পিরিয়ড: একটি সামাজিক ট্যাবু

সুমনা চৌধুরী
নারী, প্রবন্ধ
Bengali
পিরিয়ড: একটি সামাজিক ট্যাবু

প্রচণ্ড শীতের মরণকামড় রুখতে নেই কোনো শক্ত দেয়াল। অথচ এরকমই একটি নড়বড়ে ঝুপড়িতে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন পবিত্রা গিরি। ঠাণ্ডা থেকে নিজেকে বাঁচাতে যে আগুন জ্বালানো হয়েছিল সেটা নিভে গিয়ে ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে। ধোঁয়ার জ্বালায় চোখে জল আসে, কিন্তু এর মধ্যেই কোনোমতে গুটিশুটি মেরে সেই প্রায়ান্ধকার ঘরে শুয়ে থাকেন পবিত্রা।

নেপালের শতাব্দীপ্রাচীন হিন্দু রীতির কারণে এমন অবস্থায় দিন কাটাতে হয় পবিত্রার মতো আরো অনেক মেয়েদের। নির্মম সেই রীতির নাম ছৌপাড়ি। নেপালের মেয়েদের ছোটো থেকেই বিশ্বাস করতে বাধ্য করা হয়, ‘ছৌপাড়িপ্রথা পালন না করলে তাদের ওপর দূর্ভোগ নেমে আসবে। আর যদি সেটা মেনে চলে, তাহলে ভগবান তাদের আশীর্বাদ করবেন।

এই রীতি মতে, রজঃস্বলা মহিলারা অপবিত্র। তাই প্রতিমাসে মহিলাদের মাসিক বা পিরিয়ড হলে তাদের ঘরে থাকার নিয়ম নেই। প্রতিমাসে পিরিয়ডের দিনগুলিতে তাদের নির্বাসিত হয়ে কাটাতে হয় ঘর থেকে অনেক দূরে এরকমই ছোটো ঝুপড়িতে। ওইসময় তাদের খাবার, গবাদি পশু এবং পুরুষদের সংস্পর্শে আসা নিষিদ্ধ। ওই সময় তাদের ঘর থেকে অনেক দূরে তৈরী ঝুপড়িতে থাকাই নিয়ম। রীতি অনুযায়ী, এসময় মেয়েরা যদি নিষিদ্ধ কিছু স্পর্শ করে, তবে তা পরিবারের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে আনবে, অথবা রোগবালাই দেখা দিবে সেই পরিবারে। মেয়েদের এসময় মাংস, দুধ, ফলমূল এবং শাকসব্জি খেতে দেয়া হয় না এই ভয়ে যে, মাসিকের সময় এগুলো খেলে এসব পণ্য উৎপাদন নষ্ট হবে। শুধুমাত্র ভাত, লবণ আর শুকনো ফলমূল খেতে বাধ্য করা হয়। এসময় আয়নায় মুখ দেখা বা চুল আঁচড়ানোও বারণ। সন্তান জন্ম দেওয়ার পরও মহিলাদের এভাবে একমাস নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয়। নির্মম এই প্রথা পালন করতে গিয়ে অনেক মহিলার মৃত্যুও হয়। ২০০৫ সালে নেপালের সুপ্রিম কোর্ট এই ‘ছৌপাড়ি’ প্রথাকে বেআইনী ঘোষণা করলেও এখনও প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে এই প্রথা।

শুধু হিন্দু রীতিই নয়, ইসলাম ধর্মেও এই মাসিক বা পিরিয়ড হওয়াকে অপবিত্র, অশুচি রূপে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কোরআন শরীফের একটি আয়াত এ পড়েছিলাম

লোকে তোমাকে রজঃস্রাব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে, তুমি বোলো তা অশুচি। রজস্রাবকালে স্ত্রীলোক বর্জন করবে, আর যতক্ষণ না তারা পবিত্র হয় তাদের কাছে সহবাস এর জন্য যেও না।” (: ২২২)

