পিঙ্গলা (২য় ও ৩য় পর্ব)

মেহেরুন্নেছা
উপন্যাস
Bengali
পিঙ্গলা (২য় ও ৩য় পর্ব)

পর্ব – দুই

আগের পর্ব পড়ুন এখানে >>>>>>

সপ্তাহ ঘুরে হাটবার এলো। প্রতি বুধবার বিকেলে বড়হাট বসে। বড় হাট লোকে লোকারণ্য। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি তো পরক্ষণেই ঝমঝম বৃষ্টি। কালো ছাতায় সয়লাব পুরো বাজার। বাজারের সঙ্গে লাগোয়া হোচ্চার খাল। সারি সারি নৌকা ঘাটে বাঁধা। খালের দু’পাড়ের সেতুবন্ধন চওড়া পাকা সাঁকোটি অটল দাঁড়িয়ে আছে। সাঁকোর গোড়ায় বসেছে বাজার।

দুপুর থেকে মতি বাজারে ঘুরঘুর করছে। কুদ্দুসের পরিবারের সদাই-পাতি বেশিরভাগ সময়ে মতি করে দেয়। এজন্যই বাজারে আসা। কুদ্দুসের মা মরিয়ম মুটচাল দিয়ে দেয় মতির কাছে। মুটচাল বিক্রির টাকায় যতটুকু সদাই কেনা যায় ততটুকুই সে কিনেছে। কেরোসিন তেলের বোতল হাতে, পোটলায় লবণ আর গুড় মাথার ওঁড়াতে নিয়ে ভিজে ভিজে মতি রওনা দিলো কুদ্দুস কাকাদের বাড়ির দিকে।

মরিয়ম কলার বরগ মাথায় দিয়ে পূবের ঘরের কাছে এসে দাঁড়ায়। মনে মনে মতির কথাই ভাবছে। বৃষ্টি মাথায় করে ছেলেটা সদাইপাতি নিয়ে কেমন করে আসবে!

দূরে মরিয়মের দৃষ্টিতে গাছপালা যেখানে ঝাপসা হয়ে এসেছে তার থেকে কিছুটা এগিয়ে ওঁড়া মাথায় মতিকে দেখা গেল। কয়েক মিনিটের মাথায় মতি মরিয়মের কাছাকাছি চলে এলো প্রায়।

“ও বুু! খচ্চা আনছি!”

মতি মরিয়মকে বু ডাকে। মতির মাথা থেকে বাজারের ওঁড়া গ্রহণ করে মরিয়ম। সদাইপাতি না দিতেই চলে যাওয়ার কথা জানায় মতি। মরিয়ম মতিকে অপেক্ষা করতে বলে।

একটু পরে মরিয়ম বাড়ির ভেতর থেকে বাঁশের ডুলায় করে কয়েকপদ তরকারি নিয়ে এলো। মতির হাতে ডুলা ধরিয়ে দিয়ে বললো,”ধর, তোর মাত্তোন দিছ!”

“কিতা বু?”

“কয়টা ডাঁডা, কাঁকরোল আর দুগা ভাতের চাইল।”

মতি লুঙ্গি পেতে দেয়। চাল আর কাঁকরোল লুঙ্গির কোঁচে, হাতে ডাঁটাসহ বাড়ির দিকে রওনা দেয়।

এখন আর বৃষ্টি নেই। ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে ভাঁপ মিশ্রিত একধরণের বুনো গন্ধ মতির নাকে এসে লাগে।

হঠাৎ গড়ের কিনারায় পানিতে জোরে বিক্ষিপ্ত আলোড়ন শুরু হলো। মতি বুঝে গেছে এ আলোড়নের হেতু। হগার বাড়ির হাকিমের পাতা টাঙা বড়শিতে বড় মাছ ধরা পড়েছে। মতি জানে, এ হাকিম চাচার টাঙ্গা! হাকিম প্রতিদিন একই জায়গায় গড়ের পাড়ে টাঙ্গা পুঁতে রাখে।

এক্ষুনি না ধরতে পারলে বড়শিসহ মাছটা হাতছাড়া হয়ে যাবে। তার লুঙ্গির জিনিসপত্র লুঙ্গিতেই গিঁট দিয়ে ভালো করে বেঁধে সে হাঁটু জলে নামলো। বিরাট এক শোল মাছ! একটানে বড়শি তুলে রাস্তার ফেলেই হাতের কাছে থাকা কাঠের গুঁড়ি কুড়িয়ে এনে মাছের মাথায় সজোরে আঘাত হানলো।

