প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
বারবার মেয়েটার দিকে চোখ চলে যাচ্ছে। প্যারিস থেকে জেনেভা, জেনেভা থেকে জুরিখ। জুরিখ আসার কোনো কথাই ছিল না। প্যারিস থেকে লন্ডন যাবার কথা। ফ্রান্সের নিস শহর জঙ্গী নাশকতার টারগেট হয়ে সব প্ল্যান বদলে গেল। অফিস থেকেই আর রিস্ক নেয় নি। নতুন করে এয়ার টিকিট। ভালোয় ভালোয় দেশে ফেরার ব্যবস্থা। ফ্রান্সে থাকা সমস্ত বিদেশী পর্যটকদের জন্যে সরকারের বিশেষ ব্যবস্থা।
জিনি আর দোলনকে নিয়ে ইউরোপ বেড়ানোর সময় সুইজারল্যান্ড ছুঁয়ে যাওয়া হয়েছিল। টমাস কুক নাকি ভয়েজার কাদের সঙ্গে যেন বেড়ানো হয়েছিল সেবার। সুইজারল্যান্ড বেড়ানোটা বুড়ি ছুঁয়ে বেড়ানো। বেশ রাগারাগি করেছিল দোলন। একবার শুধু সুইজারল্যান্ড বেড়াতেই আসা হবে, এমন বলেছে বারবার। ওর কোন বন্ধু স্বামীর কর্মসূত্রে প্যারিসে থাকত, শেনেগন ভিসা আছে তাদের। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আটাশটা দেশের মধ্যে বাইশটা দেশের ছাড়পত্র শিংগেন ভিসা। উপায় থাকতেও কেন আর্যনীল তেমন ইচ্ছে না রেখে দেশে থাকা মনস্থ করল? কারণটা দোলনকে বলা হয় নি। যদিও দোলনের বোঝা উচিত ছিল। আর্যনীলের জীবনের বিবাহ-পূর্ববর্তী অধ্যায় দোলনের জানা। একসময় তো দোলন এই নিয়ে বেশ তৃপ্তিতে থাকত। অন্যপক্ষকে হারিয়ে দেবার তৃপ্তি জিতে যাবার তৃপ্তির চেয়েও সুস্বাদু।
তাই নানা দেশ ঘুরে বেড়ালেও জুরিখ নামটা বারবার কেন এড়িয়ে গেছে আর্যনীল, দোলনের অজানা থাকার কথা নয়। ভাগ্যের ফের দ্যাখো। এই জুরিখেই এবার একা একা আসা। থাকা।
সেবার ইতালির মিলান থেকে বাসে জুরিখ যাওয়া হয়েছিল। না না, মিলান থেকে ভেনিস। ভেনিস থেকে সুইজারল্যান্ডের সেন্ট মরিটয। ‘থ্রু দা আল্পস টুওয়ার্ডস সেন্ট মরিটয’ নামে একটা লেখা লিখে ফেলেছিল জিনি, রাতে হোটেলে ফিরে।
জিনির কথা মনে পড়তেই বুকের মধ্যেটা নরম। ডানা শক্ত হয়েছে, এবার উড়ে যাবে মেয়ে। অথচ পৃথিবী জুড়ে যা হচ্ছে, বড্ড ভয় করে। কোথাও বন্দুকবাজের হামলা, কোথাও জঙ্গী নাশকতা, কোথাও রেসিজম। জিনির অস্ট্রেলিয়া পড়তে যাবার কথায় এইজন্যেই বাধা দিয়েছে আর্যনীল। এদিকে ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গিয়ে ইউকে এখন ভিসা দেওয়া নিয়ে খুব কঠোর। লন্ডনে ভিসা পাবার কড়াকড়ি খুব। এক এক মহাদেশে, এক এক দেশে এক একরকম সমস্যা। অথচ জিনি বিদেশ যাবেই। বাবার মতই উচ্চাশা জিনির।
অবশ্য বিয়ে করে নিলে এমনিই বিদেশ যেতে পারবে। তমাল ইউএস যাচ্ছে খুব শিগগির। যাদবপুরে পড়ার সময় থেকেই দুজনে বন্ধু। কিন্তু ওরা এখন বিয়েটা করতে চায় না। জিনি ইউএস যেতেও চাইছে না। ওর ইচ্ছে প্যারিস, কিংবা এই সুইস দেশ।
কিন্তু… এই কিন্তুটাই মস্ত চাপ। ছাব্বিশ বছর আগের স্মৃতির চাপ। সব চুকেবুকে গেছে, কোনদিনই কোনো দাবি নিয়ে ফিরে আসবে না কেউ, তবু..
সরাসরি কলকাতার ফ্লাইটে জায়গা মেলে নি। জুরিখ-মিউনিখ-দিল্লী ফ্লাইটে আগামীকাল টিকিট। আজকের রাতটা জুরিখে থাকার ব্যবস্থা। জুরিখ এয়ারপোর্ট থেকেই জুরিখ শহরের প্রধান রেলস্টেশনে যাওয়ার জন্য রেল যোগাযোগ আছে। ট্যাক্সিক্যাব আর মিনিবাস সার্ভিসও আছে। এরা কি ব্যবস্থা করেছে কে জানে।
প্রথমে কাস্টমসের আইআরএম। ইউরোপের সব দেশেই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এই আইআরএম বা আইরিশ রিডেবল মেশিন। জঙ্গী কার্যকলাপ বেড়েছে, এখন সব এয়ারপোর্টে কড়াকড়ি।
লাইনে দাঁড়াতে মেয়েটাকে চোখে পড়ল আবার। পাশের লাইনে দাঁড়িয়ে। জেনেভা থেকে উঠেছিল ফ্লাইটে। লম্বা হাতা সাদা জামা, পায়ে গোবদা একটা জুতো। এলোমেলো কোঁকড়া চুল, কপাল প্রায় পুরোটাই ঢাকা, ভারি নিষ্পাপ মুখখানা। মায়া মায়া। গায়ের রঙ টকটকে ফর্সা, কিন্তু চোখের মণি কাজল কালো। এ দেশের মেয়ের এমন কালো চোখ হয় না। নিশ্চয় কালো লেন্স পরেছে চোখে। বাচ্চা মেয়ে। জিনির বয়সীই হবে। কিংবা একটু হয়ত বড়। মজাই লাগল। একটা বাচ্চা মেয়ে এমন এলোমেলো করে দিল মনটা। বয়স বাড়ছে হে আর্যনীল।
নিজের কাছেই তবু অচেনা আবার। পাশের আইআরএম-এ মেয়েটার ছবি ফুটে উঠেছে। দৈহিক মাপজোকের নানা তথ্য ভরে ফেলছে কাউন্টারের স্টাফ মেয়েটি। স্ক্রীনে ফুটে উঠছে সেসব। মেয়েটা মন দিয়ে পড়ছে। নিজের অজান্তেই সামান্য গলা বাড়িয়ে পড়তে লাগল আর্যনীলও।
স্ট্যাটাস– সিঙ্গল। ব্লাড গ্রুপ– বি পজিটিভ। আই কালার– ব্ল্যাক। ডেট অফ বার্থ– ৩১ ডিসেম্বর ১৯৮৮.. জিনির চেয়ে বয়সে বড়ই।
নেম– পারিজাত। পারিজাত? ভারতীয় নাম? বাঙালি?
সারনেম– নিল। ফাদার’স নেম– নট অ্যাপ্লিকেবল। মাদার’স নেম- …
আর পড়া হল না। স্ক্রীন সরে গেছে। ফুটে উঠছে আরো তথ্য।
কি যেন একটা অস্বস্তি। ফাদার’স নেম নট অ্যাপলিকেবল? বাবার নাম দরকার নেই এ মেয়ের? আনমনেই মাথাটা জোরে ঝাঁকালো একবার। এবার এদিকের ডেস্কে আইআরএম-এ ছবি ফুটে উঠেছে আর্যনীলের।
দুই.
