পাঠ প্রতিক্রিয়া ‘আমার সপ্তাহান্তেরা’- ইসরাত জাহান

ইসরাত জাহান
রিভিউ
Bengali
পাঠ প্রতিক্রিয়া ‘আমার সপ্তাহান্তেরা’- ইসরাত জাহান

উপায়ন

“রাত জেগে বই পড়ার একটা আলাদা ভালোলাগা আছে। চারিদিকে চুপচাপ আর নৈঃশব্দ্যের ভিড়ে বইয়ের কালো রঙের লেখাগুলো হৃদয়ঙ্গম করা যায় সহজেই। যাপিত জীবনের রোজনামচা থেকে এক লহমায় মনটা চলে যায় অন্য এক জীবনের হাতছানিতে। তবে সে জীবনে থেকে যাওয়ার উপায় নেই। তাই রাত ভোর হতেই ফিরতে হয় আবার রোজকার রোজনামচার কাছে। অতঃপর বন্ধুর জন্য লিখতেও হয় কিছুটা।
কিন্তু কী লিখব আসলে?
যা ‘আমার সপ্তাহান্তের’ লেখক লিখেছেন, তা? নাকি তার উত্তর অথবা প্রতিউত্তর?
কিছুটাতো লিখবই। জেনে নিই ‘আমার সপ্তাহান্তেরা’ কি ও কেমন?
শহরে সপ্তাহান্তটা যান্ত্রিক। এখানে আবেগ কম, বাস্তবতা বেশি। চাকুরি জীবনে ৯টা ৫.৩০ চক্র কখনও বদলায় না। কিন্তু ঋতু বদলের সাথে সাথে বিকেল সাড়ে পাঁচটার আবহ পরিবর্তন হয়। লেখক ছয় বছর ধরে এই যান্ত্রিকতাই লিখে যাচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতি বৃহস্পতিবার ঠিক সাড়ে পাঁচটায়। সেখান থেকেই তুলে আনা কিছু গল্প, বাস্তবতা আর দৃষ্টিকোণ।”
উপরের এই কথাগুলো বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখা। নিজেকে ‘থট প্রভোকার’ দাবী করা এই বইটির লেখকের নাম সামিউল মাশুক এন্টনি। বইটির নাম ‘আমার সপ্তাহান্তেরা’।
উৎসর্গ লিখতে গিয়ে যেখানে লেখক লিখেছেন ‘আমার ছেলে আয়ান ও মেয়ে নীগান। বাংলা ভাষা পড়াটা এখনও তাদের জন্য ভীতিকর। একদিন ওরা আগ্রহ নিয়ে বাংলা পড়বে, শুদ্ধ উচ্চারণে বাংলা বলবে এবং সঠিক বানানে লিখবে।’
সামিউল মাশুক এন্টনি’র গল্প অথবা অগল্পগুলো উত্তম পুরুষ ও নাম পুরুষে লেখা। তবে আমাকে টানে উত্তম পুরুষে।
বাৎসরিক ক্লান্তি ও অন্যান্য 
‘আমার সপ্তাহান্তেরা’র লেখক প্রায়ই একটি স্বপ্ন দেখেন। তিনি অফিসে কাজ করছেন, হঠাৎই বড় কর্তা ডেকে পাঠালেন।
বললেন, শিক্ষাবোর্ড থেকে চিঠি এসেছে।
চিঠি খুলেই লেখক দেখলেন, মাধ্যমিকের গণিতের ও উচ্চমাধ্যমিকের গণিতের দ্বিতীয় পত্রের খাতা পাওয়া যাচ্ছে না। তাই আবার পরীক্ষা দিতে হবে। ঘটনাটা ১৮-২০ বছর আগের। অথচ প্রস্তুতির জন্য সময় নাকি মাত্র এক সপ্তাহ। এরপর খোঁজ সিলেবাস, বই ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর ঘুম ভেঙে যায়। তখন তিনি ভাবেন, ভালো লেখাপড়ার সাথে ভালো চাকরি বা ভালো জীবন যাপনের আসলে কোন সম্পর্ক নেই। তবুও কেন যে অভিভাবকরা ইঁদুর দৌড় করাতে বাচ্চাদের পিছনে ছোটেন আল্লাহ্ মালুম। তিনি প্রশ্ন ছোড়েন পাঠকের কাছে, ‘কার কার বাবা মা বলতেন, বছর শেষে উপর ক্লাসের কারো কাছ থেকে অঙ্ক বই নিয়ে এসে বাৎসরিক পরীক্ষার আগের সিলেবাস এর দখল এগিয়ে রাখতে?’
উত্তরটা আমি দিচ্ছি, আমার বাবা বলতেন এবং আমিও তাই মেনে চলতাম। তাই প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলে যে শ্রেণিতে পড়েছি বাড়িতে তার চেয়ে এক শ্রেণি বেশি পড়েছি।
