পাসপোর্ট

অপূর্ব সাহা
গল্প
Bengali
পাসপোর্ট

একদম ছোটবেলায় শিশুদের মধ্যে সীমা সম্পর্কিত এত জটিলতা থাকেনা।মন থাকে মুক্ত  যা প্রকৃতপক্ষে আবস্ট্রাক্ট চিন্তাধারার সহায়ক।তারা যা খালি চোখে দেখে তাই ই মোমরং অথবা আধো আধো কথায় বোঝানোর চেষ্টা করে।কিন্তু মানুষের একটি সহজাত বৈশিষ্ট্য হল, সবকিছুকে প্যাটার্নে ফেলে নিয়মের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা,সব ঘটনাকে এক সূত্রে গেঁথে ফেলা।ফলে,তাদের মুক্তচিন্তা একরকম পর্দার আড়ালে চলে যায়,জীবনে জটিলতা বাড়ে ও পরবর্তীতে যা দূর করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়।

অনেকসময় চিন্তাক্ষেত্রে এই সীমাবন্ধনের কাজটা আমাদের বড়োরাই করে থাকেন।এবং পরবর্তীতে তারাই এই সীমালঙ্ঘনের উপায় আমাদের বলে একরকম অদ্ভুত আনন্দ পেয়ে থাকেন।

শিল্পী: রিয়া দাস

যেমন ধরুন অজয়ের কথা।ছোটবেলায় যখন বাবা-মায়ের সাথে বাস এ করে মামাবাড়ি যেত তখন নানারকম প্রশ্ন করতে সে তার বাবা মাকে।“এটা কোন জায়গা?”,”এটার নাম এরকম কেন?”,”এখানে কি হয়?” ইত্যাদি ইত্যাদি।মামাবাড়ি যাওয়ার পথে বাবাকে সে প্রায়ই জিজ্ঞেস করতো,”আচ্ছা বাবা,আমরা কোন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি এটা?”;বাবা বলতো,”যশোর রোড।”

-“এটা কোথায় গেছে?”

-“যশোরে।“

-“সেটা কোথায়?”

-“বাংলাদেশে।“

-“কি হয় সেখানে?”

“যেসব দুস্টু ছেলেরা বেশি বকবক করে তাদেরকে ওখানে নিয়ে যাওয়া হয়।তুমি যদি এরকমই বকবক করো তাহলে তোমাকেও ওখানে ধরে নিয়ে যাওয়া হবে”-মা একটু বিরক্ত হয়েই বললো অজয়কে।অজয় চুপ করে গেল।

এই হল চিন্তাজগতে প্রথম কাঁটাতারের সীমা।এই কথা শোনার পর স্বাভাবিকভাবেই অজয়ের মনে হলো,বাংলাদেশ বুঝি তাহলে কোনো ভয়ঙ্কর জায়গা।সেখানে হয়তো রাক্ষস,খোকসের বাস।বাপরে!পরে নানাসময় অজয় যখনই দুস্টুমি করেছে,মা ধমক দিয়ে বলেছে,”বেশি দুস্টুমি করলে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেবো।“আর অজয় ও চুপ করে গেছে প্রতিবার।

সময় এগোয় আস্তে আস্তে। শিশুও বড় হয়।জীবনের জটিলতা ক্রমশঃ দ্বিধা দ্বন্দ্বের রূপ নেয়।অজয়ের জীবনেও এরকমই ঘটলো।

অজয়ের বয়স তখন সাত কি আট।দাদুর সাথে তখন সে প্রত্যেকদিন বিকেলে মাঠে ক্রিকেট খেলতে যেত।অজয় মাঠের বাকি সব ছেলেপেলে ঘেঁটু, ঘ্যানা, টিঙ্কু,ছোটে এদের সাথে ক্রিকেট খেলতো।দাদু হতো আম্পায়ার।নাতির ক্রিকেটে অনুরাগ দেখে দাদু অজয়কে কয়েকদিন আগে বেশ ভালো তিনটে উইকেট কিনে দিয়েছে,সাথে বেলও।

অজয় খুব ভালো বল করতে পারে।যেই ওভারে বল করতে আসে সেই ওভারেই একটা করে উইকেট নেয়।দাদু তো নাতির বোলিং দেখে বিরাট খুশি।একদিন মাঠ থেকে ফিরতে ফিরতে দাদু নাতিকে বলছে,”দাদা,আমিও তোর মত বোলার ছিলাম ছোটবেলায়।একবার ছয় বলে ছটা উইকেট নিয়েছিলাম।“

-“কোথায় খেলতে তুমি?”

