি। (একটু থেমে ) —- বলতে কিন্তু কিন্তু লাগছে যদিও, তাও জিজ্ঞেস করছেন যখন বলেই ফেলি – চকোরীকে আমি খুবই — মানে বিশেষ চোখে দেখি — ভাল লাগে আর কি (লজ্জিত ভাবে ঘাড় চুলকায়) |
সঞ্চারী | এই তো চাই। গুড । তা প্ল্যানটা কী? চকোরী কী বলছে? |
বংশীধর | কি যে বলছে কিছু বোঝা মুশকিল। আপনার বোন, আপনি তো ভালোই জানেন। না বলেনি — কিন্তু হ্যাঁ ও বেরোচ্ছেনা মুখ দিয়ে |
সঞ্চারী | শোনো বংশী, চকোরী রাজী থাকলে আমার আর মা র কোন আপত্তি তো নেই, বরং খুশীই হবো আমরা। কিন্তু বাবা একটু প্রবলেম হতে পারে। |
বংশীধর | হ্যাঁ । চকোরী বলে যে কাকাবাবুকে রাজী করানো খুব মুশকিল। ব্যবসায়ী মানুষ তো – চাকরি বাকরি করা পাত্রের হাতে মেয়ে দিতে চান না। |
সঞ্চারী | সে কথা ঠিক। খুব শাঁসালো না হলে, চাকরি জিনিষটার ওপর বাবার খুব একটা ভরসা নেই। যাই হোক সলিউশন তো কিছু একটা বার করতে হবে। দেখি আমি থাকতে থাকতে যদি একটা হিল্লে হয় ব্যপারটার, তাহলে ভালো হয়। |
বংশীধর | আমি আপনার শরণ নিলাম দিদি – চকোরীকে একটু বুঝিয়ে বলুন। আমি তাহলে একবার কাকাবাবুকে প্রস্তাবটা দিয়ে দেখি – (চকোরীকে ঢুকতে দেখে) ঐ এসে গেছে। |
চকোরীর প্রবেশ | |
চকোরী | “ঐ এসে গেছে” মানে? আমায় নিয়ে কথা হচ্ছিল নাকি? |
সঞ্চারী | তোকে নিয়ে নয়, তোদের নিয়ে। তোদের দুজনকে নিয়ে |
চকোরী | আচ্ছা!! কী কথা? (ভেতরের দিকে তাকিয়ে চেঁচায়) মা – আমি এসে গেছি |
হেমাঙ্গিনীর প্রবেশ। সঙ্গে চাকরের হাতে খাবারের ট্রে | |
হেমাঙ্গিনী | (চকোরীর দিকে তাকিয়ে) হ্যাঁ দেখতে পেয়েছি। (বংশীর দিকে ঘুরে) খাও বাবা |
চকোরী ( ভেঙিয়ে) | এঃ – “ খাও ব্যাব্যা” – কী খাতির |
হেমাঙ্গিনী | চুপ কর। ও কী অসভ্যতা । বড় ক্যাটক্যাট করিস তুই। আমি যাই, তোর বাবার আসার সময় হলো। গুচ্ছের কাজ পড়ে রয়েছে। |
হেমাঙ্গিনীর প্রস্থান | |
সঞ্চারী | চকোরী – বংশী যা বলছে তা তো শুনলাম, মার সঙ্গেও কথা হলো। তুই একটু খুলে বল তোর মনের ভাব। তাহলে আমরা একটা কিছু ভাবনা চিন্তা করতে পারি। |
চকোরী | (বংশীর দিকে তাকিয়ে) – বাঃ! দিদি আসতে না আসতেই একেবারে ছালা খুলে ধরেছ? সবুর সয় না একটু? |
বংশীধর | আরে? আমি কী করলাম?.. |
সঞ্চারী | না না – আমিই খুঁচিয়ে জেনেছি। মার থেকে শুনে কৌতূহল চেপে রাখতে পারিনি। এবার তুই যদি বলিস তোর মত আছে, তাহলে আমরা এগোই। |
চকোরী | অমতের কী আছে? বিয়ে তো একটা করতেই হয়। পাত্র হিসেবে ইনি চলে যাবেন, কিন্তু তুই বল দিদি – বাবা কি মানবে? (একটু থেমে সামান্য দুষ্টু ভাবে) আর সত্যি বলতে কি – আমিও তো আদরে বড় হয়েছি। কম টাকায় যদি সংসার চালাতে না পারি? |
সঞ্চারী | সে কী রে? প্রেমের টানে টাকা পয়সা সব তুচ্ছ হয়ে যায় তো!! |
