প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নৌকাটা নদীর পারে ভিড়িয়ে এক বুক বাতাস ছেড়ে লোকটা বলল, ‘নিন, নামেন। এসে গেছি।’
চন্দন সামনে তাকিয়ে দেখল, পার বলে যেটাকে বলা হচ্ছে, আসলে সেটা ঠিক পার নয়। এখানে পার অবধি অবশ্যি কোন নৌকা যেতে পারে না কারণ সেখানে কোন ঘাট নেই। তবে পারের কাছেই নৌকাটা দুলছিল। জলের ধাক্কায়, পারের খবরদারিতে। নামতে গেলে প্যান্ট তো ভিজবেই, কাদামাটিতে পা দেবে যাওয়াও অসম্ভব নয়। তাই চুপ করে নৌকাতেই বসে রইল চন্দন। চারিদিক ভাল করে নিরীক্ষণ করে ভোঁতা গলায় বলল, ‘কিন্তু নদীর উৎস কই, তেমন কিছু তো কই দেখছি না।’ তকবির সেখ বৈঠা ছেড়ে আড়মোড়া ভাঙ্গল। তারপর বলল, ‘ওই অবধি আমি আর যাই না। সেই যে গেছি এককালে, সে কাহিনির কথা আপনি জানেন মাস্টার। তাই যতক্ষণ না আপনি ফেরেন, এই নৌকাতেই গুটিসুটি মেরে শুয়ে একটু ঘুমিয়ে নিই।’
‘বাঁশি কেন বাজে, সেখ?’
‘জানি না।’
‘এখান থেকে হাঁটতে কতক্ষণ লাগবে?’
‘পথ চিনলে দশ মিনিট, নইলে আধঘন্টা।’
লোকটার কথা শেষ করার মধ্যে এমন কিছু ছিল যে, আর কিছু বলতে পারল না চন্দন। নৌকা থেকে ঝুপ করে নেমে পড়ল। জল আর বালি মাটিতে প্যান্ট কিছুটা ভিজলেও তেমন কিছু নয় যে তাকে অস্বস্তিতে ফেলতে পারে। নদীর ঢালু পার বেয়ে সে যখন পারের ঘাসজমিতে পা দিল, নৈঃশব্দ ঘিরে ফেলল তাকে। সামনে বন, পেছনে নদী। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে এক বুক শ্বাস নিয়ে চন্দনের কেন জানি মনে হল, মাস্টারি ছেড়ে এখানেই রয়ে গেলে বেশ হয়। আর তখনই লোকটা পিছন থেকে বলল, ‘বাঁশির সুরে নিজেকে সামলে রেখেন, মাস্টার।’
গল্পটির অডিও শুনুন এইখানে
চন্দন থমকাল। পিছন ফিরে দেখল একঝলক। শীতের কুয়াশা এই দুপুরেই ঘিরে ধরছে নদীর পার। নদীর জলের উপর জমছে কুয়াশারা। চন্দনের মনে হল, নদীতে স্থিত মাঝির মতই কুয়াশা এখানে এক চরিত্র হয়ে উঠেছে। তখনই এক মোক্ষম কথা বলে ফেলল মাঝি। বলল, ‘আপনি ত ভ্রাম্যমাণ জীবনের কথাকে দেখতে এসেছেন, মাস্টার। যদি আজই সিদ্ধি পেয়ে যান, দেরি কোরেন না। ফেরার মন হলে ফিরেন, নইলে ওখানেই রয়ে যেবেন—ঐ নদীর উৎসে। ওখানে বাঁশি বাজে।’
‘কোথায়?’
