পরিযায়ী শ্রমিক

সুদীপ ঘোষাল
উপন্যাস
Bengali
পরিযায়ী শ্রমিক

স্বামী চলে যাওয়ার পরে একদম একা হয়ে পরেছিলেন, কবিতা। মনে পরতো ফুলশয্যা,  আদর।   কি করে যে একটা একটা করে রাত, দিন পার হয়ে যায়, বোঝাই যায় না। তবু বুঝতে হয়, মেনে নিতে হয়। একটা ঘুঘু পাখি তার স্বামী মরে যাওয়ার পর থেকেই এবাড়িতে আসে। আম গাছের ডালে বসে আপন মনে কত কথা বলে। ঘুঘুর ঘু,ঘুঘুর ঘু। সবিতাদেবীর সঙ্গে পাখিটার খুব ভাব।তার মনে হয় স্বামী, ঘুঘুর রূপ ধরে আসেন। তিনি আম গাছের তলায় খুদকুড়ো ছিটিয়ে দেন। ঘুঘু পাখিটা খায় আর গলা তুলে কবিতাকে দেখে । কিছু বলতে চায়। তিনি বোঝেন। আর আপনমনেই পাখিটার সঙ্গে বকবক করেন। পুরোনো দিনের কথা বলেন। ছেলের বৌ বলে,বুড়িটা পাগলী হয়ে গেছে। প্রতিবেশীরা অতশত বোঝে না। হাসাহাসি করে। শুধু তার ছেলে বোঝে মায়ের অন্তরের কথা, ব্যথা। ঘুঘু পাখিটা সারাদিন ডেকে চলে। এবার আয়, এবার আয়। কবিতার বয়স হল আটত্রিশ। বিধবা হলে কবিতার উপর নজর পরলো তাদের গুরুদেবের।গুরুদেব বললেন, যা হবার হয়েছে বুঝলে কবিতা। আমি তো আছি। স্বামীর অভাব বুঝতে দেব না। প্রথমে গুরুদেবের আসা যাওয়া ভালো না লাগলেও একদিন তা অভ্যাসে পরিণত হল।

কবিতার একমাত্র ছেলে রাজু  বামুন পাড়ার ছেলে। পৈতে হয়েছে বৈশাখ মাসে। উপনয়নের পর উপবীত ধারণ করতে হয়। এই উপবীতের চলতি নাম পৈতে। পৈতে কথাটি সমাজে বহুপ্রচলিত।   বাহুতে গুরুদেব বেঁধে দিয়েছেন কবচ। রাজুদের বংশের গুরুদেব বলেছেন, সমস্ত বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করবে এই কবচ আর পৈতে।  সব কাজে সফল হবে নিশ্চিতভাবে আর সারাজীবন রক্ষাকবচের মত আগলে রাখবে জীবন।

রাজু গরীব বামুনের ছেলে। দুবিঘে জমি, দুটো গরু আর গোটা দশেক ছাগল তাদের সম্পত্তি। রাজুর পৈতেটা একটু দেরী করেই হয়েছে। তার ফলে গুরুদেবের আদেশ অনুযায়ী  প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছে তার ফর্দমত। তার ফলে খরচ অনেকটা বেড়ে গেছে।

এখন তার বয়স উনিশ। বাবা মরে গেছেন অনেক আগেই। তার মা অই গুরুদেবের কথামত সংসার চালান। পুজো, উপবাসে মেতে থাকেন মা। আর গুরুদেবের ফলাহার রাজু তাকিয়ে দেখে। মা গুরুদেবের খাওয়ার শেষে তার উচ্ছিষ্ট খান। এটাই মায়ের গুরুর প্রসাদ।

গুরুদেব মাঝে মাঝে রাতে রাজুদের বাড়িতে থাকেন। রাজু বোঝে সবকিছু কিন্তু চুপ করে থাকে। গুরুদেব মা কে বলেন, আমার কথামত চললে তোমাদের ভাল হবে। এই ভাল হওয়ার লোভে রাজুর মা গুরুদেবের সব কথা মেনে নেন। রাজুর মায়ের মিথ্যে রক্ষাকবচ হলেন গুরুদেব। এক অদৃশ্য দেওয়া নেওয়ার খেলা  তিনি খেলেন নিষ্ঠুর হৃদয়ে।

রাজু সকালবেলা মাঠে যায়। সে বামুন হলেও লাঙল ধ’রে চাষ করে। ছোট থেকেই করে আসছে। বেশ গাঁট্টাগোঁট্টা চেহারা তার। সকলে বেশ সমীহ করে চলে তাকে। পড়াশুনা বেশিদূর গড়ায় নি। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছে কোনরাকমে।

বাবা মরে যাওয়ার   পর থেকে সংসারের দায়ীত্ব তার উপরেই ন্যস্ত।

সকালে গরু ছাগল নিয়ে মাঠে যায়। হাতে পাঁচন গলায় গামছা। লুঙ্গি পরে আলের উপর বসে থাকে। গরু ছাগল পালিয়ে গেলে ডাকিয়ে নিয়ে আসে ঘাসের বনে। পরের ফসল খেলে লোকে ছাড়বে না। এ নিয়ে অনেকবার ঝগড়া হয়েছে রাজুর সঙ্গে জমির মালিকদের। একদিন রমেন মোড়ল লাঠি নিয়ে এসে বলল, তোর ছাগলে আমার জমির ফসল খেয়েছে। খবরদার বলছি আমি কিন্তু ছাড়ব না। এই লাঠি মেরে মাথা ফাটিয়ে দোব। রাজু বললো, বেশ কাকা আর হবে না এই ভুল। আমি নজর রাখব। সঙ্গে সঙ্গে মোড়ল নরম সুরে বলল, তোমরা হলে গিয়ে বামুনের ছেলে। বলতে খারাপ লাগে। বুঝলে তোমার বাবাকে আমি দাদা বলে ডাকতাম। রাজু বলল,মায়ের কাছে শুনেছি সব। তবে আপনার ফসলের ক্ষতি হলে তো রাগ হবেই। আমি এবার ভাল করে লক্ষ্য রাখব। মোড়ল বললেন, বেশ বাবা বেশ। বেঁচে থাক।

রাজু ভাবে ফসলের মাঠে গরু, ছাগল চড়ানো খুব কঠিন। কখন যে কার মাঠে নেমে যায় বোঝা মুস্কিল। সে ভাবল, কাল থেকে অই পাকা রাস্তার ধার ঘেঁষে বারেন্দা গ্রামের কাছাকাছি জঙ্গলে যাবে গরু চড়াতে। ওখানে ফসলের জমি নাই। নিশ্চিন্তে বসতে পারবে। মাকে বলে, জলখাবার সঙ্গে নিয়ে যাবে।

পরের দিন রাজুর মা সকাল থেকে আলুভেজে দিল আখের গুড় দিল আর এক জামবাটি ভরতি করে মুড়ি দিল।   রাজু গামছায় বেঁধে গরু, ছাগলের দড়ি খুলে পাঁচন হাতে চলে গেল জঙ্গলে। সেখানে গিয়ে দেখল ঘাস আছে পাতা আছে। আর ভিড় কম। পাশে ক্যানেলের পরিষ্কার জল। সেখানে মাছ ধরছে হাজরাদের একটা মেয়ে। রাজু ভাবল, কি সুন্দর দেখতে মেয়েটা। উবু হয়ে মাছ ধরছে। মেয়েটা রাজুকে দেখতে পায় নি। একটু পরে রাজু ডাকল, ও মেয়ে, তোর নাম শ্যামলী নয়?  শ্যামলী বলল, হুঁ।

—– তুই রোজ এখানে আসিস মাছ ধরতে?

— হুঁ

— আমাকে চিনিস?

—- হুঁ

আয় এখানে আয়। দুজনে মুড়ি খাই। তোর মাছ নেব না। আয়।

শ্যামলী হাত, পা ভাল করে ধুয়ে চলে এল রাজুর কাছে। রাজু গামছায় মুড়ি ঢেলে দিল। দুজনে গল্প করতে করতে খেল। তারপর দুপুর হলে দুজনে চলে এল নিজের বাড়ি।

রাজু গোয়ালে গরু বেঁধে, হাত পা ধুয়ে স্নান সেরে নিল। তারপর দরজার কাছে এসে দেখল দরজা বন্ধ। দরজায় একটা ফুটো আছে। চোখ লাগিয়ে দেখল, গুরুদেব মা কে নিজের উলঙ্গ দেহ দিয়ে ঢেকে ফেলেছে। মাকে দেখা যাচ্ছে না। তাহলে কি মাকে বশ করেছে কবচ পরিয়ে?  আমাকেও দিয়েছে কবচ। রাজুর রাগ হল। কিন্তু কোন আওয়াজ না করে চলে গেল গোয়ালে।

প্রায় কুড়ি মিনিট পরে রাজুর মা রাজুকে দেখতে গোয়ালে এল। রাজুর মা বলল, আমি তোকে না দেখে একটু শুয়েছিলাম। আজকে তোর দেরী হল কেন?  রাজু বলল, মা আমার খিদে পেয়েছে। খেতে দাও। আমি এখানে বসে খাব।

তারপর বর্ষা এল। নদী, পুকুর, খাল, বিল সব কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেল। শুধু পূর্ণ হল না রাজুর মন। গুরুদেবের প্রতি ঘৃণায় তার মন খারাপ ছিল। কিন্তু এখনও সেই ঘটনা ঘটে চলেছে। রাজু জানে, মানুষের জীবনে কিছু ঘটনা মনের কোণে থেকে যায়। তার প্রতিকার হয় না কোনোদিন।

রাজু এবার চাষ করেছিল সময়ে। কিন্তু বন্যায় ধানের চারা ডুবে থাকল দশদিন। সব পচে গেল। পচে গেল সমস্ত কৃষকের আশা আকাঙ্খা সবকিছু। আর কদিন পরেই শরৎকালের দুর্গাপুজো। সবাই নতুন জামা, কাপড় কিনবে। কিন্তু এই গ্রামের লোকগুলো খালি গায়ে গামছা কাঁধে ঘুরবে। রাজু শ্যামলীকে এইসব কথা বলে। রাজু বলে, তোকে একটা শাড়ি দোব ভেবেছিলাম, কিন্তু কি করে দোব?

শ্যামলি বলে, দিতে হবে না গো। তুমি শুধু এমনি করে আমাকে জড়িয়ে থেক।

রাজু আর শ্যামলী দুজনে দুজনকে ভালবাসে। তারা বিয়ে করবে। কিন্তু বামুনের সঙ্গে হাজরা বা হাড়ি জাতের বিয়ে সমাজের সেনাপতিরা মেনে নেবে না। ওরা ঠিক করল, পালিয়ে গিয়ে ওরা বিয়ে করবে  পরে। ততদিনে রাজু ভাবে, একটু গুছিয়ে নেব নিজেকে। টাকা, পয়সা জমিয়ে রাখব। তারপর বিয়ে,সংসার।

প্রায় দুবছর পরে রাজু আর শ্যামলী ঠিক করল দুদিন পরে তারা শিবলুন স্টেশনে ট্রেন ধরবে। তারপর বহরমপুরে চলে যাবে। ওখানে নিশ্চয় কাজ পেয়ে যাবে। তা না হলে কুলিগিরি করবে। ওদের ঠিক চলে যাবে।

রাজু আজ বাড়ি গিয়ে গুরুদেব আর মা কে দেখতে পেল। গুরুদেবের দয়ায় মায়ের খাওয়া পরার অভাব নেই। মেয়ের বয়সী রাজুর মা। গুরুদেব   এই মেয়ের বয়সী অসহায় বিধবার সঙ্গে যে খারাপ দৃষ্টি দিতে পারে, এই ধারণা গ্রামের সরল মানুষের ছিল না। আর রাজুর দেখা সেদিনের ঘটনা একমাত্র শ্যামলী বিশ্বাস করে। আর কাকে বলবে সে। এই ঘটনার সঙ্গে যে মা জড়িত। মা যদি লজ্জায় গলায় দড়ি দিয়ে বসে তাহলে রাজু তো মাতৃহারা হবে। তাই নিজের পায়ে কোপ রাজু মারতে চায় না। নিজের মত করে পরবর্তী জীবন সে আনন্দে কাটাতে চায়।

হঠাৎ একদিন গুরুদেব রাজুকে কাছে বসালেন। বললেন, তুই নিজেকে খুব চালাক মনে করিস নয়?  রাজুর মা বললেন, কেন কি করেছে রাজু?

গুরুদেব বললেন, তোমার ছেলে হাড়িদের মেয়ের সঙ্গে ঘোরে।মাখামাখি করে। ওদের পাড়ার অনেকে দেখেছে। আমাকে বলেছে। রাজু বলল, হ্যাঁ, আমি ওকে বিয়ে করতে চাই।

গুরুদেব বললেন, আমি হতে দেব না। তুই বামুনদের ছেলে। সমাজ মানবি তো হতভাগা। রাজু বলল, আপনার মুখোশপরা সমাজ আমি মানি না। আমি জাতপাত মানি না। এই বিয়ে হবেই। কোনো শক্তি এই বিয়ে আটকাতে পারবে না। প্রয়োজনে প্রাণ দিয়ে দেব।

রাজুর মা চিৎকার করে বললেন, কাকে কি

বলছিস   তুই?  এই বিয়ে হলে আমার মরা মুখ দেখবি। আমি গলায় দড়ি দেব।

গুরুদেব বললেন, ছি ছি রাজু। মায়ের কথা চিন্তা না করে তুই দেহের কথা চিন্তা করছিস। ছি ছি।

রাজু মা কে বলল, মা হয়ে তুমি ছেলেকে সাজা দেবে?

রাজু ছুটতে ছুটতে নতুন পুকুরের পাড়ে গেল। রাজুর মা ও ছেলেকে ডাকছেন, রাজু ফিরে আয়। রাজু ফিরে আয়।

রাজু দূর থেকে দেখল শ্যামলী ছুটতে ছুটতে শিবলুন স্টেশনে যাচ্ছে। এখন তাকে কোনো বাধা আটকাতে পারবে না।

আজ তাদের পালিয়ে বিয়ে করার দিন। রাজু অবাক চোখে  দেখে, শ্যামলী খোলামাঠে হৃদয় মেলে আনন্দে  মেঘ হয়ে ভাসছে।

রাজু ভাবল, এই আনন্দ ম্লান হয়ে যেতে পারে না।সে ও হাওয়ায় উড়তে চায়।

রাজু  অসহায়  । সে ভেবে পাচ্ছে না কি করবে?  একদিকে শ্যামলী তার প্রাণের বাঁশি আর একদিকে মা, রাজুর শ্রেষ্ঠ  দেবী।

গুরুদেবের সমস্ত মিথ্যা কথা রাজুর মনে পড়ছে। কবচ পরলে নিশ্চিতভাবে সকল কাজে সফল হওয়া যায়। পৈতে থাকলে সিদ্ধিলাভ হয়। কই রাজুর জীবন তাহলে ব্যর্থতায় ভরা কেন?  রাজু ভাবে, এইসবকিছু গুরুদেবের বানানো কথা। শাস্ত্র কখনও জাতিগত ভেদাভেদ করে নি। পৃথিবীর কোন ধর্ম কোন মানুষকে ছোট করে নি।শুধুমাত্র গুরুদেবের মত স্বার্থপর লোকেরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য  এইসব নিয়ম চালু রাখেন সমাজে। রাজু এই মুখোশ একা খুলতে পারবে    না। তবু নিজের জীবনে তো   নিজের ইচ্ছেমত থাকতে পারবে। সে মা কে বুঝিয়ে বলবে। মা নিশ্চয়ই বুঝবে।

রাজু অনেক আশা নিয়ে  পৈতে খুলে ফেলল। কবচ খুলে ফেলল। দুটো বিষফলের মত, কুসংস্কারের বোঝা   ছুঁড়ে ফেলে দিল পুকুরের জলে। আর কখনও বিষফল দুটো রাজুর ভাবনার বাধা হতে পারবে না। রাজুর মনটা হাল্কা হল।

তারপর দৃপ্ত পদক্ষেপে হাঁটা শুরু করল মানুষের মনের  কুসংস্কার মুছে ফেলার সংকল্প নিয়ে।

রাজু দৌড়তে শুরু করল। তারপর সে উড়তে শুরু করল। সমস্ত বাধাকে জয় করতে পারলে বোধহয় এইরকমই অনুভূতি হয়, সে ভাবল, আকাশে ওড়া শ্যামলীকে এবার ও নিজেও উড়ত  উড়তে ধরবে। শ্যামলীকে ভালবেসে আকাশে ওড়াটা সে ভালভাবেই রপ্ত করেছে..

***

কানি নদীর পাড়ে মালিহা  গ্রাম। হারুদাদু বলতেন,এই গ্রামে পাঁচশো বছর আগে এক রাজা এসে বড় অট্টালিকা করেছিলেন এক সুন্দরীকে ভালোবেসে।সেইসব আর নাই।কালের প্রবাহে ভেসে গেছে।গ্রামে দুইশত পরিবারের বাস।বেশিরভাগই মাটির বাড়ি।সন্তুদেরও মাটির বাড়ি।    চারচালা টিনের চাল।

সন্তু ছোটো থেকেই মায়ের নেওটা। মা ছাড়া সে কিছু বোঝে না,চেনে না। ফলে মায়ের স্নেহছায়া একটু বেশি পেতো সে। মা জানতেন এই ছেলে আমার, অবর্তমানে অন্য ছেলেমেয়েদের দেখবে। সন্তুর বাবা ছিলেন সরকারী কর্মচারী। তিন ছেলে আর দুই মেয়েকে পড়াশোনা শেখাতে সমস্ত ব্যবস্থা করেছেন। খাওয়া পরার কোনো অসুবিধা নেই। বেশ চলছিলো বটগাছের ছায়ায় সাতটি জীবন। কিন্তু মহাকালের বিচার মানতেই হবে। হঠাৎ মারা গেলেন সন্তুর বাবা।

তখন সন্তুর বয়স একুশ। মেট্রিক পাশ করে আই,টি,আই এ ভর্তি হয়েছিলো। কিন্তু অর্ধপথে পড়া থেমে গেলো। সংসারের সমস্ত দায়ীত্ব কাঁধে তুলে নিলো সন্তু। বাবার চাকরীটা সরকার বাহাদুর দিলেন সন্তুকে। এবার ভাই, বোনদের পড়াশোনা, মাকে যত্ন করা সব অই সন্তুর সামান্য মাইনের টাকায়। নতুন চাকরী তাই মাইনে কম। ট্রান্সফারেবল্ জব। আজ হাওড়া তো কাল শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ি থাকাকালীন ছুটির দিনে ঘুরতো সন্তু একা। একবার দার্জিলিং গিয়েছিলো। পাহাড় তাকে ডাকতো। ভালোবাসা ধরে রাখতো সবুজ প্রকৃতির মাঝে।

সে সমতলের ছেলে। আর পাহাড়ি ছবি তার মনে শান্তি আনতো। মন খারাপ হলেই পাহাড়ের ডাকে বেরিয়ে পরতো বারে বারে।

একরাতে বাসা বাড়িতে খাবার নেই। মাইনের টাকা গ্রামে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। সামান্য কটা টাকা আছে। সন্তু জানে মাস চালাতে হবে। রাত বেশি হওয়ায় দোকানগুলো বন্ধ। একগ্লাস জল ঢকঢক করে পান করলো। অমৃতের স্বাদ। কিন্তু পোড়া পেট মানে না বারণ। চুঁই চুঁই করছে। তবু লেপ মুরি দিয়ে শুয়ে পরলো। গুরুর জপ শেষ করে ঘুমোয় সন্তু। জপ করার সময় শুনতে পেলো ঠক ঠক আওয়াজ।  তাড়াতাড়ি জপ শেষ করে বললো,কে?

—-আমি, দরজাটা খুলুন।

—–জগতে সবাই তো আমি। নাম বলুন।

—–আমি পাপিয়া,আপনার বাড়িওলার একমাত্র মেয়ে।

——এত রাতে কেন?  কি প্রয়োজন বল?