বছরের প্রথম ছয় মাসেই মৃত্যু হয়েছে চব্বিশটি দেশের একাত্তরজন সাংবাদিকের ৷ ফ্রান্স, লিবিয়া, ইরাকে সন্ত্রাসবাদীদের শিকার হয়েছেন চব্বিশজন সাংবাদিক ৷ ইয়েমেন, লিবিয়া, ইরাক, সিরিয়া, দক্ষিণ সুদান ও ইউক্রেনের যুদ্ধ পরিস্থিতি কভার করতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে সতেরো জনের ৷ তিরিশ জন সাংবাদিকের মৃত্যু হয়েছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কলম ধরে ৷ বিশেষ করে ভারত, লাতিন আমেরিকা ও ফিলিপাইনে এই ধরণের মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি ৷
পাশাপাশি গোটা ইউরোপে মৃত্যু হয়েছে তেরো জনের ৷ উনিশশ’ নব্বই সালের পর ইউরোপে এই প্রথম এত বেশি সাংবাদিকের মৃত্যুর ঘটনা ৷ দু’হাজার চোদ্দ সালে বিশ্বজুড়ে মৃত্যু হয়েছিল একশ’ আটত্রিশ জন সাংবাদিকের ৷ এবছরের প্রথম ছ’মাসেই সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে একাত্তর।
জেনেভা প্রেসক্লাবে এই নিয়েই সাংবাদিক সম্মেলন। জ্বলন্ত এই সমস্যা ধরে উঠে এসেছে মানবাধিকার নিয়ে নানা আলোচনা। মানবাধিকার। মানুষের সহজাত অধিকার যা যে কোন মানবসন্তান জন্মলাভের সঙ্গেই অর্জন করে। সহজাত ও আইনগত অধিকার। স্থানীয়, জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক আইনের দায়িত্ব হল এ অধিকার রক্ষণাবেক্ষণ করা। যদিও অধিকার বলতে প্রকৃতপক্ষে কি বোঝানো হয় তা এখন পর্যন্ত একটি দর্শনগত বিতর্কের বিষয়।
আলগা হাসল পারিজাত। কষ্টের হাসি।
বন্ধুদের মধ্যে আর্ভিন আর ইউকিহিরো মিজাতানিও এসেছিল কভার করতে। আর্ভিন বিবিসি চ্যানেলের জন্যে কাজ করে। মিজাতানি আগে পারিজাতের অফিসেই ছিল, কিছুদিন আগে ইরাকে বদলি হয়েছে। যুদ্ধবন্দী এবং যুদ্ধে হতাহত মানুষ নিয়ে ওর অ্যাসাইনমেন্ট।
আর্ভিন আসলে অরবিন্দ। অরবিন্দ দেশাই। যদিও ইন্ডিয়ার সঙ্গে ওর কোনো যোগ নেই, ওর বাবা-মাযের জন্মও এই সুইস দেশে। তিনপুরুষের বাস।
ইউকিহিরো মিজাতানি জাপানের মানুষ, এবং সেটা খুব গর্বের সঙ্গে বলতে ভালোবাসে।
তিনদিনের প্রোগ্রাম। সঙ্গে নানা সেমিনার, ডিবেট, প্রেস-মিট, ডিনার। ঠাসা প্রোগ্রাম। মাকে একবার ফোন করার সময়ও হয় নি। চিন্তা করলেও মা অবশ্য কিছুই বলবে না। মা স্পেস দিতে জানে। যদিও মানবাধিকার নিয়ে নানা কথা শোনার মাঝে বারবার মাযের মুখটাই মনে পড়েছে পারিজাতের। নানা মানুষের মানবাধিকারের লড়াইয়ে শামিল হলেও মাযের জন্যে কিছুই করা হয় নি।
কিছু করতে চায়ও না মা। মাযের মত একজন জেদী লড়াকু মানুষ কেন যে লড়াইটা ছেড়ে দিল! পারিজাত এই নিয়ে কিছু করুক, মা তাও চায় না। এত সংবেদনশীল হয়েও মা যে কেন বোঝে না, এটা তার মেয়েরও লড়াই। কিছুতেই মুখ খুলবে না। কোনোদিনই কি ছায়া-ছায়া অতীতটা আলোয় আসবে না?
অতীতের সব মানুষকে জীবন থেকে প্রায় মুছে ফেলেছে মা। মামাবাড়িতেও নানাভাবে জিজ্ঞেস করে দেখেছে ওরাও বেশি কিছু জানে না, মা কারো কাছে মুখ খুলতেই চায় নি। কারো ঘাড়ে দায় চাপায় নি, কারো নাম বলে নি, একা একা অপরাধের সব দায় বয়েছে। সেই নিয়েই দাদুর সঙ্গে সব সম্পর্ক ছেদ। দাদু বলেছিল, ‘তুই শুধু নাম বল, যে যত যে ধর্মের হোক তার সঙ্গেই বিয়ে দেবার ব্যবস্থা আমি করব। তোর বাবা এখনো বেঁচে আছে অপু।‘
মা বলেছিল, ‘যে পুরুষ দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে, তাকে বিয়ে করতে বলছ বাবা?’
সমাজের ভয়, পরিবারের চাপ, মাকে টলাতে পারে নি। তারপর একলা বাড়ি ছেড়ে আসা। দেশান্তরী হওয়া।
বাইবেলের গল্পের নোয়ার মত। মাযের পৃথিবী মহাপ্লাবনে ভেসে গেছে। নৌকো নিয়ে মা এসে উঠেছে সাত সমুদ্র দূরের দেশে। নোয়ার নৌকোয় অবশ্য এসেছিল অনেক প্রাণ, মানুষ জন্তু গাছ-গাছালি আর আকাশচারী পাখি, সবই এক জোড়া করে। মাযের সঙ্গে ছিল কেবল একটি গর্ভস্থ শিশুর প্রাণ। আর কিছু স্মৃতি। এমন স্মৃতি যা কেবল দু:খই দেয়।
নোয়া, ঈশ্বরের নির্বাচিত মানব-প্রতিনিধি, যে বোঝে নি পাপ কাকে বলে ৷ আর মা, পরিবারের চোখে মস্ত পাপী। কত প্রতিকূল পরিস্থিতি, আক্ষরিক অর্থে কত ঘাট পেরিয়ে তীরে এসে ওঠা, আজ পারিজাত সেটুকু বোঝার বয়সে এসেছে।
তিন.
মা চেয়েছিল পারিজাত অ্যাকাডেমিক লাইনে থাকুক। ইতিহাস। মাযের প্রিয় বিষয়। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস, সারা পৃথিবীর ইতিহাস মাযের প্যাশন। ইতিহাস নিয়ে মা ইউকিপিডিয়ার চেয়েও বিশ্বাসযোগ্য রেফারেন্স। শুধু ইতিহাস নয়, নানা পুরাণ। হিন্দু গ্রিক জাপানী আরবী, নানা মাইথোলজি। মা যে কি না জানে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের চাকরির ব্যাকগ্রাউন্ড থেকেই বোধহ্য় এই নেশা। যদিও কলকাতার ব্রিটিশ কাউন্সিলের চাকরির কথাটা মা তুলতেই চায় না। অবশ্য মা না বললেও গল্পটা জেনে ফেলেছে পারিজাত।
কলকাতার মামাবাড়ি, ভেনিসের সুপ্তামাসি, জুরিখেই কমলেশ আঙ্কল-তনুকা আন্টি, ফেসবুক খুঁজে পাওয়া মাযের বন্ধুরা, জাপানে থাকা হাসি আন্টি, ইন্ডিয়ার জয়পুরে রুক্মা আন্টি। দিল্লীর বিজয়লক্ষ্মী আন্টি তো আছেই। টুকরো টুকরো কথায় গল্পটা জেনে ফেলেছে পারিজাত। আর জার্নালিস্ট হওয়ার পর রিডিং বিটুইন দা লাইনস আরো ভালো শিখেছে।
অবশ্য কলকাতার মামাবাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে এই মাত্র ক’বছর আগে। ইন্ডিয়ার সঙ্গে মাযের যোগসূত্র ছিল বিজয়লক্ষ্মী আন্টি। মাযের সঙ্গেই কাজ করত ব্রিটিশ কাউন্সিলে। মাযের জুরিখ আসাও বিজয়লক্ষ্মী আন্টির জন্যে। বৈভব আঙ্কল বিজয়লক্ষ্মী আন্টির দাদা। বৈভব আঙ্কল আর সিমোন এদেশে পারিজাত আর মাযের ফ্যামিলি। বৈভব আঙ্কলের বউ হলেও সিমোন অবশ্য আন্টি নয়। শিরিনের মম হলেও পারিজাতের কাছে শুধুই সিমোন। শিরিনের কাছে মা যেমন শুধুই অপু।