‘উৎস বড় মায়াময়, মাস্টার। সে গল্প কতবার আপনাকে করেছি। সে মাঝে মাঝে থাকে ও মুছে যায়। এই থাকা ও না থাকাকে যদি আপনি একত্র পেতে চান, সেখানেই এক কুটির বানিয়ে থেকে যেতে হবে—যেভাবে দরবেশ থাকেন।’
এই থেকে যাবার কথা এমন করে কেন বললে সে? মাঝি কি থেকে গেছে এখানে, সেই পাওয়া-না পাওয়ার ভিতর? কবে থেকে ছিল সে? কতগুলি বছর? তারপর কী হল সেই থাকার? এই থাকা না থাকার কথা সে তো কখনও বলেনি তাকে! এই ভাবনাই চারিত করল চন্দনকে। মাঝির সঙ্গে নদ-নদীর কত কাহিনিই তো সে শুনেছে। কে জানে তার কতটা সত্যি আর কতটা গল্প? কিন্তু এই কাহিনির পরতে পরতে জড়িয়ে থাকে যে মায়া তাকে কী করে অস্বীকার করে সে? যত কাহিনি শুরু হয়, যতগুলি শেষ হয় তারই মধ্যে—সবেতেই যে মায়ার লিখন থাকে—চন্দনের চেয়ে এ কথা আর কে বোঝে ভাল। আর তাই তো অনেক দিনের সিদ্ধান্তের পর এই উৎস দেখতে আসা। একদিন তো মাঝির নৌকায় ভ্রমণের সময় বলেই বসল, ‘শুনেছি নদ শেষে যখন নদী উৎপন্ন হয়, সে মুখ বড়ই ক্ষীণ। সেই ক্ষীণ প্রবাহ কী করে এমন জলধারা বয়ে আনে, মাঝি?’
‘আপনি যদি সত্যিই নদীর উৎস মুখ দেখতে চান, তবে নদ-নদীর মিলন যে দেখতেই হবে, মাস্টার। আর সেটা একদিনের কাজ নয়।’
‘কেন? কী আছে সেখানে?’
কিন্তু এখানে নদীর সেই উৎস কোথায় যা সে খুঁজতে এসেছে? যেখানে সে নেমেছে সেটা কি নদীর বুকে জেগে ওঠা দ্বীপভূমি? নাকি তার ওদিকে, বন ফুরুলে মূল ভূখন্ডের সঙ্গে কোন যোগ আছে। নইলে এই সমতল ভূমিতে দ্বীপ গড়ে ওঠার কার্য-কারণই বা কী? সুতরাং দ্বীপ বলে মনে হলেও তার নিশ্চয় কোন সূত্র আছে। ছোটখাট এক নদী ছলাৎ-ছল জল নিয়ে সে বয়ে যাচ্ছে আপনমনে, নিজের মত করে। দ্বীপ সৃষ্টি করার কোন ক্ষমতা নেই তার। সে পলি বহন করে করে বুজে যেতে পারে, কিন্তু নিজের বুকের ভেতর দ্বীপ আনবে কীকরে? সাধারণত হয় কী, এই ধরনের নদী কোন একটি বড় নদী থেকে জন্ম নিয়ে পরের কোন এক বড় নদীতে গিয়ে মেশে। পাহাড় থেকে বরফ গলা জল নিয়ে তীব্র গতিতে নেমে আসার কথা তার নয়। কিন্তু এখানে বড় নদ থেকে ছোট নদীর শুরু হচ্ছে কোথায়? একদম উৎসস্থলে যাবে না বলে মাঝি এ তাকে কোথায় নামিয়ে দিল?
তকবির সেখ আসতে আসতেই তাকে বলছিল, ‘ভগবানের এ কেমন বিচার, দেখুন মাস্টার, এই নদ আসছে পাহাড় থেকে, কত নুড়ি পাথরের বুক চিরে সে নিজেকে বয়ে আনছে আর এখানে ওর বুক থেকে জন্ম নিচ্ছে নদী! কেমন না? আমাদের দেশে এমন নদ-নদী, নদী-নদ কত যে আছে, তার কোন হিসেব নেই বোধহয়। এই রকম সঙ্গমস্থলে আমার বাইতে বেশ লাগে। তবে কী জানেন, বেশিক্ষণ স্থির হয়ে থাকতে পারি না। গায়ে কেউ যেন হুল ফোঁটায়।’
তাই চন্দন নদীকে আবিস্কার করতে চায়। এই নদী পেরিয়েই তাকে তার ইস্কুলে যেতে হয়। ঘাট থেকে ঘাটে পৌঁছিয়ে তারপর ভ্যানে চেপে ইস্কুল। নদী পেরুতে পেরুতেই আলাপ জমে ওঠে তকবির সেখের সঙ্গে। তকবির বলে, ‘এখানে নদী কী দেখছেন, যাবেন নদের ধারে, দেখবেন নদী কাকে বলে। দেখবেন থেকে থেকে নদী থেকে পাতার বাঁশি বেজে উঠছে। একদিন হয় কী, আমি সেই সুরের সাথে উড়তে থাকি। কে যেন অনেক দূর থেকে বলে, নেমে এসো শেখ। এই উড়ান তোমার জন্যে নয়। তোমাকে সব পায়ে হেঁটে, নদীতে ঘুরে ঘুরে দেখতে হবে। আমি ভয় পেয়ে নেমে পড়ি। দেখি অনন্ত চকচকে বালির মধ্যে কাঁকড়া ঢুকে যাচ্ছে। মাথার উপর স্থির হয়ে রয়েছে এক বৃহৎ চাঁদ। তখন এক দরবেশকে যেন দেখি। গায়ে তার বড় একটি জোব্বা, মাথায় পাগড়ি, সাদা দাড়ি। তাকে আবার দেখব বলে একবার চোখ মুদে ফের চাই। কোথায় কী! চারিদিকে ফটফট করছে চাঁদের আলো!’
