করাচিতে নজরুল
করাচি বন্দরে এককালে গ্রিক-পারসিক-আরবীয় সওদাগরেরা নোঙ্গর করেছে; অনেক স্থাপত্য চিহ্ন আজো রয়ে গেছে; যা…..
বাংলা সাহিত্যের প্রাঙ্গণে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের অলক্ষিত আবির্ভাব যে সময়ে হয়েছিল, তার অনেক আগে থেকেই বাংলার সাহিত্যাকাশে নারী সাহিত্যিকদের সদর্প পদচারণা শুনতে পাওয়া যায়। আশাপূর্ণা দেবী, মহাশ্বেতা দেবী, নবনীতা দেবসেন, বাণী বসুদের হাত ধরে বাংলা সাহিত্যের পাঠক-পাঠিকারা ইতিমধ্যেই স্রষ্টা নারীর কলমে নারীর কথা শুনতে এবং জানতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এমতাবস্থায় সুচিত্রা ভট্টাচার্যের পক্ষে নিজেকে পাঠকের হৃদয় সিংহাসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করার কাজটি খুব একটা সহজসাধ্য ছিল না, কিন্তু তাঁর দুর্দমনীয় লেখনী প্রতিভা অচিরেই সেই অসাধ্যসাধন করতে সক্ষম হয়েছিল। এখানেই একজন সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর অনন্যতা এবং তাঁর সৃজনশীলতার অসামান্যতা। নারীকে তাঁর সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, আবেগ-অনুভূতিতে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে ফুটিয়ে তুলে পাঠক-পাঠিকার সামনে নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করতে এবং নারীর প্রতি সমাজের নানা অবহেলাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে সাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টাচার্যের শক্তিমান কলম সদা তৎপর এই কথা অনস্বীকার্য।
বলাবাহুল্য, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সাহিত্যিক হিসেবে সুচিত্রা ভট্টাচার্য অনায়াস দক্ষতায় পাঠক-পাঠিকার মন জিতে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যে তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ ছোটোগল্পকার হিসেবে হলেও খুব শীঘ্রই তিনি উপন্যাস রচনাতেও সমান জনপ্রিয়তা অর্জনে সমর্থ হন। প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে তিনি বহু ছোটগল্প এবং চব্বিশটি উপন্যাস রচনা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠনপাঠনের সময় থেকেই তাঁর লেখালেখির সূত্রপাত, সচেতনভাবে শুরু করেন মোটামুটি সত্তরের দশকের শেষের দিক থেকে। ছোটগল্পে তাঁর বিপুল সাফল্য তাঁকে আশির দশকের মধ্যভাগে উপন্যাস রচনায় উৎসাহিত করে। তবে তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তার শুরু নব্বইয়ের দশকে।
বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের নারীরা সুচিত্রার সৃষ্ট বিভিন্ন নারী চরিত্রের মধ্যে যেন নিজেকেই খুঁজে পান। ব্যক্তিজীবনে সুচিত্রা ভট্টাচার্য শহুরে পরিমণ্ডলের অধিবাসী হবার জন্য তাঁর সৃষ্ট নারীচরিত্রগুলিতে কিছুটা নাগরিকতার ছাপ সুস্পষ্ট। সূক্ষ্মবিচারে আমরা দেখতে পাই, তাঁর রচনায় সামাজিক অবক্ষয়ের ছবি যথেষ্ট প্রকট। শহুরে মধ্যবিত্তদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েন, বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে নৈতিক অবক্ষয়, যুগের পরিবর্তনশীলতা ইত্যাদি তাঁর গল্পের অন্যতম প্রধান বিষয়বস্তু হিসেবে চিহ্নিত।