-“যশোরে।“

-“বাংলাদেশে?”

-“হ্যাঁ রে দাদা।“

-“ওখানে কেউ ক্রিকেট খেলে নাকি?”

 আমি যে সময়ের কথা বলছি সেই সময় বাংলাদেশ সবেমাত্র আন্তর্জাতিক খেলা শুরু করেছে,ফলে অনেকে জানতই না যে বাংলাদেশ ক্রিকেট খেলে।

নাতির কথা শুনে দাদু বলে,”বলিস কি রে দাদা!,আমরা কত ক্রিকেট খেলতাম ছোটবেলায়।বলতে গেলে ছুটির দিনে সারাদিন পরেই থাকতাম মাঠে।তখন এরকম এখনকার মত উইকেট,ব্যাট ছিল না।বাড়িতে যখন বাঁশের বেড়ার কাজ হতো তখন বলতাম যে কয়েকটা বাঁশ কেটে নীচের দিকটা একটু ছুঁচলো করে দিও,যাতে মাটিতে পুততে পারি।জ্বালানির জন্য যে পাটকাঠি আনা হতো তারই কয়েকটুকরো দিয়ে হয়ে যেত বেল।আর ব্যাট?মোটামুটি একটূ মোটাসোটা সোজামত কাঠ পেলে সোজা বাড়িতে নিয়ে আসতাম।বাবাকে বলতাম সাইজ করে কেটে দিতে।ব্যাস ব্যাট হয়ে গেল।আর কাঁচা পেয়ারা ছিল আমাদের বল।সত্যি সেসবও কি দিন ছিল দাদা।“

-“বাবা”,বলে একটু থামলো অজয়।তারপর আবার জিজ্ঞেস করলো,”আচ্ছা সেই ছয় বলে ছ টা উইকেটের ঘটনাটা কি দাদু?”

-“ও আচ্ছা,ওটা”,বলে একটু হাসলো দাদু।তারপর বলল,”শোন তাহলে।তখন পাকিস্তান আমল।বাংলাদেশ তখনও হয়নি।আমরা তখন গ্রাম এ থাকি না আর;শহরে এসেছি।যশোর ইস্কুলে পড়ি তখন।স্কুলের ক্রিকেট টিম ছিল অনেক আগে থেকেই,কিন্তু আমি খেলতাম না।আমার খেলা বলতে ওই ছুটির পরে হালদারের মাঠে।তাও ও সবদিন খেলা হতোনা।বাবা ফি হফতায় হাটে যেত ভাস্কর লবণ বেচতে, তাই আমরা সব ভাই বোনেরা মাকে সাহায্য করতাম ভাস্কর লবণ তৈরিতে।তা যাই হোক, একদিন হয়েছে কি আমরা কয়েকজন বন্ধু স্কুলছুটির পর হালদারের মাঠে খেলছি,এমন সময় স্কুলটিমের উইকেটকিপার মাহতিব এসে আমায় বললো,’অশোক,কাল ফাঁকা আছিস?’আমি বললাম,’না!বাবার পরশু হাট আছে।কাল বাড়িতে মাকে তাই সাহায্য করতে হবে।‘