‘তুমিই তো দরবেশ হয়ে যেতে পার, সেখ।’
‘কী যে বলেন, মাস্টার! বাঁশি আমি পাব কই?’
‘একটা বানিয়ে নিলেই তো হল।
‘সে কি আর যেমন তেমন বাঁশি। ফকির বাজায় সে বাঁশি। আমি না জানি তার কারুকাজ না জানি তাতে ফুঁ দিতে। দরবেশের বাঁশিতে ফুঁ দেওয়া কি সোজা কথা!’
‘আমার তো মনে হয়, তুমিই এক দরবেশ।’
‘এটা কোন কথা হল, মাস্টার।’
‘তবে তুমিই আমাকে শিখিয়ে দাও, কীভাবে সে বাঁশি বানায়।’
‘সে গাছের পাতা কোথায় ফোটে, নদীর কোন চরে, দরবেশ যেমন জানে, আর জানে ওই হিজরেরা। আমি নদী মধ্যে পাক দি, আর বাঁশির শব্দে দেখি নদীর জল ফুলে উঠছে অথচ নদে তেমন জল নেই যে নদীকে দেয়। নদী তবে এত জল পায় কোথায়? হিজরেরা বলে, নদীর এখন মাসিক চলছে, তাই জলে এত জোয়ার।’
‘সেটা কীরকম?’ চন্দন উৎসাহিত হয়ে ওঠে।
‘সেই ওরা কয়েকজন মিলে এক হয়ে ওখানে গিয়ে জুটেছে। ওখানেই থাকে, রান্নাবান্না করে, খায়, ঘুমায় আর উদাত্ত গলায় গান করে। শুনেছি ওরাই নাকি পাতার বাঁশি বানায়। আর—’
তাই নদীকে প্রতিদিন দুই বেলা পেরুতে পেরুতে সে সিধান্ত নেয়, এই নদীকে নিজের মত করে খুঁজে বের করবে সে। নদী কেমন থাকে এই অঘ্রাণে, সেই জানার আগ্রহ থেকেই চন্দন সওয়ারি হয় তকবিরের নৌকায়। চারিদিকে ধান কাটা হচ্ছে। নদীর পার পরপর শূন্য হয়ে যাচ্ছে। ছক কাটা কাটা সব শূন্য। এটাই তো সময় নদীকে ঠিকঠিক ভাবে চিনে নেবার। মনুষ্যবর্জিত এ ভূখন্ড দেখে মনে হয় এস্থান যেন দেবতাদেরও অগম। কচ্চিত কখনও পাখির ডাক, বাতাস বয় যেন নদীর স্রোতের মত শব্দহীন, যেন তা হৃদয়রহিত; চন্দনের মনে হল, এক আলাদা পৃথিবীতে সে এসে পড়েছে, এখানে আসার কথা তার ছিল না। সে কি এই শীতল নদীর মত প্রবাহিত বাতাসকে বশ মানাতে পারবে?
‘আর…ওরাই আপনাকে সে গাছ, পাতা ও বাঁশি বানানোর প্রকরণ শিখিয়ে দিতে পারে।’
‘তার মানে কী সেখ?’
‘ও বাঁশি কোনদিন ঘরে এন না, মাস্টার।’
‘কেন?’
‘তখন তাহলে কেবল বেজেই যেতে হবে। তোমাকে।’
দুই.
