সাহসী চোর
অনেক যুগ আগের কথা। তখনকার দিনে এখনকার মতো আধুনিক সুযোগ সুবিধাময় আবাসিক হোটেল কিংবা মুসাফিরখানা…..
“তোমার সাথে আর থাকতে পারছিনা! ” রোজ রোজ বারবার এই একই কথা ককিয়ে ককিয়ে বলতো তনিমা। রাশেদের মাথায় আগুন ধরে যেতো কথাটা শোনা মাত্রই। নিজের উপরেও রাগ হতো প্রচন্ড রকম। একেকদিন চুড়ান্ত আশ্লেষে সময় কাটানোর পরেও বেঁধে যেতো তুমুল ঝগড়া। কথা কাটাকাটি থেকে তুলকালাম কান্ড, গায়ে হাত তোলা, মারধর। তনিমাও কম যেতো না, আঁচড়ে কামড়ে রক্তাক্ত করতো রাশেদকে। নিজের সাথে হওয়া অন্যায় নির্যাতনের শোধ তুলতে মরিয়া হয়ে অন্য কোন পুরুষের সাথে সম্পর্কে জড়াতে চাইতো। অথচ এই রাশেদের সাথেই একসময় ছিল তার কতো মধুর প্রেম। একসাথে কতো সময় তারা কাটিয়েছে, কতো ভালো সময়! সেসব যেনো গতজন্মের কথা!
তনিমা, তনিমা সাহা৷ সেনবাগ পোদ্দার বাড়ির বড় বউ। একটা ভরা ভরন্ত সংসারের কর্ত্রী ছিলো সে, দুই দুইটা ফুলের মতো কন্যা আছে তার।! আদতে আছে বলা যায় না, বলতে হয় ছিল। যে বাচ্চাদের আর ছুঁয়ে দেখার কি চোখের দেখা দেখবারও তার অধিকার নাই। কখনো সখনো পথে ঘাটে দেখা হলেও কথা হয় না। প্রেমের টানে ঘর ছেড়ে, স্বামী সন্তান সংসার ছেড়ে সে এসে উঠে চট্টগ্রাম শহরে রাশেদের বউ পরিচয় নিয়ে। আদতে কি সে রাশেদের বউ হতে পারলো!? বিয়ে তাদের কোন ধর্ম বা আচার মেনেই হয়নি৷ এক সংসার ভেঙে আরেক সংসার গড়তে গিয়ে কেবল সংসারের সং সাজাই হয়েছে তার। আর রাশেদের ঘরে রীতিমতো ধর্ম সাক্ষী রেখে বিয়ে করা বউ আছে। তবে তনিমা তার কি!? কী তাদের মধ্যে সম্পর্ক!
রক্ষিতা শব্দটা বড় ক্লিশে শোনায় হয়তো কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও কারো কারো জীবনে শব্দটা চরম সত্য, বাস্তব৷ লিভিং রিলেশনশিপ খুব ভালো বিষয় কিন্তু তার জন্য নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি আর স্বনির্ভর হবার প্রয়োজন অস্বীকার করা সম্ভব না৷ যদি তা না হতো তবে তনিমার মতো যারা তথাকথিত প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে তারা গ্লানিবোধ করতো না। তনিমারও প্রচন্ড গ্লাণি আছে, রাগ আছে, ক্ষোভ আছে! প্রতিটি দিন তার কাটাতে হয় রাশেদের অনুকম্পা মেনে। প্রতি পদে লাগে অনুমতি, লাগে কৈফিয়ত দিতে।
আজ যেমন রাশেদের সাথে কথা কাটাকাটি থেকে শুরু করে প্রচন্ড ঝগড়া আর মারধরে শেষ হয়েও হলো না শেষ! এটা তো রোজকার কান্ড, চলছেই ধারাবাহিক উপন্যাসের মতো। একেক সময় বড় অসহায় লাগে তার। কী করবে সে! কী তার করবার আছে!! রাশেদকে ছেড়ে অন্য কোথাও যদি চলে যেতে পারতো!? কিন্তু নিজের খরচই তো সে চালাতে পারে না আজও৷ রসায়নের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি তার আছে বটে কিন্তু নিজেকে চালাবার মতো যোগ্য সে হতে পারে নাই আজো!!
