পূর্ব বাঙলার অসংস্কৃত জনসমাজের আবশ্যিকতা হোসেন মিয়া

ইমাম গাজ্জালী
সৌরভ মিত্র-এর প্রবন্ধ
পূর্ব বাঙলার অসংস্কৃত জনসমাজের আবশ্যিকতা হোসেন মিয়া

ভূমিকা: লেখাটি পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের একটি চরিত্রের বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সেখানে উপন্যাসটির শিল্পমান, উপন্যাস হিসেবে তার সার্থকতা, সমাজের নিন্মবর্গের একটা জনগোষ্ঠীর নিখুঁত চিত্র কীভাবে আলোকপাত করা হয়েছে, সেসব বিষয় নিয়েও আলোচনা করা হয়নি। আমরা উপন্যাসের রসাস্বাদন করতে গিয়ে সেখানকার একটি চরিত্রের উপর আমাদের আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের জনসমাজের ইতিহাসের নিরিখে চরিত্রটির ওপর আলো ফেলাই এই লেখার উদ্দেশ্য। সাহিত্য সমালোচনা হিসেবে এই লেখাটি কতটুকু সঠিক হয়েছে, সে বিচার করবেন পাঠক। এই লেখাটির চিন্তার কাঠামো তৈরি করতে বন্ধুবর মাহবুবুর রহমানের অংশগ্রহণ রয়েছে।

পদ্মা নদীর মাঝি কুবের। তার সঙ্গে সখ্যতা হোসেন মিয়ার। হোসেন মিয়া মুসলমান, বাড়ি নোয়াখালী। শুধু কুবের নয়, তার মত জেলে পল্লীর সকল মাঝির কাছে হোসেন মিয়া যেন সবজান্তা, প্রায় ঈশ্বর, অগতির গতিও বটে। কুবের-কপিলাদের ‘অন্দর মহলে’ প্রবেশাধিকার রয়েছে হোসেন মিয়ার। হোসেন মিয়া গ্রামীণ প্রভাবশালী মোড়ল নন, ব্যবসায়ী, কী সেই ব্যবসা কেউ তা জানে না।

মানিক বন্দোপধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝির উপন্যাসের পটভূমি পূর্ববাঙলা, বর্তমানের বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জনসমাজ ও তার রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বিকাশ বুঝার জন্য উপন্যাসটি আলাদা মনোযোগ দাবি করে। একটু কান পাতলেই সেখানে একটা বিশেষ পর্যায়ে বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা টের পাওয়া সম্ভব, বিশেষত হোসেন মিয়ার চরিত্রের মধ্যে। হোসেন মিয়া হলেন পূর্ববাঙলার বিকাশমান বুর্জোয়া শ্রেণির ভ্রুণাবস্থা। সেই বিবেচনায় হোসেন মিয়ার চরিত্র নির্মান মানিক বন্দোপধ্যায়ের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক কাজ। যে হোসেন মিয়াদের হাতে এখন বাংলাদেশের শাসনদন্ড। কারণ হোসেন মিয়াই চিনেছে বাংলাদেশকে, এদেশের মানুষ ও সমাজকে। বাংলাদেশকে বুঝতে হলে এজন্য হোসেন মিয়ার চরিত্র বোঝা দরকার। সেটা নিয়েই আমাদের আলোচনা শুরু করতে চাই।