গ্র্যান্ডপা ক্যান্সার হয়ে লাস্ট স্টেজ, তখন। দিদুন আর মামু বারবার যোগাযোগ করেছে, ফোনে পারিজাতের সঙ্গেও কথা বলেছে। মা পারিজাতকে নিয়ে কলকাতা গেছিল, গ্র্যান্ডপার সঙ্গে দেখা করার জন্যে। গ্র্যান্ডপা চলে গেল থার্টিএথ ডিসেম্বর, পারিজাতের জন্মদিনের আগের দিন। এখনো মনে আছে।
গ্রান্ডপার লাস্ট রাইটের কাজের সময় তো আবার মিতুমাসি আর ছন্দামামীর সঙ্গে ঝামেলা হল। একটা নতুন বাংলা কথা শিখেছিল পারিজাত। কানীন মা।
ছন্দামামী জিজ্ঞেস করেছিল মাকে, ‘সুইজারল্যাণ্ডে সিঙ্গল মাদারদের স্ট্যাটাস কেমন রে অপু? মেয়েটাকে এত ভালো মানুষ করেছিস, ভাগ্যিস চলে গেছিলি। এ দেশে থাকলে আর…‘
থামিয়ে দিয়ে মিতুমাসি বলেছিল, ‘এ আবার কেমন প্রশ্ন? কানীন মাযের স্ট্যাটাস সব জায়গায় একই।‘
শ্রাদ্ধের কাজের বাড়ি ছেড়ে পারিজাতকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল মা। দিদুন মামু কারো কথা শোনে নি। দিল্লীতে বিজয়লক্ষ্মী আন্টির কাছে ক’দিন থেকে টিকিট চেঞ্জ করে বাড়ি। আর কলকাতা যায়নি মা। পারিজাত যাক, তাও চায় না। এই যে এবার টুম্পার বিয়েতে কলকাতা যাওয়া, মা পছন্দ করছে না। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী মা বাধা দেয় নি যদিও।
মাকে ছেড়ে, বাড়ি ছেড়ে একা থাকার শুরুর দিনগুলোতেও মা শান্ত থেকেছে। যত ভাবনাই হোক, প্রকাশ করে নি। জেদ চেপে বসত। রাগ হয়ে যেত। কেন মা আর সব মাযের মত নয়! অথচ পারিজাতই মাযের জীবন। ‘মাই ওয়ার্ল্ড রিভলভস অ্যারাউন্ড মাই বেবি’, সিমোনকে বলেছিল মা। বৈভব আঙ্কলের বন্ধু যখন বিয়ে করতে চেয়েছিল মাকে, তখন। কতজনই তো বিয়ে করতে চেয়েছে। মা এক কথাই বলেছে।
মা আর পারিজাত। পারিজাত আর মা। আর কাউকে মা মাঝে আসতেই দেয় নি।
সিঙ্গল মাদার। হ্যাঁ, মা একজন সিঙ্গল মাদার। স্কুলে অনেক বন্ধু ছিল, যাদের বাবা নেই। পিটার আর ন্যান্সির মত অনেক ছেলেমেয়ে ছিল, যাদের বাবা বা মা আলাদা হয়ে গেছে। দুজনের কেউই ওদের নেয় নি। অ্যাগনেস রবার্ট রবিনের মতো অনেক ছেলেমেয়ে, যাদের বাবা বা মা আবার বিয়ে করেছে, এবং ওরা স্টেপ-ফাদার বা মাদারের সঙ্গে থাকত। তাছাড়াও এদেশে ফস্টার পেরেণ্টিং স্বাভাবিক ব্যাপার, বাবামায়ের কাছে যে সন্তান ভালোবাসা পায় না, তাকে সন্তান হিসেবে আশ্রয় দেবার জন্যে অনেক মানুষ। তারাও অনেক সময়ই সিঙ্গল পেরেণ্ট।
কিন্তু কানীন মাদার মানে কি?
অকারণেই বুকের মধ্যে শিরশির। ভয় ভয়। কেন যেন মাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করতেও অস্বস্তি। এগারো বছরের পারিজাত কিন্তু সেদিনই বড় হয়ে গেছে। পিটার, ন্যান্সি বা কলকাতার রিয়া, পিকলু.. কারো মতই নয় ও। ও যে ঠিক কেমন, সেটা নিজে নিজেই জানতে হবে।
চার.
ধৈর্য, সাহস, পর্যবেক্ষণশক্তি, ইচ্ছেশক্তি। বিষয়ের গভীরে যাবার প্যাশন, হার না মানা মনোভাব। একজন সাংবাদিকের মধ্যে থাকার সব গুণ পারিজাতের মধ্যে ছোট থেকেই। কঠিন বিষয়ের তথ্য জোগাড় করে তা সহজপাচ্য কথ্যভাষায় প্রকাশ করা শিখেছে পেশায় আসার পর। কিন্তু খুঁজে নেবার গুণটি সহজাত, কোনো জার্নালিজমের ক্লাসে শেখা হয় না।
খুঁজে নেবার সহজাত অভ্যেস কি জন্মের রহস্য থেকেই? কে জানে। কিন্তু খুঁজে নিয়েছিল নিজে নিজেই। ভার্জিন মাদার। পারিজাতের মা একজন কুমারী মা। আর পারিজাত একজন জারজ সন্তান।
মাযের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে হয় নি। গুমরে গুমরে থাকা কতগুলো দিন। বুকের মধ্যে কান্না। বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার ইচ্ছে, আবার ঘরের মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে ফেলার ইচ্ছে। এক মানুষের মধ্যে যে কতগুলো মন।
মা বুঝেছিল। মাকে মুখ ফুটে কিছু বলে দিতে হয় নি। মা শুধু বলেছিল, ‘আমার উপায় ছিল না রে। তোকে বাদ দিয়ে জীবন কাটাতে ইচ্ছে হয় নি। তুই যে আমার প্রাণ। প্রাণ ছাড়া কি বাঁচা যায়, বল?’
লড়াইটার কথা বলে নি, প্রবঞ্চনার গল্পে করুণ কাঁদে নি, মাযের দু’চোখে চিকচিকে আলো, মায়ের কোল জুড়ে অসীম শান্তি। যে শান্তির স্পর্শে বেড়ে উঠেছে পারিজাত। মহাপ্লাবনে সব ভেসে যাবার পরও এত স্থির থাকতে পারে কেউ? মা পেরেছে। মা নোয়ার মতই অপাপবিদ্ধ একজন মানুষ। মাকে সাধারণে জড়িয়ে ফেলা যায় না।
দু’হাত বাড়িয়ে মুছে দিয়েছিল চোখের জল, জড়িয়ে নিয়েছিলে ঠান্ডা কোলের মধ্যে, ‘কাঁদিস না পরী, তুই কাঁদবি না বলেই তো এত কিছু। থার্টি-ফার্স্ট ডিসেম্বরের ঠান্ডা রাত, তুই এলি। আমার সব ঠান্ডা কেটে গেল, আকাশ জুড়ে ঝলমলে আলো। নতুন বছর এল ফুলের মত একটি শিশুর হাসিমুখ। আর সেই থেকে এভরি নিউ ইয়ার কামস উইথ মাই বেবি’স স্মাইল। আর তো কান্না নেই, কষ্ট নেই।‘
সিমোন বলেছিল, ‘কোনো মেয়ে কি আর সাধ করে কুমারী মা হতে চায়? অন্তত এ সমাজে? আর একটু বড় হলে আরো ভালো করে বুঝবি। তুই ঠিক বুঝবি। তুই যে অপুর মেয়ে। তুই যে পারিজাত। তুই কি আর সবার মতো হতে পারিস?‘
সবার মতো। সবার মতো হওয়া যাবে কি করে? জারজ সন্তান কি আর সব সন্তানের মত? অভিমানে মাযের সঙ্গে কথা বন্ধ হয়েছিল। চোদ্দ বছরের পারিজাত বাড়ি ছেড়ে এসেছিল সেদিন। এদেশে আঠেরো হলেই ছেলেমেয়ে আলাদা থাকে। চোদ্দ বছরের পারিজাত বাড়ি ছেড়েছে। মা বাধা দেয় নি। আকুলি বিকুলি করে কাঁদে নি। ধরে রাখার জন্যে জেদ করে নি। যদিও মাযের জেদ কম নয়। মা শান্ত অপেক্ষায় থেকেছে। মহাপ্লাবন মাকে স্থির অপেক্ষা শিখিয়ে দিয়েছে।