প্রত্যেকটা ধর্মে এটা এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যেন রজঃস্রাব একটি অপবিত্র, নোংরা, অশুচি জিনিস। এমনকী অধিকাংশ ধর্মাবলম্বী মেয়েরাও রজঃস্রাব চলাকালীন ধর্মীয় রীতি নীতি পালন করাকে পাপ মনে করে।

শুধু নেপালের সমাজ ব্যবস্থা নয়, আমাদের সমাজে , এই ২০১৯ সালে দাড়িয়েও, এই বিষয়টিকে অত্যন্ত নোংরা এবং লজ্জাজনক ভাবা হয়। পিরিয়ড হওয়াকে আমাদের সমাজ এবং ঘরে প্রচলিত কথায় বলা হয় শরীর খারাপ‘! মেয়েদের পিরিয়ড বা ঋতুস্রাব হওয়ার মতো এই অত্যন্ত সাধারণ ব্যাপারটিকে ‘শরীর খারাপ’ বলে একধরনের অসুখের কাতারে ফেলা হয়।

রেচননিঃসরণের মতো পিরিয়ড বা ঋতুস্রাব ও একটি স্বাভাবিক শারীরিক প্রাকৃতিক চক্র। পিরিয়ডের স্রাব হচ্ছে রক্ত আর টিস্যুর মিশ্রণ, যা মাতৃগর্ভে শিশুর শরীর গঠনের জন্য কাজে লাগতে পারতো কিন্তু লাগেনি। শরীরের জন্য মাসান্তে এর প্রয়োজন ফুরিয়েছে, শরীর তাই একে ত্যাগ করছে, যেমন ত্যাগ করে ঘাম, মল বা মূত্র!

আমাদের সমাজে পিরিয়ড হওয়াকে ভাবা হয় একজন মেয়ের দুর্বলতা হিসেবে।এমন একটি ব্যাপার যেটা কাউকে বলা যাবে না, বিশেষ করে পুরুষদের তো না! কত ধরনের নিয়ম মেয়েদের জন্য থাকে এইসময়ে..! পূজো করা যাবে না, নামাজ পড়া বা রোজা রাখা যাবে না, রান্নাঘরে যাওয়া যাবে না! পিঠা বানানোর সময় সামনে থাকলে পিঠা নষ্ট হয়ে যাবে, পিরিয়ড শুরু হওয়া একজন মেয়েশিশু ছেলেশিশুর সংস্পর্শে এলেই গর্ভবতী হয়ে পড়ে, এ সময় মেয়েদের মাছ, মাংস, ডিম খাওয়া ঠিক নয়, স্নান বা সাঁতার কাটা উচিত নয়, ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে, প্রাইভেট টিউশন ক্লাসের ছেলেরা কীভাবে আমরা মেয়েদের টিজ করতো এই বিষয়টি নিয়ে !! কোনো মেয়ের পিরিওড চলছে কিংবা কারো ড্রেসে রক্তের দাগ পড়েছে, সেগুলো নিয়ে ছেলেদের জল্পনা কল্পনার ঠিক নেই।অনেকে আবার এগুলো কল্পনা করে বিকৃত মজাও পায়। এমনো দেখেছি, যে ছেলেটি রক্ত দেখলেই ভয় পায়, সে ছেলেটি পর্যন্ত পিরিয়ড নিয়ে মজা করতে দ্বিধা করে না। কিন্তু একেকটি পিরিওড মানে যে কতটা অস্বস্তিকর অবস্থা, সেটা যার হয় এবং যারা নিয়মিত সেই অবস্থা দেখে, তারাই শুধু বুঝে। হয়তো ছেলেরাও বুঝতো, যদি তাদের পেনিস দিয়ে মাসে মাসে এরকম রক্তপাত হত।

স্কুলে পড়ার সময় দেখতাম বিজ্ঞান বইয়ের যে অধ্যায়ে ঋতুস্রাব, ছেলেমেয়ের শরীরগঠন সম্পর্কে তথ্য ছিল, সে অধ্যায়টি স্যার ইচ্ছে করে এড়িয়ে যেতেন। তাই এই বিষয়ে শিক্ষাটা ছেলেরা তো দূ্রে থাক, মেয়েরাও ঠিকমতো পায়নি। প্রথমবার পিরিয়ড হওয়ার পর মা, ঠাম্মারা বলতেন,

এখন থেকে খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হবে। ছেলেদের সাথে মেলামেশা কমিয়ে দিতে হবে!”