তাঁর রচিত সাহিত্যে নারী-ভাষ্য তৈরির একটি তাগিদ সময়ই সব সময়েই লক্ষ করা যায়। সাহিত্যে উত্তর-ঔপনিবেশিকতা অনুযায়ী নির্যাতিতার ভাষায় তৈরি হবে তাঁর মুক্তির সনদ। তাই নারীদের দুঃখ-যন্ত্রণা ইত্যাদিকেই সৃষ্টির মূল উপজীব্য বিষয় হিসেবে নির্বাচন করে লেখিকা সেটিকেই আমাদের সামনে নির্দ্বিধায় উপস্থাপন করেছেন। কোনো তাত্ত্বিক আবহের জটিল ঘূর্ণিতে নিজের সৃষ্টিকে আবদ্ধ না রেখে তিনি জীবনের বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত আর বাস্তবতার মাঝে নির্ভীকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন আমাদের তথাকথিত সমাজ সংসারে নারীদের দৈন্য অবস্থানটিকে।
আধুনিক মধ্যবিত্ত সমাজকে কেন্দ্র করে লেখা তাঁর নাতিদীর্ঘ উপন্যাস “অদ্ভুত আঁধার এক”। এই উপন্যাসটির ছোট্ট পরিসরে তিনি অঙ্কন করেছেন, ব্যক্তি নয়, আসলে এক অসুস্থ সমাজ ব্যবস্থাই অসামাজিক কাজের সৃষ্টি করে। বাস্তবের মতোই তাঁর সৃষ্ট চরিত্ররাও তাই পরিস্থিতির শিকার মাত্র। তাঁর সাহিত্যে সুন্দর একটা পরিমিতি বোধের পরিচয় আমরা পেয়ে থাকি অথচ সেই পরিমিতি বোধ কখনো সামাজিক অবক্ষয়কে প্রশ্ন তুলতে পিছপা হয় না।
একই প্রেক্ষাপটে লেখা অত্যন্ত জনপ্রিয় তাঁর “দহন” উপন্যাসটি। মধ্যবিত্ত ব্যক্তিজীবনের ভণ্ডামি, কীভাবে নারীর জীবনকে অসহনীয় করে তুলতে পারে সেই কথাটা লেখিকা আশ্চর্য সূক্ষ্মদর্শিতায় তুলে ধরেছেন। বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে লিখিত এই উপন্যাস একজন গৃহবধূ ও একজন সাবলম্বী স্কুল শিক্ষিকার জীবন সংগ্রাম এবং তাকে কেন্দ্র করে পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ে লেখা এক বাস্তবসম্মত আলেখ্য। তাঁর প্রায় প্রত্যেকটি সৃজনশীল সৃষ্টিতেই তিনি নারী-স্বাধীনতার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে চেয়েছেন আর সমাজের নপুংসক আর ঠুনকো মুল্যবোধকে সামনে এনে প্রশ্নবাণে লেখিকা জর্জরিত করেছেন। এই উপন্যাসটির জন্য ১৯৯৬ সালে তিনি কর্ণাটকের বেঙ্গালুরুর শাশ্বতী সংস্থা থেকে পেয়েছেন ননজনাগুড়ু থিরুমালাম্বা জাতীয় পুরস্কার। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋতুপর্ণ ঘোষ ১৯৯৭ সালে এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। যা বেশ কয়েকটি ক্যাটাগরিতে জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে। এছাড়া ‘ইচ্ছে’, ‘রামধনু’, ‘অলীক সুখ’-এর মতো বেশ কিছু জনপ্রিয় চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে তাঁর লেখা থেকে।