এই শুনে সে প্রায় কাঁদো কাঁদো সুরে বললো,’ভাই,কালকের দিনটা একটু দেখ না ভাই।আমাদের স্পিনার মোস্তফা,ওই যে ঝিকরগাছা না ঐদিকে  কোন দিক থেকে আসে না; ওর পেটখারাপ হয়ে গেছে।কাল আসতে পারবেনা হয়তো এতটা রাস্তা।খুব খারাপ অবস্থা।কাল আবার খুলনা স্কুলের সাথে ম্যাচ আছে।খেলতে আসবে স্কুলের মাঠে।তাগড়াই টিম।ব্যাটিং সাংঘাতিক ওদের।ভাই তুই বাঁচা আমাদের।প্রত্যেকদিন এইখান দিয়ে যাওয়ার যাওয়ার সময় তোর খেলা দেখি।তুই ভালো বল করিস।ভাই কাল দয়া করে আয় একটু।’আমি হাসবো না কাঁদবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না তখন।স্কুলের টিমে খেলা আমার অনেকদিনের স্বপ্ন,আবার যদি বাড়িতে কাজ না করে খেলতে যাই, তাহলে বাবা পিঠের চামড়া তুলে দেবে।দোমনা দোমনা করে শেষ অব্দি মাহতিবের কথায় রাজি হয়ে গেলাম।

পরেরদিন পৌঁছে গেলাম স্কুলের মাঠে। দেখি মাঠে মোটামুটি একশো দেড়শ জন জড়ো হয়েছে।শুধু যশোর আর খুলনা স্কুলের ছাত্ররাই নয়,স্থানীয় লোকজনও কিছু আছে সেখানে।তা যায় হোক,আমরা টসে জিতে ব্যাট করতে নামলাম।ওপেনার মাহতিম আর কাশী বেশ ভালোই টানলো।কিন্তু হঠাৎ মাহতিমের ভুল ডাকে দৌড়তে গিয়ে কাশী টা আউট হয়ে গেল।তারপর মাহতিম মোটামুটি টানলো,কিন্তু অন্য দিকের ব্যাটসম্যান গুলো পরপর আউট হয়ে যেতে লাগল।সবশেষে নামলাম আমি।প্রথম স্কুলের হয়ে খেলতে নামছি।ভয় ভয় লাগছিল।মাহতিম এসে ঘাড়ে হাত রেখে বললো,’ভাই একটু দেখে খেলিস’।আমি ‘আচ্ছা ঠিকাছে’ বলে এগুলাম।আমার সামনে খুলনার সেরা বোলার তখন।সুরেন না বীরেন কি একটা যেন নাম বেশ।তা যাই হোক,বল করতে আসলো ও।প্রথম বলটা বুঝতে না পেরে ছেড়ে দিলাম।দ্বিতীয় বলটা যেই আসলো দিলাম গায়ের জোরে বারি।বল সোজা পৌঁছে গেল ইকবাল চাচার চায়ের দোকানের ছাদে।ব্যাস,নিজের ওপর বিশ্বাস বেড়ে গেল তখন।পরের বল আসতে না আসতেই দিলাম ব্যাট ঘুরিয়ে।একটু পরেই দেখলাম আম্পায়ার আঙ্গুল তুলে দাঁড়িয়ে আছেন।পিছনে ফিরে দেখি মাঝের উইকেট উড়ে গেছে।অগত্যা আমাদের ইনিংস শেষ করতে হলো।এরপর নামলো খুলনা ব্যাটিং করতে।সত্যিই,ওদের সব তাগড়াই ব্যাটসম্যান।আমাদের বোলার রা উদম মার খেতে লাগলো।অবশেষে যখন কোনো বোলার দিয়েই হল না,তখন ক্যাপ্টেন এসে আমায় বল ধরালো।আমি দুরু দুরু বুকে বল নিয়ে এগিয়ে গেলাম।মাঠে তখনও আছে ওদের ওপেনিং জুটি।আমি প্রথম বল করলাম।আর প্রথম বলেই বল ব্যাট এ লেগে আকাশে উড়লো।আর নামলো গিয়ে কাশীর হাতে।আউট!পুরো মাঠ চেঁচিয়ে উঠলো একসাথে।তারপর দ্বিতীয় বলেও আউট।আবার চিৎকার।তৃতীয় বলে যখন ওদের ক্যাপ্টেন কে আউট করে ফেরত পাঠালাম তখন টিমের সবাই এসে আমায় জড়িয়ে ধরলো।তারপর একে একে চার,পাঁচ আর তারপর শেষ বলে যখন আবার উইকেট নিলাম,টিমের সবাই এসে আমায় কাঁধে তুলে পুরো মাঠ ঘুরলো।সেই দিন আমি কখনো ভুলতে পারবোনা দাদা।“

