পিঙ্গলা (পর্ব- চার)

মেহেরুন্নেছা
উপন্যাস
Bengali
পিঙ্গলা (পর্ব- চার)

পর্ব – চার

ঘরের দক্ষিণ প্রান্তে মাটির উপর খড় বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। খড়ের উপর মোস্তাগের আঁতির বিছানা। বিছানার উপর কালশিটে বড় একটা রাবার ক্লথ যেটা মুন্সিবাড়ী থেকে আনা হয়েছে। এটা মতির বাবা আকবরের বিছানা।

হতি রব মুন্সির বাড়িতে কাজ করে। আকবরের দুর্গতির কথা শুনে হতি চাওয়া মাত্র রব মুন্সির বউ রাবার ক্লথটি আকবরের জন্য দিয়ে দেয়।

তেল চিটচিটে বালিশটা আকবরের মাথার নিচে। বালিশের কাপড়ের রং কেমন ছিল তা ঠাওর করা মুশকিল। বিছানার পাশে রাখা মাটির হাঁড়ি। এটাতে কোনমতে মাথা তুলে আকবর কফ-কাশি ফেলে।

ঘরে ঢুকতেই উত্তর প্রান্তে একটা চকি ছিল। এটাতে মতি ঘুমাতো। এখন মতি জানু খালাদের ঘরে ঘুমায়। চকি চলে গেছে মায়ের ঘরে। মায়ের ঘর বলতে হতি ঘরের পূর্ব পাশে একচালা একটা কক্ষ বের করেছে।

মূল ঘর থেকে সে কক্ষে যাতায়াত করা যায় না। কক্ষে ঢুকতে হয় ঘরের দক্ষিণ দিক হয়ে ঘুরে। বেড়াএবং দরজা হতি নিজেই পাটখড়ি দিয়ে তৈরি করেছে। বেতের গিরা দেওয়া বেড়াগুলো খুব একটা পোক্ত না হলেও কম পোক্ত নয়। ঘরের মেঝে চকচক করে। হতি তার থাকার জায়গাটি কাদামাটি দিয়ে লেপে-মুছে রাখে। ছোটকাল থেকে সে পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালোবাসে। ঘরদোর লেপে মুছে আগদুয়ার-বানদুয়ার ঝাড়– দিয়ে তকতকে রাখা তার সারাজীবনের বাতিক।

সকাল থেকে প্রচুর বৃষ্টি হয়ে গেল। পুকুর পাড়ের মোস্তাগ পাতার সতেজতা দৃষ্টির ফাঁক এড়াতে পারে না। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। মতির হাতে ছোট্ট মগ। কলাপাতা দিয়ে ঢাকা। হাসি হাসি মুখে নিজেদের ঘরে ঢুকলো।

আকবর শুয়ে আছে। অবেলায় ছেলেকে দেখে গোঙাতে শুরু করলো। অসুখে আকবরের মুখ কিঞ্চিত বাঁকা হয়ে গেছে। তবুও বোঝা যাচ্ছে ছেলের আগমনে সে খুশি।

মতি মায়ের মত নাকে মুখে গামছা বেঁধে নিল। বাবার দিকে মগটা এগিয়ে ধরল,”আব্বা! নূরি কাকি আমনের লাইগ্যা গরুর দুধ দিছে।”

আকবর প্রসন্নচিত্তে ছেলের দিকে তাকায়।

মতি দুধের মগ নিরাপদ জায়গায় রেখে বাবাকে বহু কসরত করে বসায়। দুধ খেতে দেয়। ঠান্ডা দুধ। অবশ্য নূরি চুলায় গরম করে দিয়েছিল। ঐ বাড়ি় থেকে আনতে আনতে দুধ ঠান্ডা হয়ে গেছে। এ বাড়িতে কেউ নেই যে দুধটুকুন আবার গরম করে দিবে।

প্রথমে চুকচুক করে খেলেও শেষের দিকে একটানে আকবর দুধ শেষ করে ফেললো। খালি মগ বাড়িয়ে দিলো মতির দিকে। মতি মগ রেখে দিলো। এবার সে যেতে উদ্যত হতেই আকবর ছেলের হাত চেপে ধরে। মতি বাবার চোখের দিকে তাকায়। এই চোখ কী বলতে চাইছে তা মতি বুঝে।

