পাগলীটাও মা হয়েছে

শাহানাজ ইয়াসমিন
অণুগল্প
Bengali
পাগলীটাও মা হয়েছে

রিয়া প্রতিদিন তাদের কাঠালবাগানের বাসার সামনে থেকে রিকসা নিয়ে অফিসে যেত। ইস্কাটনের ছোটখাট একটি পত্রিকা অফিসে রিয়া কাজ করতো। পত্রিকা অফিসের কাজ রিয়ার বরাবরেই খুব পছন্দ। তাই অল্প সল্প মাইনে পেলেও ভালোলাগা থেকে কাজটি করে যেত।

প্রতিদিন বাসার সামনে থেকে রিকসায় উঠতো আর বাংলামোটরের ওভারব্রিজের কাছে রিকসা ছেড়ে ওভার ব্রিজ পার হয়ে আবার একটা রিকসা নিয়ে অফিসে যেত। দিনেরপরদিন এভাবেই আসা যাওয়া করতো। একদিন রিকসা থেকে নেমে রিয়া ব্রিজে উঠার সময় দেখলো ব্রিজের গোড়ায় এক পাগলী বসে রয়েছে। গায়ে প্রচণ্ড ময়লা হাত ছেঁড়া জামা আর পরনে পায়জামা। গায়ে কোনো ওড়না নেই, মাথার চুলগুলো ঘন আর কোকড়ানো। ময়লা জমে জমে চুলগুলো জটলা পাকতে শুরু করছে। পা দুটো লম্বা করে ছড়িয়ে বসে দু’হাতে মাথা চুলকানোর কাজে ব্যস্ত।

পাগলীকে দেখে রিয়া কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তার কার্যকলাপ দেখতে লাগল। রিয়াকে দেখামাত্রই পাগলীটা হাসি দিলো। রিয়া ভয় পেয়ে পেল পাগলীর হাসি দেখে। এক পর্যায়ে তাড়াতাড়ি ওভারব্রিজের ওপরে উঠে ওপাড়ে গিয়ে রিকসা নিয়ে অফিসে পৌঁছুল। চা খেয়ে কাজে বসেও পাগলীকে নিয়েই ভাবছে নানান ভাবনা। আচ্ছা পাগলীটা রাতে একা কী করে থাকে? ওর কোনো সমস্যা হয়না তো! আচ্ছা ওর ভয় লাগে না বাঁচা মরার! সেদিন বেশ ভাবতে শুরু করলো রিয়া পাগলীর জীবনযাপন নিয়ে। কিন্ত অফিসের কাজ বলে কথা! কাজের চাপে এক পর্যায়ে ভুলেই গিয়েছিল রিয়া পাগলীর কথা। অফিস শেষে বাসায় ফেরার সময় সেই বাংলামোটরের ওভারব্রিজে উঠতে গিয়ে আবার মনে পড়লো পাগলীল কথা। ব্রীজ পার হয়ে রিকসা নেওয়ার পূর্বে ব্রিজের গোড়ায় উঁকি মেরে দেখলো পাগলীটা সেখানে নেই। রিয়া চিন্তায় পড়ে গেল, পাগলীটা গেল কোথায় এটা তাকে ভাবিয়ে তুলল।

বাসায় গিয়েও সারাক্ষণ পাগলীটার কথাই ভাবতে লাগলো। কোনো কাজে মন বসাতে পারলো না। পরদিন অফিসে আসার সময় পাগলীর খোঁজ করলো সে, কিন্তু কোথাও পাগলীকে দেখতে পেল না। এভাবে প্রতিদিন অফিসে যাওয়া-আসার পথে পাগলীর বসে থাকার জায়গায় চোখ পড়লেও পাগলীকে আর দেখতে পেল না। একসময় রিয়া নিত্যদিনের ব্যাস্ততায় ভুলে গিয়েছিল গিয়েছিল সেই পাগলীর কথা।

প্রায় একবছরের মাথায় রিয়া তার বন্ধুকে নিয়ে শাহবাগ, ছবিরহাট পার হয়ে দোয়েল চত্ত্বরের দিকে যাচ্ছিল গোধূলীলগ্নে। এমনসময় ছবিরহাট পার হয়ে ফুটপাতে দেখতে পেল সেই পাগলীকে, যাকে এক বছর আগে বাংলামোটরে দেখেছিল। পাগলী একা নয়, তার সাথে রয়েছে একটি ফুটফুটে নবজাতক শিশু। সম্ভবত মেয়েই হবে। চোখদুটো বেশ লম্বা লম্বা, টানা টানা; মাথার চুলগুলো ঘন কালো। হাতের ও পায়ের আঙ্গুলগুলো গোলাপী রঙের। বয়স সম্ভবত একদিন হবে। পাগলীর শরীরের কাপড়ে  রক্তের দাগ। শুধু তাই নয়, মুখে কপালে গালে হাতে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। সাথের ছেঁড়া কাঁথাটি ময়লার জন্য কোন রঙ চিহ্নিত করা না গেলেও রক্তের ছাপ ঠিকই বোঝা যাচ্ছিল। পাগলী বাচ্চাটিকে মাটিতে বিছানো সেই কাঁথার ওপরে শুইয়ে রেখে বুকের উপরের দিকটায় কাঁথার একটি কোন দিয়ে ঠেকিয়ে রেখেছে। পাগলীর শরীরের কাপড়ে তখনো রক্তের দাগ। পাগলী মাতৃত্বের দায়িত্ব পালন করছে নবজাতকের পাশে বসে। রিয়ার সে দৃশ্য দেখে বুকের ভিতরে দুমড়ে মুচড়ে একাকার হয়ে গেল। পাশে তার বন্ধুর হাতটি শক্ত করে চেপে ধরে বললো, ‘দ্যাখো পাগলীটাও মা হয়েছে! কিন্তু কেউ বাবা হতে পারলো না!’ এ কেমন সমাজ, এ কেমন অবিচার!

রিয়ার দু’চোখ জলে একাকার!

শাহানাজ ইয়াসমিন। লেখক। জন্ম বাংলাদেশের রংপুর জেলায়, পেশাগত সূত্রে ঢাকায় বাস। তিনি অংশুমালী'র বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রকাশিত বই: 'গহিনের প্রেম' (কাব্যগ্রন্থ, ২০১৭),  'মেঘলা আকাশ' (উপন্যাস, ২০১৮), 'সমুদ্রের তরি' (উপন্যাস, ২০১৯), 'ভালোবাসা ছুঁয়ে গেলে' (উপন্যাস, ২০২০)।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

দৌড়

দৌড়

একবার এক দৌড় প্রতিযোগিতায় কেনিয়ার হয়ে দৌড়চ্ছিলেন আবেল মুতাই। খুবই ভালো দৌড়াচ্ছিলেন তিনি। সবাইকে পেছনে…..