সামর্থ্যের ভরসায় 
মৃদুমন্দ বাতাস, সন্ধ্যাটা সুন্দর। লেখক হেঁটে যাচ্ছেন প্রিয় মানুষ সঙ্গী করে। অথচ পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন কিম্ভুতকিমাকার সাজ দেয়া লাল বেনারসি পরা এক ভূতের মত মানুষ। কে এই ভূত?
ভূত বৌ অথবা লাল বৌ কিংবা পালিশ করা বৌ।
কি আশ্চর্য! অথচ নিজেকেই চেনানোর মতো ঐ বৌ এর সামর্থ্য ছিল। ছিল কি? নাকি সে সামর্থ্য চাপা পড়েছে অসভ্য সভ্যতার পালিশ করা সামর্থ্যের আভরণে?
ভাবায় বটে।
কথা বলি বুঝে বুঝে
কি ভাই আপনার ফুটো এমন চ্যাপ্টা কেন?
আশ্চর্য হলেন? কথাটা এমনই ছিল কিন্তু। কিসের এই ফুটো? মোবাইল চার্জারের। হা হা হা।
আরও আছে! দুই পুরুষ সহকর্মীর কথোপকথনের এক পর্যায়ে মহিলা সহকর্মীর আগমন। একজন পুরুষ সহকর্মী বললেন, আপা ভাইয়েরটা যে কত বড় তা তো জানলাম কিন্তু আপনারটা কয় ইঞ্চি তা তো জানা হলো না।
মহিলা সহকর্মী এই শুনে গটগট করে প্রস্থান করলেন। অবাক হয়ে পুরুষ সহকর্মী এবার বললেন, ভাই আপনার টিভি যে ৫৫ ইঞ্চি, আপা মনে হয় বিশ্বাস করলেন না।
কি বুঝলেন? কথা বলুন বুঝে বুঝে! বাকি মন্তব্য নিষ্প্রোয়োজন।
সমস্যার মূলে সমস্যা
বিয়ের পর দশ বছর পেরোলেই নাকি সম্পর্ক ভাই-বোনের হয়ে যায়। কিন্তু কি আশ্চর্য! এই ভাই-বোনকে বিয়ে দিয়ে বিদায় করা যায় না। তাহলে কিসের ভাই-বোন? একটা কৌতুক বলি, এক লোকের মাথা ব্যথা। ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করিয়ে সমাধান মেলে না। শেষমেশ এক চিকিৎসক বললেন, দুই পায়ের মাঝখানে দু’খানা বল আছে। সেগুলোই সমস্যার মূলে। কেটে ফেলতে হবে।
মাথা ব্যথায় মাথা কাটার চেয়ে বিচি শূন্য হওয়া শ্রেয় ভেবে বিচি কেটেই ফেললেন সেই ভদ্রলোক। আরও চিকিৎসা ও গবেষণা হলে জানা গেল, ভদ্রলোক তার মাপের চেয়ে ছোট অন্তর্বাস পরতেন। ঠিক মাপে পরলেই আর হারাতে হত না।
কি বুঝলেন? সমস্যার গোড়া খুঁজতে হবে আগে।
ব্যান্ড করব, করব না
তুমি অবসরে কী কর?
ছবি আঁকি, শিখতে যাই
গান শিখি
নাচ শিখি
তবলা, গিটার, কিবোর্ড শিখি
ব্যান্ড করি, গান বাজনা
What ? ব্যান্ড?
যেন তাল গাছ থেকে পাকা তাল পড়ল! আর সেই তালে আটা মিশিয়ে গুড় বসিয়ে পাটিসাপ্টা হয়ে গেল।
কিন্তু কথা তো অন্য খানে।
এই আমি গান বাজনা করেই বা কি করব? একটি সিডি বের করলাম, সেটা কি আপনি কিনবেন? কিনে আসলে শুনবেন কই? তাও কিনবেন? গাড়িতে ল্যাপটপে শুনবেন? ৬০, ৮০ বা ১০০ টাকায়? একটি সিডির জন্য টাকা দেবেন? যদি এমপিথ্রি দেই? আচ্ছা টাকা কি দেবেন?
উহ্ এত প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? তার চেয়ে বলা সহজ,
টাকা কেন দেব গো? তুমিতো আমার পেয়ারকা রিস্তা। সৌজন্য কপি দেবে।
যাক, আমি অবশ্য তা বলছি না। বলছি এবার একটা সিডি বের করতেই পার। কমকরেও বিশ খানা কিনে নেব। একটা নিজের কাছে রেখে শুনব সিডি প্লেয়ারে। বাকি উনিশখানা বন্ধুদের উপহার দেব।
এমপিথ্রিও দিতে পার। সেটাও মূল্য দিয়েই শোধাব।