আলগোছে সে বাবার পাশে বসে।

কোনোদিন মতি তার বাবা-মায়ের মধ্যে হাসি-খুশি ভাব দেখেনি। কল্পনায় মতি ভাবে, তুমুল বৃষ্টিতে সে তার বাবার কাঁধে চড়ে মাঠ থেকে ফিরেছে। মা তাদের জন্য কড়ই ভাজা নিয়ে অপেক্ষা করছে। তারপর তিনজনে ঘরের দাওয়ায় বসে বৃষ্টির ছাঁটে কড়ই ভাজা খায়। মা বাবার সাথে কথা বলে আর হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে।

মতি জানে এ দৃশ্য কখনোই মতির জীবনে আসবেনা। বাবার অসুস্থতা পরিবারের তিন সদস্যকে তিন প্রান্তে নিয়ে ঠেকিয়েছে।

মতির হঠাৎ একটা কথা মনে পড়লো। প্রায় সে ভাবে কথাটা বাবাকে জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু পরে আর মনে থাকেনা। ভালোই হলো আজ মনে পড়েছে, “আব্বা, রাইত্তা আমনে এতো জোরে জোরে গোঙান ক্যান?”

আকবর নিরুত্তর। দৃষ্টি ছেলের দিক থেকে ফিরিয়ে নেয়। চোখে-মুখে বিরক্তির চিহ্ন।

মতি নিজের মতো করেই উত্তর খুঁজে। একা একা তার বাবা দিনরাত শুয়ে থাকে। রাতে ঘুমায় না। এজন্যই রোগের তাড়নায় গোড়ায়। হয়তোবা একাকিত্বকে জয় করতে চায় বোবা বিষোদগারে।

মনে পড়লো, তখনো তার বাবা অসুস্থ হলেও সামান্য কথা বলতে পারে। একদিন মায়ের বকাবকি মাত্রা ছাড়িয়ে় গেলো। মতি বাবাকে জিজ্ঞেস করে,”আব্বা সত্য কইরা কওতো মায় যে তোমারে মরনের কতা কয় তোমার খারাপ লাগে না?”

“খারাপ লাইগ্যা কি অইবোরে বাপ! আঁর বাইগ্যে যা আছে তাই গটতে আছে।”

‘‘তোমারও কি দুনিয়া ছাইড়া চইলা যাইতে মন চায়’’

আকবর ফ্যাকাশে চোখে ঘরের বেড়ার দিকে তাকায়। দীর্ঘশ্বাসগুলো বেড়ায় প্রতিধ্বনিত হয়ে আকবরকেই আঘাত করে।

“তোর মারে কত কইলাম বাইলার বাড়ি থাইকা আমারে একটা তাবিজ আর পানি পড়া আইন্যা দিতো; তোর মায়তো কতা কানে নেয়না। তাবিজডা দিয়া দেহন যাইতো অসুখটা বালা অয়নি।”

মতি বাবার কথা শুনেই যায়। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে এমন একটা ওষুধ বাবাকে এনে দিতে যাতে বাবার সকল ব্যামো নিমেষে দূর হয়ে যায়। অথচ তার কিছুই করার নেই।

বৃষ্টি নেমে গেছে। টিনের চালে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। একেবারে ঝমঝম বৃষ্টি হাঁস-মুরগির গা ভিজে ছুপছুপ। পক্ষীগুলো বৃষ্টির ছাঁট থেকে রেহাই পেতে দাওয়ায় উঠে এসেছে।

আকবর মতির অস্থিরতা টের পায়। ছেলেকে কি বলবে তার পেটেই ক্ষিধে ছোঁ ছোঁ করছে। একেতো ক্ষিধে তার উপর হতি মুন্সিবাড়ি থেকে এখনো ভাত নিয়ে আসেনি। ভাত আনতে মেলা দেরি।

আকবর মতির হাত ধরে আছে। একসময় মাথা কাত করে আকবর ঘুমিয়ে পড়লো। কোনোমতেই মতি বাবার হাত সরাতে পারলোনা। কে যেন তার কানে কানে বলছে, মতি বাবাকে এভাবে ফেলে চলে যাওয়া ঠিক নয়। তাছাড়া বাইরে এখনো তুমুল বৃষ্টি। কোনোমতেই বেরুনো যাবেনা। হতি আসলে পর তাদের বাপ ছেলের পেটে দানা পানি পড়বে; সেই আশায় মতি তার বাবার হাতখানা কোলে নিয়ে অপেক্ষা করে।

যদিও মতির মা প্রতিদিন তার বাবার মুখে ভাত তুলে দেয়; তথাপি মতি জানে তার মায়ের অকথ্য কথার বাণ একটাও মাটিতে পড়েনা। মতি মনে মনে ভাবে, তার বাবা যদি সুস্থ থাকতো তবে কি তার মা তার বাবার সঙ্গে এতো খারাপ ব্যবহার করতো?

