শাহীদ লোটাস এর মুক্ত-গদ্য
১৮ মার্চ ২০১৯ মধ্যরাত! চারদিক অন্ধকারে ঢেকে আছে শুধু বাড়ির চারিপাশে বিদ্যুতের বাল্বগুলো জ্বলছে তাদের…..
চৌদ্দ পনেরো বছর আগের কথা; আমি বসে আছি একটি দোকানে, দোকানটি মূলত আমাদেরেই। দোকানের সামনে পিচ ডালা পথ । গ্রামের মানুষজন শহরে উঠে এই পথ ধরে আবার শহরের মানুষজন গ্রামে যায় এই পথ ধরেই, মূলত এটি একটি বাজার, একে সবাই নতুন বাজার বলেই চিনে। শহর আর গ্রামের সংযোগ স্থলের কারণে ধীরে ধীরে এই বাজারের সৃষ্টি হয়েছিলো বহু বহু বছর আগে । যাই হোক, সামনে দিয়ে অনেক মানুষজন যাতায়াত করছে । আমি কি যেন করছিলাম, এমন সময় মধ্য বয়সের একজন লোক অপরিষ্কার ছেড়া পোশাক পড়ে হেলে-দুলে উদ্দেশ্যহীন ভাবে সামনের পিচ-ডালা পথে হাঁটছে দেখলাম, দেখেই বোঝা যায় লোকটি পাগল। এই বিকৃতমস্তিষ্কের লোকটিকে দেখে আরো বোঝা যাচ্ছে সে মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন শিক্ষিত মানুষ । আমি এই পাগল লোকটির দিকে তাকিয়ে আছি, হয়ত ভালো লাগছে বা তার সম্পর্কে ভাবছি এই কারণেই আমার দৃষ্টি তার দিকে বারবার যাচ্ছে, আমার দৃষ্টি লোকটি লক্ষ্য করলো মনে হয় । সে রাস্তার অপর পাশে ছিলো, হঠাৎ পাগল লোকটি পিচ ঢালা পথ থেকে আমাদের দোকানের ভেতরে আমার খুব কাছে এসে দাঁড়ালো। আমি যেন তার আসার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম বা তার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, এমন মনে হলো আমার । আমি পাশের খালি বেঞ্চ ইশারা করে তাকে দেখিয়ে তাকে বসতে বললাম, বেঞ্চটি দেয়ালের সঙ্গে লাগলো। লোকটি আমার ইশারায় সাহস পেয়ে সে বেঞ্চে বসে পড়লো, দেয়ালে হেলান দিয়ে আপন মনে কি যেন ভাবতে থাকলো তখন । আমি তাকে নিয়ে কথা বলছি, সে তা বুঝতে পারছে কি না বুঝা গেলো না, এক সময় বুঝতে পারলাম আমি যা বলি তার দিকে তার সামান্য তম খেয়াল নেই, সে তার মত করেই ভাবছে, কথা বলছে। তার নাম ঠিকানা আরও অনেক কিছু আমি জানত চাইছি তার কাছে, কিন্তু সে উত্তরে কিছুই বলছে না আমাকে । মাঝে মাঝে সে পেছনের দেওয়ালে তার মাথা জোরে জোরে ঠুকছে আর বলছে, সক্রেটিস পারলো আর আমি পারলাম না ! তার এই বাক্যটিতে ছিলো অনেক বেদনা, যন্ত্রণা, অপ্রাপ্তির কষ্ট । বলতে বলতে পাগল লোকটি উত্তেজিত হয়ে উঠলো, আর তাৎক্ষনিক বসা থেকে উঠে সে আগের মতো আবার হাটা শুরু করলো । কিছুক্ষণের মধ্যেই সে অদৃশ্য হয়ে গেলো আমার দৃষ্টির সীমানা থেকে ।