তকবির বলেছিল, এটাই সেই স্থান, যেখানে নদ থেকে জন্ম হয় নদীর। নৌকা নিয়ে স্থির থেকেছে নদীর বুকে। নদীকে ছাড়িয়ে চলে গেছে নদের ভেতর। তার নৌকা দুলেছে, মাছ এসে উঁকি দিয়ে গেছে জলের ভেতর। জাল ছাড়িয়ে সে ফিরে এসেছে নদ থেকে নদীতে। বাতাস বদলে গেছে। পালটে যাচ্ছে জমির উর্বরতা। নিচু ফসলি জমি হয়ে উঠছে ডাঙ্গাজমি। ধানজমি পরিণত হচ্ছে আলুজমিতে। চন্দন জানে না, কতটা পথ, কতক্ষণ সে ঘুরে গেছে। কিন্তু কোথায় কী! এক জায়গাতেই ঘুরছে কি? সে তো এটাই ভেবেছিল, এই বনপথ ধরেই খানিকটা হেঁটে গেলে সে দেখতে পাবে সেই স্থান, যেখানে নদ থেকে বের হচ্ছে এই নদী। সেই উৎসমুখে প্রচুর নদীর কাঁকড়া মেলে। সব সময় কেউ না কেউ জলে নেমে বালি মাটি থেকে সেই সব নদীর ফসল ধরে নিচ্ছে মানুষের রসনার জন্য। কিন্তু সে তো কিছুতেই নদীকে ধরে সেই উৎস স্থলে পৌঁছতে পারছে না!
এই সময় একটি ছোট্ট কুটির চোখে পড়ল চন্দনের। সামনে বেশ কিছুটা ফাঁকা জমি। সেখানে মোড়া পেতে বসে আছে চারটি সুবেশা নারী। একটু থমকে গেল চন্দন। আশপাশে দ্বিতীয় কোন বসবাসের চিহ্ন নেই। এদের যে উঠোন, তা চমৎকার করে নিকোনো। উঠোনময় কোন এক হলুদ ফুলের রেণু ছড়ান। বড় বড় গাছের গুঁড়িতে নানা ধরণের আলপনা আঁকা। এই এতটুকু ঘরে এরা বাস করে কীকরে? চন্দনের মনে হল, যেন তার আসার অপেক্ষাতেই রয়েছে।
সেখান থেকে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা একটি মেয়ে র্যাম্পে হাঁটার মত করে তার দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘কিগো, তুমিই বুঝি আমার বর?’ পিছনের বাকিরা উঠল না। কোন মন্তব্য না করে বসে বসেই ফিকফিক করে হাসতে লাগল। চন্দন একটু থতমত খেয়ে গেল। বুকের ভিতরটা গুড়গুড় করে উঠল তার। মেয়েটির চোখে আরও একবার চোখ রাখতেই সে বুঝল এর সৌন্দর্যর কাছে সে নতজানু হয়ে যাচ্ছে। চন্দন তার ঘুঘু পাখির মত দুটি বুক থেকে ছোঁয়া দৃষ্টি সরিয়ে আবার তার রঞ্জিত ঠোঁটের উপর ফেলে বলল, ‘আমি এখানে এসেছিলাম নদীর উৎস দেখতে।’
‘হ্যাঁ, সেটা তো এখানেই। কিন্তু সেখানে তুমি কি একা যেতে পারবে? পারবে না। আমরাই গিয়ে দিয়ে আসব। আমরা ভেতরের গোপন রাস্তা জানি। সেটা দিয়ে গেলে তাড়াতাড়ি হয়।’
এই সময় সে চন্দনের গায়ের কাছে এগিয়ে এসে মুখ তুলে দাঁড়াল। তার কপালে বড় করে আঁকা কাজল কালো টিপ। পিঠ ছাড়িয়ে লম্বা চুলকে বাগে আনতে সে বারবার তার ভেতর দিয়ে আঙ্গুল চালাচ্ছিল। গা থেকে এক অদ্ভূত সুন্দর গন্ধ উঠে আসছে। ছোটখাট কমনীয় শরীর। তার নাতি উচ্চ বুকও যথেষ্ট আর্কষনীয়। চন্দন মোহিত হয়ে পড়ল। পিছনে নদীর স্রোত বয়ে যাচ্ছে। বাতাস এনে ফেলছে নদীর ছোঁয়া। পাতারা ঝরে ঝরে পরছিল। কেন জানি তার গা কাঁপছিল। মেয়েটি তাকে তাতিয়ে দিচ্ছে ভেতরে ভেতরে সে বুঝে ফেলছিল। তার খুব ইচ্ছে করছিল, মেয়েটির ঠোঁটে ঠোঁট রাখতে।
চন্দন তার লাল ঠোঁট ও কপালের বড় টিপটা দেখতে দেখতে বলল, ‘আমি শুধু এই নদীর উৎসটা দেখতে চাই। তারপর ফিরে যাব। জলের ধারে মাঝি আমার জন্য অপেক্ষা করছে। সে চলে গেলে আমি আর ফেরার পথ পাব না। যা করার তাড়াতাড়িই করতে হবে।’
‘সেটা নিয়ে ভেব না। দরকারে আমরাই তোমাকে তোমার ঘরে ঠিক পৌঁছে দেব। আর সেটা না হলে আজ না হয় এখানেই থেকে যাবে। কিন্তু তুমি এই পথে এলে কেন? কে সন্ধান দিল তোমাকে?’