জীবনের নিষ্ঠুর সংকট প্রতিনিয়ত এই পরিবারটিকে ক্লান্তিজালে মুড়ে রাখে। এই ঘরে জীবন কেবলি পিছে টানে, নিচে রাখে।

স্বভাবগত ভাবনায় সুখের নদীর দেখা এবাড়ির কোনো সদস্য কখনো পায়নি। তারপরেও তারা কি এক আশায় বুঁদ হয়ে আছে। হয়তো আশার ঘোরে স্বপ্ন দেখাই তাদের নিয়তি। তারা বুঝতে পারে না এই আশার সবটুকুই কুহক। বেলাশেষে জীবনের অপর নাম বেদনার স্রােত। আশায় আশায় সে স্রােতের তোড়ে জীবনের ভেলা নিয়ে ভেসে চলে।

ঠায় বসে অপেক্ষার প্রহর গুনার ধৈর্য মতির আর একফোঁটাও নেই। ঘুমন্ত বাবার ধরে থাকা হাত থেকে সে নিজের হাত আলতো করে ছাড়িয়ে নিলো। তার বাবা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।

বৃষ্টির কারণে ঠান্ডা আমেজে আকবরের ক্ষিধে এখন ক্ষণকালের তরে বিলুপ্ত। কিংবা শোক-তাপ-দুঃখ-কষ্ট-ক্ষিধের যন্ত্রণা আকবরকে সর্বংসহা বানিয়ে দিয়েছে। এগুলোর ভার নিয়েই সে দিব্যি নিদ্রার কোলে অনায়াসে ঢলে পড়তে পারে।

মতি বেড়ার ফাঁক দিয়ে তার মায়ের ঘরে উঁকি দেয়। দরজা-জানালা বন্ধ হওয়া সত্ত্বেও পাটখড়ির প্রশ্রয়ে যৎকিঞ্চিত আলোক আসবাবপত্রকে স্পষ্ট করে রেখেছে।
হতি রাতের বেলা এ ঘরে ঘুমায়। দিনের বেলা ঘরের দরজা বন্ধ থাকে। হতি তার ঘরে অহেতুক প্রবেশ একদম পছন্দ করেনা। মতি জানে, তার মায়ের পরিষ্কারের নেশা আছে। অবশ্য পরিষ্কার থাকার নেশা কিছুটা তার মাঝেও বিরাজমান।

মা যে পরিষ্কার থাকতে ভালোবাসে তা তার ঘরের দিকে নজর করলেই যে কেউ বুঝে। চকির উপর বিছানো কালো-লালের মিশ্রণে সাজ করা মোস্তাগের পাটি। এক পাশে কাঠের ছোট্ট একখানা মাচা বিনুনি বাঁধা রশিতে ঝুলছে।
মাচার উপরে অন্য সব তৈজসপত্র ছাপিয়ে পাউডারের কৌটাতে মতির চোখ আটকে গেলো। কেমন এক অজানা অস্বস্থি তাকে পেয়ে বসলো। চোখ ফিরিয়ে নিলো বালক। অসহায় বাবার দিকে ঘুরে তাকালো। একটা সুশ্রী নারী মুখের ছবিওয়ালা পাউডারের কৌটা তাকে অপরিমেয় বিষন্ন করে তুললো।

মুখ থেকে গামছা খুলে মতি পিতার হাতটা ধরলো। আকবর এখনো ঘুমোচ্ছে। মতি তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সারল্যভরা নিস্তেজ মুখ। শীর্ণকায় দেহখানি কেবল বেঁচে থাকার জন্যই বেঁচে আছে যেন।

আজ যে মতির কি হলো কে জানে! এতোদিন মনের দরজায় কিসের এক খিড়কি এঁটে ছিলো। সেই খিড়কি আজ ধড়াম করে একটানে খুলে গেছে।