——আরে খুলুন না ছাই।

দরজা খুলে দেখলো বাড়িওয়ালার সুন্দরী অষ্টাদশী মেয়েটা। হাতে একটা  বাটি। বললো,আজকে আমাদের সত্যনারায়ণ পুজো ছিলো, মা তাই প্রসাদ পাঠালেন। খেয়ে জল খাবেন। প্রসাদ খেয়ে জল খেতে হয়। জল খাবেন। এখন কি ঢাকা দিয়ে রেখে দেব।

সন্তু বলল,তাই দাও। আমি পরে খেয়ে নেব।

পাপিয়া বলল, আমি বসব। আপনার সঙ্গে গল্প করব।

— কিন্তু মেসোমশাই রাগ করবেন। রাতে গল্প।

— বকবে না। বাবাকে বলে, তারপর এসেছি। বলেছি   সন্তুদা প্রসাদ খাবে। তারপর বাটি নিয়ে আসতে দেরী হবে।

— কত আর দেরী হবে খেতে।

— কিচ্ছু বলবে না, বলছি না। বাবা আমাকে বকে না। একমাত্র আদরের মেয়ে আমি।

পাপিয়া বলল, এবার তোমার গ্রামের গল্প বলো। আমি কিন্তু তোমাকে, তুমি তুমি বলব সন্তুদা। তুমি বেশে কথা বল না কেন?  কথা বলবে এখন। আমি শুনব।

সন্তু বলেছিল, নিশ্চয় বলবো। কথা বলব না কেন?  আমি তো একাই থাকি। বল, কি বলবে।

সন্তুর মনেও একটা কোণে পাপিয়া ডাকত। কিন্তু বড় সংসারের দায়ীত্ব তার কাঁধে। মায়া কাটাতে হবে। বাউলের মন হয়ে যায় সন্তুর। সে ভাবে, এসব প্রেমের বিলাসিতা কি আমার সাজে? সন্তু ভাবে,বারবার ভাবে পাপিয়ার কথা। কিন্তু ভালবাসা সহজে কেউ পায় না আর কেউ কেউ বাউল সাধক। মানুষের মাঝেই তাঁর বাসা। উদাস ভালবাসা।

হঠাৎ পাপিয়ার ডাকে সন্তু চেতনা ফিরে পেলো। পাপিয়া বলল, তুমি সবসময় বাউল মনে ঘুরে বেড়াও কেন। কোকিলের মত তোমার কি বাসাবোনার ইচ্ছে নেই।

সন্তু উত্তর দেয় না। পাপিয়া আবার বায়না করে, একটা গল্প বলো না সন্তুদা। তোমার গ্রামের গল্প। তোমার মায়ের কথা,বাড়ির কথা, আনন্দের কথা। সব শুনব আমি।

সন্তু বলল,শোনো তাহলে। বলি তোমাকে শীতকালে মেলা যাওয়ার কথা। আমার আবেগের কথা।গোরুর গাড়ি চেপে উদ্ধারণপুরের মেলা যাচ্ছি। পিছনে বাঁধা রান্না করার সরঞ্জাম। মেলা গিয়ে রান্না হবে। বনভোজন। সঙ্গে মুড়ি আছে। বড়দা বললেন,গিয়ে প্রথমে মেলা ঘোরা হবে। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। মা বললেন,তোরা ঘুরবি আমি আর মানা রান্নাবান্না করবো। তারপর দুপুরে মেলা ঘুরবো। গাড়ি চলেছে ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দে। গোপাল কাকা বললেন,আরে, দেখ দেখ জিম চলে এসেছে। বড়দার ভয়ে ব্যাটা গাড়ির তয় হাঁটছে।

জিম নেড়ি কুকুর হলেও, আমরা ওকে জিম বলেই ডাকি। কুকুর ভাবি না। অনেক মানুষের থেকেও ওর ভব্যতা অনেক বেশি।

পঞ্চাননতলার মেলা যেতে একটা আল রাস্তা ছিলো। আমরা ছোটোবেলায় বারবার ওই রাস্তা ধরে আসা যাওয়া করতাম। দুপাশে কাদা ভরতি ধানের জমি। কি করে কাউকে ওই কাদায় ফেলা যায়, এই কুবুদ্ধি আমাদের মাথায় খেলা করতো। আর তাই হতো। ধপাধপ কাদায় পরে যেতো অনেকেই। আর আমরা কি মজা, কি মজা করে চিৎকার করতাম। মার খেয়েছি খুব। বদ বুদ্ধির জন্য।

গোরুর গাড়ি একবার থামলো। তামালদা আর আমি জমি দিয়ে হেঁটে গেলাম। দেখলাম আখের জমি। বললাম,একটা আখ খাবো। তামালদা বললো, না পরের জমি।

— একটা তো, কিছু হবে না।

—– যাও, তাড়াতাড়ি আসবা।

তারপর একগাছা সরালো আখ ভেঙ্গে খেতে খেতে চলে এলাম।

গোরুর গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। দিগি দিগি, পা পা, করে গোরুর সঙ্গে কথা বলে চলেছে প্রিয় তামালদা।

মন্থর গতিতে পৌঁছে গেলাম সকালের টাটকা মেলায়। ভোরবেলায় বেরিয়েছি বাড়ি থেকে। প্রায় কুড়ি কিমি রাস্তা চার ঘন্টা লাগলো। তবু ক্লান্তি নেই। মা বললেন,প্রথমে জল এনে এই ড্রাম ভরে ফেল।

জল ভরার পরে আমরা মেলা ঘুরতে চলে গেলাম। কাঁচের চুড়ির দোকান পার করে নাগরদোল্লা। চাপলাম। ভয় নেই। মনে মজা।

তারপর ঘুরে ঘুরে দেখার পালা। একই জিনিস ঘুরে এসে দেখে নতুন লাগছে। চির নতুন। কেউ বিরক্ত নয়। সবাই অনুরক্ত মানুষের ভিড়ে। এই প্রবাহ পুরোনো হবে না কোনোকালে।

বড়দা বললেন,অনেক হয়েছে। এবার খাবে চলো। মায়ের কাছে গিয়ে দেখলাম, মুড়ি, তেলেভাজা, আর রসগোল্লা রেডি। ঘুরে ঘুরে খিদে পেয়েছে। খেয়ে নিলাম। জল খেয়ে ধড়ে প্রাণ এলো। এলো আনন্দ।

মানা পিসি বললেন,চল আমি আর তুই একবার মেলা ঘুরে আসি। পিসি প্রথমেই চিতার কাছে গিয়ে বললেন,সব থেকে সত্য, এই চিতা। পিসি খুব তাড়াতাড়ি এই সত্যের সন্ধান কিছুদিন পরেই পেয়ে গিয়েছিলেন।

তামাল দা মাকে বললো,দিদিমুণি, ত্যাল দিন তো। আর ওই খোলের বাটিটা। গরুগোলাকে খেতে দি ভালো করে। ত্যাল মাকিয়ে দোবো। ওরাও তো মেলায় এয়েচে। অবিচার করলে হবে না।

মা বললেন,যাও, দাও গা। ভালো করে খেতে দাও।

মা রান্না সারার পরে একবার মেলায় গেলেন। আমার ঘুরে ঘুরে পায়ের ডিমিতে লাগছে

তবু মেলা না দেখে মন মানছে না। ক্লান্তি ভুলে অবাক চোখ চালানো সারা মেলা জুড়ে। কোনো কিছু দেখা বাকি থাকলো না তো?  তাহলে বন্ধুদের কাছে হেরে যাবো। বন্ধুরা বলবে, কেমন মেলা দেখলি। আমরা সব দেখেছি।

ঘুরে ঘুরে লেখক অবধূতের আবক্ষ মূর্তি দেখলাম। শ্মশান দেখলাম। গঙ্গার ঘাট দেখলাম। আর দেখলাম মানুষের আবেগের রঙীন খেলা। কেউ নাগরদোল্লায়।কেউ খাবার দোকানে। আর অনেকে শুধু ভবঘুরের মতো চরকী পাক খাচ্ছে ভিড়ের মাঝে। মেলায় মিলন মানুষে মানুষে।জাতিতে জাতিতে,বললেন গোপাল কাকা।

এই উদ্ধারণপুরের মেলায় গঙ্গা এক প্রধান আকর্ষণ। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে জন্ম মৃত্যুর অনেক ছবি।

আমার ঈশ্বর,আমার অনুভব,ভালোবাসা একান্তই নিজস্ব অনুভূতি। আমার জ্যান্ত ঈশ্বরের পরম করুণাময়ের সঙ্গে মিলিত হবার শেষ আয়োজনের  শুরু হয়েছে। মনে পরছে, আমার সামনে থেকেও রকেটের দাগের মতো মিলিয়ে গেলো বন্ধু। গঙ্গার জলে ডুব দিয়ে আর উঠলো না নীলমণি। রোজ আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে জ্বল জ্বল করে আমার অশ্রু আয়নায়। হাওয়ায় ওড়া আমার বেহিসাবী মন আজও দেখতে পায় অনন্ত আকাশে তার বিচরণ।

দুপুর ঠিক দুটোর সময় মা খাওয়ার জন্য ডাকলেন। মা বললেন,থালাগুলো জল বুলিয়ে নিয়ে এসো সবাই।

তারপর গোল হয়ে সবাই বসে পরলাম খেতে। মাটিতে বসে খেতে শুরু করলাম। আমি কলাপাতায় খেতে ভালোবাসি। এতো খাওয়া নয়,স্বপ্ন জগতে বিচরণ। এই ভালোলাগা বার বার আসে না। অকৃত্রিম আনন্দের জগৎ এই মেলা।

সবার খাওয়া হয়ে গেলে মা ও মানা পিসি বসলেন খেতে। সবাইকে প্রথমে খাইয়ে তারপর নিজের খাওয়া। তাই ভারতমাতার সন্তানরা দেশের দশের জন্য সব ত্যাগ করতেও কুন্ঠিত হয় না। মায়ের কাছে এই শিক্ষা তারা পায় ছোটো থেকেই।

তারপর বাড়ি ফেরার পালা। অনেক মৃতদেহ আসছে শ্মশানে। বলো হরি, হরিবোল ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত। তারা ফিরছে আপন ঘরে। আমরা ফিরছি গ্রীনরুমে।

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। মা চিন্তা করছেন। তামালদাকে বললেন,তাড়াতাড়ি ডাকাও। গোরু দুটোকে তামালদা বলছে,হুট্ হুট্,চ,চ দিগি দিগি। গোরু দুটো ছুটতে শুরু করলো। খুব তাড়াতাড়ি চললাম। টর্চের আলোয় রাস্তা দেখছি সবাই। হঠাৎ রে রে করে দশজন ডাকাত পথ আগলে দাঁড়ালো। দে যা আছে বার কর। হাতে তাদের বড় বড় লাঠি। মা বললেন,বললাম তাড়াতাড়ি করে বাড়ি চলে যায় চ, তোরা শুনলি না আমার কথা।

হঠাৎ তামালদা আর বড়দা নেমে লাঠি কেড়ে নিয়ে বনবন করে ঘোরাতে লাগলো। আমরা গাড়িতে বসেই দেখতে লাগলাম লাঠির ঘায়ে ডাকাতগুলোর মাথা ফেটে রক্ত পরছে। সবগুলো শুয়ে পরে হাত জোড়া করে ক্ষমা চাইছে। মা বললেন,ছেড়ে দে। উচিত শিক্ষা পেয়েছে বাঁদরগুলো। খেটে খাগা যা, পালা।

তারপর তামালদা ও বড়দা লাঠি দুটো নিয়ে সামনে বসলো। বড়দা বলছে,আয় কে আসবি আয়। সেই কেড়ে  নেওয়া লাঠি আজও আছে। মা বলতেন,অন্যায় করবি না,আর অন্যায়ের সাথে আপোষও করবি না।এই বলে মা দাদুর গল্প শোনাতে শুরু করলেন। আজও মনে আছে আমার সেইসব কথা। কোনোদিন ভুলতে পারব না।

পাপিয়া বলে, খুব সুন্দর গল্প। সন্তুদা আমাকে কোনোদিন ভুলবে না তো?

সন্তু বলে, তোমার দেওয়া প্রসাদ খেয়ে নি। ঢাকা পড়ে আছে অনেকক্ষণ। সেই প্রসাদ খেয়ে সন্তু ঘুমিয়েছিলো। প্রসাদ এত মিষ্টি হতে পারে সন্তুর জানা ছিল না। হয়ত পাপিয়া ভালবাসা মিশে ছিল। সন্তু ভাবে একথা কিন্তু পাপিয়াকে ঘুরিয়ে বলল, তোমার বাটিটা ধুয়ে দি।

— আমাকে দিন। আমি ধুয়ে নেব।

এইকথা বলে সে চলে গেল।

সন্তু ভাবে, কোন কারিগর বানিয়েছেন মেয়েদের মন। তার মন দিলে আর ফেরাতে পারে না, ভুলতে পারে না প্রিয়জন।

বাড়িওয়ালার মেয়ে পাপিয়া দেখতো, সন্তু সকালে বেরিয়ে যায় আর রাতে ঢোকে। তার মানে হোটেলে খায়। কোনোদিন বেশি কথা বলে না। শুধু বলে,ভালো আছেন। আর ভাড়া দিতে এলে বলে,বাবা আছে। পাপিয়া মা আর বাবাকে বললো,আমি সন্তুদার কাছে ইংরাজীটা দেখিয়ে নেবো। বাবা খুব কিপটে। বিনা পয়সায় পড়ানোতে আপত্তি নেই। মা বললেন,ছেলেটা ভালো।যাবি প্রয়োজন হলে।

রাতে সন্তু এলে পাপিয়া বই নিয়ে ওর ঘরে গেলো। লুঙ্গি পরে তক্তায় সন্তু বসেছিলো। সন্তু বললো,কিছু বলবে।

——-হূঁ,একটু ইংরাজীটা দেখিয়ে দেবেন?

—–কই দেখি, আমি পড়তে ভালোবাসি।

——আর পড়াতে।

——দুজনে আলোচনা করবো। ইংলিশ আমার বেস্ট সাবজেক্ট ছিলো।

—–তাই,তাহলে ভালোই হলো।

সন্তু দেখছে পাপিয়ার পড়াশোনায় মন নাই। শুধু কথা বলছে। বলছে,আপনি এত অগোছালো কেন?

তারপর সন্তু দেখলো পাপিয়া সব কিছু গোছাতে শুরু করেছে।

সন্তু বললো,তুমি বড়লোকের একমাত্র কন্যা

আমার কাজ করবে কেন?

—–আমি এসব দেখতে পারি না। আপনি চুপ করে বসুন। আর আমি একবার করে আপনার কাছে গল্প করতে আসবো। তাড়িয়ে দেবেন না তো?

—–না,না আমিও তো একাই থাকি। কথা বলার সঙ্গি পাবো।

—–বাবাকে বলবেন,আমি খুব পড়ি।

—–মিথ্যা বলতে নেই। যা বলার তুমি বলবে। আমি কিছু বলবো না।

—–ঠিক আছে, আপনি ক্যাবলার মতো এসব বলবেন না। বিছানায় বসেছি বা কাজ করেছি।

——আমি এসব ভালোবাসি না।

সন্তু ভাবে মেয়েটা কি চায়? আমার মাথার ওপর বড়ো সংসারের দায়ীত্ব। আমাকে সাবধানে চলতে হবে। একবার ভালোবাসাকে প্রশ্রয় দিলে বেড়ে যাবে কুমড়ো লতার মত। আমাকে শিকড়ে ঘা দিতেই হবে। আমার যে হসত পা বাঁধা, আমার মন পাপিয়া। সংসারের কাছে বেইমান আমি হতে পারবে না আমার মন।

পুজোর ছুটিতে সন্তু বাড়ি এসেছে। মায়ের জন্য সাদা তাঁতের শাড়ি। দুই ভায়ের জন্য জামা,প্যান্ট একই কালারের। বোনেদের চুড়িদার এনেছে। বাড়িতে দুর্গাপুজোর পালা। আগের দিন রাত থেকে সব্জি বনানো,কুটনো কাটা শুরু হলো। অনেক লোকজন বাড়িতে তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা। বড়ো বড়ো গামলায় রেখে সব্জি সব উঠোনে নামানো হলো। কাল সকালবেলা রান্না হবে। সন্তু কে ওর মা বলে,এবার বিয়ে করে নিবি। আমি দোনাগ্রামে মেয়ে দেখে রেখেছি। কথাও বলেছি। মায়ের কথা ফেলতে পারে না সন্তু। সে সম্মতি দিলো। তা না হলে মা দুঃখ পাবেন।

পুজোর ছুটি ফুরিয়ে গেলে সন্তু ফিরে এলো শিলিগুড়ি। এসেই দেখলো,পাপিয়া হাতে একটা চিঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সন্তু বললো,কি এটা।

—-পুজোতে তোমার জন্য লিখেছি।

—থাক,তোমার কাছে থাক। আমার আবার ট্রান্সফারের অর্ডার এসেছে। কাল মোবাইলে মেসেজ পেয়েছি। আজকে নোটিশ পাবো অফিসে।

—-কিন্তু আমি যে অনেক কিছু দিয়েছি তোমাকে। আমার মন,প্রাণ সবকিছু।

সন্তু দরজা খোলামাত্র পাপিয়া জড়িয়ে ধরলো তাকে। চোখের জলে তার জামা ভিজিয়ে দিলো। আর সন্তু তো কাঁদতে পারছে না। পাপিয়ার জন্য তার মন পাপিয়া কতবার যে ডাক দিয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নাই। সন্তুর বাসা বাড়ির টালির চাল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলো, চাঁদ আজ ঢেকে গেছে অন্ধকারে।

৷     ৷ ৷৷৷ দুই৷৷৷৷৷

সংসারে কর্তব্য করে যায় এক জাতীয় মানুষ। তারা নিজের আবেগ,ভালোবাসা বিসর্জন দেয় সকলের জন্য। আর এক জাতীয় মানুষ তাদের প্রয়োজনে ব্যবহার ক’রে দূরে ছুঁড়ে ফেলে। সন্তু এবার বাড়ির কাছে চলে এলো। খেয়ে বাড়ি থেকে বেরোয় সকাল দশটায়।

মা খুব খুশি সন্তুর। বিয়েতে ভালো পাওনা। চাকরী পাওয়া ছেলে। কুড়ি ভরি সোনা।

সন্তুর বিয়েতে কলিগরা সবাই এসেছে। মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। ফোনে পাপিয়ার গলা। বলছে,বজ আমার বিয়ে সন্তুদা। তুমি ভালো থেকো। সন্তু ফোনটা কেটে দিলো। কেউ শুনতে পেলে অসুবিধা হবে। মনকে শক্ত বেড়ি পরিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসলো। বিয়ে হয়ে গেলো। শেষ রাতে অর্ধেক চাঁদের আলোয় সন্তু পাপিয়াকে দেখলো বাগানের মধ্যে। স্বপ্নটা ভেঙ্গে গেলো। আজ বিয়ের পরদিন। কালরাত্রি। বৌয়ের মুখ দেখতে নেই।

ফুলের শয্যায় কাঁটা। বৌ জয়ার শরীর খারাপ। সন্তুর বন্ধুরা পরের দিন বললো,নতুন অভিজ্ঞতা কেমন হলো? সন্তু বললো,ভাগ্য প্রসন্ন নয়। অপেক্ষায় আছি। বন্ধুরা হতাশ।

তারপর খাড়া বড়ি থোর,থোর বড়ি খাড়া।  মামূলী জীবন। চাকরী। দিন কাবার। রাত। ভোর।রান্না।চান।জপ।খাওয়া।সাইকেল। অফিস।

মা বললেন,বোনেদের বিয়ের ব্যবস্থা করেছি

দুই বোনের একই দিনে বিয়ের ঠিক করেছি। তুমি লোন নাও।বৌমার গহনাগুলো দাও।মায়ের কথা অনুযায়ী সব কিছি হলো। জয়া সব সোনা দিয়ে দিলো। দুটো ননদের বিয়ে হলো।

বড় ভাই লন্ডন চলে গেলো সবাইকে ফেলে। ভালো চাকরী পেয়েছে। ছোটোভাই গ্রামেই একটি মেয়েকে প্রেম করে বিয়ে করলো। ভালো চাকরী পেয়ে কলকাতায় চলে গেলো। সন্তু খুশি। মাও খুশি। মা বললেন,সবাই ভালো থাকলেই ভালো। মা কিন্তু সন্তুর কাছেই থাকলেন। স্বামীর ভিটে তার কাছে স্ব র্গ। আর কোথাও তার ভালো লাগে না।

সন্তুর এখন এক ছেলে ও দুই মেয়ে। মাকে সঙ্গে নিয়ে বেশ সুখেই আছে। কিন্তু সুখ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। রুমকি ও ঝুমকি দুই মেয়ে। রুমকি এখন ক্লাস টেনে পড়ে আর ঝুমকি সেভেনে। দুজনেই এক গৃহশিক্ষ কের কাছে পড়তো। রুমকি সেন্ট আপ হলো। কিন্তু ঝুমকি আ্যনুয়াল পরীক্ষায় ফেল করলো। সন্তু আর জয়া খুব বকাবকি করলো। বললো,সারা বছর পড়বি না, তাহলে ফেল করবি না তো কি? গৃহশিক্ষক বললো,যা, গলায় দড়ি দেগা। ফেল করে বসে আছে। ঝুমকির মন খুব খারাপ হয়ে গেলো। সে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকলো। বাড়ির সবাই জানে কিন্তু কেউ একবারও তাকে ডাকলো না। ঝুমকি ভাবলো,কেউ আমাকে চায় না। ভালোবাসে না। সে শুনতে পেলো কে যেনো বলছে গলায় দড়ি দিয়ে মর। সব ঠিক হয়ে যাবে। কে বলছে? সে ভাবলো ঠিকই বলেছে। আমি খারাপ মেয়ে। গৃহশিক্ষক অজয় আমার যৌনাঙ্গে আঙুল দিয়ে রক্তাক্ত করে বলেছিলো। পড়াশোনা তোর হবে না। এইসবই হবে। গলায় দড়ি দেগা। অজয়ের মুখ থেকে মদের গন্ধ পেয়েছিলো। কাউকে বললে, প্রাণে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়েছিলো। সেদিন তার দিদি ছিলো না। দিদিকেও হয়তো ভয় দেখিয়েছে।আবার ভাবছে, আমি মরে গেলে ওই মাতালটা আরও অনেক মেয়েকে মারবে। কিন্তু ওর বেঁচে থেকে কোনো লাভ নেই। বাবা, মা পর্যন্ত আমাকে ডাকলো না। আমার খিদে পেয়েছে। একবারও ডাকলো না। ভাবতে ভাবতে তার ওড়নাটা গলায় গিঁট দিলো। খুব লাগছে। তারপর মাটির ঘরের কড়িকাঠে, ওড়নাটা, পেঁচিয়ে নিলো চেয়ারের ওপর উঠে।তারপর চেয়ারটা লাথি দিয়ে সরিয়ে ঝুলে পরলো। তারপর ভাবছে। কেন করলো এই কাজ। খুব ভুল করলো। মা বাবার মুখ মনে পরলো তার।

সন্ধেবেলায় সন্তু এসে জয়াকে বললো,মেয়েটা খেয়েছে?ঘর খুলেছে?

জয়া বললো,জানিনা, যাও তুমি দেখো।

ঘরের ফাঁক দিয়ে দেখলো মেয়েটা ঝুলছে। সন্তু ভাবে, এই সময় মা থাকলে ভালো হতো। মা ছোটো ভাইয়ের বাড়ি কেন গেলো?