‘সে এক নৌকার মাঝি। বলে দিলে এটিই সঠিক পথ, তাড়াতাড়িও হবে।’
‘আর আমাদের কথা? বলেনি?’
‘তাও বলেছে।’
‘তাহলে এই পথে এলে কেন তুমি? আমাদের দেখতে?’
বাকি তিনজন এবার এগিয়ে এল। চন্দন বুঝল, এরা কেবল নারীর পোশাক পড়েছে মাত্র, কিন্তু এর মত নারী হয়ে ওঠেনি।
তারা বলল, ‘ওকে তোমার এত পছন্দ হল যে কেবল তার সঙ্গেই ভাব করে যাচ্ছ? আমরা বুঝি কেউ না? আমাদেরকেও তোমার সাথে নিয়ে চল।’
‘এই না, তোরা কেউ যাবি না। আমি একলাই যাব ওকে নিয়ে। আর তুমি কি বলছিলে?’
‘শুনেছি তোমরা পাতার বাঁশ বাজাও।’
‘কে বললে? ওই মাঝি?’
‘শুনেছি, খুব সুন্দর সে সুর। আমাকে যদি শিখিয়ে দিতে।’
‘এই মাত্র কয়েক ঘন্টায় তুমি নদ-নদীর মিলন দেখবে কী করে? কুয়াশা এসে গেছে এই দুপুরেই। তারপর তো বাঁশির সুর শেখার কথা। আর এত কিছু মাত্র কয়েক ঘন্টায় করবেই বা কেমনে?’
‘এটা আমার কাছে একটা খুবই রহস্যের যে, এক নদ কীভাবে নদী হয়ে যাচ্ছে।’
‘ব্যাপারটা তো একই হল। নদীর উপর এখন কুয়াশার সর নেমে গেছে। এই কুয়াশাতেই তো মাঝি কন্যার সঙ্গে নদীমধ্যে নৌকা স্থির রেখে মিলন সম্পন্ন করলেন এক মুনি। আর—’
‘আর কী?’
‘আর ওখানেই বাঁশি বাজে। পাতার বাঁশি। আমাদের এখান থেকেও তা শোনা যায়। না, আমরা কেউ তা বাজাই না। জানিও না। তবু সেই বাঁশির কথা যারা জানতে পারে, তারা এখানে আসে সেই সুর শুনতে। আমাদের এখানে থেকে যায় কিছু দিন। তারা আমাদেরকে ভাগ করে নেয়। আর তুমি কি করছ, কেবল মিলনের দিকে ঢলে পড়ছ।’
তখন সেই নারী চিৎকার করে বলল, ‘এই! কেউ আমাকে মিলন বলবে না, বলে দিচ্ছি!’
‘তবে কী বলব রে তোকে,… মাগী মাগী মাগী?’
‘না। আমার যা এখনকার নাম, তাই বলেই ডাকবি।’
তখন সেই না-পুরুষ লোকটা অন্যদের দিকে ঘুরে গিয়ে বলল, ‘তোরা দেখেছিস, ওকে নাকি মিতালি বলতে হবে!’
বাকিরা হেসে উঠল। একজন এগিয়ে এসে, চন্দনের জামার ভেতর হাত ঢুকিয়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘মাঝিটাকে কত দিয়েছ, সোনা?’
‘টাকা পয়সার কথা হয়নি কিছু।’
‘ও যে আমাদের এখানে নিয়মিত আসত, বলেছে? উঁ?’