সবিস্তারে লিখিত তাঁর “কাছের মানুষ” উপন্যাসটির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ চরিত্রচিত্রণ এবং কাহিনীর ঘনঘটা তথা বাস্তবচিত ঘটনাবিন্যাস তাঁকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গ শীর্ষ স্পর্শ করতে অত্যন্ত সাহায্য করে। বাঙালীর সমাজে নারীর ভাষ্য তাঁর কলমে যেন স্রোতস্বিনী ঝরনা হয়ে সমাজে নারীর অপ্রাপ্তি, অমর্যাদা, ও অবহেলাকে জনমানসে নতুনভাবে তুলে আনে। একজন সার্থক সমাজ সচেতন লেখিকা হিসেবেই সমাজ তাঁকে বরণ করতে বাধ্য হয়, এই কথা অবশ্যই অতিশয়োক্তি নয়। তাঁর “অন্য বসন্ত” “কাচের দেওয়াল”, “হেমন্তের পাখি”,”নীল ঘূর্ণি”,”অলীক সুখ”,”গভীর অসুখ”,”উড়ো মেঘ”,”ছেঁড়া তার”,”আলোছায়া”,”অন্য বসন্ত”,”পরবাস”,”পালাবার পথ নেই”,”আমি রাইকিশোরী”,”রঙিন পৃথিবী”, “জলছবি”, “যখন যুদ্ধ”,”ভাঙ্গন কাল”,”আয়নামহল”,”মারণ বাতাস”,”তৃষ্ণা মারা গেছে” প্রভৃতি প্রত্যেকটি উপন্যাসেই নারীর প্রতি সমাজের উপেক্ষা, অবজ্ঞাকে তিনি অবলীলায় প্রশ্ন ঠুকেছেন। নারীর ভূমিকাকে, নারীর যোগ্যতাকে স্বমহিমায় তুলে ধরেছেন। মানুষের সঙ্গে মানুষের আত্মিক সম্পর্কের নানা দিক নিয়ে নারী কণ্ঠে নারী স্বরেরই প্রতিধ্বনি শুনেছি আমরা তাঁর লেখার পর লেখায়।
ব্যোমকেশ, ফেলুদা, কাকাবাবু, শবর, কীর্তি, কর্নেল, বিমল কুমার রায়, পাণ্ডব গোয়েন্দা প্রভৃতি পুরুষ গোয়েন্দা এবং নন্দিনী সোম, দয়মন্তী, নারায়ণী প্রভৃতি নারী গোয়েন্দাদের ভীড়েও আমাদের কিন্তু সুচিত্রা সৃষ্ট মিতিন মাসিকে চিনে নিতে কোনো অসুবিধা হয় না। কলকাতার ঢাকুরিয়ার বাসিন্দা মিতিনের ভাল নাম প্রজ্ঞাপারমিতা মুখার্জী। তবে সে তার বোনঝি টুপুরের কাছে মিতিন মাসি এবং বাঙালি রহস্যপ্রিয় পাঠক পাঠিকার কাছে গোয়েন্দা মিতিনমাসি নামে পরিচিত। টুপুর মিতিনের সহকারি হিসেবে সবসময় মিতিনের কেসে সাহায্য করতে চেষ্টা করে৷ মিতিনের স্বামী পার্থ প্রেসে কাজ করেন। তিনি খাদ্যরসিক ও কল্পনাবিলাসী ব্যক্তি। মিতিনের কাছে পুলিশের ডি আই জি অনিশ্চয় মজুমদার মাঝে মাঝে পরামর্শ নিতে আসেন। অপরাধ বিজ্ঞান, ফরেন্সিক সায়েন্স, অপরাধীদের মনঃস্তত্ত্ব, নানা রকমের অস্ত্রশস্ত্রের খুঁটিনাটি, অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, নানা রকম আইন সব কিছু নিয়েই চর্চা করেন মিতিন। তিনি ক্যারাটে জানেন, রিভলভার সঙ্গে রাখেন আবার রান্নাতেও পটু। সুতরাং আমরা বুঝতেই পারছি যে, মিতিন মাসির রূপচিত্র অঙ্কনে সুচিত্রা ভট্টাচার্য অতিমাত্রায় সচেতন ছিলেন। মিতিন মাসি এই বাংলারই কোনো এক নারী। তাঁকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে পাঠকের দরবারে লেখিকা হাজির যেমন করিয়েছেন, তেমনই প্রমাণ করতেও সমর্থ হয়েছেন যে, সবদিক থেকেই আজকের নারী, পুরুষের সমকক্ষ ও সমদক্ষ হবার ক্ষমতা রাখে।
