পাগল
চৌদ্দ পনেরো বছর আগের কথা; আমি বসে আছি একটি দোকানে, দোকানটি মূলত আমাদেরেই। দোকানের সামনে…..
১৯৯৫ সালে আমার প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় রবিবাসরীয় আনন্দবাজার পত্রিকায়। ‘আবার অমল’। এটা ২০২০ সাল। মানে কথাজীবনের ২৫ বছর হয়ে গেল। এই ২৫ বছরে পৃথিবীটাই তো বদলে গেল কত, আমার লেখা বদলাবে না? তবে একটা জিনিস একই রকম আছে। এখনো কোন গল্প শুরুর আগে ভয় করে। প্রথম বাক্যটা লিখতে কালঘাম ছুটে যায়, কিন্তু তারপর লেখাটা জমে যায় ঠিক আগের মতো।
১৯৯৫ সালের আগে কি আমি গল্প লিখিনি? লিখেছি, গোপন ডায়েরিতে। কাছের মানুষজন পড়েছে। মনে আছে আমাদের নিমগাছ কেটে ফেলা নিয়ে একটি গল্প লিখেছিলাম, গল্প লিখেছিলাম্ন এক গোঁড়া বৈদিক ব্রাহ্মণ পরিবারের চল্লিশ পেরোনো যুবককে নিয়ে, বাড়ির গোঁড়ামির জন্য যার কিছুতেই বিয়ে হচ্ছে না, কারণ বিশেষ শ্রেণির বৈদিক ঘরের পাত্রী চাই, তার যৌন ফ্যান্টাসি নিয়ে। শেষের এই গল্পটির নাম রবিবার, পাঠিয়েছিলাম গল্পগুচ্ছ নামের এক পত্রিকায়। সেটা ছাপা হয়নি। তখন তো হাতে লেখা, মফস্বল থেকে ডাকে পাঠানো, কিংবা আর একটু শিওর হবার জন্যে কলকাতায় অফিস করা কাউকে ধরে বলা, ‘একদম জিপিওতে ফেলে দেবেন’। আমার এই ডাকবাক্সে ফেলা ব্যাপারটা নিয়ে চিরকালের সংশয় আছে। একেবারে কৃষ্ণগহ্বর যেন, সব শুষে নেয়, বাইরে আসে না কিছুই। আমার কেবলই মনে হয়, আমার অনেক গল্প কবিতা, যেগুলো ছাপা হয়নি, সেগুলো কোন রহস্যময় ডাকবাক্সের তলায় আটকে আছে, পোস্টম্যান তার হদিশ পায়নি।
কিন্তু গল্প লেখা মানে শুধু নিজের ভাবনা, অনুভব নয়, জীবনে জীবন যোগ করা। রামকৃষ্ণদেবের গল্পে যেমন আছে একজন আর একজনকে চড় মারল আর সেই চড়ের দাগ ফুটে উঠল রামকৃষ্ণদেবের পিঠে। এই সমানুভূতি থাকলে তবেই কথাসাহিত্য সার্থক হয়। নইলে মরা বাছুরের মূর্তি হয়ে থাকে।
একদম প্রথমে যখন লিখতে শুরু করি, তখন স্টাইল অর্থাৎ ভঙ্গির দিকে নজর ছিল, ভাষা নির্মাণেও অনেক যত্ন নিয়েছি। সেটাই বোধহয় স্বাভাবিক, কারণ তখন অভিজ্ঞতার ঝুলি ছিল হালকা। যখন মানব চরিত্রের আরও গহনে ঢুকতে শুরু করলাম, রোমা রোঁলার ভাষায় মানবসমুদ্রে স্নান করা, তখন স্টাইল, আর কন্টেন্ট আর ভাষার অনুপাতটা ঠিকঠাক হল। ভালো রান্নায় যেমন হয়। খারাপ রাঁধুনীর হাতে পাঁচমিশেলি লাবড়ার প্রতিটা আনাজ যেন চেয়ে চেয়ে থাকে, কিন্তু রাঁধুনী যখন পাকা হয় তখন সব সব্জি পরস্পর মিশে অতি সুস্বাদু ব্যঞ্জন হয়।
এই ঠিকঠাক রান্নার তার আসার জন্যে আমাকে অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। আমার আজকের জায়গাটা একদিনে তৈরি হয়নি। যেহেতু কবিতা দিয়ে শুরু করেছিলাম, তাই গল্প লিখতে যখন শুরু করেছিলাম, তখন যে সমস্যাটা হত, সেটা হত ধৈর্যের অভাব। কবিতা চার পাঁচ লাইনে শেষ করে দেওয়া যায়, গল্প তো অনেকটা জায়গা দাবী করে। আমি অণুগল্পকে এই আলোচনার বাইরেই রাখছি। ফলে দু তিন পাতার গল্প লিখলেই মনে হত অনেক লিখেছি। আবার যখন উপন্যাস লিখতে শুরু করলাম, তখন এই সমস্যাটা আরও বেশি করে হল। পাতার পর পাতা লিখে যাওয়ার ধৈর্য থাকত না প্রথমদিকে। ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পারলাম, লেখকবৃত্তি কোন শৌখিন মজদুরি নয়, এটা প্রথমত এবং শেষত একটা শারীরিক পরিশ্রমের কাজ, রীতিমতো হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম লাগে একজন কথাসাহিত্যিক হতে। একজন রাজমিস্ত্রির সঙ্গে একজন কথাসাহিত্যিকের কোন তফাত নেই। শব্দের ইঁট গেঁথে গেঁথে তুলতে হয় বহু সময় নিয়ে।