সন্তুর শরীর কাঁপছে থর থর করে। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না।

জয়া দেখতে এলো স্বামীকে, ধপ করে একটা আওয়াজ শুনে। এসে দেখলো,সন্তু অজ্ঞান হয়ে পরে আছে। জয়া দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলো মেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে, ঝুলছে। বাড়ির আশেপাশে যারা ছিলো তাদের চিৎকার করে ডাকলো জয়া। লোকজন এলো।দরজা ভাঙলো। মৃতদেহ নিয়ে চলে গেলো দাহকাজে।

সন্তু আর জয়া দুবছর রাতে ঘুমোতে পারে নি। একটা অপরাধবোধ তাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতো। হয়তো তাদের ভুলে মেয়েটা অভিমানে চলে গেলো অকালে। বড়ো মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলো সন্তু।

জয়া ভাবে তার জন্মকালের কথা। মায়ের মুখে শুনেছে,জন্মমাত্রই তাকে মৃত মনে করে বাড়ির লোকজন ফেলে দিয়েছিলো বাঁশতলায়। আঁতুড় ফেলার জায়গায়। বাগ্দীবুড়ি দেখতে পেয়েছিলো জ্যান্ত মেয়েটাকে।হাত, পা নড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে তুলে নিলো কোলে। খবর ছড়িয়ে পরলো গ্রামে। তখন বাড়ির লোক এসে নিয়ে যায় মেয়ে। বাগ্দীবুড়ি নাম রেখেছিলো জয়া। ও তাদের বাড়ি এসে বলেছিলো,ও জীবন জয় করেছে। তাই ওর নাম জয়া। তারপর জয়া বড়ো হলো। কালো মেয়ে আলো রূপ নিয়ে ভরতি হলো স্কুলে। পড়াশোনায় খুব ভালো। অন্যদের থেকে আলাদা। নীরব শিল্পীর মতো তার স্বভাব। সবাই ভালো বলতো তাকে। তারপর কলেজে ভরতি হলো। কিন্তু কলেজে পড়তে পড়তেই তার বিয়ে হলো। তিন সন্তানের জননী হলো। কাজ হলো হাঁড়ি ঠেলা। আত্মীয়স্বজনের কাছে ভালো হবার ব্যর্থ  চেষ্টা। কম বয়সে শিখলো অনেক। শক্তি জাগ্রত হলো শরীরে,মনে। সহজ পথে চলা শুরু হলো। তেল মাখানো কথাও বন্ধ হলো। শত্রু বাড়লো। তবু সে বললো,কুছ পরোয়া নেহি।

একটা মেয়ে ইচ্ছে করলে পৃথিবীর সব কঠিন কাজ হাসিমুখে করতে পারে। দশভূজা দুর্গা। স্বামীর অফিসের রান্না,ছেলে মেয়েদের স্কুল পাঠানোর পরে বাসনমাজা,কাপড়কাচা ও আরও কত কি? দুপুরবেলা বই নিয়ে  বসে ঘুমে ঢুলে পরতো জয়া। আবার কোনো কোনো দিন ভাবনার সাগরে ডুব দিতো অনায়াসে। মনে পরতো কিশোরীবেলার স্কুলের পথে আলপথের ধারে ক্যানেলের জলে রং বেরংয়ের মাছের কথা। গামছা দিয়ে ছেঁকে তুলতো বায়েনবুড়ো কত মাছ। বায়েন বুড়োর কাছে চেয়ে একটা বোতলে ভরে রাখতো জল। আর তাতে সাঁতার কাটতো ছোটো ছোটো তেচোখা মাছ। পুকুরের ধারে বসতো বুড়ি গিন্নির ছাই দিয়ে বাসন মাজা দেখতে। কি ভালো যে লাগতো। মনে হতো দিই বুড়ির বাসন মেজে। কিন্তু সাহস করে বলতে পারে নি কোনোদিন। সন্ধেবেলা সিধুকাকা পড়াতে আসতো। আমরা মেয়েরা সুর করে পড়তাম একসাথে। তারপর খাওয়ার পরে শোওয়ার পালা। ঠাকুমার পাশে শুয়ে শুনতাম পুরোনো দিনের কত গল্প। গল্প শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পরতাম ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরে। জয়া এইসব ভাবতো আর বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামতো ঘাটে। স্বামী,ছেলে,মেয়েরা চলে আসতো জয়ার স্বপ্ন নীড়ে।  আবার শুরু হতো সংসারের ঘানিটানা কলুর বলদের মতো। দুঃখ,সুখের অপূর্ব মিশ্রণে বয়স কাঁটা এগিয়ে চলে টিক টিক শব্দে।

সন্তু মেয়ের বিয়ে দিলো। তারপর গ্রাম ছেড়ে চলে এলো কোয়ার্টারে। গ্রামের বাড়িতে সবখানে ভেসে উঠতো মৃত মেয়ের মুখ। তাই এই সিদ্ধান্ত। কোয়ার্টারে সন্তুর মন হাঁপিয়ে উঠতো। অফিসে ছুটি পেলেই চলে যেতো মেয়ের শ্বশুর বাড়ি। সেখানে বড়ো মেয়ের মুখ দেখে ভুলে যেতো মৃত মেয়ের মুখ। আর দুই মেয়ের মুখের আদলে দুবছর পরে ঘর আলো করে এলো নাতি। মেয়ের পুত্রসন্তানের মুখ দেখে সন্তু ও জয়া ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে লাগলো।

নাতি ও মেয়ে এসে দুমাস, তিনমাস করে থাকতো কোয়ার্টারে। এবার মন শক্ত করে সন্তু ফিরে এলো গ্রামের বাড়িতে। কোয়ার্টারে তার মন ভারী হয়ে যেতো। নিজেকে হারিয়ে ফেলতো বারে বারে। এবার গ্রামে এসে পুরোনো বন্ধুদের মাঝে সন্তু জীবন খুঁজে পেলো। সব কিছু স্বাভাবিক হলো। চাকরি ছাড়াটা তার ঠিক হল কিনা সে বুঝতে পারে না। ওখানে প্রেমের শিকলি ছেঁড়ার,জন্যই মিথ্যা বলে পালিয়ে এসেছে সন্তু। এখন সময় পেলেই সন্তু ফাঁকা সবুজ মাঠে মন ওড়ায়। উড়তে উড়তে চলে যায় নীলাকাশ ভেদ করে ছোটবেলায় পেরিয়ে আসা পথে। যে পথে শুধু আনন্দ। সংসারের ঘেরাটোপের বন্ধন ডিঙিয়ে খুশিরাজার দেশে। উদাস বাউল খুঁজে ফেরে এখনও সেই দেশ।সংসারে থেকেও কি পাওয়া যায় সেই পরমধন। সন্তু একদিন সমস্ত মায়া ছেড়ে সংসার ছেড়ে চলে গেল অজানার পথে পৃথিবীর আহ্বানে।

🔊🔊🔊🔊🔊🔊🔊🔊🔊🔊🔊🔊🔊🔊🔊

রাজু বিয়ে করার পর ভাবলো এবার তো চাকরি-বাকরি করতে হবে আর বাড়ি ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। সেখানে গুরুদেব আছে সে কোন মতেই বাড়ি ঢুকতে দেবেনা মাকে বশ করে নিয়েছে। সে বিধবা মায়ের আর কোন উপায় নেই সে গুরুদেবের কথামতো ওঠাবসা করে।

রাজু আর শ্যামলী ঠিক করল তারা কেরালা যাবে।সেখানে গিয়ে প্রথমে তারা একটা ঘর ভাড়া করল। কিছু রান্নার সরঞ্জামাদি কিনল। একটা কাজ জুটিয়ে নিল রাজু।সোনার দোকানে। ভালোবাসায় চলে যাাচ্ছিলো তাদের জীবন। ধীরে ধীরে তারা সংসারের সমস্ত নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে নিল।

সোনার দোকানের মালিক রাজুকে খুব ভালোবাসতো রাজুকাকা যে কোন পাখি ছিল না সে মন দিয়ে কাজ করতো। মালিকের সমস্ত কথাবার্তা শুনতো। যেন মালিক তাকে খুব ভালবাসত। এক্সট্রা  টিফিনের পয়সা জমিয়ে রাখত শ্যামলীর জন্য। ছুটির দিনে শ্যামলী কে নিয়ে বাজার করতে যেত সেখানে এসে কিনে দিবো কাচের চুড়ি। কাচের চুড়ি পেয়ে   আনন্দ আর সোহাগ উথলে পড়ত  শ্যামলীর।

রাজু বলল, আমি তো বেশি আয় করি না আমি তোমাকে সোনার গহনা দিতে পারব না শ্যামলী বলল সোনার গহনা আমার প্রয়োজন নেই। এ কাচের চুড়ি আমার বেঁচে থাক সোহাগরূপে।

তারপর দুঃখ শোকে সবকিছু মিলিয়ে তারা বছর পাঁচেক কাটিয়ে দিল কিন্তু তারা কোন সন্তান এখনো পর্যন্ত নেয় নি। রাজু ভাবে বেশ কিছু পয়সা আয় করে বাড়ি ফিরে গিয়ে নিচে জায়গা কিনে ঘর করে তারপর সন্তান নেবে।

শ্যামলী বলে তাই হবে।

মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক মানুষের চিন্তাধারা সঙ্গে বাস্তব জগতের কোনো মিল নেই এখানেও তাই হল রাজু পড়ে গেল মহাবিপদে।

এক বিশাল যুদ্ধ বেধে গেল বিশ্বজুড়ে সে যুদ্ধ অস্ত্রের যুদ্ধ নয়। মারণ রোগ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময় তার নাম নাকি করো না রাজু বলল এই করোনাভাইরাস পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে মানুষ মরে যাচ্ছে লাখে লাখে।

শ্যামলী বলল চলো আমরা আমাদের গ্রামে ফিরে যাই আমাদের গ্রামে ফিরে গেলে আমরা হয়তো এই রোগ থেকে রক্ষা পাবো।

রাজু বলল আরো কিছুদিন থাকি দেখি পরিস্থিতি কি হয় 14 এখন প্রধানমন্ত্রী 21 দিনের লকডাউন ঘোষণা করেছে এখন তো যাওয়া যাবে না তাহলে কি করে কোন যানবাহন নেই কি করে যাবে স্বামী বলল আমরা  প্রয়োজনে হেঁটে যাবো।

রাজু আর শ্যামলী দুজনেই উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছিল কোন রকমে। তারা তাই সংবাদপত্রের সব খবর রাখে। তারা সংবাদপত্র পড়ে। আর বসে বসে ঘরে দিন কাটায়।  রাজুকে এখন কাজ থেকে ছেড়ে দিয়েছে মালিক। ঘর ভাড়া দেওয়া খুব মুশকিল হয়ে যাবে। সামান্য কটা টাকা আছে সেই টাকা থেকে কিছু চাল-ডাল কিনে তারা ঘরে অপেক্ষায় বসে ঘরে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো।

বাড়িওয়ালা দুর থেকে খবর নেন। বলেন, রাজু তুমি কি আর কাজে যাও না?

 রাজু বলে,না মালিক আমাকে ছাড়িয়ে দিয়েছেন।

 এই মুহূর্তে আমাদের বাইরে বেরোনো উচিত নয় মালিক বলেন, তোমার চিন্তা নেই ঘর ভাড়া লাগবে না। ঘর ভাড়া তোমাদের দিতে হবে না তোমরা কোনরকম এখন গ্রামের বাড়ি চলে যাও।

শ্যামলী বলে কাকু আমাদের আর এক সপ্তাহ থাকতে দিন তারপর আমরা ঘর ছেড়ে চলে যাব।

রাজু এই এক সপ্তাহ সময়ে তার লকডাউন এর দিনলিপি লিখে রাখে  তার জীবনের খাতায়। সে দিনলিপি লেখে দিনরাত। শ্যামলী তাকে উৎসাহ দেয়। আজ রাজু লেখে, করোনা আতঙ্কে ২০২০ সালের  ২২ শে মার্চ রবিবার প্রথম লক ডাউন ঘোষণা করলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী। তারপর কিছু সময় কেনাকাটি, বাজার করার পরে টানা একত্রিশে মার্চ অবধি টানা লকডাউন শুরু হয়ে গেল। বেশিরভাগ মানুষ সচেতন কিন্তু অনেকেই বাহাদুরি করে বাইরে যাচ্ছেন। চীনদেশ, ইতালি এরাও প্রথমে গুরুত্ব না দেওয়ার ফলে করোনা ভাইরাস কোভিড 19 ছড়িয়ে পরে সারা পৃথিবীতে। পুলিশ, প্রশাসন কড়া হয়েছেন। কিছু পাবলিক লাথখোড়। তার কিছুতেই নিয়ম মানতে চাইছে না। মুরগির মাংস কিনতে, মাছ কিনতে, মদ খেতে, জুয়া খেলতে বেরিয়ে পড়ছে বাড়ির বাইরে।

সোম, মঙ্গল,বুধ পেরিয়ে গেল। এখনও লকডাউন চলছে। কতদিন চলবে কেউ জানে না। আজ একটা খবরের কাগজে পড়লাম বর্তমান পরিস্থিতি বাংলার।কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আলাদা করে তৈরি করা হচ্ছে ‘‌করোনা চিকিৎসা কেন্দ্র’‌। ৩ হাজার শয্যার করা হতে পারে এই চিকিৎসা কেন্দ্র। নোভেল করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের আলাদা আলাদা জায়গায় নয়, একই হাসপাতালে চিকিৎসা করা হবে। করোনা মোকাবিলায় নতুন এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে রাজ্য সরকার। এখন সুপারস্পেশ্যালিটি ব্লকে ৩০০ শয্যা নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে করোনা–আক্রান্ত এবং সন্দেহভাজনদের চিকিৎসা পরিষেবার ব্যবস্থা। স্বাস্থ্য ভবন সূত্রে খবর, গোটা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালকেই করোনার চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট করে বিশেষভাবে প্রস্তুত করার উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। তবে এদিন বিকেল পর্যন্ত লিখিত কোনও নির্দেশিকা আসেনি। নির্দেশিকা দ্রুত জারি হবে বলে স্বাস্থ্য দপ্তর সূত্রে খবর। সম্পূর্ণ একটি হাসপাতাল যদি শুধুমাত্র করোনা চিকিৎসার জন্য করার ভাবনা–চিন্তা সত্যিই হয় তাহলে রাজ্যে এটি নজিরবিহীন হবে মনে করছেন চিকিৎসকেরা। সূত্রের খবর, সোমবার দুপুর থেকেই নতুন করে রোগী ভর্তি নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে কলকাতা মেডিক্যাল। এখন ৩০০ শয্যা নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে করোনা–আক্রান্ত এবং সন্দেহভাজনদের চিকিৎসা কেন্দ্র। হাসপাতালের ৯ ‌তলার যে সুপারস্পেশ্যালিটি ব্লক রয়েছে সেখানে দুটি তলা রাখা হচ্ছে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য। বাকি ৭টি তলায় করোনা সন্দেহভাজনদের চিকিৎসা করা হবে। নতুন হস্টেলও বর্তমানে ফাঁকা রয়েছে। এদিন মেডিক্যাল কলেজের সমস্ত বিভাগীয় প্রধানদের নিয়ে জরুরি বিভাগ ডাকা হয়। এই সপ্তাহেই সুপারস্পেশ্যালিটি ব্লকে এই পরিষেবা শুরু হয়ে যাবে বলে জানা গেছে। করোনা সংক্রান্ত সব ধরনের চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কলকাতা মেডিক্যালের উপাধ্যক্ষ ডাঃ ইন্দ্রনীল বিশ্বাস জানিয়েছেন, ‘‌করোনা–আক্রান্ত বা সন্দেহভাজন রোগীর সংখ্যা বাড়লে  আমাদের চিকিৎসা দিতে হবে। তাই নতুন রোগী ভর্তি নেওয়া কমাতে হবে। না হলে করোনা–আক্রান্ত রোগীদের জায়গা দেওয়া মুশকিল হবে। আপাতত ৩০০ শয্যার সুপারস্পেশ্যালিটি ব্লকে চিকিৎসা দেওয়া হবে। তবে শুধুমাত্র করোনা রোগীর চিকিৎসা হবে বলে গোটা হাসপাতাল খালি করতে হবে এরকম কোনও লিখিত নির্দেশনামা আমাদের কাছে এখনও আসেনি। যদি নির্দেশ আসে তখন সেইভাবে প্রস্তুতি নেওয়া হবে।’‌  এখন ২,২০০টি শয্যা রয়েছে মেডিক্যালে। সেটি বাড়িয়ে ৩,০০০ করার পরিকল্পনা। স্বাস্থ্য দপ্তরের নির্দেশিকা অনুযায়ী সব হাসপাতালেই পেডিয়াট্রিক, চেস্ট, কমিউনিটি ও জেনারেল মেডিসিন, ইএনটি এবং মাইক্রোবায়োলজিস্ট, ক্রিটিক্যাল কেয়ার স্পেশ্যালিস্টদের নিয়ে মেডিক্যাল বোর্ড করতে হবে। সেই অনুযায়ী এখানেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা রয়েছেন। তবে এখন অন্য অনেক রোগী ভর্তি রয়েছেন যাঁদের চিকিৎসা চলছে এখানে। শয্যা খালি করার জন্য সেই চিকিৎসাধীন রোগীদের দ্রুত অন্য হাসপাতালে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আজও অনেকে বাইরে বেরিয়েছে। কোন বিজ্ঞানসম্মত বারণ মানতে চাইছে না। যদি কাউকে মানা করা হচ্ছে সে তার উত্তরে খিল্লি করছে, হাসছে পাগলের মত। আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বাড়িতে বসে যতটা পারছি ফেসবুকে সাবধানতার পোষ্ট দিচ্ছি। কবিতা, গল্প পোষ্ট করছি। শীর্ষেন্দু বাবুর গল্পের লিঙ্ক পেয়েছি। গল্প পড়ছি। এখন পড়ছি, মনোজদের অদ্ভূত বাড়ি, গল্পটা। ছেলেটা  মোবাইলে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে বলছে, ভয়ঙ্কর অবস্থা, কি হবে বাবা? ওর মা ছেলেকে বকছেন, টেনশন করবি না। সাবধানে থাকবি। হাত, মুখ সাবান দিয়ে ধুবি। চান করবি। তাহলে কিছুই হবে না। বাড়িতে বসে বসে পড়। বাইরে একদম বেরোবি না।ছেলে খুব সচেতন। সে মা কে বলে, মা তুমি কিন্তু হাত কম ধুচ্ছ। রান্না করার আগে হাত ধোও সাবান জলে।আমি জানি, আমাদের এইটুকুই জ্ঞান। আর বেশি কিছু জানি না। তবে বাবা বলতেন, সাবধানের মার নেই। পাশের বাড়িতে জমি জায়গা নিয়ে ঝগড়া চলছে এক চাষীর। চাষী তার গরু উঠিয়ে আল ভেঙ্গে দেয়। আমি জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে থামতে বললাম,বেঁচে থাকলে অনেক বাড়ি হতে পারে। এখন ঝগড়া করার সময় নয়।একজন আমাকে মেসেঞ্জার বক্সে একটা ভিডিও পাঠিয়েছিল। আমার কথা বলা হয়নি তার সঙ্গে। তাই সে রেগে আমাকে ব্লক করে দিল। সব ঝগড়ার সূত্র সেই ভুল বোঝাবুঝি।যাইহোক মেসেঞ্জার কয়েকদিনের জন্য আনইন্সটল করে দিলাম। এখন একটাই চিন্তা পৃথিবীর এই কঠিন রোগ। ভাইরাস আ্যাটাকে সারা বিশ্ব রোগগ্রস্ত। এখন দূরে দূরে থাকার সময়। দূরে থাকলে বাঁচব আর একত্রে সমাবেশ করলে মরব। ভাইরাস মানুষের হাতে হাতে ছড়িয়ে যাচ্ছে চেনের মত। এই চেনকে ভাঙ্গার জন্য লকডাউন।

প্রকৃতি শুদ্ধ হচ্ছে। লকডাউন করার ফলে দূষণ কমছে ব্যাপকহারে।এবার প্রধানমন্ত্রী একুশ দিনের লক ডাউন ঘোষণা করলেন। সচেতনতা প্রয়োজন মানুষের। গ্রামেগঞ্জে কেরালা,মুম্বাই থেকে কাজ করে ফেরা লোকগুলো যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ফলে সংক্রমণ ক্রমশ উর্ধ্বমুখি। আমলা থেকে সাধারণ মানুষের ছেলেপুলে সব একই অবস্থা। রাস্তায় বেরিয়ে সেলফি তুলছে। প্রশাসন কঠোরভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কিছু করার নেই। মানুষের চেতনা জাগ্রত না হলে ধ্বংস হবে সভ্যতা। এখন বাংলায় বসন্তকাল চলছে। পাখি ডাকছে, ফুল ফুটছে। পাখিরা পশুরা উন্মুক্ত  আকাশের নিচে আর মানুষ ঘরবন্দি। মানুষ শক্তিশালী প্রাণী। কিন্তু প্রকৃতির বিচার নিরপেক্ষ। তাই আজ উল্টোচিত্র। প্রকৃতি কি হাসছে। জানি না তবু এটুকু বলতে পারি, ভাবার সময় এসেছে। কল কারখানা, ধোঁয়া আবর্জনায় পৃথিবী কলুষিত। তাই আজ এই প্রতিশোধ।চারিদিক নিস্তব্ধ। খাওয়া আর ঘুমানো ছাড়া কোন কাজ নেই। বাজার করা, মাছ কেনা, স্কুল যাওয়া সব বন্ধ। একটা কোকিল গান শুনিয়ে চলেছে। ফিঙেটা ইলেকট্রিক তারে বসে ডাকছে। ওরা মানুষের মত স্বার্থপর নয়। তাই হয়ত গান শুনিয়ে চলেছে এই দুর্দিনে।  আজকের খবরে শুনলাম, করোনাভাইরাসের জেরে ধাক্কা লেগেছে অর্থনীতিতে। লকডাউনের জেরে উৎপাদন বন্ধ হয়েছে ছোট থেকে বড় সংস্থায়। এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে এসে তহবিল ঘোষণা করল দেশের বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া (এসবিআই)।

এসবিআই সূত্রে খবর, চলতি ২০১৯–২০ আর্থিক বছরে মুনাফার ০.২৫ শতাংশ কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা খাতে করোনা প্রাদুর্ভাবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যয় করা হবে। কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিটি বৃহত্তম সংস্থাকে নিজেদের কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা খাত থেকে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ব্যয় করার পরামর্শ দেয় কিছুদিন আগে। এবার তা পালন করতে চলল এসবিআই।

এসবিআইয়ের চেয়ারম্যান রজনীশ কুমার জানান, ‘এই তহবিলটি মূলত স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে জড়িত। দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা সংক্রান্ত খাতে ব্যবহার করা হবে। এসবিআই ভারতে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি বৃহত্তর পদক্ষেপ নিয়েছে। এই তহবিলটি মূলত সুবিধা থেকে বঞ্চিত মানুষকে স্বাস্থ্যপরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হবে।’‌

