প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
ব্যাঙ্ক থেকে ফোন করছি। কথাটা শোনা মাত্র পরাণবাবু তটস্থ। গল গল করে সবকিছু বলে দিলেন প্রশ্নকর্তাকে। মায় পাশওয়ার্ডটাও। বলেই মনে হল, ভুল করেছেন। ছেলে পইপই করে বারণ করেছিল। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙ্কে ছুটলেন। গিয়ে জানতে পারলেন, সেভিংস ব্যাঙ্কে যে ক’টা টাকা ছিল, তা ডানা মেলে উড়ে গেছে।
অথচ এই রকম পেট আলগা ছিলেন না পরাণবাবু। চিরকাল সরকারি উঁচু পদে চাকরি করে দুঁদে অফিসার বলেই পরিচিত ছিলেন। অধস্তনদের ধমক দিলে তারা যখন ঠকঠক করে কাঁপত, রীতিমতো এনজয় করতেন তিনি।
শোকজ নোটিশ লিখতে জুড়ি ছিল না পরাণবাবুর। কি করে ঘোরপ্যাঁচের ইংরেজি লিখতে হয়, তাতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ট্রান্সফারের অর্ডার বেরোলে পুঁচকে অফিসাররা কি রকম হৃৎকম্পে ভোগে দেখে একরকম তৃপ্তি পেতেন তিনি।
অবশ্য দুষ্টু লোকেরা অন্য একটা কথাও বলে। তারা বলে, একটু ওপর মহলের ফোন এলে চেয়ার ছেড়ে সটান খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে তবেই কথা বলতেন তিনি। বুঝতে পারতেন না, রিসিভার ধরে যিনি কথা বলছেন, তিনি তাঁকে চোখে দেখতে পাচ্ছেন না। এইসব কথা রসিয়ে রসিয়ে আমাদের কাছে বলত তাঁর খাস গ্রুপ ডি। সেও রিটায়ার করেছিল। আর কখনো সখনো পরাণবাবুর সঙ্গে দেখা করতে আসত। কিন্তু রিটায়ারমেন্টের পর লোকটা যেন কেমন হয়ে গেল। ভুলেও একবার ‘স্যর’ বলে না। সাধারণ ভদ্রলোকের মত আলাপ সালাপ করে। পরাণবাবুর অস্বস্তি বোধ হয়। কিন্তু কিছু বলতে পারেন না। কেননা, চাকরি জীবনের সব সময়ের সঙ্গী এই একটা লোকই ফোন করে খোঁজ খবর নেয়। আর মাসে দুমাসে হলেও একবার এসে দেখে যায়।রিটায়ারমেন্টের পর পরাণবাবুর সর্বদা পেট গুরগুর করে। ভাল হজম হয় না। তিনি এখন শয়নে স্বপনে চিন্তা করেন ওই বুঝি চিন বা পাকিস্তান রসগোল্লার মতো টপ করে ভারতকে গিলে খেয়ে নেবে। চিনের উপর মহা খাপ্পা পরাণবাবু। তিনি চান, সীমান্তে কড়া নজরদারি থাকুক। রিম্পা, তাঁর পুত্রবধূ বলেছিল, বাপি, সেখানে বড্ডো ঠাণ্ডা। দাঁত ঠকঠক করে, চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে বরফ হয়ে যায়। একটানা তিনমাসের বেশি থাকলে লোকে পাগল হয়ে যায়। কী হবে ওইসব জমি নিয়ে কূটকচাল করে! পরাণবাবু পুত্রবধূকে পড়াশুনার খোঁটা দিলেন। পড়েছ তো জিওগ্রাফি অনার্স। দেশের সংস্কৃতি বলতে তো কিছুই চেনো না। বৌমা মুখে মুখে বলতে পারেনি, আমি শিক্ষকতা করে যে টাকাটা পাই, তাই থেকে মাস গেলে নতুন ফ্ল্যাটের ইএমআই কাটে।
রগড় জমেছিল নাতির জন্মদিনে। তিন বছরের বাচ্চা জন্মদিনে অনেক খেলনা উপহার পেয়েছিল। তার বেশ কয়েকটি চিনে কোম্পানির মার্কা। লেন্স বাগিয়ে তন্নতন্ন করে দেখে পরাণবাবু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সেগুলো কিছুতেই দেশপ্রেমিক মানুষের বাড়িতে থাকতে পারে না। অতএব নাতির কাছ থেকে চৈনিক খেলনাগুলো কেড়ে নিলেন তিনি। সেও এমন বিচ্ছু যে ঠিক ওই খেলনাগুলোর জন্যই চিলচিৎকার করে। পরাণগিন্নি এসে ঝঙ্কার দিয়ে বললেন, দুনিয়ায় যেখানে যা পারো করো, ওইটুকু দুধের শিশুর খেলনা কেড়ে নিয়ে তোমার কিসের ফূর্তি বুঝিনা বাপু!
