প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
আ্যান্জেলা, দরজাটা একটু খুলবে?
দরজায় মৃদু একটি টোকা দিয়ে, নিরীহ গলায় সুবীর জানতে চাইল।
কেন? কী চাই তোমার? জানতো, এইসময়টায় আমি প্রার্থনা করি।
আ্যান্জেলার ঝাঁঝাল কণ্ঠ টের পেয়ে সুবীর সংকুচিত হয়ে বলে, প্লিজ একটু খোল, আমার ওয়ালেটটা ভুলে এইঘরে ফেলে গেছি মনে হয়।
বলেছি প্রার্থনায় বসলে বিরক্ত করবে না, তাও একটা বাহানা তোমার চাইই চাই।
এ্যান্জেলা দরজা একটু ফাঁকা করে খুলতেই সুবীর দ্রুত তার মাথা ঢুকিয়ে দিল। কুন্ঠিতভাবে বললো, সরি হানি, আর এমন হবে না।
সে দ্রুতপায়ে ঘরে ঢুকেই বেডসাইড টেবিল থেকে ওয়ালেটটি তুলে নিয়ে বেরিয়ে এলো। কিন্তু চকিতে প্রার্থনারত স্ত্রীর দিকে দৃষ্টি দিতে ভুললো না। দিনে দিনে তার প্রার্থনাস্থল এবং প্রার্থনা সামগ্রি রাখার টেবিলটি জনাকীর্ণ হয়ে উঠেছে। সেখানে মা মেরি’র পবিত্র মূর্তির পাশে রয়েছেন দন্ডায়মান ক্রুশবিদ্ধ যিশু, কয়েকটি বেবি আ্যন্জেল, নানা সাইজের জপমালা, আগরবাতি, মোমবাতি, তাবিজ-কবজ আরও কত কি!
সুবীর অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো তাদের শোবার ঘরটিতে এখন যেন তার নিজের আর কোন অস্তিত্ব নেই। পুরোটাই যেন আ্যন্জেলার দখলে চলে গেছে। কিছু জলন্ত ধূপকাঠি থেকে নীলাভ ধোঁয়া আর তার অদ্ভুতরকমের গন্ধে মোহাচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে ঘরের বাতাস। সুবীরের শরীর শিহরিত হল।বুকের গভীরে অনুভব করলো এক ভয়ানক কাপন। কী হচ্ছে এসব? কোথায় চলেছে আ্যন্জেলা? এসব কিসের আলামত?
দু’গালে মিষ্টি টোল ফেলে, মুচকি হাসিতে যে শ্যামবর্ণা মেয়েটি কোটি তরুন হৃদয়ে ঝড় তুলতে পারত, তার নাম এ্যান্জেলা ডি সিলভা। বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে।বড্ড আদুরে। স্কুলে বরাবরই প্রথম স্থান অধিকার করেছে। চমৎকার বিতর্ক করে। সবসময় ভালো কিছু করার অনুপ্রেরনা ও নির্দেশনা পরিবার থেকেই পেয়েছে। মা তার হাতের তালুর উপর রেখে মেয়েকে মানুষ করেছেন। এসএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ নিয়ে পাশ করেছিল সে।তারপর ঢাকা হলিক্রস কলেজ থেকে এইচএসসি।ঢাকা ইডেন কলেজ থেকে অনার্স। পড়াশোনা ছিল তার একমাত্র নেশা।
প্রথম দর্শনেই যে ছেলেটি এই তরুনীর প্রেমে পড়েছিল সেই রোমিও টাইপ প্রেমিক ছেলেটির নাম সুবীর কাশ্মীর পেরেরা।গাজীপুরের কালীগঞ্জ সেন্ট নিকোলাস স্কুল থেকে এসএসসি ও ঢাকার নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করে তেজগাঁও কলেজ থেকে ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স করেছে সুবীর।
