পার্থিব

রোমেনা লেইস
ছোটগল্প
Bengali
পার্থিব

জন আর মেরী খুব সুখী দম্পতি। ওরা মিসিসিপিতে একটা কনডো কিনেছে বছর দুই হলো। চমৎকার করে সাজিয়েছে। ছুটির দিনগুলিতে শপিংয়ে গেলে ঘর সাজানোর কত কী কিনে। জন কাজ করে হসপিটালের ল্যাব সেকশনে। জেনেটিক  ইঞ্জিনিয়ারিং-এ গ্রাজুয়েশন করেই জবটা পেয়ে যায়। মাস্টার্স আর করা হয় নি। মেরী পরে ওর মেজর পাল্টে হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট পড়েছে।

সে ম্যানেজমেন্ট-এ কাজ করে। দুজনের দুটো গাড়ি। টয়োটা আর হোন্ডা দুজনেই খুব বন্ধু প্রিয়। বন্ধুদের সাথে প্রায়ই ক্লাবে বারে যায়। কখনো লং-ড্রাইভে যায়। কখনো বাবা মাকে দেখতে গ্রীনভিলিতে যায়। আবার আরাকানসাসেও যায়। জনের বোন জেনেলিয়া ডাক্তার। কিন্তু বিয়ে করেনি। সে বাবা মায়ের সাথেই থাকে। জেনেলিয়া ভাই অন্তপ্রাণ। ভাই আর ভাইএর বৌ আসলে কাজ থেকে ছুটি নেয়। সমুদ্র তীরবর্তী কোন দ্বীপে নইলে পাহাড়ে বেড়াতে যায়। জেন খেয়াল করে ওর ভাই আর ভাই এর বৌ পাহাড়ের চেয়ে সমুদ্র বেশী ভালবাসে। জেন পাহাড় ভালবাসলেও ওদের নিয়ে সী বিচ, ফিশিং,আইস স্ক্যাটিং,সামার ক্যাম্প এগুলোতেই যায় বেশী। পাহাড়ে উঠতে থাকলে মেরী ড্রাইভত করেই না; বরং চোখ বন্ধ করে ফেলে গিরিখাত দেখলে।

জন সবসময় বলে- আই ম নট কম্ফরটেবল টু রাইড এন্ড ড্রাইভ অন আ মাউন্টেইন।

প্রতিবার ওরা সামারে কোথাও যায়। এবছর ওদের ম্যারেজ ডে উপলক্ষে জেন ঘোষনা দেয় ও সবাইকে ক্রুজ এ নিয়ে যাবে। ওরা কিউবা যাবে।

– আই মেড রিজার্ভেশন ফর সেভেন পিওপল। ওকে?

– সো মিঃ এন্ড মিসেস টনি, মিঃ এন্ড  মিসেস রিচার্ড, মিঃ এন্ড মিসেস আব্রাহাম  এন্ড মিস আব্রাহাম।

-ইউ আর সো সুইট মাই সিস্। ইটস এমেজিং। ইফ ইউ আর ইনফ্রন্ট অব মী আই উইল হাগ ইউ টাইটলি।

-অলরাইট ব্রো। অল দ্যা বেস্ট।

জেন এর পরিকল্পনা অনুযায়ী জুলাই মাসের পাঁচ তারিখে চমৎকার সকালে ওরা ফ্লোরিডা থেকে কিউবার উদ্দেশে যাত্রা করলো।

নীল জলরাশি আর নীল অবারিত আকাশ সাথে সকল আপনজন খুব আনন্দিত সবাই।

রাতের ডিনারের পর প্রচুর ড্রিংক করে সবাই। টনি বলে

— আই ওয়ান্না সী জন জুনিয়র সুন।

-মী টু। বলে ওঠে রুহী।

— মী টু বলে ওঠে রিচার্ড ও হাতের গ্লাসে টোকা মেরে। জন আর মেরী লজ্জা পেয়ে উঠে যায়। ওরা ড্যান্স করতে চলে যায় ড্যান্স ফ্লোরে।

ড্যান্স  ফ্লোরে মিউজিকের তালে তালে পা ফেলতে ফেলতে কোমর জড়িয়ে  মেরীর কানে ফিস ফিস করে জন

– আই লাভ দ্যা ওয়ে দে ওয়ান্ট আ বেবী।

— ইয়া। মি টু।

-ফ্রম টুডে উই ক্যান স্টার্ট ইট।

লেটস গো টু ডু আওয়ার প্রজেক্ট।

–নট নাও। বলে মারিয়া।

ডেকের খোলা হাওয়ায় ওরা দাঁড়িয়ে সমুদ্রের রাতের সৌন্দর্য দেখে। ছাব্বিশ তলা জাহাজের ষোলতলায় উইন্ডোভিউ রুম ওদের। ডোর লক খুলতেই ‘হ্যাপী এনিভার্সারি ‘ বলে চার পাঁচটা ভূত এগিয়ে এলো। রুমের নীলচে সাদা আলো মোহনীয় এক আবহ তৈরি করেছে। বিছানায় তিনটা গিফট প্যাক পেলো।

জেনেলিয়াকে ধন্যবাদ জানিয়ে ওরা সবাই ফিরে গেলো যার যার কর্মস্থলে।

পাঁচবছর হয়ে গেলো। ওদের কোন বেবী হওয়ার কোন সম্ভাবনাও দেখা গেলো না। জন জেনেলিয়াকে কল দিয়ে বললো

-হোয়াট ডু ইউ থিংক জেন? ডু আই নীড টু কনসাল্ট উইথ দা জিওয়াইএন ডক অর ফার্টিলিটি?

