পুষ্প-জহুর

মাসকাওয়াথ আহসান
ছোটগল্প
Bengali
পুষ্প-জহুর

খাইবার পখতুন খাওয়ার ডেরা ইসমাইল খান শহর তালিবান সন্ত্রাসীদের ভয়ে বিকেল হলেই ঘরে দোর দিতো। সারারাত ভয়ে ভয়ে ঘুমাতো মানুষ, কখন হানা দেয় তালিবান! বাড়ির একটা ছেলেকে জিহাদের জন্য কুরবানি দেয়ার প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয় যমদূত! জহুর নামের এক তরুণের তখন সদ্য বিয়ে হয়েছে। তালিবানদের পছন্দ হয়ে যায় তাকে।

তালিবান কমান্ডার তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে আদেশ করে প্রশিক্ষণে যেতে। জহুর জানায়, সে কেবল বাগানের মালির কাজ ছাড়া আর কিছুই পারে না। তার স্বপ্ন ফুল ফুটানো।

হতাশ হয় তালিবানরা। তাকে চোখে চোখে রাখে। এই ভীতির দিন রাত্রিতে জহুর আর তার স্ত্রীর সময় কাটতো। ওর বাবা-মা ঘর থেকে বের হবার সময় ওর মাথায় ফুঁ দিয়ে দিতো প্রতিদিন।

জহুর নীরবে বাগানের কাজ করতো। কিন্তু তালিবানরা কিছুতেই তার পিছু ছাড়তে চায় না। জহুর দূরে কোথাও পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। গভীর রাতে পেশাওয়ার থেকে করাচি গামী ট্রেনে উঠে পড়ে। বাবা-মা-স্ত্রী-সন্তানদের জন্য বুকের মধ্যে হাহাকার করে। ট্রেনে সামনের সিটের একটি শিশু তাকিয়ে দেখে সামনে বসা ভদ্রলোক কাঁদছে।

বাচ্চাটা জহুরের হাত ধরে বলে, আপনি কাঁদলে আমিও কাঁদবো। ট্রেনে দুদিনের লাগাতার কান্নায় জহুরের দুঃখ হালকা হয়ে আসে। করাচিতে নেমে তারিক রোডের ঠিকানা খুঁজে তাদের গ্রামের ডা আবিদ খানের বাসায় যায়। বাসাটা পাখির শূন্য বাসার মতো। স্বামী স্ত্রী থাকেন। ছেলে-মেয়ে বিদেশে থিতু হয়েছে। জহুরকে পেয়ে তারা ভরসা পায়; তারা একা নয়।

পরদিন জহুর এলাকার বাসাগুলোর বাগান আর ব্যালকনিগুলো লক্ষ্য করে। কয়েকটা কাজ জুটে যায় সহজেই। ভোর বেলা খুপরি হাতে জহুর বের হয়; তারপর বাগান থেকে বাগান; তার ফুল ফোটাতে ভালো লাগে। গাছের সঙ্গে গল্প করতে ভালো লাগে।

সে মাঝে মাঝে মানুষের উপচে পড়া টাকা-পয়সা দেখে বিস্মিত হয়। বড় বাড়ি-বড় গাড়ি-ছেলে-মেয়ে বিদেশে। দারোয়ান,মালি, কুক, চৌকিদার নিয়ে এক একজনের আলিশান জীবন। বৃটিশেরা চলে যাবার পর নেটিভরাই বৃটিশ কেতায় বসবাস করে। তাদেরকে সাহেব আর বেগম সাহেবা বলে ডাকতে হয়। তারা ধমক দিয়ে দিয়ে কথা বলে। বড় বড় পরিবর্তনের ঝান্ডা নিয়ে দৌড়ায়। সাঁঝ হলেই লিভিং রুমগুলোতে টকশো চলতে থাকে; টিভির টকশোর চেয়ে সবাই বেশি বোঝে। তারা বলে, সাংবাদিকেরা আবার কিছু জানে নাকি! আমরা অনেক ভালো টকশো করতে পারি।

কেউ ধর্ম নিয়ে বড় বড় গল্প দেয়; কীভাবে সৃষ্টিকর্তা বাসায় এসে কোলের মধ্যে ঝুপ করে সাফল্য ফেলে দিয়ে যান; সে গল্প করে তারা।