চকোরী | প্রেম ভাল কিন্তু অভাবী প্রেম বহুত ঝামেলার জিনিষ দিদি। আমরা কলেজের বন্ধুরা মিলে ঠিক করেছি যে প্রেমে পড়লেও এই practical angle টা সবসময় আমরা মাথায় রাখবো। |
বংশীধর | এবার বুঝলেন তো দিদি? কোন ও আশা দেখছেন কি? আমি তো দেখছিনা। আমি তাহলে এক কাজ করি — সম্পর্কে ইতি টেনে, লুচিটা খেয়ে উঠে পড়ি – কী বলেন? |
চকোরী | আজ্ঞে না। সম্পর্কে ইতি টানলে লুচি যেমন আছে তেমন থাকবে। |
সঞ্চারী | আঃ কী চ্যাংড়ামো করছিস। আমায় একটু কথা বলতে দিবি তোরা? আমি যা বুঝলাম তা হলো – প্রথম কাজ বাবাকে রাজী করানো, দু নম্বর কাজ বংশীধরের দিক থেকে ঐ practical angle এর ব্যাপারটার assurance পাওয়া। ঠিক? |
চকোরী | “ ধনকে নিয়ে বনকে যাব, থাকবো বনের মাঝখানে…. ধন দৌলত চাই না শুধু চাইবো ধনের মুখপানে” — ও জিনিষ আমার পোষাবে না। assurance required indeed. |
বংশীধর | আহা কী মুশকিল। assurance তো দিয়েছি। একটু না হয় ভরসা রাখলেই আমার ওপর। |
সঞ্চারী | ঠিক আছে, ঠিক আছে। বংশী তো বলছে, ওটা নিয়ে অত ভাবিসনা। |
চকোরী | বেশ, বলছো যখন ভাববো না। কিন্তু বাবাকে অত সহজে সাইজ করতে পারবে, ভুলেও ভেবো না। |
বংশীধর | কাকাবাবুকে বলেই দেখি না কী বলেন। আমাকে যে স্নেহ করেননা এমন তো নয়। |
চকোরী | বলতে চাও বলো। |
সঞ্চারী | শোন – আমি বলি কি, বংশী প্রস্তাবটা বাবাকে দিক। তারপর দেখা যাক। এর মধ্যে যদি ঐ পশু কম্পিটিশনে বাবার রাজমহিষী প্রাইজ পেয়ে যায়, তাহলে তো দারুন। বাবার মেজাজ তখন খুব ভালো থাকবে। তখন সবাই মিলে চেপে ধরবো। এনিওয়ে – সে কম্পিটিশন কবে? |
বংশীধর | দিন দশেক পরে। |
সঞ্চারী | বাঃ তাহলে তুমি আজই বাবাকে বলো। তোর জামাইবাবু ও এসে পড়বে আজ সন্ধ্যেবেলা। তাকেও দলে পাওয়া যাবে। |
বাইরে থেকে মহিম হালদারের হাঁক–ডাক শোনা যায়। মহিমের প্রবেশ। সে মোবাইল ফোনে কথা বলছে। বংশী উঠে দাঁড়ায়। তাকে বসতে বলে মহিম ফোনে কথা বলতে থাকে। | |
মহিম | হ্যাঁ হ্যাঁ – অন্তত তিন কলাম চাই। পারবেন তো? ঠিক আছে। ছবি? তুলতে চান তো চলে আসুন। হ্যাঁ কাল সকালে আসুন। |
মহিম ফোন রাখে | |
মহিম (আনন্দিত) | লোকাল কাগজ রাজমহিষীকে নিয়ে ফিচার করছে। ভাবতে পারিস? |
চকোরী | তুমি রাজমহিষীর জন্য পাবলিসিটি করাচ্ছ? পারোও বটে। |
মহিম | তোরা এসব কী বুঝবি? ও পাড়ার গনেশ পাল তার ভাগলপুরী গাইয়ের ছবি দিয়ে পোস্টার দিচ্ছে, জানিস ? |
সঞ্চারী | কিন্তু পাবলিসিটি করে কী হবে? প্রতিযোগিতায় বিচার তো জাজের হাতে। |
বংশী ( গলা খাঁকারি দিয়ে) | না দিদি। আজকাল একটা জিনিষ খুব উঠেছে না? — পাব্লিক পোল? ওটাও হবে এখানে। দুটো মিলিয়ে রেজাল্ট ঠিক হয়। |
সঞ্চারী | বাপ রে। বাবা – তাহলে তো তোমাকেও পোস্টার ছাপাতে হবে। |
মহিম | ভেবে দেখি – তোরাও ভাব না – আর কী P.R করা যায়। |
সঞ্চারী | বেশ তো – ভাবি আমরা। তোমার জামাই ও এসে পড়বে। এই সব মার্কেটিং এর ব্যাপারে ওর খুব মাথা খোলে। |