মিতিন মাসির প্রথম আত্মপ্রকাশ অবশ্য প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। প্রথম উপন্যাস ‘পালাবার পথ নেই’ আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয়তে প্রকাশিত হয়। মিতিন মাসি এই উপন্যাসেই সাহিত্য রসিক বাঙালীকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হন। এছাড়াও ‘বিষ’, ‘মারণ বাতাস’, ‘তৃষ্ণা মারা গেছে’ ও ‘মেঘের পরে মেঘ’ প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য লেখা উপন্যাস ও বড়গল্প। কিশোরদের জন্য মিতিন কাহিনী প্রথম পুজোসংখ্যা আনন্দমেলা ২০০২ সালে প্রকাশিত হয়। নাম ছিল ‘সারাণ্ডায় শয়তান’। এরপর থেকে মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত নিয়মিতভাবে সুচিত্রা ভট্টাচার্য মিতিনমাসির গোয়েন্দা অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকীতে লিখে গেছেন। মিতিন সিরিজের শেষ উপন্যাস ‘স্যান্ডার্স সাহেবের পুঁথি’ প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। আনন্দমেলা পত্রিকার পুজোসংখ্যাগুলিতে প্রকাশিত মিতিন মাসি সিরিজের উপন্যাসগুলি হল:- “সারাণ্ডায় শয়তান”,”জোনাথনের বাড়ির ভূত”,”কেরালায় কিস্তিমাত”,”সর্প-রহস্য সুন্দরবনে”,”ঝাও-ঝিয়েন হত্যারহস্য”,”ছকটা সুডোকুর”,”আরাকিয়েলের হিরে”,”গুপ্তধনের গুজব হাতে মাত্র তিনটে দিন”,”কুড়িয়ে পাওয়া পেনড্রাইভ”,”মার্কুইস স্ট্রিটে মৃত্যুফাঁদ”, “টিকরপাড়ার ঘড়িয়াল”,”দুঃস্বপ্ন বারবার”,”স্যান্ডরসাহেবের পুঁথি”। মিতিন মাসি একদিকে যেন ঠিক আমাদের অতি পরিচিত পাশের বাড়ির একটি মেয়ে অন্যদিকে তাঁর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সত্যানুসন্ধান শুধু শিশুদের কেন, আমাদের প্রত্যেককেই মুগ্ধ করে। এখানেই লেখিকার মুন্সিয়ানা লুকিয়ে রয়েছে।
তাঁর প্রায় সব উপন্যাসেই একটা বৈঠকি মেজাজ লক্ষ করা যায়। মূলত মধ্যবিত্ত সমাজ সংসারে বড় হওয়া মেয়েদের জীবন যন্ত্রণার প্রতিটা ঘটনা, আক্ষরিকভাবে তাঁদের জীবন সংগ্রামের ইতিবৃত্ত সাহিত্যের মাধ্যমে জনসমক্ষে তুলে ধরার মহান কাজটি তিনি নিরলসভাবেই করেছেন। সম্পর্কের জটিলতা এবং সেই জটিলতা নিরসনে নারীদের আত্মত্যাগের প্রসঙ্গ বারবার তাঁর গল্প উপন্যাসে উঠে এসেছে। সূক্ষ্ম প্রতীকী ব্যঞ্জনায় চরিত্র ও ঘটনার পরিপূর্ণ বিচার বিশ্লেষণ, চরিত্রের অনুপুঙ্খ বাস্তবতা তথা কাহিনী বিন্যাসের নিপুণ ও নিটোল বুনোটে তাঁর কলম অত্যন্ত শক্তিস্থালী। এই শক্তিই বাংলা কথাসাহিত্যে তাঁকে নিঃসন্দেহে অমরত্ব দান করেছে এই কথা একেবারেই অতিশয়োক্তি নয়।।
করাচি বন্দরে এককালে গ্রিক-পারসিক-আরবীয় সওদাগরেরা নোঙ্গর করেছে; অনেক স্থাপত্য চিহ্ন আজো রয়ে গেছে; যা…..
তিনি বললেন, ভাষা হল ওষ্ঠের উপর সুধার মতো। আর বললেন, কবিতা যথেষ্ট স্বাদু, কিন্তু…..
রূপকথা পড়েছেন ছোট বেলায় অনেকে একথা আর বলা সন্দেহমুলক, প্রযুক্তির ব্যবহার জন্মের পর থেকে এখন …..
একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..