অমনি পরাণবাবু সোফা ছেড়ে উঠে সটান দাঁড়িয়ে কল্পনানেত্রে জাতীয় পতাকাকে সেলাম করে গেয়ে ফেললেন সারে জাঁহা সে আচ্ছা, হিন্দোস্তাঁ হামারা .. হিন্দী হৈ হম্…বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী।
নিজের ঘর থেকে গলা তুলে রিম্পা বলল, বাপি, উর্দূভাষার ও গানটা মহম্মদ ইকবালের লেখা। উনি পাকিস্তানের জাতীয় কবি।
অমনি পরাণবাবুর আঁতে লেগে গেল। বলে ফেললেন, যেমন মা তেমন ছাঁ তো হবেই।
আর কোনো কথাটি না বলে চোখের জল মুছে ওলা গাড়ি ডেকে ছেলে কোলে নিয়ে রিম্পা পিতৃগৃহে চলে গেল। পরাণগিন্নি স্বামীকে বললেন, তোমার শান্তি হল তো?
অপরাধবোধে ভুগছিলেন পরাণবাবু। ভয় হচ্ছিল ছেলে অফিস থেকে ফিরে বাচ্চাকে না দেখতে পেয়ে রাগারাগি করবে কি না। এমন সময় ব্যাঙ্কের ফোন। গম্ভীর গলার লোকটা যেই না বলেছে, আপনার অ্যাকাউন্ট আমরা সাসপেন্ড করে দেব। তারপর পাঁচ হাজার টাকা ফাইন হবে। তখন, কেন, কী এমন অপরাধ করেছেন যে, এতখানি শাস্তি হবে, তাও আত্মপক্ষ সমর্থন করার কোনো সুযোগ পর্যন্ত না দিয়ে, তা পরাণবাবুর মাথায় এল না। অমনি তিনি সোফা ছেড়ে খাড়া হয়ে উঠে গলগল করে সব বলে দিলেন। গিন্নি ছুটে এসে বললেন, কাকে কি বলছিলে গো?
পরাণবাবু আগে হলে বলতেন, তুমি মেয়েমানুষ, ওসব বুঝবে না। এখন বৌমা সেইসব নিয়ে টিকটিক করে বলে মেয়েমানুষ শব্দটা উচ্চারণ করা বাদই দিয়েছেন তিনি। বললেন, ব্যাঙ্কের থেকে ফোন করেছিল। পরাণগিন্নি চোখ পাকিয়ে বললেন, অমনি তুমি গলগল করে সব বলে দিলে? জানো না, ব্যাঙ্ক কোনোদিন কাস্টমারকে এসব বলে না।
দাঁড়াও, খোকা ফিরুক। ওকে সব বলে দেব।
পরাণবাবুর মনে পড়ে, মাসখানেক আগেই পইপই করে খোকা বলেছিল, ব্যাঙ্ক থেকে ফোন করছি বললেই ফোন কেটে দেবে। পরাণবাবু বলেছিলেন, তাই কি হয় রে! একটা সত্যিকারের অফিসার তো হতেও পারে!
ছেলে বলেছিল, হ্যাঁ, ব্যাঙ্কের অফিসারের খেয়ে দেয়ে আর কাজ নেই, একটা পেনশনারকে ফোন করবে!