গো টু দ্যা জি ওয়াই এন ফার্স্ট। ডোন্ট ওরী। লেইটার ইউ কুড গো টু দ্যা  ফার্টিলিটি।

-ওকে। লাভ ইউ।

— লাভ ইউ টু, বাই।

এপয়েনমেন্ট করে ওরা ডাক্তারের কাছে কয়েকদফা গেল। সবকিছুই ঠিক আছে কিন্তু কনসিভ করে না। মিসিসিপির যে ফার্টিলিটি ক্লিনিকে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন দম্পতি, সেই ক্লিনিকের ডাক্তার জানিয়েছেন, দু’জনের ডিএনএ-র মধ্যে অদ্ভুত মিল দেখে ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তিনিই বিষয়টি চিকিৎসকের নজরে আনেন। শিকড়ে পৌঁছে যে তথ্য উঠে এসেছে, তাতে চিকিৎসক নিজে তো বটেই, ওই দম্পতিও আশ্চর্য হয়ে গিয়েছেন।

…হিমাচল প্রদেশের খাড়া পাহাড়ি পথ বেয়ে বাসটি উপরে উঠে যাচ্ছে। বাসের যাত্রীরা সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন। ৪৬ জন যাত্রী নিয়ে বাসটি উত্তরাখণ্ড থেকে শিমলার তিউনিতে যাচ্ছিল। পাহাড়ি রাস্তায় চোপাল এলাকায় পৌঁছালে বাসের চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। একপর্যায়ে বাসটি পাহাড়ি রাস্তা থেকে গড়িয়ে ২৫০ মিটার নিচে টোনস নদীতে পড়ে যায়। কাহিনীর শুরু এখানে। বাসের প্রায় সকল যাত্রী নিহত হলেও অলৌকিক ভাবে বেঁচে যায় দুটি বাচ্চা। বাচ্চাদুটির বয়স আড়াই বা তিন বছর। তারা যমজ ভাইবোন। তাদের বাবামার সাথে বাসে শিমলা যাচ্ছিলো।

টেলিভিশনের খবরে পরপর কয়েকদিন দেখানো হলো। সব পত্রিকায় ছবি দেয়া হলো কিন্তু বাচ্চাদের কোন অভিভাবক না পেয়ে অবশেষে বাচ্চাদের শিমলার একটি চাইল্ড হোমে রাখা হলো। আমেরিকান অর্থসাহায্যে পরিচালিত এই চাইল্ড হোমটিতে বাচ্চা দুটো বড় হচ্ছিলো। আমেরিকার আরাকানসাসের বার্মিহাম থেকে দত্তক নিতে আগ্রহী হন এক দম্পতি। টনি আব্রাহাম ও রুহী আব্রাহামের একমাত্র মেয়ে জেনেলিয়া দশবছর বয়সী। আরাকানসাসের বার্মিংহামে বাস করেন তারা। প্রচুর ল্যান্ড আছে তাদের। চাষ করেন। তাদের ঘোড়াও আছে। আর সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় মেয়ের ইচ্ছায় তারা ঐ চাইল্ডহোমের ছেলে বাচ্চাটিকে নিয়ে আসেন,নাম রাখলেন জনাথন আব্রাহাম। ডাক নাম জন। তখন ওর বয়স তিনবছর। জন জেনেলিয়া আব্রাহামের একমাত্র ভাই।

মিসিসিপির গ্রীনভিলেতে বাস করেন এক নিঃসন্তান দম্পতি। রিচার্ড শীলার আর ন্যান্সী শীলার। এর বছর খানেক পরে মিসিসিপির এই নিঃসন্তান দম্পতি শিমলার চাইল্ডহোম থেকে মেয়েটিকে নিয়ে আসেন। তাদের নাম অনুযায়ী মারিয়া শীলার হয়ে যায় মেয়েটির নাম। ডাক নাম মেরী। দশবছরের বিবাহিত জীবনে কোন সন্তান না থাকায় তাদের মধ্যে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয় তা থেকে মুক্তি পেতে তারা সাইক্রিয়াটিস্টের শরণাপন্ন হন। সাইক্রিয়াটিস্ট তাদেরকে কয়েকটি চাইল্ডহোমের ওয়েবসাইট দিয়ে দেন। সেদিন রাতে ল্যাপটপে ওয়েবসাইটগুলোতে বাচ্চাদের ছবিসহ তথ্য চেক করতে করতে বাচ্চা দত্তক নেয়ার পরামর্শ দেন।