সত্যি বলতে পাগল কি ? আবেগ, উত্তেজনায় যখন আমরা অন্যের মনো পুত কোন কাজ না করে নিজের মত করে সম্পাদন করি তখনেই তো আমাদেরকে অন্যরা পাগল বলে । তাই না ? একজন পাগল সে যা করছে তা কিন্তু তার কাছে সঠিক আর তার কাজ করা যে সঠিক হচ্ছে তারও অনেক যুক্তি সে দাড় করাতে পারে তার যুক্তি থেকে । মূলত কোন একজন মানুষের আকস্মিক কোন আঘাতে যে কষ্ট পায় সেই কষ্টের বহিঃপ্রকাশের নমুনাই পাগলামি । যারা নিজের এই কষ্ট ধৈর্যধারণ করতে পারেন তারাই এই পাগল হওয়ার আশঙ্কা থেকে মুক্ত হয়ে যান । মূলত যারা কোন সমস্যা সমাধানের সরল পথ না পেয়ে, অস্পষ্ট ভ্রান্তিতে পথ খোঁজেন তখনেই তাদের বিবেক বুদ্ধির বিকৃতি ঘটে আর এমন মস্তিষ্ক বিকৃতির কারণে তার দ্বারা অস্বাভাবিক হতে থাকে । একজন পাগলের থাকে অস্বাভাবিক কিছু আকাঙ্ক্ষা, যা সহজেই পাওয়া যায় না বা তারা মনে করে, সে যায় আশা করে ছিলো আর চেষ্টা করেছিলো সে তা পায় নি কিন্তু তার সেই প্রত্যাশিত ব্যাপারটি অন্য কেউ পেয়ে গেলো, কেন এমন হলো ! সে কেন পেলো না ! সে তো তার জন্য উপযুক্ত ছিলো, যোগ্য ছিলো । তার যোগ্যতা থাকার পরেও সে পাইনি, অন্য কেউই পেয়েছে । এই অন্য কেউ যা পেলো সে তা পায় নি এই হলো তার আঘাতের কারণ ।
পাগল নিয়ে সমাজের লোকমুখে অনেক কথাই প্রচলিত আছে, কেউ কেউ বলেন কোন পাপের ফল স্বরূপ একজন মানুষ পাগল হয়ে যায়, অভিশপ্ত জীবনের শাস্তি হলো পাগল হয়ে বেঁচে থাকা। আবার কেউ কেউ ধোঁকায় পরে পাগল হয়, মানে কেউ কারো প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের পর যখন দেখে আসলে তার বিশ্বাস যার প্রতি ছিলো সেই মানুষটি তার বিশ্বাসের মর্যাদা দেয় নি তখন বিশ্বাসী মানুষটি হতাশায়, ঘৃণায়, প্রচণ্ড আবেগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন, এক সময় তার কাছে পৃথিবীর সবাইকে ঘৃণ্য বা অপরাধী মনে হয়, বিশ্বাস করে প্রতারিত হওয়া মানুষটি কোন কাজে আর আস্থা রাখতে পারেন না কোর প্রতি, তার কাছে পৃথিবীটাই একটি ধোঁকা মনে হতে থাকে ধীরে ধীরে, পৃথিবীর সবাইকে ধোঁকাবাজ ভাবতে থাকেন তিনি, আর এই অবিশ্বাস থেকে তখন সে যা করে তা সাধারণ মানুষের কাজকর্ম থেকে ভিন্ন হয় আর সেটাই হলো পাগলামি । পাগলামির বিভিন্ন স্তরের হতে পারে, অনেকেই আছেন সুস্থ স্বাভাবিক কিন্তু কোন কোন কাজ তার ভুল বা হাসির রসদ যোগায়, তখন তাকে আমরা আদর করে ভালোবেসে বা দমক দিয়েও বলি ‘ পাগল ‘, এই পাগলামি পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের মাঝেই থাকে, থাকতে হয়, না থাকলে আবেগহীন মানুষ বলে আমরা তাকে চিহ্নিত করতে পারি । আবার আরেক স্তরের পাগল আছে যারা ঋতু ভিত্তিক পাগল, হয়ত শীতকালে তারা সুস্থ স্বাভাবিক আর গরম কালেই অস্বাভাবিক। আবার আরেক প্রকারের পাগল আছে যারা সব সময়েই অস্বাভাবিক, কখনই তারা সুস্থ জীবনে ফিরে আসে না, এই শ্রেণীর পাগলেই মূলত পাগল উপাধি পাওয়ার শ্রেষ্ঠ দাবীদার ।