মতির এলোমেলো ভাবনারা সব খেই হারিয়ে ফেলেছে। হৃদয়ের পাটাতনে কে যেন অবিরত হাতুড়ি পিটিয়ে চলেছে। কেনো তার মা তার বাবার প্রতি এতো ক্ষুব্ধ? অসুস্থ বলে? কেবলমাত্র অসুস্থ হওয়ার জন্যই তার বাবার প্রতি মায়ের এমন আচরণ? বাবার জন্য ভেতরে ভেতরে কি এক অস্থিরতায় পেয়ে বসেছে তাকে।

পিতার প্রতিআত্মজার এই টান চিরন্তন। এই টান কেবল রক্তের সম্পর্কের কারণে নয়; এ যে মানবের সহজাত আবেগের মথিত স্ফুরণ যাকে আমরা মায়া বলি। পৃথিবী মায়ার সমুদ্র হলেও সবাই কি মায়া অনুধাবন করতে পারে!

কিন্তু আজ এইক্ষণে এই বালক পিতার কথা ভাবতে ভাবতে চোখের জল ফেলছে। অতঃপর ভারাক্রান্ত মনে আকাশের দিকে চাইলো যেখানে স্বয়ং আল্লাহ থাকেন। তার নানি বলেন, নামাজ পড়তে আর ঐ আকাশের আল্লাহর কাছে কাঁদতে। আল্লাহর কাছে নাকি সব আছে। তিনি চাইলে তাদের দুঃখের দিনের গুজরান হবে। একদিন তাদের সকল অভাব ঘুচবে।

এবার মতি কাঁদছে। সে মনস্থির করে এখন থেকে নামাজ পড়বে। আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে প্রার্থনা করবে তার বাবার মুক্তির জন্য। তাদের এই অনটনের জীবনের সমাপ্তির জন্য।

মতি আবার বাবার হাতখানা নিজের হাতে উঠিয়ে নিলো। বাবার হাত ধরে আনমনে সে পথের দিকে তাকিয়ে আছে। দুটি বুভুক্ষু প্রাণীর আহারের তাড়না তাদের দৃষ্টিকে এখন পথপানে নিপতিত করে রেখেছে। তুমুল বৃষ্টি মাথায় করে মায়ের আসার সম্ভাবনা একেবারে ক্ষীণ। তবুও বৃষ্টিবহুল পথ দুইজোড়া নেত্রকে নিদারুণভাবে আটকে রাখছে বারবার।

দূরে বৃষ্টির পতন রেখার মাঝে কালো একটা চলমান কি যেন দৃষ্টিগোচর হলো। ক্রমে কালো অবয়বটি স্পষ্টতর হতে লাগলো। বৃষ্টি থেকে রেহাই পেতে তালপাতার পাতলা মাথায় কাঙ্খে মাটির হাঁড়ি নিয়ে যে নারী অবয়ব মতির দৃষ্টির কাছাকাছি এগিয়ে এলো সে তার রগচটা মা।

অন্য সময় হলে মতি ওঠে যেতো। মায়ের সান্নিধ্য তার একদম ভালো লাগেনা। এই ভালো না লাগা গতকালকেও চরম ছিল। কিন্তু আজ সে বাবার বাধ্য ছেলে। নাকে মুখে গামছাও বাঁধা নেই। অথচ দিব্যি সে বাবার পাশে হাত ধরে বসে আছে। ব্যাধির গন্ধ কুপোকাত হলো ছোট্ট বালকের কাছে। মায়ার কাছে ব্যাধির গন্ধ নুয়ে পড়েছে।

হতি থমথমে মুখ নিয়ে ঢুকলো। প্রতিদিনই তার মুখে মেঘ জমে থাকে। এ বেলায় মুন্সিবাড়ি থেকে মেঘ-বাদল ডিঙিয়ে ভাত দিয়ে আসার ধকল হতির বিরক্তির মাত্রা আরো কয়ধাপ বাড়িয়ে দিলো।

হতি কাঙ্খের পাতিল রেখে নাক চেপে ভিজে কাপড় নিয়ে বসে গেলো স্বামীর মুখে ভাত তুলে দিতে। মতি কাঁচুমাচু স্বরে অনভ্যন্ত ভঙ্গিতে বললো,’মা আইজ্জা আঁই আব্বারে ভাত খাওয়াইয়া দিয়াম।’ একথা শুনে হতি আকাশ থেকে পড়লো। রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে ছেলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর সচকিত হয়ে বলে,”কেমনে? কেমনে?”