পরাণবাবুর অভিমান হয়েছিল। জাঁদরেল অফিসার ছিলেন তিনি। সার্ভিস রুল, অফিসিয়াল কনডাক্ট রুল সব মুখস্থ। তাঁকে কি না নিজের ছেলে হয়ে খোকা স্রেফ পেনশনার বলে দিল! তারপর ভাবলেন, পেনশনই তো পান। আর অন্য পরিচয় তো রিটায়ারমেন্টের পর ঘুচে গেছে। পরবর্তী অফিসাররা কোনো কিছু জানতে পর্যন্ত চায় না। এখন তাদের ল্যাপটপে পেনড্রাইভে আঙুলের টোকায় সব আইন আর রুলস রেগুলেশন সার্কুলার জিও থাকে। তাই অফিসে তাঁর আর ডাক পড়ে না। অফিস চলে নিজের নিয়মে।
ইমপারসোন্যাল। নৈর্ব্যক্তিক, এই বাংলা শব্দটা মনে পড়তে নিজেকে বাহবা দিলেন পরাণবাবু। সরকারি কাজে বাংলা ভাষার প্রসার হওয়া দরকার। এই নিয়ে মধ্য যৌবনে বেশ উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। জুনিয়র স্টাফদের ডেকে বলতেন বাংলা ভাষায় লেখো। যে লোক মাতৃভাষা জানেনা, সে নিজের মাকেই চেনে না। কিন্তু সমস্যা হল, নতুন স্টাফেরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরোনো ফাইল নোট দেখে দেখে লেখে। বছরের পর বছর যে সব শব্দ যেভাবে ব্যবহার হয়ে চলেছে, কমা ফুলস্টপ শুদ্ধ, তা হুবহু নকল করে এগোয় ওরা। নতুন করে কিছু ভাবতে পারার ক্ষমতাটাই নেই। অতএব তাদেরকে কি করে বাংলাভাষায় ফাইল নোট দিতে হয়, শেখানো শুরু করলেন পরাণবাবু। এলডিসি মানে অবরবর্গীয় করণিক। ইঞ্জিনিয়ার হলেন বাস্তুকার, টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট হলেন প্রকৌশল সহায়ক। শব্দের খেলায় পেয়ে বসেছে পরাণবাবুকে। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে বলতে হবে জেলাধীশ, আর তিনি যখন ডিস্ট্রিক্ট কালেকটর তখন তিনি জেলা সমাহর্তা। কিন্তু পরাণবাবু নিজে বাংলায় লিখতে সাহস করেন না। কেননা তাঁর নোট দেখেন এডিএম। তিনি দক্ষিণ ভারতীয় আইএএস। ভালই বাংলা শিখে নিয়েছেন। বাংলা পড়তেও পারেন বেশ। আইএএস বলে কথা। ওদের বুদ্ধিশুদ্ধিই খুব উঁচু মানের। কিন্তু কোনো কারণে যদি তিনি নির্দিষ্ট বাংলা শব্দটি বুঝতে না পারেন, তাহলে সমস্যা দেখা দিতে পারে। সেই ভয়ে অধস্তন সবাইকে ফাইলে নোট দিতে বললেও পরাণবাবু নিজের নোট সাবেকি ইংরেজি ভাষাতেই লেখেন। তিনি নিজে এটাকে বলেন মজঝিম পন্থা। একজন স্টাফ জিজ্ঞাসা করেছিল, মজঝিম পন্থা না বলে মধ্যপন্থা বলতে অসুবিধা কোথায়? পরাণ বলেছিলেন বুদ্ধদেব পালিভাষায় কথা বলতেন। সংস্কৃত ভাষায় বলতেন না। তাই এই শব্দটি এভাবেই বলা ভাল।
বঙ্গভাষার একনিষ্ঠ সেবক পরাণবাবুকে বিপদে ফেলে দিলেন তাঁর অফিসের বড়বাবু। লোকটি কাজে দক্ষ। সার্ভিস কন্ডাক্ট রুল, ডিডিওস ম্যানুয়াল, অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্ট, সব মুখস্থ। কিন্তু নোটশীটে বাংলা ভাষায় তিনি কিছুতেই লিখবেন না। বড়বাবু পোশাকে আশাকে পুরোপুরি বাঙালি। ধুতি পাঞ্জাবি পরেই এখনো অফিস করেন। কিন্তু নোটশীটে ইংরেজি লেখার অভ্যাস। পরাণ ঠিক করলেন বড়বাবুকে নোটশীটে বাংলা ভাষায় লিখতে বাধ্য করবেন। বড়বাবুর জরুরি ফাইল পরপর তিনদিন তিনি ফেরত পাঠালেন। আর্দালিকে দিয়ে বলে পাঠালেন বাংলা ভাষায় না লিখলে অফিসার ফাইল ছুঁয়েই দেখবেন না।