রাশেদ রাত করে ফেরে রোজ রোজ, কিন্তু আজ এখনো এলো না! অপেক্ষায় থাকতে থাকতে একসময় ঘড়ির কাঁটার গতির কাছে অসহায় হয়ে যায় তনিমা। রাত দুটো বাজে দেখে অল্প কিছু মুখে দেয় সে! দুদিন আগের ঝগড়ার জের ধরে রাশেদ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছে। যদিও সে তনিমার সঙ্গে সবদিন থাকে না, শহরের অন্য প্রান্ত তার সাজানো সংসার আছে।
এভাবে সপ্তাহ খানেক চলে, ঘরে থাকা মজুদ খাবার ফুরিয়ে যায় দ্রুত। হাতে তার কখনো টাকা থাকেনা যে তার হিসাব করবে।একসময় বাড়ি ফিরে রাশেদ তার হাতে টাকা দিতো কিন্তু বহুদিন হয় আর দেয় না৷ এভাবে অপেক্ষায় থাকতে থাকতে কেটে গেল আরো কিছু দিন, কিছু সময়।
এক সময় আর পারেনা তরিমা, নিজেকে আর কতো বোঝাবে৷ চোখে অন্ধকার দেখে তনিমা। রাশেদের ফোন সুইচড অফ, ফেসবুক সহ সব রকম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে ব্লক করেছে রাশেদ। কাছের বন্ধুরাও কিছু জানাতে পারেন না। মাস পেরিয়ে গেছে এভাবেই। অগত্যা শহরের এক নামী পাড়ায় রাশেদের বাবা মায়ের কাছে যায় তনিমা। নাহ বাংলা সিনেমার গল্পের গরু গাছে তোলার মতো কাহিনী এখানে নাই। রাশেদের বাবা মা যথেষ্ট ভদ্র ব্যবহারই করেন তনিমার সঙ্গে। জানান রাশেদ পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে দেশের বাইরে গেছে।!!
তনিমা উচ্চ শিক্ষিত, তনিমা ভদ্র সভ্য মার্জিত রুচির মানবিক নারী।সঙ্গে তনিমা একজন ত্রিশোর্ধ নারী, দুই সন্তানের মা। তনিমার সংসার ভেঙেছে, স্বামীর কাছে ফেরার পথ বন্ধ। যার টানে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল, টেঁকে না তার সাথে সংসার নামের সং সাজার খেলাও। সব খেলা সাঙ্গ করে পুরুষটি আরো দশটা পুরুষের মতোন ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে গেছে। আর খেলা ভাঙার খেলার এই ভাঙা হাট সামলাতে জেরবার হতে হতে ক্লান্ত আরো ক্লান্ত হয় তনিমা।
বহু কাণ্ড করে বহু হাত আর ঘাট ঘুরে অবশেষে দেশের রাজধানীতে এসে হাজির হয় তনিমা। কোন ক্রমে নিজের জীবনটা বাঁচিয়ে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে তনিমা। এক মেস বাড়িতে থেকে, বাচ্চা পড়িয়ে, আচার বড়ি পাঁপর বেঁচে কোনক্রমে প্রানে বেঁচে থাকে তনিমা। এমনই এক সময়ে হঠাৎ একদিন এই ব্যস্ত শহরের ব্যস্ত সড়কে আরো ব্যস্ত তনিমার সামনে হাজির করা হয় তনিমার মা’কে। মা চিনতে পারেন তার সন্তানকে, বুকে জড়িয়ে ধরবার মতো পরিস্থিতি বা সুযোগ বা সময় কোনটাই ঘটেনা। কিন্তু ঘটনাক্রমে তনিমা তার মেস বাড়ির আবাস গুটিয়ে হাজির হয় তার মায়ের বাড়িতে। যেখানে তার মায়ের সাথে আছেন আরো কিছু মানুষ। মায়ের বর্তমান স্বামী, তনিমার সৎ বাবা ও আরো দুইটি ভাই বোন।