মাছটি পুরোপুরি না মরলেও জলে পালানোর শক্তি তার শেষ! কেবল মৃদুলয়ে কাদামাখা গায়ে ক্ষণে ক্ষণে লেজ নাড়াচ্ছে।

মতি বড়শিসহ মাছ নিয়ে রওনা দিল হগার বাড়ির দিকে। হাকিমের বউয়ের কাছে মাছ বুঝিয়ে দেয়া মাত্র দৌড়ে বের হয়ে এলো। হাকিমের বউ অনেক করে বললো, শোল মাছটা যেন মতি নিয়ে যায়। কিন্তু মতি তা নিবে না। শেষমেশ হাকিমের বউ বলে, “হতির পোলা এডা আস্তা খোদারকাডা!”

দৌড়াতে দৌড়াতে মতি রাস্তায় এসে দম নিল। এতোক্ষণ সে শোলমাছ কাবু করার ঘোরের মধ্যে ছিল। কেবল ঘোর নয়, মাছটা হাকিমের বউয়ের কাছে পৌঁছানোর পর মনের মধ্যে কি এক অজানা আনন্দ দানা বেঁধে উঠেছিল। চারদিকের গাছগাছালি ম্লানমুখে দন্ডায়মান। গৃহস্থের হাঁসগুলো সারাবেলা চইচই করে ঘুরে এখন আশ্রয়ের পানে গমনোন্মুখ। কিন্তু মতির বাড়ি ফিরতে মন চাইছেনা।

তবু সে বাড়ির দিকেই হাঁটছে। রাস্তার ধারের কচি আম পাতা ছিঁড়ে মুখে পুরলো। বিকেলের সোনালি আভায় আকাশে পাখিদের বেলা শেষের কসরত। কেমন মেদমেদে গরম লাগছে। গায়ে চিকন ঘাম। বোধহয় আবার বৃষ্টি আসবে।

ভেকের দল ডেকে চলেছে অনবরত। তার খুব ক্ষিধে পেয়েছে। বাজারে অনেক ধরণের খাবার ছিল।পয়সা না থাকায় পেটে ছিঁটেফোঁটাও পড়েনি।

বাড়ির কাছাকাছি চলে এলো মতি। বাড়ি বলতে নিজেদের বাড়ি নয়, তার নানার বাড়ি। মতি তার মা-বাবাসহ নানার বাড়িতে থাকে।

তার নানা সুবাস এসেছিলো এই গ্রামে। তাদের থাকার কোন জায়গা ছিলোনা। পরে তিন গ্রামের মানুষ দয়াপরবশ হয়ে খালের পাড়ে জঙ্গলের মাঝে একটুকরো খাস জমি দেয় নানা ফজর আলীকে ঘর তোলার জন্য। ফজর আলী ঘর বাঁধে। খালের পাড়ে উত্তর ভিটায় দোচালা টিনের ঘর।

সুবাস এসেছে বলে গ্রামের মানুষ তাদের বাঁকা চোখে দেখে। ভূমিহীন যারা একদেশ থেকে আরেকদেশে আশ্রয় নেয় তাদেরকেই এদেশে সুবাস বলে। এরা ছিন্নমূল, এরা সরকারের খাস জমিতে বসত গড়ে। তাদের সমাজে কোনো দাম নেই। তারা শেকড়হীন, সমাজের চোখে আগাছার ন্যায়।

মতির নানাদের ঘর হতে যৌবন হারানো মুলিবাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে খালের নৌকাগুলো সহজেই ঠাওর করা যায়। জানালাবিহীন বেড়ার এই জীর্ণ ছিদ্র দিয়ে ভাসমান জীবনের আঁচ খালপাড়ের জীবনের সমান্তরাল বহমানতাই নির্দেশ করে।

এই ঘরে থাকে নানা-নানি আর জানু খালা। নানা ফজর আলীর দুই মেয়ে। কোন ছেলে সন্তান নেই। মতির মা বড়।