তিনি অন্যান্য কর্পোরেট সংস্থার কাছেও এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে টুইটারে লিখেছেন, গোটা দেশ একটা কঠিন সময়ের মধ্যে যাচ্ছে। মানুষের চরম আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়েছেন। সতর্কতামূলক এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি দেশবাসীকে উদারভাবে সহযোগিতা করার আহ্বান জানাই।ভরসা পেলাম। খাবারের জোগানও অব্যাহত থাকবে। রাজ্যসরকার থেকে দিন আনা দিন খাওয়া লোকেদের জন্য সাহায্যের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। সরকার সবদিক ভাবছেন। মানুষই একমাত্র মানুষকে বাঁচাতে পারে। ডাক্তার, নার্স, আয়া, পুলিশ সকলে জীবনকে বাজি রেখে মানুষ তথা পৃথিবীকে বাঁচানোর কাজে লেগে পড়েছেন। এ এক আশার কথা। ভালো লাগছে এই কথা ভেবে যে সকলে রাজনৈতিক জীবনের উর্ধে উঠে মনেপ্রাণে এক হয়ে কাজ করছে। এই অপূর্ব মিলনের বার্তা একমাত্র ভারতবর্ষ দিতে পারে। সকলে তাকিয়ে আছে আমাদের দেশের দিকে। সারা পৃথিবী মিলিত হোক মানবতার মহান জগতে। পৃথিবী ভাল থেক। পৃথবী নিরোগ হও।আজ একটা সংবাদপত্রে পড়লাম, করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া নিয়ে এবার সরাসরি চীনের দিকে আঙুল তুলল আমেরিকা। আর এই আঙুল তুলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আগাম বিপদ সম্পর্কে চীন সতর্ক করলে এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতো না। বেজিংকে সরাসরি এই ভাষাতেই বিঁধলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এমনকী তিনি এই বিষয়ে সামান্য বিরক্ত বলেও মন্তব্য করেছেন। আমেরিকার চিকিৎসকদের সেখানে পরিদর্শনে যেতে দেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ করেছেন ট্রাম্প।এদিকে ট্রাম্প প্রশাসন দেশের যে তিনটি জায়গাকে সংক্রমণের আঁতুড়ঘর হিসেবে চিহ্নিত করতে পেরেছে, সেগুলো হল নিউ ইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া এবং ওয়াশিংটন। তালিকার প্রথমেই আছে নিউ ইয়র্ক। সেখানে ১৫ হাজার নিশ্চিত সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। তার মধ্যে ৫৪১৮টি সংক্রমণ ঘটেছে গত ২৪ ঘণ্টায়। এখনও পর্যন্ত ১১৪ জন মারা গিয়েছেন। একদিনেই প্রাণ গেছে ৫৮ জনের। গোটা আমেরিকায় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৩৫ হাজারের বেশি। মারা গিয়েছেন সাড়ে চারশো।আমি ভাবি দেশের কথা, পৃথিবীর কথা।এখন দোষারোপের কথা বাদ দিয়ে পৃথিবীকে বাঁচাই। সকলের সমবেত চেষ্টায় রোগমুক্তি ঘটুক পৃথিবীর। কারাবাসে যেমন বন্দি থাকা হয় এই গৃহাবাস কিন্তু ততটা বিরক্তিকর নয়। সংসারের মাঝে থেকে একটু একা একা থাকা। একটু রামকৃষ্ণ পড়ি, একটু রবীন্দ্রনাথ পড়ি, একটু জীবনানন্দ বা বিভূতিভূষণ পড়ি। সময় কেটে যাবে আরামসে। দেরাজে রাখা বইগুলো একটু পরিষ্কার করে রাখি। রান্নায় সাহায্য করি স্ত্রীকে। দূরে থেকে সকলকে বাঁচিয়ে চলতে পারলেই জীবনের খোঁজ পাওয়া যাবে।”অসদো মা সদগময়, ত্বমসো মা জ্যোতির্গময় ” এই মন্ত্রে এগিয়ে চলি নিশ্চিন্তে।আবার খবরের কাগজে দেখলাম কি মারাত্মক পরিস্থিতি সারা বিশ্বের। নাকানিচোবানি খাচ্ছে গোটা দুনিয়া। প্রায় সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। মারণ ভাইরাস সংক্রমণে বিশ্বে মৃত ১৭,২৩৫ জন। এ–‌পর্যন্ত মোট আক্রান্ত ৩,৯৫,৮১২। ইতালি এখন মৃত্যুভূমি। গত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে ৬০২ জনের মৃত্যু হয়েছে। সব মিলিয়ে ইতালিতে এখনও পর্যন্ত মৃত ৬,০৭৮। আক্রান্ত ৬৩, ৯২৭। ইতালির লম্বার্ডির অবস্থা ভয়াবহ। ইতালির মোট মৃতের প্রায় অর্ধেক লম্বার্ডির বাসিন্দা। সেখানে মৃত্যু হয়েছে ৩,৭৭৬ জনের, আক্রান্ত ২৮,৭৬১।  বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিতে দেরির কারণেই ইতালির এই অবস্থা। শুধু প্রবীণদেরই নয়, ইতালিতে ৩০–৪০ বছরের কোঠায় যঁাদের বয়স, তঁাদেরও কাবু করছে করোনা। নাজেহাল গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন— সব দেশেই।স্পেনের অবস্থা এখন ভয়াবহ। গত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে মারা গেছেন ৫১৪ জন। মোট মৃত ২,৬৯৬। আক্রান্ত ৩৯,৬৩৭। মৃতদেহ রাখার জায়গা অমিল। অনেক জায়গায় বাড়িতেই পড়ে আছে মরদেহ। স্বাস্থ্যকর্মীরা জানান, মৃতদেহ হিমঘরে রাখা যায়, কিন্তু করোনায় মৃত্যু শুনলে কেউ মৃতদেহ স্পর্শ করছে না। অন্ত্যেষ্টির কাজে নিযুক্ত কর্মীরা পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। অবস্থা মোকাবিলায় নেমেছে সেনাবাহিনী।ওদিকে ফ্রান্সও নাজেহাল। সেখানে মৃত ৮৬০, আক্রান্ত ১৯,৮৫৬। রাজধানী প্যারিসের রাস্তা এখন খঁাখঁা করছে। প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ। কাফে, রেস্তোরঁার ঝঁাপ বন্ধ। লোকজনের দেখা নেই। নিঃশ্বাস ফেলতেও যেন ভয়। কে জানে কখন ভাইরাস ঢুকে পড়ে শরীরে!‌ আতঙ্কে মানুষ ঘরবন্দি। ব্রিটেনেও ক্রমেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে পরিস্থিতি। সেখানে মৃত ৩৩৫। আক্রান্ত ৬,৬৫০। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন দেশে তিন সপ্তাহ লকডাউনের ঘোষণা করেছেন। দেশবাসীকে ঘরবন্দি থাকতে বলেছেন। দু’‌জনের বেশি জমায়েত নিষিদ্ধ। আমোদপ্রমোদের জন্য সপ্তাহ শেষে কেউ পার্ক বা অন্য কোথাও জড়ো হলে নেওয়া হবে কড়া ব্যবস্থা। ওষুধ আর অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দোকান খোলা। বাকি সব বন্ধ। বিয়ে আর ব্যাপটাইজেশনও বন্ধ থাকবে।

এদিকে কানাডায় করোনায় মৃত ২০। আক্রান্ত ১,৪৭৪। সংক্রমণ মোকাবিলায় ৩৪০ কোটি ডলার বরাদ্দ করেছে কানাডা সরকার। সংক্রমণ এড়াতে সকলকেই ঘরবন্দি থাকতে বলছেন। কিন্তু কেউ কেউ আইসোলেশনের তোয়াক্কা করছেন না। তাতেই চটেছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। বলেন, ‘অনলাইনে আমরা অনেক লোকজনের ছবি দেখছি। তঁারা ভাবছেন তঁাদের কেউ দেখতে পাচ্ছেন না। ভাল, তবে আপনাদের দেখা যাচ্ছে। যথেষ্ট হয়েছে। বাড়িতে যান, ঘরেই থাকুন। আমরা নিয়ম মানতে বাধ্য করব। তা লোকজনকে সচেতন করেই হোক বা জোর করেই হোক।’‌‌‌

আমেরিকায় উদ্বেগ তুঙ্গে। মৃত ৫৮২ জন।এ অবস্থায় লক ডাউনে থেকে করোনার চেন ভাঙ্গতে হবে। অন্য কোন উপায় নেই। গ্রাম থেকে শহরের প্রত্যেকটি মানুষকে সচেতন হতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে করোনা মোকাবিলায় কলকাতা পৌরসভার উদ্যোগে জোর কদমে চলছে শহর স্যানিটাইজ করার কাজ। কিভাবে গাড়ি করে সকলের বাড়ির সামনে এসে নিঃশব্দে কাজ করে চলেছে সুন্দর।

বাড়িতে যথেষ্ট খাবার মজুত নেই। ছাড় দেওয়া আছে মুদিখানা, সব্জিবাজারকে। একজন করে পরিবার পিছু ভিড় না করে বাজার করা নিয়ম। কিন্তু এটা একশ চল্লিশ কোটির দেশ। ভিড় হয়ে যাচ্ছে যেখানে সেখানে। পুলিশের টহল চলছে। আমার স্ত্রী পাড়ার  দোকান থেকে চাল, ডাল কিনে আনলেন। আমরা তিনজন। গ্রামের বাড়িতে অন্যান্য সদস্যরা আছেন। তাদের খবর রাখছি মোবাইল ফোনে, হোয়াটস আ্যপে। তাছাড়া উপায় নেই।এক একজন ধনীলোক প্রচুর খাবার মজুত করছেন বাড়িতে। এর ফলে খাবারের অভাব হতে পারে। এক সব্জীব্যবসায়ী বললেন, যার দরকার আড়াইশ আদা তিনি নিয়ে নিচ্ছেন আড়াই কেজি। চড়া দাম দিতে তারা প্রস্তুত। এ এক অদ্ভূত মানসিকতা। তারা বলছেন, নিজে বাঁচলে বাপের নাম থাকবে। তবু সবাইকে নিয়ে চলতে হয়। জীবনের চরম মুহূর্তের কথা তারা ভুলে যায়। কত রাজার ধনে মরচে পরেছে ইয়ত্তা নেই। শিক্ষা নিতে হয় অতীতের কাছে। আমার পাশের বাড়ির সকলেই কিছু খাবার কিনলেন। একুশ দিন যাওয়ার মত। কম খেতে হবে। প্রকৃতি তার হারানো ছন্দ খুঁজে পাচ্ছে জেনে আনন্দ হল। পাঁচশ বছর আগে পৃথিবীর জলবায়ু যেমন ছিলো সেরকম হতে চলেছে পৃথিবী। প্রকৃতি সব দিক দিয়ে মারেন না। একদিক ভাঙ্গলে আর একদিক গড়ে  দেয়। আশার অনেক কিছু আছে। “আশায় বাঁচে চাষা। “

আমার স্ত্রী বাজারে গেছিলেন  আজ। দোকানে দড়ি দিয়ে মেপে এক মিটার দূরে ইঁট পাতা আছে।লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন গ্রাহকরা,।পুলিশ পর্যবেক্ষণ করছেন বাজার, রাস্তা। জরুরি অবস্থায় সকলে চিন্তিত। কি করে একুশ  দিন কাটবে। কাটবে ঠিকই। আবার ফুটবে ফুল। আবার হাসবে শিশু পৃথিবী।

আজ ঘুম থেকে একটু দেরি করে উঠলাম।এখন সকাল নয়টা বাজে ঘড়িতে। চা মুড়ি আর প্রেশারের ওষুধটা খেলাম। সাবান দিয়ে হাত ধুয়েছি অবশ্যই।খবরের কাগজ পেলাম।হেডিং -ভালবাসার দেশ কিউবা।

করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করতে ইতালিতে একটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদল পাঠিয়েছে কিউবা। দেশটি জানিয়েছে, ইতালির অনুরোধে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও নার্সের একটি ব্রিগেড রওনা হয়ে গেছে। করোনায় জর্জরিত ইতালির লমবার্দি অঞ্চলে কাজ করবে তারা।১৯৫৯ সালে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর থেকেই বিশ্বজুড়ে বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলোর দুর্যোগ মোকাবেলায় কমিউনিস্টশাসিত কিউবা প্রায়ই তাদের ‘সাদা পোশাকের বাহিনী’ পাঠিয়ে আসছে। এর আগে হাইতিতে কলেরা এবং পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলার বিরুদ্ধে লড়াইয়েও দেশটির চিকিৎসকরা সামনের কাতারে ছিলেন।এবারই প্রথম কিউবা বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ ইতালিতে ৫২ সদস্যের শক্তিশালী একটি দল পাঠাচ্ছে; যার মাধ্যমে দেশটি তাদের ‘চিকিৎসা কূটনীতির’ বড় ধরনের নজিরও স্থাপন করতে যাচ্ছে। নভেল করোনাভাইরাস মোকাবেলায় এ নিয়ে কিউবার ষষ্ঠ মেডিকেল ব্রিগেড অন্য কোনো দেশের উদ্দেশে রওনা হলো। দেশটি এর আগে তাদের সমাজতান্ত্রিক মিত্র ভেনিজুয়েলা, নিকারাগুয়ার পাশাপাশি জ্যামাইকা, সুরিনাম ও গ্রেনাদাতেও চিকিৎসকদল পাঠিয়েছে। শনিবার ইতালির উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে চিকিৎসকদলের সদস্য ৬৮ বছর বয়সী লিওনার্দো ফার্নান্দেজ বলেন, ‘আমরা সবাই বেশ ভীত, কিন্তু আমাদের বিপ্লবী দায়িত্ব আছে, তাই আমরা আমাদের ভয়কে একপাশে সরিয়ে রেখেছি।

এদিকে চিনের অবস্থাও ভাল নয়। আমার কাটোয়া শহরে করোনা আক্রান্ত রোগী এখনও অবধি একটাও পাওয়া যায়নি। পুলিশ তৎপর আছে। বাইরে বেরোলেই পিটুনি খাচ্ছে আনাড়ির দল। ঘরে বসে ছেলেটা বই পড়ছে। আরণ্যক।আমিও মাঝে মাঝে পুরোনো স্মৃতি ঝালিয়ে নিচ্ছি। শীতের পোশাকগুলো গুছিয়ে রাখলাম। বসন্ত কেমন ম্লান হয়ে রয়েছে। একটা সবুজ ছোট্ট পাখি শিউলি গাছে বসে আছে। স্ত্রী রুটি বেলছে। জলখাবারের জন্য। এতদিন তো ঘরে বসে থাকার সুযোগ পাই না। বেশ লাগছে সপরিবারে একসঙ্গে থেকে। দোকানপাট যা করার লকডাউনের আগেই করা হয়েছে। সরকার থেকে খাবার বিতরণের কাজ শুরু হবে। ভবঘুরের দল ব্লক অফিস আর স্কুলগুলোতে ঠাঁই পেয়েছে। দুদিনের ঘর। তারপর তাদের ঘর ছেড়ে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়াতে হবে।

প্রতি বছর রথ যাত্রার ঠিক আগে ভগবান জগন্নাথ স্বয়ং অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর জ্বর এবং সর্দি কাশি হয়; অসুস্থতার এমন পরিস্থিতিতে তাঁকে Quarantine করা হয় যেটাকে মন্দিরের ভাষায় অনাসর বলে। ভগবানকে ১৪ দিন পর্যন্ত একা বাস মানে isolation এ রাখা হয়। হ্যাঁ, ঠিক ১৪ দিন। এই সময় ভগবানের দর্শন বন্ধ থাকে এবং ভগবানকে জড়িবুটি আর জল খাবার দেওয়া হয় মানে Patients Diet,  আর এই পরম্পরা হাজারাে বছর থেকে চলে আসছে।আর এখন ২০ শতাব্দীতেও বলা হলো isolation & Quarantine এর সময় ১৪ দিন! আগের সেই বিজ্ঞান ভিত্তিক জীবন কৌশল যা আজও বিশ্বকে পথ দেখাচ্ছে!..১৪ দিন জগতের প্রভু জগন্নাথ যদি মানেন Isolation / Quarantine / light diet আমাদের কেন তা মানায় অসুবিধা?  ভগবানকে মেনে,  চাহিদা কমিয়ে এই ক’দিন আমরা তাঁর দেখানো পথে একটু চলিইনা! কিন্তু কিছু লোক আড়ালে মশারি টাঙিয়ে তাস খেলছে। জুয়ো খেলছে। কোন আইন মানতে চাইছে না। একজন মহাপুরুষ বলেছিলেন, আমাদের দেশে কম করে দুবছর মিলিটারি শাসনের প্রয়োজন আছে। তার কথাই ঠিক। তবে যদি এরা কিছু নিয়ম শেখে তাহলে দেশের দশের উপকার।

ভারতবর্ষ ত্যাগের দেশ। আজ খবরে জানলাম, শিক্ষকরা যে যেমন পারছেন দান করছেন। এক শিখ মহাজন কয়েকলক্ষ টাকা দান করেছেন পাঞ্জাবের পিড়িতদের জন্যে। বাংলায় এক গ্রামের ধনী কয়েকলক্ষ টাকা দান করলেন পিড়িতদের কল্যাণে। খবরে প্রকাশ, রাজ্যে আক্রান্ত বেড়ে ১০। কলকাতার নয়াবাদের এক প্রৌঢ়ের শরীরে মিলল করোনার নমুনা। আশঙ্কা, কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের।

গত ২৪ ঘণ্টায় রাজ্যে একটিও করোনা আক্রান্তের সংবাদ না আসায় একটু স্বস্তিতে ছিল বাংলার মানুষ। কিন্তু বুধবার রাতেই সেই স্বস্তিতে জল পড়ল। ৬৬ বছরের ওই বৃদ্ধ সোমবার হাসপাতালে ভর্তি হন। বুধবার রাতে রিপোর্ট মেলে। তাঁর বিদেশ ভ্রমণের কোনও খবর এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তাঁর পরিবারের কেউ সম্প্রতি দেশরে বাইরে গিয়েছিলেন বলেও জানা যায়নি। রাজ্যে আশঙ্কা বাড়ল। এটি তৃতীয় পর্যায়ের শুরু কিনা ভেবে। এখনও পর্যন্ত কোনও সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছে না। জিজ্ঞাসাবাদ চলবে বলে সূত্রের খবর।

একের পর এক বাড়তেই থাকবে নাকি রোগীর সংখ্যা। কিছু বোঝা যাচ্ছে না। পরিস্থিতির উপর নজর রাখছি ঘরে থেকে।

আমি কাটোয়া পৌরসভার কুড়ি নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা।পৌরসভা থেকে বারবার মাইকিং করা হচ্ছে।সবরকম সাহায্য করার পাশাপাশি সচেতনাতামূলক প্রচারও চলছে।কাটোয়া পৌরসভা, কাটোয়া হাসপাতাল, পুলিশ ও প্রশাসন সবাই নিজেদের সাধ্যমতো চেষ্টা চালাচ্ছেন যাতে করোনা মহামারী রুখে দেওয়া যায়।মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, কাটোয়ার সর্বস্তরের জনসাধারন আমাদের যে ভাবে সাহায্য করছেন তাতে আমরা আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। এতো দিন গৃহবন্দী থাকা যথেষ্ট কষ্টকর এটা আমরা বুঝি। কিন্তু এই মারনব্যাধি থেকে মানবসভ্যতা কে রক্ষা করার এটাই এক ও একমাত্র উপায়।আপনাদের প্রতি আমাদের বিনীত আবেদন –  বাজার করা অথবা মুদি / রেশন / ওষুধের দোকানে কিছু কিনতে যাবার সময় প্রত্যেকে প্রত্যেকের থেকে অন্তত ৬ (ছয়) ফুট দুরত্ব বজায় রাখুন। খুব প্রয়োজন না থাকলে বাড়ির বাইরে বেরোবেন না। অন্যথায়, অন্যের থেকে সংক্রমন আপনার তথা আপনার প্রিয়জনের মধ্যে ছড়াতে বেশি সময় নেবে না।রাস্তায় একসাথে জড়ো হবেন না। ডাক্তারবাবুর পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাবেন না। সর্বোপরি,  নিজে সুস্থ থাকুন, নিজের পরিবারকে ভালো রাখুন তাহলেই সমাজ ব্যাপকার্থে মানব সভ্যতা রক্ষা পাবে।

কেউ শুনছে কেউবা শুনছে না। মাছ, মাংস খাওয়ার লোভে অনেকে বেরিয়ে পড়ছেন বাইরে। এটা সংযমের সময়। সংযত হয়ে চলার সময়। এটা ভাবতে পারলেই সমস্যার সমাধান হয়।

আজ খবরে পড়লাম আবার একই বিষয়ে। করোনা। করোনা। করোনা। খবরের কাগজ আর ফেসবুকের খবর ছাড়া বাইরে বেরিয়ে খবর নেওয়া উচিত নয়। তাহলে এত পরিশ্রম বৃথা যাবে। আজকের খবরে প্রকাশ, ইতিমধ্যেই করোনা আতঙ্কে জেরবার দেশের মানুষ। করোনা আতঙ্ককে সাথে নিয়ে দেশের পরিস্থিতি রীতিমতো উদ্বেগজনক। সারা দেশবাসীর কাছে এখন একটাই লক্ষ্য, কিভাবে করোনার হাত থেকে পরিত্রাণ পাবেন তাঁরা? দেশের প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা একযোগে করোনার সংক্রমণকে মহামারী হওয়া থেকে আটকাতে শুরু করেছে লকডাউন। সরকারিভাবে নোটিশ জারি করা হয়েছে এই মুহূর্তে দেশের কেউ যেন কোন রকম জমায়েতে শামিল না হন।

করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছিল চীন থেকে। সেখান থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে যায়। যার মধ্যে ভারত অন্যতম। অন্যদিকে, এই মুহূর্তে বিজ্ঞানীরা আশার কথা শোনাচ্ছেন ভারতকে নিয়ে। এই মুহূর্তে একদিক দিয়ে যেমন ভারতে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে, সেরকম অন্যদিক দিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়েও সুস্থ হয়ে উঠছেন বেশ কিছু জন। যদিও সে সংখ্যা আক্রান্তের তুলনায় অত্যন্ত কম। কিন্তু তা সত্বেও সুস্থ হওয়ার খবর নিঃসন্দেহে খুশির বলেই মনে করা হচ্ছে।

এখনো পর্যন্ত ভারতে 37 জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন বলে স্বাস্থ্যমহল সূত্রে জানা গেছে।  ভারতে আক্রান্ত হয়েছেন 492 জন। তার মধ্যে মারা গেছেন এখনো পর্যন্ত ন জন। করোনা সংক্রমণের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া 37 জনের মধ্যে 11 জন ইতালীয় পর্যটক রয়েছেন। যাঁদের সুস্থ হওয়ার পর ইতালীয় দূতাবাসের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে, চীনের পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে বলে খবর। তবে সাংবাদিক সূত্রে জানা গেছে, করোনা সংক্রমণ এর মধ্য দিয়ে চিনে আসিম্পটোমেটিক রোগী ধরা পড়ছে। নাও ঠেলা। এক রোগে নিস্তার নেই আবার শঙ্করাকে ডাকে। অন্য আর একটি রোগ যেটি ইঁদুরবাহিত ক্রমশ ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ছে জানালো চিন সরকার।

আজকে একটা ভাল খবর শুনলাম, নবান্নে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী জানান, শহরের একাকী থাকা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের যাতে কোন অসুবিধা না হয় সে খেয়াল আমাদেরকেই রাখতে হবে। কোন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা খেতে পারছে না বা প্রয়োজনীয় ওষুধ পাচ্ছে না জানতে পারলে সেই হাউসিং কম্প্লেক্সকে তিনি সঙ্গে সঙ্গে জেলাশাসক মহকুমা শাসক বা পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করার আবেদন জানান। প্রশাসন প্রয়োজনীয় চাল ডাল থেকে শুরু করে ওষুধ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেবেন। পাশাপাশি এই পরিস্থিতিতে সকলকে মানবিক থাকার অনুরোধ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। জানিয়েছেন, “কারোর জ্বর হলে তাকে সামাজিকভাবে বয়কট করবেন না। প্রয়োজনে স্থানীয় থানায় খবর দিন পুলিশ অসুস্থ ব্যক্তির চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে”অন্যদিকে ভবঘুরেদের উদ্দেশ্যে নাইট শেল্টারে তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই ভবঘুরেদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন তারা যেন কর্পোরেশনের স্কুল এবং কমিউনিটি হল গুলোতে যেখানে ব্যবস্থা করা হয়েছে সেখানে থাকেন। খাবারের ব্যবস্থা পুলিশ এবং কর্পোরেশগুলি, করে দেবে। শুনে মনটা একটু হাল্কা হল। কত অসহায় ভবঘুরে পাগল মানুষ থাকে রাস্তায়। তারাও ভাল থাকুক। ভাল থাকুক ভালবাসা। রাস্তায় যখন যেতাম এই রোগ আসার আগে। তখন দেখতাম কত গোসাপ, সাপ, শেয়াল,  কুকুর চাপা পড়ে মরে আছে মানুষের দাপাদাপিতে। এখন আর তারা চাপা পড়বে না একুশ দিন। শান্তিতে ঘুরতে পারবে। আমরা ভুলে যাই তারাও এ পৃথিবীর অংশিদার। তাদের ঠকিয়েছি আমরা। তার মাশুল গুণছে মানুষ।

