পিংকির প্রেমিক

অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী
গল্প
পিংকির প্রেমিক

এমন সুন্দরী নারী আমি খুব কম দেখেছি। আরো পরিস্কার করে বললে আদৌ দেখেছি কিনা তাই নিয়ে আমার মনে সন্দেহ আছে। পূর্ণিমার চাঁদ যখন সর্বপ্রথম আকাশে দেখা যায়, তখন যেমন দেখতে লাগে, তার গায়ের রঙ তেমনিই। এক ঢাল চুল। সরু কোমর। সেখানে অল্প মেদ থাকায় দুটি ভাঁজ পরেছে। এমন ভাঁজ ও তাতে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে থাকলে যে কোন নারীকে যে কি সেক্সি লাগে!

সে কাঁদছে। তার দীর্ঘ দুই দীঘল চোখে টলটল করছে জল! হয়ত আগেও অনেক ফোঁটা গড়িয়েছে। এবারেরটা  চোখে পড়ল। সেটা আমার দোষ নয়, পিংকির রূপের দোষ। এমন রূপ কেন তার যে তাকে দেখে আমার চোখের পলক পড়ে না। কেন তাকে দেখে এই প্রবল দুঃসময়ের মধ্যেও এমন আবেশ পূর্ণ হয়ে যাব।  মনে হল, নিজের সব বেদনা মুছে হাতে তুলে নিই ঐ টলটলে অশ্রুকণা। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলি, ‘কাঁদ কেন?’

কিন্তু এমন করা যায় না। ওর পাশে আমি চুপ করে বসে থাকি। বাতাস বইলে ওর গায়ের গন্ধ পাই। আহা, সে গন্ধ যেন জুঁই ফুলের। আর তাতে মাখান থাকে করবীর সুবাস। পাশেই রেলের পুকুরে মাছ লাফায়, বক ওড়ে। মাছরাঙ্গা বসে থাকে সজনে গাছের ডালে। চৈত্রের এই গনগনে দুপুরে, এই রোদ ছায়ার ভেতর, বকুল গাছের নিচে বসে আমি কেবল তাকেই দেখে যেতে থাকি। আর মনের ভেতর গুমরে গুমরে মরতে থাকে মনের গোপন ইচ্ছেগুলো।

এখন আমার চাকরি নেই। আজ নিয়ে কুড়ি দিন হল। একটা ছোট চিট ফান্ড কোম্পানীতে আকাউন্টস ম্যানেজার হিসেবে আমি কাজ করতাম। ডামাডোলের বাজারে সেই কোম্পানী বসে গেছে। ছোটখাট কোম্পানী, তাই কাগজে কোন খবর হয় না। মালিক সব টাকা সাপটে নিয়ে ঘাপ মেরেছে। আমাদের মত মাস মাইনের কর্মচারীদের চাকরি গেলে যে সেটা কত বড় ক্ষতি, তা এই সব অসাধু ব্যাবসায়ীরা কবে বুঝবে? চাকরি না পাওয়া এক জিনিস, আর পেয়েও হারান যে কি কষ্টের কথা, যে এই পরিস্থির মধ্য দিয়ে গেছে, কেবল সেই জানে।

বাড়িতে এখনও জানতে দিইনি। জানি না এমনি করে ক’দিন মিথ্যে দিয়ে চালিয়ে যেতে পারব। আমি আগের মতই সময়ে বেরুই। মা ভাত রেঁধে দেয়। টিফিন গুছিয়ে দেয়। সারাদিন বাইরে কাটিয়ে আবার যথাসময়তে ঘরে ফিরে যাই। ঘরেতে অভাব। বাবা হিন্দমোটরে কাজ করত। স্বেচ্ছাবসর নিয়েছিল আট বছর আগে। সেই জমানো টাকা, বাবার পেনশনের টাকা আর আমার এই ছয় হাজার টাকা মাইনেতে চলে যাচ্ছিল। সেই হিন্দমোটর তো বন্ধ হয়ে গেল!  ভারতের প্রথম মোটরগাড়ির কারখানার এই হাল!

একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে চটকল। কি করে চলবে আমাদের মত সাধারণ মেরিটদের? কি করব আমরা! জানি না একমাস পর যখন হাতে মাইনে না নিয়ে বাড়িতে ঢুকব, কি হবে! চাকরির জন্য যে উমেদারি করব, খুঁটির জোর লাগে। আমার সে সব নেই। দু’ চারটি বেসরকারি ব্যাঙ্কে দরখাস্ত দেওয়া আছে। দু’ এক জায়গায় ইন্টারভিউও দিয়ে এসেছি। কিন্তু ওই অবদিই। আর কিছু হয়নি তারপর।

এই বেকার সময় কাটানোর সময়ই দেখা পিংকির সঙ্গে। আমি যে এতক্ষণ ওর প্রায় পাশেই, গায়ে গা ঘেঁসে বসে রয়েছি, সে কি ও বুঝছে না? তবে সে একবারও মুখ তুলে তাকায় না কেন? কেন বলে না, ‘সরে বসুন’ বা কোন ট্রেনের খবর নেয় না?

তবে এই মেয়ে যে আত্মহত্যা করবে না তা আমি নিশ্চিত। তাহলে সে এতক্ষণে তা করেই ফেলত। আপে দুটি ট্রেন বেরিয়ে গেছে। সে দেখি তেমনি বসে। কখনও  যেখানে আমরা সবে আছি, সেই স্টেশনের একেবারে শেষ প্রান্তে, বকুল গাছের নিচে সিমেন্টের গোল গাছকে ঘিরে, সেখানে পা তুলে দিয়েছে; আর আমি দেখছি তার পায়ের পাতা এক অপূর্ব রঙ ধরে রেখেছে। সাদা পূর্ণ প্রস্ফুটিত পদ্মের একবারে নিচের পাতাটি যেমন করে নিজেকে রাঙ্গিয়ে রাখে, তার পদপল্লব দুটি তেমনিই। দেহি পদপল্লব মুদারম! বড় ইচ্ছে হল, পায়ের দুটি পাতায় ক’টি  চুম্বন এঁকে দিতে। তার পায়ের পাতার নূপূর জলরং দিয়ে আঁকা। সেখানে রুনুঝুনু শব্দটা যেন লেগেই আছে।  মনে হয় স্পর্শের মধ্যে  নিই সেই নূপূর; তাকে বলি, ‘এসো, এখানে যা ধুলো লেগেছে তা আমার মুখ দিয়ে মুছিয়ে দিই।’

এসময় দেখি স্টেশনের প্রাচীরের বাইরের গায়ে পলিথিন সিটের সেই চা দোকানে মাঝবয়সী লোকটা আমাকে হাতের ইশারায় ডাকছে। তার সঙ্গে আমার কোন দরকার নেই। তার দোকানে কোনদিন ধার করে আমি চা খাইনি। কারণ এই কালনা স্টেশনে আজই  প্রথম আসা। তবু আমি উঠে লোকটার কাছে যাই। খালি গা, গায়ের রঙ কালো, নাকের পাশে এক জরুল, একমাথা চুল, পরনে কেবল এক রঙ চটা লুঙ্গি। দোকানের ভেতর চায়ের সরঞ্জাম, বয়ামে বিস্কুট। তার আশপাশে নানান গাছ। কলা, আম, কাঁঠাল ও সজনে। কাছে যেতেই সে হাসিমুখে বলে, ‘বাড়ি থেকে রাগ করে পালিয়ে এসেছে বুঝি? মানাতে পারলে না এখনও?’

মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি খেলে যায়। বলি, ‘কি করে মানাব, কাকা?’

‘সে অনেক কায়দা আছে। ঝামেলার বিষয়ে কোন আলোচনা করবে না। চোখের জল মুছিয়েও দেবে না।’

‘তবে!’

‘ও এখন আর এখানে বসবে না। ও যেদিকে যায় সেদিকে যাবে, তখন ও চলে যেতে বলবে। যাবে না, কোন কথাই বলবে না। কেবল ওর সঙ্গে হাঁটতে থাকবে। শেষে ক্লান্ত হয়ে যখন কোথাও বসবে, তখনি ওর সঙ্গে কথা বলবে।’

আমি আবার গাছের নিচে এসে বসি। সঙ্গে সঙ্গে সে উঠে পড়ে। কিছুদূর গিয়ে আমি এবার আলাপ জমাই। একটু একটু করে সে নিজের কথা বলতে থাকে।