ব্যস এতটুকুই!

কখনই তাঁরা আমাদের খোলাসা করে বলেন নি, এই পিরিয়ড হওয়াটা মেয়েদের জন্য একটি প্রয়োজনীয় শারীরবৃত্তীয় ঘটনা, যার সাথে সন্তান ধারণ ক্ষমতার বিশাল যোগসূত্র আছে। শুধু দেখতাম, নিয়মিত না হলে তাদের কপালে চিন্তার রেখা ভেসে উঠতো। কারন অনিয়মিত পিরিয়ড হলে অনেকসময় সন্তান ধারণের সম্ভাবনা কমে যায়।এবং পিরিয়ড ঠিকমত না হওয়াটা যে আরও অনেক জটিল এবং মারাত্মক রোগের উপসর্গ হতে পারে, সেটা এখন, এই বয়সে এসে বুঝতে এবং জানতে পেরেছি! মাসিকের সময় প্রচণ্ড ব্যথায় প্রায় মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে অনেক মেয়ে৷ তাদের ডাক্তার দেখানো হয় না৷ কেন তার ব্যথাটা ব্যতিক্রম এ নিয়ে পরিবারের কোনো মাথা ব্যথা নেই৷ কদিন আগে একজন ডাক্তারের সাথে কথা বলার পর জানতে পারলাম কী কী কারণে এটা হতে পারে৷ শরীরে হরমোনের মাত্রা এক একজনের এক এক রকম৷ তাই প্রত্যেকের ক্ষেত্রে শারীরিক অস্বস্তিটাও ভিন্ন হতে পারে৷

পিরিওডের সবচেয়ে কষ্টদায়ক জিনিস হল প্রিমেনস্ট্রুয়াল সিনড্রোম (পিএমএস)। শুরু হওয়ার আগে তীব্র পেট ব্যাথা, পিঠ ব্যাথা, বমি বমি ভাব, বিষণ্ণতা, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, টেনশন করা এগুলো অনেকেরই খুব কমন। অনেকে আছে বিছানা থেকেই উঠতে পারে না। অনেকের আবার পিরিওডকালীন সময়েও প্রচন্ড ব্যাথা হয় কিংবা অনেক বেশি রক্তপাত হয়। কারো কারো আবার এত বেশি রক্ত বের হয়, কাহিল হয়ে যায়। কিন্তু এ সবকিছুই ঘটে লোকচক্ষুর আড়ালে। বেশীরভাগ মেয়েরাই প্রথম পিরিয়ড হওয়ার সময় ভয় পেয়ে যায়, তারা বুঝতে পারে না কেন তাদের সঙ্গে এরকম হচ্ছে। আর এই অজ্ঞতার ধরুন তাকে যেতে হয় লজ্জাজনক এবং অস্বস্থিকর পরিস্থিতির মধ্যে। আর পুরুষদের কাছে ব্যাপারটি হয়ে দাঁড়ায় ট্যাবু। যার ফলে পিরিয়ড শব্দটি শুনলেই অনেকের যৌন সুড়সুড়ি শুরু হয়ে যায়।

আমাদের দেশে, একটা মেয়ে সাধারণ স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে গেলেও শিকার হতে হয় অস্বস্তিকর পরিবেশের কিংবা মন্তব্যের। জাতীয় সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, এ দেশে ৬৮ শতাংশ মহিলা এখনও স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন না। নিয়েলসেনের সমীক্ষা বলছে দেশের ৩৫.৫ কোটি ঋতুকালীন বয়সি মেয়েদের মধ্যে ৮৮% কোনও স্যানিটারি ন্যাপকিন (প্যাড) ব্যবহার করেন না৷ তাঁরা অপরিষ্কার কাপড়, ছাই, তুষ , বালি এইসব ব্যবহার করেন৷ চিকিৎসকরা বলেন এর ফলেই বহু মেয়ে প্রজননের দ্বারে এবং প্রস্রাবের দ্বারের সংক্রমণে ভোগেন, যার ফল সুদূরপ্রসারী হতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে চিরতরে বন্ধ্যা হয়ে যাওয়া৷ অধিকাংশ গ্রামের স্কুলে তো বটেই, শহরের স্কুলেও শৌচাগারের হাল খুবই খারাপ। অপরিচ্ছন্ন, দুর্গন্ধে ভরা শৌচাগার এড়িয়ে যাওয়ার জন্য একেবারে ছোট্ট বয়স থেকেই মেয়েরা জল কম খাওয়া শুরু করে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে নানান জটিলতা। তৈরি হয় কিডনির সমস্যাও। ‘সরকার বলছে ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও!’ বেটি বাঁচবে কী করে যদি এই বয়সেই তাদের সংক্রমণ হয়?