মহিম | কবে আসছে সে? |
সঞ্চারী | বলেছে আজ রাতের দিকে আসার চেষ্টা করবে, না হলে কালকে । চল চকোরী আমরা ভেতরে যাই। বাবা তুমি বংশীর সঙ্গে কথা বলো। তোমার চা আসছে। |
দুই বোন চলে যায়। মহিম একটু অন্যমনস্ক ভাবে বসে থাকে। | |
বংশী | কাকাবাবু – একটা কথা বলছিলাম। |
মহিম | হ্যাঁ বলো, পাবলিসিটি আইডিয়া? |
বংশী | না – অন্য ব্যাপারে একটা ….। |
মহিম | অন্য ব্যাপার সব ঠিকই আছে। খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করছে। দিনে প্রায় তিরিশ লিটার দুধ দিচ্ছে। দুধটা অবশ্য একটু কমে যাবে কম্পিটিশন অবধি যেতে যেতে.. তাও ধরো পঁচিশের নিচে তো নামবে না। তাতেও ওর ধারেকাছে কেউ থাকবে না। সাধে কি আর নাম রেখেছি রাজমহিষী? আহা – মহিষিদের রানি, – রাজমহিষী। |
বংশী | হ্যাঁ অপূর্ব নাম। |
মহিম | তবে কী জানো? একটাই সমস্যা – গোপীরাম – মানে যে ওর দেখাশুনো করে আর কি, সে ব্যাটা তো পাঁড় গাঁজাখোর। রাতে সবসময় ঠিক মতো খেয়াল রাখে কিনা বুঝতে পারছিনা। আজ সকালে দেখলাম রাজমহিষীর নাকের ডগায় মশা কামড়ে ফুলিয়ে দিয়েছে। কী অন্যায় কথা বলো তো? |
বংশী (anxious) | বলেন কী? |
মহিম | খুব ধমকেছি ব্যাটাকে আজ। রাতে নিজে গিয়ে দেখবো – গোয়ালে ধূনো দিয়েছে কিনা। |
বংশী | তা অন্য কাউকে রাতের দায়িত্ব দিলে হয় না? |
মহিম | আরে সে এক ঝামেলা। রাজমহিষীর বিশাল চেহারা দেখে কেউ ওর কাছে যেতেই চায় না। আর ওটাও হয়েছে গোপীরামের তেমনি ন্যাওটা। গোপী কে ছাড়া এখন হবে না। |
বংশী | ও। |
মহিম | তুমি পাবলিসিটি আইডিয়া নিয়ে কী বলতে যাচ্ছিলে? |
বংশী | আজ্ঞে পাবলিসিটি আইডিয়া নয়। একদম অন্য একটা ব্যাপার। মানে – বলছিলাম কি– চকোরী — মানে আমাদের তো অনেকদিনের আলাপ — বলছিলাম কি — আপনাদের অনুমতি যদি পাই — |
মহিম (দীর্ঘশ্বাস) | ও হরি – এই কথা – আমি ভাবলাম কী না কী — আর বলতে হবে না – বুঝেছি – চকোরীকে বিয়ে করতে চাও, এই তো? |
বংশী | আজ্ঞে আপনাদের মত পেলে..। |
মহিম | শোনো বংশী, আমি সোজা কথার মানুষ। তুমি ছেলে হিসেবে ভালোই। তোমার কাকিমা ও তোমার দলে। যতদূর জানি চকোরীও তোমাকে অপছন্দ করেনা। কিন্তু আমাকে একটা কথার উত্তর দাও – তুমি যা উপার্জন করো, তাতে কি তুমি চকোরীর উপযুক্ত ভরনপোষন করতে পারবে? |
বংশী | নিশ্চয়ই পারবো কাকাবাবু। সবে তো কেরিয়ার শুরু হয়েছে, ভালোই চলছে, আস্তে আস্তে উন্নতি করবো। |
মহিম | হুমমম…..কত পাও? |
বংশী (থতমত) | আজ্ঞে? |
মহিম | বলছি যে কত টাকা পাও প্রতি মাসে? আফটার ট্যাক্স বলো। |
বংশী | পনেরোর মতো ছিল.। এখন পার্মানেন্ট হলাম তো একটু বাড়লো। দাঁড়ান দেখে বলছি। (পকেট থেকে কাগজ বার করতে থাকে) আসলে সবে বেড়েছে তো – এখনো ফিগারটা মুখস্ত হয়নি। |
মহিম (খুব অবাক) | তুমি মাইনের কাগজ পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াও নাকি? |