এখন নিশ্চয়ই লেখকের ঘোলাটে বৃহস্পতিবারের আকাশ মায়াবী হয়ে ফিরে আসছে পাগলাটে খুশিতে?
মৃত্যুর নয়, মৃতদেহের অপেক্ষায়
অদ্ভুত ঠেকছে? মোটেও না। বরং অপেক্ষা তো এমনই হতে হয় যদি আমার থাকে দোকান। যে দোকানের নাম ‘শেষ বিদায়’। লেখা থাকে বড় করে, এখানে লাশ ঢাকার চা পাতা, কাঠের- স্টিলের কফিন, কাফনের কাপড়, কর্পূর, আগরবাতি, মোমবাতি ইত্যাদি পাওয়া যায়। আর দিন শেষে যদি কেউ নাই বা মরল তবে কি আমার পেট শূণ্য থাকবে? তা নিশ্চয়ই হওয়ার নয়।
বেকারত্বের দিনগুলোতে প্রেম
—আচ্ছা বেকার বেকার আবার প্রেম হয় নাকি?
—হয় তো
—তাই বুঝি!
—হু
—যখন বোঝার মানুষ তুমি হও
—আর তুমি?
—আমি তোমার জন্য।
—ব্যাস! প্রেম তো এভাবেই হয়।
—তবে যখন বেকার সন্ধ্যা কাজের হয়?
—তখনও কি এমন করে রয়ে যাবে আমাতে?
—চলে যাওয়ার পথ নেই যে।
গল্পটা ঠিক এমনই তো ছিল।
মায়ের বাপ শুয়ে থাক
দাদা লজ্জা পাবেন না। আপনারা শুধু সুয়ে সুয়ে থাকবেন দাদা। এসে চুষে দেবে দাদা। শুধু সুয়ে থাকবেন।
আহ! মরণ! বলি চুষবে টা কি?
ঐ যে বুঝলেন না, লাগানোর আগে যেটা চুষে?
কি লাগাবে?
এও জানেন না!
ঐ যে মায়েরে বাপ সুয়ে থাক।
দূর ছাই কি বলছেন যে? শুধু মায়েরে কেন বাপ? বাপেরে মা নয় কেন?
আসলেই তো! একজন থ্ট প্রভোকারের চিন্তা এত গরীব কেন হবে? কেন চিন্তার প্রসারণ ধনী হবে না? আমার মাথায় এলো না তো!
দুর ছাই!
বৃহস্পতিবার মায়াবী হয় মায়াবিনী আর মায়ার কারণে। মায়া বড়ি অথবা মেডেল ঝোলানো স্টবেরির গন্ধের জন্য নয় কিন্তু।
তারপর? অবাস্তব, পরাবাস্তব, কিন্তু অতি বাস্তব জ্বীন পরি নিয়ে হুজুগে জীবন। দিন তো চলেই যাচ্ছে এভাবেই। আজও এক বৃহস্পতিবার। ভাবছি কার জন্য মায়াময় হবে!
হবে নিশ্চয়ই কারো জন্য।
আর একটু পরেই তো তোমার সপ্তাহান্তের শুরু হবে। তার আগে তোমার মোটা মোটা ভুলগুলোর চিটে খসাই।
একটা বই বের করেছ তাও আবার নাকি দ্বিতীয় মুদ্রণ এসেছে। অথচ মুদ্রণ প্রমাদ গুনতে গুনতে আমি হয়রান। গ্রাফিক্স ডিজাইন এত দূর্বল যে চোখে লাগছে রীতিমত। আর উৎসর্গে যে আশাবাদ ব্যক্ত করেছ তা চিনিতে নুন। কেন? নিজেই তো শুদ্ধ উচ্চারণে সাজাওনি বইটি। সংলাপে সাধু চলিত যাইই থাকুক না কেন বোঝানোর জন্যও কি এইটা, ওইটা, কইটা, লইটা বলতে হবে? ভাব বন্ধু, ভাব। তবে প্রচ্ছদ চমৎকার ছিল। বোঝা গেল হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেরা প্রবল ছিল কারো।
কাগজের মান উন্নত নয়। প্রকাশক তোমার জন্য কিছুই লিখলেন না ব্যাপারটা খটমট লাগেনি তোমার কাছে? পৃষ্ঠা ০৯ থেকে লেখাগুলো সাজানো উচিত ছিল। বাঁধাই আরও সুন্দর আর যত্নের ছোঁয়া পেতে পারতো। সর্বোপরি তোমার চিন্তার প্রসার ঘটাতে হবে। নিজেকে ‘থট প্রভোকার’ বলে দাবি করে আর যাই হোক গতানুগতিক চিন্তা প্রতিষ্ঠিত করো না।
একটি পাঠ প্রতিক্রিয়া
আমার সপ্তাহান্তেরা
লেখকঃ সামিউল মাশুক এন্টনি
প্রকাশকঃ রঁদেভু পাবলিকেশন
প্রথম প্রকাশঃ মার্চ ২০২১
দ্বিতীয় সংস্করণঃ মার্চ ২০২১