“কি রে? আইজগাও বড়হাটে গেলি?” জানুখালা বড়শির সুতা গুটাতে গুটাতে জিজ্ঞেস করে।

খালা-বোনপো মিলে ঘরের পিছনে খালপাড়ে প্রায় বড়শি দিয়ে মাছ ধরে। আজ অবশ্য জানু একাই মাছ ধরছে।

মতি ভালো-খারাপ কিছুই বলে না। ক্ষিধেয় তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। মতি ভাবছে কোন ঘরে ঢুকলে খাওয়া পাবে। নানিদের ঘরে ঢুকবে না নিজেদের ঘরে।

নিজেদের ঘর বলতে নানাদের রসুই ঘরটাতে তারা মা-ছেলে পঙ্গু বাবাসহ মাথা গুঁজে থাকে। নিজের ঘরে ঢুকে খাওয়া খেলে বিপদ আছে। মায়ের হাতে মার খাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সে নানিদের ঘরে ঢুকলো।

লুঙ্গির কোঁচের ভাতের চাল আর কাঁকরোল একটা বাঁশের ডালায় রাখলো। পরে এগুলো তাদের ঘরে নিয়ে যাবে।

নানা নানি দুজনেই ভিক্ষা করে। নানির নাম কৈতরি। এ বাড়িতে ভিক্ষা শব্দটা উচ্চারিত হয় না। তারা বলে হাঁটতে বের হয়।

প্রায় দিনই নানা-নানি শরীর খারাপ থাকার কারণে হাঁটতে বের হতে পারে না। তবুও নানিদের ঘরে ঢুকলেই কিছু না কিছু খাবার পাওয়া যাবে।

মতির আশা পূর্ণ হলো। সত্যি সত্যি একটা টুকরিতে সামান্য কয়টা বাতাসা আর মুড়ির ঢোকের তলায় খানিক মুড়ি পড়ে আছে। পড়িমড়ি করে সে খাওয়া শুরু করলো।

বাতাসা দিয়ে মুড়ি খাওয়ার ঢং দেখেই বুঝা যাচ্ছে মতি খাওয়ার স্বাদে মজেছে। মতি ভাবছে, কোথা থেকে জানুখালারা বাতাসা পেলো কে জানে! অবশ্য তার নানি হাঁটতে বের হলে মসজিদে দেওয়া শির্ণী-বাতাসা যা পায় তা বাড়িতে নিয়ে আসে। আর এসব মেগে আনা খাবারের বেশিরভাগ মতির পেটেই ঢুকে।

ঘরের পাশে জানুরা ছোট একচালা আরেকটা রশুই ঘর তুলেছে। চালার নিচে জানু বড়শিতে পাওয়া মাছ কুটছে।

“খালা, নানায় কই? নানীওতো ঘরে নাই।”

“একজনে আঁটতো গেছে, আরেকজনে গেছে হুবের বাইত।”

“মাছডি কি অনে রাঁইন্ধা হালাইবেন?”

“ছাই কিত্তাম হারি! না রাঁনলে খাইবো কি?”
“আঁরে ও¹া হুঁডিমাছ দিবেননি রাইত্তার ভাত খাইতাম।”

“আইছ।”

জানু পুঁটির তেলে পুঁটি ভাজে। চুলায় এক-দুইটা লাকড়ি দেয় মতি। আগুনের তেজ বাড়ে। লালচে আলোয় মতির চোখ আরো ঝিলিক মারে।পুঁটির তেলের ঘ্রাণ শুঁকে।

জানু মুচকি হেসে বলে, “কিরে? কড়কড়া হুডি মাছ খাওনের লাইনি তোর এতো চুলার ধারে বইয়া থাওন!”

মতিও হাসে। খালা-বোনপো চুলার কাছে থাকতে থাকতে বাড়ির সব লোকজন এসে হাজির।

জানু গলা উঁচিয়ে দেখে আশেপাশে কেউ আছে কিনা। ফিসফিসিয়ে বলে,”আইজগা দেহা অইছেনি তোর হোছন মামুর লগে?”

মতির মুখ ভার, অপরাধবোধ চোখে-মুখে।

জানু গলা চড়িয়ে আবারো জিজ্ঞেস করে, ” অ পোলা কতা কছনা ক্যা? জিনিসডা দিছোতনি?”