সময়টা ছিল ২০০৩ সাল। সংসদ ভবন ও মণিপুরীপাড়া লাগোয়া একটি রাস্তায় ছেলেটির সঙ্গে মেয়েটির প্রথম দেখা। প্রথম দর্শনেই প্রেম। তারপর বিরতিহীন দেখাসাক্ষাৎ। কতশত কথা। রোমিও জুলিয়েটের মতই চুটিয়ে একটানা প্রেম। একটি বছর যেন চোখের পলকেই কেটে গিয়েছিল। তারপর ২০০৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জীবনসঙ্গী হয়ে মেয়েটি তার সংসারের হাল ধরেছিল। যেন সুখের সাগরে ভাসছিল তাদের সোনার তরী।।দু’বছর বাদেই একমাত্র কন্যাটি চাঁদের রোশনাই নিয়ে এলো তাদের ঘরে।
ইতোমধ্যে লক্ষী বউটির সৌভাগ্যে ডিভি লটারি পেয়ে যায় রোমিও-জুলিয়েট পরিবার। ২০০৭ সালের মে মাসে একটি শুভদিনে স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় উড়ে চলে এলো পরিবারটি। শুরু হল নতুন দেশে তাদের টিকে থাকার লড়াই।ধনী দেশে জীবনের এই কঠিন শুরুটি অনেকেই আগেভাগে অনুমান করতে পারে না। স্বামী রাতে কাজ করেন, স্ত্রী দিনে। দু’জনে মিলেমিশে, ভাগাভাগি করে সংসার, সন্তান দেখাশোনা করতে হয়।তবে আ্যন্জেলা ও সুবীরের সংসারে এত খাটাখাটনির পরও ভালোবাসার কোনো কমতি ছিল না। এক বেডের ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে জীবন ভালোই কাটছিল।আ্যান্জেলা আর সুবীর ভাবতো, ”নীর ছোট ক্ষতি নেই আকাশতো বড়”। নতুন পরিবেশ, ব্যাস্ত জীবনে বউটি কোনো অভিযোগ ছাড়াই সুন্দর মানিয়ে নিয়েছিল।
কিন্তু হঠাৎ করেই আ্যন্জেলার গলব্লাডারে পাথর ধরা পড়ল। মেরিল্যান্ডের স্থানীয় এক হাসপাতালে তার অপারেশন হল। বলা যায়, সেদিন থেকেই যেন সুবীর পিরেরার ভাগ্যে ঘণ কালো মেঘের ছায়া নেমে এলো। অপারেশন শেষে বাড়ি ফেরার পর আ্যান্জেলার শরীর আরও বেশি খারাপ হয়ে পড়ল।আবারও হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি। দৌড়-ঝাঁপ। এভাবে কষ্টকর পনেরটি দিন হাসপাতালে অতিবাহিত করে অবশেষে সে বাসায় ফিরে এলো।প্রায় আড়াই বছর ধরে অপারেশন-পরবর্তী নানা জটিলতার কারণে আ্যন্জেলা একরকম ঘরবন্দী হয়ে পড়েছিল। বাইরের কোনো কাজও করা সম্ভব ছিল না। তার দিনরাত্রি কাটতে লাগলো বাসায়। সংসার ও একমাত্র কন্যার দেখাশোনা করে।
লোকে ভাবে আমেরিকা ডলারের দেশ। এখানে প্রাচুর্যের শেষ নেই। কিন্তু কাজ না থাকলে সেই প্রাচুর্য সোনার হরিণের মতই। একার আয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল সুবীরকে। একটা সময় তাদের ধার-দেনা শুরু করতে হলো। ঠিক সেই সময়টাতেই আ্যন্জেলার এক প্রতিবেশী বন্ধু তাকে এক পীরবাবার সন্ধান দিল।বললো, ‘মুসকিল আসান’ করতে পারে এই পীর। খুবই কামেল!এর সাথে কথা বলে, প্রার্থনা করলে মনে শান্তি আসবে। ভগ্নস্বাস্থ্য পুনর্উদ্ধার হবে। আর্থিক স্বচ্ছলতা আসবে।