অজয় এতক্ষন হাঁ করে সব শুনছিলো।এবার জিজ্ঞেস করলো,”তা,শেষ অব্দি কে জিতলো দাদু?”

দাদু হাসতে হাসতে বললো,”কে আবার জিতবে,আমরাই জিতলাম।ওই এক ওভারেই তো ওদের মাজা ভেঙে দিয়েছিলাম।জানিস দাদা,ওই ম্যাচে আমি ম্যান অব দি ম্যাচ হয়েছিলাম।“

-“বাহ।কিন্তু দাদু পরেরদিন তো হাট ছিল।বাড়িতে তোমায় বকেনি।আমার তো পরীক্ষার আগেরদিন খেলতে আসার কথা বললেই মা বকে।“

-“বাড়িতে ঢুকতেই বাবা লাঠি নিয়ে তেড়ে আসে।কিন্ত যখন প্রাইজটা দেখাই তখন বাবা খুব খুশি হন।এমনকি আট আনা ও দেন রাজভোগ কেনার জন্য।“

-“আট আনায় রাজভোগ!”

-“হ্যাঁ দাদা,ওখানে তখন পাওয়া যেত।“

অজয়ের তখন মনে হতে লাগলো,কি অপূর্ব জায়গা বাংলাদেশ।ওখানে রাজভোগ মাত্র আট আনা! অথচ এখানে দেখো,৫ টাকার কমে রাজভোগই নেই।কিন্তু মা তো বলে ওখানে দুস্টু ছেলেরা থাকে।তাহলে কি দুস্টু ছেলেরাও রাজভোগ খায়?

অজয়ের মনে এইভাবে শুরু হয় দ্বিধাদ্বন্দ্ব।এই বাংলাদেশ কেমন জায়গা?দুস্টু না ভালো কে জানে।ওখানে রাজভোগ ও সস্তা,আবার দুস্টু ছেলেও ভর্তি।ভারী অদ্ভুত তো।

সময়ের চাকা এগোয় ধীরে ধীরে।মনন বিকশিত হয়,বুদ্ধির বিকাশ ঘটে।শিকড়ের টানে মানুষের মন চঞ্চল হয়ে ওঠে।মানুষ ফিরতে চায় স্রোতের উল্টোদিকে।

অজয় উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছে সবে।এখন কলকাতার নামী কলেজে অঙ্ক নিয়ে পড়ে।দাদু এখন আর নেই।চার বছর হলো দাদু মারা গেছে।দাদুর খুব শখ ছিল নাতিকে ক্রিকেটার বানানোর।কিন্তু নাতির শখ বিজ্ঞানচর্চার দিকে।ফলে,সে সেই দিকেই ঝুঁকেছে।এখনো মনে পড়ে অজয়ের দাদুর শেষ কথা,”জন্মস্থানটা একবার দেখে আসতে পারলাম না।“আসলে মনে পড়ার কারণও আছে।দাদুর মৃত্যুর পর ঠাম্মা দাদুর টাইটানের ঘড়িটা অজয়কে দিয়েছে।সবজায়গায় অজয় ঐটাই পড়ে যায়।ফলে,সময় দেখার জন্য ঘড়িটার দিকে তাকালেই একবার করে দাদুর কথা মনে পড়ে অজয়ের।

