প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
পেঁপের ডালনা রাঁধতে গেলেই আজিজা বানুর মনে একটা গল্প ঘুরতে থাকে। তা হলো যে পরিবার থেকে তিনি ডালনা রান্না করতে শিখেছিলেন, তাদের জীবনের খণ্ডখণ্ড চিত্রগুলো তার কাছে জীবন্ত হয়ে ওঠে। যেন সেই কয়েক বছর যাবত একটানা দেখা তাদের জীবনযাত্রাটাই সেলুলয়েড ফিতার মতো তার মনে চলতে থাকে! বহু বছর ধরে আজিজা বানু গল্প লেখেন। বহু গল্প তিনি লিখেছেন। বেশ কয়েকটি বইও আছে তার। তবু এই গল্পটি একটি পরিণত বৃক্ষের মতো অনবরত তার মনে ঝাকড়া ডালপালা নাড়ালেও লেখার জন্য এতদিনে অতটা তাগিদ অনুভব করেননি! মাঝে মাঝে মৃদু ভাবতে গিয়ে কোন দিক থেকে শুরু করবেন, কোন ডালে আগে পা রাখবেন তাই ভেবে তিনি দিশাহারা হয়েছেন ভজখট লেগে থাকা ওই পরিবারটি নিয়ে!
কারণ আজিজা বানু এখনো যেন চোখের সামনে একে একে তাদের সবাইকে সরবে চলতে-ফিরতে দেখেন নিজের বাড়ির দেড়কাঠা পরিমাণ উঠোনে! যেন তারা আজো তার সবচেয়ে নিকটবর্তী প্রতিবেশী হয়ে মুখর করে রেখেছে আঙিনা! আর আজিজা বানু যেন নিজেও কাজকর্ম ফেলে তাদের নিত্য অনটনের সংসারে ঢুকে আজো মিশ্র বোধের মায়াবী জালে সেখানে গিয়ে মাকড়সার মতো আটকে যান!
এই তো বছর ছয়েক আগে একদিন এক রাস্তায় আজিজা বানুর সাথে ওই পরিবারের কর্তাব্যক্তির দেখা। আজিজা বানুর প্রাণটা চমকেই উঠলো। তার মনে হলো, একেবারে হারিয়ে যাওয়া নিজের কারোর দেখা পাওয়া। খালু মানে ওই পরিবারের কর্তা। যাদের থেকে আজিজা বানু ডালনাটা রান্না করতে শিখেছিলেন।
পাশাপাশি থাকা একটানা অনেক বছরেও আজিজা বানুর খালুর নাম জানা হয়নি। খালুর স্ত্রী’কেও তিনি অমনি খালা ডাকতেন। আর তাই শুনে শুনে আজিজা বানুর তখনকার ছোট ছোট ছেলেমেয়ে চারটিও তাদের স্বামী-স্ত্রী দুজনকে খালা-খালু ডাকতো। আর খালা-খালুর দুই ছেলে মজিবর, হবিকে তারা মামা ডাকতো। জোছনা, রোখছানাকে আন্টি। শিমুকে অবশ্য কিছু ডাকতো না। কারণ শিমু ছিলো ওদেরই মতো শিশু। সে খালা-খালুর এক মেয়ের ঘরের নাতনি। তবে শিমুর মা’কে নিয়ে ওই পরিবারের কেউ কোনোদিন একটিও কথা তোলেনি। কেউ শিমুর মা বিষয়ে জানতে চেয়েও তাদের থেকে উত্তর পায়নি। যেন শিমু পানিতে ভেসে আসা কেউ। সে ওদের কারো থেকে জন্ম নেয়নি। তাই বলে তার প্রতি অযাচিত অনাচারও কাউকে করতে দেখেননি আজিজা বানু। জোছনা, রোখছানার সাথে সেও অধিকার বলে পেয়ে যেতো পাতে সমান খাবার। সাজবার জন্য নখপলিশ-রঙিন ফিতে থেকে ঈদের সমান সওদা। কোনো কিছু কম পড়লে তারও ছিল অভিযোগের আঙুল তোলার অধিকার।
খালুকে সেদিন রাস্তায় দেখে আজিজা বানু রিকশাওয়ালাকে রিকশা থামাতে বললেন। আজিজা বানু মুখ খোলার আগেই খালু তাকে চিনতে পেরে পুরোই হকচকিয়ে গেলো। তারপর আর বিলম্ব না করে খালু আজিজা বানুকে রিকশা থেকে হাত ধরে টেনে নামালো। জীর্ণ পকেটে হাত ঢুকিয়ে রিকশা ভাড়াটাও খালু দিতে চাইলো। কিন্তু আজিজা বানু তাকে বহু কষ্টে নিবৃত্ত করতে পারলেন।
আজিজা বানুকে তাড়িয়ে বাসায় নিতে নিতে খালু বললো, ‘আমরা এই বিল্ডিংয়ে দুইডা রুম ভাড়া নিয়া থাহি। আইছেন যহন, আপনার খালারে দেইক্খা যান…। টিনের ঘরে থাহা এহন লুকশান। তাও যুদি ওই বাড়ির সামনে একখান উডান থাকতো। তাইলে আর ওই বাড়িডা ছাড়তাম না। পরের বাড়িরতন পানি টাইন্না আর কত? আর সবতে তো আপনের মতো না। যারা আপনের বাড়িডা কিনছে, তারা তো আমাগোরে আর ডোকতেই দেয় নায়।’
যেখানে আজিজা বানু নামলেন, খালুদের নতুন বাসা সে রাস্তা থেকে দূরে নয়। এইটুকু কথা বলতে বলতে খালু বাসার কলিংবেল টিপলেন। ক্লপসিবল গেট খুলতে যেটুকু দেরি। কিন্তু পাঁচতলা বাড়ি থেকে নিচের তলার একটা অংশ খালুদের ভাড়া নেয়া সর্বসাকল্যে সে দুইরুমের ভেতর খালা কই! মজিবরকে দেখা যাচ্ছে। মজিবরের বয়স তখন পঞ্চাশের মতো হলেও, তার বয়স যেন আগের থেকে কমে গেছে! তাকে পঁয়ত্রিশের বেশি লাগছে না। ঘরে ছয় এবং চার বছরের মতো দুটি ছেলেমেয়ে। তাদেরকে দেখেই আজিজা বানুর বুঝতে বাকি থাকে না, মজিবর আবার বিয়ে করেছে। আর মজিবরের থেকে অর্ধেক বয়সী ওই চটপটে সুন্দরী যুবতীই মজিবরের চতুর্থ স্ত্রী।
খালু আজিজা বানুকে গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে তাকে আপ্যায়নের জন্য দোকান থেকে বিস্কুট ও কোমল পানীয় আনতে গিয়েছিলো। সে হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এসে আজিজা বানুর উদ্দেশ্যে বললো, আপনার খালার লগে কথা হইছে?
আজিজা বানু বললেন, না তো! খালা কই?
পাশের খাটে শোয়া শীর্ণ একটি দেহের দিকে তর্জনি উঁচিয়ে খালু বললো, ওই তো!
আজিজা বানু ওই রুমটিতে ঢুকে মজিবর ও তার বউয়ের সাথে কথা বলতে বলতে ওইখানে নজর পড়ে মনে করেছিলেন ওখানে কাঁথা-কাপড় দলা হয়ে পড়ে আছে। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখলেন, কোথায় সেই গাট্টাগোট্টা মাংসল খালা! এ তো হাড্ডির সাথে চামড়া লাগানো এতটুকু একটি দেহ পড়ে আছে। তার গায়েও ছোট একটি জামা। সম্ভবত তা তার কোনো বছর দশেকের নাতনির। আজিজা বানু ডুকরে কেঁদে উঠলেন। তিনি একটু আগেও ভাবতে পারেন নি, অন্যের জন্য তিনি এভাবে কাঁদতে পারেন। এর ভেতর ঘুমে আচ্ছন্ন খালাকে খালু ডেকে তুললো। আজিজা বানুকে দেখিয়ে স্ত্রীকে বললো, কও তো এইডা ক্যেডায়?
খালা পিটপিট করে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বললো, কেডায় আবার, পাশের ঘরের মহিলা!
খালু বললো, আরে না, ভালো কইরা দেহো, এইডা দুলালের আম্মা!
খালুর কথার পরে খালা চোখ বড় করে তাকিয়ে এক ঝটকায় উঠে পড়তে চাইলো। কিন্তু পারলো না। মাথাটা বালিশে পড়ে গেলো। কিন্তু গলা ছেড়ে কেঁদে যেভাবে পুরনো স্মৃতি বয়ান করে বিলাপ করতে লাগলো, তাতে আজিজা বানুর আরো কান্না এসে গেলো। কারণ খালাকে দেখে না চেনা গেলেও খালার কণ্ঠটা অবিকৃতই ছিলো। আজিজা বানুর তখন কত কত কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো। জীবনের অনেক ক’টা বছর গেছে তার এই খালার পাশে বসে। কোনো প্রয়োজন ছিলো না তার এই পরিবারটির কাছে। বরং তাদেরই বারবার প্রয়োজন হয়েছিলো আজিজা বানুকে। আজিজা বানু ওদের তিনজনের দিকে একসাথে চোখ তুলে জানতে চাইলেন, খালার এই অবস্থা কী করে হলো?
খালুসহ মজিবর, মজিবরের বউ সবাই সমস্বরে নিজের নিজের মতো করে জবাব দিতে লাগলো। যার সারমর্ম এই- দুইবচ্ছর ধইরা প্যারালাইসিস। হার্টের বাল্বও একটা নষ্ট…।
চোখ ও মন আর্দ্র থাকতে থাকতেই আজিজা বানুর জানা হয়ে গেলো, জোছনা, রোখছানা এবং তাদের বড় মেয়ে চামেলি ভালো আছে। জোছনা, রোখছানা ঢাকাতেই নিজের মতো করে যার যার স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসার করছে। আর চামেলি ফিরে গেছে গ্রামে। তার স্বামীরও প্যারালাইসিস হয়েছে। শেষে চামেলিকে সে বারবার খবর পাঠিয়েছে। চামেলি যায়নি। ছেলেমেয়েরা এসে হাতে পায়ে ধরে নেয়ার মতো করে তাকে নিয়েছে। কারণ চামেলির বড় মেয়ের বিয়ের সমন্ধও আসা শুরু হয়েছে।
আজিজা বানু বললেন, পরে যে বিয়ে হলো চামেলি বুজির?
খালু বললো, তার সাথেও সম্পর্কটা নটখট অইয়া উঠছিলো। শেষে আমি চামেলিরে কইলাম, আমার বাড়ির ভিডা তর টাকা দিয়া কেনোন লাগবো না। ওইডা তরে আমি এমনিই লেইখ্যা দিমু। নতুন বেডায় তরে ছাড়লে টনটনা ইজ্জত যাইবো। তারতন তুই বেডারে ছাইড়া যা! তাইলে আর তর বদনাম করনের সাহস পাইবো না। আসল কথা, ভিডাটুকের ব্যাপারে আমারতন পাকা কথা পাইয়া তারপর সে বিষধর সাপ ফিইরা দ্যাশে গ্যাছে। ওরে কি সহজ মনে করছেন খালা?
মজিবরের স্ত্রী বললো, আপা, শিমুরে দ্যাখছেন তো? শিমুরেও তার মা নিয়া গ্যাছে। নিয়া বালো বিয়া দিছে।
খালু বললো, হ! আগে তো যাত্রাপালা করতো বুইল্লা আমরা শিমুর মায়ের নামই মুখে আনতাম না। দ্যাখছেন না? এহন শিমুর সোয়ামী শিমুরে কয়, তোমার মা একজন অভিনয় শিল্পী! যদি সিনেমা-টেলিভিশনে অভিনয় করতো, তহন তোমরা তোমার মা’য়েরে নিয়া গর্ব করতা। কিন্তু যাত্রার শিল্পীও একই রকম শিল্পী।
শিমুরও কোনো বড়লোকের ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছে। শিমুর চেহারা আদতেই খুব সুন্দর। কখনো পরিবারের কারো সাথে ছলছল ডাগর চোখ দুটি মেলে তাকালে আজিজা বানু তাতে ব্যথার পদ্ম ভাসতে দেখতেন। শিমুর সেই সৌন্দর্যেই পাত্রপক্ষ নাকি খুব আগ্রহ করে তাকে নিয়েছে। সবশেষে এলো সরলার খবর। সরলার বিয়ে হয়েছে এবং তার একটি ছেলেও হয়েছে। বছর খানেক সে ছেলের বয়স। চোখ ভেজা হলেও বিদ্যুতের শক খাওয়া মানুষের মতো আঁতকে ওঠেন আজিজা বানু। খালুর দিকে তাকিয়ে বলেন, বলেন কি খালু? এই সেদিন জন্ম হলো সরলার! চোখের সামনে ভাসছে ঘটনাটা। সদ্য জন্মানো শিশুর চিৎকার শুনে আমি দোতলা থেকে হোঁচট খেতে খেতে নেমে ছুটে গেলাম। আপনাদের ঘরে গিয়ে দেখলাম রক্তমাখা সরলাকে। তখনো নাড়ি কাটা হয়নি। খালা সরলার মাকে সামলাতে ব্যস্ত। তারপর সরলার সাতদিনের দিন, কত কত বাজার করে আনলেন আপনি। আমাদেরও দাওয়াত ছিলো আপনাদের ঘরে।
দুই কেজি গোশতের ভেতর চার কেজি আলু দিয়ে খালা বিরাট এক হাঁড়িতে বাইরের চুলায় রান্না করেছিলো। সে ঝোলের স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে…।
খালু বললো, দুলালের আম্মা, ম্যাগে ম্যাগে বেইল কম অয় নাই। হিসাব কইরা দ্যাহেন! আমি যহন আপনের পোলাপাইনরে দেখছি, বড়টারও তহন সব কয়টা কইরা দুধদাঁত পইড়া শ্যাষ অয় নাই। দুলাল তহন ক্লাস ফুরে পড়ে। মনে আছে খালা, একদিন কিয়ের লাইগ্যা আপনি যাইতে পারেন নাই, আমারে স্কুলে পাডাইছিলেন ওয়্যারে আনতে? এহন আপনের চাইর পোলাপানই দ্যাশ-বিদ্যাশ নিজেগো মতো ছড়াইয়া পড়ছে। এই এলাকার মানুষ আপনাগোরে একটুও ভোলে নাই। আর আমরা কইলাম আপনেগো সব খবরই রাহি…।’
খালুর এই কথায় আজিজা বানুর কণ্ঠ নতুন করে আবার আর্দ্র হলো। বোজাকণ্ঠে তিনি বললেন, কিন্তু আসল খবরটাই জানেন বলে মনে হয় না, খালু…।
খালু চোখ তুলে আশ্চর্য হয়ে বললো, কী খবর?
আজিজা বানুর অনেকক্ষণ লাগলো কান্নার হেঁচকি গিলে গিলে বাক্যটি শেষ করতে, দুলালের আব্বা যে মারা গেছে, তাই তো জানেন না দেখছি!
ঘরের সবাই একসাথে হায় হায় করে উঠলো নতুন শোনা এই খবরে। খালাও টনটনে স্বরে কত কথা বলে যাচ্ছে। দুলালের আব্বাকে নিয়ে।
দুলালের আব্বাকে এরা সবাই দেখেছে, খালি মজিবরের এই চতুর্থ স্ত্রী ছাড়া। তাই মজিবর আর খালু একসাথে সেই বউকেই বলে যাচ্ছে, জানো, এমন মানুষ দুনিয়াতে আর অইবো না। আমরা যহন ওনাগো বাড়ির সামনের বাড়িতে ভাড়া গেলাম, একেবারে মরুভ‚মি। বাসা ভাড়া নেওয়ার আগে আশেপাশে পুকুর দেখছিলাম। ভাবছিলাম ওই পানিতে নাওয়া-ধোওয়া, রান্দনের কাজ চলবো। খাওনের পানি আর কতডুক…। পরে যাওনের পর দেহি সব পুকুর শুকনা। তহন খিলগাঁওয়ের মেরাদিয়া ওই এলাকা জুইড়া তিন চাইরডা বাড়িতে খালি পানির নতুন লাইন আইছে। খালাগো বাড়ি আর আমাগো বাড়িওয়ালার বাড়ির মাঝখানে খালি ইটের গাঁথনির একফুটের দেয়াল আছিলো। সেই সীমানা টপকাইয়া আমরা এত্তগুলা মানুষের সব পানি আনছি। খালা এট্টু মুখ কালা করলেও খালু ডাইকা কইতো, যা পানি লাগে নেন আপনারা।
আমরা তো বিল্ডিংয়ের ভেতরে থাকি, আপনারা এখান থেকে কাপড়চোপড়ও ধুয়ে নিতে পারেন। এত শান্ত মানুষ আমি আর দেখি নাই। তার নিজের বউ-বাচ্চাগো সাথে কখনো এট্টু জোরে কথা কয়নাই ক্যা। মনে অইতো তিনি নিজের বাড়িতে বেড়াইতে আইছেন।
মজিবরের বউ বলে উঠলো, তাইলে অমুন বাড়িতে ভাড়া থাকতে গেছিলেন ক্যা আব্বা, যেই বাড়িতে খাওনের পানিও নাই?
খালু বললো, বাড়িওয়ালা কইছিলো, আপনেরা থাকতে থাহেন। পানি নিয়া দিমু। কিন্তু ওয়াসার লোক যা ঘুষ চাইতো, তা দেওনের ক্ষেমতা আছিলো না আমাগো সেই বাড়িওয়ালা বেডার।
খালুর কথামতো সময়ের হিসাব করতে গিয়ে আজিজা বানুর চোখের সামনে ভেসে উঠলো, খালা-খালু যখন তার বাড়ির সামনের বাড়িতে এলো, তখন সরলার মা নতুন বউ। একখানা টিনের ঘরের একপাশে দু’জনের একখানা চৌকি। সেই চৌকি চেপে বেড়া দিয়ে রুমের মতো করে আড়াল করা। চৌকির নিচেরটুক বেড়ার বাইরে। কারণ সেখানে জিনিসপত্র, বাজার-সদাই রাখা হতো। খালারা সবাই থাকতো, বেড়ার এপাশে ঢালা বিছানায়, দিনভর যেখানে রান্নাবাড়া-খাওয়া চলতো।
খালা-খালুর সংসারে একটানা খেয়োখেয়ি লেগেই থাকতো। কারণ জোছনা, রোখছানা কোনো কাজ করতো না। শিমুসহ তারা মুখে মিষ্টি কথার ফুলঝুরি আর বুকে নতুন নতুন ভিউকার্ড নিয়ে সেজেগুজে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াতো। আর বাপ-ভাইদের থেকে টাকা চেয়ে নিয়ে সেসব ভিউকার্ড কিনে জমাতো। তাদের এসব কোমল শখের জন্য আশেপাশের বাড়ির সব ভদ্র পরিবারের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তাদের সাথে সেঁটে থাকতো। মাঝে মাঝে তাদের জোটের সঙ্গী হতো আজিজা বানুর ছেলেমেয়েও। জোছনা, রোখছানাকে তারা আন্টি বলতো। বয়সে অসম হলেও একসাথে কানামাছি-গোল্লাছুট খেলতো। ঘরে এনে একসাথে টেলিভিশন দেখতো। মগ্ন হয়ে ওদের থেকে রূপকথার গল্প, বা বাংলা সিনেমার গল্প শুনতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে। কারণ তখনও তো ঘরে ঘরে টেলিভিশন ছিলো না। কিন্তু জোছনারা তিনজন কোনো না কোনো বাড়ি থেকে ভালো ভালো অনুষ্ঠানগুলো দেখার কাজ সেরে ফেলতো।
ওদিকে সরলার মা শাশুড়ির ওপর রেগে হলেও রয়েসয়ে বলতো, আম্মা, জোছনা, রোখছানাকে ক্যান কন না কাজেকামে এট্টু হাত লাগাইতে?
খালা তখন শান্ত স্বরে বলতো, থাউক। ওগোটুক তো আমিই করি!
ক্রমে সরলার মা’রও সংসারে শেকড় গভীর হতে থাকে। সেও মাঝে মাঝে সরলাকে কোলে নিয়ে আজিজা বানুর বাসায় এসে বসে থাকতো। আজিজা বানুকে একদিন সে বললো, আপা, দেখেন, আমার শাশুড়ি তার মাইয়া গো দিয়া কোনো কাজ করায় না। আমি কিছু কইলেই কয়, অগোটুক তো আমিই করি! তয় উনি মাইয়া গো টুক করলে আমার টুক করতে পারবো না ক্যান! আপা, সব ফালাইয়া থুইয়া আইছি। করুক বুড়ি আইজ সব!
এমনি কোনো একদিন সরলার মা আরো বলেছিলো, আচ্ছা আপা কন দেহি, এই যে আমার ননদ দুইডা পয়সা খরচ কইরা নায়ক-নায়িকাগো ছবি কেনে। সে ছবি বুকে লইয়া ঘোরে। ওরা কি ওইরকম নায়ক জামাই পাইবো? বিয়া তো অইবো ভাইগো মতন, অয় কোনো অফিসের পিয়নের লগে। নইলে রিকশাওয়ালার লগে। তাইলে ক্যান আমার শ^শুর-শাশুড়ি, ওগো ভাইয়েরা ওগো ক্যান প্রশ্রয় দেয়? শিমুর মা’র কথা জানেন কিছু?
আজিজা বানু হা করে তাকিয়ে থাকে সরলার মা’র মুখের দিকে। ওদের একটা কিছু গলদ তার নিজের মনেই কু ডাকে। কারণ তিনি নিজে কয়েকবারই শিমুর মা-বাবার কথা খালা-খালুর কাছে জানতে চেয়ে ওদের চুপসে থাকতে দেখেছেন। তবু আজিজা বানুর মনে হয়, ওই পরিবারটি তার নিজের আত্মীয়ের মতো হয়ে গেছে। ওদের ভালমন্দ সবই তার গায়ে লাগে। কিন্তু রহস্যটাও উন্মোচিত হতে চাইলে বাঁধা দেন না তিনি।
আজিজা বানু মুখ খোলার আগেই সরলার মা বলতে থাকে- সুন্দর দেইখ্যা এক বেটার সাথে চইল্লা গেছিলো শিমুর মা। শ্যাষে সে বেডা ফালাইয়া থুইয়া গ্যাছে। বিয়া অইছিলো কি না, ঠিক নাই। এক রাইতে আইসা সাতদিনের শিমুরে মা-বাপের কাছে গছাইয়া দিয়া আবার আন্ধার থাকতে চইল্লা গ্যাছে। শিমুর এখন সাত বছর। এর ভিতর বাতাসের কাছেও একটা খবর পাঠায় নাই! চেহারা-সুরত বোলে ভালো। তাই যাত্রাদলে পার্ট কইরা খায়, কেউ কেউ আইসা ফিসফিসাইয়া কয়।
আজিজা বানু বললেন, তুমি জানলে কীভাবে? এসব কথা তো নিজের কেউ তোমাকে বলবে না!
সরলার মা বললো, আপার কি মাথা খারাপ? এইসব ঘটনা চাপা থাকেনি? যাগো সামনে ঘটছে, তারা কেউ না কেউ তো মাঝে মাঝে আহে। তারা মিইল্লা নিজেরাই কওয়াকওয়ি করে! আমারে দ্যাকলে চুপ অইয়া থাহে।
আর আমার ননাসে, চামেলি আপায় এই বয়সে আইসা কী কাম করলো, সেইটা দেহেন না ক্যা?
খালা-খালুর বড় মেয়ে যা করেছে, তাকে আজিজা বানু মনে মনে সমর্থন করেছেন। অন্যদের চোখে ভজখট লাগলেও, একচোখা সমাজের মুখে এই থাপ্পড়টা একটা মাইল ফলকের মতো ঠেকে তার কাছে। আজিজা বানু ভাবেন, কিন্তু সেই সংবেদনশীল মানুষ কই ছাই ঘেঁটে তুষের আগুনের মতো নারীর একান্ত কষ্টগুলো নিয়ে সুবিবেচিত রায় দেবে! তবে ঘটনাটা সমাজের উঁচু স্তরের কোনো নারী ঘটালে এটা একটা মোক্ষম খবর হতো বটে! কারণ চামেলি নারীর শক্তিকে দেখাতে পুরুষের শক্তিকে একেবারে উলঙ্গ করে দিয়েছে।
সরলার মা আজিজা বানুর চাপা আগ্রহ টের পেয়ে উৎসাহ নিয়ে বলে যায়, জানেননি আপা, আমারে বিয়ার পিঁড়িতে বসাইয়াও আমার বাপ-মা আমারে এইহানে দিতে চায় নাই। কারণ আগেরতন কয় নাই। পরে শ্যাষ সুমায় শোনে সরলার বাপের আগে বিয়া আছেলো। আমার শ^শুর ম্যালাদিন যাবত আমাগো বাড়ি এইডা ওইডা লইয়া গ্যাছে, খাইছে। ঘরে গড়াগড়ি করছে। আমারে বউমা বউমা বোলাইছে, কিন্তু শেষ সুমায়, ওনার পোলার আগে বিয়া আছিলো শুইন্যা যহন আমারে আমার বাপ-মা, ভাইয়েরা দিতে চায় নাই, শ্যাষে আমি হাঁইটা চইলা আইছি আমার শ^শুরের মুখ চাইয়া। আমার বিয়া পড়াইছে তাগো বাসায় আইনা। অথচ, আমার শ্বশুর আমার সে প্রতিদান দেয় নাই আফা! তার মাইয়ারা, নাতিনডা তিনোজন জোট বাইন্দা ঘুইরা বেড়ায়, আর আমারে দিয়া একলা ঘরের হগলডি কাজ করায়। আমার শাশুড়ি বুড়ামানুষ. রান্দন ছাড়া আর কী করতে পারে? কন আপা?’
মজিবর কোনো এক সরকারি অফিসের পিয়ন। হবি তখন রিকশা চালায়। পরে অবশ্য এক স্থানীয় মানুষের কালো শালি বিয়ে করে শ্বশুরের বাড়িঘরের ভাগ পেয়েছে। শ্বশুরের টাকায় দু’বছরের জন্য বিদেশে কোথাও শ্রম বিক্রি করতে গিয়ে আগের পরিচয়টাও ঢেকে এসেছে।
দুই ছেলের রোজগারের সাথে খালুও তখন ধানাই-পানাই টাইপের কিছু করতো। যেমন মাটি কেনাবেচার দালালদের হাতের পাঁচ হয়ে থাকা। তা না করলে অতো বড় সংসারটা একবেলা পান্তা আর দুইবেলা ডালভাত খেয়ে, তেল-সাবান ব্যবহার করে চলতো কী করে!
জোছনা আর রোখছানা তো সাবানের পরিবর্তে তখন থেকে স্যাম্পুই ব্যবহার করতো। যখন ওই এলাকায় নিজেরা বাড়িঘর করে বসবাস করা অফিসারদের ঘরেও স্যাম্পু পৌঁছেনি।
ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানায় খালুদের বাড়ি ছিলো। খালাই একদিন বলেছিলো দেশে তাদের বাড়ির ভিটাটুকু ছাড়া এখন আর কিচ্ছু নেই! একখানা মাত্র ঘর ছিলো, রাজাকাররা পুড়িয়ে দিয়েছে। আর মুক্তিযুদ্ধের আগে গ্রামে কী নিয়ে কার মামলা হয়েছিলো। খালুরও তাতে নাম ছিলো। সেই থেকে খালু পলাতক ছিলো। খালু কোথায় ছিলো পরিবারের কেউই জানতো না।
আজিজা বানু বললেন, পাকিস্তান আমলে তো অমনই ছিলো দশা। আমার তখন শিশুকাল। তাতেই দেখেছি কোনো কারণে কোনো গ্রামে একবার পুলিশ ঢুকলে দিনের পর দিন সেই গ্রামের কোনো পুরুষমানুষ বাড়িতে থাকতো না। এলোপাতাড়ি দৌড়ে বের হয়ে যেতো। রোজগেরে কর্তাব্যক্তিটি পালিয়ে থাকতে থাকতে কত পরিবার ছিন্নমূলও হয়ে যেতো। মেয়েদের বাধ্য হয়ে পতিতাবৃত্তি শুরু করতে হতো। আর এখন দেখেন কতোখানে খুন করেও আসামী পুলিশের সামনে দিয়ে বুক ফুলিয়ে হাঁটে।
আজিজা বানুর কথা শুনে খালু বলেছিলো, বিষয়ডা অতো সহজও মনে কইরেন না দুলালের আম্মা খালা। দোষ কইরাও যারা পুলিসের সামনে দিয়া ঘোরতে পারে, তারা সাজা হয়তো খাডে না, কিন্তু বাপের জমি-জিরাত বেইচ্চা পুলিসের পকেটে টাকা উঠাইয়া দেওন লাগে। তাও একবার দিলে অয় না। দিয়াই যাইতে অয়! তাই দণ্ডি হেইডাও কম না!
খালা আবার বলতে শুরু করে, ‘যুদ্ধ শুরু অইলে সব যহন একাকার অইয়া গ্যালো, জেলের তালাও খুইল্যা দেওয়া অইলো তহন আপনের খালু গিয়া বাড়িতে উদয় অইলো।’
দেশ স্বাধীন হলে খালারা সবাই একসাথে ঢাকা চলে আসে। খালা আরো বলছিলো, আপনের খালু কইছে, এইখানতন টাকা পাডাইয়া যদি দ্যাশে বইস্যা কিন্যাই খাইতে অয়, তাইলে আর গ্রামে থাহন ক্যান…।
একদিন হলো কি, পড়ন্ত দুপুরে খালা ঘরের ভেতর কাজেকর্মে ব্যস্ত। খালুসহ মজিবর, হবি যে যার মতো বাইরে। জোছনা, রোখছানা, শিমু আগে আগে খেয়ে প্রতিদিনের মতো বেরিয়ে গেছে। খালার মেয়ের বয়সী কেউ একজন উদাস সে দুপুরে ভয়ার্ত মনে ঘরের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে বললো, ও খালা, সরলার মা ওভাবে তহন থেইকা ভিজা কাপড় গায়ে জড়াইয়া খাড়ায়া আছে ক্যান? কারেন্টে ধরলোনি?
খালা বেরিয়ে এসে দেখলো, ঠিকই। সরলার মা ভিজে কাপড় হাতে ঠাঁয় দাঁড়ানো। আর তার ধরে রাখা কাপড়ের আরেক অংশ কাপড় নাড়া তারের ওপরের তারে।
খালারা যে অবৈধভাবে পাশের ঘর থেকে বিদ্যুৎ নিয়েছে, সেই বৈদ্যুতিক তার এক ঘর থেকে আরেক ঘরে নিতে কাপড় নাড়া তারের অল্প ওপর দিয়ে গেছে। সরলার মা গোসল করে পরনের শাড়ি ধুয়ে তারের ওপর ফিকে মারতেই, সে শাড়ি, কাপড় নাড়া তার পেরিয়ে ওই বৈদ্যুতিক তারে পৌঁছে গেছিলো এবং তারের সেখানে ছিলো জোড়ালাগানো। কিন্তু সে জোড়ায় স্কসটেপ লাগানো ছিলো না।
ততক্ষণে সেখানে দু’চারজন পুরুষ মানুষও জড়ো হয়ে গেছে। কেউ একজন খালার চুলোর কাছ থেকে একখানা চেলাকাঠ নিয়ে সরলার মাকে তার ভেজা কাপড় থেকে আলাদা করেছে। বাড়ির কাছে ডাক্তারের চেম্বারে নেয়ার পর ডাক্তার তাকে মৃত্যু ঘোষণা করে। অবৈধ সংযোগ যারা দিয়েছিলো, গভীর রাত পর্যন্ত সময় লাগলেও স্থানীয় তাদের সাহস ও সহযেগিতায় দ্রæত লাশের দাফন সম্পন্ন করা হয়েছিলো সেদিনই।
সংসারের প্রতিদিনের খুঁটিনাটি কলহের খবর সরলার মা’র বাপের বাড়িও গড়াতো। সেই জের ধরে তারা মামলা করার ভয় দেখিয়েছিলো, তাদের মেয়েকে এরা কৌশলে মেরেছে জানিয়ে। কিন্তু তাদের এ পরিকল্পনা হালে পানি পায়নি। কারণ কেউ তেমনটি সাক্ষ্য দেয়নি খালা-খালু ও তাদের পরিবারের বিরুদ্ধে। তবে আশপাশের জানালা দিয়ে কেউ কেউ কয়েক রাত ওদের ঘরের পিছনের উলঝুলু পোশাকে কোনো পাগলকে বসে থাকতে দেখেছে। আর তাতেই তারা ধরে নিয়েছিলো, ওটা তাহলে ডিবি পুলিশ।
সরলার বয়স তখন বছর দুই। তবু কিছুদিন পর এই সরলার কথা ভেবেই দুই পরিবারের বোঝাপড়ায় আবার সরলার মা’র ছোটবোনকে সরলার বাবা মজিবরের সাথে বিয়ে দিয়ে আনে। দু’জনের জন্য সেই পুরনো চৌকির সাথে চাপানো বেড়ার আড়ালের পাতানো বড়বোনের বিছানায় এবার ছোটবোনকে তুলে দেয়া হলো। কিন্তু এই ছোট বোনকে বউ করে আনাটা পরিবারের জন্য জ¦ালার ওপর রসুন তেলার মতো হলো। আজিজা বানু কখনো মজিবরকে সরলার মাকে মারতে দেখেন নি। কিন্তু ক’দিন না যেতেই সরলার খালাকে দমাদম মার টের পেয়েছেন। আর মারের কারণও গোপন থাকেনি। মজিবর বৌ করে আনা শালিকে মারতো আর বলতো, তরে আমি বিয়া কইরা আনছি না? তুই আমার লগে থাকবি না ক্যা? এ্যাঁ? তুই আমার লগে শুইবি না ক্যান? ইশ, কয় আবার ছোডো! এই, তরতন ছোডো মাইয়াগো বিয়া অয় না?
এরকম এক মারের সময় একদিন আজিজা বানু গিয়ে সেখানে হাজির হলেন। খালা তাকে দেখে ভীষণ বিষণœ বদনে বললো, দ্যাহেনদি দুলালের আম্মা খালা, আমার আর কপালতন ঝামেলা কমলো না। সরলার কথা চিন্তা কইরা সরলার মা’র বইনরে আনলাম, এহন নিত্যই অশান্তি করে। সে এহানে সুংসার করবো না বোলে!
কিছুক্ষণের ভেতর আজিজা বানুকে একা পেয়ে সরলার খালা, ফিসফিসিয়ে বললো, আপা, সারারাইত ধইরা আমারে করে। এই শ্যাষ অইলো, আবার ধরে। সকালে ঘুমেরতন ওডার আগে আরেকবার টাইন্যা ডুকাইয়া দেয়। আর যেদিন অফিস থাহে না, সেদিন সারাদিনই…। আমি এত্ত পারি আপা? কন!
আজিজা বানু এই প্রথম খেয়াল করলেন, বারোহাত শাড়ির ভেতর সরলার যে খালা সরলার মা হয়ে এসেছে, তার বয়স মাত্র, তের কি চৌদ্দ। গড়নও শীর্ণ। আজিজা বানু এতদিন বউয়ের ঘোমটা সরিয়ে খেয়াল করেননি। তাই আজ ওই তের-চৌদ্দ’র কথার ধরনে আজিজা বানু লজ্জা পেয়ে গেলেন। কী বলবেন বুঝতে না পেরে দ্রæত নিজের সীমানায় চলে এলেন এবং ক’দিন না যেতেই শুনলেন, সরলার খালা পালিয়ে গেছে। কাপড়চোপড় কিচ্ছু নেয়নি। খালি তিন আনা সোনার রিং জোড়া, যা তার কানেই ছিলো। আর পরনের যা কাপড় ছিলো তাই কোয়া গেছে। সেদিনই খালু তাকে তার বাপের বাড়ি কামরাঙ্গির চর থেকে ফিরিয়ে আনতে গেলে, তারা খালুকে বেঁধে রাখতে চেয়েছিলো। কিন্তু খালু অবস্থা বুঝে কৌশলে পালিয়ে এসেছে।
ঢাকার খিলগাঁওয়ের মেরাদিয়ায় আজিজা বানু তার জীবনের শুরুতেই যে বাড়ি করেছিলেন, তখনি প্রাচীর দেয়ার মতো টাকা ছিলো না। আজিজা বানুর স¦ামী তখন একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হলেও যা বেতন পেতেন, সংসারেই খরচ হয়ে যেতো। তবু ব্যাংক স¦ল্প সুদে ব্যাংকারদের লোন দেয়াতে রাজধানীর উপকণ্ঠে তিনকাঠা জমি কিনে একটি পাকা বাড়ি করার সাহস তারা দেখিয়েছিলেন।
আজিজা বানুদের তিনকাঠা জমির সীমানা রক্ষাকারী একফুট প্রাচীরের ওপাশে আরেকজনের একটি দুইকাঠার প্লট ছিলো। সেখানে তারা শুধু একখানা টিনের ঘর করে রেখেছিলো। ঘরের সামনে সিকি চিলতে উঠোন ছাড়া সে ঘরে গ্যাস পানি বিদ্যুৎ কিছুই ছিলো না। নিম্ন আয়ের কাউকে কাউকে ও ঘরে আজিজা বানু ভাড়া থাকতে দেখেছেন।
তারপর কয়েকমাস গেলে বাড়িওয়ালা এসে হম্বিতম্বি করেছেন ভাড়ার জন্য। টাকার পরিবর্তে প্রতিবারই সে ঘরের মালিক পরবর্তী কোনো একদিন টাকা পাওয়ার প্রতিশ্রæতি নিয়ে গেছেন। কিন্তু তিনি সে বাকি ভাড়াটিয়ার দেয়া সময় মতো বাড়ি ভাড়ার টাকা নিতে এসে বাড়িওয়ালা জেনে গেছেন, ভাড়াটিয়া পালিয়ে গেছে। এমন অরক্ষিত অবস্থার বাড়িটি থেকে একদিন আজিজা বানু দেখলেন তাদের কল থেকে না বলেই একের পর এক মেয়ে-বৌ এসে পানি নিয়ে যাচ্ছে। এলাকায় বাড়িঘরের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ওয়াসার সাপ্লাইয়ের পানি একসময় এমনিতে আসতো না। তাই প্রেসার কমে যাওয়ার পর ওয়াসার পাইপের সাথে চাপকল লাগানো হয়েছিলো। বেশ ক’দিন অতিবাহিত হলেও আজিজা বানু ওদের কাউকে পানি নিতে মানা করতে পারলেন না। কারণ ওদের সবারই চেহারার দিকে তাকালে মনে হয় মৃদু মায়া ঝলকে ওঠে। তাই একদিন তিনি গেলেন নিজের উঠোনটুকু পেরিয়ে সেই মজবুত কাচনির বেড়ার জানালাহীন চৌচালা টিনের মাঝারি ঘরখানাতে। দেখতে গেলেন, কারা এতো স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে কলহাস্যে বালতি-কলস ভরে ভরে অন্যের বাড়ির পানি নিয়ে যেতে পারে।
আজিজা বানু যাওয়া মাত্রই বাড়ির বয়স্ক কর্তা-কর্ত্রী অনুর্ধ ত্রিশের আজিজা বানুকে একসাথে খালা ডেকে, বসতে জলচৌকি এগিয়ে দিয়ে পরিবেশটা এত আন্তরিক করে ফেললো, যে তারপর বহুবছর ধরে তারা আজিজা বানুর বাড়ির পানিতেই চলছিলো। একফুট উচ্চতার প্রাচীর পাঁচফুট হলেও তারা পরে ঘুর পথে এসে এসে পানি নিয়ে যেতো। তারপর একসময় পুরো বাড়িটাই আজিজা বানুরা ভাড়া দিয়ে অন্যত্র চলে যান। আরো বছরখানেক পর তা বিক্রিও করে দেন। আর পুরনো বিক্রিত বাড়িতে তেমন যাওয়া হতো না! কারণ তিনি নিজে একজন কেজো মানুষ। স্মৃতির তাপ মনে মনে পোহালেও বারবার পুরনো প্রতিবেশীদের কাছে ফিরে যাওয়া সম্ভব ছিলো না।
দুই হাজার পনের সাল থেকে আজিজা বানু অস্ট্রেলিয়াতে ছেলেমেয়ের কাছে আসা-যাওয়া করছেন। একবছর থাকার পর দুই হাজারের তের অক্টোবর অস্ট্রেলিয়া থেকে রওনা হয়ে চৌদ্দ অক্টোবর দেশের মাটিতে পা রাখার পর থেকেই আবার তার তখন থেকেই ফিরে আসি আসি অবস্থা চলছিলো। এই ক’দিন আগে শেষবার নয় মার্চ অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড থেকে তার বড় মেয়ে খুকুমনি ফোন করে বললো, আম্মা, তোমার ভিসা
হইছে। ষোল তারিখের ভেতর না এলে তোমার আবার মেডিকেল চেকাপ লাগবে…!
আজিজা বানুর শ্বাসকষ্ট আছে। তিনি তাই রয়েসয়ে চলেন। তার ওপর দেশে তার বহু কাজ অসমাপ্ত। তিনি মেয়েকে বললেন, আজ নয় তারিখ। ষোলো তারিখের ভেতর কী করে যাই! আমার একটা কাপড় চোপড়ও কেনা হয়নি!
ওপাশ থেকে উত্তর এলো, এতদিন কী করছো?
: এতদিন কী করছি মানে? আগে তো ভিসা হওয়ার পর সময় পেতাম ইচ্ছে মতো যাওয়ার। তার ভেতর যা যা কেনার কিনে ফেলতাম! এবারও তেমনটি ভেবে রেখেছিলাম!
: তোমার প্রচুর কাপড় চোপড় মেলবোর্ন এবং কুইন্সল্যান্ডে আছে। আর এনে বোঝা বাড়াইও না!
আজিজা বানু ফোন রেখে দিলেন।
পেটের ছেলেমেয়ের সাথে তর্ক চলে না। কিন্তু ষোলো তারিখ কি, শেষে জানতে পারেন, বারো তারিখের টিকেট কাটা হয়েছে। সাথে যাচ্ছে তার ছোট পুত্র আরিফ। আরিফের মাল্টিপুল ভিসার মেয়াদ এখনো আছে। যা জুলাই পর্যন্ত থাকার কথা। তাই ত্বরিৎ আসতে সহজ হয়েছে।
আজিজা বানু এই যে বারবার আসেন, সেটা তার মেয়ের কাছে। কিন্তু এসে ওঠেন ছেলের কাছে। এবার করোনা ভাইরাসে জন্য এসেই দুই সপ্তাহ প্রায় বাধ্যতামূলক আটকে পড়া। মানে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা। তারপর তো লকডাউন। মেলবোর্ন থেকে কুইন্সল্যান্ডের ফ্লাইট অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ।
আজিজা বানুর নিজের থাকার বিষয়ে ছেলে বা মেয়ের কাছে থাকা নিয়ে কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই। সেই প্রথমবার অস্ট্রেলিয়া আসার আয়োজন করতে করতে গুনগুন করে ক’দিন নিজের অজান্তে রবি ঠাকুরের গানের ভেতর থেকে এইটুকুু অংশ তার মন আপনা আপনিই গাইতে শুরু করেছিলো, ‘পথ আমারে সেই দেখাবে যে আমারে চায়/ আমি অভয় মনে ছাড়ব তরী এই শুধু মোর দায়…।’ কিন্তু তিনি টের পেয়েছেন, এই আসা যাওয়া করতে করতে তার মনের স্থিরতা নষ্ট হয়ে গেছে। একজন লেখালেখির মানুষ হিসাবে জীবনের এই সময়টা তার সৃষ্টিতে ভিন্নমাত্রা আনতে পারতো। কিন্তু তিনি যাওয়া-আসার এই দীর্ঘ পথের বৈচিত্র আত্মস্থও করতে ব্যর্থ। না হলে এতে করে তার লেখালেখিতে উৎকর্ষই আসার কথা ছিলো। তা না আসার কারণ তিনি জানেন বলে নিজেকে ক্ষমা করে দেন। আর সেটা করেন, তিনি একই সাথে অনেক কিছু করতে চান বলে। করেনও। তাই তিনি জানেন, একসাথে সব করতে চাওয়া মানুষের লাগসই কিছুই হয় না। তাই কেউ তার গুণের তারিফ করলে নিজের সম্পর্কে বলে দেন, আমি হচ্ছি ‘না ঘরকা, না ঘাটকা!’ এক প্রদীপের তেল যে দশ সলিতায় পোড়ায় সে আর কতদূর যাবে! না হলে নিজের কাজকে প্রাধান্য না দিয়ে এভাবে বারবার ছুটে আসিই বা কেন!
আজিজা বানুর বন্ধু কবি শেলী সেনগুপ্তা তাকে বলেছেন তুমি যা করো, সেটা আত্মঘাতী মানুষের কাজ। একজন সৃষ্টিশীল মানুষ নিজের সৃষ্টিশীলতার বিরুদ্ধে যায়, এমন কাজ কখনো করেন না। অথচ তুমি বারবার তাই করো!
শেলী সেন আরো বলেছেন, তুমি আমাকে দেখো! আমাকেও কানাডাতে আমার মেয়ে-জামাই ডাকে। ধরে রাখতে চায়। আমি মাঝে মাঝে যাই বটে। কিন্তু থাকি না, ছুটে চলে আসি!
শেলী সেনগুপ্তার কথার উত্তরে আজিজা বানু বলেন, আরে আমি তো তোমার মতো শিল্পনিষ্ঠ মানুষ নই! আমি শুরু থেকে মা দুর্গা হতে চেয়েছিলাম। তাই তো প্রদীপের নিচের অন্ধকার ছাড়া কিছু হলাম না! আর এখন আমার নিজেকে মনে হয় ছাই ফেলতে ভাঙাকুলো। তাই বিনাশ হতে হতে কেউ যদি কাজে লাগাতেই পারে, লাগাক না! আর সে কাজ যদি সন্তানের কাজ হয়।
এবার ছেলের বাসায় থাকতে ক’দিনই পেঁপের ডালনা রাঁধতে গিয়ে আজিজা বানু স্বগোক্তি করতে থাকেন, মাছে সবজি দিলে আরিফ খাবে না। তাই পেঁপে দিয়ে ডালনা-ই রাঁধলাম। কারণ প্রতিদিন যে কোনো একটা সবজিও তো সবার খেতে হবে!
নিজেকে শোনানোর জন্য নিজে বলতে বলতে লকডাউনে থেকে ঘরে অফিসের কাজে ব্যস্ত বউমাকে বলেন, এই পেঁপের ডালনা যতবার রান্না করি, সেই পুরো পরিবারের ভেতর ততবার আমি নতুন করে ঢুকে যাই। যে এই ডালনা যে রান্না করতো, তাকে আমি খালা ডাকতাম। তখন ত্রিশের মতো বয়স আমার। তাই মায়ের বয়সী সে খালার ভেতর আমার জন্য একটা মা মা বোধ তো কাজ করতো। আর আমার খালা ডাকা দেখে তোমার শ^শুর থেকে আমার ছেলেমেয়ে সবাই তাকে খালা ডাকতো। তার স্বামীকে খালু ডাকতো। তাদের ছেলেমেয়েদের আন্টি-মামা। এই নিয়ে প্রায়ই ওদের আশপাশের মানুষেরা হাসাহাসি করতো! বলতো, মায়-বাপেও যা কয়, পুলাপাইনেও তাই কয়।
খালারা মাছ-মাংস তেমন একটা রান্না করতো না! এই পেঁপেই প্রায় প্রতিদিন ডাল দিয়ে পানি পানি করে রান্না করতো। ওড়ং দিয়ে নেড়ে নেড়ে বেশ অনেকক্ষণ জ¦াল দিয়ে রান্না করতো।
আজিজা বানুর বউমার নাম ইফা। ইফা অবাক চোখে তাকিয়ে বললো, ওড়ং কি?’ যেন এতক্ষণ শাশুড়ি যা বলেছে, সবই সে তার শ্রুতিযন্ত্র থেকে পরিহার করে চলেছে। শুধু ওড়ংটা মাথায় লেগেছে।
: ওড়ংকে একেক জায়গার মানুষ একেক নামে চেনে। এটা হচ্ছে নারকেল দুইভাগ করলে কেমন হয়, দেখেছো?
: দেখেছি!
: ওই নারকেল কুরিয়ে নেয়ার পর শক্ত বাটির মতো থাকে না?
: থাকে!
: ওই বাটির ভালো খণ্ডটা লাগে ওড়ং বানাতে। আর ওই ভালো বাটিতে ওপরের দু’দিকে দু’টো ছিদ্র লাগে। এখন ওই ছিদ্র করার জন্য দেয়াল ছিদ্র করা ড্রিল মেসিন থেকে অনেক কিছুই এখন পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের ছোট বেলায় নারকেলের ওই মালা বা বাটির দুইপ্রান্তে দুটো ছিদ্র করতে, রান্নার সময় মহিলারা লোহার সূঁচালো কিছু চুলায় ঢুকিয়ে রাখতো। তারপর বারবার সেই লাল হয়ে যাওয়া দগদগে সূঁচালো জিনিসটি বাটিটার একপাশ একপাশ করে দুপাশে দুটো ছিদ্র করতো। তারপর বাঁশের চটা ছেঁচে গোল করে, ধরার জন্য লম্বা হাতল বানাতো।
: লম্বা বানাতো কেন?
আগে তো সবাইকে লাকড়ির চুলোয় রান্না করতে হতো। তাই হাতে আগুনের আঁচ যেন কম লাগে। এখন অবশ্য মহরে ওড়ং নেই। থাকলেও যারা গ্যাসে রান্না করে, তারা হাতল ছোট বানায়। আর এখন বিভিন্ন মেলায় দেখেছি, কারুশিল্পীরা নকশা টকশা করে বানায় বড়লোকের মন ভোলাতে। সময়ের বিববর্তনে সবকিছুরই ধরন পাল্টায়। প্রকৃতিই পাল্টে যায়!
: তাই তো!
: ওই ওড়ং বানানোর আগে ভালো করে দা দিয়ে ছেঁচে, মানে মসৃণ করে নিতে হতো নারকেলের মালাটা। আর সূঁচালো যে জিনিসটি ব্যবহার করতো, মালাটা, মানে নারকেলের বাটিটি ছিদ্র করতে, তা ওই দায়ের আছাড়ি খুলে, দায়ের সূঁচালো দিকটি পুড়িয়ে ব্যবহার করতো। ওড়ং সংসারের খুব একটি প্রয়োজনীয় জিনিস ছিলো! আমাদের ছোটবেলায় তো অনেক ঘরে চামচ-ই ছিল না! পিতলের দু’একখানা থাকলে তা তুলে রেখেছে। মেহমান এলে বের করা হতো!