সুবীর বাসায় না থাকলে সেই প্রতিবেশীর আসা যাওয়া চলতে থাকে। শলাপরামর্শ শুরু হয়। বিপদমুক্তি, ভগ্নস্বাস্থ্য পুনর্গঠন, আর্থিক অবস্থার উন্নতি প্রভৃতি স্পর্শকাতর বিষয়গুলো আ্যন্জেলাকে একপ্রকার মরিয়া করে তুলেছিল। তাই সেই কথিত কামেল পীরবাবা’র সাথে প্রার্থনায় যোগ দেয়ার সুপরামর্শটি তাকে ভিষনভাবে অনুপ্রানিত করে তুললো। প্রতিবেশী জানালো চাইলে ভিডিও কলের মাধ্যমেই পীরের সাথে সরাসরি প্রার্থনায় যোগ দেয়া যায়।আ্যন্জেলা বিশ্বাস করতে শুরু করল ভিডিও কলের মাধ্যমে পীরের সাথে কায়মনে প্রার্থনা করলে তাদের আর্থিক অবস্থা ও তার ভগ্ন স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে।
সুবীর তাই কখনও আ্যন্জেলার বিশ্বাস, ভক্তিতে বাঁধা দেয়নি। ধর্মানুভূতিতে আঘাত করে তাকে আরও হতাশ করতে চায়নি। সে ভেবেছে, ধর্মকর্ম করলে কোন ক্ষতিতো নেই। বরং এতে আর কিছু না হোক, হয়তো তার মনের প্রশান্তি আসবে। তার সময়টাও ভালো কাটবে। আ্যন্জেলা ফোনের মাধ্যমে বিভিন্ন পদ্ধতিতে ঢাকায় প্রার্থনারত পীর ও পীরের দ্বিতীয় স্ত্রী জেনেভি’র সাথে প্রার্থনায় যোগ দিতে শুরু করল। প্রতিদিন সন্ধ্যায় তাদের ধ্যানের আসর বসত। দেশ বিদেশে তার অনেক মুরিদ। আ্যন্জেলা আটলান্টিকের পাড়ে, সুদূর আমেরিকার ম্যারিল্যান্ড রাজ্যে বসে, বাংলাদেশে অবস্থানরত এক পীরবাবা ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে ধ্যানে বসে প্রার্থনা করত। এভাবে কিছুদিন পর পীরের সঙ্গে আ্যন্জেলার পিতাকন্যার মতো একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল।। পীরবাবা আ্যান্জেলা’কে মেয়ে বলে ডাকতে শুরু করলেন। পীরবাবা ও পীরের স্ত্রীর ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে, আ্যন্জেলা আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল। কার্যত সে তাঁদেরকে ঈশ্বরের মতই ভক্তিশ্রদ্ধা করা শুরু করল।
সুবীর বুঝতে পারলো আ্যন্জেলা ক্রমশই ধর্মান্ধ হয়ে উঠেছে। পীরবাবা যা বলে, সে তাই অন্ধভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। অন্য কেউ তার পীরবাবাকে নিয়ে কোনো মন্তব্য করলে সে ক্ষীপ্ত হয়ে জ্বলে ওঠে।আজকাল সে সুবীরের অস্তিত্ব যেন সহ্য করতে পারছে না। ক্রমে সুদূর ঢাকায় অবস্থানরত পীর তাদের সংসারের একজন অদৃশ্য কিন্ত প্রবল শক্তিশালী সদস্য হয়ে উঠলেন।