ক্রিকেটার সৌরভ থেকে আমজনতার অনেকেই মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দান করছেন অভুক্ত মানুষের কথা ভেবে। সব স্তরের মানুষ মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। জ্বালা যন্ত্রণা অত্যাচার বেড়ে গেলে ফিরে ফিরে আসে সমোচ্চশীলতার ধর্ম। সে যে রূপেই হোক। কখন রোগ মহামারী বা প্রলয়। তার বিচারের কাছে গরীব ধনী নেই। তার বিচারের কাছে শিক্ষিত অশিক্ষিত নেই। সব সমান করে নবরূপে তৈরি করেন প্রকৃতির প্রতিমা। আজকে একটা খবর পড়লাম,  করোনা ভাইরাসের কারনে পৃথিবীর প্রায় ৭৫% ছোট বড় ইন্ডাস্ট্রিজ বন্ধ হয়েছে। আকাশ পথে বিমান চলাচল বন্ধ হয়েছে। পৃথিবীর প্রায় ৮০% যানবহন চলাচল বন্ধ হয়েছে।ভারী অস্ত্রের মহড়া বন্ধ হয়েছে। পৃথিবীজুড়ে লকডাউন আইনের কারনে মানব সৃষ্ট দূষণ বন্ধ হয়েছে।হাঁচি, কাশি ঠান্ডাজনিত রোগ থেকে দুরে থাকতে সবাই এয়ার কন্ডিশন চালানো বন্ধ রেখেছে। করোনা থেকে বাচঁতে নিজের শরীর থেকে শুরু করে  বাড়ির আশে পাশের আঙ্গিনা পরিষ্কার রাখছে। যত্রতত্র বিশেষ করে পলিথিন বা প্লাস্টিকের ব্যবহার কমে এসেছে।এ সব কিছুর ফলে নাসার দেয়া তথ্যমতে পৃথিবীজুড়ে নাইট্রোজেন গ্যাস ও কার্বন এমিশনের মাত্রা ২৫% কমে এসেছে।

ফলে প্রকৃতি তার নতুনরূপে সাজতে বসেছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা কমে এসেছে। গ্রীনল্যান্ড ও এন্টার্কটিকায় গলে যাওয়া বরফ আবার জমতে শুরু করেছে।যেখানে নিজের ঘরের মানুষকে আটকিয়ে রাখা যায় না। সেখানে ৭০০ কোটি মানুষকে কিভাবে সম্ভব? হয়তো সৃষ্টিকর্তা করোনার অছিলায় ৭০০ কোটি মানুষকে আবদ্ধ করে প্রকৃতি মেরামত করে দিচ্ছেন। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ পৃথিবী কে একটু একটু করে ধ্বংস করে যাচ্ছিলো।করোনায় সৃষ্ট মহামারীতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পরবে বিশ্ব অর্থনীতিতে। কিছু কিছু দেশে দুর্ভিক্ষের ন্যায় আঘাত হানবে।

আজ আমাদের প্রতিটি সরকারের প্রতি আনুগত্য দেখানোর সময়। তারা আমাদের ভাল চাইছেন। বিশ্ববাসি প্রত্যের মঙ্গলের জন্য ঘরবন্দি থাকাটা কোন ব্যাপার নয়। এই ফাঁকে যে যার শখের কাজগুলি মন দিয়ে করতে পারবেন। ভাঙ্গা মচকা কুচটপড়া সম্পর্কগুলো মেরামত করে নিতে পারবেন। বিপদের বন্ধু প্রকৃতির সঙ্গে ভাব জমিয়ে ‘অমলের’ মত জানালা দিয়ে পাখি আর গাছের সঙ্গে মিত্রতা করলে দেখবেন কখন অজান্তে সময় উধাও হয়ে গেছে আনন্দে। এখন আর কান্নার সময় নয়। মন মিলিয়ে দূরত্বে থাকার সময়। মনের মিল থাক ফোনে, হোয়াটস আ্যপে আর মেসেঞ্জারে। দেহের দূরত্ব বজায় থাক। মশা মাছি থেকে নিজেকে বাঁচান। আর কত দিন বলে হা হুতাশ না করে ভাল থাকুন।

রাজ্যে লকডাউনের তৃতীয় দিন এবং দেশে প্রথম দিনে পরিস্থিতি কলকাতাসহ গোটা রাজ্যে একইরকম। তবে, কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় এবং লাগোয়া জেলাতে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কিছু মানুষ লকডাউনের নিয়ম ভেঙেছেন। পুলিশ কঠোর হাতে তা দমন করেছে। অনেক জায়গাতেই বাইক নিয়ে ঘোরাঘুরির জন্য পুলিশ তাড়া করেছে। এখনও পর্যন্ত কলকাতা পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে ১৩০২ জনকে। এর মধ্যে ৬৪০ জন গ্রেপ্তার হয়েছে মাতলামোর জন্য। এবং লকডাউন ভাঙার জন্য ৬৬২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কলকাতার নগরপাল অনুজ শর্মা জানিয়েছেন, প্রত্যেককে অনুরোধ করা হচ্ছে বাড়িতে থাকুন। এবং প্রশাসনকে সাহায্য করুন।

 কলকাতায় শৃঙ্খলার চিত্রও দেখা গেছে। বেলেঘাটা, উল্টোডাঙা, গুরুদাশ দত্ত গার্ডেন লেনে বহু মানুষ রাস্তায় এঁকে দেওয়া বৃত্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছেন। সহনাগরিকের থেকে দূরত্বে দাঁড়িয়ে ওষুধপত্র, বাজারহাট সবই করেছেন। ওষুধের দোকানগুলিতে প্রচুর ভিড় দেখা গেছে। বেশি টাকার ওষুধ কিনলে যে ছাড় পাওয়া যেত, এখন তা দেওয়া হচ্ছে না। অড়েক জায়গায় চাহিদামতো ওষুধও নেই। হাওড়া ব্রিজে এদিন অন্য চিত্র দেখা গেল। ব্রিজের একটা দিক দিয়েই গাড়ি যাতায়াত করবে। বাকি অংশ আটকে রাখা হয়েছে। ব্রিজের দুপারেই পুলিশ মাস্ক পরে দাঁড়িয়ে। গাড়ি নিয়ে কেউ গেলেই, থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। বড়বাজারের ক্যানিং স্ট্রিটের ছবিও একইরকম। সমস্ত বড় বড় ব্যবসায়িক কেন্দ্রগুলোর মূল ফটকে তালা। নিয়মশৃঙ্খলা ঠিক রাখার জন্য কয়েক জায়গায় র‌্যাফ টহল দিচ্ছে। ধর্মতলা জনহীন। শিয়ালদা স্টেশনের ছবিও এক। তবে কয়েক জায়গায় দেখা গেল দু’একটি সরকারি বাস চলছে। সাইকেল চালিয়ে কাজে যোগ দিতে চলেছেন অনেকে। টিভি আর মোবাইলে চিত্রগুলি দেখতে পাচ্ছি।বাইরে না বেরিয়ে বাইরের খবর জানতে পারা এক সুন্দর ব্যাপার। বেশ লাগছে। অনেকে ফোন করে খবর নিচ্ছেন। এক দাদা বললেন, মানুষ এত পাপ করছে যে সবকিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।ধর্ষণ,খুন বেড়েই চলেছে। অথচ এই কয়েকদিনের গৃহবন্দি অবস্থায় সব পাপ কমে গেছে। পুলিশ, প্রশাসন রাস্তায় মাস্ক পড়ে টহল দেওয়ার সুফল মিলছে। এর ভাল দিক আছে অনেক।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে মহাভারতে আঠারোদিন যুুুদ্ধ চলেছিল আজ করোনা রোগের বিরুদ্ধে 21 দিনের যুদ্ধ চলবে।  এ যুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে। মানুষ চেষ্টা করলে সব পারে 21 দিন কেন 21 মাস হলেেও প্রয়োজনে ঘরে থাকবে। তা না হলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। অনেকেই চাল-ডাল মালমশলা সবজিতেে  ঘর ভরে নিচ্ছেন কিন্তু এতটা স্টক করা একজনের পক্ষে ঠিক না।সবাইকে বাঁচতে হবে সকলের জন্য চিন্তা করতে হবে তবেই” ধন্য রাজার পূণ্য দেশ” ।

নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, অর্থনীতিকে এর মাসুল গুনতে হতে পারে। আর  ব্রিটিশ ব্রোকারেজ সংস্থা বার্কলেজ় সমীক্ষায় জানাল, সম্ভাব্য সেই ক্ষতির অঙ্ক প্রায় বারো লক্ষ কোটি টাকা।

গরীব ভ্যানচালক, রিক্সাচালক সকলের কথা চিন্তা করছেন সরকার। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে কাজ করছেন সরকার বাহাদুর। এ এমনএক সময় যখন সঠিকভাবে কিছু বলা যায় না। শুধু নজর রাখা আর অনুশাসন মান্য করাই ভারতবাসী তথা দেশবাসীর কর্তব্য।

কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য এবং পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী-ভারতে আজ দুপুর পর্যন্ত করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৭৩।  তাঁদের মধ্যে বিদেশি নাগরিকও রয়েছেন। দিল্লিতে সংক্রমিত ৬ জন,  হরিয়ানায় ১৪ জন (প্রত্যেকেই বিদেশি নাগরিক),  কেরলে ১৭ জন, রাজস্থানে ৩ জন (একজন ভারতীয় নাগরিক এবং দু’জন বিদেশি নাগরিক), তেলেঙ্গানায় আক্রান্ত একজন, উত্তর প্রদেশে ১১ জন (১০ জন ভারতীয় নাগরিক এবং একজন বিদেশি নাগরিক), কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল লাদাখে আক্রান্ত ৩ জন,  তামিলনাড়ুতে একজন, জম্মু ও কাশ্মীরে একজন সংক্রমিত, পাঞ্জাবে আক্রান্ত একজন এবং কর্ণাটকে করোনায় সংক্রমিত ৪ জন। এইভাবে বাড়তে থাকলে তৃতীয় সপ্তাহে দ্বিগুণহারে বাড়তে থাকবে রোগীর সংখ্যা।অনেকে এটাকে আমল না দেওয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। ইতালির কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত সকলের। ওরাও প্রথমে বাড়ির বাইরে বেরোনো  বন্ধ করেনি।

সবথেকে আনন্দের খবর পশুপাখিরা আনন্দে বিচরণ করছে। দূষণের পরিমাণ কমে গিয়ে অনেক রকম পাখির আনাগোনা বেড়ে গেছে আশ্চর্যভাবে। আমরা যদি মাসে একদিন লকডাউন করে যাই নিয়মিত তাহলে হয়ত পৃথিবীর পরমায়ু বেড়ে যাবে। এ এক আশার বার্তা।

এখন অফুরন্ত সময়। পড়ছি,   শুনছি ফেসবুকে পোষ্ট দিচ্ছি জনসচেতনতামূলক।খবরের কাগজ আছে।  আমি আর কতটুকু জানি। তবু জানার ইচ্ছে, পিঠে কুঁজ নিয়ে চিত হয়ে শোওয়ার বাসনা। করোনা ভাইরাসে আতঙ্কিত গোটা বিশ্ব। ভারতেও তা মহামারির আকার নিচ্ছে। রাজ্যে যাতে করোনা ভয়াবহ আকার ধারণ না করতে পারে, তার জন্য জনগণকে প্রতিদিন সতর্ক করে যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। রাজ্য সরকার করোনা ঠেকাতে একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে। লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে অনেকদিন।  করোনা মোকাবিলায় জরুরী ত্রাণ তহবিল গঠন করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে রাজ্যের শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, প্যারাটিচার, পার্টটাইম টিচার সহ শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত সবাইকে ত্রাণ তহবিলে মুক্তহস্তে দান করার জন্য আবেদন করলেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ও তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চ্যাটার্জি। তিনি বলেছেন, ‘আর্থিক বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যা পরিস্থিতি তাতে আগামীদিনে আর্থিক অভাব ঘটবে। আমাদের এই আর্থিক সঙ্কটের মোকাবিলা করতে হবে। এই পরিস্থিতিতে আমরা একজোট হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পাশে দাঁড়াব।’‌ পাশাপাশি তিনি দলের বিধায়কদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনাদের যতটুকু সামর্থ্য, সেই অনুযায়ী এই ত্রাণ তহবিলে সাহায্য করুন। বিধানসভা থেকে যে ভাতা পান, তার কিয়দংশ অনুদান ত্রাণ তহবিলে দিন। আপনারা যা ভাল বুঝবেন, তাই করুন। যেভাবেই হোক করোনার সঙ্গে আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। মমতার পাশে দাঁড়ান।’‌ পাশাপাশি তৃণমূলের শিক্ষা সেল ও গণ সংগঠন এবং বামপন্থীদের কাছেও পার্থ চ্যাটার্জি সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করেছেন।

সকলের সমবেত প্রচেষ্টায় পৃথিবীর এই গভীরতম অসুখ সেরে যাবে একদিন।

” একদিন ঝড় থেমে যাবে

একদিন পৃথিবী শান্ত হবে “।

এক সপ্তাহ পরে রাজু আর শ্যামলী রাস্তায় নামল। রাস্তায় নেমে তারা দেখলো কোনও যানবাহন নেই পুরো রাস্তা ফাঁকা এদিকে ঘরছাড়া হয়ে গেছে ঘর ভাড়া দিয়ে তাকে জবাব দিয়ে আসা হয়েছে সেখানেও ফিরে যাওয়ার কোন উপায় নেই এখন তারা কি করবে তারা বসে পড়লো রাস্তার ফুটপাতের উপর দূরে।

তাদের অসহায়ত্ব ভিখারি ভেবে পুলিশ তাদের হাতে খাবারের প্যাকেট তুলে তুলে দিল তারা আনন্দে খেলো কিন্তু খাওয়া-দাওয়া পর ভাবলো কি করে গ্রামে ফিরবে এখনতো বাস-ট্রেন কিছুই নেই তারা কেন যে ঘরটা ছাড়লো এতটা বুঝতে পারেনি রাজু বলল আগে যদি বাইরে বেরিয়ে একটু দেখে নিতাম শ্যামলী বলল বাইরে বেরোবে কি করে কোন কারন ছাড়া তো বাইরে বেরোনো যাবে না।

রাজু বলল যদি কোন রকমে আমরা গ্রামে যাই তাহলে বাড়িটা কোথায় করব।

 শ্যামলী বলল অত চিন্তা করো না। গ্রামে ফিরে আমরা এটাও তো দেখতে পারি যে হয়তো গুরুদেব মরে গেছে। তোমার মা একা। সেখানে হয়তো আমরা গেলে অসহায়ের সহায় হবো। আমরা তোমার বিধবা মাকে  দেখাশোনা করতে পারবো।

রাজু দেখল তাদের অদূরেই একজন সাধুবাবা বসে আছে তার লম্বা লম্বা দাড়ি। আর বগলে গেরুয়া রঙের কাপড় পড়ে বসে আছে। শ্যামলী আঙ্গুল দেখিয়ে বলল ওনার সঙ্গে একটু কথা বললে হয় না। উনিও তো আমাদের মত অসহায়।

রাজু তিন ফুট দূরত্ব রেখে বলল ও সাধু বাবা আপনি কোথায় যাবেন এখানে বসে কেন সাধুবাবা উত্তর দিল আমিও পশ্চিমবাংলায় যাব কিন্তু কোন বাস বা ট্রেন পাচ্ছিনা রাজু বলল আমরাও তো পশ্চিম বাংলার লোক কিন্তু যানবাহন না পাওয়ায় আমরা এখানে বসে আছি আর কতদিন বসে থাকবে চলো হাঁটতে শুরু করি।

সাধুবাবা পথ চলতে শুরু করল রাজুয়া শ্যামলী তার পিছনে সাধুবাবা সাধুবাবা জিজ্ঞেস করল রাজউকের তোমার নাম কি রাজু বলল আমার নাম রাজু শ্যামলী বলল আমার নাম শ্যামলী শ্যামলী বাবা আপনার নাম কি আমার নাম ছিল এখন আর নেই আমার নাম ছিল সন্তু আমি একটা সরকারি চাকরি করতাম কিন্তু আমার সারা দেশ দেখার শখ মিটলো আজ আমি ঘুরে ফিরে এসে কেরালাতে আশ্রয় নিয়েছি আজ দুই মাস হল এখন আতঙ্কে সমস্ত বন্ধ হওয়ায় আমার গ্রামে যাওয়ার পথে যতদূর চোখ যায় আমরা হেঁটে যেতে পারবো।

সাধু বাবা ও রাজু কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলল।  কথা বলছে শ্যামলী। কাঁধে একটা ব্যাগ। রাজুর কাঁধে একটা ব্যাগ আর সাধুবাবার বগলের ঝোলা। তিনজনেই হেঁটে চলেছে। হাঁটছে তো হাঁটছেই। পথের কোনো শেষ নেই। হেঁটে কি  কেরালা থেকে পশ্চিমবাংলা যাওয়া চাট্টিখানি কথা। বিরাট কঠিন ব্যাপার। তারা প্রায় 10-12 মাইল হেঁটে তারপর আবার  বসলো তখন সন্ধ্যা প্রায়। আর পুলিশ রা জিজ্ঞেস করছে নানা প্রশ্ন।  দেখুন আমরা একসাথে এসেছি কোনো যানবাহন না পাওয়ায় আমরা হেঁটে চলেছি। আমরা এখানে একটু বিশ্রাম নেব।

সেদিনের মত রাত তো তারা সেই ফুটপাতে শুয়ে কাটিয়ে দিলো তারপরে সকাল থেকে আবার হাটতে শুরু করলো রাতে কোন খাবার নেই শুকনো খাবার কিছু বিস্কুট ছিল কিন্তু বিস্কুট খেয়ে কি আর কতদিন চলবে সাধু বাবার কাছে কিছু কাজুবাদাম কিশমিশ ছিল সেগুলোও ফুরিয়ে গেল তারা হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল হঠাৎ চিৎকার করে পা ফুলে একদম ঠিক হয়ে গেছে তার মচকা লেগেছে এবং মদ কাছে মনে হয় চিড় ধরেছে শেয়ার হাঁটতে পারছে না বসে বসে বসে কাঁদতে শুরু করল ।

রাজু শ্যামলীকে কাঁধে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল।সাধু বাবা দেখে তো অবাক।

 সাধু বাবা বলল এতটা পথ তুমি একে কাঁধে নিয়ে যেতে পারবে।

 রাজু বলল কি করবো সাধুবাবা। একে তো কোন হাসপাতালে দেওয়ার উপায় নেই। হাসপাতলে এখনতো করোনা চিকিৎসাতেই ব্যস্ত। সবাই দেখছেন তো হাসপাতালের লাইন। খবরের কাগজে  আমি খবর রাখি। সবাই চলে যেতে পারে না অকারণে হাসপাতালে।

 সাধু বলেন, চলো যাওয়া যাক।

রাজু হাঁটতে হাঁটতেই বলে সাধুবাবা আপনাকে একটা প্রশ্ন করি আপনি কেন সাধু হয়েছেন সাধুদের আমি দেখতে পারিনা আমার এক গ্রামে গুরুদেব আছে সেই স্বাধীন নামে অসাধারণ কাজ করে সে আমার মাকে বশ করে রেখেছে সে আমাদের সমস্ত সম্পত্তি নিয়ে নেবার ধান্দা তার। তার জন্যই আমি কেরালায় চলে এসেছি।

সাধু এবার আসল কথা বলল সাধু বললো আমাকে সাধু বাবা বলে ডাকবে না আমাকে সন্তুদা বলবে। দাড়ি আর জটের তার জন্য তুমি আমাকে সাধু মনে করো না। আমি দেশ ভ্রমণ করতে ভালোবাসি। আমি ঘুরে বেড়াতে ভালবাসি। তাই আমি ঘুরে ঘুরে বেড়াই। দেশ ভ্রমণ করি। আমি সাধু নয়। তবে হ্যাঁ আমি অন্যায় কোন কাজকে প্রশ্রয় দিই  না।

তারপর বিকেলের আলো থাকতেই সাধুবাবা বলেন আমরা বসি। চলো আজ থেকে তুমি আমাকে সাধুবাবা বলবেনা সন্তুদা বলবে। তারপর ব্যাগ থেকে একটা ক্ষুর বের করে রাজুর হাতে দিলেন। বললেন আমার মাথা ন্যাড়া করে দাও আর দাড়ি কামিয়ে দাও। আজ থেকে আমি তোমার মত সাধারন মানুষ হতে চাই।

রাজু সন্তু তার কথামতো তাই করল ইতিমধ্যে একটা পুলিশের গাড়ি চলে এসেছে। পুলিশের গাড়ি থেকে দু’জন পুলিশ নেমে বেধড়ক পেটাতে শুরু করেছে সন্তুদা আর রাজুকে।

তারা বলছে শুনুন শুনুন আমাদের কথা -শুনবো না কেন তোমরা কাছাকাছি বসে আছো

তোমরা যাও তফাত যাও তফাত যাও তাড়াতাড়ি দূরে সরে তারা কথা বলতে শুরু করল। তারা পুরো বর্ননা দেওয়ার পর পুলিশ বলল, চলো আমাদের সঙ্গে তোমরা। তোমাদের থানার কাছে থাকতে হবে একমাস।  তারপরে তোমরা দেশে ফিরবে।  এখান থেকে পশ্চিমবাংলা যাওয়া যায় ট্রেনে, বাসে।পায়ে হেঁটে নয়।

সন্তুদা বলল যার কেউ নেই তার ভগবান আছে। দেখলে মার খেয়েও  একটা উপায় হলো। এবার তুমি তোমার স্ত্রী শ্যামলীকে ডাক্তার দেখাতে পারবে। আর আমাদের থাকার একটা বন্দোবস্ত হলো। আমরা দু’বেলা খেতেও পারবো। আর আমরা থানার সামনে,  পুলিশের নজরে আছি। আমাদের বিপদের কোন ভয় নেই।

শ্যামলীর পায়ে প্লাষ্টার হল।। সন্তুদা বলল,এখন শুধু খাওয়া আর গল্প করার সময়।

রাজু বলল,আপনি তো অনেক জায়গা ঘুরেছেন। বলুন আমাদের সেইসব গল্প।

সন্তুদা বললেন আমি যেমন এখন তোমাদের সঙ্গে মিশে গেছি। ঠিক এভাবেই মিশেছিলাম লক্ষদ্বীপে।