: এবার তোমার সেই তুলে রাখা গল্পটা বলো, যা এতক্ষণ বলছিলে?’ কম্পিউটার থেকে চোখ না তুলেই ইফা বললো।
আজিজা বানু বললেন, তুমি শুনছো জানলে তো ভালো করে বলতাম। তিনি আবার বলতে শুরু করেন, খালাকে একদিন বলেছিলাম, খালা প্রতিদিন কেন পেঁপে দিয়ে ডাল রান্না করেন?
খালা বলেছিলো, খারাপ তো নাগে না রে মা! পিত্তিদিনই নতোন সোয়াদ নাগে।
আজিজা বানু চোখ দু’টি ইফার দিতে তুলে বললেন, জানো, খালার কথায় আমি লজ্জা পেয়েছিলাম। কারণ হাদিসে আছে, যারা হালাল রুজি খায়, তারা যা-ই খায়, তাই তাদের কাছে সর্বোত্তম স্বাদ লাগবে। তাই সারাদিনের পরিশ্রমের পর যত্ন করে যে যা রাঁধবে, স্বামী-ছেলেমেয়ে নিয়ে খেতে বসে তাদের কাছে তো তাতেই পরম তৃপ্তি লাগবে!
কিছুক্ষণ দম নিয়ে আবার তিনি বলতে শুরু করলেন, আরো কী হতো জানো, আমি প্রায়ই প্রায়ই খালার থেকে ওই ডাল চেয়ে নিয়ে আসতাম! কিন্তু আশ্চর্য, খালারা কেউ কিন্তু আমার কাছে কোনোদিনই কিছু চায়নি। আমি নিজে থেকে কিছু দিলেও যে তারা বর্তে গেছে, এই ভাবটাও তাদের কারো মধ্যে আমি দেখিনি! আমার মনে হয়, তাদের সাথে আমি আজো যে একাত্মতা বোধ করি, তা ওইটুকুতেই ঝুলে আছে। হয়ত তাদের সাথে আমার আর দেখা হবে না। খালার তো বেঁচে থাকার কথা নয়। খালুও এতদিন আছে কি না! বাকি যারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, কী জানি আর কোথাও কোনোভাবে দেখা হবে কি না!
: তোমরা তো পুরো পরিবারের জন্য পানি দিতে, সেটাই কম কি!
: আওে, পানি তো আরো কতজনকে দিতাম। সারা এলাকায় তিন-চারটে বাড়িতে মাত্র একসাথে সাপ্লাইয়ের পানি এলো, অন্য সবাই কীভাবে কলে তালা দিয়ে রাখতো। আমরা তো ওসব ভাবতেই পারতাম না। একসময় বাউন্ডারিও করা হলো। তখন পানি নেয়া ওইসব মানুষের গেট ধাক্কানো শুরু হলো। এমনি অধিকার হয়ে গেছিলো সবার।
বউমার আর প্রশ্ন করার কিছু নেই। সে তার কাজে মন দেয়। শাশুড়িকে মৃদু হেসে স্মরণও করিয়ে দেয়, এখনি তার অফিসের সাথে মিটিং শুরু হবে। কিন্তু আজিজা বানু থামেন না। বলেন, দুলালের যখন ছয় বছরের মতো বয়স, তখন ও আমাদের ছাদে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিলো, ওরকম পানি নেয়া বাড়ির এক ছেলে এসে ঘুড়িটা কেটে নিয়ে গেলো। আর তাতে তোমার শ্বশুরের সে কি কষ্ট ছেলের কান্না দেখে। আর আমার ছেলের সেই হাউমাউ কান্নার রেশটা আমারও মন থেকে এত বছরে মুছে যায়নি। বোঝো তাহলে দুর্মূল্যের পানি দিয়ে কী কষ্ট কিনেছি আমরা!
আজিজা বানু থামলেই যেন গল্পের সূত্র ছিঁড়ে যাবে। তিনি থেমে থেমে বলতে থাকেন, খালাদের পরিবার থেকে একটা বিষয় আমি মনের ভেতর আলাদা করে রাখছি। এটার ঝুলি আমিও যখন-তখন খুলি না। শুধু একাকী সময়ে দৃশ্যগুলো ঝাঁপিতে পুতুলের মতো সাজাই!
ইফা কম্পিউটার থেকে চোখ তুলে শাশুড়ির দিকে খালি এক ঝলক তাকায়। তাতেই আজিজা বানু আরেকটু জোরে শুরু করেন। একদিন বাড়ির উঠোনে নেমে খালাদের ঘর থেকে নতুন মানুষের কণ্ঠ শুনে আগ্রহ নিয়ে দেখতে গেলাম। দেখি খালা কাঁথা সেলাই করছে। সাথে আরেকজন যে সেলাই করছে, তার শরীরে রোদে কহর পড়ে গেছে। পরিশ্রমের চোটে শরীরের এতটুকু তেলতেলেভাব দূরে থাক, মাংসে টান ধরেছে। মহিলার কণ্ঠেও প্রচণ্ড গ্রাম্য ঝাঁঝ। একবাড়িতে দাঁড়িয়ে আরেক বাড়ির মানুষের সাথে ঝগড়া করা মানুষের মতো। যারা পরে স্বর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না! ঘরে না ঢুকে বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে খালাকে বললাম, খালা, উনি কে?
খালা কাঁথা থেকে চোখ না তুলেই উচ্ছ¡াসহীন কণ্ঠে বললো, আমার বড় মাইয়া!
আজিজা বানু আশ্চর্য কণ্ঠে বললেন, কই, এতদিনে একবারও তো বলেননি, আপনাদের আরেকটা মেয়ে আছে?
আজিজা বানুর কথার পরে মহিলাটি সেলাই থেকে মুখ তুলে বলে উঠলো, ওই দেহো, আমি কি আর খালি খালিই কই, আমি অইলাম, আমার মা-বাপের হিসাবের বাইরের। আমার নামডাও এরা কেউ কারু কাছে কয় না! আমি যে তাগো আরেকটা সুন্তান আছি তাও কয় না। তাও সবতের বড় আমি। মাইনষে কয়, বড়ডার দরদ বেশি। আর আমার কপালে মা-বাপের পক্ষেরতনও খালি ছাই!
আজিজা বানু খালার বড় মেয়ের পক্ষ হয়ে বললেন, আসলেই তো তাই! খালা-খালু না হয় না বলেছে, জোছনা, রোখছানাও তো কখনো বলেনি, আমার বড়বোন আছে! এমনিতে দেখি ছোটবেলার কতো স্মৃতি ঘাটে!
খালার বড় মেয়ে এবার খালার উদ্দেশ্যে বললো, ও মা, আমার মনে লয়, তুমি আর বাবায় তোমাগো বিয়ার আগেই ভালবাসা কইরা আমারে প্যাডে লইছিলা, তাই তো আমার নামডা তোমরা শরমে কারু কাছে লও না।
আবার কেন আছি এট্টু খোঁজও লও না। জাগায় জাগায় ভাড়া থাহো, ঠিকানাও দেও না, আইতেও কও না। এর লাইগ্যাই তো তোমার জামাই গোলামের পুত আমারে মার্ইরা-দর্ইরা হাড্ডি-মাংস এক করার সাহস পায়!
খালা সেলাই রেখে এবার আজিজা বানুর দিকে তাকায়। বলে, খালা, শোনেন, মুক্তিযুদ্ধ লাগনের বছরখানিক আগেরতন আপনের খালুর কুনো খুঁজ নাই। পলাইয়া বাঁইচ্চা ছিলো কি মরছে, তার কুনো ঠিক আছিলো না। এরই মইদ্যে এই মাইয়াডা ডাঙ্গর অইয়া উঠছে, একজনে তার পুলার লাইগা ওয়ারে চাইলো, আমিও দিয়া বাঁচলাম। তহন বালোমন্দ দেহনের আমার ফোসরত আছিলো, কন? আর তহন তো বাড়ির কাছের উঠতি বয়সি পোলা, বাপের অবস্থাও বালো। ঘরের ধানের ভাত খায়। বালোই দেখছালাম!
আজিজা বানু বলেন, ঠিকই। মায়েদের অনেক জ্বালা। আপনার জ্বালা আমি বুঝি খালা। কিন্তু তাই বলে কখনো গল্পচ্ছলেও সন্তানের নাম মুখে আনবেন না এইটা ঠিক হয়নাই?
খালার এই বড় মেয়ের নাম চামেলি। তার কণ্ঠও বড়ই বাঁজখাই!
আজিজা বানু মনে করেছেন, এতক্ষণ তিনি একাই বলে যাচ্ছেন। কিন্তু তার বউমা শুনছে না। কিন্তু ইফা কম্পিউটার থেকে চোখ না তুলেই বললো, বাঁজখাই কি?
আজিজা বানু বলেন, বাঁজপাখির ভয়ঙ্কর অবস্থা বোঝাতে শব্দটার ব্যবহার বোধহয়। অভিধান থাকলে তোমাকে বলতে পারতাম। কিন্তু অভিধান একখানা দেশে, আরেকখানা কুইন্সল্যান্ডে খুকুমনিদের বাসায়। আচ্ছা আমি পরে একদিন তোমাকে নিশ্চিত করবো, এটার আসল মানে কি!
ইফা বুঝতে পারে, শাশুড়ির কাছে থাকলে এই গল্প শোনা থেকে নিস্তার নেই। সে ল্যাপটপ নিয়ে ওপরে নিজের রুমে চলে যায়। আজিজা বানু বুঝতে পারেন, বউমার অফিসের মিটিং…। কিন্তু আজিজা বানু এবার নিজের মনে বলা নয়, এবার যেন সেই পুরনো স্মৃতির ভেতর ঢুকে বিচরণ শুরু করলেন, সেখানে জমলেন শুধু সেই চামেলিকে নিয়ে। খালার সেই বড় মেয়ে, যে তার সব ভাইবোনের বড়, সে তার মাকে কী অবলীলায় বলে উঠলো, মা তুমরা জানো, তুমরা আমারে কুন আগুনের ফালাইয়া আইছো? এই যে তুমরা এই বয়সে আইয়াও এ্যাহনো সকালে গুছোল করো। আর যে বেডার লাগে বিয়া দিছো, সে আর বচ্ছর কাতিমাসে এক শ্যাষ রাইতে আমার ধারে আইছিলো। আর সেই রাইতেই ওই মাইয়াডা প্যাডে আইছে।
ওয়ার বয়সও দশ মাসে পড়লো, ব্যাডায় আর আমার কাছে আহে নাই! পেত্যেকটার বেলায় ওই অমনই!
আজিজা বানু চামেলির কথা শুনতে শুনতে চমকে উঠেছিলেন। মা’য়ের কাছে কেন, জগতে কারো কাছে এই কথা বলা যায়, এটা তিনি আগে জানতেন না!
চামেলিকে আজিজা বানু তবু শেষ পর্যন্ত অশ্রদ্ধা করতে পারে না! বোঝাই যায়, চামেলি পরিশ্রমী। পাঁচ ছেলেমেয়ের মা সে। বয়সে আজিজা বানুর বেশ একটু বড়ই হবে। আজিজা বানু বোঝেন, ছেলেমেয়ে হতে তো আর বয়স লাগে না। ঋতু হওয়ার পর থেকে সময় মতো বীজ পেলেই জরায়ু তা ফোটাতে শুরু করে। চামেলির আরো দুঃখ আছে, তার ছেলেমেয়েরাও তার সাথে কুকুর-বেড়ালের মতো নাকি ব্যবহার করে।
এর কারণ একদিন চামেলি নিজেই বললো আজিজা বানুকে। বললো, বোঝছেন আপা, পোলাইপানের সামনেই পোলাইপানের বাপে আমারে কথায় কথায় ধইরা ধইরা মারে। আবার তারা এও দ্যাহে, আমার বাপের বাড়িরতন কেউ আমার খুঁজ-খবর করে না। আর যদি আমার কেও থাকতো, বা আমার নামে দুইকাডা জমিন থাকতো, তাইলে পোলাপাইনে অন্তত আমারে দাম দিতো।
চামেলির চেহারাটা খালার অন্যান্য ছেলেমেয়ের মতোই বেশ ভালো। মায়াময়। তবে তার হাত-পা ফাটা ফাটা। শরীরের রঙও রোদে ঝলসানো। তার স্বামীর বেশ কিছু জমিজমা আছে। তার স্বামী নাকি কামলাসহ ফসলটা শুধু জমি থেকে উঠান পর্যন্ত এনে ফেলে। তারপর তা পিটিয়ে, মলন মলে একাই চামেলিকে ঘরে তুলতে হয়। লোকটা তারপরও নাকি আরেকটা বিয়ে করতে চায়।
আজিজা বানু ফস করে জিজ্ঞেস করেন, ‘তাহলে আপনি যে বলেন, রাতে আপনার কাছেই আসে না?’
: সুংসার বলাইবো। বুঝচ্ছেন দুলালের আম্মা আফা! আরেকজন থাকলে বেশি কইরা হাঁস-মুরগি, গরু বাছুর পালবো। এক জায়গায় বিয়া একটা ঠিকও করছোলো। আমিও সায় দিছিলাম। কইছিলাম, করো! শ্যাষে সে মাইয়াওয়ালারা আমার মত দেইক্খা আমারে কয়, কাবিনে আপনে সই করবেন, যে আপনে আনতেছেন! শ্যাষে আমি তাগোরে কইলাম, হ্যায় বিয়া করবো, আমার কোনো আপিত্তি নাই। তয় আমি কোনো সইটই করতে পারমু না! হেরপর তারা কইলো, তয় মাইয়া দিমু না।
আমি আবার হ্যাগোরে কইলাম, হোনেন আপনেরা, মানুষ নতুন কাপুড় ঘরে থুইয়া কি আর পুরান কাপড় পেন্দে? তাই যে বেডা বিয়া করতে চায়, সে আর পুরানা বউয়ের কাছে ফিরবো না নতুনডা থুইয়া। তাই দেন আপনেরা আপনেগো মাইয়ারে। কিন্তু তারা আর দেয় নাই!
আজিজা বানু অবাক হয়ে বলে ওঠেন, তো ভালো হোক, মন্দ হোক নিজের স্বামীকে কেউ বিয়ে দিতে চায়!
: আরে আফা, আমি তো জানি হ্যার ক্ষেমতা কদ্দূর। তাই ভাবছিলাম, আমি পারি নাই অন্য কেউ আইসা বিষটা মারুক!
সারাক্ষণ খই ফোটানোর মতো নিজের দগ্ধ জীবনের কথা বলা চামেলি আসার পর থেকে স্বল্পভাষী সরলার মা’র হয়েছে নতুন জ্বালা। যাকে খালা-খালু থেকে সরলার বাপ পর্যন্ত কিছুটা সমঝে কথা বলে, তারও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে চামেলি কটাক্ষ করে। কেন কাপড়ে দুইবার সাবান মাখায়! কেন প্রতিদিন মাথায় নারকেল তেল দেয়। কেন তার জন্য ম্যানোলা ভ্যানিসিং ক্রিম কিনতে হবে! মুখে কউরার ত্যাল দিলে কী হয়!
তারপর খালাই চাইতেছিল, চামেলি চলে যাক। প্রতিবেশী আজিজা বানুও তার এরকম অহেতুক খিটিমিটি দেখে বুঝতে পেরেছিলেন, যার জীবনে এতটুকু শিশিরের স্নিগ্ধতা নেই, সে অন্যের গায়ে ঘ্রাণের সাবান মেখে গোসলের মতো এতখানি আতিশয্য সহ্য করতে না পারারই কথা!
চামেলির মা-বাবা ও ভাইদের মনোভাব তার বিরুদ্ধে, এটা সে বুঝতে পেরে একদিন ঝাঁঝিয়ে ওঠে। বলে, ক্যাঁ, এহনি যামু ক্যাঁ? একজনের কাছে ঠিকানা পাইয়া আইছিলাম দুইদিনের লাইগ্যা। এহন তো বোঝতে পারছি, তোমরা ভালই আছো। দ্যাকলাম আশেপাশের মাইয়ারা গার্মেন্টসে যাইতেছে। তারা টাকা কামাই কইরা নিজেরা বুক ফুলাইয়া চলে। আমিও দেহি অগো মতো একটা চাকরি পাইনি!
চামেলির এই কথায় খালা-খালুর মাথায় বাঁজ পড়লো। তাদের ছোট ছেলে হবি তেড়ে ওঠে বলে, বুজি তোমার মাথা খারাপ অইছে? গার্মেন্টসে সব কম বয়সী মাইয়ারা চাকরি করে! তোমারে ঝাড়– দিতেও তো নিবো না!
চামেলি ফণা তোলা সাপের মতো ছোট ভাইয়ের দিকে ফিরে ফোঁসফোঁস করে বলে, আমারে নিজের চোউকখে দ্যাখতে দে! সারাজেবন অন্যের চক্ষু দিয়া দেখছি। এতদিন তো তগো ভাত আমি খাই নাই। আমার পাঁচ পাঁচটা পোলাপাইন আইছে, তরা কেউ তাগো কারো লাইগ্যা একটা সুতাও খরচ করছ নাই। এহন কয়ডা দিন আমারে থাকতে দে! আমি দেহি, কে আমারে কুনহানে নেয়, না নেয়!
খালু বলে ওঠে, একখানা ঘরের বেতর আমরা এতডি মানুষ ঠাসাঠাসি কইরা থাহি, হ্যারপর তুই গ্যাইড়া বইলে কেমুন কতা? আর গার্মেন্টসের দিক পা বাড়াইলে জামাই তরে আর ঘরে নিবোনি?
চামেলি তার বাবার কথায় আরো ক্ষেপে উঠে বলে, বাবা, আপনে কিন্তু আমারে চেতাইয়েন না কইলাম। তাইলে কিন্তু আমি বংশের মুখে চুনকালি ডইল্লা দিমু! সংসারে মাইয়া বড় অইছে, সে তার বাপেরে-ভাইবোনেরে রাইন্দা খাওয়াক। তাগোরে ইট্টু আমার অভাবডা বোঝতে দ্যান।
চামেলির তেজের কাছে সবার হার হয়। বেশ কদিন পর আজিজা বানু খালার বাড়িতে গিয়ে চামেলিকে দেখে অবাক হন। আশ্চর্য হয়ে বলেন, আরে বুজি, আপনার মাথার চুল কে কাটছে? খুব সুন্দর লাগছে তো?
চামেলি বলে, গার্মেন্টসে ভর্তি হইছি আপা। ওরা না কইছিলো, আমারে নিবে না! তাই ভাবছিলাম, দরকার হয়, গার্মেন্টসের ঝাড়–দারই হমু। তবু টাকা কামাই করার লাই¹া কিছু করমু! ওরা আমারে ভালো কাজই দিছে আপা।
আজিজা বানু বললেন, আপনি গার্মেন্টস চিনলেন কী করে?
: পাশের বাসা থেইকা দল ধইরা দেহি মাইয়ারা যায়, তাগো লগে গেছিলাম। পরদিন জোছনা-রোখছানারেও লইয়া গেছিলাম। কিন্তু দুইদিন কাজ কইরা অগো বলে মাথা ঘোরে। আর যায় না। মাথা ঘোরলেই কি? বেডারা টাকা দিবো কি এমতেই!
আজিজা বানু বললেন, আর আপনার মাথা ঘোরে না?
আমার তো ভালোই লাগতেছে। দিনভর বোতাম লাগাই। মাস গ্যালে ছয় আজার টাকা পামু! আর দ্যাশে থাইকা পুরা বতরের সুমায় ক্যাড়াইল দিয়া পিডাইয়া, নিজেগো গরু আছে দুইডা আর দুইডা মাইনষেরতন চাইয়া আইন্যা মলন মইল্যা ফসল ঘরে তুলি, তার লাইগাও তো কেউ আমার দিকে এট্টু মায়ার চোউকখেও তাকায় নাই! ভাত খাইতে গ্যালেও খোডা! আমি খালি বলে খাই-ই!
আজিজা বানু বললেন, বাড়ি থেকে আপনাকে নিতে এলে?
চামেলি বলে, দুলালের আম্মা আফা, টাকা অইলো গিয়া আসল ভাতার! আর সব ভাতার ফস্কা গিরা! সে গিরা রাহেন বইল্লা ঝুইল্যা থাহে।
আজিজা বানু চমকে ওঠেন মধ্যবয়সী গ্রাম্য চামেলির কথায়। তিনি মনে মনে ভাবেন, টাকাই বড় ভাতার। কথাটা ঠিক। কিন্তু অনেকেই তা বোঝেন না। চামেলির তেজটা ক্রমে আজিজা বানু ভালবেসে ফেলেন।
এখন আর খালা-খালু বা পেঁপের ডালনার জন্য নয়, চামেলির অকপট মনোভাব আর গতি-প্রকৃতি নির্ণয় করতেই আজিজা বানু ঘন ঘন ওদের ঘরে আসেন।
সরলার মাকে এখন চামেলি সমঝে চলে। কারণ তার দশ মাসের মেয়ে শিশুকে সরলার মা-ই দেখে সরলার সাথে। সে-ই দুধ-সুজি মিলিয়ে রেঁধে এক ফিডারে দুজনকে দু’বার খাওয়ায়। বুকের দুই পাশে দু’জনকে কাছে রেখে ঘুম পাড়ায়।
চাকরিতে ঢুকেই চামেলি তার মা-বাবার বাসার কাছাকাছি আরেকটি বাসা ভাড়া নিয়েছে। খালা-খালু বলেছিলো, যেই টাকা বাসা ভাড়া দিবি, সেইডা আমাগো দে। তুই আমাগো সাথে থাক। নইলে মানুষ খারাপ কইবো!
কিন্তু চামেলি খালি আলাদা বাসা ভাড়াই নেয়া নয়, দুইমাস না যেতে সে একজনকে ঠিক করেছে। মানে সেই লোকটিই চামেলির পিছনের লেগেছিলো। চামেলি বলেছে, ফিসফাস না কইরা কলমা পড়ো আমরা একসাথে থাকি। লোকটি তাতে রাজি হলো। সে লোক চামেলির সাথে একই গার্মেন্টে চাকরি করে। তবে সে চামেলির চাইতে কয়েক বছরের ছোট।
বাবা-মা, ভাইবোনের রে রে করে মানা সত্ত্বেও চামেলি বিয়েটা করলো। বাসাটা কাছাকাছি নিয়েছিলো সরলার মায়ের জন্য। সরলার মা তার বাচ্চা সামলাবে, তার জন্য তাকে তার বেতনের একটা অংশ দিয়ে দেবে সে।
আজিজা বানু ওদের বাসায় গিয়ে যখন তখন আর চামেলিকে পায় না। ছুটির পর চামেলির ওভার টাইম আছে। চামেলি রান্নাবান্না অবশ্য করে না। দুইজনের খাবারের চুক্তিভিত্তিক টাকা দেয় সে তার মা-বাবাকে।
খালা-খালুর পরিবার আর চামেলির ওই অবস্থা পর্যন্ত দেখে আজিজা বানুরা ওই এলাকা ছেড়ে চলে যান। বাড়িটা তখনো বিক্রি হয়নি। তাই একবার ভাড়ার টাকা তুলতে এসে খালার বাসায় গিয়ে চামেলির দেখা পেয়েছিল। সেদিন ছুটি ছিলো। আজিজা বানু চামেলিকে ডেকে বললেন, আচ্ছা বুজি, বলেন তো, এই যে বিয়েটা করলেন, আমার তো মনে হয় একসময় সব ক‚ল হারাবেন…।
চামেলি চোখ এতো বড় করে, যেন শুধু মুখে বলে আজিজা বানুকে বোঝাতে পারবে না। তারপর চোখেমুখে একসাথে বলতে থাকে, শোনেন, দুলালের আম্মা আফা, যৌবন শ্যাষ হওয়া মাইয়ামানুষ পরিবারের কাছে খালি খোলা, বুঝলেন! যত্তই আপনে সুংসারে বান্দি খাটেন, সে পরিশ্রমের কুনো দাম নাই, যদি ভাতারে দাম দেয়, তো সে আলাদা কথা! সেডুক পাইলে তো বাইরই অইতাম না!
: আপনার যৌবন শেষ কে বললো? তাহলে এই লোক বিয়ে করতো আপনাকে?
: তাই তো! এহন যেই এট্টু ঢকঢাক অইয়া থাকা শুরু করছি, রাস্তায় গিয়া লম্বা লম্বা পা ফালাইতে শিখছি, এহন আমি নিজেই বুঝছি, যে নারীর যৌবন অত্ত সহজে যায় না। গ্যালে পুরুষেরডা যায়!
: আচ্ছা বুজি মনে করেন যদি এই লোক আপনাকে রেখে চলে যায়। তাহলে আর আপনার পুরনো সংসারে গিয়ে দাঁড়াতে পারবেন?
: শোনেন আফা, আমি তো খালি এক বেডার বউ না! পাঁচ পাঁচটা পোলাপানের মাও তো! যুদি পোলাপানের আমারে দরকার অয়, আমি ছিইট্টা চইলা যামু। তাতে আমার তাগো বাপের দরকার কি? তাগো বাপ আমারে থুইয়া বিয়া করতে চাইছেলে, আর আমি কইরা দেহাইয়া দিলাম! সেদিন এমনে এমনে যুদি না এইহানে আইতাম, আগে খাইছিলাম পুলাপানের বাপের যাঁতা। এরপর শুরু অইছে তাগো। কয়দিন পরে আবার পোলাগো বউগো যাঁতা খাওন লাগবো! আর আফা, আপনে কি মনে করছেন, আমি যা কামাই করমু তা উড়াইয়া পুড়াইয়া খামু? সেইডা খামু না। আর এই বেডারও ভরসা করি না। দ্যাশে আমার বাপে যে ভিডা ফালাইয়া আইছে, সেই ভিডাডা আমি বাপের থেইকা কিইন্না নিমু। এগো ভাইল দেখলেই তো বোঝা যায়, এরা কেউ আর দ্যাশে যাইবো না। অতএব আমারে নিয়া আপনে খালি খালি চিন্তা কইরেন না।
আরিফ ঘরে ঢুকে বললো, আম্মা শুনছো, অস্ট্রেলিয়া সরকার ঘোষণা দিয়েছে, যতো টুরিস্ট আছে তাদের দেশে, সব যেন চলে যায়।
ইফা বললো, তোর তো ভিসা আছে জুনের বারো তারিখ পর্যন্ত। তাহলে?
: তবু নিজেকে অনাকাক্সিক্ষত অতিথি মনে হচ্ছে সরকারের এই ঘোষণার পর থেকে।
আজিজা বানু বললেন, যদিও হাতে দুইমাস সময় আছে। তবু তখন আবার কী পরিস্থিতি হয়। দেশে গেলে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখলে সেটার জন্য চিন্তা নেই। কিন্তু যদি আবার এয়ারপোর্ট থেকে ধরে নিয়ে কোনো ক্যাম্পে তোলে, এটা শুনলে তো আমি হার্টফেল করবো!
আজিজা বানুর এই কথার পরে আর কেউ কোনো কথা বলে না। তিনি একা একাই তার ভাবনার ডালপালাগুলো একাই বিস্তার করতে থাকেন।
মার্চের তেরো তারিখ তিনি এলেন। সপ্তাহখানেক হয়তো মেলবোর্নে থাকতেন। তারপর চলে যেতেন কুইন্সল্যান্ডে মেয়ের কাছে। ওখানে তার নাতি জেফন চৌধুরীকে নাকি এখনো চাইল্ড কেয়ারে রাখতে হচ্ছে। এটাই এখন তাকে খুব অস্থির করছে। ছোট মেয়ে আঁখিমনিকে তিনি রেখে এসেছেন, ঘরে কাজের লোক নেই। মেয়ে বড় চাকরি করে। কিন্তু সংসারের কাজগুলো সুচারুভাবে করতে শেখাননি। সে বিষয়টাও তার মাথা ভারী করছে। এখানে বড় ছেলে আশিক রহমান ওরফে দুলাল আর ছোট ছেলে আরিফ ছাড়া কেউ বাইরে যাচ্ছে না। নিজেদের অফিস তাই তারা দু’ভাই-ই অফিসে যাচ্ছে। অফিসে তারা নাকি দু’জনই কাজ করে। আর অন্য সবাইকে ছুটি দিতে বাধ্য হয়েছে।
ফেরার পথে দুলাল একগাদা করে বাজার করে আনে আর নিজেই জীবাণুনাশক ছিটিয়ে সেসব শুদ্ধ করে। আজিজা বানু মনের সুখে ছেলের আনা বাজার নিজের মতো করে শুধু রান্না করেন। তারপরই শুরু হয় পৌত্রী করিমননেসার সাথে তার লুডু খেলা। লুডু খেললে বুদ্ধি বাড়ে। পৌত্রী’র জীবনে এই লুডুর বুদ্ধিটুকু অবদান হিসাবে রেখে যেতে তিনি খুব আন্তরিকভাবে তার সাথে খেলতে বসেন।
দাদীর প্রতিটি গুটি কাটার পর করিমননেসার মুখ ঝলমল করে ওঠে। তাই পৌত্রী’র ঝলমলে মুখ দেখতে আজিজা বানু ভান করেন তেড়ে আসা গুটির সামনে থেকে তিনি তার গুটি সরাতে ভুলে গিয়েছিলেন। অথবা ধেয়ে আসা গুটির সামনে তিনি এমনিই নিজের গুটি লেলিয়ে রাখেন। কিন্তু একটা সময়ের পর থেকে তা আর তা করেন না। এখন তিনি নিষ্ঠুর হাতে ঘ্যাচাং করে করে পৌত্রীর গুটির পেছনে ওঁত পেতে থেকে কেটে দেন। কারণ উদ্দেশ্য তাকে আসল খেলাটা শেখানো। না হলে সে খেলোয়াড় হিসাবে দুর্বল থেকে যাবে। দাদী তাকে ছাড় দিলেও অন্যরা তো দেবে না! শেয়ানের সাথে লড়াই করেই কেবল শেয়ান হওয়া যায়।
এ দেশের মানুষ নিয়ম মানা জাতি বলে এমনি এমনি সবাই দূরত্ব মেনে চলে। কঠোরভাবে লকডাউনের দরকার হয় না।
আজিজা বানু এখানে কাছাকাছি সিটিজেনস্ পার্কে হাঁটাহাঁটির জন্য বাইরে যেতে ক’বার পা বাড়িয়ে আবার নিজেকে নিজে টেনে ধরেন। ভাবেন, এই ভাইরাসটা এমন নয়, যে যার হবে, শুধু সেই মরবে! না, নিজের বংশধরকে
তিনি কোনোভাবেই কোনো ঝুঁকিতে ফেলবেন না! নিজেকে তিনি খুব সতর্কতার সাথে বন্দি রাখেন এবং এই প্রথম তিনি বুঝলেন, তিনিও বন্দি থাকতে পারেন।
রান্না করা, লুডু খেলা, কিছু বইপড়ার চেষ্টা এগুলোই এখন সমান তালে চলছে আজিজা বানুর জীবনে। আর যতবার তিনি ওই ডালনা রান্নার আয়োজন করেন, ততবারই সেই খালা-খালুর সংসারে গিয়ে ঢুকে পড়েন। যেখানে একদিন তাদের সবচেয়ে বড় মেয়ে নিজের ভরা সংসার ফেলে দুদিনের জন্য মা-বাবার কাছে বেড়াতে এসে জীবনটা আমূল পাল্টে নেয়ার সাহস দেখিয়েছিলো গতানুগতিক প্রথা ভেঙে। আগের স্বামী-সন্তান-সংসারকে তুড়ি মেরে সে কিসের ভরসায় আরেকটি জোয়ান ছেলেকে বিয়ে করেছিল, অনেক উচ্চশিক্ষিত-স্বাবলম্বী নারীও এই কাজটি পারেননি, দেখেছেন আজিজা বানু! তিলে তিলে অবহেলার বারুদ কমবেশি অনেকের ভেতরই থাকে, কিন্তু তাকে ঘষে জ্বালাতে সাহস কারো থাকে না!
কোন আবহ থেকে কোন গানের বাণীর মর্মার্থ যেন আজিজা বানুর বোধের দুয়ারে এসে লাগে ‘প্রলয় আমার কেশে কেশে, করছে মাতামাতি…।’ এবার চামেলি ঝড়কে অন্তত সাথী হিসাবে পেলো। অনেকের ভেতর থেকেও যাকে ভালোবাসবার. একটু সমীহ করবার কেউ ছিলো না, এবার সে ফিরে গিয়ে ঝড়কেই সাথী হিসাবে পেলো!
আজিজা বানুকে মনে রাখার মতো তার ভেতর কোনো বৈশিষ্ট্য চামেলি খুঁজে পেয়ে তাকে মনে রেখেছে কি রাখেনি, তা জানতে না পারলেও, আজিজা বানু আজো যেন তার সব ব্যস্ততা ও অবসরে চামেলির তর্জনি গাঢ় মুগ্ধতায় ছুঁয়ে আছেন।
নদী থেকে সমুদ্রে
দীলতাজ রহমান
আমার অতি শৈশবকালটি কেটেছে খুলনাতে। কিন্তু আমার জন্ম গোপালগঞ্জ জেলার চন্দ্রদিঘলিয়া গ্রামে। আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে খুলনা যেতে মাইল তিনেক দূরে শুকতাইলের ঘাট। ঘাট বলতে ছাউনি টাউনি কিছু ছিলো না। ছিলো না ঘাটের অন্য কোনো চিহ্নও। তবু ওই পথে যাওয়া-আসার মানুষ ওখানেই জড়ো হতো। ওখান থেকে আমরা লঞ্চে উঠতাম। নামতাম।
সকালবেলা তাজামাছের ঝোল আর গরমভাত রান্না হতো। কিন্তু আমরা ছোটরা কেউ তা খেতে পারতাম না। ছোটবেলা কোথাও যাওয়া-আসার আগে আমরা ছোটরা খেতে গেলে বমি আসতো। তাই সবাই ছোটরা সে ভাত সুযোগ বুঝে ফেলে দিতাম। আর উঠোনের হাঁস-মুরগি তা দ্রæত খেয়ে, আব্বার মার খাওয়া থেকে আমাদের উদ্ধার করতো।
সবার খাওয়া হলে শ্রেণিমতো পোটলাপুটলি হাতে নিয়ে আমরা এগোতে থাকতাম ঘাটের দিকে। আর পিছনে বাড়ির বয়স্ক মানুষেরা জড়ো হয়ে ভেজা-চোখে অনেকক্ষণ আমাদের গমনপথের দিকে চেয়ে থাকতো। আমরাও বারবার ফিরে-ফিরে তাদের দেখতাম। দেখতাম ছেড়ে যাওয়া বাড়িটি। ওটাই বোধহয় নিয়ম। হয়তো তাও নয়, জড়াজড়ি হয়ে থাকা প্রাণ তখনই কেবল বিরহের আভাস পেয়ে প্রবল কাতরভাবে জেগে উঠতো। গাছ থেকে তাজা ফুলটি ছিন্ন করলে যেমন কষ ঝরে, তেমনি তখন পিছনের সবার চোখে পানি টলটল করতে থাকতো। তবে ছোটরা পায়ে পায়ে আমাদের সঙ্গে অনেক দূর আসতো। একসময় তারা যখন ফিরে যেতো বা কোনো বাঁক থেকে ফেরার জন্য যখন ঘুরে দাঁড়িয়ে পড়তো, তখন আমাদের ছোটদের বুকও ভার হতো। কী যে মায়া লাগতো, টুটাফাটা বাড়িটি এবং লতায়-পাতায় জড়ানো সম্পর্কের ওই মানুষগুলোর জন্য। মাথা তোলা চকচকে টিনের ঘরগুলো যেন তাদের মাথাগুলো আরেকটু জাগিয়ে বলতো, আবার ফিরে এসো!
শুকতাইলের ঘাটে গিয়ে আমাদের মতো অন্যান্য গ্রাম থেকে আসা আরো যাত্রীদের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়ে যেতো। অন্য গ্রামের হলেও বড়দের-
আলাপের ধরণে বুঝতাম সবাই সবার চেনা। কখন লঞ্চ আসবে সেই আশায় উদগ্রীব থেকে বড়রা খালি-চোখের ওপর হাত রেখে রোদ আড়াল করে ঘাড় উঁচিয়ে নিরিখ করতো, লঞ্চ কত দূরে! আর আমরা ছোটরা নদীর ক‚লে ছুটোছুটি করে অবাক হয়ে দেখতাম, একটু-একটু ফাটলধরা পাড় কিছুক্ষণের ভেতর ঝপাৎ-ঝপাৎ করে কীভাবে পড়ে যেতো নদীর ভেতর। বিষয়টি খুব ভয়ঙ্কর। কারণ ওই জয়াল যদি কাউকে নিয়ে পড়ে, তাহলে সে, মানে মানুষ পড়ে আগে। এভাবে কিছুদিন পর-পর নদীতে বহু প্রাণের বিসর্জন ঘটে যায় অসাবধানে-অজান্তে। তাই বড়দের খোশগল্প খুব খোশ হতে পারতো না তাদের নিজেদের জানসহ, গুড়ো এবং ডাগর ছেলেমেয়েও কুক্ষিগত করে রাখতে-রাখতে। তারপর সাইরেন বাজিয়ে আচমকা একখান লঞ্চ এসে পড়লে চিলের ছোঁয়ের মতো সে লঞ্চের যাত্রীরা তাতে যার-যার ছানাপোনাসহ পোটলা-পুটুলি নিয়ে ঢুকে পড়তো। লঞ্চ থেকে নামার আনন্দ থেকে ওঠার এই স্মৃতিগুলো এখনও মনে থরে-থরে মিশ্র হয়ে আছে। কারণ পিছনের টানটা তীব্র ছিলো বলে।
২.
মুক্তিযুদ্ধের আগেই আমরা ঢাকাতে এসেছিলাম। কিন্তু তখন পুরুষমানুষের জন্য ছিলো পুরো লঞ্চ। আর মহিলা এবং তাদের যুবতী, কিশোরী ও শিশুদের জন্য ছিলো একটি ছোট রুমের মতো জায়গা। যেখানে দরজার জায়গাটুকু বাদ রেখে চারপাশেই বেঞ্চ সাঁটা। তার ভেতর চুষিপিঠার মতো মহিলারা সবাই ভাপা হতো। কাত হয়ে ঢোকার একচিলতে যে দরজাটি ছিলো, তাও দুষ্টুমতি ছেলেমেয়ে কেউ বারবার খোলার চেষ্টা করলে মহিলারা নিজেরাই তাকে ছিঃ-ছাক্কা করে রাখতো না। কারণ সামনে দিয়ে চলাচলের পুরুষদৃষ্টি তাতে ঢুকে পড়লে মহিলাদের পর্দা নষ্ট হয় যে! তারচেয়ে তাদের পর্যাপ্ত অক্সিজেনের অভাবে নিজেদের জন্য দাঁতকপাটি লেগে থাকা অনেক ভালো। অবশ্য নদীর দিকে ছোট ছোট সারবাঁধা কটা জানালা থাকতো বটে। কিন্তু যতোই একদিকে জানালার সার থাক, বিপরীত দিকে একটা অন্তত জানালা না থাক, একটি ফাঁক-ফোকর না থাকলে বাতাস ঢোকে না। বাতাসের চিরকালের এমনি মতি।
আমরা বাবা ছিলেন ডাকসাইটে অত্যাচারী মানুষ। তার বউ-মেয়ে কাউকে অন্যলোক কেউ দেখে ফেলবে, সেজন্য কখনো তাদের মানুষের সামনে বের করেননি। তাই ওপরের কেবিনে যে ওপর-শ্রেণির মানুষ প্রশস্ত হয়ে বসে-
এলিয়ে চলাচল করে, ওরা যারা প্রাণ খুলে আলো-বাতাস পেতে-পেতে যায়, ওরা যে শুধু স্বপ্নের জগতের মানুষ নয়, তা বুঝতে আমার অনেক বছরই লেগে গেছে।
গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকা আসতে প্রথম যে পদ্মার ওপর দিয়ে এসেছি, হয়তো সমুদ্রে আসতে-আসতে ওই খুপরির ভেতর মাকে ঘেঁষে ঘেমেনেয়ে ঘুমিয়েই ছিলাম। তিনমাস পর ভয়াল পঁচিশে মার্চের তিনদিন আগে আবার ফিরে চলে যেতে আসন্ন যুদ্ধের আশঙ্কায়ই বোধহয় শিশুমন নেতিয়েই ছিলো। না হলে তখন পদ্মা দেখিনি কেন? সমুদ্রের নামে কৌতূহল তো তখনও মনে ঢুকেছিলো। মাকে বলতে শুনেছি, পদ্মা নাকি এতো প্রশস্ত যে, একপাড় থেকে আরেকপাড়ে দাঁড়ানো মানুষকে কাকের সমান মনে হয়! কিন্তু পরে তো অনুমান করতে পেরেছি, মা’র ও গল্প ভুল। কারণ কাক কেন চড়াইয়ের মতোও লাগবে না। পদ্মার একপাড় থেকে আরেক পাড়ের শুধু একটা মানুষ কেন, মানুষের মিছিলও দেখা যায় না।
যুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীনের পর আবার যখন ঢাকাতে ফিরে আসি, সেবার জেগে রইলাম পদ্মা দেখবো বলে। মহিলারা সেই যে খুপরির ভেতর বসতো, তার সামনেই তো লঞ্চের ইঞ্জিন। স্ত্রীজাতি শাসনের বেলায় আমার বাবা ছিলেন জল্লাদের প্রতিমূর্তি। তিনি লঞ্চের ওই খুপরি জায়গাটুকুতে স্ত্রী-কন্যা-শিশুদের সেঁধিয়ে রেখে আবার খোঁজ নিতে আসতেন, স্ত্রী-শাসনের প্রতি ঢিলেঢালা মনেবৃত্তির কেউ আবার তাদের জননী-জায়া-কন্যাদের দেখভালের নামে ভেতরে ঢোকে নাকি! লোলুপদৃষ্টি দিয়ে তারা অন্য নারীদের চাটে নাকি! সেরকম লোককে কতবার যে নিকুচি করতে দেখেছি আমার পিতাকে। আর তাতে মদদ-জোগানো মানুষের সংখ্যাই সবসময় বেশি ছিলো। যেনো তারা নিজেরা কেউ কোনোদিন অন্যনারীর দিকে ভুলেও তাকায় না!
স্বাধীন হওয়া নতুন দেশের গৌরবের সাথে আমার চামড়াও আরেকটু ফর্সা ও টানটান হতে থাকে। তার-ওপর আবার উপুড় হলে বুকে ব্যথা পাই। হাত দিয়ে ব্যথার উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখি, দুই বুকে মটরদানার মতো ভেতরে গুটলি। একদিন ঘরভরা মানুষের ভেতর মা’কে গিয়ে বললাম, ওমা আমার দুধে ব্যথা করে। মা চোখে তিরস্কার ফুটিয়ে নিজের জিহŸাতে কামড় খেলো। আর ঘরে খোশগল্প করতে আসা বাড়ির চাচা, চাচী, ও ফুপুরা তাতে হেসে কুটিকুটি।
কদিন পরে আবার যখন আমরা লঞ্চে করে ঢাকা রওনা হলাম, আমি প্রবল ইচ্ছে নিয়ে জেগে থাকলাম। ভাবলাম, ওই যে ইঞ্জিনের রুমের পাশে যে জানালা, ওখানে দাঁড়িয়ে পদ্মা দেখবো। কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে যতো চোখে সমুদ্র দেখবো, তার চেয়ে বেশি চোখ জ¦ালিয়ে রাখলাম, পাশ দিয়ে লঞ্চের খুপরিতে যেতে আব্বার এসে পড়াটা যেন শতপরত ঘন অন্ধকার ঠেলে হলেও আগে দেখি!
উঁচুশ্রেণির কেউ না। সব খেটে খাওয়া মানুষের ভিড় ওখানে। তখন উঁচুশ্রেণির, সাফ-সুতরো, নতুনের মতোই যাদের নিত্যদিনের পুরোনো পোশাকও, সংখ্যায় অতি নগণ্য তারা সব লঞ্চের দোতলার কেবিনে বসে যায়। আর শুয়ে যাওয়ার মতো কেবিনে তখনও আমার নজর যায়নি। এতই সীমাবদ্ধ ছিলো আমাদের দেখার গÐি। আর এসব সেই আব্বার নারীকুলকে কুক্ষিগত করে রাখা মনেবৃত্তিরই চরম কুফল।
‘পদ্মা! পদ্মা…’ রব উঠতেই ঘেমোগন্ধ মানুষের ভেতর দিয়ে মাথাটা জানালায় একটু গলাতেই কার দুটি হাত আমার সেই মটরদানা বুক এমন চেপে ধরলো, জান বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। লঞ্চের জানালা থেকে পদ্মা মনে হলো হাজার কোটি মাইল দূরে সরে গেলো। আমি নিজেকে ছিঁটকে আবার লঞ্চের সেই জ¦লন্ত চুলোর ওপর পাতিলের মতো খুপরির ভেতর চুষি পিঠার মতো ভাপানো গরম একেকটা পিঠা সেই মহিলাগুলোর ভেতর এসে ঢুকে পড়লাম। আমার শরীর কাঁপছে, ভয়ে। মনে হচ্ছে আমার আব্বা এসে আমার মুখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন, তার মেয়ে কুলি-মজুর কারো দ্বারা এমন চরম নিগৃহীত হয়েছে। আর নিগৃহীত হতে সুযোগ দেয়ার জন্য বাইরের জানালায় দাঁড়ানোর শাস্তি স্বরূপ তিনি আমাকেই এই কূল-কিনারাহীন দরিয়ায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যাবেন। কারণ বেগানা কেউ মেয়েদের ছুঁলেই সে চ‚ড়ান্ত অপবিত্র!
এরপর থেকে আমার কাছে সমুদ্র মানে ওই বুকে চাপ ধরা লজ্জাকর-মর্মান্তিকভাবে ডুবিয়ে মারার স্মৃতি।
৩.
এর আরো ক’বছর পর বিয়ে হলো। সংসার হলো। ছেলেমেয়ে হলো। স্বামী খুব কর্মব্যস্ত মানুষ। চোখে ঠুলিবাঁধা গরুর মতো সুখ-দুঃখ নিজের ছকে সংজ্ঞায়িত করে সংসার করে যেতে লাগলাম। একসময় বিধবাও হলাম।
যদিও তা অকালে হলাম। জীবনের নানানরকম অবস্থার ভেতর কত কত সমুদ্র-নদী ভ্রমণের গল্প শুনি। পড়ি। কিন্তু নেমে গিয়ে আর দেখা হয় না। কেউ আয়োজন করেও দেখায়নি। বিধ্বস্ত শরীরে-মনে একদিন সকালের
দিকে বাসার সামনে থেকে তাজা কৈ মাছ কিনে এনেছি। ড্রয়িংরুমের মাঝখানে জাবড়ে বসে খাবলা খাবলা ছাই দিয়ে তাদের কুটছি। এমন সময় কবি-বনলতাসম্পাদক নাসরীন রহমান এলেন। আসার কারণটা আগেই বলা-কওয়া কিছুটা ছিলো। ‘আমরা ক’জন কক্সবাজার যাচ্ছি। তুমিও চলো আমাদের সাথে।’ নাসরীন ঘরে ঢুকে আমার তখনকার অবস্থার বাছ-বিচার না করেই বলে উঠলো, ‘টিকেটের টাকা দাও।’ আমি নিজের ইচ্ছেতে নয়, ওর চড়াস্বরের কাছে পরাস্ত ঠেকে হাতের আঠালো ছাই কিছুটা ঘষে ছাড়িয়ে, অনিচ্ছেতেই টিকেটের দামটা ব্যাগ থেকে বের করে দিলাম। আগামীকাল সকাল আটটায় পান্থপথ আমার বাসার কাছেই কলাবাগান থেকে বাস ছাড়বে।
নাসরীনকে তার জোর দাবির মুখে আমি টিকেটের টাকা না দিয়ে পারিনি, তাই দিয়েছি। সে বেরিয়ে যেতেই আবার মাছে মন দিলাম। আর মনে-মনে প্রমাদ গুনলাম, ও কাউন্টারে পৌঁছুনোর আগেই ওকে কল দিয়ে বলবো, আমি যাবো না। আমার টিকেট কেটো না! ছাইমাখা কইমাছ অন্ধচোখে মালসাতে লাফাচ্ছে। সময় হিসেব করে আমি হাত না ধুয়েই সেই জবজবে ছাইমাখা হাতে এক মিনিটে সাত টাকা দরের কল দিতে লাগলাম। মোবাইল বাজছে-থামছে। আমি আবার কল দিচ্ছি। আমার মুখে কথাও গোছানো, আমি যেতে পারবো না। প্লিজ, মাফ করে দাও। আমার টিকেট কেটো না ! ও টাকা তোমরা নিয়ে নাও…! কিন্তু নাসরীন কেন আমার ফোন ধরলো না কে জানে!