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের প্রথমদিকের বড় অংশজুড়ে রাজধানী ছিল কোলকাতা। সেখানকার রাজনীতি অর্থনীতি ব্যবসা বাণিজ্য শিল্প সাহিত্য সিনেমা অবকাঠামো যে স্তরে উন্নীত হয়েছিল, পূর্ববাঙলা ছিল তার পশ্চাদ্ভূমি। আর পশ্চাদ্ভূমি সবসময় রাজধানীর সকল আয়োজনের যোগানদাতা থাকে। সেখান থেকে চুইয়ে পড়া অবশিষ্ট আলো পশ্চাদ্ভূমির ওপরতলার ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরে কখনো কখনো আসে, ততক্ষণে তার তেজও যায় কমে। কিন্তু সেখানকার অন্ত্যজজনের ঘরে আর আলো পৌঁছে না, তা না হলেও সেখানে থাকে উপনিবেশিক শাসনদ-ের প্রবল প্রভাব। এ কারণে অসংস্কৃতই থেকে যায় কুবের-কপিলাদের জেলে পল্লীর জনসমাজ, তাদের নীতিবোধ আর যৌন নৈতিকতা। সেটা তো হল পূর্ববাঙলার নীচতলার কথা। আর ওপরতলার পরিস্থিতি তাহলে কি? সেই দিকে একটু নজর দেওয়া যাক।

এদেশে ব্রিটিশদের ক্ষমতার ভিত্তি ছিল তাদেরই সৃষ্ট আমলাতন্ত্র ও তার অনুগত শ্রেণি। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয়দের একটি ছোট অংশ এই আমলাতন্ত্রে জায়গা করে নেয়। এই ছোট অংশের সিংহভাগই আবার কোলকাতা কেন্দ্রিক শিক্ষিত হিন্দু জনসমাজ থেকে আসা। সিংহভাগ না বলে প্রায় পুরোভাগ বললেও তেমন ভুল হবে না। এই আমলাতন্ত্র থেকে একটি শ্রেণি ব্যবসা বাণিজ্য ও শিল্প কারখানা গড়ে তোলার দিকে ঝুকে পড়ে। পরবর্তিতে সেই শ্রেণিটি ‘বুর্জোয়া শ্রেণি’ হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুবিধা পায়। এই আমলাতন্ত্রে পূর্ব বাঙলার জায়গা বলতে ছিল চাপরাশি পিয়ন আর্দালী কিংবা জাহাজের খালাসী পর্যন্তই। এর ওপরে তাদের তেমন খুঁজে পাওয়া যেত না। সুতরাং বুর্জোয়া শ্রেণির বিকাশের জন্য আমলাতন্ত্রের উপরের জায়গা বরাদ্দ ছিল না পূর্ববাঙলার জন্য। মানিক বন্দোপধ্যায়ের হোসেন মিয়াও জাহাজে চাকুরি করত। প্রথমে খালাসীর, পরে মালবাহী স্টিমারের কাপ্তান পর্যন্ত হয়েছিল সে।

অপরদিকে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্যদিয়ে বাঙলায় একটি মধ্যস্বত্ত্বভোগী শ্রেণি গড়ে ওঠে। কৃষকের কাছ থেকে ভূমি কেড়ে নিয়ে তার ওপর ওই শ্রেণির মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করে। ভূমির ওপর এদের কঠিন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। গ্রামীণ সমাজে এরা অসম্ভব প্রভাবশালী ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এদের বিকাশও কোলকাতা কেন্দ্রীক, এরাও ইংরাজী শিক্ষায় শিক্ষিত। এই শ্রেণি থেকে একটা ক্ষুদ্রাংশ ব্যবসা বাণিজ্যের দিকে ঝুকে পড়ে। রবীন্দ্রনাথের দাদার জাহাজের ব্যবসা ছিল। এছাড়া অনেকেই শিল্পায়নের দিকে ঝুকে ছিলেন। এই বণিক বা ব্যবসায়ী বা ‘বুর্জোয়া’ শ্রেণিটির বিকাশ কোলকাতা কেন্দ্রিক। দেশভাগের পর সেই ধারাটি রুদ্ধ হয়ে যায়, সেটা ভিন্ন কথা।