‘তেমন কোন কথা হয়নি।’
‘সে আমাদের বলবে বলবে, না বলবে না বলবে। তবে জেনে রেখ, সে এখন আর পারে না। তাই লোক পাঠায়। যেমন তোমাকে পাঠিয়েছে। লোক পাঠিয়ে সে নৌকায় বসে ভেবে ভেবেই সুখ নেয়। কিন্তু তুমি কে? তোমার নাম-ধাম নিয়ে একটা পরিচিতি আছে আমরা তা জানতে চাই।’
‘আমি সামান্য একজন প্রাইমারী ইস্কুলের মাস্টার।’
‘নাম কি গো তোমার?’
‘চন্দন মাইতি।’
‘আমরা কি তোমার পদবি জানতে চাইছি? আমরা শুধু নাম জানতে চেয়েছি, নাম। পদবি নিয়ে আমাদের কাম কি?’ সে এতক্ষণে হাতটা বার করে নিল।
চন্দন চুপ করে রইল। অন্য একজন বলল, ‘তোমার নাম ধাম আমরা বিশ্বাস করব কেন?’
‘সেটা এই জন্যে করবে যে আমি এখানে এসেছি বলে।’
‘বাঁশির কথাও কি সেখ বলেছে?’
‘আমি বাঁশির সুরের কথা অনেক শুনেছি।’
‘কী বলে তারা?’
‘কেউ বলে নদ-নদীর মিলনের শব্দ ওটা, কেউ বলে শীৎকার। কিন্তু রাতের মূর্চ্ছনায় তা শোনার বাঁশির মত। মাঝিও বলে নানা কথা তার মত করে। কিন্তু আমায় যেটা টানে তা হল যে নদী বেয়ে এলাম, সেটা আসলে নদ।
আমি এসেছি তার উৎস দেখতে।’
‘আমরা একদিন দল বেঁধে গেছিলাম সেখানে। একদিন কেন, পরপর ক’দিন ধরে গেছিলাম। কিন্তু মুসকিল হল, বাজাতে কাউকেই দেখিনি, কিন্তু তবু বাঁশি বাজে। এখন আর আমরা তাকে খুঁজি না। মন দিয়ে কেবল বাঁশি শুনি। যদি নদীর উৎসে যদি সে বাঁশি শুনতে পার, পাগল হতে কেবল বাকি থাকবে তোমার।’
তিন.
পথ ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে মিতালি বলল, ‘দেখ, পাতার বাঁশি আমরা বাজাই না। যারা সে সুর শুনেছে তারা আমাদের কথা বলে বটে, কিন্তু সত্যিটা হল নদীর ধারে একজন দরবেশ আসে, সেই বাজায়। কিন্তু তাকে কেউ দেখেনি। সবটাই শোনা কথা। রোজ আসে না সে। যেদিন আসে, সেদিন রাতে আমরা আর ঘুমাই না। সারারাত সেই বাঁশি শুনে যাই। সুরের প্রবাহে আমরা দেখি সেখানে অনেক যুবকের উদয় হয়েছে। সংখ্যায় তারা কুড়ি জন। নধর চেহেরার সেই সব যুবক, যাদের বক্ষ সৌন্দর্য ও নিতম্ব ঈর্শ্বনীয়। পরে বুঝি তারা আসলে নদীর চরে ফেলে যাওয়া পুজো না পাওয়া কার্তিক ঠাকুরের দল। সুরের সঙ্গে নাচে তারাই। আর—’
তার এসে পড়ল নদ-নদীর সেই সংগম স্থলে। মিতালিকে ছাড়িয়ে চন্দন এক ছুটে এসে পড়ল নদীর পাড়ে। আকাশে চাঁদ চলে এসেছে অনেকক্ষণ। বেড়েছে কুয়াশার প্রবাল্য। বিশাল নদ কুয়াশা বুকে নিয়ে চাঁদের আলোয় বয়ে চলেছে বৃদ্ধের মতন। অন্ধকারে ঢেকে আছে নদীস্থল। বাতাসে প্রবল শীত।
‘আর সেখানে তারা বর-বউ খেলায় মাতে। তারপর বসন্ত আসে। কই গো, শুনছ?’