একপর্যায়ে পীরবাবা আ্যন্জেলার কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা দাবী করলেন।সুবীরের মনে এই ভয়টাই কাজ করছিল। আমেরিকান ডলারের প্রতি অনেকেরই প্রবল আগ্রহ। শুরুতে আ্যন্জেলা কয়েকবার সুবীরকে জানিয়ে বা তার মাধ্যমেই কিছু ডলার পাঠালো। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই পীরবাবা পিতৃত্বের দাবীতে প্রতি মাসে মাসোহারা বাবদ নিয়মিত দু’শ ডলার করে দাবী করে বসলো।এরপর বিব্রত আ্যন্জেলা গোপনীয়তার আশ্রয় নিল।প্রতি মাসে পীরের নামে দু’শ ডলার করে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের মাধ্যমে পাঠাতে শুরু করল। গত তিন বছর ধরে প্রতি মাসে কখনো সুবীরকে জানিয়ে, কখনো না জানিয়েই সে অর্থ পাঠিয়েছে। সুবীর স্ত্রীর খুশির জন্য মুখ বন্ধ করে এই আর্থিক ক্ষতিও মেনে নিল।
নিরুপায় সুবীর অনুভব করছিল, তার আর আ্যন্জেলার মাঝে যেন একটি অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হচ্ছে।দেয়ালটি তাদের স্বামীস্ত্রীকে আলাদা দুই ভিন্ন জগতের বাসিন্দা করে দিয়েছে। একসময় সেই অদৃশ্য দেয়ালটি ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হয়ে উঠল। এখন সুবীর হাজার চেষ্টা করলেও দেয়ালের ওপাশের কিছুই দেখতে পায় না। পুরু দেয়ালটি ভেদ করে আ্যন্জেলার গলার স্বর, ফোনালাপের শব্দ এপাশ থেকে শোনার বা বোঝার কোনই উপায় নেই।একটা সময় তারা সম্পূর্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। সুবীর তার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসে। বিশ্বাস করে। কিন্তু পীরের প্রতি তার অন্ধ ভক্তিতে সুবীর ভেতরে ভেতরে ভীষনভাবে বিচলিত ও সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠছিল।
পীরবাবা’র নাম হিউবার্ট গোমেজ।আদিবাস নবাবগঞ্জে।তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন ঢাকার দক্ষিন মহাখালীতে। পীরের স্ত্রীর নাম জেনেভি গোমেজ। তাদের সাথে বসবাস করে তাদের তিন পুত্র। এদের দু’জন পালক ও একজন তার ঔরসজাত সন্তান। পীরের স্ত্রী দুবাইয়ে কর্মরত তার পালকপুত্র প্যাট্রিক গোমেজের জন্য আমেরিকান সিটিজেন মেয়ে খুঁজে দিতে আ্যন্জেলাকে অনুরোধ করেছিলেন। আ্যান্জেলাকে প্যাট্রিকের ফোন নম্বর দিয়ে ছেলের সাথে পরিচিত হতে অনুরোধ করেছিল পীরের স্ত্রী জেনেভি। দু’জনের মধ্যে ভাল জানাশোনা হলে পাত্রী খুঁজতে সুবিধে হবে ভেবে আ্যন্জেলাও প্যাট্রিকের সাথে গল্পগুজব শুরু করে।স্ত্রীর কাছ থেকে সুবীর জানতে পেরেছিল দুবাই থাকা পাত্রটি আগে তিনবার বিয়ে করেছে। কোনোটাই বেশিদিন টেকেনি।এখন তার ইচ্ছে হয়েছে কোন আমেরিকান সিটিজেন পাত্রীকে বিয়ে করে আমেরিকায় বসবাস করার।এসব নিয়ে আ্যান্জেলা একদিন সুবীরের সাথে কথা বলছিল। সুবীর বিরক্ত হয়ে বলেছিল, ‘আ্যন্জেলা, এমন একটি লোকের জন্য তুমি কেন মেয়ে খোঁজার দায়িত্ব নিচ্ছ? পরে কোন ঝামেলা হলে এর দায় তোমাকেই নিতে হবে। এসব বাদ দাও। তুমি প্রার্থনা নিয়ে আজকাল এত ব্যাস্ত থাকো, নিজের মেয়েটার দিকেও খেয়াল কর না।’