ওর নাম পিংকি। বয়স কুড়ি। ষোল বছরে বিয়ে হয়েছিল সোদপুরে। দেখাশোনা করেই বিয়ে। স্বজাতি এবং ওপারের লোক। ওর স্বামী বারে কাজ করে। বিয়ের আগে সেসব কিছু বলেনি। পিংকিকে বারের কাজে লাগাতে চেয়েছিল। ড্যান্সার। সে রাজি হয়নি। ওর বর ভেবে পায় না, এতে রাজি না হওয়ার কি আছে। ওর শ্বশুড়বাড়ির পাড়াতেই দু’ তিন জন মেয়ে নাচের কাজ করে। নাচ করা কি খারাপ নাকি? ঘরে পয়সাও আসে, অল্প বয়সে মেয়েরা মুটিয়ে বুড়ি হয়ে যায় না। অনেকদিন যৌবন ধরে রাখতে পারে। নাচলেই কি সবাই রেন্ডি হয়ে যায়?

এখানেই শেষ নয়। ক্রমে জটিল হয়ে যায় তাদের সম্পর্ক। পিংকির এক মামাত বোন ওর দেওরের সঙ্গে প্রেম করে। ছেলেটা ভালো নয়। রাজারহাট-নিউটাউনে জমির দালাল। রোজ রাতে মদ খেয়ে টং হয়ে বাড়ি ফেরে। এরই মধ্যে বিরাট ভুড়ি। মাথায় টাক। বয়স সাতাশ আটাশ। দেখলে মনে হবে চল্লিশ। বোনকে বারণ করেছিল পিংকি, শোনেনি। টাকা দেখে মোহিত হয়ে গেছে। বরং পিংকি যে বাধা দিচ্ছে, সে কথা বলে দিলে তার বাড়িতে দেওর প্রবল অশান্তি করে। তখন স্বামীর হাতে মারও খেতে হয়েছে তাকে।

পিংকির বাপের বাড়ি ধাত্রীগ্রাম। সেখানে দু’বছরের মেয়েকে নিয়ে থাকে। মেয়ের যখন এক বছর বয়স, তখন ওর বর ওকে বাপের বাড়ি বসিয়ে দিয়ে যায়। তারপর থেকে কোন খোঁজ খবর করেনি, টাকাও পাঠায়নি। আর বিয়ে করেনি, এক ড্যান্সারের সঙ্গে থাকে। পিংকি হাতের কাজ করে। সুতো ঘোরান। পড়াশুনো এইট অবধি। মা-বাবা-ভাইয়ের সংসারে সে একপেশে। সকালে মায়ের সাথে ঝগড়া হয়েছে। রাগ করে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পরেছে আর ফিরবে না বলে। মেয়ে রয়ে গেছে মায়ের কাছে।

এ সব কথা সে একটানা বলে যায়। আমার মনে হল, সে এমন কোন লোক চাইছিল, যাকে সে সবটা বলতে পারে। আমামকে দেখে নিশ্চয় তার মনে কিছু হয়েছে নইলে বলবে কেন। আমি চুপ করে তার সব কথা শুনে যাই। বুকের ভেতরটা জ্বালা করে। এখন আমরা স্টেশনের অন্যপ্রান্তে। এখানে তাকে আরও অন্যরকম লাগে।

তখন বুঝিনি সে কেন এত সুন্দর! কেন তার থেকে চোখ ফেরাতে পারি না? কেন তার সব কিছুই মার এত সুন্দর লাগে? সে তো সামান্যতমও সাজ গ্রহণ করেনি। সাধারণ একটা ছাপা শাড়ি পরনে। গোলাপি জমিতে সাদা ছোট ছোট ফুল ও লতাপাতা আঁকা। কপালে না আছে টিপ, না আছে গলায় কোন অলঙ্কার, না কানে কিছু। কেবল পায়ে ঐ সামান্য নূপূর। আর কি? কিছু নয়। তবু সে এক নাম না জানা ফুলের মত তার সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে বিকশিত হয়ে আছে। মনে হয় তার গোলাপি পায়ের পাতায় জাতে ধূলা না লাগে মাটিতে নিজের গায়ের জামাটা খুলে পেতে দিই। তাকে শোনাই জলপিপিদের গান। তার সামনে এনে ফেলি এক জোড়া দোয়েল। তার চোখের সামনে নেচে নেচে ফড়িং ধরুক কিছু ফ্ল্যাই ক্যাচার। পরে বুঝেছি তার গায়ের রঙই তার সাজ।