‘আহা! কি শোনালে। বলে যাও মিতালি।’
মিতালি দুই দিকে দুই হাত বাড়িয়ে চিৎকার করে বলল,‘আজ এখানে তুমি আমার বর হবে, মাস্টার। ওই যে দূরে বট গাছ আছে, তার নিচে কার্তিক ঠাকুরেরা গোল হয়ে একত্র বাস করে। না না, ওদের নিয়ে ভয় পাবার কিছু নেই। বাঁশি না বাজলে ওরা জাগবে না। আমরা ওখানেই বর-বউ খেলব, মাস্টার।’
‘কেন? তোমার বর নেই?’
‘না গো, কেউ নেই। তাই তো তুমি এলে নৌকায় চেপে। আর তোমাকে পাঠালে দরবেশ।’
‘আর ঐ সময় যদি তখন বাঁশি বেজে ওঠে?’
‘বাজবে না।’
নদের ঠান্ডা জলে হাত ছুঁয়ে চন্দন বলে, ‘কার্তিকদের সঙ্গে তুমি কখনও খেলেছ, মিতালি?’
‘না গো। সে সুযোগ আর পেলাম কোথায়। খেলব আজ, তোমার সাথে। কুয়াশার আড়ালে চলবে আমাদের মিলন।’
মাস্টার হাহা করে হাসল। মিতালি দৌড়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরল। চন্দন অনুভব করল, ওর নিঃশ্বাসে এখনও পুরুষালী গন্ধ রয়ে গেছে।
হঠাৎ সে চন্দনের গলা জড়িয়ে উপর দিকে মুখ তুলে চিৎকার করে বলল, ‘নেমে এস সেখ। নৌকা নিয়ে বারবার আকাশপথে তুমি যেতে পার না। ওটা তোমার পথ নয়। তোমাকে বলা হয়েছে যা দেখার পায়ে হেঁটেই ভ্রমণ করতে হবে তোমায়! বারবার একই ভুল কর কেন তুমি?’
কিন্তু সে নামে না। তাকে দেখতেও পায় না চন্দন। কিন্তু মিতালি বলে, সে উড়ে যাচ্ছে। পাখি হয়ে। তার মুখে একটি পাতা।
‘ও কি তবে নামবে না?’
‘নামবে। যা করার ওকে নিচেই এবার করতে হবে।’
তখন সে চিৎকার করে বলে, ‘এবার তবে পাতার বাঁশি বাজাও।’
তখনই আকাশ বাতাস মুখরিত করে এক সুর উঠল। চন্দন দেখল, সুর কাঁপিয়ে দিচ্ছে আলো। চাঁদের আলো সেই যে গলে পড়ছে নিচে, আর উঠছে না। জল হয়ে বয়ে যাচ্ছে নদীতে।
চার.
তখনি নদীর জল ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকল। বাতাসে এক সোঁ সোঁ শব্দ ভুলিয়ে দিতে থাকল চারিদিক। চারজন কার্তিক বটগাছের চাতাল থেকে পিছন দুলিয়ে দুলিয়ে দৌড়ে এল চন্দনের দিকে। তাকে বালিতে উলটে ফেলে পরপর সেক্স করে গেল। অনেকক্ষণ পর তার যখন চেতনা ফিরল, দেখল জলছোঁয়া অবস্থায় সে নদীজলের সেইখানে পড়ে আছে যেখান থেকে সে জল পায়। নদ হয়ে ওঠে নদী। মিতালি নেই, কোন রাতপাখি উড়ছে না, নদীজল শব্দহীন। তার সামনে অবহেলায় পড়ে আছে এক পাতার বাঁশি। কি মনে হতে এক হাতে সেটিকে টেন নিয়ে আলতো করে তাতে ফুঁ দিল চন্দন। তারপরই এই নদনদী, বনজঙ্গল, গাছপালা, নদীর কাঁকড়াকে খুব আপন মনে হতে থাকল তার। মনে হল, এ সেই। তার নব রূপ।
এই সময় দেখল, সে নদীর উপর উড়ছে। বাঁশির ঐ মৃদু অথচ অলৌকিক শব্দটাই ওড়াচ্ছে তাকে।
এদিকে নিচে, মায়াবী পৃথিবীতে, নদ-নদীতে আলো জ্বেলে তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে তকবির সেখের হাজার হাজার নৌকা। গায়ে তার বড় একটি জোব্বা, মাথায় পাগড়ি, সাদা দাড়ি। বাঁশির শব্দে আগত বসন্তে নৌকা নিয়ে বাতাসে ভাসা তার বারণ।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..