পরদিন ভোরে বাসা থেকে বের হওয়ার আগে আমি গোটা বিশেক রুটি আর একটা আস্ত মুরগি কেটে, বড়-বড় চাক করে পেঁপে দিয়ে রান্না করে নিয়ে সময়মতোই বাসা থেকে বের হলাম। বাসস্ট্যাÐে গিয়ে জনাদশেক বান্ধবীকে সেখানে জড়ো দেখলাম। কলের পুতুলের মতো ওদের সঙ্গে আমিও নিজেকে চালিত করে রাখলাম। তারপর গাড়িও ছাড়লো সময়মতো। গাড়ি চট্টগ্রামের শেষ সীমানায় পৌঁছুলে কক্সবাজারগামী আমাদের দলনেত্রী কবি নাসরীন রহমান বললেন, ‘আমরা এখন এখানে কোনো হোটেলে ঢুকে কিছু খেয়ে তারপর কক্সবাজারের বাসে উঠে পড়বো।’ আমি এতক্ষণে বললাম, ‘আমার কাছে রুটি আর মুরগির মাংস আছে …।’ নাসরীন বললেন, ‘কই?’ তারপর সে-খাবারের চেহারা দেখতে না দেখতে সবাই আমার হাত থেকে নিয়ে সে-কী খাওয়া! ওইভাবে সবার জুঠা সবাই ভদ্রলেডিরা খেতে পারেন তা আমার জানা ছিলো না। সবার খাওয়াদাওয়া সারা হলে তারপরে তাদের জানা হলো, দীলতাজ নিজে তৈরি করে পোটলা বেঁধে এই খাবার এনেছে! আর তাতেই বেঁচে গেলো তাদের তখনকার হাজার টাকা।
হোটেলের রুমে গিয়ে পৌঁছুনোর পর কখন নামবো সমুদ্র দেখতে, সবার ভেতর গভীর উচ্ছ¡াস। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিলো আমি ওদের সাথে তাল মেলাতে পারছি না! আমার ভেতর আগুন নেই যা ওরকম উসকে জ¦লবে। বরং বাসায় যে ছেলেমেয়ে দুটি রেখে গেছি, তারা কী খাচ্ছে, দরজা বন্ধ করে বেরোচ্ছে কি না। পোশাক ইস্ত্রির পর প্লাগটা খোলে কি না। নিজেকে মনে হচ্ছিলো ভেজা বারুদের মতো দশার! তবু চলছি সবার সাথে। আর রুমে যখন ঢুকছি রাশি-রাশি বালি গায়ে। গিয়েছিলাম সেন্টমার্টিন দ্বীপেও। নির্দিষ্ট দিনে ফেরার আগে কবি দিলরুবা শাহাদৎ-এর সাথে নাসরীনের একটু দ্ব›দ্ব লেগে যায়। চাঁদার টাকা চাইলে দিলরুবা বললো, ‘আমি দিয়েছি।’ নাসরীন বললো, ‘কোথাও ভুল হচ্ছে…।’ তবু দিলরুবা পূর্বে টাকা দেয়ার কথা জোর দিয়ে বলেও আবার গজরগজর করতে করতে চাঁদার পুরো টাকাটাই দিলো। তাও আবার আমাকে দিয়ে। আমি তখন শাঁখের করাত। কারণ দুজনকেই আমি টাকাপয়সার বিষয়ে ভীষণভাবে চিনি। তবে টাকার হেফাজতকারী আরেক লেখিকা, কবি রিফাত আরা শাহানা। যাকে আরো ভালো চিনি। বিশ^স্ত আরো একজনের চোখ দিয়ে শানিয়ে চিনি। ওই যে সাংবাদিক-মেয়েটা ছাদ থেকে পড়ে মারা গেল, টুশি, রিফাত আরা শাহানা তার মা।
একবার আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন লেখক, মিডিয়া-ব্যক্তিত্ব, সম্পাদক, শিক্ষাবিদ মুহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ বলেছিলেন, ‘জানেন আপা, আজ একটা অনুষ্ঠানে একজনের সাথে পরিচয় হলো। তার স্বামী ইঞ্জিনিয়ার। স্বামী বদলি হয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা এসেছেন। এখন থেকে তারা ঢাকাতেই থাকবেন। তো সেই মহিলা বোরখা পরেন। পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়েন। অথচ আজ তিনিই সবচেয়ে স্মার্টলি, শুদ্ধ উচ্চারণে ভালো কবিতাটি পড়লেন…।’ তারপর বহুদিন পর আমি একদিন লেখিকা সঙ্ঘ’র অনুষ্ঠানে একজনকে কবিতা পড়তে দেখে, মনে হলো, এই সেই শুদ্ধ উচ্চারণের বক্তা ও আবৃত্তিকার, মাসুম বিল্লাহ্’র মতে আদর্শ নারী! কাছাকাছি হতে আমি তাকে এমনিই বলেছিলাম, ‘একজনের কাছে আপনার খুব প্রশংসা শুনেছি।’ রিফাত আরা শাহানা কিছুই না বলে শুধু মৃদু হেসেছিলেন, এমনই তার পরিমিতিবোধ!
কক্সবাজার থেকে যেদিন আমাদের সবার ঢাকা ফেরার কথা, দিলরুবা সেদিন যাবে না। আমাকেও বললো তার সাথে আরো দু’দিন থেকে যেতে। গেলাম থেকে। কিন্তু খাবারের ওয়াক্ত এলে, সে নিজে হোটেলে তার ছোট মেয়ে লিসাকে নিয়ে যা-তা খায়। যা তা মানে নিত্যদিন যা মুখে রোচে। আর আমাকে খাওয়ায় প্লেট ভরে একইরকম বিরিয়ানি। প্রতিবেলাই এই হেরফের। সে বলে, ‘না দোস্ত, তুমি কী সুন্দর করে বলে আমার হোটেলভাড়া কমিয়েছো। আমার জন্য সংসার ফেলে থেকে গেছো। আমার চেয়ে তোমার আরো প্রিয় বন্ধুদের সাথেও তুমি চলে গেলে না। আমি একটু বলাতেই তুমি আমার সাথে থেকে গেলে।’
আমার জীবনে দিলরুবা তার ভালোবাসার প্রমাণ একবারই শুধু রাখেনি, সম্মানজনক ভালোবাসার প্রমাণ সে বারবারই দিয়েছে। একথা বহুখানে প্রসঙ্গত লেখাও হয়েছে। তাই দিলরুবা নিজের জন্য জীবনের এক-দুটো দিন যদি কোথাও আমাকে টেনেই রাখে, তাহলে তার জন্য সেটুকু করাই আমার বাঞ্ছনীয়। একটি নামকরা ব্যাংকের পরিচালক ভিআইপি শাহাদৎ হোসেনের স্ত্রী কবি, ‘অঞ্জলিকা’-সম্পাদক দিলরুবা আরো কদিন তাদের ব্যাংকের ওখানকার এক শাখা-ম্যানেজারের গাড়িতে করে ইতিউতি কতখানে ঘুরলো। ঘোরা দিলরুবার প্যাসন। বেশিক্ষণ গাড়িতে থাকলে আমার বমি আসে। এসি বাসে আরো আগে বমি আসে। আর দিলরুবা বলে, ‘যখন বাস চলে, আমার মনে হয়, এই চলা যদি আর না থামতো!’
নাসরীন যাওয়ার আগে একটি চিঠি আমাকে দিয়ে যায়। দিলরুবাকে দিতে। কিন্তু নাসরীন তাতে আমার মাথার দিব্যি দেয়, সে হোটেল ছেড়ে চলে গেলে তবেই যেন আমি চিঠিটা দিই দিলরুবাকে, তার আগে নয়। এমন অনেক সিনেমা দেখে আমি অনুমান করতে পারি, বিষয়টা কী হতে যাচ্ছে! কিন্তু আমার যে কিছুই করার নেই!
নাসরীনের বন্ধ খামটা দিলরুবার হাতে ধরিয়ে দিলে, দিলরুবা তা খুলতেই সেই কতকগুলো টাকাই প্যাকেট থেকে লাফিয়ে পড়লো। সাথে সাথে দিলরুবার মুখ থেকে বেরোলো পুরনো গজর-গজর ‘…আমি আমাদের ব্যবসার একটি বিভাগ সামলাই। আমার কোনো ভুল কখনো হয়নি।
আমি টাকা দিয়েছিলাম…।’ মানুষের দ্ব›েদ্ব বিধাতাও কখনো আমার মতো এমন অসহায় বোধ করেন বলে আমার তখন প্রাণে ঠেকলো!
দিলরুবাসহ যখন ঢাকায় ফিরলাম, ওর ঢাকার গাড়ি আমাদেরকে বাসস্ট্যান্ড থেকে তুললো। ওর তখনকার বাসা কাঁটাবন মসজিদের সামনে; ও যেতে পথে আমাকে আমার বাসায় নামিয়ে দিয়ে গেলো। সারারাত বাসে করে এসে সকালে ঢাকা পৌঁছানো। আমার ছোট মেয়ের তখন নতুন চাকরি। নক করতেই সে ঘুম ভেঙে দরজা খুলে আমাকে দেখে বললো, ‘মানুষ ভ্রমণে গেলে শুকিয়ে আসে। আর তুমি এমন ডাব্বুশ হয়ে আসছো কেন?’
বললাম, ‘ওই যে তোমার দিলরুবা আন্টি …।’
৪.
জাতিসত্তার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা আয়োজিত তাঁর চট্টগ্রামের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে, তাঁর সাথেও অনেক ঘুরেছি। আমাদের থাকা-খাওয়া-ঘোরা, সেন্টমার্টিন বেড়ানো সেবারই তুমুল হৈচৈএর সাথে হয়েছিলো। সাথে কবিতা পড়া। সেন্টমার্টিনে হুমায়ূন আহমেদের বাড়ি দেখেছিলাম। বারান্দাতে বসেছিলাম, তাও মনে আছে। কিন্তু বিষয়টা এতদিনে স্মৃতিতে ব্যাপক জট লেগে গেছে। তাই জট খুলতে স্মৃতিতে আর সূ² বা হেঁচকা টান নাই-বা মারলাম।
এরপর অস্ট্রেলিয়া গেলে আমার বড় ছেলে, যার সাথে আমার বয়স কাছাকাছি বলে ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকে। তবু ছবির এ্যালবামে ঢুকলে চোখ পড়ে-পড়ে দেখা যায়, সেও বহুবার আমাকে পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করতে টেনে-টেনে বা ঝুলিয়ে সমুদ্রে নিয়েছে। টেনে মানে না বকে। আর ঝুলিয়ে মানে বকতে-বকতে। আর সেসব যাত্রায় আমি ছবি তুলতে এত মগ্ন হয়ে গেছি, পরে মনে হয়েছে, আমি কি শেষ পর্যন্ত সমুদ্রের দিকে দৃষ্টি বিস্ফারিত করে দেখেছিলাম? দেখেছিলাম কি, সমুদ্র থেকে আকাশ কত দূরে?
এজন্যই ছেলেমেয়েরা বলে, ‘ছবি পরে তুলো। আগে দেখো। যারা দেখে তারা ছবি তোলে না। সমুদ্র দেখতে হয় মগ্ন হয়ে। স্মৃতি হিসাবে দু-চারখানা ছবি হয়তো তারা তোলে। কিন্তু তুমি ছবি তুলতে এতো ক্রেজি হয়ে যাও যে, আসল বিষয় তোমার হৃদয়ে পশে না।’
এইবার বুঝলাম কথাটি একেবারেই খাঁটি! নাহলে সমুদ্রের একখানা গল্প সে একজন গল্পকারকে দিয়ে এতোদিনে লিখিয়ে নিতে পারতো না!
৫.
সমুদ্রদর্শনের আমার সবচেয়ে ভালো স্মৃতি হচ্ছে, ডিনা চৌধুরীর সাথে যখন পরিচয় হলো, সে কিছুদিন পর মাহবুব ভাই, মানে ডিনা তার হাজবেন্ডকে দিয়ে আমাকে তার বাসায় নেয়ালো। অনেক রাত পর্যন্ত খাওয়া-দাওয়া আড্ডা হলো। রাতে আমাকে আমার ছেলের বাসায় তারা দুজনে মিলে পৌঁছে দিয়ে যাবে। কিন্তু ডিনা মাহবুবভাইকে বললো, ‘এক কাজ করো। দীলতাজ আপাকে সমুদ্র দেখিয়ে নিই।’ স্ত্রীর কথার ওপর মাহবুবভাই আমার বাবার মতো আর তার পুরুষবুদ্ধি ও দাপট প্রয়োগ করলেন না। এই আইটি-স্পেশালিস্ট মানুষটি এই বয়সে এসেও একবারও তার বুদ্ধির প্রাখর্য দেখাতে বললেন না যে, ‘এখন অনেক রাত বা এখন অন্ধকার রাত। দেখছো না আকাশে চাঁদ নেই! আজ, এইবেলা থাক। আপা তো কিছুদিন আছেনই। আরেকদিন আয়োজন করা যাবে।’
ডিনা বিভোর হয়ে একের পর এক তার পাশে এবং আমার সামনে বসে গান গেয়ে চলেছে। তিনি তাকেও নিরুৎসাহিত হওয়ার মতো কিছু বললেন না। আর তখনই আমার মনে হয়েছিল, ঈশ^র নারী-পুরুষের এই পৃথিবীটাই দেখতে চেয়েছেন। নাহলে, এমন সূ² কলাকৌশলে একমাত্র তাদের শরীর গড়েন! কী ধাত হতো যদি সব প্রাণীর মতো তাদের শরীরের ভেতরও একটি লেজ গুঁজে দিতেন?
ডিনা পল্লীগীতি থেকে কমবেশি অনেক রকম গান জানে। কিন্তু সে গাড়িতে বসে প্রথম যে গানটি শুনিয়েছিলো, ‘তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে সুপ্তরাতে।/ আমার ভাঙল যা তা ধন্য হল চরণপাতে \/ আমি রাখব গেঁথে তারে রক্তমনিহারে,/ বক্ষে দুলিবে গোপনে নিভৃত বেদনাতে \/ তুমি কোলে নিয়েছিলে সেতার, মীড় দিলে নিষ্ঠুর করে…/ ছিন্ন হল যবে তার ফেলে গেলে ভ‚মি’পরে/ নীরব তাহারি গান আমি তাই জানি তোমারি দান…/ ফেরে সে ফাল্গুন-হাওয়ায় হাওয়ায় সুরহারা মুর্ছনাতে।।’ এই গানটিই যেন ডিনার কন্ঠে বেশি মানায়। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে ওরা আমাকে বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো যতো বাড়ি বেড়াতে নিয়ে যায়, আমি অপেক্ষা করে থাকি, ডিনা কখন এই গানটি গাইবে!
সে-রাতে গান গাইতে-গাইতে, শুনতে-শুনতে, কবিতা আবৃত্তি করতে করতে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের মর্ডিয়ালাক বিচে গিয়ে তিনজনেই হতাশ হয়ে-
দেখলাম, সমুদ্র অন্ধকারে ঢাকা! মানুষের অস্তিত্ব টের পেলে যে লাইট জ¦লে, আমাদের অস্তিত্ব টের পেয়ে পেয়ে রাস্তার লাইট জ¦লেছে বটে! কিন্তু তা দিয়ে আমরা ষাটের এদিক-ওদিক বয়সী তিনজন মানুষ হাপুশহুপুশ কিছু আঁধার জড়ানো ছবিই তুললাম শুধু এবং তা ফেসবুকে-পোস্টও দিলাম ঘরে এনে।
তবে সেদিন সমুদ্র অন্ধকারে ঢেকে থাকলেও, চাঁদও জ¦লে উঠে সমুদ্র দেখতে একটু সহযোগিতা না করলেও, মাহবুব ভাইয়ের প্রচেষ্টা আমার মনন ও বোধে এক অন্যরকম জোছনার জন্ম দিয়েছে। যে আঁধার আমার পিতা সমস্ত জীবন পরত-পরত পোচে শুধু ভারীই করে দিয়েছিলেন, মাহবুব ভাইয়ের স্বতঃস্ফ‚র্ত আচরণে তাতে যেন ক্ষয় ধরলো। পুরুষমানুষ মানেই নারী ও শিশুর জবরদস্ত হত্তাকত্তাই কেবলমাত্র নন, তাদের স-ব সুখ-দুঃখ, আবেগের সাথীও!
সেদিন আমাকে বাসায় পৌঁছে দিতে-দিতে ডিনা বলেছিল, ‘আপা, আজ সমুদ্র দেখাতে এনে দেখাতে পারলাম না বটে; কিন্তু আমরা জিলং গিয়ে দিনের আলোতে সমুদ্র দেখবো।’ হলোও তাই। ডিনা এবং মাহবুব ভাইয়ের সাথে আরেকবার সত্যিই সমুদ্র দেখা হলো। সেখানে তখন কখনো ঝকঝকে রোদ এবং কখনো একটু মেঘলাও হয়ে উঠেছিলো আকাশ। দুইরকম আলোতে ছবিও তোলা হয়েছিলো বেশুমার। তাই বলে সেদিন রাতের সমুদ্রদর্শন ব্যর্থ হয়েছে, সে কথা ঘুণাক্ষরেও ভাবা যাবে না!
আমার মেয়ে-জামাই মেলবোর্ন থেকে বদলি হয়ে কুইন্সল্যান্ডে গেলে আমার বড় ছেলে আশিকও মাঝে-মাঝে সেখানে বউ-বাচ্চা নিয়ে বেড়াতে যায়। একবার গোল্ডকোস্টে সমুদ্রপাড়ে এক লাইটহাউস দেখতে গিয়ে গাড়ি রাখতে পারেনি বলে, ঘন্টাদুয়েকের পথ ছেলে ও জামাতা দুজনে দুটো গাড়ি চালিয়ে গিয়ে আবার সেভাবেই তাদের ফেরত চলে আসতে হয়েছে। পথে যে বিরতি হয়েছে, তাতে তাদের ড্রাইভ করার কষ্ট পোষায়নি। মনে কোনো বিনোদনও বোধ হয়নি। তবে যা হয়েছিলো, আমার ছেলেকে বলছিলাম, এখানে মহিবুল আলম নামে এক লেখক-মামা আছে। ‘তালপাতার পুঁথি’ নামে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তার কয়েক খÐে লেখা বিশাল উপন্যাস আছে। সেই মগ্ন মানুষটিকে তোমাকে একটু দেখে যেতে হবে। তাতে সে খুশিই হবে।
মহিবুলের সাথে দেখা করতে যেখানে সবাই গেলাম, সেই অন্ধকার সাগরের আরেক কোনো কূলে দেখা হলেও, মহিবুল-জলি টেনে আমাদের সবাইকে সেই তাদের বাসাতেই নিলো। তারপর কয়েক বাক্স পিজা অর্ডার করে-
বাড়িটাকে জলি-মহিবুল রেস্তোরা বানিয়ে ছেড়েছিলো। আর হরেক রকম পিজার রোদে ভরে গিয়েছিলো সবার ক্ষুধার্ত মুখ।
পুত্র ও জামাতার সাথে অমন আটঘাট বেঁধে গিয়েও আমার লাইটহাউস দেখা হয়নি এই কথা শুনে, বাংলাদেশ থেকে কুইন্সল্যাÐে মেয়ে ঐশির কাছে যাওয়া মিডিয়াব্যক্তিত্ব সাঈদা রোকেয়া তার জামাতা মোনাজকে পটিয়ে, ঐশীসহ ভালোমন্দ রান্না করে নিয়ে, ঠিক পরদিনই আমাকে নিয়ে পুরো লাইটহাউসসহ, লাইটহাউসের খুটিনাটিও সব দেখিয়ে এনেছে। আর লাইট হাউস মানেই চারপাশে সমুদ্র। বয়স্করা ঘরে বসে বা অবসর থেকে সময় নষ্ট না করে লাইট হাউসে কীভাবে স্বেচ্ছাসেবক হয়ে কাজ করে, তাদের সঙ্গে কথা বলিয়ে, অভিজ্ঞতাকে ঋদ্ধ করে দিয়েছে। ছবি তুলে স্মৃতিকে করে দিয়েছে সমৃদ্ধ!
অতএব এইসব মনে পড়ে সমুদ্রের রূপ ক্রমশ আমার সামনে গড়াতে-গড়াতে পাল্টাতে লাগলো। সমুদ্র দেখতে গিয়ে দেখি কেবলি মানুষের হৃদয়ের রকমফের। আর সেটুকু না হলে বুঝি সমুদ্রের মরণই হতো। সে জীবন্ত কোনো উপমা হতো না মানুষের সৃষ্টিতে।
৬.
২০১৯-এর জন্মদিন পার হয়ে গেছে তিনদিন আগে। ভূমিকা করে এবার লেখা উচিত এভাবে, অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যাÐের গোল্ডকোস্টে কথাসাহিত্যিক মহিবুল আলম থাকে। মহিবুলের সাথে পরিচয় অল্পদিনের হলেও, দেশে চলে আসার আগে সে আবার যেতে বললো জামাই-মেয়েকে নিয়ে। আমি মহিবুল আলমকে জামাই মাহফুজ চৌধুরীর সাথে কথা বলে প্রোগ্রাম ঠিক করতে বললাম। তারপর এক ছুটির দিনে মাহফুজ আমাদেরকে নিয়ে রওনা হলো। প্রথম গিয়ে উঠলাম মহিবুলের বাসায়। তারপর সেখান থেকে তাদেরকে নিয়ে একসঙ্গে বের হলাম। মানে মহিবুলের গাড়ির পিছনে মাহফুজের গাড়ি। জলি-মহিবুলের কন্যা অবন্তী মাহফুজের গাড়িতে। কারণ আমার আট বছরের দৌহিত্রী জাহরার সাথে তার অদম্য ভাব হয়ে গেছে। আর মহিবুলপুত্র অনিম ক্রিকেট খেলে বলে, সে আর যখন-তখন, যেখানে সেখানে যাত্রা শুরু করতে পারে না। আরো ক’বারই দেখেছি, সে ক্লাসে, না হয় ক্লাবে, না হয় ঘরেই থেকে গেছে তার কাজকর্ম-চিন্তা-ভাবনা নিয়ে।
সেদিন আমাদেরকে মহিবুলের যেখানে নেয়ার কথা সেখানে সরকারিভাবে কাজ হচ্ছিল। সেখান পর্যন্ত যাওয়ার আগে পুলিশ গাড়ি ফিরিয়ে দিলো।
কিন্তু ধারে-কাছে কোনো এক জায়গাকে মহিবুল বেছে নিলো, বিশ্রাম ও বাড়ি থেকে বয়ে নেয়া খাবার খাওয়ানোর জন্য। আর এই জায়গা বেছে নেয়ার দায়িত্ব মহিবুলেরই ছিলো। কারণ সে গোল্ডকোস্টকে বড় ভালোবাসে। সেখানকার প্রতি ইঞ্চি জায়গা সে চেনে। আলিশান এক বাড়িও সে ওখানে কিনেছে। এখনও সেটাতে ভাড়াটিয়া থাকে। তাই কাছে গাড়ি ভিড়িয়ে মহিবুল আমাকে সে বাড়িও দেখিয়ে এনেছে। কিন্তু আমি অস্ট্রেলিয়ার আইনুসারে সীমানার বাইরে থেকেই একলা ওর ভেতরবাড়ি উড়ে-উড়ে ঘুরে এসেছি। কারণ বাড়ি শব্দটি শুনলেই তো মানুষের মন আর মানুষের থাকে না। পাখি হয়ে যায়। মহিবুল আমার জন্য এত কিছু করলো, আর আমি ওর বাড়িটা ঘুরে দেখতে, আশিস স্থাপন করে রেখে আসতে পাখি হতে পারবো না!
অবশেষে হিঞ্জ ড্যাম নামের পানির বাঁধের কাছে চাদর বিছিয়ে আমাদের বসানোর ব্যবস্থা করা হলো। আমি হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়লে মহিবুল গাড়ি থেকে টেনে-টেনে সব খাবার নামাতে লাগলো। বিশাল রাইস-কুকারভর্তি জলির রান্না খিচুড়ি আর যতো যা করেছে, পোড়া-পোড়া মুরগি, শুটকি, আলুভাজি, আলুভর্তা থেকে গরুর মাংস সব তারা স্বামী-স্ত্রী ছুটির দিনে দুজনে মিলে করেছে। খাবার সব বের করা হয়ে গেলে মহিবুল আমার দিকে এমনভাবে তার মোবাইলের ক্যামেরা তাক করলো যে, তার এই আপা যে তার কাছে ঘাসের ওপর বসে একদিন খেতে চেয়েছিলো, তাই যেন সে আজকের এই আয়োজনের মাধ্যমে সফল করতে পেরেছে। ক্যামেরার তাকেই তার সে তৃপ্তি আকাশের রঙের মতো আমার চোখে ধরা পড়ে গেলো। তার এই সফলতার পরিতৃপ্তিটুকু আমাকে ভীষণভাবে ছুঁয়ে গেলো। পৃথিবীতে কে কার ইচ্ছের দাম দেয়! যদি কেউ কারো সেটুকু দেয়, তাই যেন একটি আগরবাতি না জ¦লেও সুবাস ছড়ানোর মতো পবিত্র ও মহার্ঘ হয়ে ওঠে।
খাওয়া-দাওয়া, ঘোরা, ছবি তোলা, সবই হচ্ছে বাসনার মাপ ছাড়িয়ে। হিঞ্জ ড্যাম বাঁধের ওপাশে পাহাড়ের ওপর গাছগাছালির ফাঁক গলিয়ে মাঝে-মাঝে কিছু বাড়ির টিনের ও টালির চাল দেখা যাচ্ছিলো। অস্ট্রেলিয়াতে আবাসিক এলাকাতে ইট-পাথরের বিল্ডিং নেই। সব ইটের দেয়াল আর ওপরে টিন বা টালির চাল। আমার মন ছুটে যায় গাছ-গাছালির ফাঁক গলিয়ে দূরের উঁকি দেয়া সেইসব বাড়িঘরে। আমি মহিবুলকে বললাম, ‘আমি যদি ইংরেজি বলতে পারতাম, তাহলে হেঁটে ওইসব বাড়িঘরে বসবাস করা মানুষদের গিয়ে বলতাম, ‘আমি তোমাদের জীবনের গল্প শুনতে এসেছি। আমার জন্য চা-কফির আয়োজন করো!’ তারপর তাদের থেকে গল্প কুড়িয়ে আনতাম।
আমার কথা শুনে মহিবুল বললো, ‘আপা, আমি জানি আপনি তা পারবেন। তবে দেশ থেকে ঘুরে আসেন। আমি আর আপনি একসাথে যাবো গল্প কুড়াতে।’
দেশে ফিরে আমি মহিবুলভক্ত, মহিবুলের অনুজপ্রতিম অন্তরঙ্গ বন্ধু লেখক শামস সাইদকে মহিবুলের কথা যতোবার বলতে যাই, সে এইভাবে কথার ফুলঝুরি ঝুড়িসহ আমার কাছে উপুড় করে দেয়, তার ভাব, ‘আপনার আপনিকে আপনি কী জানেন, আমি স-ব জানি। মহিবুলভাই আপনার ভেতর তার মা-বোন দুজনের ছবিই একসাথে খুঁজে পেয়েছে! আপনি জানেন না, আপনার জায়গা তার মনে কোথায়…।’ শামস সাইদ কথাসাহিত্যিক হারুন পাশা সম্পদিত পত্রিকা ‘পাতাদের সংসার’এ আমার ‘চিলেকোঠা’ নামের একটি গল্প পড়ে। আগে-পরে ইতিউতি আরো নাকি পড়েছে। তবে চিলেকোঠার পর থেকে নাকি সে আমাকে ঈর্ষা করে। ওর এই ঈর্ষা যে ভালোবাসার চেয়ে দামি, আর তা যে আমি বুঝি, তা ওকে আর বলা হয় না। কিন্তু শামস সাইদ কখনো এলে আমার পাÐুলপিটা খুলে দিয়ে আশ^স্ত হই। বলি, ‘শোনো সাইদ, একমাত্র আমি সেই লেখক যে কি না, লেখাপড়া না করে গল্প লিখি। তার-ওপর ওই যে সব তাজা-তাজা মানুষ নিয়ে লিখি বলে আরো ঝামেলা। কাকে কোথায় ছোট করি, কারো সম্পর্কে উল্টাপাল্টা কি লিখি, শেষে কোথায় কে আমাকে বাগে পেয়ে ধরে নিয়ে কিলিয়ে সাইজ করবে…। তাই তোমার মতো লেখক, যে কি-না আমার গল্পকে চিনেছো, সে যদি পড়ে একটু বলে যাও, মানে অভয় দিয়ে যাও যে, না আপা ভাঙাভাঙির মতো কিছু হয়নি। তাহলে পরানের পানিটা আগামী দিনের জন্য ধরা থাকে। নাহলে শুকানোর উপক্রম মাথায় বয়ে বেড়াই।’
শামস সাইদ বললো, ‘না না, ঠিকাছে।’ সে গভীর মনোযোগ দিয়ে আমার সমুদ্র নিয়ে লেখাটা পড়তে থাকে।
আমি শামসকে আরো বললাম, দেখো, আমি কী উজবুক! ‘ঋতবর্ণ’ সম্পাদক ইবরাহীম মুহাম্মদ এবার তার ঋতবর্ণকে সমুদ্র দিয়ে ভরাবেন। আমাকে বলেছেন, গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা, সমৃতিকথা, লেখা যা-ই হোক সমুদ্র থাকতে হবে। আমি ভেবেছিলাম, হাতের লেখাগুলো গুছিয়ে সমুদ্র নিয়ে উত্তম পুরুষে লেখা শুরু করবো এক প্রেমের কাহিনি। জাহাজের ডেকে বসে ইচ্ছেমতো প্রেম করবো একটি পুরুষ-চরিত্র একটু-একটু নিজের মতো গড়ে। তাতে প্রেম-প্রেমভাবে আলগা হলেও হৃদয়ে একটা আরাম ভাব আসবে। যেন প্রেমটা স্বয়ং লেখকের। কিন্তু সমুদ্রের তেমন স্মৃতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে না। তাই শুরুটা হচ্ছিলো না। কিন্তু হঠাৎই নিজেকে ডেকে বলে উঠলাম, আরে কুইন্সল্যান্ড থেকে আসার মাত্র দিন তিনেক আগে মহিবুল তোর হাতে শুধু নয়, আস্ত একটা সমুদ্র মহিবুল তোর প্রাণের ভেতর তুলে দিলো। আর তবু তোর হাহাকার গেলো না? সাইদ বললো, ‘সেই গল্পটাই কন তো আপা। যদিও তখনকার ছবি পোস্ট দিছেন মেলা। তবু আপনার মুখ থেকে শুনি!’
কিন্তু বিষয়টা হলো কি, ওই যে সেদিন হিঞ্জ ড্যাম থেকে সন্ধ্যা মাথায় করে মহিবুল আমাদের নিয়ে যাচ্ছিলো প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে। পথে আবার গাড়ি ভিড়িয়ে কী-কী যেন কিনলো। যা কিনলো জামাতা মাহফুজ চৌধুরীও আমার কাছে গোপন করে গেলো।
মহিবুলের গাড়িতে আমি আর জলি। আমি যে কদিনই মহিবুলের সাথে গেলাম, জলি আমাকে ঠেলে সামনে বসিয়ে সে পিছনে গিয়ে বসে। বেচারি সারা সপ্তাহের ক্লান্তি নিয়ে ঘুমিয়েও পড়ে। আর আমার আর মহিবুলের কত-কত কথা যে বলা হয়। যেন আমরা বুঝতে পারি, আমাদের সময় খুব বেশি না। গলা বেয়ে আসা কথাগুলো তাড়াতাড়ি সারতে হবে। সারিও। দেশের লেখালেখি ও লেখকদের নিয়ে যা জানি। যে যতটুকু নতুন কিছু পড়ি, তার থেকেও বলি!
৭
আমরা যখন সাগরপাড়ে গিয়ে পৌঁছুলাম, তখন সাগর তো রাতের কালো চাদরে ঢাকা। কিন্তু হু হু উত্তাল বাতাসের ভেতর মহিবুল তার গাড়ি থেকে অনেকরকম সরঞ্জাম বের করলো। তার ভেতর কেক মিষ্টি, কাগজের কাপ-প্লেট, প্লাস্টিকের চামচ। ম্যাচ, মোমবাতি। সাথে একখানা ছুরিও। তারপর কেকের ওপর সবগুলো হ্যাপি বার্থ লেখা মোমবাতি ফিট করে শেষ পর্যন্ত যে সে মোমবাতিগুলো সব জ¦ালিয়েই ছাড়লো ওরকম ঝাপটার বাতাসে। দীর্ঘ সময় গেলো মহিবুলের সেই মোমবাতিগুলো জ¦ালাতে।
একেকবার বাতাস একেকটি নিবিয়ে দেয়, সে আবার শুরু করে। আর আমি বিমূঢ় হয়ে তাই দেখতে থাকি। কতবার মনে হয়েছিলো, এবার মহিবুল নিস্তার হবে। কিন্তু আমার মূঢ়তাকে মুগ্ধতায় উদ্ভাসিত করে মহিবুল আমাকে অপরিশোধ্য অগ্নিঋণে আবদ্ধ করেই ছাড়লো। সে সবগুলো মোমবাতি জ¦ালিয়েই নিস্তার হলো। আর আমি একটা মহাপ্রাপ্তির ভারে ক্রমশ বুঁদ হয়ে উঠতে থাকলাম সেই মাহেন্দ্র সন্ধ্যা থেকে। আর সেই সমুদ্রের স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে নদী ও ঝোরার মতো আরো কত স্মৃতি ফল্গুধারায় তাতে ছুটে এসে কত বাঁক, কত মোহনা, বিনিসুতার মালার মতো কতো সম্পর্ক ও মুখকে ভাস্বর করে তুলেছে! একজীবনে এই পাওয়া খুব কম মানুষের ভাগ্যে জোটে। খুব কম মানুষ এই প্রাপ্তি দিয়ে হৃদয় নামক অদৃশ্য অস্তিত্বকে প্রসন্ন করে রাখতে পারে। তাই সেই কম মানুষের একজন হয়ে থাকতে সব সময় কলুষ থেকে বাঁচিয়ে প্রাণ পবিত্র ও জাগর করে রাখি আর ভাবি, পারছি তো প্রসাদকে আহার না ভেবে প্রসাদ করেই রাখতে!
দ্বিতীয় প্রেম…
দীলতাজ রহমান
একটি ছোট পত্রিকার সম্পাদক প্রথম প্রেম নিয়ে একটি গল্প লিখে দিতে বলেছেন। খুব খেটেখুটে গল্পটা লিখে পঠানোর পর মনে পড়লো, মারাত্মক ভুল করে ফেলেছি। ওই গল্পের প্রেমটা দ্বিতীয় ছিলো! প্রথম প্রেম যখন অনুভূত হয়েছিলো, তখন আমার বয়স আট। ওই যে ঊনসত্তরে যখন চাঁদের মাটিতে মানুষের পা রাখার খবর সোরগোল ফেলেছিলো।
যা হোক, হিসেব মতে তখন আমার বয়স আটই হয়। কিন্তু এখনকার চেয়ে তখনকার শিশুরা খোলা পরিবেশে মানুষ হওয়ার কারণে সম্ভবত তাদের সংবেদনশীলতা এখনকার চেয়ে তীক্ষè ছিলো। নাহলে এখনকার আট বছরের শিশুর তো এই অনুভূতি হওয়ার কথা নয়! আমরা তখন খুলনার দৌলতপুরে। ওখানে আমাদের পাশের বাড়ির আকতার নামে পনেরো, ষোলো বছরের এক ডাঙর ছেলে সব সময় আমাকে টিজ করতো! পানিতে নামলে হৈচৈরত এক দঙ্গল ছেলেমেয়ের ভিড় থেকে আমাকেই ঠ্যাং ধরে সে টেনে পানির অনেক ভেতরে নিয়ে কচলাকচলি করতো। তখন এতে আমার দম যায়যায় দশা হতো! শেষ পর্যন্ত ওকে আমার যমের মতো ভয় নয় শুধু, কেঁচোর মতো ঘেন্নাও হতো।
একবার কি করলাম, আকতারের একটা বিড়াল ছিলো। ভীষণ আদর করে পুষতো সে। আকতারকে শোধ নিতে সেই বিড়ালকে ধরে এনে ভাড়াটিয়া চলে যাওয়া এক খালি ঘরের আড়ার সাথে বেঁধে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে পিটিয়ে মেরেই ফেললাম।
মরে যখন গেলো, সে মরা বিড়াল দেখে আমার মা’র আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হওয়ার দশা! মা আমাকে বকতে বকতে বলতে লাগলো, দেখিস, আকতার কী করে! মা’র ভয় পাওয়ার কারণ আমরা তো আমরা, আমাদের বাড়িওয়ালাদের থেকেও আকতাররা ওখানে প্রভাবশালী।
তবু মা’কে তো বলতে পারি না, ও আমাকে কিছু একটা করে বলেই তো আমি তার প্রতিশোধ নিলাম!
সত্যি সত্যি কিছুক্ষণের ভেতর আকতার কেঁদেকেটে হাপুস চোখে সেখানে এসে হাজির! পুঁচকেপাচকাদের কেউ একজন তাকে গিয়ে নিশ্চয় বলে দিয়েছিলো। নাহলে লাশ গুম করার আগে সে এলো কি করে, আজো ভেবে
পাই না! আর বন্ধু-সতীর্থদের ভেতরই যে বিশ^াসঘাতক থাকে, তাও আমার সেই তখনই জানা হয়েছে।
আকতার কারো সাথে কোনো কথা না বলে, হাউমাউ করে কেঁদে উঠে তার বিড়ালের লাশ দু’হাতে তুলে নিয়ে চলে গেলো। এরপর আমি আর পারলে ঘর থেকে বেশি দূরে যাই না। পুকুরে গোসল করতে তো যাই-ই না। কিন্তু অনেকদিন পর, পরিস্থিতি একটু থিতিয়ে এলে এক অসময়ে, যখন পুকুরে কেউ ছিলো না, তেমন এক টইটুম্বর লগ্নে পুকুরের পাড় দিয়ে যেতে আমাকে যেন সে পুকুর তার সমস্ত জলের স্ফটিক ইশারায় আয় আয় করে ডাকতে লাগলো।
পানির প্রতি আমার অসম্ভব একটা টান ছিলো। যা এখনো আছে। আমি সুযোগ পেলেই মা’কে লুকিয়ে ইচ্ছে মতো ডুবিয়ে, সাঁতার কেটে, পুকুরপাড়ে খুলে রাখা শখিনো প্যান্টটা পরে বাসায় ফিরতাম। মনে করতাম মা টের পাবে না। কিন্তু শরীরের খরখরে অবস্থা দেখে মা বিষয়টা বুঝতে পারতো। আর ইচ্ছেমতো মার দিতো!
সেই দুপুরেও আমি আমার হাফপ্যান্টটি সিঁড়িতে রেখে সাঁতরে একটু শুধু কয়েক গজ দূরে মাত্র গেছি। তখনো একটি ডুবও দেইনি। এর ভেতর দেখি, বিশাল পুকুরটির যেই পারে আকতারদের বাড়ি, সেই পাড় থেকে বড় বড় পাতার একটি ডুমুর গাছ এমনভাবে পুকুরের ভেতর ঝুলে পড়েছে, যেন কলঙ্কের ভারে সে ডুবে মরতে চাইছে! ছাতার মতো সেই ডুমুর গাছের একেকটি পাতার ফাঁক দিয়ে দেখি জীবননান্দ দাশের কবিতার চিত্রকল্প সম্বলিত বিশাল এক পেঁচার মতো আকতারের ভয়ঙ্কর নেকড়েমুখ ঠা ঠা রোদে নতুন টিনের মতো চকচক করছে!
ভয়ে আমার বুক চৈত্রের মাঠের মতো চৌচির হয়ে গেলো অথৈ পানিতে থেকেও! আমি কিভাবে যে পুকুর থেকে উঠলাম, মনে নেই। তারপর সিঁড়ি থেকে প্যান্টটা হাতে তুলে নিয়ে বাসার দিকে ভোঁ দৌড় দিলাম। আর মুহূর্তে একটা তীর ছুটে এসে আমার বাম হাঁটুর নিচে বিঁধে গেলো!
এখন বুঝি তীরটা আকতার অতো মসৃণ করে আমার বুকে মারার জন্যই পাকা বাঁশের শক্ত চটা চেঁছে বানিয়েছিলো। তীরটা আমার হাঁটু থেকে টানাটানি করে খুলতে আমাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিলো। চৈত্রের সে দুপুরটা এতো নিজঝুম ছিলো, যে একটা মানুষ সেখানে কোথাও ছিলো না, যে দৌড়ে এসে আমাকে সহযোগিতা করে! এখনো মনে আছে, রক্তশূন্য মুখ কিন্ত পা রক্তে মাখামাখি। উঠোনে গিয়ে দাঁড়াতেই আমাকে ঘিরে ধরলো অনেকে। আমি শুধু বলতে পারলাম, আকতার…।
ক’দিনধরে বাড়ি সরগরম হয়ে থাকতো মানুষে, এর ভেতর একদল আমার আব্বাকে উস্কাতো মামলা করতে। আরেক দল হাতে-পায়ে ধরতো, আমরা যেন কোনো আইন-আদালত না করি!
আয়ুর শেষ সীমানায় হলেও আমলটা তো তখন পাকিস্তানের। একটু রক্তাক্তিতেই তখন খবর হয়ে যেতো। তাই শালিস-দরবার, মাফ চাওয়া-চাওয়ির ভারে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠলো। আকতারকে এ জীবনে আর আমি চোখের সামনে দেখিনি। ওকে বোধ হয় কোথাও পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিলো।
এই আকতারেরই বড় ভাই হায়দার। নায়কের মতো ছিলো চেহারা, চাল-চলন। তখন মাত্র কলেজে উঠেছে। খুলনার মহসীন কলেজে পড়তো! তাকে দেখলে আমার খুব ভাল লাগতো। সেদিন রাতে হারিকেন হাতে করে আকতারের মা-বাবা আর সেই বড়ভাই হায়দার এসেছিলো আমাকে দেখতে। আর আমার তখন মনে হয়েছিলো, ভালো করেছে, আকতার আমার পায়ে তীর মেরেছে! নাহলে হায়দারকে কোনোদিনও এতো কাছে থেকে দেখতে পারতাম না। কোনোদিনই সে আমার পায়ে হাত দিয়ে দেখতো না!
হায়দারকে যেদিন কাছে থেকে দেখলাম, বুঝলাম কাছে থেকে দেখতে সে আরো সুন্দর! কি সুন্দর করে সবার সাথে কথা বলছে! আমাকে চোখের ঝিলিক মেরে বললো, ‘তুমি কেন ওর বিড়াল মেরেছো? সেটাও কিন্তু কম অপরাধ নয়! ওটা ওর খুব ভালবাসার বিড়াল ছিলো। খেতে বসে সে নিজের ভাগের মাছ-মাংস লুকিয়ে বিড়ালকে খাওয়াতো। আকতার তোমাকে তীর না মারলে আমি তোমাকে জেলে ঢুকিয়ে দিতাম। ও, তোমার তো আবার জেল হতো না। তুমি ছোট মানুষ!’
হায়দারের এমন অনুযোগে তার প্রতি আমার ভালোলাগাটা আরো গাঢ়ো হয়ে উঠলো। মাত্র আট বছরের মানুষ প্রেমে পড়তে পারে এ আমার বিশ^াসই হয় না! কিন্তু হায়দারের কথা মনে হলেই বিশ^াস হয়, আমি মাত্র আট বছর বয়সে তার প্রেমে পড়েছিলাম!
আমি সম্পাদককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, লাকী প্রথম প্রেমের গল্প আহবান করে বই করলে না কেন? তিনি উত্তর দিয়েছেন, আপনি ছাড়া দুই বছরে কারো সাহস হয়নি ‘প্রথম প্রেম’ নিয়ে গল্প লেখার! একমাত্র আপনিই সেই বীর পুরুষ যিনি সে গল্পটি লিখেছেন!’ লাকীর কথায় এতবছর পরেও আমি সেই হায়দারকে আরেকবার ধন্যবাদ দিলাম।
আকতারের দাদি মারা গেলে ওর দাদা আরেকটা বিয়ে করেছিলো। সেই মহিলার কোনো ছেলেমেয়ে ছিলো না। তার মাথায় ছিট ছিলো। কখনো তাকে পাগলামি করতে দেখিনি অবশ্য। তবু পাগল না হলে আকতারের মার হাতে বড় বড় চেলাকাঠের অমন মার খেয়েও, কেন সে পড়ে থাকতো ওই বাড়ি? তবু কেন হায়দার, আকতার ও ওদের ছোট ভাই রিয়াজুলকে সে অকারণে অতো ভালবাসতো? কেন কারো কিছু কুড়িয়ে পেলে তাকে খুঁজে
জিনিসটি পৌঁছে দিয়ে আসতো? পাড়া-প্রতিবেশীও সবাই তাকে পাগলি বলেই ডাকতো। যেহেতু আকতারের বাবা স্বয়ং তার মা’র অবর্তমানে বাবার বিয়ে করে আনা এই দ্বিতীয় স্ত্রীকে খুঁজে না পেলে নিজেই ‘পা-গ-লি-ই…’ বলে সুর করে ইতিউতি ডেকে বেড়াতো! আর তার সে সৎমা ভয়ে জড়সড়ো হয়ে ছুটে কাছে এসে খিনখিনে কন্ঠে বলতো, ‘আমি তো এইহানেই আছি!’
পাগলি ওদের সব কাজ করে দিতো। কুড়াল দিয়ে আস্ত গাছ থেকে লাকড়ি বের করা থেকে, পুকুরে নিয়ে আকতারের মার একেক বোঝা পানও নরম ন্যাকড়া দিয়ে ডলে ডলে ধুতো। প্রাায় পঞ্চাশ বছর আগের ঘটনা হলেও আজো পান ধুতে হলে আমি সেই আকতারের দাদির মতো করে ধুই। যাকে হায়দার ছাড়া আর সবাই বলতো পাগলি। হায়দার একাই বলতো দাদি! হায়দারের পৌরুষদীপ্ত চেহারার সাথে এইটুকু ভব্যতা যুক্ত হওয়ায়ই কি হায়দারকে আমার অতো ভালো লাগতো কি না, জানি না!
পাগলির হাত-পা সব সময় সাদা দগদগে থাকতো। মানে সারাক্ষণ ক্ষার ছাই দিয়ে থালা-বাসন মাজা, কাপড়-চোপড় ধোয়া আর কাঁচা মাটির বাড়িঘর লেপাপোছা করতে করতে হাতে ঘা হয়ে থাকতো!
সত্তরের শেষের দিকে আমরা ঢাকা চলে আসি। এর ভেতর খুলনার সাথে আর কোনো যোগাযোগই নেই। ২০০৯ সালে কোরবানী ঈদের রাতে আমার ছোট মেয়ে ফারজানা আমাকে বললো, ‘ আম্মা, আমি কাল আমার অফিস থেকে খুলনা যাবো, তুমি কি আমার সাথে যাবে? গেলে সকালে রেডি থেকো!
সকালে ঘুমের ভেতর টের পেলাম আমার ছোট মেয়ে ফারজানা সুটকেস টেনে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি মাথা তুলে বললাম, তুমি না বললে আমাকে নিয়ে যাবে?
ফারজানা বললো, তুমি তো রেডি হওনি? আমাকে নিতে নিচে গাড়ি চলে আসছে!
আমি মুহূর্তে শাড়িটা পাল্টে বøাউজ পাল্টাতে আর সাহস পেলাম না। চাবিটা নিচে রিসিপশনে রেখে আমার ছোটবোন নাসিমাকে ফোন করে বললাম, আধকাঁচা মাংসসহ ঘরের যা অব্যাবস্থাপণায় আছে, সব ঠিকঠাক করে রেখে যেতে।
শ্যামলী থেকে বাসে উঠে বিকেল নাগাদ খুলনায় নেমে, ওখানকার ওয়েস্টিন হোটেলে গিয়ে উঠলাম। কিছুক্ষণের ভেতর দেখলাম সেখানে খুলনা ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার সৈয়দ মিজানুর সেখানে এসে হাজির। বয়সে তিনি আমার সমান। তবু তাকে চাচা ডাকি। কারণ কবি সৈয়দ হায়দারের তিনি সম্পর্কে ভাতিজা! তাই ভাতিজা না ডেকে চাচাই ডাকি। ভীষণ ব্যস্ততা তখন তার। তারওপর তার ছেলের তখন প্রাইমারি বৃত্তি পরীক্ষা। আগামী দু’দিনেও সময় দিতে পারবেন না। তাই একঘণ্টা সময় আমার জন্য হাতে নিয়ে এসেছেন।
এই লেখাটি সেই তখন লিখলে অনেকটা ঠিকভাবে লিখতে পারতাম। তবু একটু একটু করে মনে পড়ছে, চাচা একঘণ্টা চুক্তিতে রিক্শা ভাড়া করে আমাকে কোথায় কোথায় নিয়েছিলেন।
আমি ঢাকা থেকে যেতে যেতে পথে তার সাথে ফোনে নিশ্চয় কথা হয়েছিলো। নাহলে আমি গিয়েছি, সে খবর তিনি পেলেন কী করে! তবে এটা ঠিক মনে আছে, সেই একঘন্টা সময় অচেনা রাস্তা আর নদীর পাড় ধরে অভ‚তপূর্ব কেটেছিলো।
পরদিন সকালে আমাকে তেমনি আমার ঘুমের ভেতর আমার ছোট মেয়ে বলতে লাগলো, আম্মা, আমি আমার কলিগদের সাথে বেরিয়ে যাচ্ছি। ফিরতে রাত হবে! তুমি তোমার ছোটবেলায় এখানে কোথায় কোথায় ছিলে, খুঁজে বের করে বেড়িয়ে এসো!