প্রকৃতি তার মতো করে নির্দিষ্ট কিছু নিয়মনীতি তৈরি করে নিয়েছে পৃথিবীতে, সেই নিয়মের কারণে আমরা অধিকাংশ সময়েই নিদারুণ কষ্ট পাই, নিজেকে সামলাতে পারি না, মনে হয় পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আর অর্থই হয় না, পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে তরুণ অথবা যুবক বয়সে, মূলত এই বয়সেই একজন মানুষ স্বপ্নঘোরে থাকে বেশি। কারো প্রতি মায়ায় আচ্ছন্ন হওয়া ঝুঁকি এই বয়সেই হয়ে থাকে সর্বাপেক্ষা অদিক, তরুণ বয়সেই একটি ছেলে আর একটি মেয়ে যুগল বন্ধী হয়ে সমস্ত জীবন এক সঙ্গে থাকার প্রতিশ্রুতি নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করে, দিনের পর দিন তাদের এই স্বপ্ন মায়া সৃষ্ট করে, এই মায়া নিয়ে যায় স্বর্গের মত কোন রাজ্যে, এক সময় এই মোহ কাটানো আর সম্ভব হয় না, কিন্তু এই স্বপ্নের মাঝে কোন একজন যদি বিশ্বাস নষ্ট করে ফেলে, অপর জন তখন তা সইতে পারে না, ফলে তার কাছে পৃথিবী হয়ে পড়ে দুর্বিষহ, বিশ্বাস করা প্রিয়জনের কপটায় সে প্রচণ্ড আহত হয়, এই বিশ্বাস ঘাতকতাকে অনেকই মেনে নিতে পারে সহজ ভাবে, যারা সহজ ভাবে মেনে নেয় তারা এক সময় মিথ্যে প্রেমের এই মোহ থেকে মুক্ত হন, তার পক্ষে সুস্থ জীবনে ফিরে আসা সম্ভব হয়, আর যে প্রিয়জনের এই বিশ্বাস ঘাতকতা মেনে নিতে পারে না তার কাছে পৃথিবীর সব কিছুই ধীরে ধীরে কাপট্য মনে হতে থাকে, আর এক সময় সে প্রকৃতি বিরুদ্ধ কাজে লিপ্ত হয়ে যায়, আর তখনেই আমরা তাকে পাগল বলে ভূষিত করি। আমাদের মা, বাবা, ভাই, বোন, দাদা, দাদী বা সন্তান প্রাকৃতিক ভাবেই পৃথিবীতে আসে আবার প্রাকৃতিক ভাবেই পৃথিবী থেকে চলে যায়, আকস্মিক কোন ঘটনায় তাদের চিরতরে বিদায় বেলায় আমরা বর্ণনাতীত কষ্ট পাই, স্নেহমমতার ডোরে সংসারে যে মানুষটির সঙ্গে এতকাল জীবন যাপন করা হলো তাকে বিদায় জানাতে সত্যিই আমাদের খুব কষ্ট হয় আমাদের । এ প্রকৃতির নিয়ম! একদিন আমাদেরও এভাবেই পৃথিবী থেকে আপনজন সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে হবে, এই বেপারটি যিনি বুঝতে পারেন তার কাছে আপনজন হারানোর ব্যথা সাময়িক কষ্ট নিয়ে আসে, এক সময় তার পক্ষে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা সম্ভবপর হয় আর যিনি বুঝতে পারেন না তিনি স্বজন হারানোর এই শূন্যতায় এক সময় অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকেন, আর এমতাবস্থায় তিনিও ধীরে ধীরে এমন কর্মকাণ্ড প্রকাশ করতে থাকেন যা অস্বাভাবিকতাই প্রকাশ পায় আর তখন তাকেও আমরা পাগল বলি ।
আমরা যারা গ্রামে বসবাস করি প্রায় সবাই জানি বা স্বচক্ষে দেখেছি জিনে ধরা পরী ধরা বা শয়তানে ভড় করা মানুষকে । যার কথা আচার আচরণ উগ্র, আবুল তাবোল বলে, যা ইচ্ছে তাই করে। তাকে সুস্থ করার তাগিদে এক সময় গ্রাম্য কবিরাজ কে ডাকা হয়। কবিরাজ এসে চিকিৎসা করেন। কবিরাজের চিকিৎসায় হোক বা অন্য কোন কারণেই হোক অধিকাংশ রোগীই সুস্থ হয়, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। আবার অনেকেই কখনই সুস্থতা আর