বংশী | না না – এটা আজকেই পেলাম। কলেজ থেকে সোজা এসেছি তো। পকেটে রয়ে গেছে। – এই যে – ও বাবা – এত টাকা আবার কীসে কাটলো? এই হচ্ছে টোটাল.– দাঁড়ান দেখি — তাহলে নেট কত হলো? – উফ্ফ কী যে সব হিসেব। |
মহিম (অধৈর্য্য) | দেখি দেখি আমাকে দাও তো। |
বংশী (হাঁফ ছেড়ে) | এই নিন |
মহিম (দেখতে দেখতে ভুরু কোঁচকায়) | খেপেছ? এই টাকায় চকোরীকে পুষবে? হাঁড়ির হাল হবে তোমার। এ সব আশা ছাড়ো। |
বংশী (বিমর্ষ) | কাকাবাবু, যতদিন উন্নতি না করছি, চালিয়ে নেবো, আর চকোরীও তো চাইলে চাকরি করতে পারে। |
মহিম | না হে। চকোরী অতি সেয়ানা মেয়ে। চাকরি করুক আর আমার থেকে মাসোহারাই পাক, সে টাকা নিজের কাছেই রেখে দেবে। আমারই তো মেয়ে। তোমাকে বড়জোর মাঝেমধ্যে দু একটা প্রেজেন্ট দেবে। আফটার শেভ, টি-শার্ট এই সব। এর বেশী কিছু আশা কোরনা। আর চকোরীর হাতে পয়সা থাকেলেই বা – তুমি কি বৌয়ের হাত-তোলা হয়ে থাকবে নাকি? না না ওসব কোন কাজের কথা নয়। |
বংশী (বিমর্ষ) | তাহলে কি আমার কোন আশা নেই কাকাবাবু? |
মহিম | সে আমি কী জানি? উদ্যোগ নাও, উন্নতি হবে। |
বংশী | কী করে যে হবে তা তো বুঝতে পারছিনা। |
রজতের প্রবেশ । মহিম রজতকে খেয়াল করেনা। কথা বলে চলে | |
মহিম | আরে তোমরা ইয়ং-ম্যান। এই তো জীবন শুরু। সুযোগ আসে জীবনে। তাকে খপাৎ করে ধরে ফেলতে হয়, বুঝেছো? তবেই না উন্নতি হবে – (মহিমের মোবাইল বেজে ওঠে, কথা থামিয়ে সে মোবাইল ধরে) – হ্যালো – হ্যাঁ বলো কী ব্যাপার? (আঁৎকে ওঠে) কী-ই-ই? কী বললে? আরে ও তো সবসময় গাঁজা টেনেই থাকে। কী করেছে? কী সর্বনাশ? কজনকে পিটিয়েছে? কোন থানা? উকিল লাগিয়েছ? আরে এক্ষুনি লাগাও – জামিন চাই। গোপীরামকে ছাড়া রাজমহিষীকে খাওয়াবে কে? হ্যাঁ হ্যাঁ এখুনি। —- তুমি থাকো ওখানে, আমি আসছি। (মহিম দৌড়ে বেরিয়ে যায়) – মহেশ, মহেশ গাড়ী স্টার্ট করো, এখুনি. ..। |
রজত আর বংশী হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
|
|
বংশী | আপনি কাউকে খুঁজছেন? |
রজত | হ্যাঁ, আমি জাস্ট এলাম, এখুনি.. আমি এ বাড়ির জামাই। |
বংশী (স্বগতোক্তি) | বাঃ ভাগ্যবান আপনি। |
রজত | আপনি? |
বংশী | আমি জামাই নই |
রজত | Beg your pardon? |
চকোরীর প্রবেশ | |
চকোরী | কী হলো, বাবা চিৎকার করছে কেন? কেস ভায়োলেন্ট হয়ে গেছে নাকি? আরে!!!! রজতদা এসে গেছ? দিদি .। |
সঞ্চারীর প্রবেশ | |
সঞ্চারী | তুমি কখন এলে? বাবা কোথায় গেল? |
রজত | কিছুই তো বুঝলাম না। এই ভদ্রলোকের সঙ্গে কী সব সুযোগ উন্নতি নিয়ে কথা বলছিলেন, তারপর ফোন এলো। থানা, উকিল এই সব বলে চিৎকার করে বেরিয়ে গেলেন। (বংশীকে দেখায়) – ইনি কে? |
সঞ্চারী | এই তো সেই, যার কথা একটু আগে তোমাকে বললাম ফোনে। |