একা কোথায় ঘোরা যায়? হোটেলের নিচে রিসিপশনে গিয়ে রিসিপশনিস্টদের বললাম, আমি এখানে কোথায় ঘুরতে পারি? ওরা আমাকে বললো, এখান থেকে বিশটাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে রূপসা ব্রিজের গোড়ায় চলে যান। তারপর ব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে দেখতে দেখতে পার হয়ে নদীর ওপারে চলে যান। সারাদিন ওপারের শান্ত পরিবেশে ঘোরাঘুরি করেন। আসার সময় নৌকোয় করে পার হয়ে এইপাশে আসেন।
সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ওই পরে একাই ঘুরে বেড়িয়েছি। বসে থেকেছি। দরিদ্র দুটি পরিবারের উঠোনে বসে তাদের সাথে গল্প করেছি। আসতে সময় হেঁটেই ব্রিজ পার হয়েছিলাম। কিন্তু আবার এপাশে আসতে ডিসির বাংলোর সামনে যখন নৌকা ভেড়ালো, তখন আসন্ন বিকেল। ডিসির বাংলো তখন খালি ছিলো। নৌকা থেকে নামার পর আমি তাই অভয় মনে ওই বাংলোর শূন্য আঙিনাতে ঘুরছিলাম। শানবাঁধানো একটি বকুল গাছের গোড়ায় দেখলাম লেখা রয়েছে, বঙ্কিমচন্দ্র তার ‘কপালকুÐলা’ এই বকুল গাছের নিচে বসে লিখেছেন! আমি অভিভ‚ত হয়ে ক’খানা সরু ডাল ভেঙে মহৎ স্মৃতি হিসাবে হাতে নিলাম। তারপর সন্ধ্যা নামতে নামতে হোটেলে ফিরে গেলাম। পরদিন তেমনি উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে একটি রিকশা নিলাম। দৌলতপুর কোন্ বাড়িতে ছিলাম তা তো ভুলে গেছি। জানতাম না, সে বাড়ি খুঁজতে হলে রিকশাওয়ালাকে কি বলতে হতো।
আগেরদিন ডিসির বাংলো থেকে যখন ওয়েস্টিন হোটেলে যাই, রিকশাওয়ালাকে বলেছিলাম, আমি আগামীকাল দৌলতপুর যেতে চাই। কিন্তু এলাকা চিনি না। তবে মুক্তিযুদ্ধের আগে দেখে গেছি তো, বিশাল এলাকাজুড়ে ভাড়া দেয়ার গোলপাতার ঘর। মাঝখানে দীঘির মতো একটা পুকুর। আর একটি মাত্র টিউবয়েল ছিলো। রাস্তার পাশে একটা রাইস মিল ছিলো। বাড়িটাকে আতিয়ার মিয়ার বাড়ি বলতো। বাড়িওয়ালার কোনো ছেলেমেয়ে ছিলো না।
আমারই সমবয়সী রিকশাওয়ালা বললো, ‘হ, চিনছি! আতিয়ার মিয়া যুদ্ধের আগেই আরেকটা বিয়ে কইরেছেলো। এহন আতিয়ার মিয়া নাই। এই ঘরে পাঁচ ছাওয়াল-মাইয়ে। তারা এ্যাকাকজন ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার অইছে। বালো আছে তারা!’ আমি বললাম, ধুর তুমি চেনোনি! কারণ ওই বাড়িওয়ালা তার পাটরানীর মতো স্ত্রী’র দাপট টপকে আরেকটা বিয়ে করতে পারে, এ তখনকার যে কারো ভাবনার অতীত।
বিশাল এলাকাজুড়ে গোলপাতার ঘর হলেও, আতিয়ার মিয়া ও তার স্ত্রী জাহানারা বেগম নিজেদের জন্য দু’রুমের একতলা একটি বিল্ডিং করেছিলেন। যা আমার চোখের সামনেই ক’দিনের গড়ে উঠেছিলো। রুম দুটির ছিলো বিশাল এক বারান্দা। সামনে ছিলো গোলাকার এক পুরনো গোলাঘর। অন্যপাশে গোয়ালভরা গরু। বাড়িওয়ালাকে আতিয়ার মিয়া বলে সবাই ডাকতো। কিন্তু তার নাম ছিলো আতিয়ূর রহমান মিয়া। খুব সুদর্শন দেখতে ছিলেন তিনি! বড় চাকরি করতেন। ছিলেনও স্ত্রী’র বিপরীত স্বভাবের, খুবই মিষ্টভাষী। তাদের কোনো ছেলেমেয়ে না থাকায়, ছোটবেলায় ওই বাড়িতে কাজ করতে আসা বাড়ির চাকর যখন বিয়ের উপযুক্ত হলো, তাকে বিয়ে দিয়ে দুধে আলতা গায়ের রঙ, ফুটফুটে চেহারার যে বউ এনেছিলেন তারা। বিল্ডিংয়ের দু’টি রুমের একরুমে জাহানারা বেগম আর আতিয়ূর রহমান থাকতেন, আরেক রুমে সেই রাখাল কাম রাইসমিলের চালক মোর্শেদ তার স্ত্রী ও অন্য দুটি সন্তানকে নিয়ে থাকতো। আর মোর্শেদের প্রথম ছেলে তমাল থাকতো আতিয়ূর রহমান ও জাহানারা বেগমের মাঝখানে। গদির ওপর আরেকটি গদি দিয়ে তমালের বিছানা হতো। সাথে রাবারক্লথও যখন বিছানোর কথা মনে পড়ছে, তার মানে, তমাল অনেক ছোট থাকতেই তার পিতার মনিবদম্পতির মাঝখানে জায়গা করে নিয়েছিলো।
বেবী সাইকেলের সাথে নিত্যনতুন খেলনা ও কর্তা-কর্ত্রীর অখÐ মনোযোগের জন্য তমাল ভাড়াটিয়াদের শ’খানেক ছেলেমেয়ের মধ্যে মধ্যমনি হয়ে থাকতো! তমালের বাপ সর্ব সাকুল্যে ও বাড়ির কেয়ারটেকারের পদমর্যাদা লাভ করলেও তমাল ছিলো জাহানারা বেগম ও আতিয়ার রহমান মিয়ার পুরোপুরি সন্তান বাৎসল্যে!
মোর্শেদ ভাইয়ের সব সময় শুধু মুখে নয়, মনে হতো সারা শরীরে একটা উৎফুল্লভাব ফুটে থাকতো। সুন্দরী বৌ। বছর বছর বাচ্চা হচ্ছে বলে পিতা-মাতারও অধিক মনিবদম্পতি তাতে প্রশন্ন হচ্ছেন, নিঃসন্তান তারা চোখের সামনে নতুন বাচ্চকাচ্চার মুখ দেখছেন বলে। অথচ ফরশা, শক্তপোক্ত, চেপ্টা শরীরের লড়াকু চেহারার মোর্শেদ ভাইয়ের সেই খালি গা। মুখে পান। কোমরে গামছা বাঁধা। কখন কিসের কোন্ ক‚ল টলে ওঠে আর একমাত্র তাকেই যে সব রক্ষে করতে হয়! সম্মুখ সমরে ঝাঁপ দেয়া সৈনিকের মতোই ছিলো তার সব সময়ের ভাব!
রিকশা খুলনা ওয়েস্টিন হোটেল থেকে দৌলতপুর আসার পর কোথায় যাবো বুঝে উঠতে না পেরে পার্কে নেমে গেলাম। কিন্তু সেখানে জোড়ায় জোড়ায় ছেলেমেয়েদের আচরণ দেখলাম ঢাকার চেয়ে খারাপ। সে অবস্থায় বেশিক্ষণ বসা গেলো না। তখন আমার মামাতো ভাই বি, এম, এনামুল হক ছিলেন রংপুরের ডিসি। আমি তাকে ফোন করে বললাম, দাদা, তুই যে একবার যশোর থেকে বিরাট একটা রুইমাছ নিয়ে দৌলতপুর আমাদের যে বাসায় এসেছিলি, সেই বাসাটা দৌলতপুরের কোথায়?
দাদা বললো, তুই এখন কোথায়?
আমি বললাম, দৌলতপুর পার্কে। তারপর দাদা কোনদিকে যেতে বললো, আমি না বুঝেই আরেকটা রিকশা নিলাম। এবং কয়েক গজ গিয়ে অনুমান করে এক গ্রীলের দোকানের গিয়ে বাড়ি ও বাড়িওয়ালার বর্ণনা দিতে লাগলাম। একজন বললো, আমি চিনি! সে হাতের কাজ ফেলে আমাকে নিয়ে ত্যাড়াব্যাঁকা এক রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে লাগলো। আমি ভাবতে লাগলাম, আমি যে বাড়ির কথা বলছি, সে বাড়ি ছিলো মেইন রোডের পাশে। এই ছেলে নিশ্চয় আমাকে গলির গলি তষ্য গলির ভুল কোনো বাড়িতে নিয়ে তুলবে! তবু তার পিছনে হাঁটতে লাগলাম। বেরিয়েছিই তো পাবো না জেনে! তাহলে নতুন যে কোনো ঠিকানায় পৌঁছুলেই হলো।
ছেলেটি অতঃপর যে বাড়িতে আমাকে নিয়ে থামলো, সেটা আভিজাত্যহীন, অতি নিম্নবিত্তর এলাকার টিনসেড দুটি রুম আর তার বারান্দার দুপাশে আরো দুটি পকেট রুম। বারান্দার সে পকেট রুমের একটি থাকার রুম। আরেকটিতে রান্নাবান্নার কাজ করা হয়।
বাইরে মানুষের সাড়া পেয়ে ভেতর থেকে যে ক’জন একসাথে বেরিয়ে এলো, তার একজনকে চিনতে পেরে বুকের ভেতর তিরতির করে উঠলো। মুহূর্তে তিরতির নদীতে বানডাকা জোয়ার এলো। চোখ উপচে পানি উঠছে আমার। কথা বলতে গেলে গলা দিয়ে কথা না বেরিয়ে কান্না উথলে উঠছে। কিন্তু সেই পাটরানীর মতো গা-ভরা ভারী গয়নায় সেজে থাকা অথচ প্রচÐ মেজাজিই নয় শুধু, বদমেজাজিই যাকে মনে হতো, তাকে এখানে খালি গা আর সাধারণ একখানা মোটা কাপড়ে দেখে আমার কেন কান্না আসবে? আমি তো তার শ’খানেক ভাড়াটিয়ার ছেলেমেয়ের সাথে তার কাছে পোকা-মাকড়ের অধিক কিছু ছিলাম না!
নিজের কান্নার জন্য নিজেই লজ্জা পাচ্ছিলাম। কথা জড়িয়ে যাওয়ার জন্য আমি বেশ ক’বার বলার পর তিনি আমাকে চিনলেন। কারণ এতো বছর পর চেনার জন্য সেই ছোটবেলায়ও তিনি আমাকে সেভাবে দেখেছেন, সেভাবে বলতে হবে তো!
তাদের বাড়ির একটা পাশের পুরোটা আমরা ভাড়া নিয়ে থাকতাম! সেখানে ছিলো আমাদের ‘সিমোডিন ইউনানী দাওয়াখানা’ নামে ওষুধ তৈরির বিরাট কারখানা এবং রাস্তার পাশের দিকটায় নিজেদের করা বিক্রয় কেন্দ্র। আমার মা’র সাথে জাহানার বেগমের খানিকটা ভাব ছিলো। আমার মা অত্যন্ত কোমল মেজাজ ও শিল্পগুণের অধিকারী হওয়ায়, কেন যেন সবাইকে তার কাছে আসতে হতো। আসতেন গাভরা গয়নায় মোড়ানো এই জবরদস্ত জাহানারা বেগমও।
গতকাল রিকশাওয়ালা যা বলেছেন, তাই ঠিক। আতিয়ূর রহমান মিয়া অরেকটা বিয়ে করেছিলেন। তারপর সে ঘরের ছেলেমেয়ে বড় হতে হতে বা আগেই মোর্শেদকে তার ছেলেমেয়ে বউসহ বেরিয়ে আসতে হয়েছে। ২০০৯ সালে আমি যখন গিয়েছি, তখন সেই সদা হাসিখুশি, বাড়ি মাতিয়ে রাখা শক্তপোক্ত শরীরের মোর্শেদ পরপারে চলে গেছে।
জাহানারা বেগমের কি নিয়তি, তার নিজের সেই পাকা মহল ছেড়ে দিয়ে তাকে বাড়ির সেই চাকর মোর্শেদের ছেলেমেয়ের সাথে এসেই থাকতে হয়!
আর নিয়তি আমারও! যে আমি গেছি, অতি শিশুকালের শুধু পুরনো বাড়িটা আর আকতারকে এক নজর দেখার টানে, যে আকতারের ছুঁড়ে দেয়া তীরের দাগ আমি সারাজীবন হাঁটুর নিচে বহন করছি!
ছোট ভাইবোন সবার বিয়ে হলেও তমাল বিয়ে করেনি। কেন বিয়ে করে না, তা তার মা আর দাদি কেউ কারণ জানে না। তমাল একাই বারান্দার পকেট রুমটিতে থাকে!
তমালের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, জীবনের এতবড় উত্থান আর পতন দেখা দোটানার স্মৃতিতে যে ভোগে, তার তো অনেক কিছুতেই হিসেব না মেলারই কথা! সেখানে বয়স পঞ্চাশ পেরোলেও বিয়ে না করা আর এমন কি!
আমার কান্না দেখে খালাম্মা আশ্চর্যই হয়েছিলেন। হয়ত কোনদিনই কেউ তার জন্য কাঁদেনি! তার পরিবর্তন ও বিপর্যয়গুলো আমার চোখের সামনে ঘটলে আমারও গা-সওয়া ঠেকতো! চোখের সামনে ঘটেনি বলে কল্পিত দানবের জাদুর কুফল মনে হচ্ছিলো।
মাটিতে বিছানো পাটিতে সবার সাথে ভাত খেয়ে জাহানারা বেগমকে বললাম, খালাম্মা, আমি একটু আকতারদের বাড়ি যেতে চাই। খালাম্মা তমালের ছোটভাই শরিফুলকে আমার সাথে দিলেন, আমরা দৌলতপুর ছাড়ার আগে সেই সত্তর সালে যার বয়স বছরতিনেক ছিলো। শরিফুল সেই তাদের পুরনো বাড়ির ভেতর দিয়ে আমাকে নতুন করে সব দেখাতে দেখাতে আনছিলো। শরিফুল একজনকে দেখিয়ে ইশারায় বললো, দাদার দ্বিতীয় স্ত্রী!
শরিফুল না বললে, আমি হয়ত আরেকবার ফিরে তাকাতাম না, কাজের লোক মনে করে। আর আমার কাছে মনে হচ্ছিলো, কেন ছোটবেলায় এই একতলা বিল্ডিংটাকে এতো রাশভারি মনে হতো? বাড়িওয়ালার গোলাঘর তবু ওটা দেখলে মনে অভ‚তপূর্ব এক শান্তি অনুভ‚ত হতো! ওই গোলাঘরে কেউ ঢুকলে আমরা হুড়মুড়িয়ে পড়তাম, ওর ভেতর এক নজর অন্ধকার দেখতে। কিচ্ছু দেখা যেতো না ওতে। যে ধান বের করে আনতো, সে অনুমান করেই ধামা ভরে ধান তুলে বাইরে মইয়ের ওপর যে দাঁড়িয়ে থাকতো, তার হাতে দিতো।
তারপর পুকুরটাকেও আর প্রশান্তির লাগছিলো না। সারাজীবন সে কি এভাবেই ছিলো না কি এখন সে জৌলুস হারিয়েছে বুঝতে পারলাম না!
মামাতো ভাই, বলছিলো, বাড়িটা চিনে যেতে পারলে দেখে আসিস্, পুকুরপাড়ে সেই কদবেল গাছটা আছে কি না! ঠাস করে একটা বেল পড়লে একদঙ্গল ছেলেমেয়ে ওই পুকুরে একসাথে ঝাঁপ দিতো বেল তুলতে! পেতো একজনে কিন্তু সবাই মিলে ভাগ করে খেতো!’ চল্লিশ বছর পর দেখলাম, গাছটি আছে। কিন্তু ন্যাড়াভাব। নেই সেই রাইস মিলটা। যেখানে মানুষ ধান ভাঙাতে এলে আমরা ছোটরা ঢুকে পারলে মোর্শেদ ভাইকে ফাঁকি দিয়ে তুষসহ মেশিন থেকে বের হওয়া একেক মুঠ গরম চাল থাবা দিয়ে নিতাম। তারপর বাইরে এনে এক হাতের থেকে আরেক হাতে গড়ড়িয়ে ফুঁ দিয়ে তুষ বেছে ফেলে সে চাল খেতাম! আহা, অমৃত হার মানে তসরুফ করে আনা সে একমুঠো চালের স্বাদে!
আকতারদের বাড়িতে ঢুকেই হায়দার ভাইকে খুঁজলাম। শরিফুল বললো, এখন তো তাকে বাড়ি পাবেন না। তিনি প্রফেসার মানুষ আবার রাজনীতিও করেন। বললাম, তাহলে বৌটা দেখে যাই! ঘরের ভেতর মুখ ঢোকাতেই যাকে নজরে পড়লো। দেখলাম, তাকে দ্বিতীয়বার দেখার মতো কিছু নেই। এতে অন্তরে শান্তি নয় শুধু, মহাপ্রশান্তিই বোধ হলো। মনকে বললাম, বৌ যেমনই হোক, তোর কি তাতে? নাকি পুরনো নেশা এখনো চোখে কুয়াশার মতো রয়ে গেছে! আসছিস তো তার ছোটটাকে দেখতে!
আকতারদের বাড়িতে ঢুকেই দেখলাম খুব হ্যান্ডসাম একজন যুবক উঠোনে দাঁড়ানো। পাশেই বেশ বড়সড় একখানা মোটর সাইকেল। এতে তার সৌন্দর্য যেন আমার চোখের ভেতর বিজ্ঞাপনের মডেলের মতো আরো বেড়ে গেলো। জিজ্ঞেস করে জানলাম, ওটা রিয়াজুল। আকতারের ছোভাই। বেলা তখন ডুবে গেছে। বাড়ির একপাশে একবোঝা থালাবাসন নিয়ে দেখলাম বয়স্ক একজন মহিলা ছাই দিয়ে মাজামাজি করছে। কিন্তু হাত চলতে চাইছে না তার। দেখলাম, হাত থেকে থালাবাসন পড়ে পড়ে যাচ্ছে! ওটা সেই পাগলি তা ভাবার কারণ ছিলো না। কারণ এতদিনে পাগলির বেঁচে থাকার কথা নয়। আমি অনুমান করে বললাম, উনি খালাম্মা না?
রিয়াজুল বললো, হ্যাঁ!
আমি ছুটে সালাম করতে গিয়ে তার হাত-পা গতিক মতো পেলাম না। বরং বুকের থেকে হাঁপানির শোঁ শোঁ শব্দ শুনে আমি রিয়াজুলকে বললাম, একি করছো? বেশ শীত পড়ে গেছে। ওনাকে ওঠাও!
রিয়াজুল বললো, আপা, আমার বৌ এগুলো পারবে না। তারও শরীর ভালো নেই!
রিয়াজুলের বউকে ডেকে দেখার রুচি আর আমার থাকলো না! আমি তবু বললাম, আকতার কই? শরিফুল আর রিয়াজুল একসাথে বললো, সে আমাদের সবার থেকে ভালো আছে। এই বাড়ি আমাদেরকে ছেড়ে দিয়ে সে নতুন আরেকটা বাড়ি করেছে। আমি রিয়াজুলকে বললাম, বান্দরটা করে কি?
রিয়াজুল বললো, তারা হাজবেন্ড-ওয়াইফ দু’জনই ডাক্তার।
বললাম, আকতারকে ফোন করো!
রিং বাজতেই ফোনটি রিয়াজুল আমার হাতে দিয়ে দিলো। আমি বললাম, তুমি একজনকে তীর মেরেছিলে, মনে আছে?
আকতার বললো, মনে নেই আবার! খুব আছে। কিন্তু নামটা ভুলে গেছি।
বললাম, তীর মারার দোষটা এতদিনে ক্ষমা করতে পারলেও নামটা ভুলে যাওয়ার দোষ ক্ষমা করতে পারলাম না!
ওপাশ থেকে ভেসে আসছে, ‘কিন্তু এখন আমি কার সাথে কথা বলছি, যাকে তীর মারছিলাম তার সাথে, নাকি তার মায়ের সাথে?’
মেজাজটা খারাপ ভীষণ হয়ে গেলো আমার। মনে মনে ভাবলাম, এই নাম আর কারো আছে নাকি ব্যাটা, যে তুই আমাকে ভুলে যাবি? আমি রিয়াজুলকে ফোনটা ফিরিয়ে দিয়ে শরিফুলকে বললাম, চলো, আমাকে ওয়েস্টিন হোটেলে যেতে একটি রিকশা ঠিক করে দাও!
কতক্ষণ একসাথে ঘুরে, এক পাটিতে বসে ভাত খেয়ে শরিফুলকে মনে হচ্ছিলো একেবারে নিজের ভাইয়ের মতো। ওই পরিবারের সবাইকে সেদিনের পর থেকে মনে হচ্ছিলো আমাদের নিজের কেউ। পারলে ওদের মনোবেদনা থেকে একবোঝা বেদনা তুলে এনে ওদের ভার কিছুটা হলেও লাঘব করে দিয়ে আসি। আমি ওদেরকে খুব আন্তরিকভাবে ঠিকানা দিয়ে আসছিলাম, যারা ঢাকাতে থাকে, তারা অন্তত যেন আমার বাসায় যাওয়া আসা করে!
আকতারদের বিধ্বস্ত মাকে যখন দেখলাম, একগাদা থালাবাসন নিয়ে ভরা সন্ধ্যায় ঝামা আর ছাই নিয়ে ঘষাঘষি করছেন, আর কারো তাতে ভ্রæক্ষেপ নেই, সেই দৃশ্য মনে পড়লে আমার আজো বুক ভার হয়ে ওঠে। মনে হয়, উনি অনন্তকাল ওভাবেই বিপর্যস্ত হয়ে ক‚লহীন অবস্থায় বসে আছেন শীতের অন্ধকারে মশার কামড় খেতে খেতে। যেখান থেকে তার কোনো উত্তরণের আশা নেই! কারণ তার সুস্থ-সবল ছেলে-মেয়ে-বৌয়েরা তাকে একাজ থেকে তরিয়ে নেবে, আসলে সে সাধ্য তাদের তিনিই প্রতিহত করেছেন পাগলির গায়ে হাত তুলে। তাকে খেতে না দিয়ে। তাকে প্রাপ্য সম্মান না দিয়ে। তাই মা ও সন্তান তাদের দু’পক্ষেরই এই অধম পরিণতি অনিবার্য! আর এই সবকিছু জুড়েই পাগলি প্রচ্ছন্ন রয়ে গেছে তাদের সবকিছুতে।
আকতারের মা পাগলিকে চেলাকাঠ দিয়ে পিটাতো তো পিটাতোই, পোড়া কটা ভাত ছিটিয়ে দিতো, এ আমার নিজের চোখে দেখা। ক’দিন পরপর এক বিড়া করে পান পাগলি ধুয়ে নিতো, সেই পাগলি দুটো পান সরিয়ে না রেখে এর-ওর কাছ থেকে একটু পানের কোনাকানা চেয়ে খেতো। অথচ, পাগলি কারো কাছেই একটু বদনাম করেনি পরিবারের কারোর। একটু অযতœ করেনি কিছুর। জান দিয়ে তাকে স-ব আগলে রাখতে দেখেছি। আসলেই এটা সুস্থ মাথার মানুষের কাজ নয়!
সে রাতে মেয়ে বললো, কাল আমাদের কর্মসূচি গোপালগঞ্জ। তুমিও চলো। তোমার বাপের বাড়ির থেকে বেড়িয়ে এসো। তাই হলো, খুব ভোরে রওনা দিয়ে মেয়ের সাথে গেলাম। রাতে নতুন বাড়ি ঘোষেরচরে থাকলাম। আগেই দাওয়াত দিয়েছিলেন সৈয়দ মিজান চাচা। গোপালগঞ্জ থেকে সরাসরি খুলনা ইউনিভার্সিটির ভেতর তার বাসায় যেতে হলো। আকাশ ছিলো থমথমে। কৃষ্ণপক্ষ চলছিলো। তাই খাওয়া ছাড়া ওখানে দেখার কিছু ছিলো না! গোপালগঞ্জ থেকে সরাসরি মিজান চাচার বাসায় ঢুকেছিলাম। বেশ রাত হয়েছিলো। কিন্তু আগেই যেহেতু দাওয়াত কবুল করা ছিলো, না গিয়ে উপায় ছিলো না। বারবার চাচাকে বলছিলাম, চাচা, দিনের বেলা এলে, খাওয়ার চেয়ে খুলনা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসটা ঘুরে দেখাই বড় লাভ ছিলো।
আমার থেকে বয়সে বেশ ছোট সুন্দরী চাচী খুব সুস্বাদু করে অনেক রকম তাজা মাছ রান্না করেছিলেন। এ লেখা সেই তখন হলে চাচীর সেই রান্নাই সাহিত্যের উপাদানে কতরকম বাগাড় দেয়া যেতো!
আর প্রথম প্রেমের ব্যর্থ এমন গল্পে খুলনা ইউনিভার্সিটির রেজিষ্ট্রার এই সৈয়দ মিজানুর রহমান চাচাই কিছুটা রসদে রক্ষে করে রেখেছেন অন্তত।
হোসনেয়ারা
দীলতাজ রহমান
হোসনেয়ারা বেগমের এক বান্ধবী সেতারা বেগম একদিন তার চলমান গাড়ি থেকে হোসনেয়ারা বেগমকে বললেন, আমি একটা কাজে উত্তরা এসেছিলাম। এখন ফিরে যাচ্ছি। আজ দিনভর আমার আর কোনো কাজ নেই। তোমার আজ সময় থাকলে বলো, আমি গাড়ি ঘুরিয়ে তোমার বাসায় আসতে পারি।
হোসনেয়ারা বেগম উদগ্রীব হয়ে বললেন, ‘এসো! এসো! ঠিকানাটা আমি মেসেঞ্জারে লিখে দিচ্ছি!’ বলেই ফোন রেখে দিলেন।
হোসনেয়ারা বেগমের বাড়ি দক্ষিণখানের কোথাও। রাস্তার জ্যাম ঠেলে ঠিকানা খুঁজে খুঁজে সেতারা বেগম যখন পৌঁছুলেন, হোসনেয়ারা বেগম দরজা খুলতে খুলতে বলতে লাগলেন, তুমি যখন ফোন করেছো, তখন আমি অফিসে। তোমার আসার কথা শুনে আমি হাতের কাজ ফেলে ছুটি নিয়ে ছুটতে ছুটতে চলে এসেছি। তারপর ঊর্দ্ধশ^াসে রান্না শেষ করে বসে আছি, তোমার খোঁজ নেই।
সেতারা বললেন, রাস্তায় জ্যাম প্রচÐ। তাই বলে এতো সময় লাগবে তা ভাবিনি! কিন্তু যতো কষ্টই হোক, এসেই তোমার বাড়ির সামনে দীঘির মতো বিরাট পুকুরটি দেখে আশ্চর্য হয়েছি। কারণ গ্রামেই সমস্ত পুকুরসহ সমস্ত খানাখন্দ মানুষ বন্ধ করে বাড়িঘর তুলছে। সেখানে…। ’
হোসনেয়ারা বললেন, এই জন্যই তো এতো ভেতরে এসে বাড়ি করলাম। যেনো এই নান্দনিকতাটুকু জীবন যাপনের সাথে জাপটে থাকে! জীবনে নান্দনিকতা উপভোগের বাসনা ছাড়া আমরা দু’জনের কেউ প্রতিপত্তির লোভ করিনি!
সেতারা বেগম বললেন, তাই তো দেখছি!
: উত্তরা বা অন্য কোনো অভিজাত এলাকায় বাড়ি করলে তো নিজের ফ্ল্যাটখানা ছাড়া বাইরের আকাশও অন্যবাড়ির চ‚ড়া দখল করে রাখে।
পঞ্চাশ অতিক্রান্ত হোসনেয়ারা এবং সেতারা কথা বলতে বলতে সেখানে এসে হাজির হলেন, হোসনেয়ারার স্বামী এম নূরুল আমিন। দরজার কাছেই প্রথম দেখা হওয়া স্ত্রী’র বান্ধবীর সাথে একপ্রস্থ আলাপ শেষ হলে নূরুল আমিন সাহেব স্ত্রী’কে বললেন, এখানে দাঁড়িয়েই আলাপ শেষ করবে, নাকি যা রান্নাবান্না করেছো, মেহমানকে খেতেও দেবে!
হোসনেয়ারা সেতারার সামনে ডাইনিং টেবিলে একেক পদ এনে রাখছেন, আর বলছেন, দেখো গরুর মাংস রান্না করেছি। ইলিশ মাছ ভাজছি এবং মোরগের রোস্ট করেছি। আর এই যে বেগুন ভাজি…।’ সেতারা বললেন, তার মানে আমার কত দেরি হয়েছে আসতে, যে তুমি তোমার অফিস থেকেও এসেছো। আবার এতকিছু রান্নাও করেছো?
: যখন ফোন করেছো, তখন বেলা বারোটার মতো ছিলো। আর এখন গড়ানো বিকেল। রান্নাবান্না করে পথের দিকে তাকাতে তাকাতে চোখ অন্ধ হওয়ার দশা!
: আবার পথের দিকে তাকিয়ে চোখ অন্ধ করারও সময় পেয়েছো?
: আমি রান্না করতে ভালবাসি না। শুধু তুমি আসতে চেয়েছো, তাতেই আমার আনন্দ উথলে উঠেছে। তুমি ফেসবুকে কী সব লেখো, আগে মনে হতো, আহা যদি এই মানুষটিকে কখনো চোখে দেখতে পারতাম! তার পরে দেখলাম, একদিন তুমি আমাকে নিজেই ফ্রেÐ রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছো!
: আসলে আমি নিজে তো আর সে অর্থে লিখি না। তাই যারা লেখেন, তাদেরকে আমার ভিন্ন গ্রহের মানুষ মনে হয়। আমি বাস্তব-জীবনেও খুঁেজ খুঁজে লেখক বের করে বন্ধুত্ব করি! তবে আজ তোমার এখানে আসা আমার দ্বিগুণ সার্থক হয়েছে। তোমার বাড়ির সামনে ওই পুকুর আর বিস্তৃত ফাঁকা জায়গা দেখতে পেয়ে। পুকুরের পাশেই আবার বিরাট স্কুল। ঠাসাঠসি বাড়িঘর দেখতে দেখতে, ফাঁকা জায়গা আমার কাছে তাজমহলের থেকেও আকর্ষণীয় মনে হয়।
নূরুল আমিন সাহেব বললেন, তাহলে পিছনের হাওড় দেখে সেতারা আপা কী বলবেন কে জানে!
হোসনেয়ারা বেগম বললেন, পুকুর দেখে যদি তোমার এতই ভালো লেগে থাকে, তাহলে এক পুর্ণিমা রাতে এসে আমার এখানে থাকো। প্লিজ…। স্ত্রী’র কথায় সায় দিলেন নূরুল আমীন সাহেবও। তিনি পল্লী বিদ্যুতের জিএম ছিলেন। মাত্রই অবসরে এলেন। হোসনেয়ারা বেগম এবং এম নূরুল আমীন দম্পতির তিন কন্যা। বড় কন্যা শাচ্চী ও মেজো কন্যা শাওনের বিয়ে হয়ে গেছে। জামাই দু’জনই সেনা অফিসার। ছোট মেয়েটি’র নাম সপ্তর্ষি। সে কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। সেতারা বেগম বুঝতে পারলেন, ছোট মেয়ের নামেই এই বাড়ির নাম ‘সপ্তর্ষি’!
কন্যা সপ্তর্ষি তার রুমে ছিলো। সেতারা বেগম দূর থেকে ইশারায় তাকে দেখিয়ে হোসনেয়ারা বেগমকে বলেছিলেন, এখন এই মেয়েই তোমাদের দু’জনের প্রাণের আরাম। নাহলে দু’জনের জীবনই এখন পোড়া মাটির মতো খরখরে ঠেকতো! মনে হতো সব দায়-দায়িত্ব শেষ, আর বেঁেচে থাকার দরকার কি? এখন শেষ যাত্রার অপেক্ষা চলতো। ওই মেয়েই এখন তোমাদের মুখর করে রেখেছে। তা তোমরা ওকে পরিকল্পনা করেই দুনিয়াতে আনো, বা অপরিকল্পিতই হোক। সেতারা বেগমের কথায় হোসনেয়ারা বেগম ও নূরুল আমীন সাহেব হেসে ফেললেন। যে হাসিতে সব প্রশ্ন ঢেকে থাকে।
সেতারা বেগম বলতে লাগলেন, আমাদের দেশে অনেককে তিন নম্বর সন্তানের সামনেই বলতে শুনেছি, ‘দুর্ঘটনার ফসল’। চাইনি তবু হয়ে গেছে। কিন্তু উন্নত দেশগুলো ঘুরে জেনেছি, একই বিষয় তারা অন্যভাবে প্রকাশ করছে। তাদেরকে যদি বলো, ছোটটার বয়স অন্যগুলোর থেকে এতো তফাৎ…। তারা বিষয়টি বুঝে বলবে, চাইনি, কিন্তু গড গিফট দিয়েছেন!’ দুটি বিষয় পাশাপাশি কল্পনা করে দেখো। আমরা যা উত্তর দিচ্ছি তাতে আমাদের অনাকাক্সিক্ষত সন্তানটির মনটা ছোট হচ্ছে। আর একই বিষয়ে ওরা যা উত্তর দিচ্ছে, তাতে ওদের বাচ্চাটির মন বড় হচ্ছে, সে তার মা-বাবার প্রতি ঈশ^রের গিফট হয়ে এসেছে, ভেবে।
হোসনেয়ারা বেগম বললেন, ভালো বিষয় শিখিয়ে দিলে বন্ধু। ছোট মেয়েকে নিয়ে মানুষের প্রশ্নে সত্যি আমরাও একটানা বিব্রত বোধ করছি উত্তর দিতে। এখন ও বড় হয়ে গেছে বলে প্রশটাœও উহ্য হয়ে উঠেছে।
সেদিন হোসনেয়ারার বাসা থেকে সেতারা বেগম যখন বেরিয়ে গেলেন, তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। তবে তাকে কথা দিয়ে আসতে হলো, এই যে ক’দিন পর সামনে যে পূর্ণিমা আসছে, তখন তিনি সন্ধ্যার আগেই হোসনেয়ারার বাসায় এসে পৌঁছাবেন। আকাশে পূর্ণিমার ডগডগে চাঁদ উঠবে, আর সেদিন তারা দুই বান্ধবী পুকুরমুখো ঝুলবারান্দায় বসে পুকুরের টলটলে জলের ভেতর মনের মাধুরী মিশিয়ে সে বিম্ব যেমন দেখবেন, তেমনি দেখবেন আকাশের আসল চাঁদকেও!
পূর্ণিমার বাকি যে ক’দিন ছিলো, হোসনেয়ারা সেতারাকে তা ফোনে প্রায় প্রতিদিন মনে করিয়ে দিতেন। বলতেন, দেখো সেতারা, তুমি কিন্তু সেদিন হাতে কোনো কাজ রেখো না। কোনো অজুহাতে যেন মিস করো না। আমি কিন্তু খুব আশা করে আছি।
সেতারা বলেন, না রে ভুলবো না। আমারও তোমার বাড়িটা যেমন ভালো লেগেছে, তেমনি তোমার বরকেও! তুমি খেতে দেয়ার আগে তোমার বর আমার জন্য সোকেস থেকে নতুন প্লেট-গøাস-বাটি বের করে তোমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘সেতারা আপাকে এগুলোতে খেতে দাও।’ দেখো, এই বিয়ষটা কিন্তু আমার মনে লেগে আছে এবং তোমাদের সম্পর্কের যে রসায়ন দেখলাম, তোমাদের পাশে যারা থাকবে, তাদেরই চিত্ত ও চক্ষুকে তা আরাম দেবে!
হোসনেয়ারা বেগম বললেন, আহারে তুমি কেমন মনে রেখেছো! তুমি এসো, নূরুল আমীন সাহেবও তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন। উনি বলছেন, সেতারা আপা কিছুক্ষণের জন্য এসে বাড়িটাকে মাতিয়ে তুলছিলেন।
হোসনেয়ারা বেগম একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্ত্রী। সেতারা তার বাসায় গেলে সারাঘর খুঁজে হোসনেয়ারা ফেসবুকে পরিচিত হওয়া, তার প্রথম দেখা বন্ধু সেতারা বেগমকে তার চারখানা বইয়ের সবই দিলেন। ‘বিজন পথের বাঁকে’, ‘জলের যৌবন’, ‘জল ও জ্যোৎ¯œার প্রেম’ এবং ‘প্রমিত প্রণয়’। সেতারা বেগম নিজে কবিতা অতো বোঝেন না। তবে কবিতার ভেতর থেকে যেনো একেকটি গল্প তিনি টেনে বের করে ব্যক্তি মানুষটাকে বোঝার চেষ্টা করেন। তাও আর কতটুকু পারেন! তবে বোঝেন, হোসনেয়ারার কবিতা তার মতোই সহজ-সরল। আপন আনন্দে লেখা। সেতারা মনে মনে ভাবেন, এও কমকি! ‘… তোমার যা আছে তা তোমার আছে/ তুমি নও গো ঋণী কারো কাছে/ তোমার অন্তরে যে শক্তি আছে/ তারি আদেশ পেয়েছ \ ও জোনাকী কি সুখে ওই ডানা দু’টি মেলেছ/ আঁধার সাঁঝে বনের মাঝে উল্লাসে প্রাণ ঢেলেছ…।’ সেতারার মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের এই জোনাকীর ভীড়ে কবি হোসনেয়ারা বেগমও আছেন!
হোসনেয়ারা বেগম যখনই সেতারা বেগমকে ফোন করেন, আসন্ন পূর্ণিমাতে সেতারার যাওয়ার বিষয়টা প্রতিবার ঝালিয়ে মজবুত করতে সেই পুরনো কথাটাই বলেন, ‘আমি কিন্তু খুব আশা করে আছি, তুমি আসবে, আমরা দুই বান্ধবী সারারাত জেগে গল্প করবো সেদিন।’
হোসনেয়ারার বাড়ির সামনের ওই পুকুরপাড় দিয়ে হেঁটে গিয়ে সন্ধ্যা থেকে সারারাত জেগে দোতলার ঝুলবারান্দায় বসে আকাশ ও পাতালে একসাথে সোনার থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদটি দুইভাবে দেখতে পাওয়া সেতারার জন্যও খুবই আনন্দের বিষয় হবে। তবে সেতারা কিছুটা ভয়ও পাচ্ছিলেন, না জানি সত্যিই সেদিন তার নিজের কোনো জরুরি কাজ এসে হামলে পড়ে। তাই পূর্ণিমা যেদিন এসেই গেলো, সেদিন সকাল সকাল বনানী ব্যাংকে তার-
এমনি একটা কাজ পড়ে গেলো। সেতারা সুযোগটা কাজে লাগিয়ে একসাথে বেরিয়ে পড়লেন। একরাত থাকতে হলে দু’দিনের জন্য যা নিতে হয়, তার সব নিয়ে বের হলেন।
বাড়িটি আগেই চেনা থাকায় আজ আর আসতে অতোটা দেরি হলো না। সেদিন হোসনেয়ারার বাড়ি থেকে বেরিয়ে ড্রাইভারকে দেখাতে দেখাতে নিয়েছিলেন সেতারা বেগম। বলেছিলেন, ওই দেখো, সামনের দিকে কর্ণারে মাইলস্টোন স্কুল। ওটা নাকি মৌশাইর শাখা।
বনানী ব্যাংকের কাজ সেরে দুপুরের আগেই দক্ষিণখানের ‘সপ্তর্ষি’তে পৌঁছে সেতারা ড্রাইভারকে বললেন, কাল সকালে এসে আমাকে নিয়ে যেও। তবে ফোন দেয়ার পর রওনা হইও।
হোসনেয়ারা বেগম রান্নাবান্না করতে পছন্দ না করলেও নিশ্চয় বাড়িঘর গোছাতে, বাগান করতে পছন্দ করেন। নাহলে বাড়ির প্রতি ইঞ্চি জায়গা অতো পরিষ্কার, অতো নিপুণভাবে সাজানো থাকে কি করে! ছাদের বাগানও ভীষণ নিকানো। কত ফলফুল সেখানে। বাড়ির সামনে পুকুর। পিছনে হাওড়ের মতো ফাঁকা। অবশ্য পুরোটাজুড়ে তখন আশি^নের হাঁটু পানি। সেখানে কেউ আগাম জমি পরিষ্কার করছে। কেউ মাছ ধরছে। সারাদিন দু’জনের এইসব দেখতে দেখতে কেটে গেলো। সেতারার সাথে পরিচয় করাতে বিকেলের আগে হোসনেয়ারা খবর দিয়ে আনলেন তার আরো দুই বান্ধবী পারমিতা ও জান্নাতকে। সেতারা বেগমের মনেই ছিলো না তিনি আসলে চাঁদ দেখতে এসেছেন। কিন্তু এতো আড্ডা-গল্প, এতোকিছু দেখাদেখির ভেতরও, হোসনেয়ারা চাঁদের জন্যই যেন ব্যাকুল হয়ে আছেন। তিনি পারলে তখনি ডেকে আনা মেহমান বিদায় করে হলেও পর্দা টেনে সন্ধ্যা নামান প্রিয় বান্ধবী সেতারাকে নিয়ে মগ্ন হয়ে চাঁদ দেখতে। আর তার সাথে আপন অন্তরীক্ষ হতে শক্তি এনে স্ত্রী’কে সঞ্চারিত করছেন, নূরুল আমীন সাহেবও! যেন তারা জোড়া শালিকের মতো এমনি এমনি একইরকম দু’জন দু’জনের পায়ে ঘুরঘুর করছেন!
সেতারাকে নিয়ে হোসনেয়ারা বারান্দায় বসে আছেন যখন থেকে, তখনো সন্ধ্যা নামেনি। তবু আগে থেকে হোসনেয়ারা সেতারাকে নিয়ে সাজানো বাগানের ঠাসাঠাসি গাছ, লতাপাতার ভেতর জায়গা করে বেতের মিনি সোফায় হাত-পা ছড়িয়ে বসেছেন। যেন প্রয়োজনে এখানে রাত পার করা যায়, চাঁদের মোহ যদি তাদের টেনেই রাখে! কিন্তু সন্ধ্যা পার হয়ে যাচ্ছে পুকুরে চাঁদ দেখা যাচ্ছে না! হোসনেয়ারা আকাশে খুঁজছেন, সেখানেও নেই! তিনি ছাদে গেলেন আজ তবে চাঁদ কোন্দিকে উঠলো, তাই দেখতে! না কোনোদিকেই নেই! সবদিকে আজ সমান অন্ধকার!
হোসনেয়ারা ফিরে এলে সেতারা একটু মজা করে বান্ধবীকে বললেন, রান্নাঘর থেকে ডালঘুটনিটা নিয়ে একটু হাওড়ের জলটা ঘোটা দিয়ে দেখে এসো!
তটস্ত হোসনেয়ারা বললেন, কেন?
সেতারা বললেন, আধুলির মতো না আবার চাঁদ সেখানে খসে পড়ে কাদায় তলিয়ে আছে!
স্ত্রী’র আহাজারি শুনে শুনে নূরুল আমিন এগিয়ে এলেন। বললেন, দেখছো না সন্ধ্যার ঠিক আগে থেকে হঠাৎ আকাশে মেঘ জমেছে? চাঁদ আজ মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে। হয়তো রাতে মেঘ কাটবে। মাঝরাতের বৃষ্টিভেজা জোছনা, তার সৌন্দর্যও কম নয়! তখন না হয় দুই বান্ধবীকে আমি জাগিয়ে দেয়ার জন্য নিজে জেগে থাকবো!
হোসনেয়ারা বললেন, হায় হায়, বলো কি? আমি সেতারাকে কত সাধ করে ডেকে আনলাম সন্ধ্যা থেকে …!’
আমিন সাহেব বললেন, তুমি এতো অধীর হয়ে আছো, যে মেঘ বিকেল থেকে মাথার ওপর ভেড়ার পালের মতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তা তোমার নজরে আসছে না। তা তোমাদের সব সাধ কী ওই এক চাঁদেই জমা রয়ে গেছে? দিনভর এক বিছানায় দু’জনের এতো গড়াগড়ি, আরো দু’জন ডেকে এনে চারজনের এতো হৈহৈ গল্প, সবাই মিলে ছাদে গিয়ে চা খাওয়া, ছবি তোলা, ফেসবুকে পোস্ট দেয়া, বড় চোখে মিনি হাওড় দেখা, খোলা প্রান্তরে বিকেলের গড়ানো রোদ দেখা এসবে আবেগের কিছুই তোমার খরচ হয়নি?’
সেতারা বেগম বললেন, ঠিক বলেছেন ভাই। আমার আর চাঁদ দেখার অতো সাধ নেই। চাঁদ না ওঠাতে হোসনেয়ার যে আক্ষেপ দেখলাম, আমার মনে হয়, জীবনে কিছু অভিযান ব্যর্থ হওয়ার দরকার আছে। কারণ বিফল মনোরথই নিজের মতো একটা পথের ছবি আঁকতে পারে, আঁকা সে পথে সে চলতে না পারলেও। আর পায়ে হেঁটেই কেন চলতে হবে! মনকেও তো তার মতো ছেড়ে দিয়ে কখনো খেলা দেখতে হয়!
আমিন সাহেব বললেন, ঠিকই বলেছেন আপা, সাপ ছেড়ে দিয়ে খেলা দেখার কথা তো আমাদের পূর্ব পুরুষরাও তাদের পূর্ব পুরুষের কাছ থেকে শুনে আসছেন! আর উপমিত সাপটি তো মানুষের মনই। তাই এখন না হয় মেঘে ঢাকা চাঁদের বিহরলাবণ্যে আমরা সার্থকভাবে আধুনিক কিছু করি! যেমন একালের কোন লেখকের কোন বই কে কোনটা পড়েছি এবং তা কেমন লাগলো তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আমিন সাহেব এবার স্ত্রী’র কপালে দৃষ্টি বল্লমের মতো তাক করে বললেন, খালি লিখলেই তো হবে না! তোমার সময়ে কে কী লিখছেন তাও তোমাকে জানতে হবে। কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-শরৎচন্দ্র-বঙ্কিমের নাম পেড়ে না এনে। তোমাদের সাথে এই আলাপের জন্য আমি প্রস্তুত! তার আগে চুলোয় চায়ের পানি আমি নিজেই চাপিয়ে আসি!
বাড়িটি খুবই নান্দনিকভাবে সাজানো। তিনতলা বাড়িটির নিচতলা ভাড়া দেয়া। আর দোতলা, তিনতলা মিলে আপাতত ওদের তিনটি প্রাণীর বসবাস। ওপরের ফ্লোরটা সাজানো-গোছানো পড়ে থাকে। জামাইসহ মেয়েরা এলে তিনতলা ব্যবহার হয়। দোতলার একরুমে ওদের ছোট মেয়ে থাকে। আরেক রুমে ওরা দু’জন। আর দুটি রুম ফাঁকা। নূরুল আমিন সাহেবের সাথে বইপড়া নিয়ে আড্ডা শেষে সেতারা ওদের দুজনের থাকবার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন। কারণ প্রথমদিন তাকে এই রুমেই এনে বসিয়েছিলেন হোসনেয়ারা। আজো দুপুরে খাওয়ার পরে এ ঘরেই দু’জন গড়িয়ে গল্প করেছেন। তাই পুরো বাড়িতে এই রুমটিই সেতারার বেশি চেনা। এ রুমটিই রাতে থাকার জন্য তাকে টানছে।
সেতারা শোয়ার পর হোসনেয়ারা তার পাশে খাটের কোনায় এসে বসলেন। হোসনেয়ারাকে জানার পর থেকে তাকে যতোটা নির্ভার-ফুরফুরে মেজাজের মনে হয়েছিলো সেতারার, এখন সেতারার তেমনটি মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, ওর ভেতর এখনো অনেক ভার আছে। আর আজ তাকে চাঁদের অপ্রত্যাশিত প্রত্যাখ্যান তিনি যেন কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারছেন না। তাই পিছনের দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে সব রেখে ভেতরের বিষটুকু বহুগুণ করে উগরে দিচ্ছিলেন। যেন খানিকটা এরকম, চাঁদ ফিরে এলে গÐুষ বেয়েপড়া বিষের দাগটা যেনো তার নজর না এড়ায়।
হোসনেয়ারা কথা বলতে বলতে বললেন, জানো, আমার ছোট মেয়েটা বড় দুটোর থেকে বেশ ছোট। বড় দুটো একেবারে পিঠাপিঠি। একসাথে বড়ও হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু মনের মতো সম্বন্ধ আসছিলো না। তাই বিয়ে দিতে দেরি দেখে, অনেকে বলেই ফেলতো, মেয়েমানুষ হচ্ছে কাঁচা তরকারির মতো। তরকারি যেমন প্রথমবেলা না বেচতে পারলে দাম থাকে না। তেমনি মেয়েমানুষও।
কিছুদিনের ভেতরই পরপর আমার দুটো মেয়েরই ভালো বিয়ে হয়েছে। দু’জনেরই আর্মি অফিসারের সাথে বিয়ে হয়েছে। কিন্তু মানুষের ওই কথাটা আমার মনে ভিমরুলের কামড়ের মতো লেগে আছে!
সেতারা বেগম বললেন, এগুলো মনে রাখতে হয়? যাদের কাছে মেয়েমানুষ কাঁচা তরকারির মতো, তুমি কি সেই শ্রেণিতে? তুমি নিজে এমএ পাশ করেছো। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে উঁচু পদে চাকরি করছো। সাধারণ, পিছিয়ে থাকা মানুষের কথায় তোমার মন খারাপ হলে তো আমি বলবো, আসল শিক্ষাটা তোমার হয়নি! তুমি কি জানো পুরুষের থেকে নারীর সব শক্তিই বেশি?
হোসনেয়ারা বললেন, আমি ওইরকমই। একটুতে ভীষণ কষ্ট পাই। কিন্তু কাউকে তা বলিও না!
সেতারা বললেন, আবার যদি কেউ বলে এমন কথা, বলে দিও, তোমাদের মেয়ে কাঁচা তরকারি। আমাদের মেয়েরা চালতার মতো। কারণ তাদেরকে মেরুদÐ সোজা ও শক্ত করে তৈরি করা হয়েছে!
হোসনেয়ারা আবার বললেন, আমার আরো একটা কষ্ট আছে। তাও কাউকে বলি না!
: কি?
: এখনো কাউকে কোনোদিন তা বলিনি! অথচ, সে কষ্টটাও আমাকে কোনোদিন সুখি হতে দেয়নি!
: তোমাকে দেখার আগে তো তোমার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছিলো না। কিন্তু দুইদিন দেখার পর থেকে আমার মনে হচ্ছে, তোমার মতো, মানে একঘরে থাকা তোমাদের দু’জনের মতো সুখি মানুষ খুব দুর্লভ। কারণ তোমরা দু’জনই একেবারে নির্লোভ-নির্ভার দু’জন মানুষ। নাহলে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই চাকরি করা দু’জন মানুষ এইখানে এসে বাড়ি করে? পিছনে হাওড়। সামনে পুকুর। রাস্তা স্যাঁতসেতে। অবশ্য এর জন্য তোমাদের দুজনের প্রতিই আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গেছে। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য ওই সম্মানটুকুই দরকার। প্রয়োজনের বেশি সম্পত্তি আমার কাছে গাধার পিঠে চিনি বয়ে বেড়ানোর মতো মনে হয়। মানে বোঝা বইছে ঠিকই, কিন্তু চিনির স্বাদ সে নিতে পারছে না! মানুষও তাই করলে তাহলে সে গাধা না তো কি! বলো তো কী হবে দামি জায়গায় বাড়ি করে মানুষের মনের চোখে যদি অসম্মানীত হয়ে থাকতে হয়!