এদিকে, পূর্ব বাঙলায় এই মধ্যস্বত্ত্বভোগী শ্রেণির একটি ছোট তরফ ছিল মুসমানদের মধ্যে, তারাও খানবাহাদুর, চৌধুরী, তালুকদার ইত্যাদি খেতাব নিয়ে গ্রামীণ সমাজে ক্ষমতার ছড়ি ঘোরাতো। তবে তাদের বড় অংশই বড় জমিদারের (মধ্যস্বত্ত্বভোগী) ছোট তরফ। বড় জমিদারের ভূ সম্পত্তির কিয়দাংশের মালিকানা ছিল এদের হাতে। গ্রামীণ সমাজে মোড়লীপনা করে মানুষের সর্বশান্ত করে ছাড়ত। ষড়যন্ত্র চক্রান্ত ক্ষুদ্র স্বার্থবোধ ও লাম্পট্য দিয়ে ভরা ছিল এদের চরিত্র। নানা কূটকৌশলে দরিদ্রের জমি ও সম্পত্তি আত্মসাৎ ও তাদের নারীদের ধর্ষণ করাই ছিল এই শ্রেণির কাজ। এই শ্রেণির লোকজন নিয়ে বিস্তর সিনেমা নাটক কবিতা উপন্যাস হয়েছে। পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসে এই শ্রেণির কার্যকারিতা প্রায় অনুপস্থিত।

আমার দেখতে পাচ্ছি, হোসেন মিয়া মধ্যস্বত্ত্বভোগীর ভেতর থেকে উঠে আসা বণিক নন, ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রের গর্ভে সৃষ্ট বুর্জোয়াও নন। মাত্র কিছুদিন আগেও ছিল কর্পদকহীন নিঃশ্ব মানুষ, ঠিক কুবের মাঝিদের কাতারে। হোসেন মিয়ার ময়নাদ্বীপ নতুন স্বপ্ন নয়, উপনিবেশ। সে উপনিবেশ সা¤্রাজ্যবাদের উপনিবেশ নয়, তারই অনুকৃতি। আমাদের বিবেচনায় বাংলাদেশ এখনো ‘হোসেন মিয়ার উপনিবেশ’।

হোসেন মিয়া স্বপ্ন দেখাতে সক্ষম। মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে না জানলে তো আর তার বাণিজ্য টেকে না। এমনকি ভোটে জিততে হলেও মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে হয়। ময়নাদ্বীপই তার স্বপ্নভূমি। সেখানে কেউ স্বপ্ন তাড়িত হয়ে গিয়ে ধরা খায়, যেমন রাসু। সেখান থেকে ফিরে আসার পর দেখুন কী অবস্থা হয়েছিল রাসুর।

“তিন বছর আগে হোসেন মিয়ার সঙ্গে সপরিবারে সে যখন ময়নাদ্বীপের উদ্দেশ্যে যাত্রা করিয়াছিল দেহ তখন তাহার অবশ্য বিশেষ পরিপুষ্ট ছিল না, কিন্তু এমনভাবে ভাঙিয়াও সে পড়ে নাই। রাসুর মাথায় বড় বড় চুল জট বাঁধিয়া গিয়েছে, সর্বাঙ্গে অনেকগুলি ক্ষতের চিহ্ন, কয়েকটা ঘা এখনও ভাল করিয়া শুকায় নাই। দুটি পা-ই হাতার হাঁটুর কাছ হইতে গোড়ালি পর্যন্ত ফোলা। গায়ের চামড়া যেন তাহার আলগা হইয়া শুকাইয়া শক্ত ও কালো হইয়া উঠিয়াছিল। এখন বৃষ্টির জলে ভিজিয়া জুতার চামড়ার মত স্যাঁতস্যঁতে দেখাইতেছিল। একটু আগে বহুদূর হইতে অত জোরে হাঁক দিবার শক্তি সে কোথায় পাইয়াছিল ভাবিয়া কুবের অবাক হইয়া রহিল।”