“এক্কারে খালা মনো নাই! তয় হোছন মামুরে দেখছি রিক্সার সিডো বইয়া বিরি টানে।”

“হর শয়তান! ইয়ানো হুঁডি খাওনের লাই বইয়া রইছোত। আইজগা তোর খানা নাই!”

মতি কিছুক্ষণ দম ধরে থাকে। তারপর অভিভাবকসুলভ স্বরে বলে, “খালা একটা কতা কই?”

জানু সাড়া দেয়না। মতির উপর রাগে ফেটে পড়ছে। কত কষ্ট করে সে একটা রুমালে ফুল তুলেছে। টাকা জমিয়ে জমিয়ে রুমালে ফুল তোলার চাকতি, সুঁই, রঙিন সুতা এসব কিনেছে।
সব কিছু কেনার পর ভেজাল লাগলো রুমালে পেন্সিল দিয়ে ফুল আঁকা নিয়ে। অবশেষে কুদ্দুসের বউ নূরি তার রুমালে ফুল এঁকে দেয়।

এ রুমাল জানুর ভালোবাসার মানুষ হোছনের জন্য। এখনো রুমালটা হোছনকে দেয়া হয়নি বলে মতির উপর জানুর এতো ক্ষোভ!

হোছন রিকশা চালায়। হোচ্চার খালের পাড়ে তাদের চৌচালা ঘর। জমি-জিরোত বাপ-ছেলে দেখাশোনা করে বটে তবে ফাঁকে ফাঁকে হোছন রিকশা চালিয়ে বাড়তি আয় করে।

“ও খালা, একটা কতা কই?” মতি জোর দিয়ে খালার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে।

এবারও জানু চুপ। মতি জানুর রাগ টের পায়।

তারপরেও সে বলে, “খালা, হোছন মামু জানি কেমন! খালি দেমাক দেহায়।”

“তুই আঁর চোখের সামনেততোন হর। তোরে অন চেলি দিয়া একটা বাড়ি দিয়াম।”

একথা বলে সে মতির দিকে তরকারি নাড়ার কাঠি উঠালো।

মতি মুচকি হেসে বলে উঠলো, “ওরে আঁই এতোক্কণ হুদা কতা কইছি! আসলে হোছন মামুরে রুমাল কোনকালে দিয়া দিছি। আন্নেরে কেবল হোক খাওয়াইছি।”

ধপাস করে জানুর ভেতর থেকে ভারি কি যেন নেমে গেল। পুলকিত দুটো হাতে খোঁপা ঠিক করে নিলো সে। বানদুয়ার গুছাতে লাগলো তড়িঘড়ি। চুলার নিভু নিভু আলো জানুর চেহারায় এক অপার্থিব আলপনা এঁকে দিলো।

খালপাড়ের দিক থেকে আসছে অজানা পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ। জানু ভাবে, পাখিটা ডানা ঝাপটিয়ে কার কাছে যায়!

এমন সময় বড় বোন হতির বকাবকি কানে এলো।

হতি এক নাগাড়ে মৃদু চিৎকার করে চলেছে,”ও মতি, এমি আয়ছোন! মরার ঘানি একলা আর কতো টানতাম! দামড়া পোলা বাপের কাছ থাইকা কেল হইরা থাকবো।”

বোনের রাগান্বিত কন্ঠ শুনে জানু মতিকে তাগাদা দেয় মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য। মতি তাড়াহুড়োয় নিজেদের ঘরের দিকে এগুলো। প্রতিদিন তার মা হতি সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরেই মতির অসুস্থ বাবা আকবরের উপর একচোট লয়।

ফজর আলীর মেয়ে হতির শরীরের বান ভালো। গায়ের রঙ ময়লা। তবুও হতির মধ্যে একটা লাবণ্য আছে।

তাকে গ্রামের লোকজন মিলে আকবরের সাথে বিয়ে দেয়। আকবরের বাবা- মা-ভাই-বোন কেউ নেই। গ্রামে বদলা-কামলা খেটে রোজগার করতো। হতিও অন্যের বাড়িতে কাজকর্ম করে যাই পেতো তা দিয়ে কোনোমতে দুই পেট চলতো।

বছরবাদে মতি এলো সংসারে। আকবর সংসার ঠিক রাখার জন্য অতিরিক্ত পরিশ্রম করতো। যে পরিমাণ পরিশ্রম সে করতো সে পরিমান খাওয়া শরীরকে দিতে পারতো না।