পিংকি উঠে পরে। হাঁটতে থাকে এলোমেলো। কেবার আড়চোখে পিছন পানে দেখে নেয় আমি আছি কিনা। ওর পিছুপিছু চলতে চলতে কতদূর চলে যাই। মনে হয় গোটা পৃথিবীটাই একবার পাক দিয়ে আসি ওর সঙ্গে। তারপর দেখা হবে আকাশ- মহাকাশ -পাতাল- ভূতল। সে দাঁড়ায় এক টলটলে পুকুরের সামনে। এই চৈত্র দিনে যখন প্রায় সমস্ত পুকুর-খাল-বিল প্রায় ফুটিফাটা, তখন এই টলটলে সবুজ জলে বাতাস ঢেউ তোলে, জল ছুয়ে উড়ে যায় জল-ফড়িং, পাড়ে বট-পাকুড়। অন্যান্য লতাঝোপ, বন্য ফুলের সৌরভ। শান্ত-সিন্ধ এক নীরব পরিবেশ। তার মুখ দিয়ে আপনিই বেরিয়ে আসে, ‘বাঃ, কি সুন্দর!’

আমি তাল মিলিয়ে বলি, ‘সত্যিই খুব সুন্দর।’

‘আপনি বারে কাজ করবেন?’

‘না।’

‘বার খুব খারাপ জায়গা, না?’

‘আমার জানা নেই।’

আপনি বারে যান না?’

‘এখনো না।’

তখনিই দেখি সেটশনের চা দোকানের সেই লোকটা। বট-পাকুরের ওপারে দু চারটি যে দরমার ঘর গাছ পালার আফঁকে ফাঁকে দেখা যায়, সেখান থেকে উঁকি মেরে ডাকছে। এখন পরনে একটা ছোট ধুতি, লুঙ্গিরমত করে পরা। তেমনিই খালি গা। পিংকিও দেখেছে। বলল, ‘সেই লোকটা না?’

‘হ্যাঁ।’

‘ডাকছে মনে হচ্ছে?’

‘চলুন দিকি কেন, একবার দেখি।’

 ঘরের কাছে পৌঁছতেই লোকটা একগাল হেসে তার বউকে ডাকে। সাধারণ এক ছাপা শাড়ী পরা এক মহিলা ঘর থেকে বেরিয়ে বলল, ‘ওমা, এসে গেছ। তোমাদের এদিকপানে আসতে দেখেই তোমাদের দাদা আবার ভাত বসাতে বললে। এসো ভেতরে এসো। সারাদিন রাগ করে কোথায় না কোথায় টংটং করে ঘুরেছ! এখন নাও, দুপুরের একটু আহার সারো। হাত মুখ ধোও। লেবুজল করে দিই। মুখ দুটি শুকিয়ে যে একেবারে আমসি হয়ে গেছে। যা রোদ!’

এখানে কোন কথা চলে না। যে আদর আমাদের প্রাপ্য নয়, তা পেলে আর মুখে ভাষা আসে না। আমরা পাতকোর জলে হাত মুখ ধুয়ে ঘরের মেঝেতে পাতা চ্যাটাইতে  বসি। শরীরটা কেমন যেন শান্ত শান্ত লাগে। মনটা স্থির হয়। টুকটাক কথার ফাঁকেই গরম ধূমায়িত ভাত এসে যায়। পাতে নালিতা শাক, একটু ঘি। বাটিতে পাতলা করে পিঁয়াজ ফোড়নের মুসুরি ডাল, আলু ঢ্যাড়শের একটা মাখোমাখো তরকারি, চুনো মাছের ঝাল, কাঁচা আমের টক। খিদের সময়, চৈত্রের গরমের এমন দিনে, এমন পরিবেশে, যেন অমৃত। কর্তা-গিন্নি বারবার আফশোস করতে থাকল বড় মাছ না থাকার জন্য।

খেতে খেতেই কথা চলছিল লোকটার সঙ্গে। নাম চন্দ্রপ্রসাদ রাজবংশী। বাড়ি বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার বাঁশুরিয়া গ্রামে। উল্টোপানে টুঙ্গিপাড়া গ্রাম। মাঝে কাটা খাল। পাড় ধসে ধসে সে খাল নদীর মতন চওড়া। টুঙ্গিপাড়াতে হাচিনার বাড়ি। বলতে বলতে তাদের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠতে থাকে। স্ত্রী রাসমণি বলে,  ‘আগে ওদের বাড়িতে যে কেউ ঢুকে পরতে পারত। এখন নানা বিধিনিষেদ আরোপ করেছে।’ কাকা বললে, ‘আমি তো বঙ্গবন্ধুকেও দেখেছি। চোখের সামনে দিয়ে টুঙ্গিপাড়ার মাটির রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেছেন। তিনি বেঁচে থাকলে আর এপারে এসতাম না। ওখানেই সুখে শান্তিতে ঘর করতে পারতুম। নিজেদের জমিতে চাষ করে রাজার হালে থাকতে পারতুম। এখানে এসে ভিখারি হয়ে আছি।’