আ্যান্জেলা চোয়াল শক্ত করে, জেদী চোখে সুবীরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল। তারপর সুবীরের কথার কোন উত্তর না করে নিজের ঘরে ঢুকে সশ্বব্দে দরজার পাল্লাটি ঠেলে আটকে দিয়েছিল।
এদিকে সারা বিশ্ব জুড়ে শুরু হল কোভিড-১৯ মহামারি।মার্চের মাঝামাঝি আমেরিকায় শুরু হয়ে গেল মৃত্যুমিছিল।সিটি গভর্নররা যার যার নগরীতে লকডাউন ঘোষনা করলেন। ভীষণ বিষাদময় একটা সময়। সব জায়গায় লকডাউন হলেও হাসপাতালের কাজ বিরতিহীন। বরং কাজের চাপ আগের তুলনায় বেড়ে গেল। বেড়ে গেল ব্যস্ততা, বাড়লো অস্থিরতা। তাই সুবীর ও অ্যাঞ্জেলা দুজনকেই এই দুর্যোগেও কাজ করতে হচ্ছে। দীর্ঘদিন শারীরীক অসুস্থতার কারনে কর্মবিরতির পর অ্যাঞ্জেলা কাজ শুরু করেছে স্থানীয় একটি হাসপাতালে। সে কিডনি ডায়লেসিস টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করছে। করোনা ভাইরাসের কারণে রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। তাই কাজের চাপও বেড়ে গেছে। আ্যান্জেলাকেও কাজ করতে হচ্ছে করোনা আক্রান্ত রোগীদের সাথে। হাসপাতাল থেকে পর্যাপ্ত এন-৯৫ মাস্ক ও পিপিই থাকলেও রোগীর সংখ্যা দিনকে দিন বেড়ে যাওয়াতে অনেক সময় একই গাউন পরে সারাদিন কাজ করতে হচ্ছে তাদের।
প্রতিদিন সকালে তারা দুজনে এক সঙ্গেই কাজে বের হয়। ঘরে একমাত্র মেয়ে স্যান্ড্রা একা থাকে। তখন মেয়েটি ঘুমিয়ে থাকে বলে কথা হয় না। বের হওয়ার সময় দু’জনের মনেই ভয় থাকে, সুস্থতা নিয়ে ঘরে ফিরতে পারবো তো?
এঞ্জেলাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে মাঝেমধ্যে রাত দশটা এগারোটার মত বেজে যায়।প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে তারা তিনজন এখন বাড়ির তিনরুমে অবস্থান নিয়েছে। একসাথে খাওয়াও হয় না আগের মত। কথাও হয় খুব কম। কষ্ট হলেও নিরাপত্তার কথা ভেবেই এভাবেই বসবাস করতে হচ্ছিল। একই বাড়িতে থেকেও তারা তিনজন যেন বিচ্ছিন্ন তিনটি দ্বীপের বাসিন্দা।
দিনশেষে বাবা মা যখন ঘরে ফিরে আসে চৌদ্দ বছরের মেয়েটা তখন দূর থেকে তাকিয়ে দেখে। আগে ঘরে ফিরলে পাপা বলে জড়িয়ে ধরতো। এখন চাইলেও পারে না। ছোট্ট মেয়েটি মনের কষ্ট মনে চেপে রেখেই নিজের ঘরে বসে থাকে। মাঝে মাঝে সুবীর অস্থির হয়ে ওঠে। ভাবে কাজটাই ছেড়ে দিবে। কিন্তু সংসার চালানোর কথা ভেবেই আবার হতাশ হয়ে পড়ে।