আর অনেকে ময়নাদ্বীপে যায়, পরাজয়ের আশ্রয় হিসেবে। যেমন এক সময় হিন্দু সমাজের পরাজিতের আশ্রয় ছিল বিন্দাবন, মথুরা প্রভৃতি তীর্থ কেন্দ্র। এসব আশ্রয়ের খোঁজ করার মানে হল কুৎসিত সমাজকে মোকাবেলার দায় থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া। যুদ্ধ ময়দান থেকে পালিয়ে বাঁচা। অসহায় কুবের যখন মিথ্যা মামলায় ফেসে গেল, তার আর সাধ্য নাই, সেই মামলাকে মিথ্যা প্রমাণ করা। ঝড় ঝাপটায় সাগরের ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকে যে কুবের, সেও লড়াই করার সাহস পায় না। আর পায় না লড়াই করার আর কোনো মতাদর্শিক হাতিয়ার। তার আর সাধ্য থাকে না জীবন যুদ্ধে বীরের মত লড়াই করা। হার মানা কুবের আশ্রয় নেয় হোসেন মিয়ার ময়না দ্বীপে। অনেকে হয়ত লোভেও পা বাড়ায় ময়নাদ্বীপে। অনেকে যায় সর্বশান্ত হয়ে। ‘সকলকে হারাইয়া রাসু একদিন ময়নাদ্বীপ হইতে ফিরিয়া আসিয়াছিল, এখানে আমিনুদ্দি সকলকে হারাইয়া ময়নাদ্বীপে যাইতেছে।’ হোসেন মিয়ার ময়নাদ্বীপের সামান্যই জানত তার হদিস।

“হোসেন মিযার গোপন মতলবের দুটো একটার খবর যে জেলে পাড়ার লোকেরা রাখে না তা নয়। জেলে পাড়ার তিনটি পরিবার উধাও হইয়া গিয়োছে। হোসেন মিয়া যে ছেলে-বুড়ো স্ত্রীপুরুষ নির্বিশেষে এক একটি সমগ্র পরিবারকে কোথায় রাখিয়া আসিত প্রথমে কেহ তাহা টের পায় নাই, পরে জানা গিয়াছিল নোয়াখালির ওদিকে সমুদ্রের মধ্যে ছোট একটি দ্বীপে প্রজা বসাইয়া সে জমিদারি পত্তন করিতেছে। সে দ্বীপ নাকি গভীর জঙ্গলে আবৃত, শহর নাই, গ্রাম নাই, মানুষের বসতি নাই, শুধু আছে বন্যপশু এবং অসংখ্য পাখি।”

হোসেন মিয়া কীভাবে টাকার কুমির হল, তা কেউ জানে না। অবৈধ মাদক ব্যবসা তার রয়েছে, সে ইঙ্গিত রয়েছে উপন্যাসে। হঠাৎ করে একজন নিঃশ্ব মানুষের এভাবে ধনকুবের হয়ে যাওয়ার জন্য যে সিধা পথ নাই, তার রহস্য ভেদ করার জন্য মহাভারত রামায়ন পাঠের দরকার হয় না। ধর্মকমের ধার না ধারা মুসলমানি লেবাসের এই হোসেন মিয়া চরিত্র আমাদের দেশের রাজনীতিকদের মধ্যে পাওয়া দুস্কর নয়। তার ভাষ্য রয়েছে পদ্মা নদীর মাঝি’তে। সেখান থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি, একটু দীর্ঘ।