মতি হওয়ার বছর খানিকের মাথায় আকবর একদিন ক্ষেতে কাজ করতে গিয়ে ঘুরে পড়ে যায়। এরপর থেকে পঙ্গু আকবর আজ অবধি বিছানায়।

মতি গ্রামের লোকদের কাছ থেকে আকারে-ইঙ্গিতে নিজের বাবা-মা সম্পর্কে নানা রকম কথা শুনে। মতির বাবা ভীষণ বদমেজাজি। এদিকে মায়ের কথাবার্তাও মারাত্মক টনটনে। তর্কাতর্কি-মারামারি ছিল এবাড়িতে নৈমিত্তিক ব্যাপার।

মতি বাবার দিকে তাকায়। শুয়ে থাকতে থাকতে মানুষটির পিঠে ঘা হয়ে গেছে। দেহের অপাচ্য অংশ বিছানায় ত্যাগ করে।

এখানে অভাবের শেকড় এতো গভীরে যে শত পরিশ্রম আর পরিচ্ছন্নতার কোনোটাতেই মানুষগুলোর লড়াই শেষ হয়না।

হতি আবারো গজগজ করে, “আল্লায় আঁরে এই আজাবতোন নেয়না। আর কত কাঁচাইতাম! কত চেঁচাইতাম! আল্লাায় এক কিনার করেনা কিল্লাই আঁরে!”

হতি নাকে মুখে গামছা বাঁধে। আকবরের বিছানার ময়লা পরিষ্কার করতে প্রত্যেকসময় হতি এই পদ্ধতি অবলম্বন করে। প্রচন্ড দুর্গন্ধ থেকে রেহাই পেতে হলে এ ছাড়া উপায় নেই।

মতি নাক চেপে বসে আছে। হতির ক্ষোভ এসে পড়লো মতির উপর “খোদার কাডা! জমিদারের মত বইয়া রইছোত! খালেরতোন আরেক বালতি হানি আন।”

মতি বসা থেকে ওঠে। নাক চেপে বালতি হাতে খালের দিকে পা বাড়ায়। চেহারায় অনিশ্চয়তার রেখা। বুঝ হওয়ার পর থেকে মতি বাপের এই অবস্থা দেখে আসছে।

আকবর কে সকাল-সন্ধ্যায় দুই বেলাই হতি পরিষ্কার করে। যত পরিষ্কারই করুক ব্যাধির গন্ধ বড় উৎকট! এ বাড়ির আনাচে-কানাচে প্রতিটি জিনিস থেকে যেন আকবরের ব্যাধির গন্ধ বেরোয়। পারত পক্ষে কেউ আকবরের কাছে ঘেঁষে না।

পর্ব – তিন

মুটমুঠে অন্ধকার বিদায়ের পালা। আলোর মৃদুমন্দ আভা ছড়িয়ে পড়েছে প্রকৃতিতে। কুদ্দুস আড়মোড়া দিয়ে জাগলো। বিছানা থেকে নেমে গলা খাঁকারি দিতে দিতে কপাট খুললো। মায়ের বিছানার দিকে তাকিয়ে ডাকলো “আম্মা”!

“কিরে বাবা? আম্মায়তো হেই কোন কালেরতোন হজাগ। তুমি আল্লার নাম লইয়া অনে মছজিদো যাও।”

কুদ্দুসের হাতে হারিকেন। বাইরে পাখিদের কিচিরমিচির। ঘুমন্ত পৃথিবী জেগে উঠেছে মাত্র। কুদ্দুসের হারিকেন দিনের কর্মমুখরতার সূচনা করলো।

পুত্রের পেছন পেছন মরিয়মও উঠলো। মা ছেলে একই সময় ঘুম থেকে ওঠে। মরিয়ম তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করে। কুদ্দুস মসজিদের দিকে কদম রাখে।

একটু পরেই কুদ্দুসের কন্ঠে ফজরের আযান ধ্বনিত হলো। সঙ্গে সঙ্গে পুরান বাড়ির উঠান থেকে ভেসে এলো কুকুরের নৈঃশব্দ ভেদ করা তীক্ষè চিৎকার। মরিয়ম নামাজের পাটিতে দুপা সামনে ছড়িয়ে এক পায়ের উপর আরেক পা উঠিয়ে লম্বা ঘোমটা টেনে সম্মুখে ঝুঁকে আছে। তাহাজ্জুদ শেষ। এরপর ফজরের নামাজের পালা। তার আগে খানিক বিরতিতে মরিয়ম তসবি জপছে।

চকির উপরে ইমরান ঘুমিয়ে আছে। ইমরানের যাতে ঘুম না ভাঙ্গে সেজন্য দাদির সতর্কতার শেষ নেই। তবুও আজকে তার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ইমরানের আওয়াজ পেয়ে মরিয়ম হতবাক!