বড়বাবু সোজাসুজি লোক। এডিএম সাহেবের চেম্বারে ঢুকে টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। জিজ্ঞাসু চোখে এডিএম তাকালে তিনি বললেন, বাংলা ভাষায় ফাইলে নোট দিতে না শেখার জন্য তাঁর ফাইল ফেরত আসছে। তাই বাংলা ভাষাটা তিনি মাস্টার রেখে শিখবেন। তারজন্য তিন মাসের ছুটি চাই। এডিএম কানাঘুষায় শুনে ছিলেন পরাণ নিজে ইংরেজি ভাষায় লিখলেও অধস্তনদের বাংলাভাষায় লেখার জন্য চাপ দেন। এটা নিয়ে একটু রগড় করতে ইচ্ছে করল এডিএম এর। বড়বাবু ছুটির দরখাস্ত লিখে হাতে করে নিয়েই গিয়েছিলেন। ছুটির দরখাস্তের উপরেই এডিএম লিখে দিলেন, প্লিজ অ্যালাও হিম লিভ ফর থ্রী মান্থস টু লার্ণ হিজ মাদার টাং অ্যাণ্ড অ্যারেঞ্জ ফর হিজ সাবস্টিটিউট। তারপর বড়বাবু সেই কাগজ নিয়ে পরাণের চেম্বারে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। পরাণ বসতে বললেও বসলেন না। বললেন, সাহেবদের সামনে বসার যোগ্যতা আমার নেই।
বড়বাবু ছুটির দরখাস্ত নিয়ে সরাসরি উপরওয়ালার কাছে চলে গিয়ে ছুটি মঞ্জুর করে এসেছেন দেখে পরাণ নার্ভাস বোধ করতে লাগলেন।
পরাণ বড়বাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন এটা কি রকম হল? আপনি যে আমাকে ডিঙিয়ে সোজা এডিএম এর কাছে চলে গেলেন?
বড়বাবু বললেন, আমি অপরাধ করে থাকলে আপনি আমাকে শাস্তি দেবার উদ্যোগ নিন।
পরাণ পড়লেন ফাঁপরে। যেখানে এডিএম ছুটি মঞ্জুর করে বিকল্প লোকের ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দিয়েছেন, সেখানে ছুটি হবে না, তিনি বলতেও পারেন না। অথচ বড়বাবুর মতো কাজ জানা লোক কই? সব দায় তো বড়বাবুই সামলে দেন। কোনো ভুল চিঠি ইস্যু হয়ে গেলে প্রাপকের বাড়ি থেকে সে চিঠি বিনা বাক্যব্যয়ে তুলে আনার এলেম আছে ওঁর। ব্যাক ডেটে মেমো নম্বর চাইলে দু মিনিটে ম্যানেজ করতে জানেন। পছন্দসই রেটে তিন তিনটি কোটেশন যোগাড় করে ফেলেন এক চুটকিতে। এহেন কাজের লোককে তিনমাস তো দূরের কথা, তিনদিন ছাড়লে অফিস অচল হয়ে যায়। এমন অবস্থায় পরাণ বললেন, আপনাকে ছুটি দিলে অফিস চলবে কি করে?
বড়বাবু বললেন, স্যর, আমি লেখাপড়া বেশিদূর করি নি। সবে মাধ্যমিক পাশ করেছি। বাবা বললেন, আর পড়তে হবে না। হাতের নড়া ধরে টেনে এনে সোজা ব্যানার্জি সাহেবের টেবিলের নিচে ঢুকিয়ে দিলেন। আমাকে বলে রেখেছিলেন, পা চেপে ধরবি। ওই দিনেই আর্দালির চাকরি। ক’বছর পরে আবার প্রাইভেটে মাধ্যমিক পাশ করে ক্লার্ক হলাম। কোনোদিন বড়সাহেবদের অসম্মান করি নি। আপনাদের পায়ের নিচে আশ্রিত আমরা। আপনারা যদি দূরছাই করেন, তো আমরা যাই কোথায়? ছুটি দিন, পড়াশুনা করে নিজেকে কাজের যোগ্য করে তুলি।
পরাণবাবুর একবার ছোটখাটো একটা অপারেশন হয়েছিল। তখন সাতদিনের ছুটি নিতে হয়েছিল। তখন অফিস থেকে আর্দালিকে দিয়ে ফাইল পাঠিয়ে দেওয়া হত। তিনি লিখে দিতেন। পরাণ বড়বাবুকে বললেন, তাহলে বাড়িতে ফাইল পাঠাতে হয়। বড়বাবু বললেন আমি যাব শ্বশুরবাড়ি। নবদ্বীপে। সেখানে শ্যালকের বড়ছেলে আর বৌমা দুজনেই কলেজে বাংলার মাস্টারি করে। তাদের কাছে বাংলা শিখে আসব এখন।