বিচ্ছিন্নতার, নির্জনতার এই সুযোগে ঢাকা থেকে পীরের জোড়ালো পরামর্শ আসতে থাকে। ডাকযোগে আসে তাবিজ, কবজ, জপমালা, ধূপধূনো। পীরবাবা একসময় আ্যান্জেলাকে জানালেন, তারা ধ্যান ও প্রার্থনার মাধ্যমে মা মেরি’র সাথে সংযোগ তৈরি করেছেন। ধ্যানের মাধ্যমে তারা তাঁর আদেশ নির্দেশ পান। মা মেরি’র কাছ থেকে এমনি একটি গায়েবী আদেশ এসেছে, ‘আ্যন্জেলা’কে তার স্বামীকে ডিভোর্স দিতে হবে।’ স্বামী ও কন্যাকে ত্যাগ করে দুবাইয়ে বসবাসরত প্যাট্রিক গোমেজের কাছে চলে যাবার ঐশীবাণীটি জানালেন পীরবাবা।স্বর্গীয় বাণী অবহেলা করার কোন উপায় নেই। স্বামী-সন্তানের মায়া ত্যাগ করতে পারলে সে খুব সহজে দুনিয়াতেই স্বর্গ লাভ করবে।
পীর পরিবার ও পীরপুত্রের প্রেমে অন্ধ হয়ে স্ত্রীটি গোপনে ডিভোর্সের কাগজ তৈরি করলো। ব্যাংক থেকে ডলার উঠালো। নিজের আমেরিকান পাসপোর্ট, গয়নাগাটি, মূল্যবান পোশাক-পরিচ্ছদ গুছিয়ে নিয়ে সবার অগোচরে অদেখা প্রেমিকের কাছে ছুটে গেল আ্যান্জেলা। পেছনে পড়ে রইল তার সতেরো বছরের সংসার। স্বামী ও একমাত্র কন্যা!
কিছুটা সন্দেহ হলেও তাযে এই পর্যায়ে পৌঁছাবে ভাবতে পারেনি সুবীর। প্রার্থনার নামে ঘর বন্ধ করে থাকতো আ্যন্জেলা।ওর ঘরে ঢুকলে প্রার্থনা ব্যাহত হবে ভেবে সচরাচর আ্যান্জেলার ঘরে যেত না সুবীর। প্রার্থনা কখন যে প্রেমে রূপ নিয়েছে বুঝতেই পারেনি সে। তাই পীরের পরামর্শে যখন সব ডকুমেন্ট ও জিনিসপত্র প্যাকিং চলছিল, তাও বাড়ির অন্যদের অগোচর রয়ে গেছে।
১২ আগস্টের কোন একটা সময় আ্যান্জেলা বাসা থেকে লাগেজসহ চুপিসারে বেরিয়ে গেছে। সেদিন রাতে সে বাসায় ফিরে না আসায় সুবীর খোঁজাখুঁজি শুরু করল। কোথাও খুঁজে না পেয়ে অবশেষে পুলিশে রিপোর্ট করতে হল।আ্যান্জেলা চলে যাওয়ার দুদিন পর কোর্ট থেকে একটি ডিভোর্স লেটার এলো।
আগস্টের ১৫ তারিখে সুবীর জানতে পারল আ্যান্জেলা দুবাই চলে গেছে। তারপর দুবাই থেকে ঢাকা। ঢাকায় সে অবস্থান করছে দক্ষিন মহাখালীর পীরবাবার আস্তানায়। সে ঢাকায় নিজ বাড়িতেও যায়নি। সুবীর ও আ্যান্জেলা’র যৌথব্যাংক অ্যাকাউন্ট ট্রাক করে দেখা গেল, সে কয়েক দফায় জমানো সব টাকা তুলে নিয়েছে। ফোনকল ট্র্যাক করে খুব সহজেই বাংলাদেশে তার অবস্থান নির্ণয় করা গেল।সুবীর ও মেয়ে স্যান্ড্রা’র পাসপোর্ট ও সিটিজেনশিপের সার্টিফিকেট ঘরে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। হাতের কাছে পাসপোর্ট না থাকায় আ্যান্জেলাকে খুঁজতে সুবীরের দেশে যাবার গোপন ইচ্ছেটাও মাটিচাপা পড়ে গেল। সুবীরের ইচ্ছে ছিল দেশে গিয়ে ক্যাথলিক বিশপস কনফারেন্সে পীরের নামে বিচার দেয়া।সুবীর ভেবেছিল, বিচার দিলে ক্যাথলিক মণ্ডলি হয়তো ধর্মের নামে এই ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে।