রজত | Ahhhh … my junior (হ্যান্ডশেক করে) বেশ বেশ, তুমিই বলো কী হয়েছে। |
চকোরী | তুমি কী এমন বললে যে বাবা থানায় দৌড়লো? |
বংশী | আমি কিছু বলিনি। কথা শুনে মনে হলো গোপীরাম গাঁজা খেয়ে মারামারি করে হাজতে গেছে। কাকাবাবু বোধহয় ছাড়াতে গেলেন। |
সঞ্চারী | কী সর্বনাশ, গোপীরাম হাজতে মানে তো রাজমহিষীর কেস কেলো। |
রজত | এটা কিন্তু পুরো আউট অফ সিলেবাস হয়ে যাচ্ছে। রাজমহিষী কে? একটু প্লীজ খুলে বলবে তোমরা কী হয়েছে? |
সঞ্চারী | রাজমহিষী বাবার potential prizewinner buffalo. গোপীরাম তার valet. সে না থাকলে রাজমহিষী কে সামলানো মুশকিল। আর রাজমহিষী প্রাইজ না পেলে বাবার যা মেজাজ হবে, তাতে চকোরী আর বংশীর কেস খুব খারাপ হয়ে যাবে। এবার বুঝলে? |
রজত | বুঝলাম। (রজত বসে পড়লো) |
সঞ্চারী | বসে পড়লে যে? কিছু একটা করো? |
রজত | ভাই বংশী। আমি যখন এলাম শ্বশুরমশাই তোমাকে তখন কী বলছিলেন মনে আছে? |
বংশী | হ্যাঁ… ঐ তো, সুযোগ আসে, খপ করে ধরতে হয়.. এই সব। |
রজত | Exactly. এই তো সুযোগ, খপ করে ধরো। |
বংশী | ঠিক বুঝলাম না তো। |
রজত | দৌড়ে যাও, গোপীরামকে ছাড়ানোর ব্যাবস্থা করো আর ছাড়াতে না পারলে ওর সঙ্গে দেখা করে জেনে নাও কী করে ঐ মোষ-কে ম্যানেজ করতে হবে। এই তো সুযোগ ওনাকে সন্তুষ্ট করার। |
বংশী | শেষে মোষের খিদমত করতে হবে? পারবো? |
রজত | কেন পারবে না? This is no rocket science. |
বংশী | আপনি বোধহয় ঠিক ই বলছেন। কাকাবাবু কে ইম্প্রেস করার এতবড় সুযোগ ছাড়া উচিত নয়। |
বংশীর প্রস্থান | |
প্রথম দৃশ্য শেষ |
|
দ্বিতীয় দৃশ্য |
|
মহিম মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে। শরীর খারাপ। উঃ আঃ করছেন। চকোরী ছাড়া সবাই চারিদিকে আছে। হেমাঙ্গিনী হাওয়া করছেন। | |
হেমাঙ্গিনী | কী গো? একটু ভালো লাগছে? |
মহিম (আর্তনাদ করে) | না লাগছেনা। তিনদিন হয়ে গেলো, রাজমহিষী কিছু খাচ্ছেনা, রোগা হয়ে গেছে, তিরিশ লিটার কমে বারোয় এসে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থায় ভালো লাগতে পারে? |
সঞ্চারী | বাবা একটু শান্ত হও । উকিলতো চেষ্টা করছে গোপীকে জামিনে ছাড়ানোর |
মহিম | পারবে না রে। ও আমি বুঝে গেছি। জামিন ও পাবে না। মামলার হাকিম কে জানিস? |
সঞ্চারী (অবাক) | কে? |
মহিম | গনেশ পালের বেয়াই। রাজমহিষীর সঙ্গে গনেশের ভাগলপুরি সরাসরি পেরে উঠবে না বলে এই ভাবে শত্রুতা করছে। |
সঞ্চারী | না বাবা, এতটা কি হতে পারে? |
মহিম | খুব পারে। তোরা বিলেতে থাকিস তো, তাই জানিসনা এখানকার পলিটিক্স কীরকম হতে পারে। ঐ গনেশের লোকই নির্ঘাৎ গায়ে পড়ে মারামারি বাধিয়েছিল। পুরোটাই ষড়যন্ত্র। |
সঞ্চারী | বাবা তুমি একটু শান্ত হও । এর পর তোমার শরীর খারাপ হবে। |
মহিম | রাজমহিষীর কী হবে সেটা ভাব। আমার কথা ভেবে কী হবে? |