 আমার যেতে মনে হলো লাক্ষাদ্বীপ। লাক্ষাদ্বীপে কিছুদিন কাটিয়ে এলে মন্দ হয়না। ভাবাও যা ভাবাও যা কাজ শুরু হলো আর শুরু হল তোড়জোড়।

দমদম এয়ারপোর্টে টিকিট বুকিং করে কয়েকদিন পরে কলকাতা থেকে সরাসরি উড়ানে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম কোচি বিমানবন্দর। যেহেতু আমরা উড়ানে গেলাম  তাই সময়টা কম লাগলো।তা না হলে  হয়তো থেকে জলজাহাজে 16 ঘন্টা লাগে।আমি বিয়ে করেছিলাম একজন গরীব মেয়েকে।

আমরা চারজন একসাথে আছি। আমি আলাদা। ওরা  স্বামী স্ত্রী। আমি পাশের ভদ্রলোককে বললাম, চলুন। , আমি আমার বন্ধু রতন আর আমার স্ত্রী এবং রতনের স্ত্রী। চারজনের চারটে লাগেজ। সঙ্গে টাকা পয়সা কিছু আছে এটিএম কার্ড আছে। ওখানে প্রয়োজনমতো সব কিছু কিনে নেওয়া যাবে। রতনের সঙ্গে রাস্তায় পরিচয়।

প্রথমেই বিপত্তি একটা লাগেজ চুরি হয়ে গেছে বিমানবন্দর থেকে। থানায় একটা রিপোর্ট করে আমরা এগিয়ে চললাম। ব্যাগে অনেক টাকা পয়সা আছে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আছে। ফিরে না পেলে খুবই অসুবিধা। থানায় আমরা পৌঁছানোর আগেই আমাদের পুলিশ আমাদের সমস্ত জিনিসপত্র দিয়ে গেলেন।চুরি নয় আমরাই হারিয়ে ফেলেছিলাম ব্যাগটা। একজন পুলিশ বললেন, নামতে গিয়ে মিস করেছেন লাগজটি। যাইহোক পাওয়া গেছে আফটার অল।

এর আগে দিঘা পুরীতে সমুদ্র দেখেছি কিন্তু এখানকার সমুদ্র একদম অন্যরকম। নীল সমুদ্রের জলের সঙ্গে নীল আকাশ যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

 নীলে নীলে নীলাম্বর…

সরকার অনুমোদিত সংস্থার সঙ্গে আমরা এসেছি। সেজন্য লজের কোন অসুবিধা হয়নি রাত কাটালাম নিরাপদে।

লজে ছিল কুয়ার আমিন, বলে একজন গাইড।

গাইড আমাদের সঙ্গে গেলেন এবং তিনি ইতিহাস বোঝাতে বোঝাতে আমাদের সব জাগায় ঘুরাতে লাগলেন। 1555 সালের কেরালা  এখানকার রাজা ঘোষণা করেন প্সাদ িনর্মাণের।প্রাসাদটি কিন্তু তারপরেও তাড়াতাড়ি নষ্ট করে দেয় হানাদস্যুরা।

শতাব্দীর শেষের দিকে যখন অন্য রাজা এদিকে আসেন তখন এই প্রাসাদটি পুনর্নির্মাণ করে তারা।

এরপর ক্লকটাওয়ার। তারপরে 1760 সালে তৈরি 45 ফুট লম্বা চার মুখী ঘড়ি দেখলাম

 গাইড কে জিজ্ঞাসা করলাম এখানে প্রবাল পাওয়া যায় অনেক না।

গাইড বলল পাওয়া যায় প্রবাল পাওয়া যায় প্রত্যেকটা দিকেই কিন্তু কোনটাই নিয়ে যাওয়া  যায়না। দু-একটা লুকিয়ে-চুরিয়ে নিয়ে যেতে পারেন।

তারপর কেরলের বিখ্যাত মসলা বাজারে ঢুকলাম সেখানে আমার স্ত্রী এবং বন্ধু স্ত্রী খুব কেনাকাটি শুরু করলেন।

আমি বললাম এত মসলা দিয়ে ব্া গ ভরে যাবে এত মশলা নিয়ে কি করবে।

 বন্ধুর স্ত্রী বলেন আপনারা কি বুঝবেন। এসব ব্যাপার আপনার নাক গলাবেন না। বাড়িতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিতে হবে তো।

এতদূর বেড়াতে এসেছি আর বারবার আসা হবে?

এরমধ্য একটা অঘটন ঘটে গিয়েছে।অন্যমনস্ক হয়ে দলছাড়া হয়েছে রতন।

 রতনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গাইড বলল, আমাকে না জানিয়ে কোথায় গেল?

বন্ধুর বৌ কান্না শুরু করল।

আমি সবাইকে বুঝিয়ে লজে নিয়ে এলাম।

বৌকে বললাম, তোমরা ফিরে যাও। আমি রতনকে নিয়ে ফিরব। বন্ধুর বৌ বলল, আমি যাব না। আমার স্বামীকে ফিরিয়ে নিয়ে যাব। রতনের বৌ রেখা আমার সঙ্গে থাকল। চলে গেল আমার স্ত্রী। বাড়িতে তা না হলে সবাই চিন্তা করবে।পৌছে দিলাম বন্দরে টিকিট কেটে। সময় বেশি লাগবে। কিছু করার নেই।

রেখা আর আমি খোঁজ শুরু করলাম তার পরের দিন সকাল থেকে। রেখা খুব স্মার্ট আর চালাক। ক্যারাটে কুংফু শিখেছে অনেকদিন। আমাদের গাইড অন্য খদ্দের পেয়ে চলে গেছে। লজের মালিককে বলে সরকারি সংস্থা কে সব জানিয়ে রাখলাম। তারা বললেন, আমরা থানায় জানিয়ে রাখব। আপনারা সবরকমের সহায়তা পাবেন।

এখানে কেরলের শুধু নারকেলের বন নারকেলের বাগান সুন্দর সবুজ বনানী।

আর নীল আকাশ আমাদের মন মুগ্ধ করল।

 কিন্তু বন্ধু হারিয়ে যাওয়ায় আমাদের অানন্দের মাত্রা  কমে গেল।

 এখন আমাদের খোঁজ শুরু হল নব উদ্যমে।

 শুরু করলাম প্রথম থেকে।

 মসলা বাজারে যেখানে বন্ধু নিখোঁজ হয়েছিল সেখান থেকে। হাঁটা শুরু করলাম।

হাঁটতে হাঁটতে একটা গলিপথ পেলাম।

সেই গলিপথ পেয়ে একটু দূরে গিয়ে দেখতে পেলাম সমুদ্র। সমুদ্রের ধারে মোটা চেনের সঙ্গে বাধা জাহাজগুলো।

সমুদ্রের ধার বরাবর আমরা এগোতে লাগলাম আমাদের উদ্দেশ্য স্থানীয় লোকদের সঙ্গে মেলামেশা করে তাদের বুঝিয়ে, আমাদের বিপদের কথা বলা।

এত লোকেরা মাঝে  যখন আমরা জাহাজে উঠতে পারলাম তখন বেলা প্রায় বারোটা। জাহাজে উঠে খোঁজ শুরু করলাম। গাইড বলেছিল, জাহাজে করে এরা চোরাপথে কারবার করে আবার জাহাজের ঘর ভাড়া দেয় যখন মাসখানেক দাঁড়িয়ে থাকে। জাহাজ তো বাসের মত সহজে যাওয়া আসা করে না। নিয়ম তাদের আলাদা।

লাক্ষা দ্বীপের লক্ষ দ্বীপের কথা বলা হয়।

 কিন্তু পাঁচটি দ্বীপে  শুদ্ধমাত্র যাওয়া আসা করা যায়। বাকিগুলো সব নিষিদ্ধ।চোর ডাকাতরা নিষিদ্ধ দ্বীপেই ডেরা নেয়।

আমার বন্ধু কোথায় হারিয়ে গেলো খুঁজতে খুঁজতে আমরা হয়রান।  বন্ধুর বউ রেখা খুব স্মার্ট এবং চালাক সে বলল কোন ভয় নেই আমরা তাকে খুঁজে বার করবোই।

কেরলে প্রবাল রাজ্যের হাতছানি।

এখানে লাল-নীল-সবুজ কত রকমের প্রবাল পাওয়া যায় তার ইয়ত্তা নেই।

 এখানকার স্থানীয় লোকজনর সঙ্গে পরিচয় হলো। ইশারায় তারা সব ভাষা বোঝে।  তবু তারা হাতের আংটি দেখিয়ে বলল যে এর ব্যবসা চলে রমরমিয়ে। সেখানে লোকের প্রয়োজন হয় অনেক।আমার আশা জাগল, তাহলে এখানেই রতনের খোঁজ পাব।

স্থানীয় লোকটির নাম জিজ্ঞেস করলাম। সে বলল জিন্দালা আলু আলু।

আমাদের সঙ্গে থেকে নিয়ে গেল ঝাল মিষ্টি পকরার দোকানে।

চা খাওয়ালেন রেখা।  স্থানীয় দাদা দিদিরা বসে আছেন দোকানে।

ভাষার সমস্যার জন্য কারো সঙ্গে দুদন্ড কথা বলা গেল না।

জিন্দালার সঙ্গে আমরা চলে এলাম এক জঙ্গলে।মনে পড়লো বিভূতিভূষণের আরণ্যক।আমি রেখাকে বললাম,এই বিপদের মাঝে মনে পড়ছে, ‘আরণ্যক।এটা’ কি সত্যিই কল্পনা-লোকের বিবরণ বা বানানো গল্প হতে পারে? তাহলে সেই প্রিয় চরিত্রগুলো এতো বাস্তব কেন মনে হয়?এখানকার জঙ্গল দেখে মনে পড়ে গেলো সব কথা।

যদি বিভূতিভূষণের ঠিক পরবর্তী প্রজন্মের লোক হতাম, তাহলে নিশ্চয়ই বিহারে যেতাম। লবটুলিয়া, ফুলকিয়া বইহার, সরস্বতী কুণ্ডী, মোহনপুরা অরণ্য, মহালিখারূপ ও ধন্ঝরি পাহাড় খুঁজে বেড়াতাম। সেই প্রিয় চরিত্রগুলো সত্যিই কি আছে? খোঁজখবর নিতাম। রাজু পাঁড়ে, গনোরী তিওয়ারি, মুসম্মত কুন্তা, ভানুমতী  প্রভৃতি সাধারণ লোকদের না পেলেও অন্ততপক্ষে নন্দলাল ওঝা, রাসবিহারী সিংএর মতো বিত্তবান ব্যক্তিদের সন্ধান পেতে অসুবিধে হত না।  তবে এখন এতো বৎসর পরে কোনোভাবেই এই পরিকল্পনা করা যায় না।সম্বিৎ ফিরে এল। রেখা বলল,এখন রাত হয়ে গেছে আর ফেরার উপায় নেই রাতেই সে একটা পাতার ছাউনি দেওয়া ঘর দেখিয়ে দিল সেই ঘরে গিয়ে আমরা দুজনে ঢুকলাম খাবার-দাবারে কোন অসুবিধা হয়নি কিন্তু সবার বেলায় খুব অসুবিধা কোনমতে রেখা আমার সাথে শুতে চাইছেন সে নিচে শুয়েছে হঠাৎ মাঝ রাতে বারোটার সময় একটা বল্লম। দেখে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। আমি বললাম, রেখা তুমি কি ক্ষেপে গেলে? তোমার কি মাথা খারাপ হল? ছেড়ে দাও।

 কি হলো?

রেখা বলল-একটা বল্লমের  ডগায় রক্ত দেখলাম।

আমি বললাম, তাহলে আমাদের সন্ধান কেউ পেয়েছে। নিষিদ্ধ এলাকায় আমরা আছি। পুলিশ খুঁজেও পাবে না আমাদের লাশ।

আমি চিৎকার করে ডাকলাম, জিন্দালা।

জিন্দালা এল। ঈশারায় বলল,ভয় নেই। আমি আছি। ওদের আটঘাট সব চেনা। তাই ওরা ভয় পায় না। কী গভীর ভালোবাসায় আমাদের জন্য ও রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে।

চিৎকারে  আমাদের ঘুম ভেঙে গেল। কাছে গিয়ে দেখলাম, কেউ একজন তাকে খুন করে রেখে চলে গেছে। একটা অবস্থায় পড়ে আছে জঙ্গলে আশেপাশে এসব লোক ভিড় করে চলে এসেছে তার চিৎকারে।

সকলের চোখে মুখে একই জিজ্ঞাসা কে মারল তাকে?

এখানে তার শত্রু বলতে কেউ নেই। শত্রু হয়তো আমাদের থাকতে পারে।হয়ত আমাদের সাহায্য করার পরিণতি এটা।

 কিন্তু সে আড়ালেই আছে। আমি আর রেখা খুব সাবধান হয়েগেল। আমি গেলাম দুজন স্থানীয় লোক লক্ষ্য করে,  আমরা বললাম আমাদের বিপদের কথা। তারা ইশারায় সবকিছু বুঝে নিল। বিপদ আমাদেরও ঘনিয়ে আসছে এখন রাত্রি দুটো। এখনো রাত শেষ হতে প্রায় 4 ঘণ্টা বাকি। ছয়টা বাজলে আমরা বেরিয়ে পড়বো।

রকমে জেগে রাত কাটিয়ে দিলাম ঘরের ভেতর। খিদে পেয়েছে। কিন্তু কোন খাবার নেই। ছটা বাজতেই আমরা স্থানীয় লোকেদের বলে বেরিয়ে পড়লাম।আর ওদের সঙ্গে নিলাম না।

 এবার আমাদের নিজেদের শক্ত হতে হবে। আর কারো সাহায্যের আশা করলে হবে না। তার কারণ হচ্ছে কতজন আমাদের জন্য প্রাণ দেবে। আমরা এরকম মনে করে, আমরা বেরিয়ে পড়লাম দুজনে। সরকারি স্পর্শিয়ায় আমরা খবর পাঠাইনি। তারা জানেনা আমরা কোথায়। তারা হয়তো খোঁজ করছে। কিন্তু আমাদের যে বন্ধু রতনকে খুঁজে বার করতেই হবে।

সৈকতের ধার বরাবর এগোতে এগোতে আমরা চলে এলাম এক চেইন বাধা জাহাজের কাছে। সেখানে একটি পানসি নৌকা। অনেক ভেতরে চলে গেলাম। কিন্তু মাঝ নদীর সমুদ্র বরাবর। রেখা ধারে ধারে যায়। পানসি ধারে ধারে গিয়ে আমরা আরো ঘন জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করলাম। আশেপাশে কেউ আমাদের ফলো করছে নাকি। আমরা লক্ষ্য করলাম। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ আমরা একটা নেকড়ের সামনে পড়ে গেলাম। পানসি ছেড়ে ছুটতে শুরু করলাম জঙ্গলের ভিতরে।

নেকড়ে আমাদের দিকে তেড়ে এল আমরা ফাটা বাঁশে আওয়াজ করতেই দুমদুম করে  সে পালিয়ে গেল।বাঁশটা পড়ে ছিল বনে।

 সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় লোক কিছু ভিড় করে চলে এল। আমরা ইশারায় তাদের কথা বললাম। পেটে হাত দিয়ে আমরা তাদের কথা বললাম। তারা আমাদের খেতে ফলমূল দিল। ফলমুলাহার করে, জল খেয়ে যাক আমাদের ধড়ে প্রাণ এলো। এবার আমরা ইশারায় তাদের আমাদের বিপদে কথা বোঝাতে লাগলাম। আমরাএ ও বোঝালাম আমাদের বন্ধু রতন হারিয়ে গেছে। আমরা তাকে খুঁজতে এসেছি। তারা কোনরকমে বুঝল কিন্তু তারা আমাদের ভাষা বোঝে না। ইশারা করে কষ্ট করে তাদের বোঝাতে হলো।

আমাদের অভিযান শুরু হলো আরও দুর্গম পথে।

স্থানীয় লোকদের সাহায্যে এত কাণ্ডের পর লোহার মই বেয়ে যখন আমরা জাহাজে উঠতে পারলাম। তখন বেলা প্রায় বারোটা। এলাম কাবা কাবা রাত্রি চারতলায় আজ থেকে চার দিন আমাদের ঠিকানায় কাভারাত্তি। 406 নম্বর কেবিনে ঢুকে অবাক ওরে বাবা এইতো চকচকে ঝকঝকে ঘর শুধু বিছানার চেয়ার টেবিল সাজানো।। ওকে টি আমাদের পয়সার অভাব নেই কিন্তু এত সুন্দর ব্যবস্থা হোটেলের মতো সবকিছুই এখানে সহজলভ্য এটাচ বাথ গরম জল ঠান্ডা ঘর দেয়াল জড়ায় না সবকিছু এখানে আছে। ভাড়া মিটিয়ে দিলাম। জাহাজে রতন নেই।এই জাহাজে করে পাচার করা হয় মানুষ,প্রবাল ও অরণ্য সম্পদ। বিশেষ করে জঙ্গলের কস্তুরী মৃগ এদের সবথেকে লোভনীয়  ব্যবসা। এদের লম্বা হাত। পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে চলে এই ব্যবসা। লোকাল পুলিশ আমাদের সাবধান করে দিয়েছিল। এবার দেখলাম নিজের চোখে। জাহাজের ঘরগুলি প্রায় বন্ধ।মাংস পচা গন্ধ আসছে।

স্থানীয়রা এতক্ষণ জঙ্গলে চলে গেছে তারা নেই এখন আমরা দুজনে আছি সকলের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলে পরিচয় করলাম। পরিচয় করে তারা একটা ঘর দেখিয়ে দিল

 সেই ঘরে আমরা চারদিন থাকলাম।

লোকজন উঠছে মালপত্র উঠছে।  ক্যাপ্টেনের সঙ্গে তিনি সারারাত কাজ করে নিচ্ছেন সব ব্যবস্থা ঠিকঠাক আছে নাকি দেখতে।

 তারপর থেকে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি।বেশ ভাল লাগল না। রতনকে এখনও পেলাম না।

ক্যাপটেন বলল, চারদিন হো গয়া। এখন আপনারা নেবে যান। জাহাজ ছাড়ব দুঘণ্টা পরে। তার আগেই, হঠাৎ করে ঘোষণা শুরু হলো এবং ইংরেজিতে ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু আমরা জাহাজে তো যাব না।

 আমরা এখানে বন্ধুর খোঁজ নেব। তাই কাভারাত্তি তে নেমে জেটির উপর দিয়ে একটু ঘুরিয়ে সৈকতে এসে পৌঁছাতেই হাতে হাতে মিলিয়া বড়া খেলাম।

 বড় ডাক্তার নেই।রেখার জ্বর।

 পরবর্তী দিনগুলোতে দেখলাম ডা দীপেন আমার সঙ্গে একরকম ব্যবস্থা করেছেন চিকিৎসা র।

সব লোক  স্থানীয়। লোকদের। দেখে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে মন প্রাণ জুড়িয়ে গেল।

কিন্তু বন্ধু যদি সঙ্গে থাকত এই আনন্দ দ্বিগুণ হতো। স্থানীয়রা বলল-এখানে প্রবাল রাজ্যের হাতছানি এখানে নানান রকম প্রবাল লাল, নীল সবুজ সব রকমের ব্যবসা রমরমিয়ে চলে।চোরাচালান পথে চলে

তার জন্য অনেক লোকের প্রয়োজন হয়।হয়ত এরা এরজন্য লোক এমনকি মহিলা পর্যন্ত চুরি করতে পিছুপা হয় না। এবার আমাদেরও আশা একটু বাড়লো হয়তো এই প্রবালের ব্যবসাদারদের কাছেই আমরা বন্ধুর খোঁজ পাব। স্থানীয়রা ইশারায় তারা বলল, আমরা সঙ্গে আছি।

মহাবিপদ, কি হলো হঠাৎ আমাদের তাড়া করলো দুটো অ্যালসেশিয়ান কুকুর।

লেলিয়ে দিলো কে। আমরা সমুদ্রের জলে এসে পড়লাম। অমূলকভাবে শান্ত আরব সাগরে স্নান করার মজাটাই হলো আলাদা।

এই বিপদে,সময় সুযোগে আমাদের সমুদ্র স্নান করে নিলাম।

রেখার এক্সপার্ট কিন্তু এর প্রমাণ কোনরকমে হাতের ব্যাগ একজনের কাছে জমা করে ঝাপিয়ে পড়লাম জলে। সাঁতার কাটলাম মহানন্দে। স্থানীয় লোকদের ডাকাডাকি। শুরু হয়ে গেল খবর।কুকুরদুটো আর নেই।রহস্যজনকভাবে এল আবার জলে না নেমে চলেও গেল।

ভিজে জামাকাপড়েই আমরা এগিয়ে চললাম বন্ধুর খোঁজে। স্থানীয়রা প্রত্যেক লোককে জিজ্ঞেস করে করে দেখছে। এই নামের কোন বন্ধু আছে নাকি। কোন লোক এখানে নতুন এসেছে নাকি।

 একজন খবর দিল। খবর দিল, হ্যায় ইখানে একটা নতুন লোক এসেছে। লোক কোথায় আছে তা জিজ্ঞেস করতেই লোকটি বললো, ইশারায় বলল, আঙ্গুল দিয়ে সেই ঘরটি দেখিয়ে দিল।

সাহসে ভর করে আমরা ঘরের ভেতর ঢুকে গেলাম অন্ধকার ঘরে হঠাৎ আমাদের পিঠে ধপাস করে আঘাত।লাঠির আঘাত।

নাও এবার বন্দি হয়ে গেলাম আমরাও তাদের জালে। আর কিছুক্ষণ পরেই তাদের দলের সর্দার এল। এসে বলল যে তোমাদের সাহস তো মন্দ নয়। ইংরেজিতে বলল। এখানে এলে আর ফিরে যাওয়া যায় না। তোমার বন্ধু এই ঘরেই আছে। এই দেখো এটা কি তোমার বন্ধু?

দেখলাম হ্যাঁ রতন ই বটে।

রতন তো আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল। সেরা রুটি আর নারকেলের কিছু সব দিয়ে তারা চলে গেল। আমরা ঘরে বন্দি হয়ে রইলাম।

কি করে এই ঘর থেকে বেরোনো যায় পরিকল্পনা করতে শুরু করলাম। কিন্তু কোথাও  জানালা নেই। দরজা আছে। দরজা একটামাত্র। দরজাটা তালা দেওয়া।

তাহলে বেরনো যাবে কি করে?