পাপা কাজে চলে গেলে স্যান্ড্রা’র দিনের সময়টা তবুও কোনরকম কেটে যায়। কিন্তু রাতে তার খুব ভয় করে। মায়ের উপর অভিমানে বুক ভারী হয়ে আসে তার। মা তার পাঠানো ডিভোর্স লেটারে লিখে গেছে, সে মেয়ের কোন দায়িত্ব নেবে না। এটা জানার পর একমুহূর্তে মেয়েটির দুনিয়া যেন অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল।চৌদ্দ বছর বয়সের নিজের পেটের সন্তানকে ফেলে কী করে চলে গেল একজন মা? তার একটুও বুক কাঁপলো না? সতেরো বছরের এত সুন্দর করে সাজানো-গোছানো ঘরবাড়ি ফেলে যেতে মা’র এতটুকুও কষ্ট হোল না? এসব ভাবতে ভাবতে বাঁধভাঙ্গা কান্নায় স্যান্ড্রা’র চোখ ভেসে যায়।
সুবীর একদিন মেয়ের পাশে বসে, শান্তভাবে সবকিছু মেয়েকে খুলে বলতে বাধ্য হল। মেয়েকে বলতেই হল তার মা চলে গেছে। আর আসবে না বলেই।তারপর পিতা-কন্যা গলা জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদল তারা। একসময় তারা ভাষা হারিয়ে ফেললো। বাড়ন্ত এই মেয়েকে নিয়ে একা কীভাবে কী করবে সুবীর বুঝে উঠতে পারছে না। মেয়েটিও সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকে।নীরবে চোখের জল ফেলে।মেয়েটির মনে পড়ে যায় তাদের অতীতের সুখময় স্মৃতিগুলো। মনের কষ্ট প্রকাশ করতে পারে না সে। পাছে তার পাপা আরও ভেঙ্গে পড়ে।স্ত্রীর ছবির দিকে অপলক তাকিয়ে সুবীর মনে মনে ভাবে, ‘প্রভু, খুনিরও একসময় মন পরিবর্তন হয়। আর সে তো ছিল আমার ভালোবাসার মানুষ।আমার সন্তানের মা। ওর কি মন পরিবর্তন হবে না?’
এদিকে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর মেরিল্যান্ডের সব স্কুলেই ৩১ আগষ্ট থেকে ক্লাশ শুরু হয়েছে। ক্লাশ চলবে অনলাইনে, জুমের মাধ্যমে। স্যান্ড্রা এবার হাইস্কুলে উঠেছে।সে এখন নবম গ্রেডের ছাত্রী।কিন্তু তার মন খুব খারাপ। পড়াশোনায় মন বসছে না। তার পাপা কাজে চলে যায় সেই ভোরে। বাসায় সে এখন সম্পূর্ণ একা। নিজেদের বাড়িটি এখন তার কাছে ভুতুরে বাড়ি বলে মনে হয়। প্রায় রাতেই বিছানায় সে ছটফট করে। কিছুতেই দু’চোখ এক করতে পারে না। কেবল ভয় ভয় লাগে তার। বাইরে যখন তুমুল ঝড়বৃষ্টি হয়, স্যান্ড্রা’র ভয় আরও বেড়ে যায়।
মাত্র ক’দিনের ব্যবধানে তাদের জীবন কেমন উল্টেপাল্টে গেল।মাঝেমধ্যে সে ভুলে যায় মা চলে গেছে। মাকে ডাকতে ডাকতে সে মা’য়ের ঘরে চলে যায়। তারপর শুন্যঘর দেখে চমকে ফিরে আসে। ঘরটি যেন রাক্ষসের মত হা করে আছে তাকে গিলে খাবে বলে। খুব জোরে চিৎকার করে কাদঁতে ইচ্ছে করে তার। কিন্তু পাছে পাপা দেখে ফেলে, তাই অনেক কষ্টে কান্না চেপে রাখতে হয়। এখন পাপা তাকে সাহস দেবে কি, তাকেই উল্টো পাপাকে সাহস দিতে হয়। পাপা’র মেডিসিন খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিতে হয়।পোশাক খুঁজে দিতে হয়।এখন তার বেচেঁ থাকার একমাত্র আশ্রয় তার পাপা। পাপা’র একমাত্র আশ্রয় সে।