যে কাজটি এ বালক এতোদিন করে নি; এমনকি মুন্সিবাড়ি থেকে মা ভাত নিয়ে আসতে বললেও আনেনি ; আজ সে বাবার মুখে ভাত তুলে দিচ্ছে। হতির নিজেকে বেশ হাল্কা লাগছে। মুখের চামড়ার কঠিন ভাবটা এখন একদম নেই। বহুকাল পরে ফুরফুরে মনে আর্দ্র বাতাসে ভর দিয়ে ভেজা কাপড়ে হতি আবার মুন্সি বাড়ির দিকে রওনা দেয়।

বাবার মুখে ভাত তুলে দিতে গিয়ে তার বেদের বহরের কথা মনে পড়ে গেলো। তাদের এলাকায় যে বেদেরা আসে তারা নৌকাতেই জীবন কাটায়। সে দেখেছে, অসুস্থ বাবা বেদে নৌকায় গুয়ে আছে। তার ছোট্ট ছেলে বাবার মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে। মতি মনে করছে, বেদে নৌকার সেই ছোট্ট ছেলেটির মতো সেও এখন বেদে নৌকায় আছে।

বেদে মেয়েদের কথা ভাবতে ভাবতে আনমনে মতি হাসে। সেবার বর্ষা শেষ হয়ে এলো প্রায়। শুকনো মৌসুমে বড় হাটের কাছে হোচ্চার খালে অনেক বেদে নৌকা এসে ভিড় করে। তাদের নৌকায় সংসার! নৌকায় জীবন! মতিকে এ জীবন বড় টানে!

একবার তাদের বাড়িতে এক বেদেনি এসেছিলো মাথায় ওড়া ভর্তি চিনির বাসন-কোসন নিয়ে কোমর পেঁচিয়ে শাড়ি পরা বেদেনির গলায় ছিলো পুঁতির মালা আর হাতে রঙ-বেরঙের চুড়ি।

পায়ে নূপুরের ঝংকার তুলে বেদেনির ছন্দময় হাঁটা মেঠো পথে আনন্দের নহর ছড়িয়ে দিয়েছিলো। তার জানু খালা বহু দর কষাকষি করে বেদেনি থেকে এক জোড়া কাচের প্লেট কিনেছিলো।

আরেকবার মতির নানির কোমর ব্যাথা। অবশ্য তার নানি এই ব্যাথায় ভুগছিলো অনেকদিন যাবত। যখন ব্যাথা ওঠে তখন নানি অসহ্য ব্যাথায় কাতরাতে থাকে। সেবার পাগলের মতো চিৎকার করে মতিকে ডেকে বললেন, “ও মতি নানির কোমরডা আবার কামড়ায়-চাবায়। নানির লাইগা একজন বাইদানি ডাইক্কা আনতা যদি। কোমরে শিংগা দিলে নাকি কামড়ানি-চাবানি সারে।” বলামাত্র মতি ছুটতে লাগলো হোচ্চার খালের পাড়ে বেদের বহরের দিকে। মৃদুমন্দ বাতাসের ঝাপটায় মতির শরীরে খেলে যায় অজানা শিহরণ।

মতি জানতোনা পথিমধ্যে তার জন্য কি এক দারুণ ভাল লাগার ব্যাপার অপেক্ষা করছে।

পাশের গ্রামে মেম্বার বাড়ির কোনায় বড় গাব গাছের তলায় অনেক মানুষের ভিড়। সাপের খেলা দেখানো হচ্ছে। মতিকে আর পায় কে! সাপের খেলা দেখতে দেখতে মতি বেমালুম ভুলে গেলো তার নানি তাকে কি জন্য পাঠিয়েছিল।

অল্প বয়সি এক তরুণ সাপ নাচাচ্ছে। তরুণের মুখ ফুলিয়ে বাঁশি বাজানো, সাপের তাল ধরে ওঠা, মতির চোখ আর নড়েনা। সে যদি এমন দেহ দুলিয়ে, বাঁশি বাজিয়ে সাপের নাচ দেখাতে পারতো!