পূর্ববাংলার সাহিত্য সম্মন্ধে খুব একটা ধারণা ছিলনা অজয়ের। ছুটিতে একদিন স্থানীয় পাবলিক লাইব্রেরি তে গিয়ে একটা বই নজর কাড়ে ওর। সবুজ কালো মলাটের মোটা একটা বই।উপরে লেখা,”মিসির আলি”। মোটা বইটার রহস্যময় মলাট আকর্ষণ করে ওকে।বইটা ও বাড়িতে নিয়ে আসে। বাড়িতে এনে আবিষ্কার করে বইটা ওপার বাংলার।ব্যাস,সেই থেকে ওর ওপার বাংলার সাহিত্যের প্রতি কৌতুহল।কৌতূহল এসে থামল সত্তরের দশকে।বাবা মা,দাদু দিদার কাছে সেই সময়ের অনেক ঘটনাই শুনেছে ও আগে,কিন্তু অতটা গুরুত্ব দেয়নি আগে।শোনেনি অতটা সচেতনভাবে। কিন্তু এবার ওর মনে হলো যে না, এবার ঘটনাগুলো সচেতনভাবে শোনা উচিত।অজয় এটুকু ভালোভাবে জানত যে,তার বাবাদের আদি বাড়ি যশোরে, আর মায়েদের আদি বাড়ি বরিশাল এ। বাবার সঙ্গে কথাপ্রসঙ্গে জানতে পারলো যে,৭১ সালের যুদ্ধের সময় দাদু সপরিবারে এপারে চলে আসে।বাবা বলে,”যশোর ক্যান্টনমেন্ট তখন ইন্ডিয়ার দখলে।খানসেনারা সব আত্মসমর্পণ করেছে তখন।বনগাঁ থেকে যশোর প্রায় ৩৫ কিমি।যশোর রোডের ওপর বিভিন্ন জায়গায় বুলেট, সেল, রক্তাক্ত লাশ পড়ে থাকতো। বিভিন্ন জায়গায় পোতা থাকতো ল্যান্ডমাইন।যদিও তখন যশোর ইন্ডিয়ার দখলে,তবুও যশোর রোড দিয়ে সপরিবারে এদিকে আসা নিরাপদ ছিল না।তাই তোর দাদু ঠিক করে,বেনাপোল দিয়ে স্থলপথে নয়,জলপথে এদিকে আসবো আমরা।আমরা সাতক্ষীরা এলাম।সাতক্ষীরা আর ২৪ পরগনার সীমা দিয়ে চলে গেছে ইছামতী।ইছামতী পেরোলেই এপাশে ইন্ডিয়ার ঝাউডাঙ্গা, আঙরাইল।আমারা ঐদিক দিয়েই এদেশে আসলাম।

-পাসপোর্ট ছিল?

-বাবা,তখন জীবন বাঁচাতে হবে।ওসব পাসপোর্ট ফাসপোর্ট তখন মাথায় আসেনা।তখনকার দিনে ওসবের অত চলও ছিল না।আর তাছাড়া যেখানে সীমা আছে সেখানেই তো সীমালঙ্ঘন করতে পাসপোর্ট লাগে।জলের উপর কি সীমা দিবি তুই?

-“হুম”,বলে চুপ করে গেল ও।কিছুক্ষন পর আবার জিজ্ঞেস করলো,”নদী পেরিয়ে এপারে কোথায় উঠেছিলে যেন বললে?”