“একটু রহস্যময় লোক এই হোসেন মিয়া। বাড়ি তাহার নোয়াখালি অঞ্চলে। কয়েক বৎসর হইতে কেতুপুরে বাস করিতেছে। বয়স তাহার কত হইয়াছে চেহারা দেখিয়া অনুমান করা যায় না। পাকা চুলে সে কলপ দেয়, নুরে মেহেদি রঙ লাগায়, কানে আতরমাখানো তুলা গুঁজিয়া রাখে! প্রথম যখন সে কেতুপুরে আসিয়াছিল পরনে ছিল একটা ছেঁড়া লুঙ্গি, মাথায় একঝাঁক রুক্ষ চুল-ঘষা দিলে গায়ে খড়ি উঠিত। জেলেপাড়া-নিবাসী মুসলমান মাঝি জহুরের বাড়িতে সে আশ্রয় লইয়াছিল, জহরের নৌকায় বৈঠা বাহিত। আজ সে তাহার বেঁটে-খাটো তৈল-চিক্কন শরীরটি আজানুলম্বিত পাতলা পাঞ্জাবিতে ঢাকিয়া রাখে, নিজের পানসিতে পদ্মায় পাড়ি দেয়। জমি-জায়গা কিনিয়া, ঘরবাড়ি তুলিয়া পরম সুখেই সে দিন কাটাইতেছে। গত বছর নিকা করিয়ে ঘরে আনিয়াছে দু নম্বর স্ত্রীকে। এই সব সুখের ব্যবস্থা সে যে কী উপায়ে করিয়াছে গ্রামের লোক ঠিক অনুমান করিয়া উঠিতে পারে না। নিত্য নূতন উপায়ে সে অর্থোপার্জন করে। নৌকা লইয়া হয়তো সে পদ্মায় মাছ ধরিতে গেল- গেল তো সত্যই, কারণ যাওয়াটি সকলেই দেখিতে পাইল, কিন্তু পদ্মার কোনখানে সে মাছ ধরিল, মাছ বিক্রিই বা করিল কোন বন্দরে, কারো তাহা চোখে পড়িল না। তাহার নৌকার মাঝিদের জিজ্ঞাসা করিয়া একটা গল্পমাত্র শোনা গেল যে, যে বন্দরে তাহারা মাছ বিক্রয় করিয়াছে সেখানে নৌকায় যাতায়াত করিতে নাকি সাত-আটদিন সময় লাগে। তারপর কয়েকদিন হয়ত হোসেন গ্রামেই বসিয়া থাকে, একেবারে কিছুই করে না। হঠাৎ একদিন সে উধাও হইয়া যায়। পনেরো দিন, একমাস আর তাহার দেখা মেলে না। আবির্ভাব তাহার ঘটে হঠাৎ এবং কিছুদিন পর দুশ গরু-ছাগল চালান হইয়া যায় কলিকাতায়।”

একটু খেয়াল করলেই মিল পাওয়া যাবে আমাদের দেশের রাজনীতিকদের চরিত্রের সঙ্গে। কোথায় কি করছে, কেউ জানে না। জনগণ বসে থাকে নেতা কী বলে, তা শোনার জন্য। এই হোসেন মিয়ার চরিত্র সম্পর্কে আরো বলা হয়েছে

“বড় অমায়িক ব্যবহার হোসেনের। লালচে রঙের দাড়ির ফাঁকে সব সময়েই সে মিষ্টি করিয়া হাসে। যে শত্রু, যে তাহার ক্ষতি করে, শাস্তি সে তাহাকে নির্মমভাবেই দেয়, কিন্তু তাহাকে কেহ কোনদিন রাগ করিতে দেখিয়াছে বলিয়া স্মরণ করিতে পারে না। ধনী-দরিদ্র, ভদ্র-অভদ্রের পার্থক্য তার কাছে নাই, সকলের সঙ্গে তার সমান মৃদু ও মিঠা কথা। মাঝে মাঝে এখনো সে জেলেপাড়ায় যাতায়াত করে, ভাঙা কুটিরের দাওয়ায় ছেঁড়া চাটাই-এ বসিয়া দা-কাটা তামাক টানে। সকলে চারিদিকে ঘিরিয়া বসিলে তার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হইয়া উঠে। এই সব অধ-উলঙ্গ নোংরা মানুষগুলির জন্য বুকে যেন তাহার ভালবাসা আছে। উপরে উপলে গিয়াও ইহাদের আকর্ষণে নিজেকে সে যেন টানিয়া নিচে নামাইয়া আনে। না মনে মনে ইহা বিশ্বাস করে না জেলেপাড়ার কেহই। জীবন-যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের একেবারে মিলনসীমান্তে তাহারা বাস করে, মিত্র তাহাদের কেহ নাই। তবে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের জন্য কিছু আসিয়া যায় না। হোসেন মিয়া হাসিমুখে একেবারে বাড়ির ভিতরে গিয়া জাঁকিয়া বসিয়া গোপনে তাহার গভীর ও দুর্জ্ঞেয় মতলব হাসিলের আয়োজন আরম্ভ করিলেও জেলেপাড়ায় এমন কেহ নাই যে তাহাকে কিছু বলিতে পারে। বলিতে হয়তো পারে। বলে না শুধু এই জন্য যে বলা নিরর্থক। তাতে কোন লাভ হয় না। যা সে ঘটায় সমস্তই স্বাভাবিক ও অবশ্যম্ভাবী। অন্যথা করিবার জন্য বুক ঠুকিয়া দাঁড়াইলে কার কী লাভ হইবে? তার চেয়ে বর্ষাকালে ঘরের ফুটা চাল যদি একটু মেরামত হয়, উপবাসের সময় বিনা সুদে যদি কিছু কর্জ মেলে, তাই ঢের লাভ।”