একসময় সাপের খেলা শেষ হলো। মাঝারি আকারের কাঠের বাক্সে সাপ ঢুকানো পর্যন্ত মতি দাঁড়িয়ে রইলো। নূরী কাকী আর ইমরানকে যদি সাপের খেলা দেখানো যেতো! এ যাত্রায় দেখানো না গেলেও আরেকদিন তাদেরকে সে সাপের খেলা দেখানোর ইচ্ছা পোষণ করে। তারপর রওনা হলো হোচ্চার খালের পাড়ে বড় হাটের দিকে।

শেষমেষ বাইদানি আনতে আনতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। তখন দিনের আলোর ভাটা শেষে রাতের আঁধারের জোয়ারের অপেক্ষায় সেতুপুর গ্রাম।

মতি একনজরে বেদেনির মন্ত্র পড়া দেখতে লাগলো। বেদেনি পুঁটলি থেকে চিকন চিকন লোহার শিকলের ন্যায় নরুইন বের করলো। সাধারণত নরুইন দিয়ে গ্রামে নখ কাটলেও বেদেনি এখন নানির কোমরের কাপড় সরিয়ে চামড়ায় খোঁচাতে লাগলো।

চামড়া বেয়ে কালো রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। শিংগা চেপে কাঁচিয়ে কালচে রক্ত আনা হলো। বেদেনি বলছে, এগুলো নাকি ব্যারামের বিষ। শরীরের বিষ রক্ত নামছে, সঙ্গে ব্যারামও নেমে যাচ্ছে। নানির চেহারা ব্যাথায় কুঁচকে গেলেও আপাতত নানি সব কষ্ট চেপে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।

সন্ধ্যা আগত প্রায়। উঠান জুড়ে চলছে বেদেনির চিকিৎসার তেলেসমাতি। কোমরের কামড়ানির চিকিৎসা শেষ। এবার বাতের চিকিৎসার আয়োজন শুরু। এর মাঝেই বেদেনি ঘোষণা দিতে থাকলো, দাঁতের পোকা সারাতেও সে সিদ্ধহস্ত ।

বাতের চিকিৎসার জন্য পুঁটলি থেকে মাছের কলিজা বের করে নানির চোখের পাতায় রাখলো। কতক্ষণ পরে কলিজা উঠানোর পর দেখে, সেখানে ছোট ছোট কৃমির মতো পোকা।
মতির কাছে এই পোকারা এখনো বিস্ময়! মাছের কলিজার এতো শক্তি? চোখের পোকা বের করে ফেলে! এই পোকারাই তাহলে নানির বাতের ব্যামোর জন্য দায়ী! কেবল নরুইন আর মাছের কলিজার চিকিৎসা চলেনি। মহাসমারোহে বেদেনি ঝাড়ফুঁকও চালিয়ে যাচ্ছে।

কিছুক্ষণ বাদে গালে হাত রেখে কোঁকাতে কোঁকাতে জানু আসলো দাঁতের পোকা ছাড়াতে। মারাত্মক ফুলে গেছে জানুর চোয়ালসহ বাম গাল। শুরু হলো দাঁতের চিকিৎসা। বেদেনি মন্ত্র জপে ভেজা তুলো গুঁজে দিলো পোকলা দাঁতে। চেপে তুলা ধরে আছে সে দাঁতের উপর। অবশেষে এই তুলাতেও পাওয়া গেলো কৃমির মতো ছোট ছোট পোকা।

বেদেনি চিকিৎসা করে চাল ডাল নিলো বটে কিন্তু তার নানি এবং জানু খালার কোনো রোগই ভালো হয়নি। এখনো মতির নানি কপাল চাপড়ায় আর বলে, “আহারে ব্যারামরে! যেই কোয়াল, হেই মাতা!”

মাঝখান থেকে এই চিকিৎসার কারণে তার নানি প্রায় মরতে বসেছিলো। পরেরদিন নানির প্রচন্ড জ্বর হয়। পরে গণেশ কবিরাজের ওষুধে নানি ভালো হয়। খালাও প্রায় সময় এখনো দাঁতের ব্যথায় ভুগে।

মতির ভাবনারা যখন প্রান্তে এসে ঠেকে তখন তার বাবাকে ভাত খাওয়ানোর পর্বও শেষ। এই ফাঁকে মতিও খেয়ে নেয়।

বাবাকেও গণেশ কবিরাজের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিলো। গণেশ বলে দিয়েছে, এ রোগ বড় কঠিন রোগ। ঢাকায় নিতে হবে। সেখানকার বড় ডাক্তাররা যদি এ রোগের কোন তালাফি করতে পারে।

মতি জানে বাবাকে কোনোদিন ঢাকায় নেয়া হবে না, রোগও সারবে না। এভাবেই তার বাবা যতদিন বাঁচে ততদিন বিছানায় গড়াবে।

 

চলবে…

মেহেরুন্নেছা। গল্পকার ও শিক্ষক। জন্ম ও বাস বাংলাদেশ। পেশাগত জীবনে তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