তনিমার বাবার সঙ্গে তার মায়ের সম্পর্ক ভালো ছিল না কখনোই, তবুও তনিমা ও তার বোন জন্মেছিল। হিন্দু বিবাহ আইনে ডিভোর্স নামক কোন স্বস্তিদায়ক পথ খোলা নেই বলে তনিমার বাবা মা একসাথে বসবাস করতে বাধ্য ছিলেন। তনিমার বাবা একপর্যায়ে মারা যান, ধরে নেয়া হয় তিনি নিজেই নিজেকে সংসার নামক নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেবার পথ খুঁজে নিয়েছিলেন চলতি ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে। “ট্রেনে কাঁটা পড়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ জনিত কারণে মৃত্যু, “…. এরকমটাই জানে সমাজ।
সংবাদপত্রের শিরোনাম হয় এরকম মৃত্যু! কিছুদিন আলোড়ন তোলে, আলোচনার নামে চায়ের কাপে ঝড় তুলে অবশেষে ছাঁই চাপা পড়ে যায় আরো সব ঘটনার ভীরে।
তনিমার মনের গভীরেও চাপা পড়ে ছিল সেই ঘটনার স্মৃতি! হাজার হোক বাবা তো! মায়ের সংসারে নিজেকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করে চলে তনিমা। রাশেদের সাথে সংসার সংসার খেলবার সময়েও বেশ কয়েকবার বড় ধরণের গন্ডগোল লেগেছিল তার ধর্মান্তরিত না হওয়ার কারণে। নতুন পরিবেশে নতুন করে সমস্যাটা আবারও এসে দাঁড়ায় তনিমার সামনে।
তনিমার মায়ের বর্দমান স্বামী মুসলমান, তিনি মানে তনিমার মায়ের ধর্মও এখন ইসলাম। একটা মুসলিম পরিবারে হিন্দু মেয়ে যে আবার নিজের সংসার ছেড়ে এসেছে তা গলার কাঁটার মতোই বিঁধে থাকে, তনিমাও তাই হয়ে আছে।
তনিমা সংসারের কাজ করে, ভাত রাঁধে আলু কাঁটে কাপড় ধোয়। তনিমা ভাত বেড়ে পাত পেড়ে খাওয়ায় সবাইকে, তনিমা এলাকার কচিকাঁচা বাচ্চাদের পড়ায়, শাড়িতে ফল বসায়, জামাকাপড় সেলাই করে। কিন্তু থেকে থেকেই কথা উঠে সে কেন টিপ পরে! কেন সে বড় লাল টিপ পরে! কেন সে নমাজ পড়ে না! হাতে তার শাঁখা তো নেই, তবে কেন তার পায়ের আঙুলে আংটি, কেন পায়ে শব্দ করা নুপুর! সে কি জানেনা মুসলমান বাড়ির মেয়েরা শব্দ করা অলঙ্কার পরে না!? জানে না লাল টিপ চিহ্ন বহন করে বেশ্যা নারীর!!
তনিমার মায়ের বর্তমান স্বামী খান সাহেবকে তনিমা বাবা বলে না। তিনিও তাকে মেয়ে মানেন না। এতো বড় ধিঙ্গি নারীকে মেয়ে মানতে যে কোন পুরুষের ঘাড়ে চাপ পড়ে। কেননা নারীটি তার বৈধ ঔরসজাত না তো। পরের মেয়েকে নিজের কন্যাসমা ভাবতে পারে কয়জনে! যতোই কন্যাটি তার নিজের স্ত্রীর গর্ভজাত হোক না কেন।বরং মেয়েটিকে কন্যা না বলে স্ত্রীর আগের ঘরের মেয়ে বলতে তিনি স্বস্তি পান, কিন্তু মনে মনে তার অন্য খেলা চলে৷ ইসলাম ধর্মে স্ত্রীর গর্ভজাত কিন্তু অপর পুরুষের ঔরসজাত সন্তান নিষিদ্ধ সম্পর্কের আওতায় পড়ে তা খান সাহেবও জানেন বৈকি। তনিমার ভরভরন্ত শরীরের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি কি আর করতে পারেন!