 আমরা বন্ধ হয়ে গেলাম অন্ধকার জেলে।  আর চারিদিকে সশস্ত্র প্রহরী। জামা কাপড় পাল্টানোর জন্য আমাদের জামা কাপড় দেয়া হয়েছিল। আমরা সেই জামাকাপড় পরে নিলাম। যেন কাঁদিয়ে কয়েদির পোশাক যাওয়ার জন্য লাইন দিতে  হলো।

 কিন্তু কোন উপায় নেই এই ঘর থেকে আমরা মুক্তি পাব কি করে। নৌকা দুশমনরা  আমাদের চোখ বেঁধে দিল। সেই সবুজ, নীল নীল সমুদ্রের জল আমাদের চোখে ভাসছে। আমরা যে ঘরে বন্দি হয়ে আছি সেই ঘরে একটিমাত্র দরজা। সেই দরজায় কি ফুটো আছে ফুটোয় চোখ রেখে রেখা দেখল, কত রকমের প্রবাল।

তারা প্রবাল গুলো নিয়ে ঘষাঘষি করে তৈরি করছে আংটি। আর মজুরদের দরকার হলে প্রয়োজনে ধমক দিচ্ছে। এমন কি মারছো। মধ্যযুগের বর্বরতা।

কি করে আমরা এদের হাত থেকে পরিত্রান পাব। এই নিয়ে আমরা চিন্তাভাবনা শুরু করলাম। কিন্তু হা হতোস্মি। কোন দিক দিয়ে পালাবো আমরা।

 আমাদের পালাবার পথ বন্ধ হয়তো সারা জীবনই এই ঘরের মধ্যে আমাদের তিনজনের কেটে যাবে।

ওরা যা খেতে দেবে তাই খেতে হবে। যা কাজ করাবে তাই সেই কাজই করতে হবে কোথায় চালান করে দেবে জাহাজে তাও জানিনা। এই ভাবনায় বাড়ির কথা মনে পড়তে লাগলো মনে পরতে লাগলো মা বাবার কথা আমার স্ত্রীর কথা। আর এখানে ধরে কাঁদতে শুরু করলো কি করে আমরা কি আর বাড়ি ফিরে যেতে পারবো না কোনদিনই কোনদিনই বাড়ি যেতে পারব না। এই ছোট্ট ঘরে মধ্যে আমাদের কাটাতে হবে। দ্বিতীয় রাত কেটে গেল তবু আমাদের কোন উপায় হলো না।

 কোনো রকমে খেয়ে একটু জল খেয়ে বেঁচে আছি।

এবার হয়তো ওরা আমাদের কোথাও পাচার করে দেবে আমাদের পোশাক পাল্টানোর জন্য তারা পোশাক দিয়ে গেছে। এবার কি আমাদের নিয়ে যাবে আমাদের চিন্তা হলো তাহলে সরকারি সংস্থা থেকে আমাদের তো নিয়ে এসেছে।

 তারা কি পুলিশ থানায় খবর দেয় নি।মোবাইল কেড়ে নিয়েছে।

 তারা নিশ্চয়ই খোঁজ করতে করতে এখানে আসবে।

 সেই মনে পড়ছে নারকেল গাছের নিচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আড্ডা শুরু করেছিলাম।

সেই সময়টিতে নামল বৃষ্টি এখানে সমুদ্রের মজাটাও পাওয়া গেল না যতদূর হলে হাটু গেড়ে বসে পড়তে পড়তে আমাদের কখন যে ঘুম এসে গেল। আমরা সকলে ঘুমিয়ে পরলাম।

আর পরদিন সকালে আমাদের তিনজনকে নিয়ে একটা জাহাজে উঠলো।

 জাহাজে উঠে আমরা চিনতে পারলাম সে ক্যাপ্টেনকে।

ক্যাপ্টেন ইশারায় একটুখানি হাসি হাসলো কিন্তু কিছু কোন কথা বললো না।

 আমরা এখন কি জাহাজে চেপে থাকতে পেরেছি।

হ্যাঁ ঠিক তাই ক্যাপ্টেন সামনে।

এতক্ষণ তো কেউ ছিলনা থেকে নিঃশব্দে আমাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। আমাদের কোলে তুলে নেবে বলে। কিন্তু আমাদের তো যাওয়ার সময় হয়নি।

এমন সময়ে বিভিন্ন রকম কায়দা করতে শুরু করলো।

তারপর আমরা দেখলাম তারা  বেশি করে নিয়েছে প্রবাল ও কস্তুরী। সুগন্ধি কস্তুরীর গন্ধে আমরা পাগল। তাও বস্তায় প্যাকেট করা আছে।

জাহাজ আমাদের তিনজনকে নিয়ে চলে এলো গেঞ্জি কারখানায়।

 সেখানে দেখলাম খুব ভালো সুতোর টি-শার্ট। আর কি কম দাম উপহারের জন্য অনেকে কিনে নিচ্ছে।

ইশারায় আমাদের বলা হলো এখানেই তোমাদের কাজ করতে হবে। আজীবন। এখানেই তোমরা থাকবে আমাদের বন্দিদশা এখনো ঘোচেনি।

 ঘুরে চা পান শেষে আবার তারা ফিরে গেল। আবার আগের ঠিকানায়। এই ঠিকানায় তারা আজ শেষ রাতে এসেছে।

 কাল সকালেই হয়তো পৌঁছে যাবে কোচিতে।  আমাদের মন কেমন যেন হয়ে গিয়েছে আর এই আছে তারা কর্মীরা আমাদের ভয় করতে মানা করলো তারা বলল একটা উপায় কিছু হবেই। আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন। তারপরে তারা চলে গেল।

বদমাশরা চলে গেলে এদের কাছে অনেক কিছু জানতে পারলাম।

এর মধ্যে একজন এগিয়ে এল।

বদমাশ রহিম শেখের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করল। এখন বাধা দেয়াতেই চাবুক আলা 2760 নং কয়েদী রতনের পিঠে চাবুক মারল।

 রতনের বিরক্ত হতে শুরু করলো। কিন্তু রেখা তো থেমে থাকার পাত্র নয়। সে মার্শাল আর্টে কাবু করে ফেলল যাকে তাকে একদম ধরাশায়ী করে ফেললো মেঝেতে। বদমাশ লোকটি শুয়ে পড়ল মাটিতে আহত হয়ে।

সকলে হাততালি দিয়ে উঠল। আর মালিকেরা মালিকদের লোকজন এখন কেউ নেই ওরা হয়তো পাশের ঘরে আছে। শুনতে পায়নি। আমরা পুলিশের আশায় বসে আছি। অবৈধ প্রবাল পাচারকারী দলের নেতা সহ 10 জন আমাদের ঘরে ঢুকলো এবার তারা অত্যাচার শুরু করবে।

তাদের কাছে আমরা শুনেছিলাম তারা প্রত্যেকদিন এইভাবে মারধর করে এবং ভয় দেখিয়ে রাখে যাতে ভালো কাজ পায়।

 কাজে ফাঁকি তারা বরদাস্ত করে না।

 এইভাবে তারা ভয় দেখিয়ে কাজ বাগিয়ে নেয়। মোটা লাঠি দিয়ে ওরা সবাইকে পেটাতে শুরু করল।

রক্তাক্ত হয়ে গেল মেঝে।

কিন্তু ওদের মায়া দয়া নেই।

 ওরা পৈশাচিক। আনন্দে মশগুল। এমন সময় হঠাৎ সদলবলে পুলিশ বাহিনীর আবির্ভাবে আমরা নিঃশ্বাস ছেড়ে বাঁচলাম। এবার তাহলে একটা উপায় হবে। হ্যাঁ ঠিক আমাদের খুঁজতেই তারা এসেছেন।

 তারা আমাদের সরকারি সংস্থার মাধ্যমে সেই স্পোর্টস থানায় রিপোর্ট করাতে তারা আমাদের এখানেও চলে এসেছেন। এবার আমরা নিশ্চিন্ত। নিশ্চয়ই একটা বিহিত হবে। আমাদের তিনজনকে মুক্ত করতে এসে মুক্তি পেয়ে গেল 30 জন বন্দি।

 আমাদের খুব আনন্দ হল। সবাই একসাথে বেরিয়ে পড়লাম বাইরে।

কি সুন্দর প্রকৃতির হাওয়া সবুজ নির্মল পরিবেশে মন জুড়িয়ে গেল আর কদিনের আকাশ দেখা মন খারাপের দিনগুলো যেন উধাও হয়ে গেল।

 পুলিশের আই সি বললেন আপনারা বেড়াতে এসেছিলেন।

আপনারা এইদিকে কিছু স্থান  দেখে তারপরে কোচি। কোচি থেকে আপনারা ফিরে যাবেন কলকাতা। পুলিশের আইসি বললেন আপনাদের তিনজনের দৌলতে ধরা পড়ে গেল বড় চোরাকারবারী দল।

 এরা গেঞ্জি কারখানা কাপড়ের কারখানা দেখিয়ে প্রবাল গুলো গোপন পথে চোরাচালানে বিক্রি করে প্রচুর টাকা লাভ করে।

এদের ধরতে আমাদের হিমশিম খেতে হয় কিন্তু আপনাদের খুঁজতে এসে আজ আমরা আমরাই ধরতে পারলাম।

পুলিশের লোকটির নাম মদনলাল ুরানা। ইনি বললেন, এই দলটা শুধু প্রবাল নয়। এখানকার জঙ্গলের সম্পদ নষ্ট করে চোরাচালান করে।

গোসাপের চামড়া চালান করে। হাতির দাঁত কেটে নেয়। নিরীহ হরিণ হত্যা করে।

তিনি আরও বললেন, আমরা জেনেছি বিশেষ সূত্রে বা বই পড়ে যে, কস্তুরী খুব দামী সুগন্ধি, যা মোঘলরা ব্যবহার করত বলে জানা যায় ৷

 বর্তমানে এক গ্রাম কস্তুরীর মূল্য প্রায় 55000 টাকার কাছাকছি !!এই কস্তুরী চোরাচালান করে চোরাকারবারির দল নির্বিচারে হরিণ হত্যা করে চলেছে। পাপ শব্দটা এদের অভিধানে নেই।

 রতন বলল,কস্তুরী কি,  এবং কোথায় পাওয়া যায়, বুঝিয়ে আমাদের বলুন।

মদনলাল বললেন, বই পড়ে যেটুকু জেনেছি তাই বলছি আপনাদের।

হরিণের দশ বছর বয়সে নাভির গ্রন্থি পরিপক্ব হয়।

এ সময় হরিণটিকে হত্যা করে নাভি থেকে তুলে নেওয়া হয় পুরো গ্রন্থিটি।

তারপর রোদে শুকানো হয়। একটা পূর্ণাঙ্গ কস্তুরী গ্রন্থির ওজন প্রায়  ৪০ গ্রাম।

এটি বিশেষ ধরনের প্রাণিজ সুগন্ধি।

 হরিণের নাভি থেকে পাওয়া যায় এই কস্তুরী, যা মহামূল্যবান সুগন্ধি হিসেবে পরিচিত। অনেকে নিশ্চয় নাম শুনেছেন।

রেখা বলল, আমিও পড়েছি, বহু গুণসম্পন্ন এবং বহু নামসম্পন্ন, এর ঘ্রাণ  যোজনগন্ধা বললে কম বলা হয়।

 কস্তুরীর এক তিল পরিমাণ কোন বাড়িতে ফেললে বহু বছর সেখানে এর ঘ্রাণ থাকে।

 তিন হাজার ভাগ নির্গন্ধ পদার্থের সঙ্গে এর এক ভাগ মেশালে সমস্ত পদার্থই সুবাসিত হয় কস্তুরীর ঘ্রাণে।

চোরাকারবারি এগুলিকে বিদেশে পাচার করে মোটা ডলার পায়।

মদনলাল বললেন, কস্তুরী সংগ্রহকারীরা এই সুগন্ধিকে প্রায় প্রকৃত অবস্থায় রাখেন না।

সচরাচর অন্য পদার্থের সঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি করেন। অন্য পদার্থের মধ্যে রক্ত বিশেষ একটি উপাদান। শুকিয়ে যাওয়া রক্তের সঙ্গে কস্তুরীর বিশেষ সাদৃশ্য আছে । কস্তুরীর সুবাসেও আছে বৈচিত্র্যI

সুগন্ধি ফুলের মতোই যুগ যুগ ধরে মানুষের দৃষ্টি কেড়েছে কস্তুরী মৃগ। এই মৃগ অর্থাৎ হরিণ এক প্রজাতির পুরুষ হরিণ। ইংরেজি নাম ‘মাস্ক ডিয়ার’। এরা খুব লাজুক স্বভাবের। তাই নিরিবিলি বাস করে। বিচরণ করে একান্ত নির্জনে।

রতন বলল,হিমালয় পর্বতমালার উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলেও উৎকৃষ্ট কস্তুরীমৃগ পাওয়া যায়। ওই অঞ্চলে একপ্রকার ছোট আকারের হরিণ আছে, তারা ছাগলের চেয়ে বড় নয় কিন্তু দেখতে অত্যন্ত সুন্দর। এদের পা অতি সরু, মাথা সুন্দর এবং চোখ চমৎকার উজ্জ্বল । এই হরিণ অন্য হরিণ থেকে আলাদা নয়। অত্যন্ত শীতল পার্বত্য পরিবেশে বাস করায় এদের লোম সরু না হয়ে অত্যন্ত মোটা ও পালকের মতো হয়। এ ছাড়া পামির মালভূমির গ্রন্থি পর্বতমালায় তৃণভূমি সমৃদ্ধ উপত্যকায় এই হরিণ পাওয়া যায়। এখানেও চোরাকারবারির অভাব নেই।

মদনলাল আবার বলতে শুরু করলেন, কস্তুরী মৃগের ওপরের মাড়ি থেকে গজদন্তের মতো দুটি দাঁত ছোট আকারে বের হয়। এ ধরনের দাঁত সব প্রজাতির হরিণের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। এই দেখেই কস্তুরী মৃগ সনাক্ত করা হয়।

এই প্রজাতির হরিণ আত্মরক্ষায় পটু। কিন্তু তারা নিজেদের লুকিয়ে রাখতে পারে না, কারণ এদের দেহের তীব্র ঘ্রাণ। এই ঘ্রাণ অনুসরণ করে শিকারি ঠিকই এদের সন্ধান পেয়ে যায়। এই হরিণের নাভি থেকেই মূলত এই সুগন্ধি দ্রব্য সংগ্রহ করা হয়।

পুরুষ হরিণের নাভি মুখের গ্রন্থিতে এক বিশেষ ধরনের কোষের জন্ম হয়। এই কোষ যখন পূর্ণতা লাভ করে তখন এ থেকেই সুঘ্রাণ বের হতে থাকে। হরিণের ১০ বছর বয়সে সুগন্ধি কোষ পূর্ণতা লাভ করে। তবে মজার ব্যাপার হলো, যে হরিণটির নাভিতে এই কোষের জন্ম, সে নিজে কিছুই বুঝতে পারে না। তার নাকে যখন এই সুগন্ধ এসে লাগে তখন সে পাগলের মতো ছুটতে থাকে এই সুঘ্রাণের উৎসের সন্ধানে। অথচ সে বুঝতে পারে না যে, সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে তার নিজের দেহ থেকেই।

 বাইরের দিকটায় থাকে এলোমেলো কিছু লোম। সেগুলো ছাড়িয়ে শুকনো কোষটিকে যখন জলেতে ভেজানো হয়, তখন পরিষ্কার কস্তুরী বেরিয়ে আসে। কোনো কোনো হরিণের মধ্যে পাওয়া যায় খুব কম পরিমাণে কস্তুরী। অপরদিকে এই প্রজাতির সকল হরিণের নাভিতে একই পরিমাণে কস্তুরী উৎপন্ন হয় না; হরিণের বয়স এবং পরিবেশভেদে কস্তুরীর পরিমাণের তারতম্য হয় ।

দেখা গেছে, এক কিলোগ্রাম কস্তুরী পাওয়ার জন্য প্রায় দুই হাজার হরিণ শিকার করতে হয়।

রতন বলল, পচা মাংসও এরা রপ্তানি করে। কিছুই ফেলে না। জাহাজে আমরা পচা গন্ধ পেয়েছি।

কস্তুরী যখন সংগ্রহ করা হয় তখন এর গন্ধ এত উগ্র থাকে যে হরিণের নাভিকোষ কেটে নেওয়ার সময় শিকারিরা মোটা কাপড় দিয়ে নিজেদের নাক বেঁধে নেয়।

অনেক সময় এ গন্ধ সহ্য করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কারো কারো চোখ, নাক থেকে জল ও মুখ থেকে লালা ঝরা শুরু হয়। এমনকি জীবনহানিও ঘটে।

এইসবই আমার বিভিন্ন গ্রন্থ পড়ে জানা।

 তবে এই লক্ষদ্বীপের আনাচে কানাচে রহস্য লুকিয়ে আছে। তাই এখানে দশটি দ্বীপ ছাড়া অন্য দ্বীপে যাওয়ার পারমিশন নেই।

তবু চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী।

মদনলাল এবার বিদায় নেবেন। সমুদ্রের ঢেউ একের পর এক দ্বীপকে ভিজিয়ে চলেছে নিশিদিন। আমরা ভেসে চলেছি অজানা কে জানার নেশায় যাযাবরের মত।

রাজু বলল,আপনি স্ত্রী কে পাঠিয়ে দিয়েছেন কিন্তু আপনার খবর তো পায় নি।

সন্তুদা বলল,আমি ওকে বিয়ে করেছি। ওর সঙ্গে আমার পরিচয়ও ছিল না। গরীব একা মেয়ে দেখে বিয়ে করেছি। ওর বাবা, মা কেউ নেই। আমার মোবাইল ফোনে সে আমার খবর পায়।

শ্যামলী বলে, এবার সন্তুদা বাড়িতেই থাকবেন। আপনি ধনী লোক। সরকারি চাকরি করতেন । আপনার অভাব নেই।

সন্তু বললো,আমি খেয়াল হলে হাওয়াই জাহাজে চড়ি আবার পয়দলেও স্বচ্ছন্দ। দেশে দেশে আমার ভালবাসা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এবার আমরা বাড়ি যাব। তোমরাও বাড়ি যাবে। নিজের বাড়ি ছেড়ে আর কোথাও যাবে না। চাষ করবে, ফসল ফলাবে। প্রয়োজনে আমাকে ডাকবে। আমিও রাজুর মত শ্রমিকের কাজ করেছি। কুলিগিরি করেছি।কোন কাজই ছোট নয়। আমরা কৃষিকাজে এবার মন দেব সবাই। তাহলে দেখবে কাউকে আর গ্রাম ছাড়তে হবে না।

শ্যামলী বলল, সন্তুদা তোমার তো অভাব ছিল না। বিয়ে হয়েছে।মা বাবা ছিল। তাও তুমি ঘরছাড়া কেন হলেন?

সন্তু বলল, আমার বিয়ের পরে বৃন্দাবনে গেছিলাম। তারপর লাক্ষা দ্বীপও ঘুরেছি। ফোনে বাবা জানিয়েছিলেন, একটি গ্রামের ছেলেকে নিয়ে আমার বউ ঘর ছেড়ে পালিয়েছে কামের তাড়নায়। আর আমি বৃন্দাবনের দেখা মেয়েকে আবার দেখতে গেছিলাম। তার কেউ নেই। আমি তাকে ভালবেসেছিলাম। সেই আমাকে গেরুয়া পরিধান করিয়েছে।আমাদের প্রেম দেহের উর্ধে। মনের সেতুবন্ধন।

রাজু বলল,আমাদের বলুন বৃন্দাবনের কথা।

সন্তু শুরু করল বৃন্দাবনের কাহিনীর কথা।

দুজনে ভেবে ভেবে  ঠিক করলাম বৃন্দাবনে যাবো। রমার সঙ্গে পরিচয় আগে ছিল না। বিবাহসূত্রে পরিচিত হয়েছে।

 এখনো পরিচয়পর্ব অনেক বাকি আছে।

 কেউ কাউকে চিনতাম না।

বাড়ি থেকে দেখাশোনা করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এবার নিজেদের মধ্যে পরিচিতি বাড়ানোর জন্য  বিভিন্ন সময় গল্প-গুজব করি আমরা।

সময় কাটাতে আবার কাজের ফাঁকে ফাঁকে বেড়াতে যাওয়ার কথাও চিন্তা করতাম। ঠিক ভেবে ভেবে তাদের সময় পেরিয়ে বৈশাখ মাস থেকে  জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় শ্রাবণ, ভাদ্র পেরিয়ে আশ্বিন মাস হল।

 পুজোর ছুটিতে  ঠিক করলাম বৃন্দাবনে যাবো। শুরু হল তোড়জোড়। প্রয়োজনের কিছু জিনিস নিলাম। বাকিটা কিনে নেওয়া যাবে। আমি জানি নগদ টাকা পয়সার সঙ্গে এ টি এম কার্ডটাও রাখতে হবে।

কলকাতা থেকে দিল্লি আগ্রা হাইওয়ে ধরে  135 কিলোমিটার দক্ষিনে গেলেই বৃন্দাবন।বৃন্দাবনও মথুরায় মন্দির  কমকরে হলেও ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় তিন হাজার প্রায়। মন্দিরগুলি যার বেশিরভাগই কৃষ্ণ, রাধা কৃষ্ণ র সঙ্গে কোন না কোন ভাবে সম্পর্কিত।বৃন্দাবনে গিয়ে তারা প্রথমে ঠিক করল বাসা। একটি লজ পছন্দ হয়েছে। লজের নাম রাধা ভবন।

 সেই রাধা ভবনে তারা আশ্রয় নিল।ভাড়া মিটিয়ে চাবি নিয়ে ঘরে ঢুকল। এখানে নিরামিষ খাওয়ার ব্যবস্থাও আছে। রমা ও অনুপের পছন্দের খাবার এখানে আছে। লজের সামনে একটা বেশ সুন্দর রাধাকৃষ্ণের ছবি। আর কৃষ্ণের হাতে বাঁশি। স্বয়ং কৃষ্ণ যেন সাক্ষাৎ দাঁড়িয়ে একদম বাঁশি বাজাচ্ছেন। অনুপ আর রমা খুব সুন্দর ভাবে খাওয়া দাওয়া করার পর দুপুরের দিকে বেরিয়ে পড়ল বৃন্দাবন ঘোরার জন্য।

বেড়াতে এসে তো আর শুয়ে পড়ে সময় কাটানো ভালো লাগে না। তাই  ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম একটার পর একটা মন্দিরে মন্দিরের অভাব নেই। এখানে এখানে এসে এখনো মনে হয় যার মনে হয় যেন হাজার বছর আগে থেমে আছে।উত্তরপ্রদেশের এই প্রাচীন ভূখণ্ডটি শহর হয়ে ওঠে।শহরে নেই পাঁচতারা হোটেলের ঝলক।শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত শপিং প্লাজার স্মার্টনেস কিংবা মাল্টিপ্লেক্সের উত্তরাধুনিকতা কিছুই যেন ছুঁয়ে যায়নি ব্রজ ভূমিকে।

 সরু গলি  কাচা-পাকা রাস্তা সাইকেল রিকশা মলিন স্কুল ইউনিফর্ম পরা দল মন মাতিয়ে চলে।রাস্তায় কেবলই গেরুয়া বসন ধারীর সংকীর্তন ধ্বনি। কেমন লাগছে তোমার রমা।অনুপ বলল।আমার বউ রমা বলল, সব দেখে খুব ভালো লাগছে। দেখো কুমোরপাড়ায় মাটির কারুকাজ।এদের আর কোন আলাদা ইষ্ট নেই, শ্রীকৃষ্ণ চরণের এই ভূমিতে।মাটির তৈরী রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ বিস্ময় জাগায় অনুপের মনে প্রাণে। এখানে একটা দোকানে শ্রীকৃষ্ণের প্রচুর ছবি বিক্রি হচ্ছে।সেই ছবি বিক্রি করছে একজন সুন্দরী মহিলা। তার বিয়ে হয়নি কি বিধবা বুঝতে পারছে না অনুপ। কেবল তার ডাগর রূপ মনে এক অদ্ভুত সুর তোলে ক্ষণে ক্ষণে। অনুপ ভাবে, ভাগ্যিস মনের রূপ দেখা যায় না চোখে। তা না হলে কত হৃদয় যে ভেঙ্গে যেত মুহূর্ত প্রেমে। সে এতো সুন্দরী যে তাকে তাকে দেখতে মনে হয় অনেক বার। বারবার ঘুরে ফিরে তার দিকে চোখ দিয়ে ফেলছে।

 স্ত্রী রাগ করে বলছে তুমি ওদিকে বারবার তাকাচ্ছ কেন। কী মনে করবেন উনি।  অনুপ কিন্তু দৃষ্টি সংযম করতে পারছে না ।

সুন্দরী মেয়েটি বলল, নিন বাবু দুটো ছবি নিন শ্রীকৃষ্ণের ছবি বাড়িতে থাকা খুব মঙ্গলের। এই ছবি থাকলে কোন বিপদ-আপদ আপনাদের জীবনে নেমে আসবে না। রোজ দুবেলা এই শ্রীকৃষ্ণের ছবিতে ধূপ দেখাবেন।

 বাতি দেখাবেন। তাহলে দেখবেন কোন বিপদ আপনাকে ছুঁতে পারবে না।

আমি বললাম দুটো নয়, আমাদের চারটে ছবি দিন। আমরা চারটে ঘরে চারটে ছবি টাঙিয়ে রাখবো।আর মনে মনে ভাবল তোমার স্মৃতি ও এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে।দাও চারটে শ্রীকৃষ্ণের ছবি দাও ।

রমা বললো চারটে প্রয়োজন নেই। একটাই নাও।

— না একটা নিলেই তো হয় না।

—ঠিকমতো ধুপ বাতি দেখালেই তো একটা ফটোতে ভক্তি হবে।

 ভক্তি দেখানোর জন্য অত ছবি নেওয়ার প্রয়োজন নেই।

আমি বললাম,তুমি বাধা দিও না প্লিজ।  না চারটিই থাক।

আমি  সুন্দরী মেয়েটিকে বললাম, আপনাকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারি?