বাড়ি ছেড়ে যাবার দিন সিমোন এসেছিল। আর এসেছিলেন সিস্টার জুডিথ। সিমোন মাযের হাত ধরে বসেছিল। সিস্টার বলেছিলেন, ‘আমি জানি তুমি ফিরে আসবে। তুমি যে পারিজাত। অপরাজিতা আমায় তোমার নামের মানে বুঝিয়ে দিয়েছিল, তুমি যখন এইটুকু হয়ে আমাদের কাছে এসেছিলে।‘
পারিজাত। অপরাজিতার মেয়ে পারিজাত।
পারিজাত স্বর্গের শোভা। পারিজাত অনন্যা। পারিজাত গাছ নাকি ঝড়-ঝঞ্চা প্রতিরোধ করতে পারে। আগুন-প্রতিরোধক, বাতাস ও ঝড়ের বিপরীতে টিকে থাকতে পারে। এমনকি প্রবল বন্যায় দু’ সপ্তাহ পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।
আর আছে সমুদ্রমন্থনের পৌরাণিক গল্প। অমৃতের সন্ধানে দেবতা ও অসুররা মন্দার পর্বতকে মন্থনদণ্ড হিসেবে ব্যবহার করে সমুদ্র থেকে তুলে আনছেন একের পরে এক আশ্চর্য জিনিস। সেই মন্থনে উদ্ভাসিত দেবী লক্ষ্মী, হাতী ঐরাবত, ঘোড়া উচ্চৈশ্রবা, কামধেনু, চন্দ্র, অপরূপা সব অপ্সরা। এবং অবশ্যই হলাহল বিষ ও অমৃত। এসব ছাড়াও সেই মন্থনে উঠে এসেছিল এক আশ্চর্য বৃক্ষ, যার নাম পারিজাত। ইন্দ্রের নন্দনকাননে প্রধান গাছটিই হল পারিজাত। ইন্দ্রের স্ত্রী শচীদেবীর খুব প্রিয় পারিজাত ফুল, তিনি রোজ একটি করে পারিজাতমঞ্জরী চুলে লাগিয়ে সাজগোজ করেন। কোনো কোনো পুরাণে আবার পারিজাত একটি কল্পতরু, এর কাছে যা প্রার্থনা করা যায়, তা-ই পাওয়া যায়।
আর আজকের যুগে? পারিজাত একটি জারজ সন্তানের নাম। এই সামাজিক পরিচয় মায়ের জন্যেই। মাকে মায়া করতে পারে নি পারিজাত।
মায়েরই তো মেয়ে। পারিজাত ঠিক সেই কাজগুলোই করেছে তারপর, যেগুলো মা চায় নি। এই যে এবারে কলকাতা যাওয়া, মামুর মেয়ে টুম্পার বিয়ে উপলক্ষ্যে, তাও মাযের উল্টোপথে হাঁটার জন্যেই। যাবে পারিজাত, নিশ্চয় যাবে কলকাতা। মা না চাইলেও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে। সেই মানুষটাকে খুঁজে পেতে হবে। সেই বিশেষ মানুষটা, যার জন্যে আজ পারিজাত এক কানীন মাযের সন্তান। মাযের জেদ আর কঠিন পণের জন্যে যে সহজ জীবন থেকে বঞ্চিত, তার স্বাদ চাই। কে বলতে পারে, সেই মানুষটাও মাযের মতই একলা প্রতীক্ষায় আছে কিনা।
তাছাড়া এখন মাকে একটু হলেও বোঝে পারিজাত। জোর করে কেড়ে নেওয়া, আটকে রাখা মাযের স্বভাবেই নেই। লম্বা জীবনটা একলা কাটিয়ে এল সেই বিশেষ মানুষটা এল না বলেই। একবার খোঁজ করবে না পারিজাত, তাকে যদি পাওয়া যায় আবার! হয়ত প্রবল একটা অভিমানের প্রাচীর দুজনের মধ্যে। পারবে না পারিজাত?
মনে মনে শক্ত হয়েছে। নবীন সাংবাদিকের নতুন গোপন মিশন।
পাঁচ.
দোলন বারবার বলে দিয়েছে তাড়াতাড়ি ফেরার কথা। মল্লিকের মেয়ের বিয়ে। জিনিকে নিয়ে দিনের বেলা একবার ঘুরে এসেছে দোলন। সন্ধেবেলাও তাড়াতাড়ি যেতে হবে। মল্লিক বারবার বলে দিয়েছে, ‘কুটুমবাড়ির লোকজন, আপ্যায়ন করার সময় পাশে থেকো তোমরা।‘
এই বিয়ে শাদি ব্যাপারগুলোই এমন। আজকাল বিয়েবাড়ি গেলে মনটা ভার হয়ে যায়। জিনির জন্যেও এমন দিন আসছে। বয়স হচ্ছে সত্যিই। কিছুদিন আগেও বিয়েবাড়ি মানেই নিজের বিয়ের স্মৃতি, বাড়ি ফিরে দোলনের জন্যে বিছানায় জোরালো আকর্ষণ। দোলন মুখে রাগ করত, ‘বিয়েবাড়ি থেকে ফিরলেই তুমি এমন দস্যু হয়ে যাও কেন’.. কিন্তু চোখ জুড়ে অন্য কথা, সারা শরীর জুড়ে আবাহন।
বাড়ির কাছাকাছি এসে মন ভালো হয়ে গেল। হালকা সবুজ আর গাঢ় মেরুন রঙ, জানলায় সাদা সুদৃশ্য গ্রিল, দোতলার বারান্দায় লম্বা অ্যাকাশিয়া পাম। নিচে গ্যারেজের পাশে সবুজ লন, লনে বাহারি দোলনা। এপাশে সার দিয়ে মনোহারী ফুলগাছ, পাতাবাহার। রোজ সকালে মালী এসে বাগান পরিষ্কার করে যায়।
দোলনের পছন্দের ডুপ্লেক্স। ডুপ্লেক্স নয়, ডুপ্লে। প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে মেয়ে-জামাইকে উপহার দিয়েছিলেন দোলনের বাবা। দোলনকে নিয়ে আর্যনীল তখন আঙ্কল স্যামের দেশে। বিদেশ গিয়ে ম্যানেজমেণ্ট পড়ে আসার ব্যবস্থাও দোলনের বাবার। ফিরে এসে এবাড়িতে সংসার শুরু। জিনির জন্ম এবাড়িতেই।
বাবার মন বোঝা যায় নি, দোলনকে বিয়ে করাটা বাবা মেনে নেয় নি, কিন্তু মা খুশি হয়েছিল। যদিও ছেলের বাড়ি এসে থাকা হয় নি বাবা-মা কারোরই। জিনিকে দেখতে এসে মা সোনার গিনি দিয়েছিল। জিনির অন্নপ্রাশনে বাবা-মা আসে নি, আসতে বলাও হয় নি।
অজিত গাড়িটা গ্যারেজে তুলছিল, বারণ করে দিল আর্যনীল। থাক, এখনই বেরোতে হবে।
তিনধাপ সিঁড়ি দিয়ে উঠে দরজা। দরজায় পেতলের ঘণ্টা। ঘণ্টায় হাত দিতে গিয়ে থেমে গেল। সাজগোজ নিয়ে মা-মেয়ে ব্যস্ত হয়ত। পকেটে হাত দিয়ে চাবি বের করে নিল।
তখনই চোখে পড়ল গাছটা। লতানো গাছ। পাশের বাড়ির দেয়াল থেকে নেমে এসেছে এদিকে। নীল নীল ফুল, পুজোর কাজে লাগে। পাতাভর্তি লতার ফাঁকে ফাঁকে একেকটি ফুল, যেন ফুলগুলো একা থাকতেই ভালবাসে।
দোলন দেখতে পেলেই মালীকে দিয়ে কাটিয়ে দেবে। কাজের মেয়েটা একটা নয়নতারা না টগর গাছ এনে লাগিয়েছিল বাগানে। দোলন রাগ করেছিল। দোলনের সব গাছের দারুণ পেডিগ্রী। কিটিপার্টির বন্ধুদের কাছে বাগানের জন্যেই দাম বেড়ে গেছে দোলনের। গাছের মতই মানুষেরও পেডিগ্রী আছে না?
‘পরাজিতা তুই সকল ফুলের কাছে,
তবু কেন তোর অপরাজিতা নাম?
বর্ণ সেও তো নয় নয়নাভিরাম।
ক্ষুদ্র অতসী, তারো কাঞ্চন-ভাতি
রূপগুণহীন বিড়ম্বনার খ্যাতি!