রাসমণি বলে, ‘আমার বাপের বাড়ি ওপারে। সবাই এখনও ওখানেই থাকে। এখন যেমন কাঁটাতার, তখন এ সবের বালাই ছিল না। সোজা হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছিলাম। কোথাও কেউ ছিল না যে বাধা দেবে। সীমান্ত বলে কোন কিছুই ছিল না। এখন অবশ্য সে দিন নেই। দালাল ধরে পার হতে হয়। মাথাপিছু আড়াই হাজার টাকা।’

 কাকা প্রথম প্রথম সবজি বেচেছে, ফল নিয়ে পাড়ায় ঘুরেছে। তখন নদীয়ায় থাকত। এখানে ডেরা বেঁধেছে সাত বছর হল। এখন এই চায়ের দোকান। তার দু ছেলে। এক ছেলে ভিডিও তোলে, অপর ছেলে অটো চালায় কালনা শহরে। বলে, ‘এক যুগ আগে সীমান্ত পেরিয়ে দেশে গেছিলাম। ছেলেদের ভিটে দেখিয়ে আনলাম। এখন অবশ্যি কড়াকড়ি হয়ে গেছে।’

এসব শুনতে শুনতে মনে হল, এদের ভেতর দেশ ছাড়ার এক চাপা দুঃখ রয়ে গেছে। কথা বলার লোক নাই, এখানে যে দুই চারিটি ঘর আছে, সকলেই নানা ভাবে ওপার থেকে পালিয়ে এসেছে। তাদের কাছে এসব আর কি বলবে। তাই এখন আমাদের পেয়ে মন উজাড় করে কথা বলছে। ভার লাঘব করছে।

পিংকিরও জন্ম বাংলাদেশে। সে যখন বাবা মার সঙ্গে এপারে চলে আসে, তখন খুব ছোট। ফলে ওখানের লক্ষীপুরের কোন এলাকায় বাড়ি ছিল কিছুই তার মনে নেই। এখানে এসে তাদের অবশ্য বিশেষ ঝামেলা পোয়াতে হয়নি। এখানে পিংকির মামার বাড়ি। তারা এসে প্রথমে মামার বাড়ীতে ওঠে। পরে নিজেরা রেল লাইনের ধারে ঘর করে নেয়। মাথায় টিন। এখন তার কুড়ি বছর বয়স। তিন-চার বছর বয়সে সে বাবা মার সঙ্গে চলে আসে।

 শুনে লোকটা খুশি হল। বলল, ‘তবে তুমি আমার দেশের লোক। ভালোই হল। বাবাজীর বাড়ি কেবল এপারে। ওপারে এখনও আমার দুই দাদা, এক ভাই ও কাকারা থাকে। দাদার দুই ছেলে। একজন আছে পুলিশে, অন্যজন কাজ করে মিলিটারিতে। সরকারি চাকরি! তোমাদেরও এখনও কেউ থাকে নাকি, মামণি?’

খাওয়ার পর ওরা দু’জন আমদের একরকম জোর করেই পাশের ঘরটাতে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে বন্ধ করে দিল। বলল, ‘এখন একটু বিশ্রাম নাও। আর মান অভিমানও সারিয়ে নাও।’

মহা ফ্যাসাদ! এবার কি হবে? এসেছিলাম এক করতে, হল আর এক! মেঝেতে পা রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। যেন শিকড় গজিয়ে গেছে। মেয়েটা কি করবে এখন? ওর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারি না। এতক্ষণ যে চোখ দুটি দিয়ে ওকে চুরি করে দেখেছি, সেই আমার চোখ কেবলই টেনে ধরছে মাটির দিকে। পিংকি ব্যাপারটা কিভাবে নেবে? আমকেই কি এর জন্য সে দোষী ভাবছে? ঘর খুলে বেরিয়ে যাবে? নাকি দরজা ধাক্কে বলবে, ‘ও আমার বর নয়, পথের আলাপ’ নাকি আমাকে শাসন করতে শুরু করবে?