এই যে পরিশ্রম, এর জন্যে নিজেকে তৈরি করতে হয়। একজন অভিনেতা যেমন নিজের শরীর ঠিক রাখার জন্যে জিমে যান বা তেলজাতীয় খাবার বর্জন করেন, তেমনি একজন লেখককে তাঁর মনের মেদ ঝরাতে অনুশীলন করতে হয়, বর্জন করতে হয় অসূয়া বা নিম্নমেধার সঙ্গ। দই পাতার মতো নির্জনতা তৈরি করতে হয়। সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন একবার বলেছিলেন, তিনিই লেখক, যিনি মনের মধ্যে একলা। এই কথাটাই অন্যভাবে পাই ফার্নেন্দো পেসোয়ার লেখায়-
‘টু বি আ পোয়েট ইজ নো অ্যামবিশন অব মাইন
ইট ইজ মাই ওয়ে অব স্টেয়িং অ্যালোন’
মনের এই একাকীত্ব, এই নির্জনতা রক্ষা করা আমার কাছে খুব ইম্পপর্টেন্ট। আরও একটা ব্যাপার হচ্ছে, আমি যে ভূগোলটা নিয়ে লিখি, সেই ভূগোলটা আমার কাছে খুব জরুরি। সেটা আমাকে ফিল করতে হয়, আর আমি না ফিল করলে পাঠকের কাছে সেটা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে না। এটা এরকম নয় যে আমি সবসময় সেখানে যেতে পারি। আমি ‘নদীর স্বদেশ’ এবং আরও কিছু গল্প যাদের পটভূমি বাংলাদেশ, লিখেছিলাম বাংলাদেশ যাবার বহু আগে। কী হয় কি, আমি যখন তীব্রভাবে কিছু নিয়ে ভাবি, সেই জায়গাটা আমি চোখের সামনে দেখতে পাই। সেখানকার মানুষজন বা তাদের ভাষা, পোশাক –এগুলো তো বই বা ইন্টারনেট থেকে পাওয়া যায়, কিন্তু আমি ভাবি দেওয়ালে পড়া রোদের রঙ বা একটা অখ্যাত সিনেমাহলে বিক্রি হওয়া সস্তার ভেজিটেবল চপের গন্ধ নিয়ে। ভাবি, একা থাকতে চেয়ে পৃথিবীর নির্জনতম প্রান্তে চলে যাওয়া মানুষ সঙ্গে তার বেড়ালটাকে নিয়ে যাবে না শেষতম প্রেমিকার একটা লঁজারি? গলিগুলোর নিজস্ব গন্ধ থাকে, প্রতিটা শহরের নিজস্ব পাগল থাকে, প্রতিটা গ্রামে ঢোকার মুখে একজন নিঃসঙ্গ গ্রামদেবতা থাকেন, আমার কাজ তাদের চিহ্নিত করা। আমি ‘অগ্নিবলয়’ উপন্যাসে অ্যালিসিয়ার কথা লিখেছি, যার বিদেশে বেড়ে ওঠা, সেখানে অনেক অরফ্যানেজ হোমের কথা আছে, এসব কিছুই আমি দেখিনি। কিছু পড়াশোনা করেছি, আর বাকি অনেকখানিই আমার নিজস্ব গুগল ম্যাপ, যা দিয়ে আমি চোখ বন্ধ করে এই সমগ্র পৃথিবীর বড় রাস্তা থেকে অলিগলি, মেঠোপথ খুঁজে বার করতে পারি। নিখুঁত ভাবে সেজে সব মুছে সাজের আভাস মুছে দেবার মতো প্রচুর পড়াশোনা করার পর সেটা মুছে একদম সাদা পাতা থেকে লিখতে হয়, তবেই সেখানে সরস্বতীর পায়ের ছাপ পড়ে।