পরাণ বুঝে গেলেন, রোজ রোজ একশো কিলোমিটার দূরে ফাইল পাঠানোর বাস্তবতা নেই। হয় তো বড়বাবুর কাজ চাপবে তাঁরই ঘাড়ে। কেননা, অফিসের কাজ বসে থাকবে না। পরাণবাবু হেডক্লার্কের হাতদুটো ধরে বললেন, যা হয়ে গেছে গেছে। আপনি যে ভাষা জানেন, তাতেই ফাইল নোট দেবেন। আমি আর ফেরত পাঠাব না। পাকাগোঁফের নিচে হাসি লুকিয়ে বড়বাবু গিয়ে বসলেন নিজের চেয়ারে।
নতুন একটি মেয়ে বাংলা টাইপিস্ট হিসেবে কাজে যোগদান করতে এল সালোয়ার কামিজ পরে। তাকে জয়েন করিয়ে নিজের সামনে বসিয়ে তিনি বললেন, দ্যাখো মা, আমাদের বাংলা সংস্কৃতি বিপন্ন। এখন তোমরা মায়ের জাত। বাংলাভাষা ও সংস্কৃতিকে তোমরা রক্ষণাবেক্ষণ করবে না তো কে করবে বলো?
সদ্য কাজে যোগদান করা মেয়েটি ঘামতে শুরু করেছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে ভয়ে। রুমাল দিয়ে কপাল মুছে সে বলল, আপনি আমার বাবার মতো। কি করতে হবে বলুন, তাই করব। পরাণবাবু জয়ের গর্বে বুক ফুলিয়ে বললেন শাড়িই ভারতীয় মাতৃজাতির সনাতনী পোশাক। কাল থেকে শাড়ি পরে আসবে। ভয়ে ভয়ে মেয়েটি বলল, তাই আসব।
পরে একদিন মেয়েটিকে ব্লাউজের গড়ন কেমন হবে বলে দিলেন। বক্ষ বিভাজিকা যেন দেখা না যায়। লো কাট ব্লাউজ চলবে না। পুরোহাতা হলে ভাল। নয়তো থ্রি কোয়ার্টার হলে চলবে। তাঁর কথা শুনে তক্ষুণি মেয়েটি শাড়ির আঁচলটা ভাল করে গায়ে জড়িয়ে নিল।
বাড়িতে গিয়ে গর্বভরে গিন্নিকে ওই কথা বলতেই তিনি খেপে গেলেন। বুড়ো বয়সে তোমার কি ভীমরতি ধরেছে? কে কি পোশাক কিভাবে পরবে না পরবে, সেটা তার মাথাব্যথা। তোমার বলার কি দরকার?
জাঁদরেল অফিসারের গলায় পরাণ তাঁর গিন্নিকে বললেন, তুমি মেয়েমানুষ এসব বোঝো না।
গিন্নি ছাড়বেন কেন? তিনি বললেন, মেয়েদের ভারতীয় পোশাক বলে সত্যি সত্যি কোনো পোশাক নেই। রাজস্থানে গুজরাটে কাশ্মীরে কেরলে অরুণাচলে মেয়েদের পোশাকে অজস্র রকম পার্থক্য। আন্দামানে জারোয়া মেয়েরা পোশাকই পরে না। শুধু নিম্নাঙ্গে সম্মুখভাগে একটু আড়াল। পশ্চাদ্দেশ অনাবৃত। বহু আদিবাসী গোষ্ঠীর মেয়েরা ঘরে থাকার সময়ে বক্ষ উন্মুক্ত রাখে। তাতে তাদের শালীনতাবোধ বিপন্ন হয় না। আগে বাঙালির মেয়ে বউ সায়া পর্যন্ত পরত না। সায়া কথাটাই বিদেশী। একটা বিয়েবাড়ি গেলেও দামি বেনারসি শাড়িটুকু সায়া ব্লাউজহীন গায়ে তারা এমনভাবে নিত, তাতে সংস্কৃতি বিপন্ন হত না। খামখা নিজের বিপদ টেনে এনো না বলে দিচ্ছি। গিন্নির কথা শুনে পরাণবাবুর চক্ষু চড়কগাছ। পরদিন অফিসে জয়েন করলেন নতুন এক অতিরিক্ত জেলা শাসক। মহিলা। ত্রিশের নিচে বয়স। হরিয়ানার মহিলা। নামের আগে ডঃ লেখেন। টাইট একটা সালোয়ার কামিজ পরেছেন। তায় আবার খাটো ঝুল। পুষ্ট উরুদুটি, ভারি সুগোল নিতম্ব, উন্নত বক্ষদেশ প্রকটিত। তবু তাঁর পোশাক নিয়ে কিছু বলার সাহসই হল না পরাণের। আইএএস বলে কথা!