সে কোনদিন পাপা’কে উচ্চকণ্ঠে ঝগড়া করতে, চেচাতে দেখেনি। বরং সব সময় নরম সুরে হাসিমুখে কথা বলতে দেখে আসছে। প্রতি রবিবারে তারা তিনজন কত সুন্দর সেজেগুজে র্গীজায় যেতো। স্যান্ড্রা সেবিকা হয়ে বেদীতে ফাদারকে সহযোগিতা করতো। তার বাবা, মা একসাথে হাসিমুখে সামনের সারিতে বসে মিশা শুনতো। স্যান্ড্রা নিজেও খুব হাসিখুশি মেয়ে। সে জানতো ‘মিশা’ হল শান্তি বিনিময়ের সময়। বেদি থেকে নেমে সেও বাবা মার সাথে মিলে সবার সাথে কুশল বিনিময় করতো।
এরপর হয়তো সুদিন এলে তারা আবারও গির্জায় যাবে।সে ঠিকই আগেরমতই বেদীতে সেবিকা হবে। কিন্তু সামনের সারিতে তার ‘মা’কে আর হাসিমুখে দেখা যাবে না।সে তার পাপা’কে অসহায়ের মত একা দাড়িঁয়ে থাকতে দেখবে। আজ চিৎকার করে তার মা’কে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করছে, এভাবে ফেলেই যদি যাবে, তবে কেন পেটে ধরেছিলে মা?
স্যান্ড্রা’কে নাচ শেখানোর প্রবল উৎসাহ ছিল আ্যন্জেলার। মায়ের কাছ থেকেই সে সবসময় নাচের অনুপ্রেরনা পেতো। মা তাকে নিজেও কতবার নাচের মূদ্রা দেখিয়ে দিয়েছে। আজ সব কিছুই কেমন শূণ্যতায় ভরা। এই বয়সেই তাকে জীবনের কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছে। অথচ তার বন্ধুদের জীবন কত নিশ্চিন্ত। কত আনন্দময়। তাদের জলখাবার তৈরি করার জন্য, স্কুলের পড়ায় সাহায্য করার জন্য তাদের ঘরে একজন মা আছেন। তার মা তাকে ফেলে চলে গেছে; কথাটি ভাবতেই বুকের ভেতরে একটা তীব্র ব্যাথা যেন মোচর দিয়ে ওঠে। চোখে জল চলে আসে স্যান্ড্রা’র।
স্যান্ড্রা’র মনে পড়ে, মা তাকে তার নাচের ড্রেসের সাথে ম্যাচিং করে মেকআপ দিয়ে সাজিয়ে দিত। নিজের গয়না পরিয়ে দিয়ে মুচকি হেসে বলত, ‘একদম পরীর মত সুন্দর লাগছে আমার প্রিন্সেসকে।’ হাসলে তার মায়ের দুই গালে কত সুন্দর টোল পড়তো। কী মিষ্টি দেখতে ছিল তার মা। ‘মাগো, মা, তুমি কেন এভাবে আমাকে ফেলে চলে গেলে? আমি কি দোষ করেছি মা?পাপা’র সাথে রাগ করে আমাকেও ত্যাগ করলে?একবারও নিজের মেয়ের কথা ভাবলে না?
মা, আমি জানি ঈশ্বরের উপর তোমার অনেক বিশ্বাস। তাই তুমি প্রতিদিন প্রার্থনা করতে। যে লোকটিকে তুমি বিশ্বাস করে, ভালোবেসে আমাদের ছেড়ে চলে গেলে, সেকি আমার চেয়েও তোমায় বেশী ভালোবাসবে, মা?’
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..