সে দেখি চেয়ারটাতে বসে পড়েছে। দু’ চোখ বুজে আছে। কোঁচকানো কপালে হাত। অপর হাত উরুতে। কি ভাবছে কে জানে! চোখ বন্ধ করে থাকাতে যেন একটু সাহস পাই। ঘরটাকে দেখতে থাকি। একটা নিচু তক্তপোস, পাতলা বিছানা। দুটি বালিস। একপাশে একটি ছোট্ট আলনা। তাতে কিছু জামাকাপড়। একটা ছোট টি টেবল। তাতে আয়না চিরুনি ইত্যাদি টুকিটাকি জিনিস।  খানিক অন্যমনস্ক হয়েছিলাম, হঠাৎ দেখি সামনে সে দাঁড়িয়ে। কোমরে হাত রেখে বলে, ‘সে বলে, ‘বেশ তো স্বামীর ভূমিকায় অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছ! বাবুর মুখ দেখে কিচ্ছুটি বোঝার উপায় নেই!  স্টেশনে বসে থাকতে থাকতেই এ সব ফাঁদা হয়েছিল বুঝি?’ কাতর হয়ে বলি, ‘সে সব কিছু ব্যাপার নেই পিংকি। লোকটাই ওসব ধারণা করে বসে আছে।’

‘আমায় বিয়ে করবে?’

‘মানে?’

‘মানে ঐ। করবে?’

সোজাসুজি এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি সে আমকে দাঁড় করিয়ে দিল। অসহায় হয়ে বলি, ‘আমার চাকরি নেই পিংকি!’

‘তুমি তো বি কম পাশ; আবার একটি চাকরি কি পেতে পার না?’ আমি চুপ। সে বললে, ‘এত লোক কোথাও না কোথাও কাজ করছে। আর তুমি পাবে না? কিছু না কিছু কি পাবে না? তখন না হয় আমাকে গ্রহণ কোরো। আজই বাড়ি গিয়ে জানাবে তোমার চাকরি নেই। ওঁনাদের বলবে চিন্তার কিছু নেই, দু’এক মাসের মধ্যে তুমি নতুন একটা চাকরি ঠিক যোগার করে নেবে। দেখবে, মনে একটা জোর পাচ্ছ। মনের ভার নেমে যাচ্ছে। পাষানে পথ কেটে নদী আবার বইছে। আমার জীবনের কুড়িটা বছর তো কিছু না পেয়েই কেটে গেল; না হয় আরও কয়েক মাস কাটবে।’

সে আরও কি সব বকে যাচ্ছিল। সে সব কথার কোন কিছুই আমার কানে প্রবেশ করছিল না। আমি মুগ্ধ হয়ে ওর সেই অপূর্ভ বিভঙ্গ দেখে যাচ্ছিলাম। ঘামে কপালের উপর লেপ্টে থাকা নরম কিছু চুল, নাকের ডগে ফুটে ওঠা বিনবিন ঘাম, ঝুলপি দিয়ে ধীর গতিতে গড়িয়ে নামতে থাকা স্বেদরেখা; বাইরে কোকিলের ডাক, চৈত্র দিনের গরমের হলকা, রাধাচূড়া ফুলের সুবাস, হাস্নুহানার গন্ধে মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে উঠল। মনে হল, কি হবে ঘরে ফিরে? এই বট পাকুড়ের নীরবতার মাঝে একখানা দরমার ঘর, আর আমরা দুজন; আর কি চাই?

এই সব ভাবনার ভেতর কখন যে আমি পিংকির সঙ্গে দু’কদমের ব্যবধান মিটিয়ে ফেলেছি কে জানে! খেয়াল হতে দেখি আমার দুই হাতের অঞ্জলিতে আলতো করে তুলে ধরা  প্রস্ফুষ্টিত শ্বেতপদ্মের আদলে গড়া একটি মুখ, ফুল্ল অধর; দেখে মনে হল, স্বচ্ছ কাচের উপর একটু গোলাপি রঙ নিয়ে কেউ যদি দাগ টানে, তা যেমন দেখতে লাগে; তেমনিই স্বচ্ছ, পাতলা, এক গোলাপি অধরের মালিক সে। যে অধর ভেদ করে দৃষ্টি চলে যায়। এমন পবিত্র অধরের স্বাদ নিতে কোন পুরুষেরই না ইচ্ছে যায়! শ্বাস বন্ধ করে সেই নারী দুই চোখ মুদে সেই চুম্বনের প্রত্যাশায়!