হেমাঙ্গিনী | ঠিক ই তো, তুমি তো আর গবাদি পশু প্রতিযোগিতায় যাবে না.। |
মহিম (খেঁকিয়ে) | কী?? |
সঞ্চারী | Peace peace. তোমরা একটু আমার কথা শোন মন দিয়ে। আমাদের আসল অবজেকটিভ হলো রাজমহিষী যাতে খাওয়া দাওয়া করে তার ব্যবস্থা করা। |
মহিম (অধৈর্য্য) | গোপীরাম না থাকলে সেটা হবে কীভাবে শুনি? |
সঞ্চারী | আহা শোননা, বলছি তো। বংশীকে গোপীরামের কাছে যেতে বলেছিল রজত, রাজমহিষীকে কীভাবে ও খাওয়ায় সেটা জানতে। বাকিটা বংশীর কাছে শোন, very interesting. |
বংশী | আমি জেলে গিয়ে গোপীরামের সঙ্গে দেখা করেছিলাম, ও যা বললো – তাতে মনে হয় একটা উপায় পাওয়া যাবে। |
মহিম | আরে, ভনিতা ছাড়ো। আসল কথাটা কী? কী করতে হবে সেটা বলো |
বংশী | একটা গান গাইতে হবে |
মহিম | মানে? তুমি কি আমার সঙ্গে ইয়ার্কি মারছ নাকি? |
বংশী | আজ্ঞে না না। গোপীরাম রাজমহিষীকে খাওয়ানোর সময় একটা গান করতো। সেই গান না শুনলে নাকি রাজমহিষীর খিদে পায় না। |
মহিম | কী বলছ কী? এরকম আবার হয় নাকি? |
সঞ্চারী | বাবা, একে বলে কন্ডিশন্ড রিফ্লেক্স। এরকম হয়। বিজ্ঞানীরা প্রমান করে দেখিয়েছেন। |
মহিম | বলিস কী? তা সে গান কে গাইবে? কীরকম গান? |
বংশী | ওটা কাকাবাবু আপনাকেই গাইতে হবে। আর কে যাবে রাজমহিষীর ধারেকাছে? |
সঞ্চারী | গানটা কী? ছঁইয়া ছঁইয়া টাইপ হলে বাবা পারবে না কিন্তু । |
বংশী | না ওরকম নয়। একটা বাংলা – হিন্দি mixed দেহাতী সুরের গান। গোপীরামকে দিয়ে গাইয়ে রেকর্ড করে এনেছি। |
হেমাঙ্গিনী | গান গেয়ে মোষকে খাবার খাওয়ানো হবে? হায় ভগবান। |
মহিম | রাজমহিষীর অনশন ভাঙার জন্য শুধু গান কেন, দরকার হলে আমি গান গেয়ে নেচেও বেড়াতে পারি। |
সঞ্চারী | বাঃ that is the spirit বাবা. বংশী আমরা তাহলে এখান থেকে সরে যাচ্ছি। তুমি বাবাকে গানটা শেখাতে শুরু করো। |
বংশী | বেশ |
(সকলের প্রস্থান) | |
বংশী | কাকাবাবু – শুরু করার আগে একটা কথা। এতে যদি কাজ হয়, আমার পুরষ্কার কী হবে? |
মহিম | আবার সেই কথা – চকোরীর সঙ্গে বিয়ে তো? দেবো, তাই দেবো। আগে কাজটা হোক। |
বংশী | আজ্ঞে না। বিয়ে নয়। অন্য পুরষ্কার চাই। |
মহিম | অন্য পুরষ্কার!! সেটা কী? |
বংশী | আপনার ক্যামাক স্ট্রীটের সাততলা, শিয়ালদার চারতলা আর বালিগঞ্জের পাঁচতলা – এই তিনটে বাড়ী আমাকে দিতে হবে। |
মহিম ( স্তম্ভিত) | এঁ – কী বলছ হে ছোকরা? তোমার সাহস তো কম নয়। ঐগুলো থেকে আমার বছরে কত আয় হয় তোমার কোন ধারনা আছে? |
বংশী | আজ্ঞে, আছে বলেই তো চাইছি। রাজী থাকলে কাগজে সই করুন আর গান শিখতে শুরু করুন। |
মহিম | বিয়েটা বদলে বাড়ী করে ফেললে কেন বাবা? আর তাও একেবারে তিনটে বাড়ি!! (গলা নামিয়ে) কিছু কম করা যায় না ওটা? |
বংশী | আজ্ঞে ওর কমে পারবো না । |
মদন | আর বিয়েটা তাহলে চাই না? |