এই সমস্ত অবৈজ্ঞানিক ও অসত্য ধারণার ফলে অন্যান্য অবমূল্যায়নের পাশাপাশি, একটি মেয়ে বঞ্চিত হয় মানবাধিকার থেকে। প্রতিমাসের এই ‘শরীর খারাপ’ আর ‘অপবিত্রতা’র অনুভবে ধীরে ধীরে সে হীনমন্যতায় ভুগে। তার নিজের শরীরই তার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। এ সময় মেয়েরা বাইরে যেতে স্বস্তি বোধ করে না, এমনকি নিজের ঘরেও আড়ষ্ট থাকে। তাকে অশুচি, অপয়া ভাবা হয়, এমনকি তাকে নিজেকে অশুচি ভাবতে বাধ্য করা হয়, সে বঞ্চিত হয় তার মানবমর্যাদার অধিকার (Right to Dignity) থেকে। তাকে আবদ্ধ রাখা হয় ঘরে, এ সময়ের নিরাপত্তাহীনতা আর ‘লজ্জা’র কারণে অনেক মেয়েশিশুরা স্কুলে যেতে চায় না, লঙ্ঘিত হয় তার শিক্ষার অধিকার (Right to Education)। মাসিককে একটা শারীরিক বৈকল্য বিবেচনা করে তাকে বঞ্চিত রাখা হয় বিশেষ কিছু কর্মের অধিকার (Right to Work) থেকে। উপযুক্ত টয়লেট সুবিধা না থাকায় ক্ষুন্ন হয় তার উপযুক্ত কর্মপরিবেশের অধিকার (Right to Work in Favorable Environment)। নীরবে সব সহ্য করায় বা সহ্য করতে শেখানোর মাধ্যমে হরণ করা হয় তার মতপ্রকাশের অধিকারকে ( Freedom of Expression)

ফলত, এই ক্রনিক বা সিস্টেমেটিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাধ্যমে সমাজে ছড়ানো হয় জেন্ডার বৈষম্য!

মেয়েদের জীবনে এই মাসিক বা ঋতুস্রাব নামক প্রক্রিয়াটি যে যারপরনাই গুরুত্বপূর্ণ, তা বোঝা নিশ্চই খুব কঠিন নয়। আর যদি এটি গুরুত্বপূর্ণই হয়েই থাকে, তাহলে কেন এ নিয়ে সচেতনতা তৈরি করা হবে না? এই বিষয়ে শিক্ষা শুধু মেয়েদের না, ছেলেদেরও পাওয়া উচিত। স্বামী এবং স্ত্রী, ভাই, বোনের, বাবা এবং মেয়ের মধ্যেও এই বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা হওয়া উচিত!

যে শারীরিক প্রক্রিয়াকে মানুষ নোংরাভাবে, যাকে অসুস্থতা বলে আখ্যা দেওয়া হয়, সেটি না ঘটলে তো এই পৃথিবীতে বংশ বিস্তারের প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতো! একবার ভেবে দেখুন তো, পিরিয়ড হওয়াটা অসুখ বা শরীর খারাপ, নাকি না হওয়াটা? আমরা রক্তাক্ত হই বলেই কি না এই পৃথিবী চলছে, এখনও মানুষ জন্মাচ্ছে৷

সুমনা চৌধুরী। লেখক, শিক্ষক ও মানবাধিকার কর্মী।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..