“বিবি…!”

ইমরান দাদিকে বিবি সম্বোধন করে। নামাজে মগ্ন থাকায় নাতির ডাকে সাড়া দিতে পারেনি।
নামাজ শেষে মরিয়ম ইমরানের পাশে এসে বসে। ডান হাতে তসবি আর বাম হাতে নাতির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

“বিবি! আযান দিলে কুত্তায় ডাহে কিল্লাই?”

“বোবা জীব ভূত-প্রেত-দেও-দানোরে দেহে। আযান দিলে লোকালয় ছাইড়া দুষ্ট আত্মারা সব হলায়।”

মরিয়ম যা জানে তা দিয়েই নাতিকে কুকুরের চিৎকারের ব্যাখ্যা দেয়।

ইমরান দাদির বুকের কাছে মাথা তুলে দাদির গলা আঁকড়ে ধরে।

পাশের কক্ষ থেকে দরজা খোলার শব্দ হলো। নূরি উঠেছে। শেষরাতে আযানের ধ্বনির সাথে কুকুরের চিৎকার নিয়ে দাদি-নাতির কথোপকথন নূরি ঠিকই শুনছিল।

দরজা খুলতে খুলতে বলে,”আম্মা! এডি কি বুঝ দেন এমরানরে! বুঝি কুত্তার ডাকে দেও-দানোরা হলায়!”

নূরি মরিয়মের বুকে মাথা গুঁজে রাখা ছেলের কাছে যায়। পিঠ মুছে দেয়।

ইমরান তাড়া দেয় মাকে তাড়াতাড়ি কুকুর কেনো চিৎকার করে তা বলার জন্য। নূরি বলে,”রাইতের লম্বা নীরবতার হর আচমকা আযান দিলে মাইনষের আওয়াজ হায় দেইখ্যা
কুত্তায় এরুম কুঁই কুঁই করে।”

ইমরান মায়ের কথায় আশ্বস্ত হতে পারলোনা। আবার দাদিকে জিজ্ঞেস করলো,”ও বিবি! আম্মার কতা ঠিকনি?”

ঘরের স্বল্প আলো সত্ত্বেও মা-দাদির স্মিত হাসি ইমরানের চোখ এড়ালোনা। তার এমন কৌতূহল মাখা প্রশ্নই যে তাদের হাসির উদ্রেক করেছে তা মরানের বুঝতে বাকী রইল না।

মরিয়ম নাতিকে আরো বুকে টেনে নেয়। নূরির সমর্থনে বলে,”হ দাদা! তোমার আম্মায় লেহাপড়া করছে। তোমার আম্মার কতা ঠিক।”

“না আম্মার কতা ঠিক না। আসলে কুত্তায় জ্বীন দেহে। এল্লাইগ্যা কুত্তায় ডাহে। আঁরে মতি ভাইয়ে কইছে। মতি ভাইয়ে বেলে একবার জ্বীন দেখছে।”

“থাক দাদা! জ্বীনের কতা বাদ দাও! অহন উইঠ্যা যাও। নামাজ হইড়া মছজিদো যাওন লাগবো। আইজগা না গেলে তোমার আব্বায় কইলাম চেতাচেতি করবো।”

ইমরান সকালে মসজিদে তার বাবার কাছে গ্রামের অন্য ছেলে মেয়েদের সাথে আরবি পড়ে। সে কায়দা, আলিফলাম শেষ করে কোরান শরিফ পড়া শুরু করেছে।

প্রতিদিন আরামের ঘুম বাদ দিয়ে মসজিদে যেতে ইমরানের মন টানে না। ঘুমের ঘোরে রাজ্যের আয়েশি ভাবনা এসে জড়ো হয় তার।