বংশী | সেটা চুক্তির মধ্যে ঢোকানোটা কি ভালো দেখায়। সব মিটে গেলে আমার আর্থিক অবস্থা দেখে বিচার করে যদি ভালো মনে হয় দেবেন। |
মদন | তুমি যে এতবড় ধুরন্ধর তা ভাবতেও পারিনি। |
বংশী | আজ্ঞে, আপনি ই তো বলেছেন, সুযোগ এলে খপ করে ধরতে। |
মদন | (কাগজ টেনে নিয়ে সই করতে করতে) হুম – শোনো বংশী সই করছি – কথাও আমি রাখবো। কিন্তু গান শুনে যদি কাজ না হয়, তাহলে কিন্তু তোমার এ বাড়িতে ঢোকা একদম বন্ধ। |
বংশী | বেশ তাই হবে। এবার গানটা শুরু করা যাক । গানটা এইরকম
– “ সোনামুখি রাজভঁইসি পাগল করেছে, যাদু করেছে হামায় টোনা করেছে। ঝমে ঝমে ঝঁয় ঝঁয় ঝমে ঝমে ঝঁয়” |
মহিম (স্তম্ভিত) | এর মানে কী? |
বংশী | গোপীরামের গাঁয়ে এক পাগল কোন এক বাঙালি মহিলাকে দেখলে এই গানটা গাইতো। বাঙালিনী শব্দটা পাল্টে রাজভঁইসি করে গোপীরাম গানটা গায়। ওর নাকি খুব পছন্দের গান। |
মহিম | আমার কপাল। চলো গাই, আর কী করবো। |
সঙ্গীত শিক্ষা শুরু হয়। ভেতর থেকে মহিলাদের হাসি ভেসে আসে। মহিম একটু কিন্তু কিন্তু করে | |
মহিম | শোনো বংশী, এখানে বড় বেশী লোকজন আর ডিসটার্বেন্স। চলো খামার বাড়িতে চলে যাই, সেখানে নিরিবিলিতে সুবিধে হবে। |
বংশী | বেশ তো চলুন |
দুজনে বেরিয়ে যায়। | |
দ্বিতীয় দৃশ্য শেষ | |
তৃতীয় দৃশ্য | |
চকোরী আর হেমাঙ্গিনী বসে আছে। চকোরী বই পড়ছে, হেমাঙ্গিনী সেলাই করছে। | |
হেমাঙ্গিনী | ওদিকের খবর কী? |
চকোরী | লাস্ট রিপোর্ট – তিন জায়গায় বাবার সুর ভুল হচ্ছে। রজতদা বললো রাজমহিষী রিজেক্ট করতে পারে। |
হেমাঙ্গিনী | মোষকে গান গেয়ে খাবার খাওয়ানো – বাপের জম্মে শুনিনি এ সব। |
চকোরী | সব কাজই তো কেউ না কেউ প্রথম করে – এটাও তাই ধরে নাও। |
(সঞ্চারীর উত্তেজিত ভাবে প্রবেশ) | |
সঞ্চারী | গান তোলা হয়ে গেছে। বংশী বললো বাবার দ্বারা ওর থেকে বেটার কিছু হবেনা। তেমন হলে, রেকর্ড করে আনা গোপীরামের গান চালিয়ে দেবে, বাবা লিপ দেবে। |
চকোরী | আরে দারুন আইডিয়া তো। ওরা কোথায় এখন? |
সঞ্চারী | গোয়ালে গেছে। রাজমহিষীর সামনে খাবার প্লেস করে বাবা গান গাইবে। বংশী প্লে-ব্যাক নিয়ে রেডি থাকবে আর রজত observer |
চকোরী (উত্তেজিত) | তাহলে চল আমরাও যাই। |
সঞ্চারী | না না – বেশী লোক গেলে রাজমহিষী যদি বেয়াড়াপনা করে? তোর রজতদা বললো – লাইভ রিপোর্ট করবে, ফোনে। দাঁড়া ফোনটা লাগাই। (ফোন করে) হ্যাঁ বলো – কী হচ্ছে ওখানে? |
হেমাঙ্গিনী | স্পীকার এ দে না, আমরাও শুনি। |
চকোরী (উত্তেজিত) | হ্যাঁ হ্যাঁ স্পীকার স্পীকার |
স্পীকারে রজতের গলা ভেসে আসে | |