কালো আঁখিপুটে শিশির-অশ্রু ঝরে-
ফুল কহে, মোর কিছু নাই কিছু নাই,
ফুলসজ্জায় লজ্জায় যাই নাকো,
বিবাহ-বাসরে থাকি আমি ম্রিয়মাণ
মোর ঠাঁই শুধু দেবের চরণতলে,
পূজা, শুধু পূজা মোর জীবনের ব্রত;
তিনিও কি মোরে ফিরাবেন আঁখিজলে-‘
(অপরাজিতা- যতীন্দ্রমোহন বাগচি)
নতুন মেয়েটা আবৃত্তি করেছিল, সিনিয়র ছাত্রছাত্রীদের সামনে দাঁড়িয়ে। এখন গালভরা নাম দেওয়া হয়েছে ব্যাপারটার। কলেজ র্যাগিং একটি বহুচর্চিত বিষয়। নিছক মজা পাওয়ার র্যাগিং র্যাগিং খেলায় কত যে অঘটন। তখন ব্যাপারটা অবশ্য মজায় মজায় হত।
বিদিশা নাকি গার্গী বলেছিল, মেয়েটার নাম শুনে বলেছিল, ‘আর্টস পড়তে এসেছ, বাংলা কবিতা মুখস্থ আছে তো? তোমার নাম নিয়ে একজন বিখ্যাত কবির কবিতা আছে। বলো শুনি।‘
প্রথমদিনই চোখে পড়েছিল মেয়েটাকে। সাধারণ বাঙালি মেয়েদের তুলনায় বেশ লম্বা, অন্তত পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি। শ্যামলা দোহারা গড়ন। লম্বাটে মুখ, সুন্দরী বলবে না কেউ, কিন্তু কেমন একটা আকর্ষণ আছে। কাজল কালো চোখ, অত কালো চোখের মণি সচরাচর চোখে পড়ে না। প্রথম দৃষ্টিতে চোখের দিকে নজর পড়বেই। টিয়ে সবুজ শাড়ি, কালো ব্লাউজ, কপালে কালো একটা ছোট টিপ।
‘ড্রেস সেন্স নেই’, মালবিকা নাকি মধুমিতা বলেছিল, ‘বেশ গাঁইয়া আছে। নির্ঘাত বাংলা অনার্স। কোন স্কুল?’ এটা মেয়েটাকে।
‘সারদাবালা বালিকা বিদ্যালয়।‘ হাতে আঁচলের খুঁট, মাটির দিকে চোখ, ভীরু গলায় উত্তর দিয়েছিল মেয়েটা।
‘বেশ বেশ। ওহে বালিকা, একটু আমাদের দিকে নজর দাও’, দীপ্তেন চিরকালের ফচকে।
পরে এই দীপ্তেনই অপরাজিতার সত্যি বন্ধু হয়ে থেকেছিল। সেই সব দিনে, যখন মেয়েটা এখান থেকে সেখানে ছুটে বেড়াচ্ছে একটু আশ্রয়ের খোঁজে। তখন তো আজকের মতো এত মহিলা পিজি ছিল না। পেয়িংগেস্ট রাখারই চল ছিল না। তার ওপর একলা যুবতী মেয়ে, মা হতে চলেছে অথচ স্বামী-পরিত্যক্তা নাকি বিধবা কিছুই বলে না।
দীপ্তেন ছুটে এসেছিল বারবার। ‘অপু বাড়ি ছেড়ে এসেছে’, ‘অপু পাগলের মতো খুঁজছে তোকে’, ‘অপু কিছুতেই ভ্রূণ-সন্তান নষ্ট করতে চাইছে না’.. বারবার। প্রথম প্রথম ভয় হত, অপু যদি এবাড়িতে এসে ওঠে। বাবা-মাযের সামনে এসে দাঁড়ায়।
না, প্রখর আত্মসম্মান ও মেয়ের। সন্তানের দায় নিতে না-চাওয়া পুরুষকে মানুষ বলেই গণ্য করে না। বিষম জেদ। আর বড্ড অহঙ্কার। কেমন স্থির গলায় বলেছিল, ‘তুমি না চাইলেও ও আসবে, মাযের পরিচয়েই বড় হবে।‘ অপু কোনদিন এসে হাত পেতে দাঁড়াবে না।
আস্তে আস্তে ভয় কেটে গেছে। কি করবে ও? কি করতে পারে ওর মতো মেয়েরা? সন্তান নষ্ট যদি না-ই করে, বাড়ি থেকে ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দেবে। সাধারণ বাড়ির সাধারণ মেয়ে, ওর হয়ে কে দাঁড়াবে? কে-ই বা আসবে এগিয়ে?
বিশেষত যখন এপক্ষে এমন ক্ষমতাশালী অর্থবান সহায় রয়েছে। আর তাছাড়া যা-ই বলো, দোলনচাঁপা ফুলের সঙ্গে অপরাজিতার তুলনা হয়? রঙ রূপ গন্ধ। আহা।
ছয়.
দরজা খুলে ঢুকতেই জিনি বেরিয়ে এল ঘর থেকে। অকারণেই কেমন একটা চমক। শাড়ি পরেছে জিনি। অন্যরকম লাগছে মেয়েটাকে। শাড়ি পরেছে বলেই কি? উঁহু, ওই যে কপালের অর্ধেক ঢেকে চুলের সাজ করেছে আজ। তাতেই একদম বদলে গেছে মেয়েটা। এলোমেলো কোঁকড়া চুল, বাবার মতই কোঁকড়ানো চুল মেয়ের। আর্যনীলের চুলে অবশ্য পাক ধরেছে, ঘন সে কোঁকড়া ভাবটাই নেই আর।
‘কেমন লাগছে বলো? ও বাবি’, জিনি এগিয়ে আসছে।
আর সেদিকে তাকিয়ে থেকে হঠাত্ একটা অন্য মেয়ের ছবি। এলোমেলো কোঁকড়া চুল, কপাল প্রায় পুরোটাই ঢাকা, মায়া মায়া মুখ। জুরিখে দেখা সেই মেয়েটা। জিনিকে সেই মেয়েটার মত লাগছে না? হঠাত্ মনটা এমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে কেন?
‘দ্যাখো না, জিনি বলছে ওখানে খাবে না। আমাদের সঙ্গে যাবে, কিন্তু শ্রেয়ার সঙ্গে দেখা করেই বেরিয়ে যাবে। ওদের পার্টি আছে আলাদা। ক্লাবে যাবে, ডিস্কে যাবে।‘
‘ডিস্কে যাবে, তাহলে শাড়ি পরেছে কেন?’ আর্যনীল একটু সামলে নিয়েছে নিজেকে।
‘আরে বাবি, প্রোগ্রামটা তো এখনি ঠিক হল। তমালের এক বন্ধু এসেছে নিউ জার্সি থেকে, বলেছিলাম না? চন্দন, এসেছিল না সেদিন আমাকে মিট করতে? কাল চলে যাবে চন্দন। ওরা বন্ধুরা সবাই মিলে পার্টি করছে আজ। তমাল আমাকে মল্লিককাকুর বাড়ি থেকে পিক করে নেবে, ভেবো না।‘
‘ওকে নো প্রবলেম। তমালই রাতে পৌঁছে দেবে তো?’
‘ওহ বাবি, আমি আর ছোট নেই। এসব জিজ্ঞেস কোরো না প্লিজ।‘ ‘প্লিজ’ শব্দটায় বেশ জোর, মোটেই অনুগ্রহ চাওয়ার ভঙ্গী নয়। জিনি সত্যিই বড় হয়ে গেছে।
‘অফ কোর্স পৌঁছে দেবে। কবে তমাল ওকে একা ছেড়ে দিয়েছে? তুমি শুধু শুধু বেরোবার সময় মুড অফ করছ মেয়েটার।‘ দোলন বলে উঠল, ‘চা খাবে? নাকি একেবারে ওখানে গিয়েই..’
হাত নাড়াল আর্যনীল, চা দরকার নেই। ‘ফ্রেশ হয়ে আসছি।‘
সাত.
‘তুমি ইন্ডিয়া যাচ্ছ কবে?’ চিফ এডিটর ফোন করেছিলেন, ‘নেক্সট স্যাটারডে, না? টোয়েন্টি সেভেন্থ, রাইট?’