: তুমি তো আমার আরেকটা কষ্টের কথা জানতেই চাইলে না!
: কষ্টকে প্রশ্রয় দিতে নেই। কষ্টের কথা কাউকে বলা মানে, সে কষ্টের গোড়ায় পানি ঢেলে তাকে আবার সজীব করে তোলা। আর কাউকেই না বলতে বলতে দেখবে তুমি নিজেই বিষয়টি ভুলে গেছো!
: না, এতদিনে যখন ভুলি নাই, এটা আর ভুলবো না!
: আচ্ছা, ঠিকাছে বলো!
: আমিন সাহেকে তো তুমি দেখলেই। ওর সাথে আমার বিয়ে হয়েছে গার্জিয়ানদের ইচ্ছেয়। তবু তাকে পেয়ে মনে হয়েছিলো, আমি ঠিক এই মানুষটাকেই জীবনসঙ্গী হিসাবে চেয়েছিলাম। বিশ^াস করো, আমার জীবনে কোনো অপূর্ণতা ছিলো না।
: বলো কি? কোন ফাঁক গলিয়ে আবার তোমার সর্বনাশা অপূর্ণতা এসে ঢুকলো তবে? তাও আবার আমিন সাহেবের মতো মানুষটিকে নিয়ে। তোমাদের দু’জনকে একসাথে দেখার পর থেকেই মনে হচ্ছে তোমাদের একজনের জন্যই আল্লাহ আরেকজনকে বানিয়েছেন!
: আমি তোমাকে বলি কি? বিয়ের পর থেকে অনেকদিন পর্যন্ত আমারও তাই মনে হয়েছিলো!
সেতারা বেগম একথা ওকথা দিয়ে আমিন সাহেবকে নিয়ে হোসনেয়ারার দুঃখের প্রকাশটা ঠেকিয়ে রাখতে চান! কিন্তু সব কথাই একসময় ফুরোয়। এমন কি চাঁদটির অনিবার্য উদ্ভাসও যে সম্পূর্ণ ব্যাহত হলো, সে দুঃখটাও হোসনেয়ারা এখন বেমালুম ভুলে গেছেন আমিন সাহেবের দেয়া দুঃখের কথা মনে পড়ে।
একসময় হোসনেয়ারা বলতে থাকেন। তোমাকে তো বলেছি, জীবনে ওকে স্বামী হিসাবে পাওয়া আমার প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি পাওয়া। কারণ আত্মীয়-স্বজনের ভেতর দেখেছি তো, আমার থেকে তাদের মেয়েরা আরো বেশি সুন্দরী-শিক্ষিত। কিন্তু নূরুল আমিনের মতো জামাই কেউ পায়নি। উনি জীবনে অনেকগুলো চাকরি করছেন। একটা ছেড়েছেন আরেকটায় ঢুকেছেন। সব উচ্চপদে। সবদিক থেকে ওনার মতো আমাদের আর কারো জামাই নয়!
সেতারা এবারও প্রশ্ন করেন না, ‘দুঃখটা কী দিলেন উনি, তাই বলো!’ হোসনেয়ারা নিজেই পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে এসে টানা বলতে থাকেন, আমি যেমন ওকে পেয়ে ধন্য হয়ে গিয়েছিলাম। আবার উনিও আমাকে পেয়ে। হানিমুন করতে নেপাল গিয়েছিলাম আমরা।
কিন্তু তারপরও কতখানে বেড়াতে নিয়ে গেছে। ওই ঘটনার আগে প্রতিবারই মনে হতো নতুন করে হানিমুনে যাচ্ছি। সব অনুষ্ঠান, সব পার্টিতে ও নিজে আগ্রহ করে আমাকে নিয়ে যেতো। বন্ধুদেরকে দাওয়াত দিয়ে এনে আমাকে দেখাতো। আমাকে নিয়ে সে যে গৌরব বোধ করতো, এটা আমি বুঝতাম।
সেতারা এবার আর বলেন না, তাহলে দুঃখটা কি?
হোসনেয়ারা তার গল্পের ধারাবাহিকতায় এক সময় বলেই ফেললেন, একদিন নূরুল আমিনের অনেকগুলো বন্ধু একসাথে বাসায় এসেছেন। বাবুর্চি টি-পট ভর্তি করে চা দিয়ে আসছে। কিছুক্ষণের ভেতর আমিন সাহেব আমাকে ডাকলেন তাদের ভেতর। আমি সেখানে গিয়ে দেখি সবার হাতে হাতে গরম চা। ধোয়া উড়ছে। এর ভেতর নূরুল আমিন তার এক বন্ধুর কথার পিঠে একটু জোরেই বলে উঠলো, ‘আসলে আমার ওই সময় বিয়েটা করা ঠিক হয়নি! আমেরিকায় পিএইচপি করতে যাওয়ার সুযোগ যখন পেয়েছিলাম, যাওয়াই উচিত ছিলো!’ বিশ^াস করো, সেই আমার নিপাট সুখে চিড় ধরলো! অথচ এইটা নিয়ে আমি তাকে ওই সময় তো কিছু বলিইনি। কোনোদিনই তাকে কিছু বলিনি, যে তুমি এমন কথা কেন আমার সামনে এতোগুলো মানুষের কাছে বললে?’
সেতারা হোসনেয়ারার কথার পরে কী বলবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। তবে মনে মনে ভাবছিলেন, আমিন সাহেব জীবনে আর একটি দুঃখও না দিতে পারার জন্য, সেই সে জীবনের প্রথম দিকের মৃদু বেদনাটা এখনো হোসনেয়ারার বুকে সেতারের মতো ঝংকার তুলছে এবং সেতারা এও বুঝতে পারছেন, বেদনা ওই একখানাই! এরপর হোসনেয়ারাকে কিছু একটা বলতে হয়, তাই বললেন, ওই দুঃখেই কি তুমি কবিতা লেখো?
: ওই দুঃখে কি না জানি না। তবে দুঃখটা এসে যায়।
: শোনো দুঃখ কাউকে দুঃখি করে না। ধনী করে। মানে সমৃদ্ধ করে। তবে ভাগ্যিস উনি তোমাকে আর দুঃখ দেননি। তাহলে ওই চারুবেদনা পানসে হয়ে যেতো। আজকে যা হেম হয়ে গেছে, তা বেনোজলে যেতো ভেসে! যা তা দুঃখ দিয়ে তো আর কবিতা হয় না! তোমার ওই আকাশের চাঁদ ও পুকুরে চাঁদের বিম্ব, কিছুই মনে লাগতো না। সব শরতের মেঘের মতো চোখের ওপর দিয়ে জীবনের সব সৌন্দর্য নিয়ে ভেসে চলে যেতো বাদাড়ে।
: কিন্তু সেই থেকে ধীরে ধীরে না দেখা কারো জন্য আমার ভেতর একটা অপেক্ষা কাজ করে।
: তুমি কি সেই অপেক্ষাকে ভরাট করে তুলতে কবিতা লেখার কথা ভাবলে?
: প্রথম তো কিছু ভেবে লিখতে শুরু করিনি। তবে ওই যে দোয়াতের কালিতে কলম চুবিয়ে ছোটবেলায় যেমন লিখেছি, কবিতা লিখতে গেলে মনে হয়, ওই বেদনায় কবিতা লেখার কলম আপনা থেকে চুবে আসে! কিন্তু এতো ভাষা কোথায় পাবো তাকে কাজে লাগাতে। তারপর মনে হয় বেদনার কালি কলমের নিবেই শুকায়।
: আচ্ছা একটা সত্যি কথা বলো তাহলে, তোমার ওই ফাটল চুইয়ে, কখনো অন্য কারো প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করেনি?
: ইচ্ছে করেছে! ওই যে বলেছি, একটা অপেক্ষা আছে কারো জন্য…।
: তুমি চাকরি করা মানুষ। সর্বোচ্চ ডিগ্রিটি তোমার আছে…!
: সত্যি বলতে কি, বড় রাস্তার পাশে যার বাড়ি, সে আর গলির ভেতরের বাড়ি পছন্দ করবে না বসবাস করতে! যাদের সাথে আমার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করা যেতো, তারা কেউই নূরুল আমিনের থেকে বেশি নাম্বার পাওয়ার যোগ্য নয় আমার কাছে। পেলে বোধ হয়, টলে যেতাম!
সেতারার ঝিমুনি টের পেয়ে ঘুমাতে বলে হোসনেয়ারা চলে গেলেন পাশের রুমে স্বামীর কাছে। অপরিচিত বিছানায় একা শুয়ে মন্দ লাগছিলো না সেতারার। বাসায়ও তো তিনি একাই থাকেন। ছেলেমেয়েরা যে যার মতো নিজের নিজের ঘরে দরজা আটকে থাকে। সেতারার হাজবেন্ড নেই বহু বছর। বাকি রাতটুকু হোসনেয়ারার মনস্তত্ত¡ নিয়ে খেললেন সেতারা। ক্ষুদ্র একটু কাঁটার যন্ত্রণাও তো যন্ত্রণাই। তবে এমন অনেক কাঁটার ঘা যারা অহরহ খায়, তাদের বোধ আর সূ² থাকে না, এমন একটু সূ² বেদনা হীরের কৌটোয় রেখে পোষার মতো! তিনি নিজের বুকজুড়ে তন্নতন্ন করে খুঁজেও একটু বেদনা পেলেন না, যাকে সঙ্গী করে, হাওড়ের দিকের জানালার একটি কপাট অন্তত খুলে, পর্দা সরিয়ে জলের ওপর নামা জোছনার প্লাবন দেখে রাতের বাকি সময়টুকু নির্ঘুম কাটাতে পারতেন। কিন্তু পারলেন না।
পরদিন সকালে সেতারা বেগম তার ড্রাইভারকে কল দিলেন, হোসনেয়ারা ঘুম থেকে ওঠার আগেই। কারণ ড্রাইভারেরও তো এতটা পথ আসতে সময় লাগবে। সেতারার গাড়ি হোসনেয়ারার বাসায় পৌঁছলে সেতারা নাস্তা খেয়ে, ওদের দু’জনকে শুভ বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লেন। যতক্ষণ দেখা যায়, সেতারা ফিরে ফিরে দেখলেন, হোসনেয়ারা বেগম ও নূরুল আমিন সাহেব পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছেন তার গমন পথের দিকে।
তারা দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলে সেতারার সামনে চলে এলো দেলু নামের তেইশ-চব্বিশ বছরের একটি মেয়ে। তার আবার ছিলো তিন আর পাঁচ বয়সী দুটি মেয়ে। একসময় দেলু সেতারা বেগমের বাসায় ছুটা কাজ করতো। দেলুর মায়ের তিনটি মেয়ে ছিলো। দেলু ছিলো ছোট। তার বিয়ে হয়েছিলো যার সাথে, সে নারায়ণগঞ্জ একটি জুটমিলে কাজ করতো। লোকটির আগের স্ত্রী আছে। আছে আরো তিনটি ছেলেমেয়েও। তবু দেলু সেখানে খেয়েপরে ভালোই ছিলো। কিন্তু একবার দেলুকে তার মায়ের কাছে বেড়াতে পাঠিয়ে সে লোক তার খোঁজখবর নেয়া বন্ধ করে দিলো। দেলুর মা কয়েকটি বাসায় ছুটা কাজ করতো। বাপ ছিলো না দেলুর। ভাইও না। শেষে দেলু ধারেকাছে তিন বাসায় ছুটা কাজ নিলো। তার ভেতর সেতারা বেগমের বাসা একটি। তখন দেলুর থেকে সেতারা বেগমের বয়সও খুব বেশি ছিলো না। হয়তো তার থেকে বছর পাঁচেক কম হবে দেলুর বয়স। তবু দেলুর কথা তার হঠাৎ হঠাৎই মনে পড়ে যায়। মেয়ে দুটিকে গেটের ভেতরে এনে ছেড়ে দিয়ে দেলু নিজে একা বাড়িতে ঢুকতো। তারপর বাড়িময় ছুটে কাজ করতে করতে দেলুর স্বগোক্তিগুলো আজো সেতারার প্রাণে বড়শির মতো বিঁেধ আছে। দেলুকে মনে পড়লেই তিনি ভাবেন, আসলে সুখ-দুঃখ বিষয়টা যে ভীষণ আপেক্ষিক, সেটা সেই সংসারজীবনে ঢোকার কয়েক বছরের ভেতর দেলুই তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেছে।
দেলুর চেয়ে দেলুর মা-ই বেশি বাসায় কাজ করতো এবং সে অভিজাত এলাকায় বড়লোক দেখে কাজ ঠিক করতো। এর জন্য রিকশায় করে যাওয়া-আসা করতে হতো দেলুর মাকে। দেলুর মা সে সব বাসা থেকে প্রতিদিন কিছু না কিছু খাবার নিয়ে আসতো। দেলু তার মায়ের ছোট মেয়ে হওয়াতে কন্ঠে আহ্লাদ ঝরতো কথা বলতে। সে সারাক্ষণ নরম স¦রে নিজের দুর্ভাগ্য নিয়ে একাই আক্ষেপ করতো। সেতারা বেগম কেন যেন তাতে বিরক্ত হতে পারতেন না! কখনো ধমক দিয়ে বলেননি, যতক্ষণ আমার বাসায় কাজ করবি, মুখ বন্ধ করে কাজ করবি! বরং সেতারা বেগমের কাছে সুখ-দুঃখের সংজ্ঞাটা ক্রমাগত যেন পাল্টে যেতো দেলুর প্যাঁচালের সাথে সাথে। বাসায় ঢোকার পর থেকেই তার শুরু হতো নিজের সাথে নিজের কথা বলা। আর তা সেতারা বেগম যেচে শুনতে না গেলেও যেটুকু তার কানে আসতো, যেন বোধের ভেতর পরত পরত এক ভাঙাগড়ার কাজ চলতো।
দেলু ঘরে ঢোকার সাথে সাথেই শুরু হতো, থাউক, আমার খুঁজ নিলে নে, না নিলে না নে! কিন্তুক তর মাইয়া দুইডার খুঁজ তো নিবি! একবার চিন্তা করবি না, তারা কী খাইতেছে। কেমুন আছে। তরই তো বাচ্চা! আমার কি বাপ বাইচ্চা আছে, নাকি আমার একটা ভাই আছে। বুড়া মা, জান পিডাইয়া মাইনষের বাড়িরতন খাওন আনে। তার একলার খাওনে আরো তিনডা মানুষ ভাগ বসাই। আর আমি ছাড়াও তো তার আরো দুইডা মাইয়া আছে। তাগো পাতেও তো কহনো চাইরডা ভাত দেওন লাগে। নাতি-নাতনি গো আব্দার মিডান করণ লাগে। তার ওপর তার বড় মাইয়া বিধবা। বাসা ভাড়া দেওন লাগে। কেমনে তুই দুইটা বাজাইয়া আমারে বাসাইয়া দিলি। দিলিই যুদি, দিতি আমি যহন একলা আছিলাম!
আবার কখনো দেলুর কণ্ঠে অন্য সুর। থাউক, খুঁজ নিলে নে। না নিলে না নে! আমিই কি না খাইয়া আছি! আল্লাহ আমারে খাওয়াইতেছে না। এই তো মায় পিত্তিদিন আনারসের ছাবাগুলান বাসাবাড়ির তন নিয়াসে সেগুন খাইয়াই সন্ধ্যারাইতে প্যাট ভইরা যায়। মাঝরাইতে উইঠা রাইতের খাওন খাওয়া লাগে! প্রায়দিন মা’য় বড় মাছের বড় বড় টুকরার তরকারি নিয়াহে। বাসি অইলেই কি! তুই তো গুড়া মাছই পিত্তিদিন খাওয়াইতে পারতি না। আল্লাহ যা কপালে রাখছিলো মাইন্যা নিছিলাম…।
এক ঈদের পরদিন দেলু খুব ঝলমলে মুখে সেতারা বেগমের বাড়িতে ঢুকলো। ঢুকেই সেই তার নিজের সাথে কথা। ঈদটা গেলো এট্টু খুঁজ নিলি না। মাইয়া দুইডার লাইগ্যাও একগাছা সুতাও পাডাইলি না। না পাডাইলি। আমার মায় দিছে আমার মাইয়াগোরে। এই যে মায় তিন বাসার থেইকা জাকাতের তিনখান শাড়ি পাইছে, দুইহান আমারে দিয়া নিজের লাইগ্যা একখান রাখছে। তুই দেস্ নাই, কিšুÍক আল্লায় আমারে অন্যখান থেকে পাওয়াইয়া দিছে!
একটানা অনেকদিন পর্যন্ত কয়েক ঘন্টা করে দেলুর প্যাঁচাল সেতারা বেগমের মনের অন্ধিসন্ধিতে যেনো জট লাগতো আর খুলতো। অথবা দেলু তার জীবনের গল্প বলে যেতো আর সেতারা বেগমের মনে সেলুলয়েডের ফিতার মতো দৃশ্যগুলো চিত্রায়িত হতো! অভিমানের যে একটা সুখ আছে। ক্রোধের যে একটি তেজ আছে, দেলুর ভেতর তার বিন্দুমাত্র না দেখে সেতারা বেগম তার সেই বয়সে খুব হতাশ হয়েছিলো।
স্বামীর অন্যায়ের প্রতিবাদ করার মতো ওর ভেতরে দ্রোহের এতোটুকু আগুন না দেখে তিনি মনে মনে ভাবতেন, সব মানুষের প্রবণতা যদি দেলুর মতো হতো, তাহলে পৃথিবীটা স্বর্গ নয়, একেবারে গোয়াল ঘর হয়ে থাকতো।
শেষমেষ একদিন দেলু সাজগোজ করা অবস্থায় এসে হেসে বললো, আমার মাইয়া গো বাপে আমাগো নিতে আইছে আপা। আমি যাইতেছি। আইজকারতন খুঁজলে কাইল পর্যন্ত কামের মানুষ আপনি ঠিকঐ পাইবেন। কিন্তু আপনি তো আইজ বিপদে পড়বেন। তাই যাওনের আগে লুকাইয়া আইছি, খালি থালাবাসনগুলা অন্তত ধুইয়া দিয়া যাই। আর খুচরা যে কয়দিন কাম করছি, টাকা কয়টা আমার মারে দিয়া দিয়েন!
সেতারা বেগম দেলুকে আর থালাবাসন পর্যন্ত যেতে দিলেন না। দু’হাতে থাবা দিয়ে তাকে প্রতিহত করলেন। আর পুরো মাসের টাকাটা তাকে তখনি ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, তোকে তো বাড়তি কিছু কখনো দিইনি। আজ পুরো মাসের টাকাটাই তোকে দিলাম। এ খুব বেশি না!
দেলু বলেছিলো, অহনো মাসের অর্ধেক অয় নাই।
সেতারা বেগম বলেছিলেন, তুই আমাকে কিছু দিয়ে গেলি। আমরা যে জীবন যাপন করি, তার সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই কোনো ধারণা নেই। আর এর নির্দিষ্ট কোনো মাপকাঠিও হয় না, মেপে চলার। কিন্তু তুই বোধ হয় সেই একখান অদৃশ্য মাপকাঠি আমার হাতে তুলে দিয়ে গেলি!
দেলু বললো, আমি জানি না আপনে কী কন। আমি কী দিলাম। তয় দোয়া কইরেন। য্যান আমার বুইড়া মায়ের ওপর আর বোজা অওন না লাগে! এইটুক ছাড়া আমি দোজখে থাকতেও রাজি আছি!
বাসায় ফিরতে ফিরতে দুপুর হয়ে গেলো। দক্ষিণখান থেকে ধানমÐি। রাস্তা কম নয়। জ্যাম লাগাতার থাকেই। বিকেলে হোসনেয়ারা বেগম সেতারা বেগমকে ফোন করে বললেন, তুমি বাসায় পৌঁছে একটা ফোন দেবে না? কেমন বন্ধু তুমি, অ্যা? তুমি চলে যাওয়ার পর বাড়িটা ফাঁকা লাগছে। অথচ থাকলে তো মাত্র একটা রাত!
সেতারা বললেন, ফোন দেবো কি! তোমার বাসা থেকে বের হওয়ার পর পয়ত্রিশ বছর আগের তখনকার আমার প্রায় কাছাকাছি বয়সের এক তেইশ-চব্বিশ বছর বয়সী মেয়ে আমার মনটাকে তার নাটকের মঞ্চ বানিয়ে রেখেছে। সেই যে সে কাজ করতে করতে তার যে রোজনামচা আওড়াতো, তাই মহাজীবন্ত হয়ে উঠেছে!
: তুমি আমার সাথে এতো এতো গল্প করে গেলে, চাঁদ দেখতে এসে তাও দেখতে পারলে না, সে সবের কোনো রেশ তোমার মন-মাথা স্পর্শ করতে পারেনি। সেই তোমার জোয়ানকালের কাজের মেয়ে এসে এরি ভেতর তোমাকে কব্জা করে বসে আছে?
: মনের ওপর কারো জোর চলে বলো? তাহলে তো তুমিও পারতে আলগোছে আমিন সাহেবের অসতর্ক কাঁটাখানা সরিয়ে রেখে নিজেকে নিপাট সুখি করে রাখতে!
: তোমার কাজের মেয়ের গল্পটা আমাকে শোনাও তো! নিশ্চয় আমার ওই কাঁটার সাথে তোমার কাজের মেয়ের কোনো বিষয়ের মিল আছে!
: না রে! বরং সম্পূর্ণ বিপরীত। তবে সত্যি কথা সেই বৈপরীত্যের জন্যই তাকে মনে পড়েছে! কতো ছোট্ট একটা বিষয় প্রশ্রয় পেয়ে তোমার মনের সবটুকু জায়গা দখল করে আছে। আর ওই মেয়ের মনে কোনো বেদনা-অভিমান, ক্ষুধা-তৃষ্ণাকে ঘনীভ‚ত করে তোলার একটু জায়গা অবশিষ্ট নেই…’ বলে, সেতারা বেগম দেলুর কথাগুলো হোসনেয়ারা বেগমকে বলে যেতে লাগলেন আর মনে মনে ভাবলেন, বিষে বিষ ক্ষয় করার চেষ্টা করি আরকি!
অগ্নিবলয়
দীলতাজ রহমান
তৈয়বের মা মারা গেছেন, এই খবরটা জার্মানিতে সামিউলের কাছে বেড়াতে যাওয়া অবস্থায় যখন সামিউলের মা’র কানে পৌঁছুলো, সামিউলের মা সেই বিদেশের মাটিতে বসে সমবয়সী মানুষটির জন্য শুধু শোকার্তই হলেন না, তিনি বেশ একটু স্মৃতিকাতরও হয়ে উঠলেন। ছেলেকে বললেন, আহা, এই বয়সে তৈয়বের বাবার কী হবে!
সামিউল বললো, কি আর হবে? তৈয়বের বড় মা আছেন না? তৈয়বের বাবা ওনাদের বগুড়ার বাড়িতে তৈয়বের বড় মা’র কাছে গিয়ে থাকবেন। অথবা বড় মা ঢাকাতে তৈয়বের কাছে চলে আসবেন! তাদের যে কারো থাকার জন্য তৈয়ব তো একা নয়। আরো ভাইবোন ঢাকা ছাড়াও অন্যান্য জেলায়ও আছে। সবাই যে যার মতো ভালো পজিশনেও আছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে তৈয়বের ছেলেটাকে নিয়ে। আন্টিই ওর ছেলেকে রাখতেন। তৈয়বের বউ একটা পাবলিক ইউনিভার্সিটির টিচার।’
সামিউলের মা ছেলের কথার কোনোই উত্তর দেন না। কিন্তু তিনি আনমনে কিছুক্ষণ নিজেকে নিরীক্ষণ করে মনে মনে ভাবলেন, নিজের ছেলেমেয়ের কাছে অতিথি হয়ে এসেই বেশিদিন থাকা যায় না। আর তো সতীনের ছেলের কাছে এসে পড়ে থাকা। তা সম্পর্ক দেখতে যতোই ভালো হোক। আমার তো কিছু জানা হয়ে গেছে!
এরপর সামিউলের মা’র মনে ক’দিন ধরে একটি বিষয় কাঁটার মতো খচখচ করতে থাকে। তবু তিনি ছেলেকে ডেকে কখনো আর তৈয়বদের কারো কোনো খবর জানতে চান না। কিন্তু পুরনো কিছু দৃশ্যের মহড়া সারাক্ষণ তার মনে নতুন করে চলতে থাকে। কিন্তু নাটকের পরিণতি যেন চিত্রনাট্য লেখক লিখে শেষ করেননি। তাই কোনো এক কুশীলব শেষ দৃশ্য একেক বার একেক রকম করে উপস্থাপন করার স্বাধীনতাটুকু কাজে লাগাচ্ছেন।
সামিউলের মা’র ক’দিন যাবত একটানা মনে পড়তে থাকে, তাদের ছেলের এসএসসি পরীক্ষার সময় মতিঝিল একটি সরকারি স্কুলে সিট পড়েছিলো। তখন অধিকাংশ পরীক্ষার্থীর মায়েরা তাদের সাথে এসে সেই স্কুলের সামনে শেষবেলা পর্যন্ত বসে থাকতেন।
ছেলেদের পরীক্ষা শেষ হলে তারপর তারা হুড়মুড় করে একসাথে উঠে যে যার ছেলের সাথে রিকশায় উঠতেন। যাদের গাড়ি ছিলো তারা গাড়িতে যেতেন।
প্রতিদিন দু’তিনটি চাদর একসাথে বিছানো হতো। সেখানে সবাই গোল হয়ে বসতেন। তারপর রোদ তাড়া করলে তারা সবাই একদিক থেকে আরেকদিকে সরে বসতেন। কিন্তু সেই আগের মতো একসাথে গোল হয়েই বসতেন। কারণ তারা যে কয় ঘন্টা ওখানে থাকতেন, একজনের গল্প আরেকজনের গল্পের সাথে এমনভাবে জোতবাঁধা থাকতো, তা তাদের যে কোনো কারো জন্য খোলাটা নিজের থেকে সহজ ছিলো না! এর ভেতর সবারই থাকতো বাড়ি থেকে আনা কিছু কিছু খাবার। কেউ কেউ আবার সবার জন্য আনতেন ফ্ল্যাক্স ভর্তি চা! কোনো ছেলের বাবা খোঁজ নিতে আসতেন তো তিনিও সাথে করে দোকানের কোনো খাবার ছেলেদের সমবেত মা’দের জন্য প্যাকেট করে নিয়ে আসতেন।
কিন্তু সামিউলের মা মাজেদা বেগমের যা আশ্চর্য লাগতো, তা হলো তৈয়বের দু’জন মা আসতো। এর ভেতর কোনজন তৈয়বের মা, তা আরো অনেক পরে তৈয়বদের বাড়িতে গিয়েও জানতে পারেননি মাজেদা বেগম। অনুমানে জেনেছিলেন আরো অনেক পরে। কিন্তু খোলা মাঠে সেই মায়েদের ভীড়ে তখন সেই ক’টা দিনে তীর্যক থেকে সোজা কোনো প্রশ্নে অন্য কোনো একজন মা-ও চেষ্টা করে জানতে পারেননি!
ছেলেদের পরীক্ষার সময় একত্র হওয়া মায়েদের কেউ কেউ স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন, আপনার দুজনের কে তৈয়বের আসল মা বলেন তো!’ দুই মায়ের একজন একটু বেশি বয়স্ক। গায়ের রং শ্যামলা এবং তার থেকে বছর দশেক কম বয়স যার তিনি লালচে ফরসা। তখন শ্যামলা আর ফরশা দু’জনে একসাথে গলগল করে হেসে উত্তর দিয়েছেন, দু’জনেই ‘আসল মা, নকল কেউ নই।’
উত্তর পাবে না জেনেও চক্ষুতেচর্মহীন দু’চারজন হা-ভাতে বুদ্ধির মা তবু কটাক্ষপূর্ণ মন্তব্য অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু ঘেরাটোপের ভেতরে থেকে দু’জন নারী সতীন হয়েও সম্পর্কের ভেতর যে সৌন্দর্য সৃষ্টি করে রেখেছেন, তা ক’জন মোটা দাগের বুদ্ধিসম্পন্ন নারীর ছেঁড়াটানেও তখন ছেলেদের-
পরীক্ষার সেই দীর্ঘ একটানা সময়ের কোনো ফাঁকে এতোটুকু খসেনি!
মাজেদা বেগম, মানে সামিউলের মা’র সেই থেকে কৌত‚হল ছিলো, দুই সতীনের এত একাত্মতা কেন? কিন্তু মাজেদা বেগম বিষয়টি নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ থাকলেও নিজের মনেই আলগোছে কাঁটার মতো প্রশ্নখানা সরিয়ে রেখে দেন। কারণ পরিমিতি বোধ বলে অভিধানে একটি শব্দ আছে, এটা তার জানা ছিলো।
আরো বছর দুয়েক সময় গড়ালে মাজেদা বেগমের এক পরিচিতা তার কানাডা প্রবসী ইঞ্জিনিয়ার ছেলের জন্য মেয়ে খুঁজছেন জানালে, মাজেদা বেগম বললেন, মেয়ে একটা আছে বটে। আপনি যেমন চাইছেন, পছন্দ হবে। কিন্তু একটা কিন্তু আছে।
পরিচিতা বললেন, কী সেই কিন্তু?
মাজেদা বেগম বললেন, মেয়েটি দেখেন আগে, মেয়ে পছন্দ হলে, ও কিন্তু কোনো কিন্তু নয়।
ততদিনে ছেলেরা কলেজে উঠে যে যার মতো কলেজে ভর্তি হলেও তাদের বন্ধুদের ভেতর বন্ধুত্বটা তাজাই ছিলো। সেইসূত্রে তাদের মায়েদেরও হাই-হ্যালো চলতো। প্রায়ই একে অপরের বাড়িতে আসা-যাওয়ার মতো ঘটনাও ছিলো। সেই সূত্রে মাজেদা বেগম তার পরিচিতাকে নিয়ে গেলেন তার ছেলের স্কুলের সেই বন্ধু তৈয়বদের বাড়ি। তৈয়বের ইমিডিয়েট বড়বোনটাকে মাজেদা বেগমের চোখে লাগে। আর তা তার রূপের জন্য নয়। বরং মাজেদা বেগমের মনে হয়, বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট নেই, তবু কেন মেয়েটি চোখ টেনে রাখে!
মাজেদা বেগম ও তার পরিচিতাকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসতে বসতে তৈয়বের বড় মা জানলেন ছোটজন বাড়ি নেই। মাজেদা বেগম কোনো ভ‚মিকা না করে বললেন, অসুবিধা নেই। একজন থাকলেই হলো। এই যে এই সুন্দরী মহিলাকে সাথে করে এনেছি, ওনার কানাডা প্রবাসী ইঞ্জিনিয়ার ছেলের জন্য ঠিক ওনার মতো একটা সুন্দরী মেয়ে উনি চান। তো আমার মনে হয় আপনাদের তুহিনূরকে ওনার পছন্দ হবে। আর ছেলেও আপনাদের পছন্দ হবে জেনে আমি ওনাকে সরাসরি সাথে করে নিয়ে এলাম!
তৈয়বের বড় মা বললেন, কিন্তু তুহিনূরের মা তো বাড়ি নেই। তাই আমি কিছু বলতে পারছি না…। আর ওদের বাবাও আমেরিকা গেছেন, অফিসিয়্যাল ট্যুর…।’
তৈয়বের বড় মায়ের কথায় পরিচিতা, ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের মা থতমত খেলেন। তিনি বুঝলেন, এই সেই কিন্তু। পাত্রী’র মা দুইজন।
মাজেদা বেগম পরিচিতার ভাব বুঝেও তৈয়বের বড় মা’কে বললেন, যাক আপনাদের সাত ছেলেমেয়ের মধ্যে একজনেরটা জানা গেলো, কে তুহিনূরের মা!
ছেলের জন্য পাত্রী প্রার্থী পরিচিতা নারীর নাম সুফিয়া খান। তিনি তখনি ঝাড়া গলায় বলে উঠলেন, ছেলেমেয়ের বিয়ে-শাদি মাথায় উঠুক, আগে বলেন আপনি সতীন সহ্য করলেন কেমনে? আমি তো জীবনেও পারতাম না…!
: সহ্য না করে কী করতাম কন?
: বিয়ে করে আনার পর দৌড়াইয়া দিলেন না ক্যান?
: কার বাড়ি থেকে কাকে দৌড়াই। আমি চলে যেতে পারতাম। কিন্ত আমার তখন ছেলেমেয়ে দু’জন।
: মেয়ে দেখে বুঝেছি আপনার সতীন সুন্দর। ও মেয়ের মা অন্যখানে ভালো জামাই পায়নি, যে এই রূপ নিয়ে সতীনের ঘর করতে আসছে?
: সতীনের দোষ ছিলো না। সে এই বিয়েতে রাজি ছিলো না। তার মা-বাপকে অনেক ধরাধরি করে, তার নামে গ্রামের একবিঘা জমি লিখে দিয়ে তারপরে আমার স্বামী তারে আনছে।
: মানে আপনাদের একই গ্রামের?
: হ্যাঁ!
: তা হোক, তবু আপনি চুপ করে থাকলেন?
: চুপ করে থাকলাম মানে, চুপ হয়ে গেলাম। সতীনের ওপর আমার বিন্দুমাত্র রাগ-হিংসা জন্মালো না। বরং মনে হলো, সে-ই প্রমাণ করে দিলো, আমার সাথে প্রতিরাতে যা হতো, তাতে কোনো ভালবাসা ছিলো না। সে মনে মনে আরো ভালো শরীর, সুন্দর মুখের আশা পুষতো। আমি ব্যবহার হইছি পায়খানা-পেচ্ছাবখানার মতো! আর সতীন বাড়ি আসার দু’দিন পরেই আমার নির্বিকার অবস্থা দেখে সে কেঁদে বলেছিলো, আপা, আমাকে সারাজীবন অপরাধী হয়ে থাকতে হবে, আমি আপনার শত্রæ হয়ে ঘরে ঢুকেছি!’ সে যে এইটা বুঝতে পারছে, সে জন্য প্রতিজ্ঞা করলাম, ওর ওপর কোনো রাগ আমি রাখবো না!
: আপনি প্রতিজ্ঞা করলেন আর বিষদাঁত উপড়ানো সাপের মতো রাগ আপনার কথা শুনলো?
: যে ঘর ছেড়ে চলে যেতে পারিনি সে ঘরের পরিবেশ বিষাক্ত করলে আমারও তো ক্ষতি। মানে আমার আর লাভ-ক্ষতির প্রশ্ন অসছেই কেন!
আমার ছেলেমেয়েরই ক্ষতি। যে সংসারে অশান্তি থাকে সে সংসারের ছেলেমেয়েদের শৈশব পুড়ে খাক হয়ে যায়!
: আপনি নীলকণ্ঠ হয়ে ভার নিলেন সবার শান্তি রক্ষা করার?
: আমার মা বলেছিলেন, আমিও তো সতীনের সংসার করেছি। তাই আমি জানি সতীনের আগুন কি! মা আরো বললেন, মা যদি হতে চাও, মাটি হয়ে থাকো। দেখো, অবলা-নিরীহ মুরগির কোলে বারোটা চৌদ্দটা করে বাচ্চা থাকে। মুরগি তো বাচ্চার বাপ খুঁজতে যায় না! বাচ্চা ফুটে গেলে তার প্রধান পরিচয় সে ওই বাচ্চার মা! মুরগি স্বভাবে হিংস্র নয়, কিন্তু মা হয়ে যাওয়ার পরে সে শেয়ালের সাড়ে লড়ে। বেজির সাথে লড়ে। কাক-চিলের উপস্থিতি টের পেলে ঊর্ধ্বমুখে ছুটে তাদের তাড়িয়ে দেয়। বাচ্চারা বড় না হওয়া পর্যন্ত মা কোনো খাবার সে মা মুরগি গেলে না। মাটি চেলে পোকামাকড় খুঁটে বাচ্চাদের মুখে তুলে দেয়। মানুষ অতোটা পারে না, তাই কখনো মানুষকেও পশু-পাখির থেকে মমত্ববোধ ধার নিতে হয়। তাছাড়া লেখাপড়া যেটুকু শিখেছো, চাকরি করার জন্য তো তৈরি হওনি যে বেরিয়ে আসবে! তোমার বাপই বিয়ে দুটো করেছে, সে আর তোমার দরদ কী বুঝবেন!
: মায়েরা যার যার জায়গা থেকে কমবেশি যে যেটুকু করে, তা ওই পরের ছেলে স্বামী পুরুষটি যেমন কম বোঝে, তেমনি ছেলেমেয়েও যে বোঝে না, তা অবশ্য আমি বুঝতে শুরু করেছি! অবশ্য আমার কোনো প্রত্যাশাও নেই বোঝার!’ সুফিয়া খান বললেন।
: মায়ের কাজ হিসেব করে চলা নয়। মা তো নদীর জলের মতো!’ বললেন মাজেদা বেগম।
: এরশাদ একটা ভালো কাজ করেছিলেন। তার সময় আইন পাশ হয়েছে, দ্বিতীয় বিয়ে করতে বড় স্ত্রী’র স্বাক্ষর লাগে।’ বললেন, সুফিয়া খান!
: সে আইন আইয়ুব খান করেছিলেন। কিন্তু তা কেউ মানতো না। এরশাদ সেটা কড়াকড়ি করেছেন। তবে স্ত্রী’র অনুমতি ছাড়া বিয়ে করলে তিনমাস জেল হয়। বিয়ে তো আর অবৈধ হয় না আপা!’ বললেন মাজেদা বেগম।
তৈয়বের বড় মায়ের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে সুফিয়া খান গাঢ়স্বরে বললেন, কিন্তু আপনি তো দেখা যায়, আপনার জামাইরে আবারও জায়গা দিছেন, না হলে আর তিনটা ছেলেমেয়ে কি করে হলো?
: ঠিকই। জানেন, আগেও রাতদিনের কোনো সময়ই ওসব মনে হতো না! কিন্তু উনি আরেকটা বিয়ে করার পর থেকে মাথার ভেতর খালি ওই ভাবনা! সারাক্ষণ মনে হয়, আমার সাথে যা করতো, তা ওর সাথেও করছে!
রাতে ঘুম আসে না। বিয়ে করে আনার পর অনেকদিন তো আমার কাছে আসেইনাই! এদিকে বুকের আগুন শরীরের আগুন এক হয়ে চব্বিশ ঘন্টাই শরীর উত্তপ্ত হয়ে থাকে। তাই যখন এলো ফেরাবো কি, মনেহয় সর্বস্ব দিয়ে তখন আরো বেশি করে ধরে রাখি! রাত ভাগাভাগি নিয়ে দেখলাম আমি হিসেবি হয়ে উঠলাম। শরীরের ভেতর যে এত আগুন লুকানো ছিলো, সে আমিও আগে টের পাইনি! সতীন এসে বুঝিয়ে দিলো।’ তৈয়বের বড় মা বললেন।
: এখন কি সব সয়ে গেছে? সুফিয়া খান বললেন।
: এই সমাজে নারীরা সয় বলেই পুরুষের অসভ্যতা ঢেকে থাকে। আর নারীর যদি স্খলন একটু থাকে, সেটারই কতরকম কাহিনী তারা বাতাসে ভাসায়! তখন যদি আমি নিজের উগরানো বমি নিজে ফিরে খাওয়ার মতো তাকে গ্রহণ না করে চলে যেতাম, তার খেসারত কদ্দূর গড়াতো বলেন? আমার ছেলেমেয়ে দুটো আমার ওপর রাগ করেই বখে যেতো। তারা তো আমার আগুন চেখে দেখতো না। খালি বুঝতো, মা চলে গেছে! আর আমার মা-বাবাকে বিপদে ফেলা হতো। আবার কাউকে বিয়ে করলেও তো কারো দ্বিতীয় স্ত্রী হতে হতো!’ তৈয়বের মা বললেন।
: এজন্যই তো পনের বছর ধরে স্বামী মারা গেছে, মাঝে মাঝে জীবন অসহ্য হয়ে উঠলেও ওসব আর ভাবতে সাহস পাইনি। আমার দুই ছেলে। লেখাপড়ার সূত্রে দুটো দুই দেশে। বাংলাদেশে আমি একা।
: আপনি তো রূপবতী নারী। আপনাকে তো যে কোনো রাজকুমার এসে এখনো পঙ্খিরাজে তুলে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা…।’ মাজেদা বেগম বললেন।
: ওই উড়াল দেয়ার আগেই আমি পঙ্খিরাজ থেকে পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পাই। তাই ওড়া হয়ে ওঠেনি! আর রূপটা আমি রাখি বলে আছে। এই রূপ নিয়ে যদি কারো ওপর ভাত-কাপড়-আশ্রয়ের নির্ভর করতে হতো, তা হলে এটা হতো পণ্য! স্বামী মারা গেলে যা ছিলো, তা খুব গুছিয়ে চলেছি। কিন্তু আমি কারো বৈভবের আশা করিনি! অনেকে টোপ দিয়েছে। এখনো দিচ্ছে। কিন্তু ঠেকিয়ে রাখার মতো কাঠিন্যটুকু আমি বহাল রেখেছি।’ সুফিয়া খান হেসে বললেন।
সুফিয়া খানের রূপের চেয়ে লাবণ্যের ধার বেশি। এজন্যই অনেকেই তাকে সোফিয়া লরেন বলে। কিন্তু শারীরীক সৌন্দর্যের লাবণ্যের চেয়ে ব্যবহারের মাধুর্যের জন্য মাজেদা বেগম সংক্ষেপে তাকে মাঝে মাঝে বলেন, লরেন আপা। যাতে সোফিয়া লরেনই বোঝায় এবং স্মার্ট শোনায়।
তৈয়বের বড় মা আর সুফিয়া খান যতক্ষণ কথা বলছিলেন, মাজেদা বেগম বলার মতো কোনো কথাই খুঁজে পাচ্ছিলেন না। কারণ এই বাড়িতে তার ছেলের আরো বন্ধুর মায়েরাসহ একবার এসেছিলেন। সবাই ঢুকেই দেখেছিলেন, তৈয়বের দুই মা-ই যেন দুর্গার মতো দশ দশ বিশ হাতে কাজ করছেন। যেন কে বেশি করে কাকে আসান দিতে পারেন। ছেলেমেয়েগুলোর সাথে দু’জনেরই আচরণ এমন, যে বোঝার উপায় নেই এর কোনোটা একা একজনের। আর তাতে মাজেদা বেগমসহ অন্যান্য মায়েরাও সেদিন বিস্মিত না হয়ে পারেননি। তবে বেশি বড় যে দুটো, তাদেরকে তারা মনে মনে বড়জনের ভাগেই ফেলেছিলেন। সেদিন তৈয়বদের বাড়িতে সবাই একসাথে খেতে বসে আরো চমকালেন, যখন ছোট সতীন বললেন, আপা, আমার কেন যেন খেতে এখন ইচ্ছে করছে না।’ বড় সতীন ছোট’র সে এঁটো ভাত নিজের প্লেটে ঢেলে নিতে নিতে বললেন, তোমার এগুলো আমি খাই। আমার মাছখানা রেখে দিলাম, তুমি পরে খেও।’
মাজেদা বেগমসহ তার ছেলের আরো ক’বন্ধুর মা তখন একসাথে মুখ চাওয়াচাইয়ি না করে পারেন নি।
তারপর মাজেদা বেগমের সাথে তৈয়বের ছোটমায়ের একবার দেখা হয়েছিল। সামিউল ততোদিনে লেখাপড়া শেষ করে জার্মানিতে সেটেলড্। সে দেশে ফিরে এসে তার স্কুলের বন্ধুদেরকে তাদের সবার মা’সহ নিজেদের ধানমÐির বাসায় ডেকেছিলো। তৈয়ব এসেছিলো তার ছোট মা’কে নিয়ে। আর তাতেই প্রমাণ হয় না তৈয়ব ছোটমায়ের ছেলে। সেই তখনই ছিলো তৈয়বের ছোট মায়ের সাথে মাজেদা বেগমের শেষ দেখা।
সেদিন তৈয়বের ছোট মা বলেছিলেন, ঢাকার বাড়িটা বিক্রি করে ব্যাংকের লোন শোধ করে বাকিটা ব্যংকে রাখা আছে। ছেলেমেয়ে সব একে একে চাকরি-বাকরি পেয়ে বেরিয়ে গেছে। আর ব্যাংকের লোন শোধ করা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিলো। বাড়িতে গাড়ি ঢোকে না বলে কোনোটা আর ও বাড়িতে থাকতেও চায় না। তৈয়বের বাবা বললো, সারাজীবন লোনের ঘানি না টেনে বাড়ি বিক্রিই করে দিই!’ এখন তৈয়বের বাবা আর আমি দু’জন তৈয়বের বাসায় থাকি। কারণ ওর বউও চাকরি করে। ওর ছেলেকে আমার রাখতে হয়।
মাজেদা বেগম বলেছিলেন, তৈয়বের বড় মা?
: উনি বগুড়াতে। আমাদের বাড়ি তো শহরে। তার একটা ছেলে লেখাপড়ায় ভালো করতে পারেনি। তাকে দেশে ব্যাবসা ধরিয়ে দিয়েছে তার বাপ। তাই উনি ওখানে থাকেন!
তৈয়বের ছোট মা’য়ের সাথে গল্প করার সময় সুফিয়া খানের সাথে তৈয়বের বড় মায়ে’র সেদিনের সেই কথাগুলো মাজেদা বেগমের খুব মনে পড়ে গেলো। সেদিন তৈয়বদের বাসা থেকে বের হতেই সুফিয়া খান বলেছিলেন, মেয়েই তো গেট খুলে দিলো। না বলে আসাতে স্বাভাবিক সাজেই দেখতে পারলাম। তবু মেয়েটিকে আমার পছন্দ হয়েছে। ঢাকায় নিজেদের বাড়ি আছে। এটাও একটা প্লাস পয়েন্ট। কিন্তু এইটুকু সময়ের ভেতরই একটা অদৃশ্য মিহিন আগুন আমাকে জড়িয়ে ধরেছে, মাজেদা আপা। আমি আমার ছেলেকে এই আগুনের অংশীদার করতে চাই না!
কী আগুন দেখলেন আপনি একবার এসেই?’ বললেন মাজেদা বেগম।
কেন আপনি দেখেন না?’ সুফিয়া খান বললেন।
তারপর মাজেদা বেগমের উত্তরের অপেক্ষা না করেই সুফিয়া খান টানা আবার বলতে লাগলেন, ছেলে দুটিকে শিশু অবস্থায় রেখে তার বাপ মারা গেছে। আমি তাদেরকে খুব আগলে বড় করেছি। আত্মীয়-স্বজনের ভেতরও কোনো ধরণের ঝঞ্ঝাট যেখানে দেখেছি, সেখান থেকে আজো সরিয়ে রাখি। কোনো অশান্তির আঁচ ওদের গায়ে কখনো লাগতে দিইনি।’
আপনি তো ছেলে বিয়ে দিয়ে বউ নিয়ে যাবেন। আপনি তো মেয়ে বিয়ে দিচ্ছেন না যে তাকে এদের ভেতর পড়ে থাকতে হবে!’ মাজেদা বেগম বললেন।
এইটা কি বললেন আপা! ছেলে হোক আর মেয়ে হোক এবং তারা যত দূরেই থাক, কোনো পরিবারে অশান্তি থাকলে তা নাড়ার আগুনের থেকে আরো দ্রæত বেয়ে চলে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের ভেতর।’
তা বটে!’ মাজেদা বেগম বললেন। মনে করেন, যে পরিবারে সমন্ধ করবেন, অনেকে মনে করেন, ফ্যামিলির ভেতরের অবস্থা যেমনই থাক, মেয়ে বিয়ে দিলে তো জামাইয়ের সাথে দূরে থাকবে। তার গায়ে আাঁচ লাগবে না। আসলে কিন্তু তা নয় মাজেদা আপা!’ সুফিয়া খান বললেন।
সেটা আমিও বুঝতে শিখেছি?’ মাজেদা বেগম বললেন।
শোনেন আপনার মেয়েকে জামাই দূরে নিয়ে থাকে। কিন্তু পরিবারে অশান্তি থাকলে, আপনার মেয়ের জামাইও তো ওই পরিবারের অংশ, সে কি পরিবারের কলহ টের পেয়ে প্রতিটি খুটিনাটি বিষয়েও অংশগ্রহণ না করে থাকতে পারবে? আর মেয়ে অশান্তির পরিবারে মেয়ে বিয়ে দিলে তো, সেই শ^শুরবাড়িই যদি তাকে থাকতে হয়, সেটা হয় চুলোয় নেমে আগুন পোহানোর মতো! … মেয়েদের তো স্বামী যেখানে থাকে, সে সেখানে তার থাকটাই স্বাভাবিক।
তৈয়বের ছোট মা’য়ের মৃত্যু-সংবাদে মাজেদা বেগমের বুকের ভেতর একটা নিঃশ^াস দীর্ঘ হয়ে বুকেই ঘুরপাক খাচ্ছিলো। এতদিন পর সেদিনের সুফিয়া খানের খুঁচিয়ে বের করে দেখানো আগুনের আঁচটা এবার যেন নিজের ভেতর টের পাচ্ছেন।
মাজেদা বেগম বুঝতে পারেন, এখন তৈয়বের বাবা তৈয়বের বড় মা’য়ের কাছে গিয়েই থাকবেন। কারণ পুরুষ মানুষের প্রথম বয়সে স্ত্রী’র প্রয়োজন যতোটা, বৃদ্ধ বয়সে প্রয়োজন অনিবার্য। তাই তো স্ত্রী মারা গেলে সব বুড়োই বিয়ের জন্য পাগল হয়ে ওঠে এবং চাকরানি থেকে শুরু করে যাকে পায়, তাকেই বিয়ে করে ফেলে। কিন্তু জোয়ানকালে বউ মারা গেলে পুরুষরা সাধারণত দ্রæত কোনো সিদ্ধান্তে যায় না।
মাজেদা বেগম আরো ভাবছেন, যখন তাদের তিনজনের ঢাকা-বগুড়া এই দুই জায়গায় থাকাটা ভাগাভাগি হয়েছিলো, কে কোথায় থাকবে, তাতে কি তৈয়বের বড় মা’র মতামতের ধার আর দু’জন ধেরেছিলো? তাহলে এই একটা সুযোগ বড় মায়ের। মাজেদা বেগমের ইচ্ছে করে, তৈয়বের বড় মা পালিয়ে যান বাড়ি ছেড়ে। সেটাই তার স্বামীর প্রতি সারাজীবনের মোক্ষম প্রতিশোধ হয়। কিন্তু নারী-পুরুষ, দুইজাতের কেউই বোধহয় সে প্রতিশোধটা এই পড়ন্ত বেলায় এসে নিতে পারে না! কোথাও ক্ষমা নামক গুণটি শ্যাওলার মতো মানুষের কোথাও মনের ভেতরে না হলেও অসহায়ত্ববোধে এসে ঠেকে থাকে। শরীর-মন দুর্বল হলে তা-ই জোয়ারের মতো ফুলেফেঁপে ওঠে! আর তার নাম হয় ক্ষমা! জীবনটা তখন গোঁজামিলে বোঝাই ঠেকে বলেই হয়তো বোঝার ভারের নিচে সুকোমল সব বোধ চাপা পড়ে যায়! কিন্তু মাজেদা বেগম যেন তৈয়বের ঘুমন্ত বড় মা’কে ঘুমের ভেতরও ধাক্কাতে থাকেন। বলেন, পালান আপনি! জীবনে আর কি পাওয়ার আছে আপনার? যৌবনে ঘায়েল হওয়ার, অপমানিত ও নিগৃহীত হওয়ার মোক্ষম প্রতিশোধ এই এখন বিনা কসরতে আপনি নিতে পারেন। যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যান! পারলে সংসারের কিছু অর্থ তুলে নিয়ে কোনো বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে গা ঢাকা দিয়ে থাকেন। তেমনটি না পারলে প্রয়োজনে পৃথিবী ছেড়ে পালিয়ে যান! সব বাঁচাই কি বাঁচা! কোনো কোনো মরণও বেঁচে থাকার চেয়ে অধিক!