মরিয়ম নাতিকে আবারো সজাগ করে দেয়,”দাদা তাড়াতাড়ি ওডো। আইজগা আমরা তাল দিয়া মুরি খাইয়াম। তুমি মছজিদতোন আইলে হরে বেকে একলগে নাস্তা কইরাম।”

ইমরান অলস ভঙ্গিতে ওঠে। বারকয়েক কাশি দেয়।

ইমরানকে কাশি দিতে দেখলেই শ্বাশুড়ি-বউয়ের মুখ চিন্তায় টানটান হয়ে ওঠে।

নাতির কপালে হাত দিয়ে উষ্ণতার মাপ নেয়,”কিও দাদা! আবার কাশিডা চেতলোনি!”

ইমরান কথা না বলে ঘাটলার দিকে চলে যায়।

মরিয়ম ঘর থেকে নামে। আর্দ্রতার ছড়াছড়ি চারদিকে। মুখ তুলে আকাশ নীরিক্ষণ করে। আকাশ তার সকল ভার নিয়ে থমকে আছে।

উঠান জুড়ে ছন্নছাড়া খড়-কুটোর ভেজা গন্ধ মরিয়মের নাকে লাগে। মরিয়ম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বানদুয়ারের দিকে এগোয়।

প্রায় পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছরের মরিয়মকে এখনো বয়স কাবু করতে পারেনি। দোহারা গড়েন কাঁচা হলুদের মতো গায়ের রং। মাথা আর কবরী—আকার আকৃতিতে প্রায় কাছাকাছি।
পান খাওয়া ঠোঁটে লাল রং সৌন্দর্যে আলাদা মাত্রা যোগ করেছে।

রান্নাঘরের পাশে মুরগির খোঁয়াড়ের দরজা খুলতে হবে। গরু ঘর পরিষ্কার করতে হবে। এ কাজগুলো প্রতিদিন মরিয়মই সারে। ছেলের বউকে সে এসব কাজ থেকে বিরত রাখে।

কুদ্দুস হাসতে হাসতে একদিন বলেছিল,”আম্মা, আমনে যে নূরিরে এসব কাম করতো দেন না, আমারেও করতো দেন না, আমনে মইরা গেলে তহন কে করবো?”

মরিয়ম দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে়,”বাবুরে দুনিয়াতে কোনো কাজ কারো লাইগ্যা আডক থাহেনা। আঁই মইরা গেলে তহন তোমরা সব হাঁডাইয়ো। যতদিন রথে কুলায় ততদিন আঁই কইরাম।”

ছোটকালে কুদ্দুসকে তার মা তুই সম্বোধন করলেও এখন তুমি ছাড়া কথা বলেনা।

বদ্ধ খোঁয়াড়ে হাঁস মুরগি গুলো বিকাশমান দিনের খবর পেয়ে গেছে। খোঁয়াড় ছেড়ে বের হওয়ার জন্য বোবা প্রাণীগুলো ব্যাপক তড়পাচ্ছে। তারা আর খোঁয়াড়ে থাকতে চায়না।

মুরগির খোঁয়াড়ের পাশে রান্নাঘর সংলগ্ন হাঁসের খোঁয়াড়। মরিয়ম হাঁস-মুরগি উভয়ের খোঁয়াড়ের দ্বার খুলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে গৃহপক্ষীরা তাদের জন্য নির্দিষ্ট পাত্রে রক্ষিত বাসিভাত ও ধানের কুঁড়া মিশ্রিত খাবার খুঁটে খেতে লাগলো।

চুলার দুয়ারে নূরি। দু-চোখের মাটির চুলায় রান্না চড়িয়েছে। বর্ষাকালে গোবর লাঠির আগুনেই বেশির ভাগ রান্না সারতে হয়।

নূরির পাশে গোবর লাঠির স্তুপ। পাটখড়ির লাঠিতে গোবর মিশিয়ে, বাড়ির পাশে নিচু ভূমি যেখানে অনেক বেলা পর্যন্ত রোদ থাকে, সেখানে মরিয়ম এগুলো শুকায়। এই গোবর লাঠি দারুণ জ্বালানি। সঙ্গে অল্প তুষ দিলে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে।