‘হ্যাঁ।‘
‘মেক ইট অ্যান অফিসিয়াল ট্যুর। তুমি কাশ্মীর কভার করতে যাচ্ছ।‘
‘কাশ্মীর? ওহ, কাল ওখানে দু’জন জার্নালিস্ট..’
‘ইয়া ইয়া।‘ বেশি কথা বলেন না চিফ, ‘সুসানা উইল এক্সপ্লেইন এভরিথিং। গো টু ডেলহি অফিস ফার্স্ট। মার্ক হ্যাজ অলরেডি লেফট ফর ডেলহি। মিট হিম অন ফার্স্ট আর সেকেন্ড। ইজ ইট ওকে উইথ ইউ? তোমার কলকাতার প্রোগ্রামটা কবে।‘
‘টোয়েন্টি নাইন্থ, হয়ত থার্টি ফার্স্টও একটা..’
‘ওকে ওকে। তুমি প্ল্যান করে নাও। কল মি ইফ ইউ নীড।‘
টুম্পার বিয়েতে মা যাচ্ছে না। মামু মামী অনেকবার ফোনে কথা বলেও মাকে রাজি করাতে পারে নি। পারিজাত বলেছে, ‘যাব।‘ মাকে সেকথা জানিয়েও দিয়েছে। মায়ের যদি একটা লড়াই থেকে থাকে, তাহলে পারিজাতের লড়াইটাও লড়াই। শিকড়ের থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকবে না পারিজাত।
কিসের ভয়? জারজ শিশু এ দেশের পথে-পার্কে, অলিতে-গলিতে গড়াগড়ি। তাদের মায়েদের সঙ্গে পারিজাতের মাযের অনেক পার্থক্য। আর্থ-সামাজিক অবস্থানে, চিন্তনে, মননে। তারা শখ করে ভার্জিন মাদার হয়নি, প্রকৃতির দান পেট পেতে বইতে বাধ্য হয়েছে মাত্র। কিন্তু মা তো বাধ্য ছিল না। সন্তান নষ্ট করাতে চাও নি, ঠিক আছে। তার জন্যে তোমার মনের জোরকে আলাদা সম্মান দেওয়াই যায়। কিন্তু তুমি আমাকে শিকড় থেকে ছিনিয়ে আনলে কেন? কেন এইটুকু সুযোগ থাকল না যে, আমার বাবাকে খোঁজ করি? কেন কাউকে তুমি তার কথা বলো নি? তুমি বলেছ, সে বেঁচে আছে। তাহলে কেন নিজের অধিকার চাইলে না? কেন পারিজাতের জন্যে অধিকার চাইলে না?
মাকে ক্ষমা করতে পারে নি পারিজাত।
দিদুন এবার অনেক গল্প করেছে। পারিজাত মাকে ছেড়ে অন্য বাড়িতে চলে গেছে শুনে খুব কেঁদেছে, ‘তোর মা একজন দু:খী মানুষ। শুধু তোকে বাঁচানোর জন্যে, তোকে মানুষ করার জন্যে মস্ত লড়াই করেছে সারাজীবন। তুই মাকে দু:খ দিস না রে।‘
টুম্পাও ছিল সেসময়, বলল, ‘জানিস পরী, এদেশেও এবার সিঙ্গল মাদার আইন হয়েছে। সিঙ্গল মাদার কনসেপ্ট এখন ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ স্বীকার করে নিয়েছে। টিভিতে যেদিন খবরটা দেখালো, আমার বাবা পর্যন্ত কেঁদে ফেলেছিল। এই আইনটা যদি আগে থাকত! পিসিমণি মাথা উঁচু করে এখানে থেকেই তোকে মানুষ করতে পারত।’
দিদুন গল্প বলেছে, মহাভারতের কুন্তির গল্প। তিনি কুমারী মা অথচ পঞ্চসতীর অন্যতমা। কর্ণ তাঁর বিবাহ-বহির্ভূত সন্তান, কানীন পুত্র। কুন্তির মতো বহু কুমারী মা সমাজে আছে। তারা লিভ টুগেদার করে, সন্তানের জন্ম দেয়। অনেকেই সিঙ্গল মাদার হয়ে এককভাবে সন্তানের দায়িত্ব বহন করে বেঁচে থাকে। নিষিদ্ধ পল্লিতে কত মা। কত ধর্ষিতা মা তথাকথিত সুশীল সমাজে উপেক্ষিতা হিসেবে চিহ্নিত হয়েও বেঁচে থাকে। সমাজে এসব মায়েরা আজও লড়াই করে বেঁচে আছে, বেঁচে থাকেও। এদেশে প্রাচীনকাল থেকেই নারী নির্যাতন এক সামাজিক ব্যাধি। একদিকে নারীকে দেবীরূপে পুজো করা হচ্ছে, আবার অন্যদিকে তাঁদেরই অসম্মান অপমান নির্যাতনের শিকার করা হচ্ছে।
এমন নয় যে, পারিজাত এগুলো প্রথম শুনছে। দিদুন জানে না, কত রাতের পর রাত জেগে ভার্জিন মাদার নিয়ে পড়াশোনা করেছে ও। আসলে কাউকেই বোঝানো যাবে না, কোথায় কষ্ট। মা-ই বুঝতে পারে নি, অন্য কেউ বুঝবেই বা কি করে?
এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে বরং আনন্দ করা যাক। এই তো তিন চারটে দিন। থার্টি ফার্স্ট টুম্পার শ্বশুরবাড়িতে রিসেপশন পার্টি হয়ে গেলেই মজা শেষ।
তারপর তো আবার কাজ। দিল্লী। কাশ্মীর।
আট.
ফোনটা এল, তখন অনেক রাত। কিছুক্ষণ আগে বিয়েবাড়ি থেকে ফিরেছে। জিনি এখনো ফেরে নি। মোবাইলে একবার ফোন করেছিল দোলন। নট রিচেবল। মাথা ঘামায় নি তেমন। তমাল তো সঙ্গেই আছে।
তড়িঘড়ি হাসপাতালে রওনা দেবার মধ্যেই আরেকটা ফোন। পুলিশের। পার্ক স্ট্রীট থানা থেকে। মাথা কাজ করছে না। দোলনের মুখও ভয়ে শুকিয়ে গেছে। হাসপাতালের ফোনটা আসার পর একবার কেঁদে উঠেছিল, পুলিশের ফোন আসার পর থেকে একবার হেঁচকি তুলে থেমে গেছে। লোকনাথ বাবার ছবি হাতে চুপ করে বসে আছে।
এখান থেকে পার্ক স্ট্রীট অনেকটা দূর। আগে থানায় যাবে নাকি হাসপাতালে! তমাল কোথায়? দোলন একবার তমালকে ফোন করছে না কেন? অনেক বছর হয়ে গেল অজিতই গাড়ি চালাচ্ছে। কলকাতার রাস্তায় গাড়ি চলতে গিয়েই কি এমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সব? দু’বার ভুল দিকে টার্ন নিয়ে লম্বা রাস্তা ফিরতে হয়েছে। এদিকে সব ওয়ান-ওয়ে ড্রাইভ।
ওয়ান-ওয়ে ড্রাইভ। জীবনের মতই। একবার রাস্তা বেছে নিলে সে রাস্তায় চলাই দস্তুর।
হাসপাতালে ঢুকতেই অনেকগুলো ক্যামেরা এগিয়ে এল। এত রাতে এই ছেলেমেয়েগুলো কোথা থেকে এল? দোলন দৌড়ে ঢুকে গেছে ভেতরে। জিনি কোন দিকে আছে? কে যেন ফোন করেছিল? ফোন হাতে নিয়ে উদ্ভ্রান্তের মত কললিস্ট হাতড়াচ্ছে আর্যনীল।
‘আপনারা কখন খবর পেলেন? কে খবর দিল?’
‘মেয়ে কি প্রায়ই ডিস্কে যেত? একা গেছিল, নাকি সঙ্গে কেউ ছিল?’
‘মেয়ে কি নিয়মিত ড্রিঙ্ক করত, নাকি আজই? এত রাত করে বাড়ি ফিরত রোজ? কার সঙ্গে ফিরত?’
‘ছেলেগুলোকে চেনেন? নাকি মেয়ে প্রায়ই অচেনা ছেলেদের সঙ্গে…’
‘এই মর্মান্তিক ঘটনা, আপনার প্রতিক্রিয়া কি?’