ক্রমে  আবিস্কার করতে থাকি পরিপূর্ণ দুটি পদ্মকোরক, যা ভোরের শিশিরের মত স্বেদ সিক্ত;  তলপেটের কোমল রোমশ্রেনীর অভ্যন্তরে বেলকুঁড়ি-নাভিশঙ্খ, যার অতলে ঝাঁপ দিলেই পুরুষ হয়ে ওঠে নেশাতুর; সবশেষে যে শালুক আরও আরও প্রস্ফুটিত হতে থাকে আমারই নিদারুন আদরে; যার সকরুণ আহ্বানে যখন আমি সাড়া দিই, বুঝতে পারি বাইরের দুনিয়ায় এক প্রবল আলোড়ন উঠেছে। সমস্ত বৃক্ষেরা জেনে গেছে  হলুদ পাতাদের ঝরিয়ে ফেলার আজই শেষ চৈত্রদিন! খস খস শব্দ, বাতাসের মধ্যে পুকুরের বন্য গন্ধ; বুঝলাম, এই হল পৃথিবী; এই হল তার জেগে ওঠার দিন! পুরান, জীর্ণ সব মুছে এখন সে সাজবে নতুন রূপে। অদ্ভূত এক জোর পেলাম মনে। মনে হল, একদিন জীবনটা অপূর্ণ ছিল। ফাঁক ছিল কোথাও। সেই ফাঁক এক নারী এসে পূর্ণ করে দিল। সে আমাকে দিয়েছে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াবার সাহস। এই সাহসের জোরেই সে এত কষ্টের পরও আমি পারব, নিশ্চয় পারব।

বিদায়ের আগে রাজবংশী দম্পত্তির সঙ্গে অনেক কথা হল। তারা বললে, ‘পরেরবার মেয়েকে এনো।’ আমরা বললাম, ‘আনব’। তারা বললে, ‘টেশনের ধারে যে কলাগাছ করেছি, ভালো জাতের কাঁঠালি। কাদি ধরেছে, সে তোমরা হয়ত দেখেছ, একমাসের মধ্যে এসো, ততদিনে কলা পুরুষ্টু হয়ে যাবে।’ আমরা বললাম, ‘নিশ্চয় আনব। আমদের মেয়ে গাছপাকা কাঁঠালি খেতে ভালোবাসে।’ তারা বলল, ‘ধাত্রীগ্রাম টেশনের পাশেই কি তোমাদের ঘর?’ আমরা বললাম, ‘হ্যাঁ। একদিন যাবে সময় করে’ ইত্যাদি কথা হল।

রোদ পড়তে আমরা বেরলাম। দেখি সেই রোদ মনের ভেতর উঁকি দেয়। আহা, কি অপূর্ব এই জীবন! ওই কাটা খালের মত। নদী হয়ে যা বইতে থাকে। তার পাড়ে যে তৃণভূমি, পিংকি যেন সেখানের হরিণী। যেন সে নিজেই চৈত্রমাস! যেন চৈত্রের সকল সৌন্দর্য তার মধ্যে এমনি ফেটে পড়ছে যে, তার গায়ে লেগে দোদ্দুর হয়ে উঠছে রঙ্গীন! সে নিজে হয়ে উঠছে সেই আলোর রেণু। যেন সে কোন এক পাখির পালক, এমনি তার ভরহীন দেহ! জুতো জোড়া হাতে নিয়ে খালি পায়ে ঘাসপাতা মাড়িয়ে, গুঁড়ো করতে করতে  সেই বট-পাকুড়ের কাছে চলেছে পিংকি মন্ডল ওরফে পিংকি বিশ্বাস ওরফে পিংকি … ।

অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী। গল্পকার। লেখকের দেশ-ভারতবর্ষ। জন্ম ১৯৭৬ সালে, ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলি জেলার ছোটচৌঘরা গ্রামে। পড়াশুনো- বাংলা সাহিত্যে এম এ। জীবিকা- চাকুরি। প্রকাশিত বই- একটি। 'মশাট ইস্টিশনের মার্টিন রেল' (১৫টি গল্পের একটি সংকলন)।  প্রকাশিত গল্পের সংখ্যা দুইশত। পশ্চিমবঙ্গের নানা পত্র পত্রিকায়...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..