ত্রসরেণু
দীলতাজ রহমান
সন্ধ্যারাতের সামান্য জ্বর গণগণিয়ে বেড়ে মাঝরাতে অনেক হলো। অমন জ্বর যার হয়, সে নিজে কারো কাছে সাহায্য চাইতে পারে না। তার ওপর শিহাবের পাশে কেউ নেই। সাতদিন হয় নদী রাগ করে তার বাবার বাড়ি চলে গেছে।
মা-বাবার একমাত্র সন্তান নদী। তাই শিহাবও তাকে প্রথম প্রথম অনেক প্রশ্রয় দিয়েছে। তার অনেক আব্দার মেনে নিয়েছে। কিন্তু তাই বলে বাড়ির মেয়েমানুষের অন্যায় আব্দার সে মেনে নেবে না, এ রকম একটি ইগো সে তার পূর্বপুরুষের কাছ থেকে জোরালোভাবে পেয়েছে। যদিও বাপ-দাদার ইগোর খনিকটা সে বর্জন করেছে। পুরোটুকু কখনোই পারবে না। একটি উচ্চবালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষত্রী মাকে পর্যন্ত দেখেছে বাবার কথার বাইরে কোনোদিন যাননি। কোনো ধরনের অন্যায় আব্দার করা দূরে থাক। বরং তার বাবার সব কাজে-কথায় তার মা-ই প্রথম সাপোর্ট দিয়েছেন। স্বামী মনে কষ্ট পাবেন এমন সব কাজ ও কথা থেকে তিনি ছেলেমেয়েদেরও বুঝিয়ে নিবৃত্ত রেখেছেন। সংসার-পরিবার টিকিয়ে রাখতে হলে একজনকে তো নমনীয় হতে হয়! শিহাব তার মা-বাবাকে দেখে বুঝেছে, স্বভাবত নমনীয় হওয়াটা নারীকেই মানায়, যদি সে পরিবারের পুরুষটি দুর্বিনীত স্বেচ্চাচারী না হন। নারী একটুখানি আনুগত্য দেখালেই পুরুষ তার পুরোটা অর্জন তার কাছেই বিসর্জন দিচ্ছে। দুই-চারটি ব্যতিক্রম ছাড়া সমাজে তাই তো প্রমাণিত হচ্ছে অহরহ।
সময় পাল্টেছে এটা শিহাব বোঝে। নারী হোক বা পুরুষ, যে কোনো অগ্রসর মানুষের কথা মাথা পেতে নেয়াই যায়। কিন্তু যে নিজেরই কোনো পরিবর্তন আনতে পারে না, শিহাব ভাবে, আমি কেন তার একরোখা আব্দার মানতে যাবো!
নদী হয়ত ভেবেছিলো সে রাগ করে চলে গেলে শিহাব সেদিনই তাকে আনতে যাবে! কিন্তু শিহাব সাতদিনেও সে কাজটি করেনি।
কলহের সূত্রপাতটা ঘটেছিলো এভাবে, নদী বলেছিলো, গুলশানে তার মামার নির্মিত ভবন থেকে একটা ফ্ল্যাটের বুকিং দিতে। মামা মোট মূল্য থেকে তাদের জন্য নাকি অনেক কমিয়ে দেবেন!
শিহাব বলেছে, কমালেও কত কমাবেন? আর আমি কারো দয়া বা সুযোগ নিতেই যাবো কেন? আমাদের জীবন পড়ে আছে। মাত্র দু’বছর হয় আমাদের বিয়ে হয়েছে। চাকরির বয়স তিন। ওসব ফ্ল্যাট-ট্যালাট এমনি সময় মতো হবে!
কিন্তু নদী তা মানতে নারাজ। সে তার আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব কে কোথায় জমি-ফ্ল্যাট কিনছে, কে কোথায় বুকিং দিয়েছে সেইসব উদাহরণ টেনে টেনে উচ্চস্বরে শিহাবের সাথে কথা বলেছে। আর এতেই চরমভাবে দমে গেছে শিহাব। তার আর নদীর দিকে ফিরে তাকাতে ইচ্ছে করেনি! আগেও যে একআধটু বচসা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দু’জনের হয়নি, তা নয়। কিন্তু প্রতিবার শিহাবই থেমে গেছে। সে ভেবেছে, এখনো হানিমুনের রেশ কাটেনি, এখনি
কারো বিষদাঁত দেখে ফেললে তাকে নিয়ে এক ছাদের নিচে থাকাটা খুব ন্যাক্কারজনক। তাই যতদিন তা দেখা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। তবু তারা পাশাপাশি দুদিকে ফিরে শুয়ে দু’রাত পার করেছে। শিহাব কেবলি ভাবছিলো, যে স্ত্রী তার স্বামীর সামর্থের ওপর আঘাত করে, সে আঘাত শারীরীক আঘাতের চেয়েও অধিক। বাকি জীবন তাকে এই লাঞ্ছনার ভেতর দিয়ে যেতে হবে এবং নদীর মতো নারীর পেটে তাকে বাচ্চার নামে বিষফল জন্ম দিতে হবে, এসব ভেবে সে শঙ্কিতও হচ্ছিলো। পৃথিবীতে কত কত বিষয় আছে আলাপের, কিন্তু ঘরে ঢুকলেই মনে হয় স্ক্রড্রাইভার দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তার মাথায় স্ক্র ঢোকাচ্ছে নদী। তার চিন্তা-ভাবনা প্রবলভাবে ব্যাহত হচ্ছিলো। অন্যেরা তাদের স্ত্রী’র এইসব বিষয় কীভাবে মেনে নেয় এটাই শিহাব ভেবে পাচ্ছিলো না।
অযথা বিলাসদ্রব্য কিনতে, বা ঘরের ফার্নিচার পাল্টাতে নিষেধ করলেই নদী বলে ওঠে, অন্যেরা পারলে তুমি পারবে না কেন?
: অন্যেরা কীভাবে পারে এটা তাদের বিষয়। আমি শুধু আমারটুকু জানি। আমি ব্যাংকে যে পোস্টে চাকরি করি, সেই হিসাবে আমার মোটামুটি ধারণা আছে আমি কবে নাগাদ কোথায় পৌঁছাবো। কবে আমার কী পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ! তাছাড়া আমি ব্যাংকিং সেক্টরে ব্যাতিক্রম কিছু কাজ করতে উচ্চশিক্ষার জন্য একবার হলেও উন্নত কোনো দেশে যেতে চাই। কানাডা আমার লক্ষ্য। যেহেতু সৌরভ সেখানে সেটেলড। তোমাকেও বলে রেখেছি আমার সাথে যেতে চাইলে তুমিও একটা উপায় বের করো। সৌরভ আমার ছোটভাই। ওর ওখানে গেলে আমাদের অসুবিধা হবে না। তবে যাওয়াটা কাজে লাগাতে হবে। তখন বেশ কিছু টাকার দরকার হবে। আর আমার মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়, আমি এমন কোনো কাজ আপাতত করতে চাচ্ছি না, এসব কথা বারবার তোমাকে বোঝাচ্ছি…।
: এত যদি গায়ে বাতাস লাগিয়ে জীবন কাটাতে চাও, তাহলে বিয়ে করেছিলে কেন?
: বিয়ে করেছি কি আমার বুদ্ধি-বিবেক বিসর্জন দিয়ে তোমার কথা মতো চলতে? বিয়ে মানুষ যে জন্য করে আমিও সেজন্য করেছি! তুমি কি ভেবেছিলে, যাকেই বিয়ে করো সে তোমার কথা মতো চলবে?
: তুমি কখনো আমার কোনো কথা রাখো না!
: রাখার মতো কথা তুমি আজ পর্যন্ত কোনটা বলেছো? শোনো নদী, দুই পক্ষের গার্জিয়ান যখন পাকা কথার আগে আমাদের দু’জনকে সুযোগ দিয়েছিলেন আলাদা করে কথা বলতে, তখনি কিন্তু আমি তোমাকে আমার এইসব পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলাম!
: তাই বলে নিজেদের জন্য আরো ভালো পরিবেশে স্থায়ী একটা থাকার জায়গা করবে না?
: ভাল পরিবেশ টেশ কিছু না। ভালো পরিবেশ বলতে তুমি বোঝোটা কি? তোমার হলো অসুস্থ মানসিকতার মানুষের সাথে প্রতিযোগিতায় নামার সাধ জন্মগত। বেসিক বিষয়গুলো তোমাদের কারোই জানা নেই। জানা থাকলে তোমার ভেতরও ছিঁটেফোটা আসতো! তোমার রেজাল্ট যা হোক, ইউনিভার্সিটির সর্বোচ্চ ডিগ্রিটি তুমি অর্জন করেছ, মানছি। কিন্তু তুমি একটা স্কুলেও চাকরি করার যোগ্যতা অর্জন করোনি। আর তা নিয়ে তোমার কোনো গøানিও নেই! তোমার বন্ধুদের কাছে এই বিষয়টা নিয়ে তোমার লজ্জা হয় না? নাকি স্বামীর গলায় রক্ত তোলা টাকায় বাড়ি-ফ্ল্যাট কিনে সবাইকে দেখিয়ে সেই খামতিটাই পুষিয়ে নিতে চাও?
: সমাজে থাকতে হলে সবার মতো হয়েই তো থাকতে হবে। নাকি?
: তাহলে জেনে রাখো, তোমার সমাজ আর আমার সমাজ আলাদা। ঢাকাতে আমাদের নিজেদের যেখানে বাড়ি আছে, সেখানে তোমার এত হতাশ হওয়ার কারণ কি? বাড়ি কিনে আম্মা-আব্বাকে আমি যতো কষ্ট করতে দেখেছি, ওই কষ্ট আমি করার দরকার মনে করি না! আর আব্বা চাইলে ওখানেই আধুনিক ফ্ল্যাট হতে পারে!
: তা তিনি কখনো করবেন না!
: বাড়ি তার। না করলে না-ই করুন। তবু আমি কেন গুলশানের মতো জায়গায় একটা ফ্ল্যাটের পেছনে এখনি আমার সবটুকু নিংড়ে দেবো এবং সেখানেই আমার নিয়তি ঠেকিয়ে রাখবো? আমার স্বপ্নগুলো অন্যরকম।
: তোমাদের বাড়ি থেকে আর কতটুকু পাবে তুমি? একগাদা ভাইবোন তোমরা!
: এক পরিবারের জন্য কয়টা ফ্ল্যাট লাগে? আর তুমি তো একা!
: ও, তাহলে আমার বাবার সম্পত্তির দিকে তাহলে তোমার নজর আছে!
: আমার খুব ঘেন্না হচ্ছে তোমার জন্য আমি আমার মা-বাবা ভাইবোনদের ছেড়ে আলাদা ফ্ল্যাটে চলে এসেছি। ভেবেছিলাম তুমি একা বড় হয়েছো, অনেক মানুষের হৈচৈ তোমার সবসময় ভালো লাগে না।
তাই মন খারাপ করে থাকো। আর স্বামী হিসাবে সেটুকু দেখার বা বোঝা আমি দায়িত্ব মনে করেছিলাম। তবে বড় সন্তান হিসাবে আমার যে দায় মা-বাবার প্রতি, তার থেকেও আমি সরবো না!
: তুমি আমার জন্য আসোনি! তোমার অফিস বনানী, তাই বনানীতে বাসা ভাড়া নিয়েছো।
: আমি কি আগে আমাদের বাড়ি থেকে এসে এখানে অফিস করিনি? আম্মা নিজের টাকায় আমার স্ত্রী’র জন্য বাড়িঘর নতুন করে সাজিয়েছেন, তারা নতুন বৌ নিয়ে থাকবেন বলে। তবু আমি আব্বা-আম্মাকে বুঝিয়ে তোমাকে নিয়ে চলে এসেছি।
: ঠিকাছে, ভুল করে থাকলে ফিরে যাও!
: সেটা সময়ই বলবে!
দু’রাত গুমোট কাটিয়ে তার পরদিন শিহাব অফিস থেকে ফিরে এলে দরজা খুলতে খুলতে সাহারা বললো, নদী বাসায় নেই। সুটকেস ভর্তি কাপড়চোপড় আর খুঁটে খুঁটে সব গহনা নিয়ে চলে গেছে। তোমাকে তা জানিয়ে সারাদিনের জন্য মাথা ভারী করে দিতে চাইনি! কারণ তুমি অফিস থেকে চলে আসতে আসতে ওকে ঘরে পেতে না!
নদীকে শিহাব ফোন করলে নদী লাইন কেটে দিলো। তারপর সে নদীর বাবাকে কল দিয়ে জানিয়ে দিলো, নদী তাকে না বলে চলে গেছে! শিহাব সে রাতে অফিসের পোশাক না ছেড়েই শুয়ে পড়লো। রাতে উঠে আর খায়ওনি।
তারপরের ক’দিনে নদীর মা-বাবা ক’বারই শিহাবকে ফোনে বলেছেন, হয় নদীকে তুমি নিজে এসে নিয়ে যাও, না হয় তুমি এসে আমাদের এখানে ক’দিন থাকো। এখান থেকে অফিস করবে। শিহাব বলেছে, টানা দুই বছর তো আমরা একসাথেই আছি। এখন ও ক’দিন একা আপনাদের ওখানে বেড়াতে চাইলে বেড়াক। যখন তার ফিরতে ইচ্ছে করবে, তখনি যেন ফেরে!
জামাইয়ের কাটা কাটা উত্তর নদীর মা-বাবা কারোই ভালো লাগেনি। তাই তারা ধরে নিয়েছেন, জামাইয়েরই দোষ। জামায়ের একরোখা স্বভাবের জন্য তাদের মেয়ের কোনো কথাই সংসারে মূল্য পায় না!
নদীর মা-বাবা বিষয়টি শিহাবের মা-বাবাকে জানালে তা শিহাবকে আরো বিব্রত করে তোলে। কারণ সবার অযথা প্রশ্নের কোনো উত্তর শিহাবের জানা নেই। তা ছাড়া উটকো একটি বিষয়ের জন্য অযথা মা-বাবাও কষ্ট পাচ্ছেন, সে জন্যও জীবনে এই প্রথম নিজেকে তার খুব অনর্থ মনে হয়। সে ভাবে, মানুষ কেন বিয়ে করে! একজন সঙ্গী এসে জীবনের ভারগুলোর
ভাগ নিয়ে আনন্দকে আরো বাড়িয়ে দেয়ার কথা। কিন্তু তা না হয়ে সব সময় তাকে উৎকর্ণ হয়ে থাকতে হয় কিসে স্ত্রী’র মন ভালো থাকবে। সব খারাপ অবস্থা মানে, তার যে সব পছন্দ নয় তার থেকে তাকে সরিয়ে রাখা। তার জন্যও শিহাবের কোনো দুঃখ ছিলো না! কিন্তু যে নারীর নিজেকে তৈরি করতে, কোনো কিছুর সাথে যুক্ত থাকতে, বই পড়তে বা ভালো কোনো বিষয়েই যার আগ্রহ নেই, সেই তার জন্য তার মা-বাবা, ভাইবোন ফেলে, নিজের উচ্চাকাক্সক্ষা বিসর্জন দিয়ে তার নিজেকে গার্ড হয়ে থাকতে হবে!
শিহাব ক’দিনই নদীকে বলেছে, মাস্টার্স করে কোনো মেয়ে অকর্মা বসে থাকে এটা তোমাকে ছাড়া এসময়ের কোনো নারীকে দেখিনি!
নদী ঝামটা মেরে বললো, কটা মেয়েকে তুমি দেখেছ?
আমার আফিসে প্রায় অর্ধেকই মেয়ে! এ ছাড়াও বুঝি মেয়ে দেখিনি! আর বাজার করা থেকে সংসারের সব দায়িত্বই তো সাহারা আপা পালন করেন। সেই আমাদের ছোটবেলা থেকে সাহারা আপা আমাদের সংসারের হাল ধরে ছিলেন। এর ভেতরও তিনি কতকিছু শিখেছেন। শুধু আমাদের ভালো থাকার জন্য আম্মা তাকেও আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। তার থেকেও তোমার শেখার অনেক কিছু ছিলো। এবার তুমি যা হোক, তোমার নিজের জন্যই একটা কিছুর চেষ্টা করো।
নদী ক’বার অবশ্য ইন্টারভিউ দিয়েছে কয়েক জায়গায়। কিন্তু হয়নি। দু’বার বিসিএস দিয়েছে, একবারও টেকেনি। আর কোনোটাই হয়নি বলে তার সব চেষ্টা থেমে গেছে।
শিহাব ভাবে, নদী ফিরে আসতে চাইলে তাকে একাই আসতে হবে! না হলে সেধে আনতে গেলে সেই পুরনো বিষয়ের পূনরাবৃত্তি জোরেসোরে ঘটাতে থাকবে। এই জের জীবন ভর টানা যাবে না! নীতিগর্হিত বা অর্থহীন কোনো কাজই সে কারো জন্য করবে না।
কারণ পৃথিবীতে মানুষের ভাববার ও করবার মতো অনেক মহৎ বিষয় আছে!
সাতদিন পার হয়ে গেছে নদী আসেনি। শিহাবের বাবা-মাও প্রতিদিন ফোন করে একই প্রশ্ন করছেন, ‘বউমা এসেছে? না এলে আমরা গিয়ে বুঝিয়ে আনবো কি না…।’ সব মিলিয়ে তার মানসিক চাপ হুহু করে বাড়তে থাকে।
সেদিন রাত দশটা নাগাদ শিহাবের কোঁকানোর শব্দে পাশের রুম থেকে চলে আসে সাহারা।
সে শিহাবের কপাল স্পর্শ করে আঁতকে ওঠে। সাহারা থার্মোমিটারে জ্বর মেপে সময় নষ্ট না করে, দ্রæত একটি পলি কাগজ এনে শিহাবের মাথার নিচে গুঁজে দিয়ে, ছুটে গিয়ে বালতিতে করে পানি আনে। সাহারা মগ দিয়ে
শিহাবের মাথায় পানি ঢালতে লাগলো, আর বলতে লাগলো, আরো মানুষের বউও রাগ করে চলে যায়। তাই বলে তার মান ভাঙিয়ে ফিরিয়ে আনবে না! পুরুষমানুষ একটু বেহায়া না হলে সংসারে সৌন্দর্য থাকে না!
সাহারা শিহাবের মাথায় ক্রমাগত পানি ঢালছে আর স্বগোক্তি করেই যাচ্ছে। কতক্ষণ ধরে সে পানি ঢালছে, নিজেও জানে না! কিন্তু জ্বরের ঘোরে তা শিহাবের কানে ঢুকছে না। একসময় সে পানি ঢালা বন্ধ করে মাথা মুছতে গিয়ে দেখে শিহাবের পিঠ পর্যন্ত ভিজে গেছে। পিঠের নিচে বিছানা জবজব করছে।
সাহারা শিহাবকে তুলে সোজা করে তার গেঞ্জি খুলে ঘাড়-গলাসহ বুক-পিঠের পুরো অনাবৃত অংশ সব ভেজা তোয়ালে দিয়ে মুছে দিলো। বিছানার ভেজা অংশে আরেকটা চাদর পুরু করে বিছিয়ে শিহাবকে ঠেলে ভেজা স্থান থেকে সরিয়েও দিলো। তার আগে শিহাবের গেঞ্জি পাল্টে নিজের ঘর থেকে জ্বর কমার দুটো ট্যাবলেট এনে খাইয়ে ঠিক করে শুইয়ে দিলো।
আর নিজে পাশের বেতের সোফায় বসে ঝিমোতে লাগলো। একসময় তারও ঘুম চলে আসে।
এর ভেতর শিহাব উঠে বসে হকচকিয়ে বললো, আরে সাহারা আপা, তুমি এখানে কেন?
: ও, তুমি উঠে বসতে পারছো? তোমার ভীষণ জ্বর উঠেছিলো। আমি তোমার মাথায় পানি দিয়েছি। জ্বরের ওষুধ দিয়েছি তাই তো জ্বর কমলো।
: তুমি জানলে কি করে যে আমার জ্বর? আমি তো তোমাকে ডাকিনি। অফিস থেকে এসেই অফিসের পোশাক না পাল্টে শুয়ে পড়েছি! তারপর কখন ঘুম চলে এলো টের পাইনি!
: তুমি কোঁকাচ্ছিলে, তাই শুনে ছুটে এসেছিলাম! আগে ভেবেছিলাম অফিস থেকে এসে তুমি একাই খাবার নিয়ে খেয়েছো। আজ হয়েছে কি, পাশের ফ্ল্যাটের ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া এক ছেলে পুরনো খবরের কাগজের সাথে নতুন একখানা বিষাদসিন্ধু বিক্রি করে দিচ্ছিলো।
আমি তাকে বইটা বিক্রি করতে নিষেধ করতেই সে বললো, সময় খরচ করে মিথ্যে কাহিনী পড়বার সময় আমাদের নেই। আধুনিক বই রাখারই জায়গা নেই সেলফে। আর ঐতিহাসিক কোনো বিষয়ে এত খাঁদ থাকলে তা না পড়াই ভালো। আমরা তো আর লেখক নই, যে কে কি লিখলেন, চেখে দেখতে হবে। আপনাদের সময় ছিলো আপনারা পড়েছেন। কেঁদেছেন।
পারলে আরো কাঁদুন। আপনি নিয়ে যান এটা…।’ শেষে আমি কিনে আনতে চাইলে ওরা আমাকে বইটা এমনি দিলো। জোর করলেও টাকা নিলো না!
: বাহ্, বেশ খাতির করেছে তো তোমাকে!
: এটা আমি দ্বিতীয়বার পড়ছি, কিন্তু ওদের কথা শুনে এবার আর কান্না আসছে না। শুকনো চোখেই পড়তে পারছি। ও তুমি তো পড়োনি বুঝবে না ওর ভেতর কতটা কল্পনা-আবেগ-দরদ মেলানো।
: জানি!
: না পড়ে কী করে জানো?
: আমি পড়িনি তা যেমন করে তুমি জানো!
: শোনো দেখি কথা! আমার সামনে দিয়েই তো তোমরা বড় হলে। কখন কী দেখলে, পড়লে এসব নিয়ে তোমরা খাবার টেবিলে হৈচৈ তুলে সবাই আলাপ করতে। মামাও তখন তোমাদের মতো একজন হয়ে যেতেন। আমার এখনো সব মনে আছে। কিন্তু বিষাদসিন্ধু নিয়ে তোমরা কোনদিন কথা বলোনি!
: শোনো, আসল কাহিনী তো এমনি পড়ে জানতে হয়। তাই জানি। কিন্তু বিষাদসিন্ধুতে কল্পনার রং কতখানি, আরো কী আছে, তা আমার দাদা-দাদি এতো বেশি বলতেন, তারা ওটাকে আরেকখানা ধর্মগ্রন্থই মনে করতেন। এমনও দেখেছি, দাদাভাই পড়ছেন দাদি শুনছেন। আবার অন্য সময়ে দাদি পড়ছেন, দাদা শুনছেন। আর তাদের পাশে একে একে যেই এসে দাঁড়াতো, সেও গালে হাত দিয়ে বসে পড়তো। তাই বাড়িতে যাওয়ার পর তাদের আশপাশে থেকে অন্য আরো অনেকের মতো শুনেই আমার পড়ার অধিক হয়ে গেছে! আর তা শুধু বিষাদসিন্ধুই নয়। তাঁর আমলের অনেক বই। আনোয়ারা, মনোয়ারা, আছিয়া। ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ও দাদাভাকে পড়তে শুনেছি। এখনো মনে পড়ে হাসি পায়, দাদাভাই জোরে জোরে বই পড়তেন।
: তোমার দাদা ঢাকায় এলে তোমাদের স্কুলের পুরনো বইও বোঝা বেঁধে নিয়ে যেতো বাড়িতে নিয়ে পড়তে। মনে আছে? এইটা নিয়ে আমারা কতো হেসেছি!
: দাদা বলতেন, ছোটবেলা তো আমিও ফাঁকি দিয়েছি সব না পড়ে। তাই তোমাদের বই পড়ে পুরনো বিদ্যা ঝালাই করি আর দেখি, তোমাদের সময় এসে তোমরা কী শিখছো! তোমাদের জন্য কী লেখা হয়েছে। আমার দাদাই কিন্তু আমাকে কবিতা আবৃত্তি করতে উৎসাহিত করেছেন। আর আমি তাকে পুথি পড়তে শিখিয়েছি! উল্টো না বিষয়টা?
: আসলে তোমাদের সবার ভেতরের এই বন্ধনটুকু আমার খুব ভালোলাগে! স্বপ্ন দেখতাম আমার পরিবারটিও আমি এভাবে গড়বো! তোমার দাদা-দাদির, মা-বাবারও সম্পর্কের যে রসায়ন, তোমাদেরও তেমনটি হলে ভালো লাগতো। যাকগে, ভাসা ভাসা শোনা আর পড়ার ভেতর বিস্তর ফারাক। বুঝেছো! সিনেমা দেখতে গেলে যখন কাহিনীটা চেনা মনে হয়, আর যখন মনে পড়ে যায়, এটা ওই বইয়ের কাহিনী, তখনি কেবল বোঝা যায়, বইয়ের পটভ‚মির বিস্তৃতি থেকে পরিচালক খুব বেশি দৃশ্যমান করতে পারেননি। আর যে সিনেমার বই তুমি আগে পড়োনি, তাতে তুমি যেটুকু দেখবে, তার বেশি ভাবতে পারবে না! মানে মনে হবে না, কিছু বাদ গেলো।
শিহাব নিজের দিকে তাকিয়ে বললো, এমা, সাহারা আপা, তুমি আমার গেঞ্জিও পাল্টে দিয়েছ? আমি কিন্তু এখন লজ্জা পাচ্ছি।
: শুধু গেঞ্জি পাল্টেছি? গা-মাথা মোছাইনি? আমি ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু ওই জ্বর না নামালে কী হতো বলো তো! কিন্তু জ্বরটা বাঁধালে কী করে?
: আসলে প্রতিদিনের একটু একটু মানসিক চাপ এখন আমার মগজে প্রচÐ ধাক্কা দিয়েছে। অফিসের কাজ-কর্মেও ভুল হয়ে যাচ্ছে। একসাথে ঘর করা দু’জন মানুষের যদি প্রতিটি বিষয় নিয়ে মতে অমিল থাকে, কতদিন তা হজম করা যায়! প্রাইভেট ব্যাংকে চাকুরি। সব ঠিক মতো করতে না পারলে যখন তখন খালি হাতে বেরিয়ে আসতে হবে। নদীর বাবার তো নিজের ব্যবসা। এজন্য এসব বোঝে না। আমি বাড়ির বড় ছেলে। নিজের বিষয় দিয়ে মা-বাবাকে ভারাক্রান্ত যেমন করতে পারি না, দূরে থাকলেও পরিবারের প্রতি দায়িত্বও আমি এড়াতে পারি না। আমার হেল্প তাদের লাগুক আর না লাগুক। এসব তো নদীকে বুঝতে হবে!
: তোমার অফিসে ওকে একটা চাকরি দাও!
: চাকরি দেবো মানে? ব্যাংক কি আমার নাকি? আব্বাই তো আমাদের ব্যাঙ্কের জিএম ছিলেন তা তো জানোই। কিন্তু আমি কখনো তার পরিচয় কাজে লাগাই না! আব্বাও কাউকে কোনদিন সুপারিশ করতে পছন্দ করেন না!
: তুমি তোমার বাবার পরিচয় কাজে না লাগাও। তবু তুমি নিজে ম্যানেজার পদে যখন আছো…।
: ম্যানেজার পদটা খুব বড় নয় বুঝলে সাহারা আপা! তুমি ববং ওকে বলো চাকরির জন্য লেখাপড়া করতে আর সেই সাথে বাচ্চা নিতে!
যদিও তার দিকে আমি বহুদিন ফিরতে পারি না। তবু যদি সে আমার সাথে টিকে থাকতে চায়। আচ্ছা বলো তো, কতজন চাকরি ছেড়ে দিয়েও নিজের মতো কতো কিছু করে। ও তো তোমাকে নিয়ে একটা বুটিক হাউস করার কথা ভাবতে পারতো! নিজে পরিশ্রম করলে অন্যের শ্রমের মূল্য বোঝা যায়! ও আম্মার থেকেও কিছু নিতে পারেনি। তোমার থেকেও না!
শিহাবের নদীর দিকে না ফিরতে পারার কথায় সাহারা বেশ লজ্জা পেয়ে গেল। সে প্রসঙ্গ পাল্টাতে দ্রæত বলল: আমার কথা বরদাস্ত করবে কেন? তোমরা যেভাবে আমাকে দেখো, ও আমাকে সেভাবে দেখে না! আমি যে রোজ ইস্ত্রি করা কাপড় পরি, এটা নিয়ে তার মা’র সাথে তাকে আমি আলোচনা করতে শুনেছি। সারাদিন যার সাথেই কথা বলে, তার অনেকটা সময়জুড়ে আমার কথাই থাকে। যা আমার জন্য খুবই অস্বস্তিকর। আসলে ব্যক্তিগত দুঃখ আমাকে দগ্ধ করলেও, নিজের মানুষদের ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হলেও, তোমাদের উছিলায় অন্য মানুষের ভালবাসা-প্রশংসা আমি এতো পেয়েছি, যে তোমাদের যে কারো জন্য এটুকু ছাড় আমি দিতেই পারি! তাই এখানে আসার পর থেকে প্রতি মুহূর্তে ঢোক গিলি। এটা তোমাকে অন্তত কখনো বলতাম না তুমি কথা না তুললে।
: বলো কি? তোমার কথা বরদাস্ত করবে না মানে? আমরা তোমাকে মান্য করি! আমাদের পরিবারে যে কোনো সিদ্ধান্তে তোমাকেও কথা বলতে দেখেছি। আমাদের অমন বাঘের মতো রাগী বাবাও তো তার জন্য তখন তোমাকে থামিয়ে দেননি! মা’র জন্য বাবা কিছু আনলে মাকে দেখেছি সব সময় তোমাকে তার থেকে ভাগ দিয়েছে। অচেনা মানুষের সাথে পরিচয় করাতে বাবা বলেন, আমার বোনের মেয়ে। আমরা ভাইবোনেরাও তোমাকে সেভাবেই জানি!
: হ্যাঁ কখনো তো আমাকে কিছু চাইতে হয়নি তাদের কাছে। আমার মেয়ের বিয়ের সময় মামা দুই ভরি সোনার হার দিলেন মামা। ছেলেকে মোটর সাইকেল, বউকে কানের দুল কিনে দিলেন। শেষ বয়সে যেন আমাকে নিঃসম্বল থাকতে না হয়, তার জন্য মামীই প্রতিমাসে আমার নামে ব্যাংকে টাকা রাখেন। অথচ আমি বেতন নিলে তা আর ক’টাকা হতো! আর টাকার কথা আমার কখনো মনেই আসেনি! নিজেকে তোমাদের পরিবারের একজন ভাবতে পারি, এটার মূল্য অপরিসীম। এর বাইরে আমি কিছু না!
: তুমিও আমাদের সবার জন্য অনেক করেছ। মা তোমাকে দিয়ে কখনো ঘর মোছা, থালাবাসন ধোয়ার কাজ করাননি। অথচ তুমি এখানে একা সব করছ!
: এখন সময় পাল্টে গেছে। জীবন যখন যেমন। ছোট্ট একটা সংসারে আরেকটা কাউকে ঢোকালে আরো সমস্যা। তোমরা সবাই আমার আন্তরিকতাটুকু বোঝো বলেই বোধহয় দুই যুগের বেশি তোমাদের সাথে পার করে দিলাম! যাকগে, নদীকে কাল গিয়ে নিয়ে এসো!
: তুমি তো জানো, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হিসেব করে চলা আমার মা-বাবা আমাদের কীভাবে মানুষ করেছেন। এখন একজন জীবনের সাথে জড়িয়েছে বলে তার ইচ্ছে মতো আমাকে আমূল বদলে যেতে হবে, যে বদলে বিবেক ও মনুষ্যত্বের কোনো উৎকর্ষই নেই! তাহলে পরিবার থেকে এতদিন কী শিখলাম?
: কিছুটা তো বদলাতে হবে!
: সেটুকু আমি বদলেছি সাহারা আপা! তার মতামতের দাম দিতে গিয়েই আমার বেতনের অর্ধেক টাকা বাসা ভাড়া দিতে হচ্ছে। অথচ রামপুরা গলির ভেতর পুরনো আমলের বাড়ি হলেও আমাদের মতো মানুষেরা সবাই সেখানে থাকছে না, বলো?
: ঢাকার যেখানেই হোক, একটা বাড়ি থাকাই সৌভগ্যের। আমার কাছে তো সেখানেই ভালো লাগতো। গুলশান গিয়ে তারাই উঁচুশ্রেণির হতে চায়, যাদের নিজের কোনো সমাজ নেই। সমাজের সাথে সংযুক্ত থাকার যোগসূত্র নেই। সত্যিই এখানেও আমার বড় একা লাগে। মানুষের সাথে না মিশলে অবচেতনে মানুষের চেতনা মরে আসে। একটা উঠোন দীর্ঘদিন না ঝাড়ু দিলে চারপাশ থেকে আগাছা যেমন তার পরিধি কমিয়ে আনে।
: দেখো, সেই তুমিও কিন্তু আমাদের জন্য এভাবে ত্যাগ স্বীকার করছো। নদী রান্নাবান্না করতে পছন্দ করে না বলে আম্মা তোমাকে আমাদের কাছে পরে পাঠালেন! তুমিও আসতে আপত্তি করোনি! কিন্তু আম্মার কথা ভাবো, এখন কী কষ্ট করছেন! কিন্তু ও আব্বা-আম্মাকেও সম্মান দিয়ে কথা বলে না।
নিজের দুর্ভাগ্যের কথা মনে হয়ে সাহারার মন খারাপ হতে থাকে। বিয়ের চার বছরের ভেতর দুটো ছেলে হওয়ার পর হঠাৎই তার স্বামী আরেকটা বিয়ে করে আনে। তারপর শ্বশুর-শাশুড়ির বারণ সত্তে¡ও তখনি সে ছেলেমেয়ে দুটি নিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসে। কিন্তু তার নিজের বাবা-মা না থাকায়, একসময় সে ছেলেমেয়ে দুটিকে আবার তাদের বাবার কাছে ফিরিয়ে দেয়। তারা সেখানেই বড় হয়, লেখাপড়া শেখে। বিয়ে করে তারাও এখন দুজনই যে যার মতো সংসার করছে। সাহারার ছোটবেলাতেই তার মা-বাবা মারা গিয়েছিলো। দুটি বড় দুটি ভাই থাকলেও ভাই ও ভাইয়ের বউদের মুখ ঝামটা থেকে বাঁচতে কাঁচা বয়সেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থা নিয়ে যখন শিহাবদের সংসারে এসে ওঠে, তখন শিহাবের বয়স ছয়-সাত হবে। শিহাবের বয়স এখন বত্রিশ। সাহারাও বয়স পঞ্চাশ পার হয়ে গেছে দু’তিন বছর আগে।
পুরনো কাসুন্দির মতো নিজের অতীত স্মৃতি ঘাটতে ঘাটতে ঘড়িতে চোখ পড়ে সাহারা বললো এবার ঘুমাও। আবার শরীর খারাপ লাগলে ডেকো! বা ফোন করো। আমি জেগে থাকবো।
সাহারা শিহাবের রুমের বাতি নিভিয়ে ডিমলাইট জ্বালিয়ে বেরিয়ে গেলো। বাইরে থেকে দরজা টেনে বন্ধ করতেই শিহাব ডেকে উঠলো, সাহারা আপা!
সাহারা আধো-আলোতে ফিরে এসে শিহাবের পাশে দাঁড়ালো। বললো, বলো?
শিহাব মুখ তুলে সাহারার দিকে চেয়ে থাকে। কিন্তু ওইটুকু আলোতে সে শিহাবের চোখের ভাষা বোঝে না! সাহারা বলে, কিছু খাবে? দুধ গরম করে আনি? এতক্ষণে সাহারার মনে পড়লো, শিহাব কিছু খায়নি। শিহাবের অসম্মতি সত্তে¡ও সে দুধ পাউরুটি এনে শিহাবকে জোর করে খাওয়ালো। ডিম লাইটের অলোতেই খেতে খেতে শিহাব বললো: তোমার মনে আছে, তখন আমি ক্লাস টেনে পড়ি। একবার আমি বন্ধুদের সাথে বেড়াতে গিয়ে স্কুল কামাই করেছিলাম এবং অনেক রাতে বাড়ি ফিরেছিলাম বলে আব্বা আমাকে ঘরে ঢুকতে দেননি। তারপর কি হয়েছিলো মনে আছে তোমার?
শিহাবের কথায় সাহারারও পুরনো দিনের স্মৃতি মনে পড়ে যায়। সেদিন সন্ধ্যা থেকে টিপটিপ বৃষ্টি আর খুব শীত ছিলো। তার ওপর মাঘমাস। বৃষ্টি বেগে আসতেই শিহাব বাড়ি ঢুকতে গেটে নক করেছিলো। আর মামা একটা বেত নিয়ে ছুটে গিয়ে শিহাবকে শাসিয়ে বাইরে রেখেই আবার গেট বন্ধ করে দিয়েছিলেন। অল্পক্ষণের ভেতর সাহারা মামার সতর্ক দৃষ্টি বাঁচিয়ে পিছনের দরজা খুলে চুপিচুপি গেটের বাইরে থেকে শিহাবকে ছোঁ দেয়ার মতো টেনে নিয়ে নিজের ঘরে থাকতে দিয়েছিলো।
শীতের তীব্রতায় দু’জনের কারোই লেপের বাইরে থাকার উপায় ছিল না। তারপর ওরা দু’জন সারারাত ওই একজনের লেপের নিচে ছিলো।
এত বছর পর শিহাবের আচমকা তোলা প্রসঙ্গে সাহারাকে কি এক আচ্ছন্নতায় পেয়ে বসলো। তার সারা শরীরের ভেতর তিরতির করে একটা হারিয়ে যাওয়া নদী প্রবলভাবে জেগে ওঠে। সাহারা নিজের অজান্তে আবেশ জড়ানো কণ্ঠে শিহাবকে পাল্টা প্রশ্ন করলো-
: এখনো তোমার সবকিছু মনে আছে?
: সে সব ভোলা যায়? সেদিন তোমার একার বিছানার ভাগ নিয়ে আমি ঝড়জলে ভেজা শরীরে তোমার সমস্ত উষ্ণতা শুষে নিতে উদ্যত হলাম। কিন্তু তুমিও তো আমাকে উদ্ধার করতে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছিলে। শাড়ি পাল্টে এলেও শরীরের ভেজাভাব তখনো ছিলো। আমার ঘর থকে একটা জামা, একটা প্যান্ট তুমি খুব সাবধানে আব্বার নজর বাঁচিয়ে এনেছিলে। আব্বা তখনো বারান্দায় পায়চারি করে পাহারা দিচ্ছিলেন আমি যেন ঢুকতে না পারি! এখন ভেবে দেখো, একজন পিতার তার সন্তানের প্রতি কি ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা?
: সত্যিই ওটা মামার মারাত্মক নিষ্ঠুরতা ছিলো। আমি লুকিয়ে না নিয়ে এলে সে রাতে কি যে হতো! কোথাও যাওয়ারও তো তখন জায়গা ছিলো না!
: শীতে সমানভাবে আমরা সে রাতে একসাথে তোমার লেপের নিচে কাঁপছিলাম। কিন্তু আমি যখন তোমার বুকে মুখ গুঁজে দিয়েছিলাম, তুমি কিন্তু আমাকে নিবৃত্ত করোনি। বরং নিজেকে সমর্পণ করেছিলে!
: ক্ষুধার্ত বাঘিনীর কাছে হরিণ এলে বাঘিনী কি তাকে ফিরে যেতে দিতে পারে?
: তুমি বিশ্বাস করো, স্ত্রী’র বাইরেও বিয়ের আগে আমার জীবনে তোমাকে ছাড়া আরো দু’জন নারী এসেছে। তারা অনেক শিক্ষিত। সুন্দরী। দু’জনের সাথেই ঠিক সেই ঝড়-জলের শীতের রাতের মতো তেমনি স্বেচ্ছায়, স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে আমাদের দৈহিক সম্পর্ক হয়েছে। কিন্তু সেই রাতের মতো ভয়ঙ্কর মধুর প্রশান্তি আমাকে কেউ দিতে পারেনি এবং আমার কী হয় জানো?
বোঁজা কন্ঠে সাহারা জানতে চায় : কী?
: ওমন স্তন আর কারো নয়! … ওইসব মুহূর্তে আমার নারীদের মুখে আমি তোমার মুখ কল্পনা করেছি! যদিও কোনোদিন তোমাকে তা বলা হয়নি!
: না বলে ভালো করেছো! তাহলে তো আর এখানে থাকা হতো না!
: কিন্তু তখন তো তুমি চলে যাওনি!
: তখন বিষয়টি অনারোপিত ছিলো। যেভাবে ঘটেছে আমার নিজেকে অসম্মানীত মনে হয়নি!
: সত্যি বলতে কি, নর’র বিপরীতে নারীর যে সংজ্ঞা, তা আমি তোমার ভেতর সবটুকুই দেখি! পারবো না বলে তোমাকে কখনো কোনো কাজ থেকে পিছিয়ে আসতে দেখিনি। তুমি কিছুই করছো না এমন শূন্য প্রহর আমি তোমার কখনো দেখিনি!
: কারো দেখা শূন্য প্রহরও যে কারো কত যে পূর্ণ-ভরাট হতে পারে, জীবন আমাকে সে ঐশ্বর্য দিলো কই, যে শূন্যতার ভিন্ন মানে বুঝবো? আর তুমি যে সব কাজে ব্যস্ত দেখো, তার মূল্যই বা কতটুকু!
: সাহারা আপা, তুমি আর বিয়ে করলে না কেন?
: সেই কাঁচা বয়সে মনে হতো, যার কাছে সমস্ত লজ্জা-দ্বিধা বিসর্জন দিয়ে শরীরটাকে সমর্পন করবো তার সাথে মিলনের সময় ঘন হয়ে আসা নিঃশ্বাসের শব্দ আমি ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ শুনতে পারবে না। তার শরীরের স্পন্দন, গোপনীয়তার সমস্ত ভাষা আমি ছাড়া আর কেউই জানবে না! আর সেই পুরুষই যখন আমাকে অবজ্ঞা করে আরেকজনকে ঘরে এনে তার সাথেও যা করবে, আমার সাথেও ফিরে এসে তাই করবে। আর আমি আবার তাই তাকে করতে দেবো, এ যেন গøাসে তুলে বানের জল খাওয়া! শরীরটাকে আমার কাছে মন্দিরের মতো মনে হয়, জানো! যে তার নিজের মতো করে কোনো পরম পুরুষের জন্যই আপনা থেকে পোড়ে! মানুষের অতৃপ্তি কখনো তাকে ছেড়ে যায় না! না হলে আমিই বা কেন আজো তেমন কারো স্বপ্ন দেখি, সে আসবেই, শরীর এবং মন একসাথে যাকে চায়!
: আমাকেও কি তোমার রোগে পেয়ে বসলো?
: তোমার কথা বলতে পারবো না। তবে নারীর হৃদয় তার ভালবাসার পুরুষের জন্য চাতক হয়ে থাকে। চাতক যেমন বৃষ্টির জল ছাড়া আর কিছু খায় না!
: ক’জন নারীকে তুমি জানো!
: আমি না হয় আমার কথাই বললাম! জানো, রুমুর সাথে যখন শুটিংস্পটে যেতাম, একদিন এক সহশিল্পীর আসতে দেরি হচ্ছে দেখে পরিচালক তাকে ফোনে খুব বকছিলেন। পথেই ছিলেন তিনি। জ্যামে আটকে ছিলেন। হঠাৎ তারপর আমার দিকে নজর পড়ে পরিচালক বললেন, ‘আপনাকে দিয়েও হবে ওই চরিত্রটা। আপনি পারবেন। না হয় সংলাপ-দৃশ্য সংক্ষিপ্ত করে ফেলবো।’ আমি লুফে নিলাম প্রস্তাবটা। তিনি তখনি ক্যামেরার সামনে আমার টেস্ট নিলেন। সন্তষ্টও হলেন। সবাই হাততালি দিলো। রুমু তো জড়িয়েই ধরলো আমাকে। বললো, ‘একবাড়িতে দু’জন অভিনেত্রী!’ কিন্তু ঠিক তোমার বয়সী মেকাপম্যান আমাকে মেকাপ করাতে গিয়ে বøাউজের গলা পেরিয়ে যেখানে দরকার নেই সেখানেও সে মেকাপের উছিলায় হাত ঢুকিয়ে দিলো এবং ওইটুকু স্পর্শ’র ভাষাই বলছিলো, বিষয়টা উদ্দেশ্য প্রণোদিত। মনটা এত খারাপ হলো, যে উদ্দীপনাটা নষ্ট হয়ে গেলো। দ্বিতীয়বার ক্যামেরা অন করার পরে আমার কাজটা উত্তীর্ণ হতে পারলো না।
রুমু শিহাবের পিঠাপিঠি ছোটবোন। সে একজন পেশাদার অভিনয় শিল্পী। সে নাটকে অভিনয় শুরু করলে সাহারাই তার সাথে যেতো। নাহলে তাদের মা’র স্কুল বন্ধ থাকলে মা সাথে যেতেন।
সাহারার কথা শেষ হতে নিজের অজান্তে বিস্মিত চোখ তুলে শিহাব বললো : তাহলে রুমুর সাথেও ওই একইরকম আচরণ করে?
: আমি তা জানি না। আমার সাথে যা ঘটেছে, আমি তাও রুমুকে কখনো বলিনি!
: তুমি এতো দেখেও কি আজো পুরনো ধারণায় বন্দি আছো?
: সেই পুরনো ধারণা নিয়ে না থাকলে তো এমন উদ্দেশ্যহীন জীবন যাপন করতাম না। সাধারণ একটা বিয়ে করে ঘরকন্না শুরু করতাম। মানুষ যাকে বলে নিজের ঘর! জানো, কতবার ভেবেছি, আবার বিয়ে করবো। বিশেষ করে রাতগুলো বড় দুঃসহ ঠেকে। কিন্তু কেউ তো আমার জন্য এই বয়সে কুমার অবস্থায় নেই। সেই হয়ত কারো স্ত্রী মরে গেছে। না হয় ছাড়াছাড়ি হয়েছে। ওরকম বিয়ে আসলে একঘরে বসবাস করেও কেউ কারো নয়!
: বিয়ে হয়নি তুমি সেরকম কাউকেই দেখতে!
: শুধু বিয়ে হয়নি সেরকম হলেও তাকে আমার জানতে হবে তো! সেটা সম্ভব যদি আমার সাথে তেমন কারো সাথে পরিচয় হতো। কিন্তু তেমনটি হয়নি তো! সবাই সবকিছু পারে না। যা আমিও পারিনি। তুমি ভেবে দেখো, আমি কিন্তু শুদ্ধর বাবার সাথে স্কুল থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিলাম। আমি তখন এইটে পড়ি।
: হ্যাঁ জানি তো! গ্রামে গেলে কেউ কেউ বলতো, সাহারা আর তাহেরের প্রেম লাইলী-মজনুকেও হার মানিয়েছে! সেই প্রেম ভুলে তাহের ভাই আবার যাকে বিয়ে করলো, নারীটি সব নিয়ে খুব শিক্ষা দিয়ে গেছে। এরপর তাহের ভাই তোমাকে নিতে চায়নি কেন?
: নিতে না চাওয়ার মতো সেইটুকু ভয় তার আছে বলেই তাকে আমার লিখিতভাবে ছাড়া হয়নি!
সাহারার কথায় শিহাব উচ্চস্বরে হেসে বললো: তবে তুমি মা’র সাথে পাল্লা দিয়ে যতো বই পড়েছো, তুমি কিন্তু এখন আর এইটের ছাত্রীটি নেই সাহারা আপা! অতএব তাহের ভাইয়ের থেকেও তোমার যোগ্য কারো দরকার। না, বলছিলাম কি, যদি কখনো ফেরো, তাই বলা!