পরদিনই টাইপিস্ট মেয়েটি আবার সালোয়ার কামিজ পরে এল। গটগট করে অতিরিক্ত জেলা শাসকের ঘরে ঢুকে জানতে চাইল, ম্যাম, ইজ মাই ক্লোদজ আর আনসুটেবল্ ফর দিস অফিস? হরিয়ানভি মহিলা হেসে বললেন, সার্টেনলি নট। হু টোল্ড ইউ সো?
টাইপিস্ট মেয়েটি পরাণবাবুর নাম করে নি।
পাশের বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে একটা নতুন বৌ এসেছে। ঘরে সে ম্যাকসি পরে থাকে। ওই ম্যাকসি পরেই নিশ্চিন্তে ছাতে কাপড় শুকোতে দিতে যায়। পরাণ গিন্নিকে বললেন সে কথা। গিন্নি বললেন, ওই বউটা তোমার ছেলের সমবয়সী। তোমার ছেলে ঘরে বারমুডা পরে থাকে। মধ্যে মধ্যে ওই পরেই বাজারে গিয়ে ডিম বা দুধ নিয়ে আসে। তাতে তো কই আপত্তি করো না? পরাণ আশ্চর্য হয়ে বললেন, ও যে ছেলে! গিন্নি বললেন, তোমাকে নিয়ে আর পারি না। ফের যদি আমি ছাড়া আর কোনো মেয়ের পোশাক পরা নিয়ে কিছু মন্তব্য করেছ তো আমি যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাব।
তো পরাণ বৌকে একটু ভয়ই পান। বৌয়ের দাবি কিছুই নেই। বড্ডো সাদামাটা মেয়ে। এমনিতে সাত চড়ে রা কাড়ে না। পরাণ শুনেছেন, যারা কখনো রাগ করে না, তারা কিন্তু খেপে গেলে সাংঘাতিক কিছু করে ফেলতে পারে।
ছেলের বৌ এলে গিন্নি পইপই করে পরাণকে শেখালেন, সে কলেজ পাশ করে ইশকুলের দিদিমণি। তোমার বৌয়ের মতো ইশকুল পাশ করেই ছাদনাতলায় বসে পড়া মেয়ে নয়। দোহাই তোমার যা পোশাক পরে পরুক, সে তোমার ছেলে বুঝবে। তুমি কথাটি কোয়ো না। যদি অশান্তি করো, তো আমি দেয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে ফাটিয়ে ফেলব। সেই ভয়ে রিম্পার পোশাক নিয়ে কোনোদিন কিছুই বলার সাহস পান নি পরাণ। যদিও পোশাক জিনিসটা বাদ দিয়ে অন্য অনেক কিছু নিয়ে তিনি সমালোচনা করেন। রিম্পা দুধ খেতে চায় না। কিন্তু দুধে ময়দা গুলে রূপটান করে। দোকান থেকে টাকা খরচ করে চুল বেঁধে আসে। ইউটিউব দেখে রকমারি খাবার বানায়। ছানার চাইতে পনির বেশি পছন্দ করে। ছেঁচকি কি জানে না, অথচ রায়তা খুব ভালবাসে। অদ্ভুত একটা মেয়ে। গিন্নি বোঝান, ও থাক্ না নিজের মতো।
ছেলে অফিস থেকে ফিরল। জুতোটা খুলে আলমারিতে ঢুকিয়ে দিল। রিম্পা ওর জন্য পুরোনো তোয়ালে দিয়ে ঘরের চটি বানিয়ে দিয়েছে। চলতে ফিরতে আওয়াজ হয় না। নাম দিয়েছে বাবুশ। রাশিয়ান না চেকোশ্লোভাকিয়ান, না কি হাঙ্গেরি, কোন্ দেশের সিনেমায় দেখেছে দুজনে। তাইতে শখ করে বানিয়েছে। কাপড়ের জুতো পরে বাথরুমে যাওয়া যায় না। তখন হাওয়াই চটি পরে। রিম্পা বলে বাবা হাওয়াই দ্বীপের নাম জানো তো? ওখানকার স্টাইলটা আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের কত পছন্দ দ্যাখো। ভাল জিনিস একদেশ থেকে অন্য দেশে গিয়েও আদর পায়। চিন থেকে এসেছে চিনি, মিশর থেকে মিশ্রি বা মিছরি, বাটাভিয়া থেকে বাতাবি লেবু, মোজাম্বিক থেকে মুসম্বি লেবু।