বাবা অন্যমনস্ক ভাবে বলল,”ঝাউডাঙ্গা।“

তারপর বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে।এরই মধ্যে পুজোর ছুটি চলে এলো। কলকাতার জাকজমকপূর্ণ পুজোর মধ্যে “ঝাউডাঙ্গা”নামটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল।সপ্তমীতে বাড়ি ফিরলো অজয়।ওর বাড়ি বনগাঁয়।কলকাতায় পড়াশুনার জন্য থাকে।ট্রেনে আসতে আসতে কাশফুল দেখে ওর মধ্যে নস্টালজিয়া জেগে উঠলো।মনে হলো এবার গ্রামের পুজো দেখা উচিত।বাবার কাছে বনগাঁর কাছাকাছি ভালো গ্রামের পুজো কি আছে জিজ্ঞেস করাতে বাবা বললো,”কালিতলার দিকে যা,ভালো পুজো দেখতে পাবি।“বাবার কথামত দশমীর দিন এক বন্ধুর সাথে বাসে করে রওনা হলো কালিতলা।যেতে যেতে গুগলে ম্যাপ দেখছিল অজয়।কন্ডাক্টর এসে ভাড়া চাইছিল।বন্ধু ভাড়া দিতে যাবে এমন সময় অজয় বাধা দিল তাকে।কন্ডাক্টর কে জিজ্ঞেস করলো,”বাসটা কি ঝাউডাঙ্গা যাবে?”কন্ডাক্টর ইতিবাচক উত্তর দিল।কন্ডাক্টর কে বলল,”তাহলে দুটো ঝাউডাঙ্গা দিন।“

বন্ধু বললো,”ওদিকে কি ভালো পুজো হয়?”

অজয় মৃদু হেসে বলল,”হ্যাঁ ভাই,সেই পুজো হয়।“

মাঝে মাঝে সত্যিকে উপলব্ধি করতে আপনাকে আমাকে স্রোতের উল্টোদিকে হাটতে হয়।সময়কে আয়নায় প্রতিফলিত করে সেই দিকে হেঁটে আবিষ্কার করতে হয় আমাদের শিকরকে।আর শিকড়ের আবিষ্কারই আমাদের দ্বিধা দ্বন্দ্ব,ভয় ভীতি সব দূর করতে সহায়তা করে।

ইছামতী ঘাটে ঠাকুর বিসর্জন হচ্ছে।এপাশে ঝাউডাঙ্গা বাজারের ঠাকুরটা আর ওপাশে?

ওপাশে তো অন্য দুনিয়া।হ্যাঁ ওপাশ টা তো বাংলাদেশ।কিন্তু কি আশ্চর্য,ওপাশের লোকজনের মাথার চুল তো অন্যরকম না,পোশাক আশাক তো অন্যরকম না,ওদের ঠাকুর তো আমাদের মতোই।ওরাও তো ঠাকুর আমাদের মতোই ইচ্ছামতিতে বিসর্জন দিচ্ছে।এই তো সব পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি এপার থেকে।কিছুই তো পার্থক্য নেই,সব ই তো এক।শুধু একটা নো মান্স ল্যান্ড টেনে দিলেই সেটা সীমা?নদী পার হতেও নৌকা নয়,পাসপোর্ট চাই?আচ্ছা,এই নদীটা কার?পূর্ববাংলা না পশ্চিমবাংলার?কার?

এসব ভাবতে ভাবতে চোখটা বুজে আসে অজয়ের।পরিষ্কার দেখতে পায় ও ওর দাদুকে,বাবাকে।দেখতে পায় ৭১ এর পটভূমিকে।ঐতো ওর বাবা দাদু ফিরে যাচ্ছে আবার ওপারে।ঐতো যশোর স্কুলের মাঠে আবার খেলা শুরু হচ্ছে।দাদু ছ উইকেট নিচ্ছে।খেলছে হালদারের মাঠ,বানাচ্ছে ভাস্কর লবণ।

দুপারেই একসঙ্গে মা ঘাটে নামছেন। চারিদিকে উলু আর শঙ্খধ্বনি। মায়ের লক্ষ ইছামতী। ‘বাংলার ইছামতী’।

বন্ধুটা একমনে বিসর্জনের দুপারের বিসর্জনের ছবি তুলছিলো।একসময় হাসতে হাসতে অজয়কে শুধু জিজ্ঞেস করলো,”আচ্ছা ভাই,মায়ের পাসপোর্ট লাগবে না?”

অপূর্ব সাহা। জন্ম: ২২ শে অক্টোবর ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর চব্বিশ পরগনার সীমান্ত শহর বনগাঁ'য়। কলকাতার আশুতোষ কলেজে গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী। ছোটবেলা থেকেই লেখালিখি, বিতর্ক, নাটক, কুইজ প্রভৃতির প্রতি আকর্ষণ।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..