ইসরাত জাহান। কবি। জন্ম বাংলাদেশের পাবনা জেলার ঈশ্বরদী। বর্তমান নিবাস ঢাকায়। তেরোবছর বয়স থেকে লেখালিখি শুরু। লেখা শুরু করেছিলেন দৈনিক বাংলার বাণীর মাধ্যমে। তারপর দৈনিক আজকের কাগজে নিয়মিত লেখালিখিতে ছিলেন। এরপর হঠাৎ করে বারোবছর লেখালিখি থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন। প্রকাশিত বই: 'তোমার...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

স্থির করে দাও কম্পমান জল : গালিবের প্রজ্ঞার সুরাপাত্র হাতে কবি কাকন রেজা

স্থির করে দাও কম্পমান জল : গালিবের প্রজ্ঞার সুরাপাত্র হাতে কবি কাকন রেজা

  রুমী, খৈয়াম, হাফিজের কয়েক শতাব্দী পর এলেন গালিব। মির্জা গালিব। এত দিতে সুরাপাত্র ও…..

প্যাটাক্যুয়রিক্যাল নাইটশোয়ে আপনাকে স্বাগতম (পঞ্চম পর্ব )

প্যাটাক্যুয়রিক্যাল নাইটশোয়ে আপনাকে স্বাগতম (পঞ্চম পর্ব )

ইংরেজি ভার্সান এখানে >>> Welcome to the Pataquerical Night Show (Episode-5) পূর্ববর্তী পর্ব এখানে>>> শেষ…..