এক চুলায় ভাত, আরেক চুলায় তাল। এক ফাঁকে নূরি বড় ঘরে এসে জ্বাল দিয়ে রাখা বাইলা মাছ ও পুঁটি মাছ নিয়ে গেল। গতকাল হলুদ-লবণ ও রসুন দিয়ে মাছগুলো জ্বাল দিয়ে রেখেছিল।

প্রতিদিন ইমরান মসজিদে আরবি পড়া শেষ করে হগারবাড়ি যায় তার হাকিম চাচার কাছে। কুদ্দুস ইমামতি করে বটে কিন্তু জাল পাতা, আন্তা পাতা, বারা পাতার কাজ হাকিম করে দেয়।

কুদ্দুসের বর্গা জমি চাষের পাশাপাশি কুদ্দুসের পরিবারের অনেক কাজও হাকিম করে। কিছু মাছ হাকিম রাখে। বাকিগুলো কুদ্দুসের পরিবারকে দেয়। ইমরান গিয়ে মাছগুলো নিয়ে আসে।

রান্নাঘরের পাশে লাগানো ঝিঙের মুড়া পুরো চাল জুড়ে আছে। বাড়ির আনাচে-কানাচে যেখানেই রোদের স্পর্শ এসে লাগে সেখানে মরিয়ম তরকারির মুড়া লাগায়। সেগুলো ঘরের চাল জুড়ে় থাকে অথবা শুকনো ডাল আর চিকন বাঁশের মাচায় জড়িয়ে বেড়ে ওঠে। উঠানের পাশে লাউ, কুমড়া ও শসার আরোহি লতায় স্পষ্ট মরিয়মের মায়াময় যতেœর ছাপ।

আজ মরিয়ম ঝিঙ্গে এনে দিল নূরির কাছে। নূরি একবার চুলায় জ্বাল দিচ্ছে আরেকবার ঝিঙ্গে কুটছে।

“আম্মা, দেহেন কি আনছি” বলতে বলতে মাছের ডুলাটা ইমরান নূরির দিকে এগিয়ে দিলো। ইমরান রীতিমতো হাঁফাচ্ছে। চেহারায় উপচে পড়া আনন্দ।

ডুলার ভেতর বড় একটা বাইলা মাছের সাথে দুইটা বড় চিংড়ি। তাজা মাছের গায়ের ঝিলিক এবার ইমরানের মায়ের চোখে।

কুদ্দুস মসজিদে আরবি পড়ানোর কাজ সেরে মাত্র বানদুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে। মাথা নুয়ে ডুলার মাছ নেড়েচেড়ে দেখছে। নূরিকে উদ্দেশ্য করে বলে, “নাইরকোল দিয়া মাছডি রান্না করবা।”

আগে নূরির নাম ছিল নূরজাহান। বিয়ের পর নামের দৈর্ঘ্য কমে যায়। সৌন্দর্যের দিক থেকে নূরিকে বলা চলে এ বাড়ির আলো।

ছেলে নারিকেল দিয়ে বাইলা মাছ রান্নার কথা বলতেই মরিয়মের দূর অতীতে ফেলে আসা স্বামীর স্মৃতি মনে পড়লো। লতিফ মিজি সব তরকারির সঙ্গে নারকেলবাটা দিতে বলতো। নারকেল বাটা দিলে তরকারির স্বাদ নাকি অন্যরকম হয়ে যায়।

দীর্ঘশ্বাস চেপে মরিয়ম বড় ঘরে ঢুকলো। নাস্তা খাওয়ার জন্য ছোট-ছোট মোস্তাগের বিছানা পাতলো। মুড়ির ঢোক থেকে মুড়ি নিলো টুকরিতে।

সবার জন্য থালায় তাল পরিবেশন করলো। নিজেদের গাছের তাল, ঘরে দোয়ানো গরুর দুধ ও বেশি করে নারকেল দিয়ে রান্না করা ঘন তাল মুড়ির সঙ্গে মিশিয়ে আজ এ বাড়ির নাশতা হবে।

পুরো বাড়ি এখন নারকেল-দুধ-তালের মিষ্টি গন্ধে কেবল মৌ মৌ করছে।

 

চলবে…

মেহেরুন্নেছা। গল্পকার ও শিক্ষক। জন্ম ও বাস বাংলাদেশ। পেশাগত জীবনে তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