সুন্দরী মেয়েটি বলল হ্যাঁ নিশ্চয়ই পারেন।

– আপনার নাম কি জানতে পারি। মেয়েটি বলল হ্যাঁ নিশ্চয়ই, আমার নাম লেখা।

—-আপনি এখানে  আপনি এখানে এলেন কি করে।

মেয়েটি বলল আমি বিধবা হওয়ার পর এখানে এসেছি।তারপরে আমি নিঃসন্তান। তাই একাই আমি এই ব্যবসা করি আর বৃন্দাবন ধামের প্রসাদ গ্রহণ করি। এই ভাবেই আমার জীবন চলে যায় রাধামাধবের দয়ায়। জয় রাধে জয় রাধে।

রমার মনে এইবার মায়া জেগে উঠলো সে বললো আহা এত অল্প বয়সে তুমি বিধবা হয়ে গেছো আমি শুনে খুব দুঃখ পেলাম।জয় রাধে।

 আমি বললাম এই বৃন্দাবনে বেড়াতে আসার উৎকৃষ্ট সময় কোনটা বলতে পারেন?লেখা বলল, বৃন্দাবনে বেড়াতে আসতে হলে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকে নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে শ্রেষ্ঠ সময়।সে আরও বলল,বৃন্দাবনে গোবিন্দজী মন্দির টি অসাধারণ দেখবেন। দেখবেন পুরোটা লাল পাথরে তৈরি। প্রায় হাজারখানেক  কারিগর নাকি পাঁচ বছর ধরে মূর্তি তৈরি করেন।

 আমরা শুনেছি তবে এই বিষয়ে একটা কথা বলা ভালো  আপনার বিশ্বাস থাক আর না থাক বেড়াতে গিয়ে সমস্ত সন্দেহ সরিয়ে রাখবেন। আপনার সন্দহ জড়িয়ে না থাকাই রাখাই ভালো।

রমা এবার বলল আপনাকে দেখে তো শিক্ষিত মনে হচ্ছে আপনি তো অনেক খবর রাখেন লেখা বলল হ্যাঁ আমি নরসিংহ দত্ত কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করেছি।পড়াশুনা করি বৃন্দাবনের ইতিহাস নিয়ে। অনেক বই পাবেন বাংলা, হিন্দী বা ইংরাজীতে লেখা। এই বৃন্দাবনের পৌরাণিক ইতিহাস।

লেখাও বলল, আমার বরাবরই এই বৃন্দাবন ধামের প্রতি  একটা আকর্ষণ ছিল। ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণ যেন আমার সেই আশাই পূর্ণ করে দিয়েছেন। জয় রাধে।

আমি বললাম তাহলে আপনার  দেবতা কৃষ্ণ। শুধু কৃষ্ণ।আহারে কৃষ্ণ প্রেমের কারণে আপনি এখানে এসেছেন।

লেখা বলল, হ্যাঁ ঠিক তাই। ঠিক তাই। ঠিকই ধরেছেন আপনি। এই একটাই দেবতাকে ভজনা করি। তবে শুধু কৃষ্ণ প্রেমের কারণে নয় ভাস্কর্যশিল্পের দিক থেকেও মথুরা অত্যন্ত আকর্ষণীয়।

আমি বললাম তাহলে কৃষ্ণ প্রেমই আপনাকেই বৃন্দাবনে টেনে এনেছে।আর তার সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করে।

 লেখা বলল হ্যাঁ এটা বলতে পারেন। আমার জীবনে ইচ্ছে ছিল এই শ্রীবৃন্দাবনে এসে শেষ দিন কাটানো। ঈশ্বর যেন সেই আশাই পূর্ণ করলেন। আবার বলল লেখা, তবে শুধু কৃষ্ণ প্রেমের কারণে নয় ভাস্কর শিল্পের দিক থেকেও দেখবেন এই কাছের মথুরা অত্যন্ত আকর্ষণীয়। মিউজিয়ামে প্রায় 2000 বছর আগে বুদ্ধের মূর্তি অপূর্ব সুন্দর দেখবেন।

আপনারা থাকুন কিছুদিন এখানে। শুধু পাথরের মূর্তি সংগ্রহ প্রায় 5 হাজারের মত।ভাল লাগবে দেখে।

রমা বললো দুদিন দোকান বন্ধ রেখে আমাদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করুন না।

 আপনাকে নিয়ে দেখলে সব কিছু জানা যাবে। আপনার আর্থিক কোনো ক্ষতি হবে না।

 আমরা আপনাকে পারিশ্রমিক দিয়ে দেব।

 লেখা বলল, ঠিক আছে  আমার আপত্তি নেই। আমি আপনাদের এই কৌতুহল মেটাতে রাজি।

আমি ভাবলাম, মানুষ অজান্তে খাল কেটে কুমির আনে জীবনে। হয়ত এটাই ভবিতব্য। তারপরের দিন থেকে লেখাকে  নিয়ে শুরু হলো মথুরা ভ্রমণ। মথুরা জুড়ে 2525টি ঘাট আছে। বিশ্রাম ঘাটের সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করে। লেখা  কথাগুলো বলে চলেছে আমরা শুনে চলেছি। লেখা আরো বলছে, কথিত আছে কংস বধের পরে  শ্রীকৃষ্ণদেব  এই ঘাটে  বিশ্রামে ছিলেন। এই ঘাটে তাকে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য মন্দির।

বিশ্রাম ঘাটে সন্ধারতি এক অনন্য অভিজ্ঞতা। কোন পর্যটক এটা মিস করেন না।

লেখা বলল, আমাদের বিয়ের পরও আমরা প্রথম হানিমুনে বৃন্দাবনে এসেছিলাম। আমার মনে পড়ে আমরা ওই লজেই থেকেছি। আপনারাও রাধা ভবনে আছেন।

 ওই রাধা ভবনে যে আমরাও ছিলাম আজ থেকে পাঁচ বছর আগে। কিন্তু আমাদের বিবাহ জীবন সুখের হলো না। স্বামী এক পথ দুর্ঘটনায় মারা গেলেন। জয় রাধে। আমার স্বামী ছিলেন কবি,বাউল। সংসারে তার মনযোগ ছিল না। মালিহা গ্রামে তাদের বাড়ি ছিল। খুব আনন্দে থাকত আমার স্বামী। সে আমাকে তার জীবনের গল্প বলেছিল। স্বামীর নাম ছিল সন্তু। আসুন আমরা বিশ্রামঘাটে বসে তার গল্প বলি।

কানি নদীর পাড়ে মালিহা  গ্রাম। হারুদাদু বলতেন,এই গ্রামে পাঁচশো বছর আগে এক রাজা এসে বড় অট্টালিকা করেছিলেন এক সুন্দরীকে ভালোবেসে।সেইসব আর নাই।কালের প্রবাহে ভেসে গেছে।গ্রামে দুইশত পরিবারের বাস।বেশিরভাগই মাটির বাড়ি।স্বামীর মাটির বাড়ি।    চারচালা টিনের চাল।  টাকা গ্রামে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। সামান্য কটা টাকা আছে। সে জানে মাস চালাতে হবে। রাত বেশি হওয়ায় দোকানগুলো বন্ধ। একগ্লাস জল ঢকঢক করে পান করলো। অমৃতের স্বাদ। কিন্তু পোড়া পেট মানে না বারণ। চুঁই চুঁই করছে। তবু লেপ মুরি দিয়ে শুয়ে পরলো। গুরুর জপ শেষ করে ঘুমোয় সে। জপ করার সময় শুনতে পেলো ঠক ঠক আওয়াজ।  তাড়াতাড়ি জপ শেষ করে বললো,কে?

—-আমি, দরজাটা খুলুন।

—–জগতে সবাই তো আমি। নাম বলুন।

—–আমি পাপিয়া,আপনার বাড়িওলার একমাত্র মেয়ে।

——এত রাতে কেন?  কি প্রয়োজন বল?

——আরে খুলুন না ছাই।

দরজা খুলে দেখলো বাড়িওয়ালার সুন্দরী অষ্টাদশী মেয়েটা। হাতে একটা  বাটি। বললো,আজকে আমাদের সত্যনারায়ণ পুজো ছিলো, মা তাই প্রসাদ পাঠালেন। খেয়ে জল খাবেন। প্রসাদ খেয়ে জল খেতে হয়। জল খাবেন। এখন কি ঢাকা দিয়ে রেখে দেব।

সন্তু বলল,তাই দাও। আমি পরে খেয়ে নেব।

পাপিয়া বলল, আমি বসব। আপনার সঙ্গে গল্প করব।

— কিন্তু মেসোমশাই রাগ করবেন। রাতে গল্প।

— বকবে না। বাবাকে বলে, তারপর এসেছি। বলেছি   সন্তুদা প্রসাদ খাবে। তারপর বাটি নিয়ে আসতে দেরী হবে।

— কত আর দেরী হবে খেতে।

— কিচ্ছু বলবে না, বলছি না। বাবা আমাকে বকে না। একমাত্র আদরের মেয়ে আমি।

পাপিয়া বলল, এবার তোমার গ্রামের গল্প বলো। আমি কিন্তু তোমাকে, তুমি তুমি বলব সন্তুদা। তুমি বেশে কথা বল না কেন?  কথা বলবে এখন। আমি শুনব।

সন্তু বলেছিল, নিশ্চয় বলবো। কথা বলব না কেন?  আমি তো একাই থাকি। বল, কি বলবে।

সন্তুর মনেও একটা কোণে পাপিয়া ডাকত।

সে বলেছিল আমাকে, কিন্তু বড় সংসারের দায়ীত্ব তার কাঁধে। মায়া কাটাতে হবে। বাউলের মন হয়ে যায় সন্তুর। সে ভাবে, এসব প্রেমের বিলাসিতা কি আমার সাজে? সন্তু ভাবে,বারবার ভাবে পাপিয়ার কথা। কিন্তু ভালবাসা সহজে কেউ পায় না আর কেউ কেউ বাউল সাধক। মানুষের মাঝেই তাঁর বাসা। উদাস ভালবাসা। বৃন্দাবনের শান্তি বারিতেই যেন বিশ্বের মানুষ ভালোভাবে বেঁচে আছেন। সমস্ত দুঃখ তাপ জন্ম থেকে মুছে গেল মুহূর্তে।রমা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখল আমি জোড়হাতে বিছানায় বসে আছি।রমা জিজ্ঞেস করল কি হল তোমার তুমি কি রাধার রাগে মগ্ন আমি বললাম,হ্যাঁ আমি আমি রাধা ভাবে আচ্ছন্ন। এখন রাধার প্রেমে আমি মাতোয়ারা।জানো শ্রীকৃষ্ণ রাধা কৃষ্ণের দর্শন আমার এই ঘরে বসেই হয়ে গেল।আমি মগ্ন হয়ে থাকলাম কিছুক্ষন শ্রীরাধা ভাবে মানবদেহের রাধাভাব এর মধ্যে দেখতে পেল লেখাকে।

 লেখার সুন্দর মুখখানি ভেসে উঠেছে। সেই সেই মুখে কোনো ব্যথা নেই যন্ত্রণা নেই শুধু আলো আর আলো।

আমরা কয়েকদিন এসেছি। কিন্তু এই কদিন এসে আমাদের শারীরিক মিলন কিন্তু একবারও হয়নি।

কেমন যেন আচ্ছন্ন হয়েছি আমি। রমা খুব অবাক হল কি হল। সে ভাবল, আমার স্বামীর এ কি হল। সে ভাবল  যে শ্রী কৃষ্ণ ভক্তিতে সে হয়তো এগুলো করতে চাইছে না। এখন বাড়ি গেলে হয়ত সব ঠিক হয়ে যাবে।পরের দিন আবার শুরু হলো বৃন্দাবনের দর্শনীয় স্থান গুলো দেখার জন্য।লেখা সুন্দরী এসে গেছেন অমোঘ আকর্ষণে।অনুপ মনে মনে ভাবল এই কথা। হয়ত আমাদের ভালবাসা হয়ে গেছে প্রথম দর্শনে। লেখা বলল-এখানে দর্শনীয় স্থানের অভাব নেই যুগল ঘাঁটি সেবাকুঞ্জ ও কালিয়া ঘাটাল শ্রী কুঞ্জ গোবিন্দ কুণ্ডু শিলঘাটা মদনমোহন বাঁকে বিহারী রাধাবল্লব যুগলকিশোর রাজি দামোদর গোবিন্দ গোবিন্দ।এগুলো আমাদের দেখাও লেখা।

আমিনবললাম, আমরা একে একে সব দর্শনীয় স্থান ঘুরবো তবে প্রথমে বৃন্দাবন মন্দির টা একবার দেখাও।লেখা বলল চলুন আজ আমরা বিদ্যামন্দিরে যাই। সেখানে এক বিরাট আকর্ষণ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।লেখা বলল মদনমোহন মন্দির টি কালীঘাটে র কাছে মথুরা থেকে 15 কিলোমিটার দূরে এই মন্দির গুলো বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে আছে।রমা জিজ্ঞাসা করল আচ্ছা মুলতানি কাপুর কি এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন? লেখা বলল,  এটিই বৃন্দাবনের সবচেয়ে পুরনো মন্দির। বাঁকে বিহারী মন্দির, জয়পুর মন্দির রাধাবল্লব মন্দির মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল 1876 সালে।অন্যতম আকর্ষণ রাধাকৃষ্ণের বহু মূল্যবান অলঙ্কারসমূহ। এগুলো ভারতবর্ষের সম্পদ।

আমি বললাম আপনি এত কিছু জানলেন কি করে?

 লেখা বলল আমার এখানে প্রায় দশ বছর থাকা হয়ে গেল।

 আর বৃন্দাবন ভ্রমণ বৃত্তান্ত, বইয়ে পাবেন এসব কথা। এখানে বই কিনতেও পারেন।তাছাড়া বাইরের অনেক বই আছে। জানার ইচ্ছেটাই আসল। রমা ঘুরতে ঘুরতে লেখা আর আমার দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।সে হয়তো অন্য  কোথাও ঘুরতে গেছে।

চলে আসবে চিন্তা করবেন না। এখানে চলে আসবে। আর না হলে আমার তো সব জানা জায়গা।  আমি খুঁজে নিয়ে আসবো ।

আমি বললাম এখন ওকে দরকার নেই।এখন আমার তোমাকে দরকার।তাই আমরা হয়ত সুযোগ পেলাম বিধির বিধানে।

তোমাকে একটা গোপন কথা বলতে চাই।লেখা বলল, বলুন আমিও বলবো একটা কথা কিন্তু আমি কি করলাম আর কি, লেখাকে জড়িয়ে ধরে দীর্ঘ চুম্বনের রত হলাম।এটাই চাইছিল লেখা। তার শরীর কেঁপে উঠল।  মনে মনে তৃপ্ত হল। এর মধ্যে রমা চলে এসেছে।

তখন রমা দেখল আমি আর লেখা গল্প করতেই ব্যস্ত।

আমি বললাম আমরা সারা জীবন যদি এখানে থাকতে পারতাম তাহলে খুব ভালো হতো।  রমা বললো তাহলে ঘর-সংসার ছেলে চলো দুজনেই আমরা এখানে সন্ন্যাসী হয়ে থেকে যাই।

তারপর,আহা তারপর দুজনে মিলে এখানে সারা জীবন কাটিয়ে দিই।লেখা বলল, তাহলে আজ এই অবধি থাক। এখন রাত্রি নটা বেজে গেছে এখন আপনারা বাড়ি যান। এই বলে লেখা নিজের গন্তব্যের দিকে রওনা দিল।লজে এসে রহমান নিরামিষ খাওয়া দাওয়া দিয়ে গেল। আহার করে তারা বিছানায় শুয়ে পড়ল। তারপর রমার সঙ্গে সঙ্গমে রত হলাম।

 আজ এত ভালো লাগছে কেন রমা বুঝতে পারলো না। রমাকে আসলে লেখা ভেবে অনুপ আদর করতে শুরু করলাম।

 তার মধ্যে লেখার ভাব পরিস্ফুট হতে দেখল। লেখাকে আমি আদরে আদরে পাগল করে তুললাম।রমা বলল আমি কোনোদিন এতক্ষণ এত আনন্দ পাইনি।তুমি আজকে আমাকে খুব আনন্দ দিলে।আমি বললাম, রমা তুমি কি শুনতে পাচ্ছ চারিদিকে বাঁশির আওয়াজ।কি মিষ্টি শ্রীকৃষ্ণের বাঁশির আওয়াজ ভেসে আসছে।

তুমি কি শুনতে পাচ্ছ বাঁশির আওয়াজ।এই বাঁশির আওয়াজ আমি শুনে এত আনন্দ  হচ্ছে কেন।রমা বলল,কই আমি তো বাঁশির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি না পাচ্ছি না। তুমি কি পাগল হয়ে গেলে।

আমি বললাম, আমি বোধহয় ভুল শুনছি নাকি। ঠিক শুনছি। এই তুমি কি পেতে শোনো দেখো বাঁশির আওয়াজ ভেসে আসছে চারিদিক থেকে।এমন সময় রমার মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো। এতদিন লেখার সঙ্গে যোগাযোগ রমার সঙ্গে কথাবার্তা সব মোবাইল ফোনেই হয়েছে। লেখার মোবাইল ফোন আছে।  ফোনে রমাকে জিজ্ঞেস করল,  আপনি কি বাঁশির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন?

চারিদিক থেকে বাঁশির আওয়াজ ভেসে ভেসে অন্তর ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে প্রেম সুন্দরের কাছে।   সুন্দর বাঁশির আওয়াজ ভেসে আসছে আসছে রমাদি। রমাদি আপনি শুনছেন। সন্তু দা কি শুনতে পেয়েছেন বাঁশির ইশারা।  রমা নিরুত্তর হয়ে বসে রইল।হারিয়ে যাওয়ার ভয় চেপে ধরল রমার অন্তর। সে বলল,না আর নয়, এবার ফিরতে হবে।

আমি বললাম,ফিরতে পারব কি? ফেরা যে কঠিন হল মরমিয়া।

রমা অনুপের কথায় হেঁয়ালির সুর খোঁজে। বাঁশির সুর তার কানে বাজে নি। সে জানে না, এখনও এখানে বাঁশি বাজে। সারা পৃথিবী জুড়ে বাঁশির খেলা চলেছে নিশিদিন। মোবাইলের ও প্রান্ত থেকে শোনা গেল লেখার গলায় বাঁশির করুণ সুর, রমার মোবাইলে সাউন্ড হাই থাকায়।  হ্যালো হ্যালো হ্যালো, আমি শুনছি বাঁশির সুর। এসুরে আমি মাতোয়ারা। এ সুর ভালবাসার…

তারপর বাড়ি চলে গেলাম কিন্তু মন পড়ে রইল বৃন্দাবনের লেখার খাতায়। আবার বাড়ি ছাড়লাম। লেখা শিখিয়ে দিল দেহ ছাড়া প্রেম। সে বৃন্দাবনের আশ্রম ছেড়েএল না আমার সঙ্গে। আমার আর খেদ নেইন।দেখেছি পরম পুরুষের ঈশারা। আমি গ্রামে যাব। চাষ করব। আর কোন তরুণ যেন গ্রাম ছেড়ে বাইরে না যায়। আমি তোমাদের সাহায্য চাই।

রাজু বলল,আমরাও চাষ করব। আর কোথাও  যাব না। আমরাও অন্য তরুণদের উদ্বুদ্ধ  করব। এখন থেকে এটাই হবে আমাদের মন্ত্র। আজ সকালে উঠে থানার আই সির পারমিশন নিয়ে তারা ট্রেনে চেপে বসলনএক মাস পরে। আর কোন বাধা নেই। নতুন পৃথিবী গড়বে এবার নব উদ্যমে।

সুদীপ ঘোষাল

গ্রাম + পো– বড় পুরুলিয়া

জেলা পূর্ববর্ধমান

৭১৩১৪০

মো ৮৩৯১৮৩৫৯০০

মেলsudipghoshal59@gmail.com

সুদীপ ঘোষাল। গল্পকার। জন্ম ভারতের পশ্চিমব্ঙ্গরাজ্যের কেতুগ্রামের পুরুলিয়া গ্রামে। প্রকাশিত বই: 'মিলনের পথে' (উপন্যাস)। এছাড়াও কয়েকটি গল্প ও কবিতার বই আছে।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