নিজেই বলছে মর্মান্তিক, আবার জিজ্ঞেস করছে প্রতিক্রিয়া কি! কি প্রতিক্রিয়া হবে একজন বাবার, যার মেয়ে গভীর রাতে নির্জন রাস্তায় অচেতন পড়ে থাকে? আহত, এবং নির্যাতিত? ব্রুটালি রেপড?
নয়.
টুম্পার শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরোতেই বেশ রাত হয়েছিল। সাতটা না আটটা গাড়ি একসঙ্গেই বেরিয়েছিল। মামুর বন্ধু রঞ্জন আঙ্কল, মামীর বন্ধু চন্দ্রামাসিরা, মিমির বড়মামা ছোটমামা, আরো কেউ কেউ এগিয়ে গেল। শান্ত বলল, ‘পার্ক স্ট্রীট হয়ে যাবে দিদিভাই? রাতের কলকাতা দেখবে না?’
রিয়া পাপন মৃদুল, মিমির বন্ধুরা সবাই হৈ হৈ করে উঠল, ‘চলো চলো। লেট’স সেলিব্রেট।‘
সেলিব্রেশন মনে ড্রিঙ্ক। এখানে এটা বেশ মজার ব্যাপার। বড় হয়ে গেছি বোঝানোর এই একটাই রাস্তা। হেসে মাথা নেড়েছে পারিজাত। রাতের কলকাতা দেখে নেওয়া যাক।
ফেরার পথে চোখে পড়েছিল গাড়িটা। স্পীড বেশ, কিন্তু মাঝে মাঝেই এঁকেবেঁকে চলছে। পাপন, নাকি টুবাই বলে উঠেছিল, ‘সাবধান শান্ত, সামনের গাড়িটা দেখে চালাস।‘
‘আরে, আমি অনেক পেছনে আছি। ওকে এগিয়ে যেতে দিচ্ছি।‘
সাংবাদিক সত্তা জেগে উঠেছিল পারিজাতের, সামথিং সিরিয়াস। ‘গাড়িটা একটু কাছে নেওয়া যাবে?’
‘ওকে দিদিভাই, আমি এগোচ্ছি, বাট অ্যাম শিওর দ্য ড্রাইভার ইজ ড্রাঙ্ক।’ শান্ত স্পীড তুলেছিল।
তখনই ঘটল ব্যাপারটা।
চলন্ত গাড়ি থেকে ছিটকে পড়ল একটা মেয়ে। পড়ল, নাকি ফেলে দিল কেউ?
‘থামিস না শান্ত। স্পীডে বেরিয়ে যা।‘ সবাই বলছিল। ঝামেলায় জড়াতে চায় নি কেউ। ‘পুলিশের গাড়ি এসে যাবে এখুনি, মেয়েটাকে রেসকিউ করবে পুলিশ। আমরা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাই চল।‘
পারিজাত জোর করে গাড়ি থামিযেছে। ছেলেরা কেউ চাইছিল না। শুধু রিয়া বলেছিল, ‘রাস্তায় এখন অনেক সিসিটিভি ক্যামেরা থাকে। আমরা চলে গেলেও আমাদের গাড়ি আইডেন্টিফাই করা যাবে। পরীদি ঠিক বলছে। উই শুড হেল্প হার।‘
মেয়েটার জ্ঞান ছিল না। শাড়ি ব্লাউজ ছিঁড়ে গেছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে শরীর, রাস্তা। রেপ ভিক্টিম। কেউ কথা বলছিল না আর।
তারপর হাসপাতাল। দুটো নার্সিংহোম ফিরিয়ে দিল। ওদের নাকি জায়গা নেই। এক জায়গায় বলল, আগে পুলিশ আসুক তারপর ট্রিটমেণ্ট। এমন ধমক দিচ্ছিল যেন মেয়েটাকে এনে অন্যায় করেছে। একজন তো শান্তকেই চার্জ করে বসল, ‘সাধু সে নার্সিংহোমে এসেছ এখন? মেয়েটার জ্ঞান ফিরলে তোমাদের কপালে বিপদ, বুঝতে পারছ?’
বাড়ি ফেরার পর মামুও শান্তকে বকাবকি করছিল, ‘পরী নাহয় জানে না, তুই কেন গাড়ি থামালি? জানিস না, পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা? এখন তো আবার মিডিয়া জুটেছে। পরীর সঙ্গে ওদের কথা বলতে দিলি কেন?’
এইরকমই হয় এখানে। কেউ জড়াতে চায় না। এই যে মেয়েটাকে নিয়ে এত খবর, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মেয়েটার ইন্টারভিউ দেখাচ্ছে, টিভির চ্যানেলে চ্যানেলে আলোচনা, রাজনীতির লোকেরা পর্যন্ত ঢুকে পড়েছে, পারিজাতের দিল্লী যাওয়াও পিছিয়ে গেল পুলিশের নির্দেশে… ছেলেগুলোকে কিন্তু ধরা যায় নি। একটা ছেলে তো মেয়েটার হবু স্বামী ছিল, ব্রাইট কেরিয়ার নাকি। আরেকটা নিউ জার্সি থেকে বেড়াতে এসেছিল, পুলিশ সেখানেও পৌঁছে গেছিল, কিন্তু ধরতে পারে নি। গাড়িটা ধরা পড়েছে, গাড়ির সূত্রে একজন ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট বাবার ছেলেকে থানায় ডেকেছিল পুলিশ। তারপর থেকে সে ছেলেটারও হদিশ নেই।
কষ্টে কেমন একরকম হেসেছিল দিদুন, ‘কিছু হবে না রে। এদেশে এই নিয়ম। দু’দিন সহানুভূতি পাবে মেয়েটা, তারপর সবাই ওর দিকেই আঙুল তুলবে। কেন রাতে ডিস্কে গেছিল, কেন ছেলেদের সঙ্গে গাড়িতে উঠেছিল, কেন নেশা করেছিল.. কত রাজনীতি শুরু হয়ে গেছে দেখছিস না?’
মিমির বন্ধুরা, মিমির শ্বশুরবাড়ি, মামুর বন্ধুরা, মামীর বাপের বাড়ির লোকেরা অবশ্য পারিজাতকে প্রশংসাই করেছে। শুধু ছন্দামামী বলেছে, ‘কার মেয়ে দেখতে হবে তো? অপুরও তো সর্বদা এমন নাটক করার অভ্যেস।‘
তপনমামা অবশ্য সবার সামনেই বকেছিল তখন, ‘অপুকে এর মধ্যে টানছ কেন? পরী নিজে একজন জার্নালিস্ট, ভুলে যেও না।‘
দশ.
বাড়ি এসেছে জিনি, বারো দিন হয়ে গেল। এখনো মিডিয়ার আসা বন্ধ হয় নি। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পুরোনো ইন্টারভিউ দেখাচ্ছে। পুলিশ ইনভেস্টিগেশন চলছে, ঘটনার পুনর্নির্মাণ বলে একটা প্রসেস হল আজ। বাবাকে সঙ্গে যেতে দেয় নি জিনি, দোলন গেছিল।
ঘুরে এসে পাশে বসেছিল চুপ করে, রিমোট হাতে চ্যানেলে চ্যানেলে আলতো চোখ মেলে বসেছিল আর্যনীলও। হঠাত্ সোজা হয়ে বসল, ‘এ মেয়েটা কে?’
ক্লান্ত চোখ মেলে চাইল দোলন, ‘ওই তো পারিজাত। আমাদের জিনিকে বাঁচিয়েছে। ও না থাকলে… শোনো, ওকে আমাদের বাড়িতে আসতে বলেছি। কাল আসবে। এ ক’দিন কথাটা মাথায় ছিল না। মেয়েটাকে আমাদের কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত ছিল আগেই। মনেই ছিল না। আজ ওকেও ডেকেছিল ওখানে। তখনই…’
দোলনের কথাগুলো ভেসে বেড়াচ্ছিল ঘরের হাওয়ায়, আর্যনীল স্পষ্ট দেখল উইন্ডচাইমে জলতরঙ্গ শব্দ তুলে সাদা পর্দা দুলিয়ে কথাগুলো ভেসে গেল জানলা দিয়ে। আলগোছে। সেই মেয়েটা।
কাল আসবে এ বাড়িতে? পারিজাত?