আবার হোসেন মিয়ার বদমতলব সম্পর্কেও সচেতন জেলে পল্লীর অনেকে। যখন কুবেরকে কাজের প্রস্তুাব দেয় হোসেন, তখন কুবের ঠিকই বুঝতে পারে তার বদ মতলবের কথা। ‘মনে মনে কুবের ভয় পাইল। কী মতলব করিয়াছে হোসেন মিয়া? যাচিয়া কাজ দিতে চায় কেন? হোসেন মিয়ার উপকার গ্রহণ করিলে শেষ পর্যন্ত মঙ্গল নাই, কুবের তাহা ভাল করিয়াই জানে,.. .. ..কুবের একবার ভাবিল, না, হোসেন মিয়ার নৌকায় সে কাজ করিবে না।’

হোসেন মিয়ার অপকর্মেও ফিরিস্থি অনেকেই জানে, তবুও তাকে ছাড়া চলে না যেন। যেমন আমাদের দেশের রাজনীতিকদের বেলায়। তাদের চরিত্রের কলুষতা জানে পাবলিক, তবু তাকে ছাড়া যেন চলে না, ছেলের চাকুরির তদবির কিংবা নিরাপরাধ ছেলেকে থানা পুলিশ থেকে ছাড়াতে তাদের ছাড়া আর গতি কই। ভোট দেওয়ার বেলায় তাকেই দরকার। আর এর মূল্য কড়াগন্ডায় আদায় করে নেওয়া হয়। অর্থাৎ হোসেন মিয়ারা যে সমাজের ওপর চেপে বসে আছে তাই নয়, সমাজে তার আবশ্যিকতা রয়েছে। সেই সমাজের ভেতর তার তেলে-জলে নয় জলে জলে মিলমিশ। সমাজের সাধারণের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়া কিন্তু সেই সংস্কৃতির ওপর প্রভাবক স্বতন্ত্র চরিত্র রয়েছে হোসেনের।

“টাকাওয়ালা মানুষের সঙ্গে মেশে না হোসেন, তাদের সঙ্গে সে শুধু ব্যবসা করে, মাল দিয়ে নেয় টাকা, টাকা দিয়া নেয় মাল। মাঝিরা তাহার বন্ধু। অবসর সময়টা সে পদ্মার দীন-দরিদ্র মাঝিদের সঙ্গে গল্প করিয়া কাটাইয়া দেয়। টাকার ফাপানো ব্যাগ পকেটে নিয়া বর্ষার রাত্রে জীর্ণ চালার তলে চাটাইয়ে শুইয়া নির্বিবাদে ঘুমাইয়া পড়ে।”কথিত শিক্ষিতরা যেখানে মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন, সেখানে হোসেন মিয়া ঠিকই ‘জীর্ণ চালার চাটাইয়ে শুইয়া নির্বিবাদে ঘুমাইয়া পড়তে’ পারে। এ ক্ষমতা আর কারো নাই। ঠিক যেন বামপন্থী ও সুশীলের বিপরীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের চরিত্র। হোসেন মিয়াই চিনেছে কুবের ও কপিলাদের চরিত্র, অন্যরা চেনেনি। হোসেন মিয়ার বর্তমান তরফ (আওয়ামী লীগ-বিএনপি) যেমন জনগণকে (কুবের-কপিলা) চিনেছে, এ কারণেই তারা ক্ষমতায় থাকতে সক্ষম হচ্ছে, বিপরীতে তাড়া তাড়া বই পড়া পন্ডিতরা চিনতে পারেনি কুবের কপিলাদের।