খান সাহেবকে লোকে বড় ভালো লোক বলেই জানে৷ নিজের সন্তানদের ধর্মীয় আচার শিক্ষা দিচ্ছেন। আর এক বিধর্মী নারীকে বিয়ে করে তার সন্তানদেরও লালন পালন করছেন, তাদের ধর্মান্তরিত করেছেন। এ বড় সওয়াবের কাজ বটে, ধর্মে আছে। কোন মালাউনকে মুসলমান বানালে তার জান্নাত নিশ্চিত। খান সাহেব এখন কেবলই ভাবেন কিকরে তনিমাকে ধর্মান্তরিত করা যায়। স্ত্রীকে বোঝান, তোমার মেয়েকে নামাজ ধরতে বলো। জান্নাতে তোমার সাথে আমরা সবাই একসাথে থাকতে পারবো৷!!
রাশেদ দেশে ফিরেছে, করছে সংসার। খুব ব্যস্ত সময় কাটে তার। একদিন ফেসবুকে বন্ধুস্হানীয় একজনের পোস্টে দেখে তনিমার ছবি। জানতে পারে আরো দুইদিন আগে তনিমাকে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল, মানে তনিমা মৃত। ফেসবুকের নানা চেনা মানুষের স্ট্যাটাসে ঘুরে বেড়ায় তনিমার ছবি, তার বন্ধুদের সাথে বা একা হাস্যমুখের সব ছবি। যেখানে কোন গ্লানি বা কালিমা নেই৷ নেই জীবনযাপনে কোন হতাশার ছাপ বা চাপের চিহ্ন৷ তবু তনিমা আজ মৃত, তার লাশ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। কেউ জানেনা কেন সে মরে গেলো এমন অবেলায়! এমন করে কেউ যায়!?
সংবাদপত্রের খবর হয়েছিল তনিমার বাবার মৃত্যু, খবর হয় তনিমার মৃত্যুও। তনিমার ঝুলন্ত শরীর দরজা ভেঙে বের করে আনা হয়েছিল। যারা দেখেছেন তারা বলেন শরীরে রক্তের দাগ ছিল, ছিল মাথার পিছনে আঘাত আর রক্ত! কি হয়েছিল সেদিন? কি ঘটেছিল তনিমার সাথে!? আমরা কেবল জানি কিছু মানুষ আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ে জন্মায় কিন্তু নিজেকে শেষ করতে কতোটা সাহস লাগে তা জানি কয়জনে! তনিমার মতো লড়াকু একজন মানুষ কেন নিজেকে শেষ করে দেয়? কেন ঘটে এমন রাহুরদশা, কেন ঘটে পূর্ণিমায় পূর্ণগ্রাস!!
অনেক যুগ আগের কথা। তখনকার দিনে এখনকার মতো আধুনিক সুযোগ সুবিধাময় আবাসিক হোটেল কিংবা মুসাফিরখানা…..
আশ্বিন মাসের পড়ন্তবেলায় ঢাকা-মাওয়াগামী লক্কড়-ঝক্কর ‘ইছামতী’ নামের বাস, নিমতলা বাসঘাটে এসে খানিকক্ষণ থামল। গালকাটা আব্দুল…..
প্রথম পর্ব নদীর ধার দিয়ে নিত্য আমার আনাগোনা । গ্রীষ্মে দেখি শুকনো বালির বৈশাখী…..
“নিরালা” বৃদ্ধাশ্রমের দোতলার একদম শেষ ঘরটা বিদিশা আন্টির। ঘরের কোণে একটা বই ভর্তি আলমারি।…..