পাম গাছের গান

পুলক বড়ুয়া
কবিতা
Bengali
পাম গাছের গান

(চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে বিপন্ন পাম গাছের করুণ কাহিনী)

আমরা পাম গাছ
আমরা স্বেচ্ছায় এখানে আসিনি
তোমরাই আমাদের এখানে নিয়ে এসেছ
তোমাদের আঙিনায় শোভাবর্ধনের জন্য

তোমাদের মনে এত সুন্দরম তোমরা এত সৌন্দর্যপ্রিয় তোমরা এত চিরসৌন্দর্যপিয়াসু তোমরা এত চিরসুন্দরকে বন্দনা করো সত্যিই তোমরা চিরন্তন সৌন্দর্যের পূজারী তোমরা মহান সুন্দরকে ভালোবাস মুক্ত সুন্দরকে দেখে তোমাদের মন আনচান করে পরাণে হাহাকার ওঠে হঠাৎ লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে সহজাত মাধুর্যকে এমন আগলে ধরতে চাও খোলামেলা সুন্দরকে এমন উজাড় করে উপড়ে আনতে চাও অতঃপর স্বাধীন- সার্বভৌম সুন্দরকে স্বার্থপরের মতো ভালোবাসতে গিয়ে এমন অন্ধ হয়ে যাও সহসা সুন্দর উপদ্রুত দ্রুত অবরুদ্ধ সুন্দরের নাভিশ্বাস বন্দীপাখির মতো তার আত্মা গৃহত্যাগী, গৃহশূন্য

আমরাও তোমাদের কাছে নজরকাড়া বৃক্ষ হিসেবে এত ব্যাপক পরিচিত পেয়েছি যে এত সুখ্যাতি পেয়েছি যে এমন সমাদর পেয়েছি যে এমন স্বনামধন্য হয়ে উঠেছি যে তোমরা আমাদের এ শুশ্রূষাগারে এ সেবাসদনে নিয়ে এসেছ বড় আদর করে হ্যাঁ এ নিসর্গনন্দনকে কিংবা এ সুন্দরকে এতটুকু যত্নআত্তি করে মোটেও বিন্দুমাত্র কোনো সেবা দিতে নয় শোভনকে কিঞ্চিত সারিয়ে তুলতে নয় পরিচর্যা করতে নয় স্রেফ আমাদের চোখে চোখ তোমাদের চোখে চোখে শোভা পেতে সুখদ হতে মন কাড়তে সুনজর সাজাতে

অকস্মাৎ উটকো কিছু ব্যানার-পোস্টার আমাদের গায়ে গা ঘেঁষে গায়ের উপরে বলপূর্বক উঠে গেলে যার যেখানে খুশি যে যেভাবে পারল সজোরে
ভর করলে বদমায়েশী করলে নর্তন-কুর্দন শুরু করে দিলে নষ্টামী শুরু করে দিলে একদম প্রকাশ্য দিবালোকে আর যায় কোথায় তোমাদের চক্ষুশূলদৃষ্টি গেঁথে গেল আমাদের গায়

যাকে বলে একেবারে বেলেল্লাপনা যখন তখন ঝুলে পড়া অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে ধরা এসব তোমাদের কাছে বড্ড অশ্লীল ঠেকলো এই অস্বাভাবিক ঢলাঢলি অসহ্য আলিঙ্গন তোমাদের অতিষ্ঠ করে তুলল দেহমন বিষিয়ে ফেলল নষ্ট পচা গলা করে দিল কী করব আমাদের নিয়তিই এই আমরা যেন তার ক্রীড়নক বাধা দিতে ব্যর্থ অক্ষম আমাদের কথা কেউ বোঝে না শুনতে চায় না কী করব মৌনতা এভাবে মার খায় নীরব ভাষা এভাবে নির্যাতিত হয় আমাদের কেউ মূল্য দেয় না আমলে নেয় না গ্রাহ্যই করে না শুধু কাজে লাগায় ব্যবহার করে কান্ড শাখা প্রশাখা পাতা ফুল ফল পুরো শরীর তারপর সব শেষ অথবা ফেলনা ফিরেও কেউ তাকায় না আমরা বুঝি কেউ না কারো কিছু না কোনো কিছু না কোনো কথা না যতদিন দিয়ে যেতে পারি ততদিন অতঃপর দূর হ দূর হয়ে যা