দেখুন কীভাবে কুবেরদের মনস্তত্ত্ব চিনেছে হোসেন মিয়া। কুবের যখন হোসেন মিয়ার টাকা চুরি করে, তখন কুবের চিন্তা করেছিল, হোসেন তা বুঝতে পারবে না।

“কুবের তো জানিত না যে তিন টাকায় দুই আনার বেশি ফাঁকি দিবার সাহস তাহার নাই বলিয়াই হোসেন তাহাকে বিশ্বাস করে! কুবের পাঁচটা টাকা কোনদিন চুরি করিতে পারিবে না। শুধু সাহসের অভাবে নয়, দু আনার বেলায় যে বিবেক তাহার চুপ করিয়া থাকে পাঁচ টাকার বেলাই তাহাই গর্জন করিয়া উঠিবে।”

এবার দেখা যাক শিক্ষিত সামন্তীয় মেজবাবুর সঙ্গে হোসেন মিয়ার পার্থক্য।

“.. … … ভাল করিবার খেয়ালে বড়লোক কবে গরিবের হৃদয় জয় করিতে পারিয়াছে? মেজবাবু তো হোসেন মিয়া নন। দুর্নীতি, দারিদ্র্য, অন্তহীন সরলতার সঙ্গে নিচু স্তরের চালাকি, অবিশ্বাস ও সন্দেহের সঙ্গে একান্ত নির্ভয়, অন্ধ ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে অধর্মকে অনায়াসে সহিয়া চলা-এসব যাদের জীবনে একাকার হইয়া আছে, পদ্মার বুকে নৌকা ভাসাইয়া যারা ভাবুক কবি, ডাঙায় যারা গরিব ছোটলোক, মেজবাবু কেন তাদের পাত্তা পাইবেন? ও কাজ হোসেন মিয়ার মত মানুষের পক্ষে সম্ভব, মেজবাবুর চেয়ে বেশি টাকা রোজগার করিয়াও যার মাঝিত্ব খসিয়া যায় নাই।”

শেষে আলোচনার উপসংহার টানতে চাই এই বলে যে, মানিক বন্দোপধ্যায়ের নির্মিত একটি অনবদ্য চরিত্র। পূর্ব বাঙলার বিকশমান শাসক বুর্জোয়া শ্রেণির ভ্রুণ। এখনো হোসেন মিয়ারাই বাংলাদেশে রাজত্ব করছে। এখনো বাংলাদেশ হল ময়নাদ্বীপ আর ময়নাদ্বীপ হলো উপনিবেশের নিৎকৃষ্ট অনুকৃতি। হোসেন মিয়ারাই চেনে বাংলাদেশকে, তারাই চেনে কুবের কপিলাদের। তাদের অসংস্কৃত জীবন বোধের স্বাভাবিক প্রকাশ হলো হোসেন মিয়া। হোসেন মিয়া হল অসংস্কৃত সমাজের আবশ্যিকতা।

ইমাম গাজ্জালী। লেখক ও সাংবাদিক। পেশায় সংবাদকর্মী। ঢাকার একটি দৈনিকে কাজ করেন। এর আগে ছাত্রজীবনে একটি বামপন্থী দলের সার্বক্ষণিক কর্মী ছিলেন। এতদিন দেশের বিশিষ্টজনদের লেখা পড়েই সন্তষ্ট থাকতে চেয়েছেন। কিন্তু তা দিয়ে বাস্তবের হিসেব মেলাতে পারছেন না বলেই হাতে কলম...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

কলিম খান: সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠা এক অত্যাশ্চর্য্য রাজপুত্রের রূপকথা

কলিম খান: সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠা এক অত্যাশ্চর্য্য রাজপুত্রের রূপকথা [ কলিম খানের অকাল…..