এল। একটা লম্বা সাদা মোমবাতি যেন। সব অন্ধকার দূর হয়ে গেল। নাকি সাদা উজ্জ্বল একটা ফুল। স্বর্গের বাগানে ফোটে এমন ফুল।
অনেকদিন পর নিজের ঘর ছেড়ে এসে বাইরের ঘরে বসল জিনিও। ভাষাহীন চোখ, হারিয়ে ফেলা দৃষ্টি। ম্লান মুখ। একটা রাতের একটা ঘটনা বদলে দিয়েছে ওর জীবন। বিশ্বাস হারানোর যন্ত্রণা, নারীত্বের অপমান, সমাজে পদে পদে কৌতূহলী রসালো প্রশ্ন। সত্তা জুড়ে বিপন্নতা। উজ্জ্বলতা হারিয়ে গেছে।
তবে পারিজাতের উজ্জ্বলতার সঙ্গে কি আর জিনিয়া ফুলের তুলনা চলে?
পারিজাতকে দেখে একটু হাসল জিনি। অনেকদিন পরে।
‘আমি কাল চলে যাচ্ছি জিনিয়া। তুমি কিন্তু ভয় পাবে না একদম। আই’ল বি ইন টাচ।‘
‘তুমি, চলে যাবে?’ জিনি শক্ত করে হাত ধরল মেয়েটার।
‘যেতে তো হবেই। কাজ আছে না? তাছাড়া এখানে তো আমার জায়গা নেই, আমাকে তো দেশে ফিরতে হবে।’ হাসল মেয়েটা। একটা ছোট্ট গজদাঁত।
হাসিটা যেন কার মত? কার এমন গজদাঁত ছিল যেন? হাসলে একমুঠো শিউলি ঝরে পড়ত?
‘দেশে ফিরবে? কোথায় থাকো তুমি?’ কথা খুঁজে পেয়েছে আর্যনীল।
‘তুমি জানো তো। টিভিতে এতবার দেখিয়েছে ওর কথা, কাগজেও বেরিয়েছে’, দোলন এসে পাশে বসল মেয়েটার, আলতো হাত রাখল মেয়েটার হাতে, ‘ও জুরিখে থাকে। জার্নালিস্ট। দেশে এসেছিল, মামার মেয়ের বিয়ে উপলক্ষ্যে।‘
জুরিখ! তবে কি…
বাবা বলেছিল, ‘ঈশ্বরের আদালতে সব বিচার হয়। মেয়েটার জন্যে কিছু করতে পারলাম না, এই অপরাধবোধ থেকে আমার মুক্তি নেই।‘
কোন অপরাধবোধ তো ছিল না। ঈশ্বর, বিচার, আদালত.. হেসে উড়িয়ে দেবার ক্ষমতা ছিল। আজ তাহলে কেন মনে হয়, বাবার কথাগুলো সত্যি হল? কেন মনে হয়, শাস্তিগ্রহণ পালা চলছে? বাবার অপরাধের শাস্তি পাচ্ছে জিনি?
জোর করে মাথা তুলল আর্যনীল, মনের এই ভাবটা কাটাতেই হবে, ‘বর্ন অ্যান্ড ব্রট আপ ইন জুরিখ? তুমি তো বাঙালি, কলকাতায় মামার বাড়ি এসেছিলে, মানে মাও বাঙালি। বাবা? বাঙালি? তিনিও কি জার্নালিস্ট?’
এগারো.
জিনিয়ার বাবার প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্যে মুখ ফিরিয়েছিল পারিজাত। ছবিটা চোখে পড়ে গেল।
সাদা-কালো ছবি। ইউনিভার্সিটির একদল ছাত্রছাত্রী। মাযের কাছেও এমন একটা ছবি আছে না? স্পষ্ট নাম পড়া যাচ্ছে। ওহ গড, অবশেষে একটা খবর পাওয়া যেতে পারে। একটা সূত্র। মাযের ইউনিভার্সিটি, একই জায়গায় পড়াশোনা যখন। হতে পারে আলাদা ব্যাচ। তবু চেনা তো থাকেই অনেক সময়। আহ। এবার কলকাতা এসে সত্যিই কাজ হল? সেই বিশেষ মানুষটাকে চিনতেন ইনি?
উত্তেজনাটা বেরোতে দিল না অবশ্য, ছবিটার দিকেই ইশারা করল, ‘ওই ছবিটা?’
জিনিয়ার মা হাসলেন, ‘ওটা আমাদের ইউনিভার্সিটির ছবি। এই এদিকের দেয়ালে দ্যাখো, এটা আমার ব্যাচ। ওটা জিনির বাবার ব্যাচের ছবি।‘
এদিকের দেয়ালে? এই ছবিটা যে বড্ড চেনা পারিজাতের। এই ভদ্রমহিলা মাযের ক্লাসমেট? একই ব্যাচ? আহ ভগবান!
অজান্তেই সোজা হয়ে বসেছে পারিজাত, ‘হোয়াট আ সারপ্রাইজ। এই ছবিটা…’
জিনির বাবার দিকে চোখ পড়ে গেল। কৌতূহলে চেয়ে আছেন এদিকেই। আনমনে একটা হাত মাথার ওপর, কপালের চুল হাতের টানে উঠে গেছে মাথার দিকে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে একটা লাল জড়ুল। ডানদিকের কপালে, চুলের ঠিক নিচে।
ঘরের চারদিকে চোখ পড়ল একবার। ডোকরার মস্ত ময়ূর, পোড়ামাটির ঘোড়া, রঙিন কাচের ফ্লাওয়ার ভাস, জয়পুরী মিনার কাজ করা উইন্ডচাইম, পেতলের বুদ্ধ, ক্রিস্টালের গণেশ, টেরাকোটার দুর্গা। পরিপাটি জীবন। সুন্দরী স্ত্রী, মিষ্টি মেয়ে, স্বচ্ছল স্বচ্ছন্দ জীবন।
মুখ লুকিয়ে, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পালিয়ে যাওয়া সহপাঠিনীর কোনো স্মৃতিই নেই। আর সেই অজাত ভ্রূণ, যাকে রক্ষা করার তাগিদে মহাপ্লাবনের বিপদসঙ্কুল যাত্রা অসহায় মাযের, সেই প্রাণের অস্তিত্বই নেই। প্রার্থনা না-ই থাক, স্বীকৃতিটুকুও থাকবে না?
আহা মা।
‘হ্যাঁ, কি বলছিলে তুমি? ওই ছবিটা.. কি? তোমার চেনা কেউ আছেন ছবিতে? তোমার বাবা?’
কপালের ওপর থেকে চুল তুলে টেনে বেঁধে নিল পারিজাত। একমাথা কোঁকড়া চুল। জিনিয়ারই মত। জিনিয়ার বাবার মতও। টেনে টেনে তুলে ক্লাচার লাগাল। চুল দিয়ে কপাল ঢেকে রাখার কোনো দরকার নেই আজ।
তারপর স্থির চোখে চাইল, চোখে চোখ রেখে স্পষ্ট উচ্চারণে বলল, ‘আমি পারিজাত। আমার কোনো বাবা নেই। আমার মা একজন ভার্জিন মাদার।‘
অবাক হয়ে চেয়ে আছে জিনিয়া। এক রাতের অন্ধকার এলোমেলো করে দিয়েছে জীবন, আর এ মেয়েটার জন্মই সেই এলোমেলো অন্ধকার নিয়ে? তবুও এমন সটান ঋজু সতেজ? এই মেয়েটা পেরেছে, জিনি পারবে না? ভাগ্যিস এল পারিজাত। ভালোবেসে পারিজাতের হাত জড়িয়ে নিল জিনিয়া।
হাতে অভিব্যক্তি নেই। কোনো সাড়া নেই। পারিজাত বসে আছে সটান, সোজা শিরদাঁড়া। উল্টোদিকের সোফায় বসা বাবির দিকে চেয়ে। বাবিও অপলক চেয়ে আছে পারিজাতের দিকে। অদ্ভুত বিপর্যস্ত লাগছে মাকেও। বিস্মিত দৃষ্টি। বিস্মিত, নাকি বিপন্ন। বড্ড অচেনা লাগছে বাবা-মা দুজনকেই। কি দেখছে এমন নিস্পন্দ হয়ে বসে? কি হল? কি হয়েছে?
বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে আর্যনীল। পারিজাতের ডান কপালে চুল ঘেঁষে মস্ত লাল জড়ুল। জন্মমূহুর্তে নিজের হাতে স্বীকৃতি দিয়েছেন বিধাতা। পিতৃপরিচয় খুঁজে বেড়ানোর সত্যিই দরকার নেই আর।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..