: কিছু যোগ্যতা তো তাহেরের আমার থেকে বেশিই ছিলো। আর তখন তো আমার কোনো যোগ্যতাই ছিলো না! পাড়ার ছেলেরা যখন নাটক করতো, বরাবর নায়কের চরিত্রটা তাহেরকেই করতে দেয়া হতো। আর সেটাই বুঝি আমার কাল হয়েছিলো। অনেক মেয়েরই তার দিকে নজর ছিলো। কিন্তু তার নজর ছিলো আমার দিকে। বিয়ের পর আমি লেখাপড়া না করলেও সে তো ডিগ্রী পাশ করেছিলো। জানো, দুইপক্ষের কেউই তখন আমাদের বিয়ে মানেনি। অনেক চড়াই উৎরাইয়ে ভেতর দিয়ে যখন থিতু হলাম। ছেলেমেয়ের মা হলাম, সবাই মানতেও বাধ্য হলো, শ্বশুরের টাকা এবং আমার ভাইয়েরাও আমার যেটুকু পাওনা ছিলো, বাবার সম্পত্তির, তারা তার ন্যায্য মূল্য দিয়েছিলো। ঠকায়নি। সব মিলিয়ে তাহের বাজারে একটা শাড়ির দোকান দিলো। কর্মচারিই চালাতো। চলছিলও ভালো। আর ঠিক তখনি আমাকে ঘর ছাড়তে হলো। বুক থেকে সন্তান ছাড়তে হলো।
: তুমি তোমার টাকাগুলো চেয়ে নিয়ে আসতে!
: তুমি ব্যাংকার মানুষ তো। টাকার হিসাব বোঝো। অভিমান-ক্ষোভ এগুলোর মূল্য বোধহয় বোঝো না! টাকা চাওয়ার মতো সময় ওখানে ক্ষেপণ করতে হলে তো মুড়ো ঝাটার মতো আরো ক’দিন তার সাথে বাহাস করতে হতো। অন্তত তাকে এটুকু তো দেখাতে পারলাম, আমার আত্মসম্মানে আঘাত লাগলে সব ছাড়তে পারি! যেখানে আমি বুক থেকে দুধের সন্তান ছেড়ে দিয়ে আসছি! যা হোক, তখন মামী তোমাদের নিয়ে দেশে বেড়াতে গিয়েছিলেন। আমার উ™£ান্ত অবস্থা দেখে এবং সব শুনে আমাদের বাড়িতে গিয়ে আমাকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। তারপর সেবারই ঢাকায় নিয়ে এলেন। তখন আমার মন ভালো রাখার জন্য মামী কতো কি করতেন! যে গল্পটা পড়ে তার ভালো লাগতো, মামী সেটাই আমাকে পড়তে বলতেন। তারপর ধীরে ধীরে আমি তোমাদের একজন হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছি শুধু।
: তাহের ভাইয়ের বিরুদ্ধে তুমি আইনি ব্যবস্থা নিলে না কেন তখন?
: তাতে কী হতো? তাহেরের তিনমাস জেল হতো। বিয়েটা তো বাতিল হতো না! আরো পোক্ত হতো। আর ছেলেমেয়েদের আমি ছেড়েছিলাম ওদের দাদা-দাদির ভরসায়। তারা নিশ্চয় নিজের উত্তরসূরীর যতœ করবেন ভেবে। কারণ তাহের তাদের একমাত্র সন্তান। তাই তারা তা করেছেনও! না হলে দু’জন লেখাপড়া শিখতে পারতো না। এতো ভালো বিয়েও হতো না। আর আমি তাদের কোথায়ই বা রাখতাম, বলো তো?
: এটাও তোমার একটা বড় ত্যাগ। তুমি মাতৃস্নেহে অন্ধ হয়ে যাওনি। তুমি এখন চাইলে সন্তানদের কাছে ফিরতে পারো না?
: যাদেরকে আমি নিজে ধরে রাখতে পারিনি, যাদের মানুষ করার পিছনে আমার কোনো ভ‚মিকা নেই, তাদের কাছে আশ্রয় চাই কোন মুখে! এমনিতে ওরা এলে তো দেখা হয়ই। তারওপর তোমার মা যে আদর-যতœ করেন। এটা ওটা হাতে তুলে দেন। সেটুকুই আমার যথেষ্ট!
: কিন্তু তুমি তাদেরকে পেটে ধরেছো, তাদের কাছে সেই দাবি তোমার আছে!
: কোনো কোনো মানুষের তাদের আপনজনদের ভেতরে বেঁচে থাকার চেয়ে, তাদের দেয়ালে ছবি হয়ে ঝুলে থাকা মর্যাদার।
সাহারার এই কথার পরে শিহাব গম্ভীর হয়ে যায়। সে বলে : তাই বুঝি কাদম্বরী দেবী মরে গিয়ে তার ঠাকুরপো’র কাছে নিজের মর্যাদা রক্ষা করেছিলেন!
: তা ছাড়া আর কি! আর আমিও তো ছেলেমেয়ে পেটে ধরার জন্য ওদের বাবার সাথে ঘর পালাইনি! ঘর তো পালিয়েছিলাম নিজের তাড়নায়!
: চমৎকার কথা বলেছো। তবে একটা সাধ তোমার পুরোই মিটেছে!
: কী?
: ওই যে অনিশ্চিত কারো হাত ধরে ঘর পালানো! তবে ছেলেমেয়ের বিষয়ে বেশিরভাগ মানুষই যা বোঝেন না, তুমি তা বুঝেছো!
: কী, বলো তো?
: সবাই জন্ম দেয়ার সুবাদেই সন্তানকে মনে করে নিজস্ব সম্পত্তি! তুমি তা মনে করোনি।
: যাই আমি। তুমি শুয়ে পড়ো’ বলে সাহারা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়। শিহাব এক ঝটকায় খাট থেকে নেমে সাহারার পথ আটকায়। বলে সেই ঝড়-জলের রাতের মতো আজ আরেকটি বার আমাকে তোমার বুকে আশ্রয় দাও!
সাহারা শান্ত, নিরুদ্বেগ কণ্ঠে বললো: সেই ঝড়জলের রাতে তোমার সত্যিকার আশ্রয় দরকার ছিলো। কিন্তু আজ যদি তেমন কিছু হয়, সেটা হবে সুযোগ নেয়া এবং দু’জনেরই সুযোগ নেয়া হবে। আমি তো এই বয়সে এসে আমার নারীসত্তাকে লাঞ্ছিত করতে দিতে পারি না!
সাহারার এই কথায় শিহাব সমস্ত শরীর ঝাড়া দিয়ে একটু পিছিয়ে যায়। বলে ওঠে, ‘না! তুমি অত নীচ আমাকে ভেবো না! নদী তো এমনি কতবার এক দু’রাত করে তার বাবার বাড়ি গিয়ে থেকেছে। আমি কখনো তোমাকে বলেছি এসব কথা? আমার বিবেক কখনো সে সায় দেয়নি। আমি মানুষ হিসাবে তেমনটি হলে বোধহয় নদীর সাথে আমার সুখেই সংসার করা হতো!
: তাহলে আজই বা আমাকে কেন বলছো?!
: আসলে পরিস্থিতিই আজ তৈরি হয়েছে এই কথা বলার জন্য। আমার মনে হয়েছিলো আমি আমার পৌরুষ হারিয়েছি! নিজেকে আমি কিছুতেই নদীর দিকে ফেরাতে পারছিলাম না। কিন্তু আজ আমি শুধু তোমার স্পর্শে আবার জেগেছি! আমার বোধহয় আবার জ্বর আসছে…। আমি শুয়ে পড়ি। তুমি অন্তত আমার কাছে বসে থাকো!
: তা থাকতে পারি। আমি এখানে সোফায় বসি। তুমি শুয়ে থাকো!
সোবেহসাদিকের আলো ক্রমে প্রস্ফুটিত হতে হতে সাহারা শিহাব নিজেদের আবিষ্কার করে একজনের উন্মত্ত শরীরের নিচে আরেকজনের উন্মত্ত অবস্থান। শিহাব ভুলে যায় তার শরীরের নিচে কে পিষ্ট হচ্ছে। যেন নদী নয়, ইলোরা নয়, মুনমুন নয়, সে সেই বালকবেলার শুধু পুরনো এক স্বাদ খুঁজে আরো অতলে নামতে চাইছে আর শীৎকারে শীৎকারে আরো শিহরিত করছে ভাটার টানধরা সাহারার বুভুক্ষ শরীর । যা সে এ যাবৎ কখনো কারো সাথে কোনো মিলনে করেনি!
পুরুষ্ট বুকের দু’পাশের বোঁটা দু’টি গড়িয়ে ওষ্টসুধায় ভরে যায় সাহারার পুরো স্তন। সাহারা নিজেই টের পায়, তার শিথিল স্তন যুগলের টানটান হয়ে ওঠা ভাব। সেই স্কুলের শেষের ক্লাসে পড়া শিহাবকে সে অত বছর আগে সেদিন এতটা আঁকড়ে ধরেনি, যেভাবে ধরেছে আজ। কারণ তখন একটা ক্ষীণ ভয়ও কাঁটার মতো বিঁধছিল। যদি সে কনসিভ করে! তার ওপর ছিলো শিহাবের বালক বয়স। কিন্তু আজ সাহারা নির্ভয় এবং পুরুষ হিসাবে আজকের শিহাব চৌধুরী যে কোনো নারীর স্বপ্নের পুরুষ। সাহারা বোঝে, তখন দুই সন্তানের মা হলেও পূর্ণ তারুণ্য আসার আগেই সে স্বামীকে ছেড়ে এসেছে। অতএব যৌবনের এইরকম পরিপূর্ণ স্বাদ আগে তার কখনো পাওয়া হয়নি। এখন তার পিপাসা আগের চেয়ে আরো গাঢ় হয়েছে। তারও চেয়ে বড় কথা ফুরিয়ে যে সে যায়নি, এই ধারণা তাকে মানসিক প্রশান্তি যুক্ত করে দেয় দৈহিক আনন্দের সাথে। এতোদিনের ফল্গু হয়ে থাকা আনন্দোৎস ভেতর ঝর্নার মতো বইতে থাকে।
মেরুণ রঙের ভারী পর্দা ভেদ করে নদী ও শিহাবের শয়নরুমের ভেতরে কখনো আলো প্রবেশ করতে পারে না। বাইরে সূর্য উঠে গেলেও ঘরের ভেতর নিবিড় রাত। ডিমলাইটও নিভানো। জমাট অন্ধকারে দু’জন নর-নারী দু’জনকে যেন নতুন করে চিনছে। পর্দাঘেরা এই অনন্ত আঁধারই যেন দু’জন দু’জনকে চেনার মোক্ষম আয়না! দু’জনের ভেতরের দু’জন পরস্পরের ভীষণ অচেনা! এর আগে তারা কেউ কাউকে দেখেনি। চেনে না! তবে যেন তাদের জন্মই হয়েছিল এটুকু সময়ে জন্য একজন আরেকজনকে পরম তৃপ্তিতে ভরিয়ে জীবনের চরম অতৃপ্তিকে ঘুচিয়ে দিতে।
প্রথমবারের ঘোর কাটতে না কাটতে শিহাব দ্বিতীয়বারের জন্য যখন আবার সাহারার অবশিষ্ট আবরণ খুলে ছুঁড়ে নিচে ফেলে দিচ্ছিলো আর বলছিল, আমি পুরুষত্বহীন হয়ে যাচ্ছিলাম। অনেকদিন থেকে আমি পারছিলাম না। নদী আমার বুকে যতবার হাত রেখেছে, আমি নিজের অজান্তে সরিয়ে দিয়েছি। আজ তোমার স্পর্শে আমি নিজেকে ফিরে পেলাম সাহারা…।
থ্যাঙ্কস্ গড! আমার এই জ্বরের দরকার ছিল, নাহলে তুমি আমার কাছে আসতে না। আমারও কোনোদিন তোমাকে বলার সাহস হতো না! এই যে যা ঘটছে তুমি কি রাগ করলে? সাহারা যেন গভীর খাদ থেকে ক্লান্ত কণ্ঠে উত্তর দিল : জানি না!
শিহাব অবিরাম সাহারাকে বিদ্ধ করতে করতে বললো : তোমার খুব ক্ষতি করলাম…!
সাহারা এবার উত্তর দিলো : করলেই তো!
যদিও বাইরে সেই বৃষ্টি নেই। তবু সেই তেমনি শীতকাল। কিন্তু শিহাবের কপাল চুঁইয়েপড়া দরদরে ঘামে সাহারার মুখ-কণ্ঠ-বুক ভিজে জবজবে হয়ে যাচ্ছে। এমনিতে শিহাবের জ্বরের তাপে তারও শরীর পুড়ছে। তবু সে তাপ ও ঘামের গন্ধ তাকে মাতাল করে তুলছে। তার শরীর বুভুক্ষু বাঘিনীর মতো শিহাবকে আঁকড়ে রেখেছে। নারীর এমনি সমর্পণ বুঝি পুরুষকে আরো পুরুষ করে তোলে। এমন দোলাচলের ভেতরও শিহাবের একবার মনে পড়ে গেলো, নদী কখনো তার কাছে নিজেকে এভাবে সঁপে দেয়নি! এভাবে আঁকড়ে ধরেনি! তার স্পর্শে এমনি কামনায় উন্মত্ত হতে পারেনি! তপ্ত মাটি যেভাবে বৃষ্টির ফোটায় গলে যায়, নদী গলেনি তার ভালবাসায়। সব সময় একটা ভয় শিহাবের ভেতর জেগে থাকে, এই বুঝি তার দিকে তাচ্ছিল্য বা কটাক্ষের দৃষ্টিতে তাকাবে নদী। নিজেকে তার কাছে সতর্ক রাখতে রাখতে প্রতিরাতে বিছানা তার কাছে কণ্টক শয্যা মনে হচ্ছিলো। রাত মানেই তার নিজের ভেতরে নিজের গুটিয়ে থাকা!
শিহাব সাহারাকে জাপটে ধরে রেখে বললো, জ্বর থাকাতে আমার সময় বেশি লাগলো, তোমাকে বোধ হয় আমি কষ্টই দিলাম দ্বিতীয়বার!
সাহারা কিছুই বলে না। সে মনে মনে ভাবে, সমস্ত জীবনই তো মনে হয়েছে, কখনো না কখনো এমনি কেউ আমার জীবনে আসবে! যে আমাকে কোনোদিন ছেড়ে যাবে না। মনে হয় আমি সেই তার জন্য প্রতিনিয়ত নিজেকে নির্মাণ করে চলেছি। কিন্তু আমার সব প্রার্থনা অবশেষে ক্ষণিকের অতিথি তোমার কাছে এসে ঠেকলো! যার সাথে জীবন শুরু করেছিলাম, যখন বুঝলাম, শারীরীক সৌন্দর্যের সাথে ভালবাসা তার কাছে ফিকে হওয়ার বিষয়। নাহলে সে রূপবতী একজনের হাতছানি পেয়ে আমাকে গৌণ করে দিলো কী করে! নাকি সে ভেবেছিলো, ছেলেমেয়ে হয়ে গেছে বলে আমি ওই নিগৃহীত অবস্থায়ই শুধু তার ছেলেমেয়ের মা হয়ে পড়ে থাকবো! মাত্র কটা বছরে ঘর যখন খোঁয়াড় হয়ে উঠলো, আমি পথে নয়, একেবারে প্রান্তরে নেমে এলাম। এর পর থেকে মানুষ সম্পর্কে আমি আরো সতর্ক হয়েছি। আর তোমাদের ভেতর ঠাঁই পেয়েই বুঝেছি, যে মানুষ আমি কল্পনা করি, সেই মানুষ এই ধূলির ধরাতেই আছে। তবে এক প্রজন্মের শিক্ষায় এটা হয় না!
সাহারা অনেকক্ষণ কথা বলছে না। সারাজীবন সাহারাকে শিহাবরা ক’ভাইবোন একজন অভিভাবক হিসাবে দেখে আসছে। কিন্তু এই এখন একেবারে বাহুলগ্ন অবস্থায় তার মগ্নতা এবং শরীরের বাক্সময় সঞ্চালন শিহাবকে প্রচÐ আবিষ্ট করে। সে বলে তোমাকে যে বুঝবে, তার একজনমে তোমাকে ভালবেসে সাধ মিটবে না!
: তেমন কিছু যদি থেকেই থাকে আমার, সেটা সেই সমস্ত কিছু না পাওয়ারই লাবণ্য!
: কী চমৎকার কথা তুমি বলতে পারো। তবু তোমাকে আমি বেঁধে রাখতে পারি না!
: জানো, আমার এই এখন তোমার এই কথার পরে মনে হচ্ছে, তুমি আমার থেকে কত বছরের ছোট সেটা কোনো বিষয় নয়। বিষয়, তুমি একজন পুরুষ আর আমি একজন নারী।
পৃথিবীতে আমরা দু’জন দুই সময়ে এসেছি এই যা! দু’জন মানুষের শারীরীক সম্পর্ক হতে বয়স কোনো বাঁধা নয়। তবে সামাজিক সম্পর্ক হতে গেলে, যা আমাদের চিরাচরিত নিয়ম, সেই চক্রই মানতে হয়।
আমরা বাবাকে বয়স-শিক্ষা-দীক্ষায় বড় দেখি, মাকে ছোট। বাবা ধমক দেবেন আর মা ঘোমটাটা আরেকটু টেনে ঘরে ঢুকবেন। আমাদের চোখ যা দেখে অভ্যস্ত আমাদের জীবনে তেমন আচরণ ও সম্পর্ক’র প্রতিষ্ঠা আমরা চাই!
: সব থেকে ভাল হয় সমাজ ছেড়ে যারা নিজের মতো বসবাস করে। তাই বলে তারা অন্যের খারাপ হয় এমন কিছু কিন্তু করে না! এমন কি তারা একটা মিথ্যে কথাও বলে না। তাদেরকে যারা অপছন্দ করে, তারাও তাদেরকে নিঃশব্দে এড়িয়ে চলে!
: আহা, আমি অমন কাউকে পেলে এই সমাজ ছেড়ে চলে যেতাম!
: কেন, সমাজ তোমাকে আর টানছে না বুঝি!
: সমাজের থেকে যা পাওয়ার, তা আমি পেয়ে গেছি। যা পাইনি, তার জন্য সমাজের বাইরে যেতে চাই! ওই যে যারা একতারা বাজিয়ে গান করে আমার ওইরকম বোষ্টমী হওয়ার কতবার সাধ হয়েছে। কিন্তু দেখলাম বোষ্টমী হতে গেলে একজন সঙ্গীর প্রয়োজন অনিবার্য!
এলোমেলো শাড়িখানা শিহাবের পিঠের নিচ থেকে টেনে নিয়ে সাহারা যখন দৌড়ে সরে যাওয়ার কথা ভাবছিল, শিহাব তার হাত টেনে ধরে বললো, এই আগুন তুমি চেপে রাখো কীভাবে?
সাহারা বললো, বারুদও তো পুষে রাখে দাউ দাউ আগুনকে!
: আজ আমার বড় উপকার করলে সাহারা আপা!
সাহারা শিহাবের শক্ত করে ধরে থাকা হাতের মুঠো থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা না করেই বলে, কি উপকার করলাম?
: ভেবেছিলাম, নারীরা পঞ্চাশের আগেই ফুরিয়ে যায়। কারণ পুরুষমাত্রেই তাই বলে বেড়ায়। কিন্তু বিষয়টা এত সংবেদনশীল, এটা নিয়ে তো কোনো নারী চ্যালেঞ্জ করতে আসে না। তাই পুরুষের বলার অধিকারটি দিনে দিনে ব্যাপ্তই হয়েছে! আর চল্লিশ না পেরোতেই নারীরা কোণঠাসা হয়েছে। এই অবস্থার এখনো যে অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়েছে, তা কিন্তু নয়! কিন্তু আজ আমার ধারণা ভেঙে গেলো!
: শোনো দুইরকমের বিষয় আছে। এটা তো চর্চার বিষয়। দু’জন মানুষের সম্পর্কের ভেতর যদি ভক্তি ও আবেগ থাকে, তাদের যৌবন কখনো শেষ হয় না! শেষ তখনি হয়, অভক্তি ঢুকে গেলে। অতএব আমার মনে হয়, জীবনে এটাই জরুরি, সবাই যেনো নিজেদের সম্পর্কটা যে কোনো মূল্যে ভালো রাখে।
: নিজেকে দিয়ে আমি তা বুঝতে পারছি!
: আর বউ মরে গেলে কাজের দোহাই দিয়ে পুরুষরা ঘরের কাজের মেয়েকে বিয়ে করতে পারে। অথবা হতদরিদ্র পরিবারে টাকাপয়সা টোপ দিয়ে একটা কম বয়সী মেয়ে বিয়ে করে আনে। মানে একটা কম বয়সী মেয়ের টাইট শরীর তাদের চাই। কিন্তু নারীরা তো কম বয়সী ড্রাইভার-বাবুর্চি বিয়ে করবে না। গোপনে ভোগও করবে না। যদি কেউ সেটা করে তা ব্যতিক্রম। কিন্তু গড়পরতা নারীর সেটা স্বভাববিরুদ্ধ। তা কেবল একচেটিয়া পুরুষরা করে। আর বুড়োদের মুরোদও বয়স্ক নারীদের জানা আছে। কারণ ততদিনে তারা চোখের চামড়া খুলে সব বুঝতে শিখেছে।
: কীভাবে শিখেছে?
: আচ্ছা, একটা সহজ উদাহরণ দেখাই। একটা মেয়েকে পাঁচজন-দশজন পুরুষ ভাড়া করে এরকম খবর তো প্রায় দেখো, শোনো। নাকি?
: হ্যাঁ!
: কিন্তু কখনো শুনেছো, দু’জন মেয়ে একটা ছেলেকে নিয়ে ডেটিং করছে?
: না তো!
: তবে আবার বøু-ফিল্মে দেখা গ্রæপ সেক্সের আজগুবি উদাহরণ টানতে যেও না! মনে রেখো, মেয়েদের সিক্সথ সেন্স বড় প্রখর। সবকিছু নিজের জীবনে না ঘটলেও অন্যের অবস্থা দেখে টের পায়। তাই ভাত-কাপড়, আশ্রয়ের অভাব না হলে কোনো নারী ‘নারী প্রগতি’র জোয়ারে ভাসা এই সময়ে এসে কোনো বুড়োকে অন্তত বিয়ে করবে না। বুড়োদের বিয়ে করবে নিঃসম্বল যুবতীরা, যারা বুড়োদের মরার পর একটা কিছু পাবে।
: ‘নারী প্রগতি’ যদি বোঝোই, তুমিও তো আমাদের চার দেয়ালে এসে আটকেই থাকলে!
: দেয়াল স্বাধীনতা হরণ করে না। বরং সব সুশৃঙ্খল কাজের জন্য পোক্ত দেয়ালেরই দরকার। তোমাদেরকে আপনজন হিসাবে পেয়েছি। স্বাধীনতাও পেয়েছি। কত কাজ শিখেছি। কথা শিখেছি। জীবনের কত কত স্তর দেখা হলো। অন্তত নিজের দহনের ভাষাটা তো বুঝতে শিখেছি! এখানে না এলে সে ভাষাই তো জানা হতো না! মামী আমাকে রান্নার স্কুলে ভর্তি করে রান্না শিখিয়েছেন। দর্জিবিদ্যা শিখিয়েছেন। একটা সময় থেকে আমি তোমাদের ছেড়ে নিজের মতো কিছু করতেই পারতাম, কিন্তু অসময়ে এসে অত সংগ্রামী হতে আমার ভালো লাগলো না। তার চেয়ে তোমাদের যার জন্য যখনি কিছু করি, তোমরা তাতেই মুগ্ধ হও, সেই মুগ্ধতাও আমাকে একধরনের প্রশান্তি দেয়।
: এই যে তুমি এত কথা বললে, এর ভেতর বস্তুগত কোনো কথা নেই। নেই আরোপিত কোনো বিষয়। সারাজীবন মুখোমুখি বসে একটা মানুষের সাথে কাটিয়ে দেয়া যায় এই মুগ্ধতাকে ভর করে!
: তাও তো করছে মানুষ। হয়ত তার সংখ্যাটা কম। ওই যে তুমি তোমার দাদা-দাদিকে দেখেছ, একজন বই পড়ে আরেকজন শোনে। তাদের জীবনেও প্রাচুর্য ছিল না। তাদের মরচে ধরা একখানা মাত্র টিনের ঘর ছিলো। সে ঘর আমিও দেখেছি। কিন্ত পরস্পরের প্রতি মুগ্ধতা নিয়ে তাদের জীবন তো কেটে গেছে। উত্তরসূরী হিসাবে সেই রেশই তো বয়ে চলেছো। তাই তো নদীর সাথে তোমার বনছে না। অথচ নদীদের সংখ্যাই সব সময় বেশি। শুধু অবস্থার রকমফের এই যা।
: আমিও তাই ভাবি, এদের স্বামীরা কী করে এদের সাথে তাল মিলিয়ে চলে!
: চলে আর কই! যাদের মনোবৃত্তি স্ত্রী’র মতো একই রকম, যাদের আদর্শ হিসাবে কেউ সামনে নেই তারাই সংসার বাঁচানোর নামে সহজে গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যায়! তুমি পরোয়া করছো না বলেই সাড়াশব্দ উঠছে। মেনে নিলেই স্রোতে গা ভাসানো হতো!
: আর পারে না যারা?
: যারা পারে না তাদের ভেতর দূরত্ব নেমে আসে। স্ত্রী’র প্রতি আকর্ষণ হারায়। আর ওই জায়গাটা দখল করে অন্য কেউ। আর অন্য কেউও যদি শুধু প্রেমিকা হয়ে না থাকে, তারও প্রেম বা সঙ্গদানের বিনিময় প্রত্যাশা দীর্ঘ হয়, তখন পুরুষ আবার আরেক অন্যজনকে খোঁজে! এই খোঁজাটা আসলে বিনিপয়সার প্রেমের জন্য নয়, তাকে নিখাঁদ প্রেম খোঁজার নেশায় পেয়ে বসে।
: তুমি সত্যি জানো?
: আচ্ছা, তুমি কখনো প্রেম করোনি?
: করেছি, তবে গভীর প্রেম করিনি! আমার মনে হয় প্রেম কেউ করে না হয়ে যায়! আমার হয়নি! কারণ আমাকে কেউ দীর্ঘদিন পছন্দ করেনি। তাদের সন্দেহ ছিলো, শেষ পর্যন্ত সম্পর্কটা টিকবে কি না! একসময় আমাকে দিয়ে শুরু করে দেখা গেছে পরে আমি যাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি তাদের সাথে আমার চেয়ে বেশি ভাব!
: প্রেম ছাড়া জীবন চলে না। ভাত-কাপড়-বাসস্থানের প্রয়োজন মিটলেই, অই অপ্রয়োজনীয় বিষয়টা ভীষণ প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তোমাদেরকে আমিও তো স্কুলে, কোচিংয়ে নিয়ে গেছি। মানুষের আড্ডার কত রকম বিষয়বস্তু শুনেছি। দেখেছি।
: মেয়েদের তুমি কী জানো?
: একসময় রুমুর সাথে সাংস্কৃতিক পরিমÐলে ঘুরে, কোনো কোনোদিন, সারাদিন নানান রকম মানুষের ভিড়ে মিলে থেকে কতকিছু যে বুঝতে পারতাম! তখন ভাবতাম, বিধাতা, এতকিছু উপলব্ধি করার সুযোগ দেবে বলেই কি আপনজন ছাড়া করে আমাকে পরের ভেতর এনে ফেললেন! এত অভিজ্ঞতা আমি কোন কাজে লাগাবো!
: তুমি এত কিছু আত্মস্থ করে ফেলেছো, অথচ কত উচ্চশিক্ষিত মানুষও সারাজীবন কতকিছু দেখেও তার কোনোকিছু বোঝে না!
: আমি আরো কি বুঝেছি, জানো?
: বলো!
: এই যে পুরুষগুলো স্ত্রীবিমুখ হয়ে অন্যত্র বিকল্প সুখ খুঁজে বেড়ায়। অধিকাংশ স্ত্রী’দের হাতেই অর্থের প্রাচুর্য থাকে। কারণ পুরুষরা অন্যের সাথে যা-ই করুক, কিন্ত বৈধ অবৈধ যা-ই কামাই করুক, তা বউয়ের হাতেই সব তুলে দেয়। আর বউরা তা দিয়ে নিজেদের ঘষামাজা করে এবং অনেকেই তরুণদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে। আর এর পরিণতি কী হয় জানো?
: কী?
: একজন পুরুষকে একটি মেয়ের সাথে দৈহিক সম্পর্ক গড়তে হলে তাকে জায়গা খুঁজতে হয়। বিষয়টা তার জন্য সত্যি কঠিনই। কিন্তু একজন নারীর যদি কারো সাথে সম্পর্ক হয়, তার কিন্তু জায়গা খুঁজতে হয় না! আর একটা বয়সে এসে স্বাধীনতারও অভাব হয় না! তার লজ্জা ভয়, নিরাপত্তার অভাববোধ সব কেটে যায়। নারী কোনোভাবে ধরা পড়ে গেলে আত্মপক্ষ সমর্থনের সব যুক্তি-অজুহাত সে খাপের খাপ মিলিয়ে দেখাতে পারে!
: আমার মাথাটা খারাপ করে দিচ্ছো কিন্তু!
: যে সব পুরুষ যা খুশি করে বেড়ায়, আর মনে করে তার ফুরিয়ে যাওয়া নারীটি এমনিই থাকে! আসল কথা কি জানো, ঠিক তোমার আর নদীর বেলায় যা ঘটেছে, কমবেশি এই তো পরিবারগুলোর ভেতরের চিত্র। এইরকম খেয়োখেয়ি করতে করতে পরস্পরের থেকে পরস্পরের রুচি উঠে যায়। কিন্তু সেই তৃষ্ণা অন্য কাউকে দেখলে আবার উসকে ওঠে! তার প্রমাণ তো তুমিই!
শিহাব চুপ হয়ে অবসন্ন শরীরে পড়ে থাকে। তার মন খারাপ হয়েছে ভেবে সাহারা তার মাথার চুলে বিলি কেটে দেয়। তারপর ঠোঁটের পরে ঠোঁট রাখে। ধীরে ধীরে বলে এত কথা বলা আমার ঠিক হয়নি!
: মিথ্যে তো কিছু বলোনি! আর তোমার কথা বলবার জায়গাই বা কই!
: সেক্সডল দেখেছো?
: কেন বলো তো?
: এতো নিপুণ ও পারঙ্গম করে তা বানানো হয়, তবু একজন নারী বা পুরুষ তার বিপরীত লিঙ্গের কারো কাছেই উজাড় হতে চায়। তার ঘনিয়ে ওঠা শিহরণটুকু আরেকজনকে আন্দোলিত করছে, ‘চরম সুখ’এর পরেও যেন অতিয়েন্দ্রীয় আরেকটি সুখের পর্ব সেটা!
সাহারার কথা শেষ না হতেই শিহাব আরেকবার সাহারার শরীরটাকে টেনে নিজের দিকে আনতে চায়। সাহারা ফিসফিসিয়ে বলে, তুমি অসুস্থ। তাহলে এবার আমি…।
শিহাব কাত হয়ে শুয়েছিল। সাহারার কথায় সে চিৎ হয়ে টানটান হলো। সাহারা তার ওপরে বসলো এবং এই তৃতীয়বার দীর্ঘক্ষণ তারা আসন পাল্টাপাল্টি করে একেবারে শিহাবের অফিসে যাওয়ার টায়টায় সময় পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে খেলাটা চালিয়েছিল।
বাথরুম থেকে বেরিয়েই সাহারার সেই মুহূর্তে একটি রবীন্দ্রসংগীতের কথা মনে পড়ে ঝড়ের মতো তার মন এলোমেলো করে দিলো। সে দ্রæত হাতে মোবাইলে সার্চ দিয়ে গানটি খুঁজে বের করলো। জীবনে এই প্রথম যেন তার নিজের জন্য একটু বিলাসিতা। গান বাজছে, ‘তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে সুপ্তরাতে।/ আমার ভাঙল যা তা ধন্য হল চরণপাতে।।/ আমি রাখব গেঁথে তারে রক্তমনির হারে,/ বক্ষে দুলিবে গোপনে নিভৃত বেদনাতে…\’
অফিসের যাওয়ার সময় আসন্ন। শিহাব দ্রæত নাস্তা সেরে আরো দ্রæত চুমুকে চা খেতে খেতে বললো, দেখো, রবীন্দ্রনাথ কারো কথা বাদ রেখে যাননি লিখতে! তুমিও তার মনে ছিলে।’ সাহারা এবার দৃষ্টি গাঢ় করে আড়চোখে শিহাবের দিকে তাকালো। কিন্তু সে দৃষ্টি বেশিক্ষণ স্থির করে রাখলো না! মনে মনে মৃদু ক্ষুব্ধ হয়ে বললো, তোমার এতো এতো যোগ্যতা থাকার পরেও রবীন্দ্রনাথের হাজার হাজার গানের থেকে একটাও তোমার নিজের বলে মনে হবে না। আর সে অপ্রাপ্তিটাও তোমার কম নয় শিহাব চৌধুরী!
সাহারার চেহারাতে তারুণ্যের আলগা লাবণ্য না থাকলেও দহনের একটা ছাপ সুস্পষ্ট। তাই যেন তাকে অলঙ্কারের আভা দিয়ে রেখেছে। শরীরের বাঁকগুলো বয়সের দাপটে মিলিয়ে না গিয়ে স্বাভাবিকভাবে তা স্পষ্ট হয়ে আছে। কারণ চিকন গড়ন শরীর তার। যা আধুনিক নারীদের কাক্সিক্ষত। সাজ-সজ্জার ভেতর অতি সচেতনা নেই। তবে সচেতনভাবেই সে পরিপাটি থাকে। পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী নারীদের সাথে নদীর চেয়ে সাহারার খাতিরটা জম্পেশ। সেলাই-ফোঁড়াই থেকে শুরু করে অনেকে রান্নার বিষয়েও সাহারার থেকে শিখে যায়। কারো ভারী কেনাকাটা থাকলেও সাহারাকে তারা সাথে পেলে বর্তে যায়।
বহুদিন সাহারা ভালো কিছু রান্না, বা পিঠা বানানোর সময়ে নদীকে ডেকেছে, দেখে শিখে রাখতে। বলেছে, আমাকে তো কখনো যেতে হবে। তখন যেন করতে পারো। আর যে কোনো শেখা কাজ কখনো কঠিন মনে হয় না।
নদীর প্রতি সাহারার এইরকম কত আগ্রহ নদী নীরব অবহেলায় দমিয়ে দিয়েছে। কখনো তার কোনো ডাক শুনতে পেলেও সাড়া দেয়নি। সাহারাকে ওর কাছে গিয়ে বলে আসতে হয়েছে। সাহারা পারতো নদীর কাছে না গিয়ে থাকতে। সে এখতিয়ার সে ওই পুরো পরিবারের ভেতরে দিনে দিনে অর্জন করেছে। কিন্তু সে সব সময় চেয়েছে কারো সম্পর্কের ভেতর কোনো কলহের সেতু না হয়ে উঠতে। কিন্তু আজ যা ঘটেছে, তাতে তার মনে হয়েছে নদীকে নিঃস্ব করে সে জয়ী হয়ে গেছে। যেন সাপ থেকে মণিটা সে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। আর যে প্রাণ সে রেখে যাচ্ছে, তাতে সাহারাই ঢেউ হয়ে দু’ক‚ল উপচে পড়বে। চিরদিনের জন্য নদী সাহারাতে বিলীন হয়ে গেলো। যদিও এমন জয়ের আকাক্সক্ষা সে কখনো করেনি! শিহাবের মনের কোথাও নদীর জায়গা নেই এই খবর সাহারাকে আজ ব্যথিত করেনি। সে ভেবেছে এটাই হওয়ার কথা! কিন্তু তাই বলে কি নিজের জন্য সে এখান থেকে সুখের বীজ হৃদয়ে বপন করে নিয়ে যেতে পারছে!
সকাল বেলা শিহাবের সাথে একসাথে বিছানা ছাড়তে ছাড়তে সেই তখন থেকে নিজের ভেতর টের পাচ্ছে চন্দনকাঠে সাজানো চিতা। যাতে আগুন লেগে গেছে। যার সুবাস ম ম করলেও পুড়ে যাচ্ছে তার মনভ‚মি!
দিনভর সে ওই একই গান বারবার টেনে বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে শুনতে শুনতে ঘরের রান্নাসহ কাজগুলো গুছিয়ে ফেললো। সে চলে যেতো আগেই।
কিন্তু গতরাতে শিহাবের মাথায় পানি ঢালতে ভিজিয়ে ফেলা সমস্ত বিছানা তুলে সে ছাদে শুকাতে দিয়েছে। ভেজা তোষকের এপিঠ-ওপিঠ শুকাতে হয়েছে তাকে। এর ভেতর কিছু লেখার জন্য কলম ও রাইটিং প্যাড এনে টেবিলে রাখলো।
এক সময় কিছুদূর লেখার পর কী মনে করে পাতাটা ছিঁড়ে সে পুড়িয়ে ফেললো। তারপর মোবাইলেই লিখতে শুরু করলো। মোবাইলে লিখতে তার বেশি সময় লাগে না। কিন্তু লেখার পর সব কেমন অপ্রয়োজনীয়, হাবড়া জাবড়া ঠেকে। প্রাণোৎসারিত হয়ে বেরিয়ে আসা তার সে কথাগুলো তার কাছে দামি মনে হলেও সে বোঝে, এগুলো পৃথিবীর আর কারো জানার জন্য জরুরি নয়! তাই ডিলিট করে করে বাক্যগুলো আবার সমন্বয় করতে তার অনেকটা সময় লেগে গেলো।
সাহারা বাসা থেকে বেরিয়ে যখন গেলো, তখন ভরা সন্ধ্যা। তাতে অবশ্য তার কোনো অসুবিধা নেই। রাতের যে কোনো একটা বাসে উঠলেই হবে। সে ভেবে রেখেছে, যতো রাতই হোক, সে তাহেরকে বলবে তাকে বাসস্ট্যাÐ থেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং বাস ফেনীর কাছাকাছি গেলেই তবে এতবছর পর তাকে ফোনটা করবে। নাম্বারটা সে কিছুক্ষণ আগে জোগাড় করেছে। ছেলেমেয়েকেও বলেনি, যে আমি একেবারে ফিরে আসছি!
ভাইদেরও বলবে না। সেদিন তারা তার মনের অবস্থা বুঝে সম্মানের সাথে তাকে আশ্রয় দেয়নি। বোঝেনি, ভুল তো ভুলই। তারা দেখেশুনে বিয়ে দিলে সেখানেও কি এমনটা হতে পারতো না! দু’ভাই মিলে তাকে একটু আগলে রাখলে এই বেদনাকে বরণ করে নিতে তাকে এতদূর আসতে হতো না। সাহারা হঠাৎই টের পেলো তার বুকে জগদ্দল পাথর চাপানো। যে ভার নিয়ে সে দ্বিধা-দ্ব›েদ্ব টলতে টলতে অন্যের সংসারে এসেছিলো, সে ভারও তো এতো ভার ছিলো না! তারপর দিনে দিনে সে কুয়াশার মতো সব কাটিয়ে উঠেছিলো। জীবনটাকে সে টবের লতার মতো চর্চা করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু মাত্র একটা রাত বালির বাঁধের মতো স-ব গুড়িয়ে দিলো! কিন্তু এখানে থাকা তো যাবে না আর!
এই আলগোছে সরে যাওয়ার ইচ্ছেয় এত বছর পরে পথে নেমে, গন্তব্য একটাই অনিবার্য করে রাখে সে। তাহেরের নাম্বারটা আবারো বের করে দেখলো। নাস্তা খাওয়ার পর সাহারা আবার মনে করে শিহাবকে জ্বরের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছিলো। পকেটে পুরেও দিয়েছিল আরো দুটো এবং সাবধান করে দিয়েছিলো, পরবর্তী ছয় ঘণ্টার আগে যেন এ ওষুধ আর না খায়। বলেছিলো, বেশি করে পানি খেও!
তখন অফিসে যেতে ব্যস্তসমস্ত শিহাবের কথা বলার সময় ছিলো না। সে বরাবরের মতো সাহারার কথা শুনছিলো আর মাথা নাড়ছিলো। অফিসে গিয়ে সাতদিন পর আজই প্রথম তার মনে হলো, নদীকে একটা ফোন দিই। বাসায় চলে আসতে বলি। বললেই আসবে না জানি। তবু ফোনটা তো করি।
প্রতিদিন সন্ধ্যা পার করেই শিহাব বাসায় আসে। আজো আগের মতো সময়ে সে বাসায় ফিরলো। কলিংবেল টিপে কিছুক্ষণ দরজার এপাশে অপেক্ষা করলো। ভেতর থেকে দরজা খোলার আভাস না পেয়ে তার কাছে থাকা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখলো টেবিলে তার খাবার সাজানো। এমনটি কখনো তো থাকে না। সে বাসায় না ফেরা পর্যন্ত কখনো খাবার বাড়া হয় না। তবু সে ভেবেছিলো, সাহারা বাথরুমে আছে। অথবা কোথাও গেছে। সে-ই তো কেনাকাটাও সব করে।
শিহাব ফুরফুরে মেজাজে অফিসের পোশাক পাল্টে ড্রয়িংরুমের সোফায় গিয়ে বসলো। অনেকদিন তার নিজের এমন মেজাজের কথা সে ভুলে গিয়েছিলো। গতরাতে, মানে আজ ভোর পর্যন্ত যা তার জীবনে ঘটলো, বাস্তবিকই সাহারা তার অস্তিত্ব ও বোধের ডালপালা নাড়িয়ে দিয়েছে। খবরের কাগজ তাকে টানছে না। টিভিও না। বরং গতরাত থেকে আজ সকাল পর্যন্ত যা ঘটেছে, তারই পুনরাবৃত্তি চলছে তার ভেতরে। সে ভাবছে, সাহারা আপার ভেতর আসলে যৌবন যা আছে, তার থেকে তৃষ্ণাই তাকে এমন ক্রেজি করে রেখেছে। বাস্তব জীবন শিখিয়েছে পরিশীলিত হতে। সবকিছু না চাইতেই পেলে মানুষের যে পরিমিতিবোধ আসে না। প্রেমেন্দ্র মিত্র’র দুখানা চরণ শিহাবের মনে পড়ে যায়, ‘মেটার যা নয়, সেই তৃষ্ণাই প্রাণের গহন উৎস চেনায়।’ আজ অফিসেও তার মেজাজ ভালো ছিলো বুঝতে পারে। আজ সে কারো সাথে নিজের চড়াস্বর শোনেনি।
সাহারা গেলো কোথায়, ভেবে একটু অসহিষ্ণু হয়ে উঠলো শিহাব। অস্থির হাতে সে টিভি ছাড়লো। খবরের কাগজও টেনে কাছে আনবে এমন সময় মোবাইলে মেসেজ আসার শব্দ পেলো। সাহারার মেসেজ। ‘তোমার এখানে আর আমার থাকা ঠিক হবে না! জীবনটা একভাবে কেটেই যাচ্ছিল। কিন্তু আজকের পর থাকলে নিজের আত্মার প্রতি সীমাহীন লাঞ্ছনা প্রয়োগ করা হবে। এখন আমি ফিরে যাচ্ছি পুরনো সেই মানুষের কাছে। যাকে ডিভোর্স দিতেও ঘেন্না হয়েছিলো। মনে হতো আসল ডিভোর্স তো হয়েই গেছে। লোক দেখানো ডিভোর্স দিয়ে আর কী হবে!
আজ তুমি অফিসে চলে যাওয়ার পরপরই আমার মনে হলো, আমিও তো আমার সমস্তর ভাষা আরেকজনকে উপলব্ধি করতে দিয়েছি এবং এটাকেই আমি প্রতিশোধ মানছি। আর সেই স্পৃহায় শুধু শরীরের ক্ষুধা নিয়ে তার কাছে যাওয়া। মন তো রেখে গেলাম তোমার কাছেই, বাস্তবতার বাইরে যার মন নিয়ে খেলার কোনো সময় নেই জেনেও।
আজ মনে হচ্ছে কি জানো, আজ যা তোমার কাছে পেলাম, তা আমার সমস্ত হারানোর অধিক! এ এক অন্যরকম স্বাদ। অন্যরকম আনন্দ। এ এক অন্যরকম বোধ। যেন সবকিছু ভেঙে আবার আমাকে নতুন করে কেউ গড়ে দিল। অথচ এই বোধের মিশ্র লাবণ্য আমাকে আর রাতে ঘুমোতে দেবে না। সুখি হতে দেবে না কাউকে নিয়ে! তবু আলগোছে এইটুকু প্রাপ্তি এবং তুমি যে আমার শরীর-মনকে ভালবাসো, এই মহার্ঘ্য বিশ্বাসটুকু নিয়ে জোড়াতালির নিস্তরঙ্গ-মরা নদীর মতো বুহ্যে ঢুকে পড়তে এখন আর আমার কোনো কষ্টই লাগছে না।
ভেবেছিলাম এসব তোমাকে লিখে রেখে আসবো। কিন্তু নদী আগে এসে ঘরে ঢোকে যদি! মনে রেখো, সাহারা মানে শুধু মরুভ‚মি নয় কিন্তু। উপবনও!
আগুনের আলো
দীলতাজ রহমান
স্বামীর সাথে মাগরিবের নামাজ শেষে চা খেয়ে মোসলিমা খাতুন ডাইনিং টেবিলে প্যাড রেখে একখানা চিঠি লিখতে বসলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে উঠে বেডরুমে ঢুকলেন।
কিছু না বলে নিজের পাশ থেকে স্ত্রী’র নীরবে উঠে যাওয়াতে সায়েম মহম্মদ স্ত্রী’র কাছে গিয়ে বললেন, আমার পাশ থেকে কিছু না বলে চলে এসে বুকের নিচে বালিশ দিয়ে লুকিয়ে কী লিখছো?
: তোমাকে আগে থেকে দেখাবো না বলেই তো এখানে চলে এলাম!
সায়েম মহম্মদ স্ত্রী’র এমন কথা শুনে তার গায়ের ওপর পা তুলে জড়িয়ে শুয়ে বললেন, তাহলে তো লিখতেই দেয়া যাবে না। তুমি এমনভাবে লিখছো, যেন কোনো কলেজ পড়–য়া মেয়ে তার নিষিদ্ধ প্রেমিককে লিখছে!
: আর তাই বুঝি তুমি এই বুড়ো বয়সে স্বামীগিরি ফলাতে এলে?
: কাকে চিঠি লিখছো?
: তোমাকে না দেখিয়ে পোস্ট করবো না। তবে এখন সরো তো! লিখতে দাও!
: ভুলে যেও না তোমাকে এ বয়সেও তন্বি-তরুণী রাখতে আমারই ভ‚মিকা!
: সবই তোমার ভ‚মিকা। বিধাতা পুরুষ আমাকে তো আর নিজের করে এতটুকু রূপগুণ কিচ্ছুটি দেননি!
: শোনো প্রতিদিন সকালে আমি তোমার আগে ঘুম থেকে উঠি। একথা তুমি অস্বীকার করতে পারবে?
: দরকার কি অস্বীকার করার?
: তাই প্রতিদিন নিজের জন্য উষ্ণ জলে মধুসহ একগøাস লেবুর সরবত বানাতে গিয়ে আমি দুই গøাস বানিয়ে ফেলি। আর তুমি ঘুমে থাকতে তা তোমাকে বিছানায় নিয়ে খাওয়াই। না হলে আজো তোমার লাবণ্য সেই প্রথম দিনের মতো থাকতেই পারতো না! যখন আমি ঢাকায় থাকি না, তখনো কোনো কোনোদিন ভুলে দুই গøাস বানিয়ে ফেলি!
: তুমি যখন বলছো আমার লাবণ্য প্রথম দিনের মতো আছে। আর এ নিয়ে আমি তর্ক করবো, অতো বোকা আমি নই! কারণ তুমি তো জানোই আমি কার ছেলের বউ!
: সে আর বলতে! তবু বলছিলাম, কাউকে প্রথম পরিচয়ের শুরুতে না বলে দিলে সে ভাবতেই পারবে না এই তরুণী বঁধুটি দু’জন ডাক্তার ছেলেমেয়ের মা!
: তাতে আমার কোনো ভ‚মিকা নেই। সেটা প্রকৃতিগত। মানে স্বাভাবিকভাবে পাওয়া।
: কিছুটা আমার লেবু মধু যোগে গরমে জলেরও গুণ…।
মোসলিমা খাতুনকে আজ তার কলেজে অধ্যক্ষ হিসাবে নিয়োগ দেয়া হলো। তার জীবনের সেরা এই দিনটিতে আজ সবচেয়ে যার কথা তার মনে পড়ছে, তিনি তার শাশুড়ি। শাশুড়ির পরিবর্তে এমন খবরটি প্রথমই অন্য কাউকে বলবেন, এটা তিনি ভাবতেই পারেন না! শাশুড়িকে আজো মোসলিমা চাচী ডাকেন। নিজের মা এখনো জীবিত থাকলেও তিনি মা’কেও সে চাচীর বিকল্প ভাবতে পারছেন না! তাই প্রথম চিঠি লিখে তাকেই খবরটা দিচ্ছেন মোসলিমা।
ঘোর অমাবশ্যার সেইরাতে পথের আলোর জন্য যদি তিনি পাটখড়ি জ¦ালিয়ে সেদিনের লিমাদের বাড়ি না যেতেন, কি হতো লিমার ভাগ্যে। হতে পারে কোনো বড় চাকুরিজীবির সাথেই তার বিয়ে হতো। কিন্তু তিনি কি আজকের মোসলিমা হয়ে উঠতে পারতেন! অসম্ভব। কিছুতেই নয়।
তবু তার মনে হয়, বড় ডিগ্রি, বড় চাকুরি অর্জন করলেও গতানুগতিকতার বাইরে তিনি কিছু করতে পেরেছেন বলে তিনি মনে করেন না। তবে তিনি চেষ্টা করেছেন, ছাত্রছাত্রীদের মনপ্রাণ ঢেলে শিক্ষা দিতে। ক্লাসের পড়ার বাইরেও সারাপৃথিবীর উৎকৃষ্ট উদাহরণগুলো তাদের সামনে টেনে এনেছেন। তার নিজের বিষয় বাংলা সাহিত্য ছাড়াও নতুন সব তথ্য নিয়ে তাদের সাথে আলোচনা করেছেন। তিনি নিজে যা শিখেছিলেন, তা শুধু জ্ঞানার্জনের জন্য নয়, তা বিলানোর জন্যও। আর বিলাতে বিলাতে অর্জিত বিষয়টি ভিন্নরূপে তার নিজের হয়ে উঠেছে। তার বাড়ির দুয়ারও তার ছাত্রছাত্রিদের জন্য উন্মুক্ত। এ জন্য তিনি সবার কাছে স্বতন্ত্র একজন।
তবু তিনি ভাবের, যেন একটি সাধারণ আটপৌরে মানুষকে তিনি অতিক্রম করতে পারেননি। সততায়-আদর্শে। মানবিকতায়। মনের জোরে। এত শক্তি-সাহস তিনি কী করে পেতেন! লিমা মোসলিমা হয়ে উঠতে উঠতে যতবার সে এই মানুষটির সাথে মনে মনে আলাপ জমায়, ততবারই তার মন গেয়ে ওঠে, …তুমি ফুলের বক্ষে ভরিয়া দাও সুগন্ধ,/ তেমনি করে আমার হৃদয় ভিক্ষুরে/ কেন দ্বারে তোমার নিত্যপ্রসাদ পাওয়াও না \’
আসলে জন্মের পর থেকেই তো তাকে একটু একটু করে দেখা। কই, ওভাবে তো আর কারো ছবি মনে ভাসে না! তার সমস্ত প্রহরগুলো কেন সেই চাচী এসে জুড়ে থাকেন। তিনি শাশুড়ি হওয়ার পরও লিমা তাকে মা অথবা আম্মা ডাকতে পারেননি। ওই ‘চাচী’ সম্বোধনেই তার প্রাণ মধুতে জড়িয়েছিলো। তাই তার ঘরে বউ হয়ে গেলেও নতুন সম্বোধনে তা পাল্টাতে হয়নি!