শুধু পৃথিবীই নয়, যখন কল্পবিজ্ঞান লিখি , তখন তো আমি শুধু এই সৌরজগত না, অন্য সৌরজগতের গ্রহে গ্রহান্তরে ঘুরে বেড়াই, সেখানে চাঁদে লোকে রিসর্ট বানায়, বাতিল মহাকাশযানে থাকে ভবঘুরেরা, এলেবেলে গ্রহে ধাপার মাঠের মতো বর্জ্য ফেলা হয়। এই কল্পনাগুলো কিন্তু ভিত্তিহীন নয়, এর জন্যে আমাকে সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ফোরকাস্ট নিয়মিত দেখতে হয়। হাজার, দুহাজার পর পৃথিবীটার চেহারা কেমন হবে, মানুষের জীবন, যাপন, যৌনতায় কী বিরাট বদল আসতে চলেছে, কেমন দাঁড়াবে সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি – এইসব ভাবা আমার একটা প্রিয় ব্যসন। সেই ভাবনাগুলোই আমার কল্পবিজ্ঞান লিখতে প্ররোচিত করে। আর এর একটা রাজনৈতিক আন্ডারস্টেটমেন্ট আছে। বর্তমানের যেসব ইস্যু নিয়ে সরাসরি মুখ খুললে বিপদে পড়তে পারি, কিংবা এই সময়ের সব অসঙ্গতি, শোষণ, অসাম্য, এগুলো আমি লিখি কল্পবিজ্ঞানের ঢালের আড়ালে থেকে।
একটা কাহিনী নির্মাণে বাস্তব কতটা জরুরি? এই প্রসঙ্গে রামকৃষ্ণদেবের একটি গল্প মনে পড়ছে। একজন চিঠি লিখে জানিয়েছিল পুজোয় এত সন্দেশ, এত ফল ইত্যাদি লাগবে। চিঠি পড়ে সেই তথ্যটুকু মাথায় নিয়ে নিলে তারপর আর তার দরকার নেই। চিঠিটা ছিঁড়ে ফেললেই হয়। বাস্তবও ওইটুকুই দরকার। একটুখানি। সেটা হচ্ছে এরোপ্লেনের টেক-অফ পয়েন্ট। উড়তে শুরু করার পর শুধুই কল্পনার আকাশ।
আমি বিশ্বাস করি বাস্তবকে জেরক্স কপি করা লেখকের কাজ নয়। বরং লেখক নিজস্ব বাস্তবতা তৈরি করেন। প্রত্যেক লেখকের নিজস্ব বাস্তবতা আছে। সেটাকেই আমরা বলি তাঁর সিগনেচার। যিনি নিজের বাস্তবতা তৈরি করতে পারেননি, তিনি লেখক নন, ফটোকপিয়ার। সিনেমা আর সাহিত্যে মিল এইজায়গায়। দুটোই মেক বিলিভ। অর্থাৎ যা ঘটেছে তাই সত্য নয়, যা দেখানো হচ্ছে, বা ভাবানো হচ্ছে, তাই সত্য। পুরো ব্যাপারটাই আসলে মায়া। কারণ সাহিত্যের শেষ কথা সৌন্দর্য নির্মাণ। সৌন্দর্যই সেই মায়া যা মনকে জাগতিকতার উর্ধবে নিয়ে যায়।
সত্যজিৎ রায় একবার বলেছিলেন পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীত সিনেমার স্ট্রাকচার তৈরি করতে খুব কাজে লাগে। আমি সার্বিকভাবে দেখেছি সুর একটা কাহিনীকে ধরে রাখে। রাগসঙ্গীত বা লোকগান, বা পুরনো কোন ফিল্মের গান- এইগুলো চালচিত্রের মতো আমার কথাবস্তুকে ধরে রাখে। ‘নদীর নাম সাতপুকুর’ গল্পটিতে বারবার ফিরে এসেছে একটি নজরুলগীতি ‘তোমার আঁখির মতো আকাশের দুটি তারা’, কিংবা ‘এখানে টাওয়ার নেই’ উপন্যাসে ক্লাইম্যাক্স তৈরি হয় সোহিনী রাগ দিয়ে।
হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা তত্ত্ব বলে কোন চলমান বিন্দুর গতি এবং অবস্থান একসঙ্গে নিশ্চিত করে বলা যায় না। আমার কথাজীবন এই তত্বের ওপর দাঁড়িয়ে। শূন্যতা আর অনিশ্চয়তা আমার কবচকুণ্ডলের মতো। একটি গল্প বা উপন্যাস তাই আমি শুরু করি ঠিকই, কিন্তু তার গন্তব্য অনিশ্চিত। তাই পাঠককেও সে ঠেলে দ্যায় অনির্ণেয় অভাবনীয় অনিশ্চয়তার দিকে।
চৌদ্দ পনেরো বছর আগের কথা; আমি বসে আছি একটি দোকানে, দোকানটি মূলত আমাদেরেই। দোকানের সামনে…..
১৮ মার্চ ২০১৯ মধ্যরাত! চারদিক অন্ধকারে ঢেকে আছে শুধু বাড়ির চারিপাশে বিদ্যুতের বাল্বগুলো জ্বলছে তাদের…..
জোছনা করেছে আড়ি আসে না আমার বাড়ি গলি দিয়ে চলে যায়, গলি দিয়ে চলে যায়…..
পাঠকদের প্রায় জনেই হয়ত জানেন, সমকাম কি ? সমকামী কারা ? সমকামীর প্রকারভেদ, কেন…..