পরাণ গিন্নি অমনি বলেন রিম্পা তোর বাবাকে মুসুম্বির রসটা করে দেনা মা। রিম্পা অমনি ছোটে। গেলাস ভরতি করে রস এনে সোফায় বসে থাকা শ্বশুরকে দেয়। বলে নাও বাবা। পরাণের চোখে পড়ে রিম্পা ঘরোয়া পোশাকের নিচে অন্তর্বাস পরে নি। ঝুঁকে গেলাস দিতে গিয়ে বুকের ভেতর অনেকটা দেখা যাচ্ছে। পরে সেই নিয়ে গিন্নির কাছে অনুযোগ করেন তিনি। গিন্নি রেগেমেগে বলেন, মেয়েটা তোমাকে সর্বদা বাবা বাপি এসব বলে। বাবা নেই ওর। তোমাকেই বাবা ভাবে। তোমার মেয়ের বাবা হওয়া উচিত ছিল। সেদিন পরাণের সামনেই রিম্পা তার ছেলের হাতে টাকা দিয়ে বলল, আমার জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন এনো তো। পিরিয়ড শুরু হয়েছে। কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল পরাণের। রিম্পার বিরুদ্ধে গিন্নিকে কিছু বলা যাবে না। শাশুড়ি বৌয়ে খুব ভাব। সেদিন শাশুড়ির শাড়ির কুঁচি ঠিক করে দিয়ে, আঁচলটা বাগিয়ে দিয়ে টপ করে তাঁকে একটা চুমু খেয়ে ফেলল রিম্পা। বলল, আই লাভ ইউ মা।
সেভিংস ব্যাঙ্কের টাকাগুলো হাতছাড়া হয়ে যেতে রাগ হচ্ছে পরাণের। দেশে তো গোয়েন্দারা আছে। তারা খুঁজে পায় না, কারা এইসব অপকর্ম করে? ব্যাঙ্কের থেকে তথ্যই বা এদের কাছে যায় কি করে? সর্ষের ভিতরে যদি ভূত বসে থাকে… ভাবতে গিয়েই নিজেকে সংশোধন করেন পরাণ। না দেশের প্রশাসন যথেষ্ট পরিমাণে তৎপর। কিন্তু ওই প্রতিবেশী দেশটা যত সর্বনাশের গোড়া! ওরাই কিছু লোককে ভাড়া করে…
ছেলে অফিস যাবার আগে বলে গেছে, বাবা, থানায় যেও কিন্তু। টাকা তুলে নিয়েছে। পরিষ্কার চিটিং কেস। আইপিসির ৪২০ ধারা। নন বেইলেবল সেকশন। আর লোকটা মিথ্যে করে নিজেকে ম্যানেজার বলেছে। সেটা লোক ঠকানো। তাহলে আইপিসির ৪১৯ ধারা। দুটোই কগনিজেবল অফেন্স। তার মানে পুলিশ নিজের থেকে ইনভেস্টিগেশন শুরু করে দেবে। এফআইআর হবে।
ছেলে বেরিয়ে যাবার খানিকটা সময় পরে রিম্পা চিঠিটা প্রিন্ট করে দিল। বলল, বাবা রিকশা করে যাবে। পরাণ বললেন, দশটা মিনিট লাগে না, হেঁটেই তো যেতে পারি। রিম্পা বলল না, রিকশা করে যাবে। রিকশা থানার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে। ওই রিকশাতেই চলে আসবে। পরাণ বললেন, রিকশা দাঁড় করিয়ে রাখব কেন? আসবার সময় না হয় একটা নিয়ে নেব। রিম্পা বলল, না বাপি। আমার কথা শোনো। রিকশা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে। আর এই একশোটা টাকা ওকে দিয়ে দেবে। পরাণ বললেন, আমার কাছে টাকা আছে। রিম্পা শ্বশুরের ঠোঁটে তর্জনী চাপা দিয়ে টাকাটা বুক পকেটে ঢুকিয়ে দিল। পরাণ আপত্তি করতেই গিন্নি ঝাঁজিয়ে উঠলেন। একটু আদর নিতেও শিখতে হয় গো। ও কি পরের জন্য করছে?