ঘরবাড়ি গড়বে—কারখানা—উপড়ে ফেল—কেটে ফেল—বিক্রি করে দাও—বাহ্ কী মধুর-মনোজ্ঞ তোমাদের এই শিল্পবোধ-শিল্পচৈতন্য—কী মোলায়েম এই শিল্পকলা তোমাদের ভেতর বাহির কামনা বাসনা যা তোমাদের কাল হয়েছে
অথচ আমিই আদিম সেই আদ্যিকাল থেকেই আমি আদিপ্রাণ যুগে যুগে কালে কালে আজো

হায় আমরা সংখ্যায় ষটপঞ্চাশৎ পাদদেশ থেকে
৫ হাত জুড়ে ১০০—১৫০ টি ৪ ইঞ্চি লোহার পেরেক—অর্ধেক—কী নিষ্ঠুর পরিহাস নিয়তির
ঠুকে দিলে পুঁতে দিলে একবারও ভাবলে না যন্ত্রণার কথা আমাদের পরিণতি সেই থেকে আজ বছর দেড়েক এইভাবে আছি

রক্ত-জল নাকি অশ্রুকণা ক্ষতস্থান দিয়ে কষ গড়িয়ে পড়ছে কারো কথা বলি না আমরা
যাকে বলে সুশীল নীরব দর্শক মানুষ না ঝড়কে আমরা রোধ করি মূল দিয়ে ভূগর্ভের জল টেনে ভূপৃষ্ঠ সকাশে নিয়ে আসি তোমাদের জন্যে অহিত অঙ্গার-দ্বি অম্লজান ছেঁকে বাঁচোয়া অনল অঙ্গার-দ্বি-অম্ল কেড়ে সবুজ ছাড়পত্রে ছাড়ি তোমাদের বুকে হিতকরী অমল অম্লজান অপকারক মূ্ল্যহীনকে নিশ্চিন্তে ছিনিয়ে উপহার দিই‌ বাঁচিবার মূল্যবান মৌলিক রসদ

আমরা তো যিশু নই আমরা তো শিশু নই আমরা তো তার প্রেরিত পুরুষ নই আমরা তো নই ঈশ্বরের সেই বহুল পেরেকবিদ্ধ পুত্র আমরা তার মতো একমাত্র নই একা একসঙ্গে আমরা ঐ অনেক আমরা অপাপবিদ্ধ তবে তিন ইতোমধ্যে তিলে তিলে ধুঁকে ধুঁকে শহিদ তিন বোবা সারাক্ষণ আজীবন অনড় নিশ্চল থাকি আজন্ম আমৃত্যু নীরব থাকি আমাদের চোখে মুখে বুকে কথা নেই বার্তা নেই বিনা যুদ্ধে বিনা মূল্যে উড়ে এসে জুড়ে বসে ওরা ( কী ! সু-ন্দ-র ! ) আর তার মূল্য দিতে হয় এই ভা-বে । আ-মা-দে-র
কেন । দিতে । হবে
শু-ধু । আ-মা-দে-র

ক্ষত-স্থা-ন । দি-য়ে । ব্যাক-টে-রি-য়া
অনু-জী-ব । ঢু-কে
ইতোম-ধ্ধে ব্যাক-টে-রি-য়া
মর-তে । ব-সে-ছি । দে-খ-ছো না–
আমাদের জীবনীশক্তি পাইপ । লাইন । দিয়ে
পাচার । হয়ে । যাচ্ছে

এখানে । মানুষ । সুস্থ । হতে । আসে

কতো-গু-লো । অসুরদে-র । হা-তে
কতো-গু-লো । অসুন্দরে-র । হা-তে
কে-উ । কে-উ । আমাদে-র । ম-তো
নিগৃহী-ত । জি-ম্মি । হ-তে । আ-সে