রজত | মহিমবাবুর গোয়াল ঘর থেকে রজত বসু বলছি। খেলোয়াড়েরা মাঠে নেমে পড়েছেন, মহিম বাবুর পরনে গোপীরামের পুরোন ফতুয়া। আমাদের টেকনিকাল বিশেষজ্ঞ বংশীধর বাবুর মতে এটাও কন্ডিশন্ড রিফ্লেক্সের একটা অঙ্গ। তাছাড়া খাবার আনার একটু আগে গোয়ালঘরে একটু গাঁজার ধোঁয়া দিয়ে ঘুরিয়ে আনা হয়েছে। এই গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন বন্দী গোপীরামের ছোট ভাই রামবিলাস । মোদ্দা কথা হলো পরিবেশের মধ্যে যতটা সম্ভব গোপীরামের প্রেসেন্সকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি গামলা ভর্তি খাবারের সামনে রাজমহিষী গোঁয়ারের মতো ঘাড় উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আর মহিম বাবু এক হাতে কান চেপে ধরে গান শুরু করছেন। ঐ তিনি হাতে তালি মেরে সম খুজছেন। এইবার ধরলেন গান – আপনারা শুনতে পাচ্ছেন হয়তো। |
গান ভেসে আসে… | |
দেখে মনে হচ্ছে, রাজমহিষী ভীষন অবাক হয়েছে। মহিম বাবুর দিকে খানিক্ষন তাকিয়ে সে কিন্তু এবার মুখ নামাচ্ছে গামলার দিকে – wow – মুখ নামছে নামছে – কিন্তু না -আ -আ- একটু শুঁকে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু বংশী হাল ছাড়েনি. সে গান চালিয়ে যাবার জন্য ইশারা করছে। গান চলেছে চলেছে ঘুরে ঘুরে.. রাজমহিষী আবার একটু নড়েছে, একি একি দেখছি, সোজা সে মুখ নামিয়ে দিয়েছে গামলার ভেতর – খাচ্ছে খাচ্ছে – তালিয়াঁ তালিয়াঁ | |
সবাই হাততালিতে ফেটে পড়ে | |
তৃতীয় দৃশ্য শেষ | |
চতুর্থ ও সমাপ্তি দৃশ্য | |
সদলবলে মহিমের প্রবেশ – সঙ্গে ঢাক ঢোল। প্রবীন সমাজপতি গনপতি বাবু মহিমের হাতে পুরষ্কার তুলে দিলেন – রাজমহিষীর ফার্স্ট প্রাইজ।
মহিম বংশীকে ডেকে তার হাতে প্রতিশ্রুত সম্পত্তির দলিল তুলে দেয়। |
|
মহিম | বংশী – এই নাও – ক্যামাক স্ট্রীট, শিয়ালদা , বালিগঞ্জ । |
বংশী | আর একটা কথা কাকাবাবু। আপনার তো অনেক জানাশোনা, একটা দামী চাকরিও যদি ঐ সঙ্গে করে দেন। |
মহিম | আমার বুকে বাঁশ ডলে যা পেরেছ তো বাগিয়ে নিয়েছ। আবার চাকরির শখ হলো কেন? |
বংশী | আজ্ঞে না হলে লোকে যে বলবে – ব্যাটা শ্বশুরের বিষয় পেয়ে নবাবি করছে। আপনার মেয়ের কি শুনতে ভালো লাগবে? |
মহিম (আস্কারা মেশানো তিরস্কারের স্বরে) | এ ছোঁড়ার কি শয়তানির কোন শেষ নেই গো? |
রজত | না বাবা ওকথা বলবেন না। কাজটা তো করে দেখিয়েছে। proof is in the pudding. |
সঞ্চারী | আরে ওসব ছাড়ো এখন। আজ রাজমহিষী কে চিয়ার করার দিন। Three cheers for Rajmahishii, – |
সবাই থ্রি চিয়ার্স দেয়। আবহ্সঙ্গীত এ গান চলতে থাকে (with music) – “সোনামুখী রাজভঁইষী পাগল করেছে..।” |
শেষ
একটি শ্রুতিনাটক ভালোবাসার মুখোমুখি (এই নাটকের তিনটি চরিত্র –প্রতিষ্ঠিত লেখক বাবা নশ্বর সরকার, মা…..
(খালি মঞ্চে সেন্টার স্টেজে একটি বেঞ্চ পাতা।বাঁদিক থেকে ১ম অভিনেতা তুড়ি বাজিয়ে গান গাইতে গাইতে…..
ভূমিকা: নবকুমার বসুর এই গল্পটি অবলম্বনে শ্রুতিনাটক করার দায়িত্ব পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলাম। শ্রদ্ধেয় অগ্রজপ্রতিম…..