ন্যান্সী চারবছর বয়সী মেয়েটিকে পছন্দ করে। রিচার্ড ও এককথায় রাজী হয়ে যায়। তখন ইমেইল করে চাইল্ডহোমের ইমেইল এড্রেসে। ভীষণ এক্সাইটেড থাকে দুজনেই। পরদিনই রিপ্লাই পেয়ে ওরা যাবতীয় কাগজপত্রসহ এম্বেসিতে যোগাযোগ করলো। ইন্ডিয়ায় যাওয়ার টিকিট বুকিং করলো। শিমলা এয়ারপোর্টে নেমে ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়েই ছুটে গেলো চাইল্ড হোমে। সিস্টার সাদা ফ্রক আর মেরুন সোয়েটার পরা মেয়েটিকে ওদের সামনে আনতেই ন্যান্সী আবেগে ছুটে গিয়ে কোলে তুলে নিলো। ওর জন্য আনা পুতুল চকলেট ওর হাতে দিলো। ওরা ওকে মাই বেবী বলে ডাকছিলো। এডাপ্টেশন রুলস এন্ড রেগুলেশন মেনে নিয়ে সব কাগজপত্র সাইন করলো। সব সাইন করা হয়ে গেলে ওরা মারিয়াকে নিয়ে গ্রীনভিলিতে। মারিয়া জানলো বিদেশ থেকে ওর বাবা মা ফিরে এসেছে ওকে নিতে। মারিয়ার বয়স তখন চার।

জনাথন ওহাইওর সিনসিনাটি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলো জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এ। ডরমে থাকবে। ডরমে যে রুম পেলো সেখানে চারজন থাকবে। ইউএসের বিভিন্ন স্টেট থেকে এসেছে সবাই। ক্লাসে গিয়ে প্রথম পরিচয় হলো নার্গিসা আমিরোভা নামের এক আলবেনিয়ান মেয়ের সাথে। ছিপছিপে গড়নের সদা হাস্যময়ী। ওদের বেশ বন্ধুত্ব হয়। নার্গিসা যে ডরমে থাকে সেটা পাশেই।

সেদিন সকালে ঘুম ভেঙে দেখে বাইরে তুমুল বৃষ্টি। বৃষ্টির মধ্যে ছাতা নিয়ে ক্লাসে যাচ্ছিলো জন। লাল রেইনকোট পড়ে একটা মেয়ে যাচ্ছিলো। জনের ইচ্ছে হলো ছাতাটা উড়িয়ে দেয়। আর লাল রেইনকোট পরা মেয়েটিকে জাপটে ধরে

-হাই গুডমর্নিং।

— হাই গুডমর্নিং ।

-আ এম জনাথন আব্রাহাম। জন। ইউ ক্যান কল মী জন।

–নাইস টু মিট ইউ। আই’ম মারিয়া। ইউ ক্যান কল মি মেরী

হ্যান্ডশেক করতেই কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো। কেন যেন মনে হলো ওরা অনেকদিনের চেনা।

–আই ম ফ্রম আরাকানসাস। এন ইউ?

– আই ম ফ্রম মিসিসিপি।

টুকটাক কথা বলতে বলতে দেখলো ওরা দুজনেই একই মেজর নিয়েছে। তবে ভিন্ন প্রফেসারের আন্ডারে। ক্লাসের শেষে ওরা দেখা করবে লাইব্রেরি হলে এই বলে দুজনে দুজনের ক্লাসে চলে গেল।

-সি ইউ সুন।

— বাই নাও। সী ইউ সুন দেন।

দুজনেই ক্লাসের শেষে দেখা হবে এজন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে ক্লাসে গেল। দেখতে দেখতে বছর চলে গেল। ওদের ঘনিষ্ঠতা বাড়লো। জন এক বিকেলে বলল

-ক্যান উই গো টু ডিনার টু নাইট?

–অফ কোর্স। হোয়াই নট

-ওহ। ইউ আর গ্রেট!

সেই রাতে ডিনারের পর ওরা ভদকা আর পাইনএপল জুস মিশিয়ে ড্রিংক করলো। তারপর হলভর্তি ছেলেমেয়ের মাঝেই ব্লু লংড্রেস পরা মেরিকে প্রপোজ করলো জন।

-আই লাভ ইউ। ডু ইউ লাভ মী? হাটু গেড়ে বসলো মারিয়া’র সামনে এবং মারিয়ার দিকে চেয়ে রইলো। মারিয়াও বললো

-আই লাভ ইউ টু।

হাতে হাত কোমর পেঁচিয়ে ধরে মারিয়াকে গাড়িতে উঠালো। গাড়ি স্টার্ট করার আগেই দীর্ঘ চুমুতে নিমগ্ন হলো। পেছনের গাড়ির হর্ন শুনে তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে বসলো। তারা দুজনেই জোরে হেসে উঠলো…

রোমেনা লেইস। জন্ম বাংলাদেশে, বর্তমান নিবাস নিউইয়র্কের ব্রুকলিন। প্রকাশিত বই: 'মেঘের দেশে মেঘবালিকা', 'ভালবাসার রঙ নীল', 'মিতুলের বন্ধু বটগাছের ভূত ও ঘুঙুর' 'চন্দনী'।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