রিম্পা মোবাইলে ফোন করে কার সাথে কথা বলেই পরাণকে বলল, রিকশা এসে গেছে। পরাণ অবাক হলেন। ফোন করে ওলা উবের গাড়ি ডাকা যায় তিনি জানেন। তারা মোবাইলে রাস্তা চিনে নিয়ে যায়। তার জন্য অ্যাপস আছে। কিন্তু রিকশাচালকের মোবাইল! নাঃ, দেশটার সাংঘাতিক উন্নতি হয়েছে!
থানায় গিয়ে আদৌ পাত্তা পেলেন না পরাণ। ওসি নেই। এস পি অফিসে মিটিংয়ে গেছেন। যে সাব ইনসপেকটর ডিউটি অফিসার হিসেবে কাজ করছেন, তিনি দরখাস্ত পড়েই দাঁত খিঁচিয়ে উঠলেন। বললেন বয়স তো তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে। এখনও এইটুকু বুদ্ধি হয়নি যে ব্যাঙ্ক এভাবে ফোন করে না? চোখ ফেটে জল আসতে লাগল পরাণের। তাঁর তুলনায় একজন সাব ইনসপেকটর কতো সামান্য। তবুও এভাবে কথা বলছে।
পরে বুঝতে পারলেন, পুলিশ এইসব কেস দেখে দেখে বীতশ্রদ্ধ হয়ে গেছে। আর গণতান্ত্রিক দেশে সরকারি চেয়ারে বসলে নাগরিকের সঙ্গে দাঁত খিঁচিয়ে কথা বলাই দস্তুর।
পরাণের জন্য এফআইআর হয় না। কগনিজেবল নন বেইলেবল এসব শব্দ ঝঙ্কার পুলিশ শুনতে চাইল না। বলল, বড্ড বেশি বুঝে গেছেন না? নিছক একটা রশিদ করে দিয়ে বলল, এবার আপনি আসুন। পরাণের গা মাথা টলছে। অবসরপ্রাপ্ত গেজেটেড অফিসার বলে না হলেও সিনিয়র সিটিজেন বলে কি কোনো সম্মান তাঁর প্রাপ্য ছিল না? দেশের জন্য কর তো তিনি দেন। আর নাগরিকদের করের টাকাতেই এদের মাইনের টাকাটা জোগাড় হয়।
দেয়ালে হাত ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে বৃদ্ধ রিকশার কাছে এলেন। রিকশাচালক পরম যত্ন নিয়ে তাঁকে ঠেলে রিকশায় তুলে বাড়ি পৌঁছে ধরে ধরে সিঁড়ি দিয়ে তুলে দিল।
সোফায় ধপ করে বসলেন বৃদ্ধ। অপমানে অভিমানে দু চোখ দিয়ে জল ঝরতে থাকে বৃদ্ধের। রিম্পা কাছে এসে বসে রুমাল দিয়ে চোখ মুছিয়ে দিতে থাকে। বলে, বাবা, মনে করো ওই টাকা ক’টা ঠাকুরকে দিয়েছ। ওই তো ক’ হাজার টাকা। ও তোমাকে আমিই পুষিয়ে দেবো বাবা, প্লিজ কেঁদো না। শরীর খারাপ করবে।
পরাণের মনে হয় মাথাটা দুলছে। মনে হয়, বাবা শব্দটা বাংলা নয়, তুর্কি ভাষা থেকে এসেছে। ঠাকুর শব্দটাও বাংলা নয়। তুর্কি থেকে এসেছে। হাজার কথাটা এসেছে ফার্সি থেকে। মাথাটা লটপট করছে। রিম্পার গায়ে ঢলে পড়েন বৃদ্ধ। মনে হয় মায়ের কোলে মাথা রাখছেন। মা ডাকেন, আয় আয়। পুলিশ তোকে বকেছে? আচ্ছা, আমি পুলিশকে খুব করে বকে দেব। আয় বাবা, এই তো আমার কোলে আয়।
রিম্পা আর্তনাদ করে ওঠে, মা তোমার ছেলেকে ডাকো। বাপিকে এক্ষুণি নার্সিং হোমে নিতে হবে।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..