ফিরে পায় না। এর কারণ কি ? যাকে আমরা শয়তানে ভড় করা বা জিন পরী ধরা রোগী হিসেবে চিহ্নিত করি তাকে কি আসলেই জিন পরী ধরে ? আগুনের তৈরি অদৃশ্য দেহধারী জীববিশেষ আর পক্ষ বিশিষ্টা কল্পিত সুন্দরী পরী মানুষের ভেতরে কি আসলেই বসবাস করে ? নাকি সব কল্পনা ? বিভ্রম ? মস্তিষ্কের তৈরি এক জগত ? যে জগত নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে তার ইচ্ছে মতো ভোক্তাকে ব্যবহার করে, যে জগত অদৃশ্য তম। আমরা যারা ধার্মিক তারা জিন পরী আর শয়তানের অস্তিত্ব বিশ্বাস করি, কিন্তু প্রশ্ন হলো পৃথিবীর শিক্ষিত অধিকাংশ মানুষেই শহরে বসবাস, এই জিন পরী আর শয়তান কেন শহরের এই শিক্ষিত মানুষ রেখে গ্রামের অশিক্ষিত বা অর্ধ শিক্ষিত মানুষের ভেতরে নিজের ক্রিয়া কলাপ প্রকাশ করবে ? তাহলে কি ধরে নেবো, জিন পরী বা শয়তান অশিক্ষিত অর্ধ শিক্ষিত আবেগ প্রবণ সরল মানুষের গোর বিশ্বাসের এক জগত যা এক সময় পাগলামিতে রূপান্তরিত হয়।
মস্তিষ্কের বিকৃতি বিভিন্ন কারণেই হতে পারে, সরলতা থেকে, বিশ্বাস থেকে, পাপ থেকে। পাগলামির উৎপত্তি যেখান থেকেই শুরু হোক মূলে থাকে সঠিক বিবেচনার অভাব।
আমাদের সমাজের এই পাগল চিহ্নিত করতে গিয়ে দার্শনিক, বিজ্ঞানী বা সাহিত্যিককেও একসময় পাগল বলে বিবেচনা করে অনেকেই । স্বাভাবিক ভাবেই একজন দার্শনিক কবি আর বিজ্ঞানী সমাজের বহু লোক থেকে আলাদা এবং মৌলিক হবে । তাদের জীবন যাত্রাও আলাদা হবে, সাধারণ মানুষের মতো শিশু থেকে বড় হয়ে যৌবন বয়সে বিয়ে করা, সংসার করা, সন্তান সন্ততি জন্ম দিয়ে বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যুতে হারিয়ে যাওয়া তাদের জীবনে থাকে না, তাঁরা সব সময় স্বাভাবিক কাজে লিপ্ত না হয়ে তাদের পরিকল্পনা মাফিক কাজ করেন। তাদের কাছে আমরা সবাই ঋণী, তাই অহেতুক তাদের জীবনকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যতায় দেখে নিজেদের মূর্খ হিসেবে জাহির করার কোন অর্থই হয় না।
পাগল নিয়ে কথা বললে কথা যেন শেষেই হবার নয়, কারণ পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের মাঝেই কম বেশী অস্বাভাবিকতা বিদ্যমান, আমরা সবাই কম বেশী পাগল । তবে আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, কোন কোন পাগলামি এক সময় পাপে পরিণত হয়, যে পাগলামিতে অন্যের ক্ষতি হয় এমন পাগলামি যেন আমাদের দ্বার না হয় ।
১৮ মার্চ ২০১৯ মধ্যরাত! চারদিক অন্ধকারে ঢেকে আছে শুধু বাড়ির চারিপাশে বিদ্যুতের বাল্বগুলো জ্বলছে তাদের…..
জোছনা করেছে আড়ি আসে না আমার বাড়ি গলি দিয়ে চলে যায়, গলি দিয়ে চলে যায়…..
পাঠকদের প্রায় জনেই হয়ত জানেন, সমকাম কি ? সমকামী কারা ? সমকামীর প্রকারভেদ, কেন…..
সাধারণত আমরা পাপ নির্ধারণ করি ধর্মের নিয়ম নীতির উপর নির্ভর করেই । ধর্মে যায় নিষেধ…..