স-বা-ই
এ-ক
ন-য়

আ-ম-রা
আ-লা-দা

আ-ম-রা
অ-মা-নু-ষ

মা-নু-ষ
বাঁ-চা-ও
সা-রা-ও
জী-ব-ন
দা-ন
ক-রো

অ-মা-নু-ষ
ম-রে গে-লে
ফি-রে-ও তা-কা-ও না

মানুষের মতো দেখতে কতোজনকেই তো তোমাদের চোখে কতো অমানুষকেই তো
হেলায় হাসপাতালে মেরে ফেল অমানুষের দল এত অমানুষ যে গণপিটুনি মারমার কাটকাট মহাভাঙচুরের আওয়াজ বাদ প্রতিবাদ আকাশে বাতাসে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হোক না ভেসে যাক না তোমাদের সুমতি হয় না তোমরা মোটেও কর্ণপাত করো না মানুষ নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে করতে মোট কথা কেমন যেন ভাবলেশহীন হয়ে গেছ সবকিছুতে

কোনো কোনো মানুষকে খুব গণ্য করো দেখি
কোনো কোনো নর-নারীকে বদান্যতা দেখাও
মানব নই বলে আমাদের এতই নগণ্য-কার্পণ্য করো ? আমরা অন্য-অমনুষ্য প্রজাতির দলে ? এ
এখতিয়ার কে দিয়েছে তোমাদের, আজ ম্যারাথন হত্যা করে যাও আমাদের ? মৃত্যুর এক মহোৎসব, হোলি খেলা খেলছো । মানুষকেও কী নিরবছিন্ন মানুষ ভেবেছ তোমরা ? কী করে এত অপসাহসের চর্চা করো ? বেশ তো । মরে যাব । কার ক্ষতি ।
চলে যাব । কার কী ? থাকবো না । তাতে কী ।
আম-রা । কা-পুরুষ । ন-ই । অ-সহায় । আ-র্তির । বুক-ফাটা । কান্-না । ছিটে-ফোঁটা । আহা-জারি । ঝর-বে না । জম-বে না। শুন-বে না : তোম-রা ! তাতে কী । না শোন !

আমাদের দৈহিক রূপ-যৌবন দেখতে দেখতে
তোমাদের দুটি চোখের একটি পুরোপুরি ঝলসে গেছে । অন্যটি সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে গেছে । তোমাদের অন্তঃ ও বহিঃ : চর্ম ও মনশ্চক্ষু : দুই
পুড়ে গেছে : মরা নদী । পানি শূন্য । শোকাশ্রুহীন । পাথর । আনন্দ-বেদনাহীন ।

ঐ বিভাগটিই ভ্রষ্ট-অন্ধ এখন । কিংবা ইচ্ছে করেই দুচোখ বন্ধ করে আছে । অথবা, দেখে না, দেখেও—দেখার ভান করছে । হৃদরোগ বিভাগটিও কী হৃদরোগগ্রস্থ, হৃদয়হীন !

শোন, হে চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়
শোন, হে মানবিক হাসপাতাল
আমরা তোমার ছত্রছায়ায় আর
আহত হবো না, কোনো অপাঙক্তেয় আছর আর
আমাদের ওপরে পড়বে না
আমাদের আশু আরোগ্যলাভের আগে, শুধু
তোমরা আরেকটিবার প্রকৃত লোকধর্মে দীক্ষা নাও
তোমরা প্রকৃত মনুষ্যধর্মে স্বশিক্ষিত হও
তোমরা শুদ্ধ প্রকৃতিপাঠ করো
বিশুদ্ধ প্রেমিক হও
সুশিক্ষিত হও
তোমাদের সুচিকিৎসা জরুরী!

পুলক বড়ুয়া। কবি। জন্ম বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। লেখাপড়া করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রকাশিত গ্রন্থ: ‘ওই পূর্বে রাঙা সূর্যে’, এবং ‘পাঠেরা খেলছে মাঠে’।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