জহুর সৃষ্টিকর্তাকে খোঁজে। কৈ তিনি তো জহুরের কোলের মধ্যে কিছুই ফেললেন না। আবার সে ভাবে, হয়তো এই ফুল ফোটানোর ক্ষমতাটাই সৃষ্টিকর্তার দেয়া।

একদিন এক ব্যালকনি বাগানে কাজ করার সময় স্ত্রীর ফোন আসে। জহুরের বাবা অসুস্থ। এ খবর শুনে পাওনা আদায়ে বাড়ি বাড়ি যায় সে। সবাই বেশ ডিলেডালা করে। শেষে এক সাংবাদিক দম্পতির কাছে সাহায্য চায় সে। এরা তাকে শুরুতেই বলে দিয়েছে, সাহেব-বেগম সাহেব ডাকা লাগবে না। নো ফর্মালিটি।

জহুর কিছু টাকা ফোনের ই-পয়সা ব্যবহার করে স্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে আবার কাজে মনোযোগ দেয়।

সাংবাদিক মহিলাকে জহুর বলে, আপা ফুল খেয়ে তো মানুষ বাঁচে না; কিছু সবজি চাষ করি। খুব ইচ্ছা না থাকলেও মহিলা বলে, পেছনের ব্যালকনিতে সবজি চাষ করো; সামনের টাতে ফুলই থাকুক।

কবে গাছে পোকা নিধনের ওষুধ দিতে হবে; এই চিন্তায় ঘুম হয় না তার। রাতে ঘুমের মধ্যে গাছগুলো ডাকে, শরীর ভালো নেই; কাল একটু চেক আপ করে যেও জহুর ভাই।

ভোর থেকে মধ্যরাত অসংখ্য বাগানের শত শত গাছের সঙ্গে গল্প হয় জহুরের। মানুষের সঙ্গে মিশতে খুব একটা ভালো লাগে না। মানুষ খুব অহংকারী; ফুলেদের মতো নিরহংকার নয়।

জহুরের স্ত্রী ফোন করে, ওর বোনের বিয়ে ঠিক হয়েছে; পাত্রপক্ষকে দুই লাখ টাকার জিনিসপত্র দিতে হবে। মনটা দমে যায় জহুরের। সে জানে না কোত্থেকে এতো টাকা জোগাড় হবে।

বাগান গুলো ফুলে ফুলে ছেয়ে থাকায় ক্লায়েন্টেরা খুব খুশি। জহুর তার বোনের বিয়ের কথা জানালে সবাই আশ্বাস দেয়। ডা আবিদের বাড়ির কক্ষটিতে শুয়ে শুয়ে জহুর ভালো লাগা অনুভব করে। ইসমাইল দেরা গাজি ছেড়ে এসে সে এখন নতুন জায়গায় মালি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। শুধু একটা বিষয় ভেবে কূল কিনারা করতে পারে না; মানুষ কোত্থেকে এতো টাকা পায়! মানুষের সঙ্গে নিজের তুলনা করে পিঁপড়ের মতো ঘুমিয়ে পড়ে জহুর।

স্বপ্নের মধ্যে ভয়ে কুঁকড়ে যায়, তালিবান কমান্ডার তার মুখের কাছে ঝুঁকে এসে বলে, আমি নির্দেশ দিয়েছিলাম রক্ত ঝরাতে আর তুই বেটা ফুল ফুটিয়ে বেড়াচ্ছিস; তোকে পেয়ে নিই। স্বপ্নের মাঝে জহুর ফুল গাছের আড়ালে আড়ালে ঘুরতে থাকে। ফুলেরা বলে, ভয় পেয়ো না; আমরা এমন করে তোমাকে লুকিয়ে রাখবো; তালিবানরা তোমাকে খুঁজে পাবে না জহুর ভাই।

মাসকাওয়াথ আহসান। লেখক, শিক্ষক ও সাংবাদিক। 'শিল্পের জন্য শিল্প নয়, সমাজ-রাজনৈতিক উত্তরণের জন্য শিল্প' এই ভাবনাটিই মাসকাওয়াথ আহসানের লেখালেখির প্রণোদনা। নাগরিক বিচ্ছিন্নতার বিচূর্ণীভাবনার গদ্য ‘বিষণ্ণতার শহর’-এর মাঝ দিয়েই লেখকের প্রকাশনার অভিষেক ঘটে। একটি পাঠক সমাজ তৈরি হয় যারা নাগরিক জীবনের...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