তার ওই চাচী ডাকের ভেতরেই তার কণ্ঠে এতো দরদ ছিলো, যে মা অথবা আম্মা ডেকে তখনকার লিমাকে সম্পর্কটি ভরাট করতে হয়নি।
লিমার পুরো না মোসলিমা খাতুন। কিন্তু সবাই মোসলিমাকে ছোট করে ডাকতো লিমা। লিমাদের বাড়ি থেকে মাত্র দু’বাড়ি পরে ছিলো আলী শেখের বাড়ি। মোসলিমার দাদা অন্য গ্রাম থেকে এসে ওখানে সস্তায় পাঁচ একর জমি কিনে পুকুর-বাগানসহ চারপাশে পরিখা কেটে বিশাল বাড়ি করেছিলেন। কাছাকাছি কিনেছিলেন অনেক ফসলি জমি। শহরে আছে তাদের পূর্ব পুরুষের আড়ৎ। এই গ্রামে বসতি গড়া তার দাদার যৌবনে। তার বাবা-চাচাদের তখন শিশু বয়স।
মোসলিমা জন্মেই দেখেছেন আলী শেখের পাঁচ ছেলেমেয়ে ও তাদের সবার জীবন যাপন। মোসলিমার চোখের সামনে এখনো ভাসে বয়স্ক হলেও শক্ত-সমর্থ আলী শেখ লাঙ্গল কাঁধে চার ছেলেকে বকতে বকতে জমিতে নিচ্ছে, কেন তারা জমিতে যেতে এত দেরি করে। প্রতিদিন কেন তাড়িয়ে নিতে হয়। এভাবে প্রতিদিন খেটেখুটেই তাদের পেটের ভাত অর্জন করতে হতো।
একে একে ওদের ছেলেমেয়ের সংখ্যা বাড়তে লাগলো। তার ওপর আলী শেখের একমাত্র মেয়ে রাজিয়া ফুপুও তার দুই বছরের ছেলে হারুনকে নিয়ে বিধবা হয়ে বাপের বাড়িতে এসে ওঠে। হারুনরা বড় হতে হতে আলী শেখের রথ পড়ে আসে। তার কথা আর কোনো ছেলে আগের মতো আর মানে না।
একদিন আলী শেখ স্ত্রী’কে বললো, তুমার ছাওয়াল মাইয়েরে কও, স-ব জুদা অইয়ে যাক। কামাই-কাজে কারুর মন নেই। আর সব বিষয়ে এট্টুহানি জাগার ভেতর এত্ত খেয়োখেয়ি ভালো নাগে না! তারা মনে হরে, তাগে বাপের গাঁঠিতি টাহা জম্মায়। তাই দিয়ে বাপ পুরো গুষ্ঠিরে চালায়ে নেবে।
জুদা হওয়ার কথা যখন উঠেছে, তার প্রতিধ্বনি ছেলেদের কানে পৌঁছুতেই সবাই এককথায় রাজি। সবার তখন ভাবখানা, ভিন্ন হয়ে যেতে পারলে যেন প্রতিদিন বাবার অধীনে থেকে বাধ্যতমূলক কাজে যেতে হবে না। প্রতিদিন এমনি এমনি খাওয়া জুটে যাবে।
আলী শেখ মানুষটা মানুষ হিসাবে খারাপ ছিলো না। বাপ হিসাবেও নিরপেক্ষ। সে তাই, তার ছোট বড় ঘর দু’খানায় যার যার প্রয়োজনানুসারে ভেতরে হোগলার বেড়া দিয়ে ভাগ করে দিলো। বড় ছেলের বউ অবশ্য এ বাড়িতে আসার বছর দুয়েকের ভেতর নিজের উদ্যোগে নিজেদের জন্য আলাদা একখানা ঘর তুলেছিলেন।
অন্যসবকিছু ভাগাভাগিতে এক-আধটু কম পড়লো যার, ভাগে সে নিম রাজি হলেও বাপের সামনে উচ্চবাচ্য করতে সাহস পেলো না। তারপর আলী শেখ তার নিজের পাঁচ বিঘা জমি মৌখিকভাবে পাঁচ ছেলেমেয়ের ভেতর বন্টন করে দিলো। শর্ত হলো চার ছেলে তাদের মা-বাবা দু’জনকে একসপ্তাহ করে খাওয়াবে।
বোন রাজিয়াকে ভাইদের সমান একবিঘা জমি দিলে আলী শেখের চার ছেলের চার বউয়ের ভেতর তিন বউই তাদের যার যার স্বামীকে মন্ত্র শোনাতে লাগলো, ‘ভাই যা পায়, বুন পায় অর্ধেক। তোমরা চার ভাই মিলে আব্বারে কও!’
আলী শেখের বড় ছেলে আফজাল শেখ বাদে আর তিন ছেলে তা তাদের বাপকে যেই বলতে গলা বাড়িয়েছে, আলী শেখ ঘরের বারান্দার চালের সাথে গুজে রাখা গরু পিটানো পাচুনখানা টেনে বার করতেই তিন ছেলে ঘরে ঢুকে যার যার বউকে কিলঘুষি মারতে মারতে বলতে লাগলো, আমার বাপের সম্পত্তি আমার বাপ তার মাইয়েরে কতটুক দেবে না দেবে, তোগে কাছে জাইনে দেবে নাকি? তোরা বাপের বাড়িরতে কে কতটুক আনছিস?’
চার ভাইয়ের মাথাপিছু সেই একেক বিঘা জমিতে আর একেক পরিবারে কী হয়। তার ভেতর নতুন ছেলেমেয়ে জন্মানো তো ঠেকে নাই। আগে থেকেই আলী শেখের ছেলেরা অন্যের জমিতে কাজ করতো। কেউ ক্ষুদ্র ব্যাবসাও করতো। তা ছাড়া যে কোনো কাজেই তার চার ছেলে বাপের মতো পটু ছিলো। ফিরোজার স্বামী পুলিশ বিভাগে সেপাইয়ের চাকরি করতো। রোড এক্সিডেন্টে তার স্বামী মারা গেলে রাজিয়াকে সরকার থেকে যে টাকা দেয়া হয়েছিলো, রাজিয়া তাই যক্ষের ধনের মতো নেড়েচেড়ে খেতো। সেই টাকার থেকেই কিছুটা দিয়ে আলী শেখ তাকে ছোট হলেও একখানা মজবুত টিনের ঘর করে দিয়েছিলো। বলেছিলো, তোর ছেলে যেন না ভাবে পরের বাড়ি আছি। তারে বুঝতি দিতি অবে, ঘরডা তার বাপের টাকার। আর ঘরের জমিডা তার মার। এ জমিতে তার মামাতো ভাইবুনির মতো তারও সুমান হক! এইটা ভাবতি না শিখালি সে পরমুখা স্বভাবের অইয়ে বড় অবে, আমি তা চাই না!
রাজিয়ার জন্য নতুন টিন কিনে ঘর বানানো হলে দেখা গেলো সেখানাই বাড়ির অন্য ঘরগুলোকে ¤øান করে দিয়েছে। তার ওপর আলী শেখের বড় ছেলের বউ রাবিয়া সুলতানা তাকে নিজে বøাউজ-পেটিকোটসহ বাচ্চাদের পোশাক বানানো শিখিয়ে দিয়েছেন। একটি শেলাই মেশিনও তিনি নিজের টাকায় ননদকে কিনে দিয়েছিলেন। তারপর বাচ্চাদের ফ্রক-শার্ট-প্যান্টের ছবি বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করে দিতে থাকলেন। কিছু ডিজাইন নিজে হাতে এঁকে দিতেন, একদিন তার চারপাশে গোল হয়ে কাজ দেখা কৌতুহলী মেয়ে-বউদের বললেন, কাউকে মাছ না দিয়ে তাকে মাছ ধরা শিখিয়ে দিতে হয়, বুঝলে তোমরা? এই যে আমি রাজিয়াকে এগুলো শেখাচ্ছি, তোমরা দেখো, রাজিয়া এই কাজগুলো এতো ভালো পারবে, যে আশপাশের সবাইকে তার কাছে আসতে হবে এগুলো তৈরি করতে!
কিন্তু মুশকিল হলো, হাঁড়ি-কোলা, ঘরের রুম ভাগাভাগির আগে ছেলেরা যেভাবে মা-বাবার দায় স্বীকার করে নিয়েছিলো, পরবর্তী সময়ে দেখা গেলো, তাদের দু’জনের পাত পর্যন্ত ছেলেদের ভাত পৌঁছাতে গড়িমসি হয়। যে যার মতো বাড়ি ঢোকে। খেয়ে-না খেয়ে, কম খেয়ে বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে গলগল-কলকল করে আবার বেরিয়ে যায়। আলী শেখ আর তার স্ত্রী’র তখন পেটের ক্ষুধা ছড়িয়ে যায় শরীর থেকে মনে। তাদের জোয়ানকালের কথা তাদের মনে পড়ে যায়। ছেলেমেয়েরা তাদের ছোটবেলা বাড়ি ঢুকে প্রথমেই মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরতো। কোথায় কী ঘটলো সব এসে মা-বাবার কাছে ঊর্ধ্বশ^াসে বলতো। স্বামী-স্ত্রী দুজনের কারো তখন সময় ছিলো না শিশুসন্তানদের মুখে পাড়ার অগোছালো খবর শোনার। কিন্তু তারা তাদের হাতের কাজ করতে করতে ভান করতো, যেনো স-বই শুনছে! কিন্তু এখন তাদেরকে শোনানোর জন্যও ছেলেদের আর কোনো কথা নেই। মেয়েও ঠেকায় পড়েছে বলে বাপের বাড়িতে এসে আশ্রয় নিয়েছে। এটাও আলী শেখ ও তার স্ত্রী ভালোই বোঝে।
আলী শেখ এখন প্রায়ই আক্ষেপ করে বলে ওঠে, যার যার ছ্ওায়াল মায়েরে ভাত খাওয়ায়ে হাঁড়ি উপুড় কইরে রাহে। আর কয়, আইজ রান্দা অইনাই! ভরা হাঁড়ি আর খালি হাঁড়ির শব্দ শুনতি শুনতি এহনো যদি না বুজি, কার গরে কী রান্দা অয়…। পাবি, তোরা এর পতিদান পাবি…। তয় আমি দ্যাখফো না এই আর কি! সিডাই বালো। সুন্তানের দুর্দিন আর কিডা দেখতি চায়! তোগে সুদিন আসুক বরং তাই য্যান আমরা দেইহে মরি!
প্রতিদিন শ^শুর-শাশুড়ির একই ধরণের শাপ-শাপান্ত শুনতে শুনতে ভিন্ন হওয়ার মাস ছয়েক পর একদিন, আলী শেখের বড় ছেলে আফজাল শেখের স্ত্রী রাবিয়া সুলতানা তার ঘর থেকে নেমে মধ্যউঠোনে দাঁড়িয়ে শ^শুরের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, ‘আব্বা, আপনি ক্যান আপনার জমি পাঁচ বিঘা সবাইকে আগের থেকে দিয়ে দিলেন? আর এখন ক্যান আপনার অন্যের ঘরের ভাতের জন্য অপেক্ষা করতে হয়? আপনাদের দুইজনকে আমি আগেও বলছি, আপনারা প্রতিদিন তিনবেলাই আমার ঘরে খান।
আলী শেখ বলে ওঠে, রক্তে যে টান পড়ে বড় বউ! তো এহন কি জমি ফিরাইয়া নেবো? তুমি কী কও? জমি লেইহে তো আর কেউরে দেইনাই!
বাড়ির বড় ছেলে আফজাল শেখ। আফজাল শেখ খুব নিরীহ টাইপের একটা মানুষ না হলেও তার মুখে মানায় না এমন কথা সে কারো প্রতি উচ্চারণ করে না। আর তা হয়েছে যাকে নিয়ে সে সংসার করছে তার প্রভাবে। তাই বাড়ির কোনো নাকাল অবস্থায়ই তার কোনো উচ্চবাচ্য থাকে না। কিন্তু তার স্ত্রী’র কথা ঠাসঠাস। তিনি সেই উঠোনে দাঁড়িয়েই বলে উঠলেন, এই আমি বললাম, এই আজকের থেকে আপনাদের দুইজনের দায়িত্ব আমার। আর কোনো ঘরের ভাতের অপেক্ষা আপনারা করতে পারবেন না!
আলী শেখ বলে উঠলো, কী কও বড় বউ? তোমার ছাওয়াল মাইয়ে ডাঙ্গর অইয়ে ওঠছে। বড় দুইজন স্কুলির বড় ক্লাসে ওঠছে। তুমাগেই কত খরচ? আফজালের দোকান তো ওইটুক এট্টা!
বড় বউ বললেন, আপনি তাইলে আপনার ছেলের দোকানের টাকাই হিসাব করছেন? আপনার বউমার রোজগারটা দেখেন নাই? যাক, সে সব আপনার ভাবতে হবে না। চারটে ভাতের জন্য মা-বাপ হয়ে আপনারা বিলাইয়ের মতো অপেক্ষা করেন। এই ইজ্জতহীনভাবে আপনারা কবরে গেলে আমার ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে লাভটা কি? তাদের অস্তিমজ্জার ভেতর বসবাস করবে পূর্বপুরুষের আত্মমর্যাদাহীন এক ছবি। তারা মানুষের চোখের দিকে কখনো সোজা দৃষ্টিতে তাকাতে পারবে না! আত্মবিশ^াস অর্জন করতে কয়েক পুরুষ লাগে। কথাটা আমার দাদাকে বলতে শুনেছি।
আলী শেখ তার বড় ছেলের বউয়ের কথায় হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দেয়। বলে, মারে আমি কী পুণ্য করছিলাম, যে ভালমন্দ কিছু না বুঝেই তুমারে আমি ঘরে আনছিলাম…।
রাবিয়া সুলতানার মেট্রিক পরীক্ষার কয়েক মাস আগে তার বাবা মারা যান। রাবিয়া সুলতানার আর পরীক্ষা দেয়া হয় না। কিশোরী রাবিয়ার জন্য পাত্র খোঁজা শুরু হলে, আলী শেখ অনেকটা দয়া করেই রাবিয়াকে বউ করে আনে। রাবিয়ার বাবা প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার ছিলেন। তারও তেমন কোনো জমিজমা ছিলো না। রাবিয়াকে কোনো যৌতুক দিতে পারেনি বলে, আলী শেখকে তার বাড়ির মানুষেরা বলতো, শ্যাখ, তুমি ছাওয়াল বিয়ে দিয়ে ঠইকে গেছো!’ আলী শেখ সোজা-সাপটা বুদ্ধির মানুষ। বউ যে কিছুটা লেখাপড়া জানা, এটাও যে একটা বলার বিষয়, তা বলেও আলী শেখ কারো কথার পাল্টা জবাব দিতে পারেনি। বরং তার মনে হয়েছে, লেখাপড়া সে আর কি! এখন তো ঘরে ঘরেই ছাওয়াল-মাইয়েরা স্কুলে যায়। তার নিজের ছেলেমেয়েরাও তো কোনোটাই একেবারে মূর্খ না। বাড়ির কাছে প্রাইমারি স্কুলের সব কয় ক্লাসই তো সবাই পড়ছে। এখন তার নাতিপুতিরা সবাই দল বেঁধে সেই তার বাপ-চাচাদের স্কুলে যায়। তবে হাইস্কুল বেশ দূরে। পাশের গ্রাম পাইককান্দিতে। বড় ছেলের ছেলে দুটো সেখানে যায় পড়তে।
রাবিয়া সুলতানা জোর দিয়ে বলার পর সেদিন থেকে সত্যিই আলী শেখ আর তার স্ত্রী অন্যকোনো ছেলের ঘর থেকে ভাত আসার অপেক্ষা করে না। মোসলিমার তখনকার শিশু চোখের সামনেই পরিবর্তনটা ঘটতে থাকে। পরবর্তী সময় যতই লিমা ওই বাড়িতে গেছেন, আলী শেখ আর তার স্ত্রী’র কথাতে আর কোনো আহাজারি শুনতে পাননি। মুখের রুক্ষ-সূ² হাভাতে ভাবটাও তাদের ক্রমে মিলিয়ে যেতে থাকে। রাবিয়া চাচী তার ছেলেমেয়ে তিনটিকে শিখিয়েছিলেন প্রতিদিন স্কুলে যেতে দাদা-দাদীকে বলে যাবে। তাদেরকে রেখে কোনো কিছু খাবে না। সম্মান করে কথা বলবে।
মোসলিমা স্বয়ং রাবিয়া চাচীকেই দেখতেন, যে কোনো কাজে তিনি তার শ^শুর-শ^াশুড়ির সাথে পরামর্শ করছেন। প্রতিবেলা, রান্না করতে গেলে শাশুড়িকে বলেন, আম্মা এইবেলা চাল কতগুলো দেবো?’ শাশুড়ি জানতে চাইতো, আগের ভাত কতগুনো আছে? তারপর সে যা বলতো, তা-ই যে চাচী রান্না করতেন, তা নয়। কিশোরী মোসলিমা একদিন রান্নারত রাবিয়া সুলতানার পাশে পাটি বিছিয়ে আরো ক’জনের সাথে অংক করতে করেতে জানতে চাইলেন, আচ্ছা চাচী, দাদী যা বলে, আপনি তো তা রান্না করেন না। আপনি তো আপনার মতো করেন! তাহলে কেন জিজ্ঞেস করতে যান দাদীর কাছে?
মোসলিমার মা’র সাথে রাবেয়া চাচীর খুব ভাব ছিলো। রাবিয়া চাচী মোসলিমাদের বাড়িতে বেশি যেতেন না। আর সেটা হতো তিনি সময় পেতেন না। তবে মোসলিমার মা নিজেই সম্পর্কে পাড়াতো জা এই রাবিয়া সুলতানার জন্য এটা ওটা নিয়ে আসতেন। মোসলিমাদের চার ভাইবোনকেই রাবিয়া সুলতানা তার ছেলেমেয়েসহ অন্যদের সাথে পড়াতেন। কারণ স্কুলে রাবিয়া সুলতানার ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খুব সুনাম ছিলো। কড়া শাসনে রেখে পড়াতেন তাদের মা। তাই রাবিয়া সুলতানার ছেলেমেয়ে তারেক, সায়েম, সৌমি একসময় মোসলিমাদের ভাইবোনের মতোই ছিলো।
সেদিন মোসলিমার প্রশ্নের উত্তরে রাবিয়া সুলতানা বলেছিলেন, যে মানুষ পাঁচ পাঁচটা ছেলেমেয়ে মানুষ করেছে। এতবড় সংসারটা একা সামলেছে, সেই মানুষটার এখন করার মতো কিছু নেই। অথর্ব। তাই তার বেঁচে থাকাটা যেন তার কাছে অসহনীয় না হয়ে ওঠে! তাই এটা ওটা জিজ্ঞেস করে বোঝাই এখনো তার বেঁচে থাকার দাম আছে।
শৈশব পেরোতে পেরোতে মোসলিমা তার এই চাচীর কাছে আরো কত কত প্রশ্ন যে রেখেছেন। তার প্রতিটি উত্তরে মোসলিমা চমকিত হয়েছেন। মোসলিমা একদিন বললেন, আপনি তো আপনার শ^শুর-শাশুড়িকে এমনিই খাওয়ান। তারওপর, তারা প্রতিদিন ডেকে ডেকে রাজিয়া ফুপুকে তরকারি দিয়ে দেয়!
চাচী বলেছিলেন, নিজের সন্তানের সামনে কেউ কিছু খেতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর বড় হলে, তোমাদের যখন এমন দিন আসবে, তখন মিলিয়ে নিও।
মোসলিমা যখন উঁচু ক্লাসে উঠে গেলেন, তখন সে আর রাবিয়া চাচীর কাছে পড়তে যেতেন না। তাকে স্কুলের এক মাস্টার এসে পড়াতেন। কিন্তু তারেক, সায়েম, সৌমি ওদের মায়ের সহযোগিতা নিয়ে নিজেরাই লেখাপড়া করতো। তবু মোসলিমাদের থেকে ওদের রেজাল্ট ভালো হতো। চাচী অবশ্য তার বিয়ের পর থেকে বাড়ির প্রায় সব ছেলেমেয়েসহ আশেপাশের সব স্কুলপড়–য়া সবাইকে লেখাপড়া করাতেন। একসময় নাইন-টেনের ছাত্র-ছাত্রীরাও তার কাছে পড়তে আসতে শুরু করলো। কারণ চর্চার ভেতর থাকতে থাকতে নাইন- টেনের বিদ্যাও তার আয়ত্ত¡ হয়েছিলো। স্কুলে পড়াকালীন সময়ে তার নিজের ছোট ভাইবোনদের পড়াতে পড়াতে তার নাকি এই অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো, সবাইকে ডেকে ডেকে পড়ানো। তাই চাচীর শ^শুরের নিজের প্রায় ত্রিশটি পরিবার বসবাস করা অতো বড় বাড়ি ছাড়াও আশপাশের সব বাড়ির স্কুল পড়ুয়া কেউ-ই বাকি থাকতো না চাচীর কাছে পড়া শিখতে আসতে।
তিনি প্রায় দিনভর বারান্দায় পাটি বিছিয়ে পড়াতে পড়াতে একদলকে ছুটি দিয়ে আরেক দল নিয়ে বসতেন। ওর ভেতরই চলতো তার সব সাংসারিক কাজ থেকে শিল্পিত সব ভ‚মিকাও। আর তা কারো রুমালে ফুল আঁকা। সুতার রঙ মিলিয়ে দেয়া। কারো একটা বøাউজ বা বাচ্চার জামা কেটে দেয়া। কারো একখানা চিঠি লিখে দেয়া। কারো মেয়ে দেখতে আসবে, তাকে সাজিয়ে বরপক্ষের সামনে নিয়ে যাওয়া। কোরমা-পোলাওটা নিজের চুলো রান্না করে দেয়া।
স্কুলে যে কেউ স্কুলে পিছিয়ে গেলে তাদের মায়েরা কান ধরে ধরে এনে রাবিয়া সুলতানার কাছে এনে হাজির করতো। আর সেইসব ছাত্রছাত্রীদের তিনি সারাজীবনের জন্য তরিয়ে দিতেন। এভাবে তার নাম স্কুলের স্যাররাও জানতেন। স্কুলে কেউ খারাপ করলে, শিক্ষরা গার্জিয়ান ডেকে তাকে রাবিয়া সুলতানার কাছে পাঠাতে বলতেন।
রাবিয়া সুলতানার বড় ছেলে তারেক যখন খুলনা থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করলো, তখনি একটা নামকরা মিলে তার চাকরি হয়ে গেলো এবং অল্পদিনের ভেতরে সিনিয়রদের ডিঙিয়ে তারেককে একটা উঁচু পদ দেয়া হলো। তারেকের এই গৌরব খুব উচ্চকিত হয়ে গ্রামে রটতে লাগলো। যতটা না তা তার মা-বাবা বলে, তার চেয়ে তার দাদা আলী শেখই বলে বেড়ায়। এখন আলী শেখ আর বারান্দার বিছানায় দিনরাত এককরে জড়সড় হয়ে বসে থাকে না। পান ফুরিয়ে গেলে স্ত্রী’র সাথে গালিগালাজ করে নূব্জ স্ত্রী’কে এঘরে-ওঘরে পান আনতে পাঠায় না। আলী শেখ এখন তার বংশের তৃতীয় প্রজন্মের প্রথমজনের প্রথম দেয়া কাশ্মিরী অফহোয়াইট শালখানা মজবুত করে গায়ে জড়িয়ে বড় রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে গিয়ে বসে থাকে আর পৌত্রের গল্প করে।
আর ওই চায়ের দোকান থেকেই আলী শেখের সমবয়সী মোসলিমার দাদা খন্দকার জমিরউদ্দিন আলী শেখের বাড়ির সব নতুন খবর তার বাড়িতে নেয়া শুরু করলেন। মোসলিমা তখন একবছর আগে মেট্রিক পাশ করেছেন। কলেজে পড়বে এমন স্বপ্ন তাকে কেউ দেখায়নি। কারণ আরেক গ্রামের স্কুলে গিয়ে মেয়েমানুষ মেট্রিক পাশ করেছে, সেটাই অনেক বড় বিষয়! বরং লেখাপড়া কম হলেও অবস্থাপন্ন, পরিবারের নাম আছে এমন পাত্রকেই প্রধান্য দিয়ে তার জন্য খোঁজা হচ্ছিলো। কারণ তাদের পরিবারের বংশ পরম্পরায় ধারণা, চাকরি যত বড়ই হোক, বেতন আর কত হবে! বরং জমি-জিরাত আছে, ছেলে ব্যবসা বোঝে এমন পাত্র কম বিদ্যান হলেও ভালো।
একদিন মোসলিমা খাতুনের বাবা মোসলিমার জন্য একটা পাত্র নিয়ে আলোচনা করছিলেন। দাদা বললেন, আমরা এই এলাকার ভেতর গণ্যমান্য। একশো বিঘা জমি আমার এখনো আছে। তোমাদেরকে আমি উচ্চশিক্ষিত না করলেও লেখাপড়া তো শিখিয়েছি! ওই বিদ্যাতেও তোমরা চাকরি বাকরি করতে পারতে। কিন্তু আমি তা দেইনাই। কারণ যার যতো টাকা, সম্মানও তার ততো, আমি এই মতে বিশ^াসী মানুষ। এই যে আমাদের আশেপাশে যারা আছে তারা সবাই কোনো না কোনোভাবে আমাদের আনুগত্য স্বীকার করে আছে। সেহেতু জামাইটা যেন আলী শেখের নাতির থেকে যোগ্য হয়। সে ক্ষেত্রে শহরে যে বউমার ভাইয়েরা থাকে, তাদের বলো ভাগ্নির জন্য পাত্র খুঁজতে।
দাদা এবং বাবার কথায় কী ছিলো, মুসলিমার মনে একটা দিক নির্দেশনা চিহ্নিত হয়ে গেলো। মুহূর্তে তার ভাবনার সবটুকু তারেক ছেয়ে ফেললো।
তার মনে হতে লাগলো হাত বাড়ালেই সে তারেককে পেতে পারে। যদি শুধু বাবা আর দাদা রাজি থাকেন! মোসলিমার মনে হতো, একটু ইঙ্গিত পেলে আলী শেখের পুরো বংশ এসে হামলে পড়বে ওদের দাওয়ায়। কিন্তু মোসলিমার দাদা খন্দকার জমিরউদ্দিনই একদিন এক খবর নিয়ে এলেন এবং ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনি নিয়ে সারধরে পাটিতে খেতে বসে খেতে খেতে সে খবর পরিবেশন করেন, আজ চায়ের দোকানে আলী শেখ বললো, তার নাতি তারেককে নাকি মিলের মালিক বিদেশে পাঠাবে উচ্চতর ট্রেনিংয়ের জন্য। সাথে মালিকের মেয়েকেও পাঠাবে। তয় দু’জনকে বিয়ে দিয়ে। তার মানে মেয়েও তারেকের মতো ইঞ্জিনিয়ার।
কেউ টের পেলো না মোসলিমা সেদিন তার সামনের খাবার রেখে উঠে পড়েছিলেন। সেই থেকে তার খাবার মুখে তুলতে গেলে অরুচি হয়। যে তারেক একসময় তাকে সমঝে কথা বলতো, সে এখন তার থেকে এতেদূরে! মা-বাবাকে বলার সাহস নেই। কিন্তু সেই কবে থেকে তিনি ভেবে রেখেছিলেন, তারেক এলে তাদের বাড়ি নিশ্চয় আসবে। তখন তিনি নিজেই তাকে বলবেন, আমি তোমার সাথে ঘর বাঁধতে চাই!’ কিন্তু সে আসেনি। অবশ্য প্রতিবার গ্রামে এলেই যে তারেক মোসলিমাদের বাড়িতে আসতো তেমনও নয়। কারণ একটা সময়ের পর যে কোনো বাড়িতে নিজের বয়সী কোনো ছেলে থাকলে আরেকটা ছেলে সে বাড়িতে অনায়াসে যেতে পারে। মুসলিমার ভাই তিনটি তার থেকে ছোট।
সেই যে ছোটবেলা অনেকে মিলে ইট বিছিয়ে, গামছা টাঙিয়ে ঘর বানিয়ে তাদের খেলা হতো। সবাই মিলে মোসলিমাকে বউ বানাতে চাইতো কারণ মোসলিমা ছিলেন সবার থেকে সুন্দর মেয়ে শিশু এবং একমাত্র তারই পুঁথির মালা, ছোট ছোট রঙিন চুড়ি, ইমিটেশনের দুল আর জরিপাড় ছোট শাড়ি ছিলো। একদিন তাকে তারেকের বউ সাজতে দেখে মোসলিমার দাদী কার কাছে খবর পেয়ে, এসে ছোঁ মেরে তুলে টানতে টানতে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলো। সেদিন দাদীর চোটপাটে সেই থেকে তারেকদের বাড়িতে গিয়ে তার ওসব খেলা বন্ধ।
কদিন ধরে আলী শেখের বাড়ির আরেক বিষয় নিয়ে জনেজনে কথা হচ্ছে। আলী শেখের দ্বিতীয় ছেলে আফসারের বিধবা মেয়ে রমিজার জন্য ভালো একটা পাত্র পাওয়া গেছে। পাত্রের বয়স একটু বেশি। তবে বিরাট ব্যাবসা আছে। ঢাকায় উচ্চবিত্তের এলাকায় বাড়ি আছে। পাত্রের আগের বউ তাকে ছেড়ে অন্যলোকের সাথে একেবারে বিদেশে চলে গেছে।
লোকটির ছেলেমেয়ে দুটিও বেশ বড়। তারা তাদের মতো থাকে। রমিজাকে ছাকু ঘটক গোপালগঞ্জ শহরে নিয়ে সে লোককে দেখিয়েছে।
রমিজাকে লোকটি পছন্দও করেছে। কিন্তু তিনি গ্রামে এই হতদরিদ্র পরিবারের ভেতরে এসে বিয়ে করতে রাজি নন এবং তিনি রমিজার ছেলেকে মাঝে মাঝে কিছু টাকা পাঠালেও রমিজা তার ছেলেকে নিজের কাছে নিয়ে রাখতে পারবে না। এই শর্তে রাজি থাকলে তিনি শাড়ি-গহনাসহ যাবতীয় সবকিছু রমিজাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন, সেসব পরে রমিজা গোপালগঞ্জ শহরে যাবে। সেখানেই কাজী অফিসে বিয়ে হবে। সেখান থেকে তিনি তার গাড়িতে করে রমিজাকে ঢাকাতে নিয়ে যাবেন।
উঁচু ডালের ফল পাড়তে হলে লম্বা আকশি লাগে। তাই অত উঁচুশ্রেণির পাত্রের প্রকৃত খোঁজ-খবর নেয়া সম্ভব হয় না। তবে বিধবা রমিজার ছয় বছরের একটি ছেলে আছে আর তা জেনেও যে শিক্ষিত বিত্তবান লোকটি বিয়ে করতে রাজি হয়েছে, এতেই পালের বয়স্কজন আলী শেখ বর্তে গেছে। রমিজার বয়স বাইশ। আর লোকটি যতই সুঠাম দেহের হোন, চুল কলপে কালো করুন, যার ছেলেমেয়ে দু’টি ইউনিভার্সিটি পাশ করে নিজেদের মতো থাকতে শিখে গেছে তার বয়স তো অন্তত পঞ্চাশ উত্তীর্ণ হবেই। তাহলে রমিজার থেকে সে কত বড় হয়, এই প্রশ্নটা আর কারো মনে না জাগলেও একজনের মাথায় ঠিকই জেগেছিলো। তিনি কঠোরভাবে মানা করলে তার স্বামী আফজাল শেখের ছোট ভাই আফসার শেখ আর আফসারের স্ত্রী মধ্য উঠানে দাঁড়িয়ে গলা চড়িয়ে তার উদ্দেশ্যে বলেছিলো, নিজির ছাওয়াল তো দুই হাত ভরে টাকা পাঠাচ্ছে। তাই দিয়ে কাঁচাঘর ভাইঙ্গে পাকা ঘর বানানোর জন্য ইট-বালি কেনছো! আমরাও এট্টু ভালো থাহি, তা চাও না ক্যান? আমাগে তো আর ভালো থাকবার উপোয় নাই। মাইয়েডারে বিয়ে দিলাম, সে বিধবা অইয়ে এট্টা ছাওয়াল নিয়ে ফিরি আসলো। দুইডে টাকা দূরি থাক, গায়ে একভরি গয়না দিছিলাম, তাও জামাইর চিকিৎসা করাতি খুয়াইছে…। বিয়ের পর নিজির চিষ্টায় মাইয়েডা আইএ পাশ করলো, এট্টা মানুষও তো নাই যে তারে এট্টা চাকরি দেয়। তা দিলিও তো এট্টা উপোয় অতো! এই যে রমিজার ছাওয়ালডা আছে, তবু তারা দাদা-দাদির কাছতে পাবে নানে ফেইসোডাও। নাই তো দেবে কোহানতে! ছোট মাইয়েডা মেট্টিক ফেল করলো, ওয়ারে দিই কি অবে? তারে বিদেয় হরতিও তো এতোগুলোন টাকা নাগবে। তাই বা কিডা দেবে? এট্টা মানষির খাটনির উপর এত্তগুলা প্যাট। আমরা জানি, রমিজা এ বিয়ে বসপে না বুইলা বড় চাচীর পায়ের উপর পড়ছে। কিন্তুক চাচীর কি উচিৎ না অবুজ মাইয়েডারে বুজানো! তাই কই, আল্লারওয়াস্তে তোমরা আর কেউ এ বিয়েতে বাঁদা দিও না…’।
আফসার শেখের স্ত্রী বড়ই বাজখাই। সে স্বামীর ওপর দিয়ে আরো এককাঠি। সে তার প্যাঁচাল অব্যাহতই রাখলো। বলতেই থাকলো, ছাকু ঘটক আমার বাপের বাড়ির কাছের মানুষ। সে মেলা জায়গা-জমিন কিনিছে এইরহম বড় বড় বিয়ের ঘটকালি কইরে।
বিয়ের নির্দিষ্ট তারিখের দুইদিন আগেই ছাকু ঘটক এলো। ঘটকের তল্পিবাহক হয়ে আসা এক কিশোরের মাথায় বিশাল এক নতুন আধুনিক সুটকেস দেখে জোয়ারের মতো বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ, ছেলেমেয়েতে উঠোনসহ বাড়ির ক’খানা ঘরের সবগুলো বারান্দাও ভরে গেলো। মেয়ে রাজিয়ার ঘরের একরুমে আলী শেখ তার স্ত্রী’কে নিয়ে থাকে। সেই ঘরের বারান্দায় সুটকেস রেখে ঘটক বললো, আমার অন্যখানে কাজ আছে। আরেক জাগায় এমন আরেকটা পাত্রীর সুন্ধান পাইছি, তারে আরেক পাত্ররে দেহাতি অবে। আমি যাবো সেইহানে পাশের গ্রামে। আমার তাড়াতাড়ি যাতি অবে। কেউ তোমরা সুটকেসটা খোলো। জিনিসগুনো বুজে নেও।
আলী শেখের বাড়িতে ওরকম আধুনিক সুটকেসের জিনিস বুঝে নেয়ার যোগ্য সৌমি ও সায়েম, ভালো হিসাব বোঝা মানুষ। আর বাড়ির বড় বউ এগিয়ে এলে তো আর কাউকে লাগে না! আলী শেখ তার বড় ছেলের ছোট দুই ছেলেমেয়েকে একসাথে তাদের নাম ধরে ডাক দিলো।
নিজের ঘরে থেকে রাবিয়া বেগম শ^শুরকে ধমক দিলেন। বললেন, আব্বা, সায়েমের ইউনিভার্সিটি খুলেছে। তাকে সকালে ঢাকা পাঠিয়েছি। সৌমি তার খালার সাথে খালার বাড়ি বেড়াতে গেছে। আর এর ভেতর আমরা কেউ থাকবো না! খবরদার বলে দিলাম, সৌমি-সায়েম কেন, ওদের বাবাও যদি এর ভেতর থাকে, তো আমার সাথে বাইরে বোঝাপড়া করে তাকে ঘরে ঢুকতে হবে।
আলী শেখ পারলে তার বড় ছেলের বউয়ের পায়ে ধরে। বলে, মা’রে, তুমার খাই। তুমার ফরি। তোমার পরিচয়ে সারাজীবনের পড়া মাথাডা এহন উঁচা কইরা চলি। কিন্তু ওগুলারে কই ফেলাই, যেগুলারে মানুষ করতে পারি নাই? ভাত দেয় নাই, তারপরেও তো তাগে চিন্তায় ঘোম আসে না।
অবশেষে সবকাজে আগবাড়িয়ে চলা আলী শেখের ছোট ছেলের বউ বড় ভ‚মিকা রাখতে এগিয়ে এলো। ঘটক তার হাতে চাবি দিলে, ছোট বউ সুটকেস খুলতেই ঠেসেভরা কাপড় চোপড় ঝুপঝুপ করে পড়তে লাগলো।
ভেতরে আরো কি আছে, যে ভুরভুর করে ঘ্রাণে মাটির সোঁদা গন্ধ ঢেকে যায়। মা-খালা-চাচী সহ সবার জন্য শাড়িই দিয়েছে খান বিশেক। তাও অনেক দামি। তার ওপর কনের জন্য আলাদা শাড়ি খানকয়েক। গহনার বাক্স খুলতেই মুরুব্বিরা সব আলী শেখের উদ্দেশ্যে একসাথে বলে উঠলো, শ্যাখ, কোনো শ্যাকরারে ডাইকে গয়নাগুলো দেহাইয়া নেও। এতো বড় বড় গয়না। ওজনও যহন মেলা, এগুনো আসল সোনার কিনা…।
মুরুব্বিদের কথা শুনে আধা বয়সী ঘটক এমন ধমক দিলো, যে অনেকেরই তাতে পা বেয়ে ভেতরের পানি উপচে হাঁটু বেয়ে পড়ার কথা!
রমিজার বিয়ের দিন বেলা বারোটা নাগাদ তারেক বাড়ি এসে হাজির। রাবিয়া বেগম সরগরম বাড়ির ভেতর তারেককে দেখে আঁতকে উঠলেন। বললেন, তুমি আজ বাড়িতে কেন?
তারেক বললো, দাদাভাই খবর পাঠিয়েছেন। রমিজার নাকি বিয়ে? খবর শুনে আমি কিছু টাকা দিতে চেয়েছিলাম না এসে। দাদাভাই, চিঠি লিখে জানালেন, তুমি পুরির বড়। যা হোক একটা কাজ হতে যাচ্ছে, তুমি না এলে আমার আত্মা শান্তি পাবে না!
এই বিয়েতে রাবিয়া সুলতানার অমত দেখে তার স্বামী আফজাল শেখ সেদিন নিজেই সকাল সকাল দোকান খোলার নাম করে কর্মচারি আসার আগেই পালিয়ে আছে। আর সেখানে রাবিয়া সুলতানার নিজের ছেলে কি না তার অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে এসেছে খুলনা থেকে! মা’র কাছে আগে চিঠি লিখে কিছু জানতেও চাইলো না! তিনি ছেলেকে নিজের মুখোমুখি করে বললেন, যদি আমার এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া না চাস্, এখুনি চলে যা। এ বিয়ের নামে একটা প্রহসন। আমার সামনে এটা ঘটতে পারে না! এমনও হতে পারে মেয়েটাকে এইসব গহনাগাটি টোপ দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কারণ এই ঘটক একবার জেল খেটেছে। তারপর পুলিসকে টাকা ধরিয়ে নিজের এইসব মেয়ে ধরা কাজ বজায় রেখেছে। পাঁচভরি সোনা আর ওই জিনিসপত্রর যা দাম, তার থেকে বেশিই পাবে রমিজাকে বিক্রি করলে। এটা আমার কাছে একটা ¯্রফে টোপই মনে হচ্ছে। এইসব কাজ যারা করে, তারা তো আর একা করে না। পিছনে লোক থাকে…।
তারেক তার মাকে থামিয়ে বললো, এসব বিষয় আমিও তো কিছু জানি। নাকি? তবে তোমার চোখের সামনেই তো সব ঘটেছে। একদিনের ঘটনায় তো আর পালকি আসেনি! তুমি এসব কথা এদেরকে আগে বুঝিয়ে বলোনি কেন?
: আমি আমার মতো করে আমি বারণ করেছিলাম। আর রমিজাও রাজি নয়। কিন্তু রমিজার মা আর বাবা মধ্যউঠোনে দাঁড়িয়ে আমার সাথে ঝগড়া করেছে। তারা মনে করেছে, ভালো বিয়ে হচ্ছে দেখে আমি হিংসায় রমিজাকে মদদ দিয়ে বিয়েটা ভাঙছি।
: তাই নাকি! তাহলে আমার থাকার প্রশ্নই আসে না’ বলে তারেক মাকে বললো, আসছি যখন চারটে খাবার দাও চলে যাই। শুধু শুধু দাদাভাই আমার সময় নষ্ট করলেন!
রাবিয়া সুলতানা ছেলেকে তাড়াতাড়ি বিদায় করবেন বলে পাতিলে যা ছিলো তাই ঢেলেপুছে খেতে দিতে লেগে গেলেন।
বাড়িতে বিয়ে হবে না। বিয়ে হবে গোপালগঞ্জ শহরে কাজী অফিসে। চন্দ্রদিঘলিয়া থেকে সাথে যাবে ঘটক আর রমিজার বাপ। তাই বাড়িতে বাড়তি মানুষের জন্য কোনো রান্নাবান্না খাওয়া দাওয়ার আয়োজন ছিলো না। রমিজার জন্য পালকি আসাতে কৌতূহলি মানুষে বাড়ি উপচে পড়ছে। এর ভেতর ঘটকের তাড়া, তাড়াতাড়ি রমিজাকে পালকিতে তুলে দিতে।
এদিকে ঘরের ভেতর থেকে তারেকের কণ্ঠ শুনে আলী শেখ দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলতে থাকে, বড় বউ তুমি আমার এমন পতিশোধ নিতি পারো এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনাই! আর খাবো না আমি তোমার ঘরের ভাত…। তোর ছাওয়াল তো আমার বংশের নাকি?
রমিজাকে যখন সাজিয়েগুজিয়ে পালকিতে তুলে দেয়া হলো, তার আর তার ছেলের কান্নায় যেন বাতাস ভারী হয়ে উঠলো। রাবিয়া সুলতানা ভেতর থেকে বাইরের মানুষের একত্রিত কণ্ঠের হায়হায় রবে রমিজার বেহুশ হওয়ার কথা শুনতে পেলেন। তিনি আচমকা দরজা খুলে বেরিয়ে এসে, ঘটকের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, পালকি ফিরিয়ে নাও। তারপর তার অন্য জা’দের উদ্দেশ্যে আঙুল উঁচিয়ে বললেন, রমিজা যাবে না। ওর গায়ের থেকে শাড়ি গয়না সব খুলে সুটকেসে ভরে দাও!’
সবাই একসাথে আশ্চর্য হয়ে উঠলো। ছলোছলো চোখে কমবেশি সবার কান্না থেমে আপন-পর, ছোট-বড় সবার চোখে একটাই প্রশ্ন, তাহলে?
ঘটক জানে এ বাড়ির বড় বউয়ের একটা আলাদা সম্মান আছে। তার মুখের ওপর কথা বলার বিপদকে সে উপেক্ষা করতে পারলো না। তার ওপর তার বড় চাকরি পাওয়া ছেলে এসে ঢুকেছে বাড়িতে।
বাড়িভরা নীরব, উৎসুক মানুষের ভিড়ে রাবিয়া সুলতানা বললেন, রমিজাকে আমি আমার ছেলের বউ করে নিচ্ছি!
তোমরা যা কিছু এনেছো, সবসহ পালকি ফিরিয়ে নিয়ে যাও। তারপর ছোট দেবর আদিল শেখকে বললেন, ছোট শেখ, বাড়ি ফাঁকা করো আর আপাতত মসজিদের ইমাম সাহেব কোথায় আছে, দেখো। তিনি এসে কলমাটা পড়িয়ে দিয়ে যাক!
বাড়ির মানুষ কারোই আর মুখে রা নেই। কিন্তু তারেক চিৎকার শুরু করলো। বললো, মা এ অধিকার তোমার নেই। তুমি জানো, আমার জার্মান যাওয়ার কাগজপত্র রেডি হচ্ছে। তোমাদেরকে বলেছি তো, আমাদের ইÐাষ্ট্রির মালিক তার ছোট মেয়েকে আমার সাথে বিয়ে দিতে চান বলে তোমাদের জানাতে বলেছিলেন। আমি তোমাদের জানিয়েছি। তোমাদের অমত হবে জানলে তো আমি এগোতাম না!
রাবিয়া সুলতানা চোখ বড় করে বললেন, বাবা, আমি এতগুলো মানুষের ভেতর কথা দিয়ে ফেলেছি যে। এই যে বাচ্চার কান্না যদি আমার সামর্থ থাকা সত্তে¡ও আমি না ঠেকাই আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না।
: তাই বলে আফসার চাচা আমার শ^শুর হবে? মা, আমার জীবন এখন আমার! আমি বড় হয়েছি! আর ওরা তোমাকে অপমান করেছে!
: সেটা তারা যা বুঝেছে, করেছে। কিন্তু আমি আমারটা বোঝাই। জীবন সবভাবেই সুন্দর করা যায়। শুধু ধরণটা পাল্টে। আর এতবড় একটি ত্যাগের ফলাফল আল্লাহ তোমাকে না দিয়ে পারবেন না। সবর করে দেখো!
: না মা, আমি মেলাতে পারছি না!
: তোমার ইÐাষ্ট্রির মালিক যদি তোমাকে বিদেশে পাঠানোর যোগ্য মনে করে থাকেন, সেটা তিনি এমনিই পাঠাবেন। অথবা তুমি নিজেই যেতে পারবে। নিশ্চয় আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে। পাকিস্তানের কবল থেকে মাত্র দেশ স্বাধীন হলো। মানুষের জীবনযাত্রার মান এখন বাড়তে থাকবে। এ দেশের ছেলেমেয়েদের এরকম বিদেশে যাওয়ার বহু পথ তৈরি হয়ে যাবে। তোমার ইÐাষ্ট্রির মালিকের মেয়েকে বিয়ে না করলে যদি তিনি তোমাকে জার্মানিতে না পাঠান, তাহলে সে যাওয়াতে আমার আপত্তি আছে। আমি তোমাদের তিন ভাইবোনকে যেভাবে মানুষ করেছি, রমিজাকেও তোমার উপযুক্ত করে আমি গড়ে তুলবো। আর ওর বাচ্চাটা তো এ বংশেরই সন্তান। ওদের দায়িত্বও তুমি নেবে। মানুষ চাইলে সব হয়। খালি ইচ্ছেটাই আসল! সবারই কেন একই রকম জীবন যাপন করতে হবে! অন্যদের মতো মিলিয়ে সমন্ধ করতে হবে!
: কিন্তু মা মানুষ কি বলবে?
: মানুষ তোমাকে আদর্শ হিসাবে দেখবে। মানুষ তোমাকে মানুষ হিসাবে দেখার সাহস পাবে না। দেখবে মহামানব হিসাবে।
ছেলের ওপর মায়ের মতামত চাপানোর একটা জোর তো মায়ের ছিলোই। সে শুভবোধ দিয়েই তো তিনি ছেলেমেয়ে মানুষ করেছেন। তবু রাবিয়া সুলতানার নাভিশ^াস উঠছিলো একাই ডোবা তরি ক‚লে টেনে তোলার মতো!
ঈমাম সাহেবকে খুঁজে পেতে আদিল শেখের দেরি হয়নি। দু’দিক থেকে দু’জনকে শুধু অজু করিয়ে বিয়ে পড়ানো হলো।
আর একজনকে দিয়ে আফসার শেখকে তার দোকানে খবর পাঠানো হলো কেজি দশেক মিষ্টি নিয়ে বাড়ি চলে আসতে। কি কেন, স্ত্রী’র আদেশের খালি এমন প্রতিউত্তর পাঠানোর সাহস আফজাল শেখের কোনোকালে ছিলো না। সে তাই মিষ্টি নিয়ে বাড়িতে ঢুকলেও তার সবকিছু বুঝে উঠতে সময় লাগলো।
মিষ্টি বিতরণের অনেক পরে যারা বাড়ি ছেয়ে থাকলো, তাদের ভেতরে তিনি স্বামীকে ডেকে বললেন, তুমি এভাবে কর্মচারিসহ হন্তদন্ত হয়ে চলে এলে যে, দোকানে তালা লাগিয়ে এসেছো তো?
এই বিয়েতে আফজাল শেখ যারপর নেই ক্ষুন্ন। তার মনে কত আশা ছিলো ছেলের উঁচু ঘরে বিয়ে হবে। বড়লোক বেয়াই আসবে। মানুষ তাকিয়ে দেখবে। তাই সে না হেসেই বললো, ঠিক মনে পড়তিছে না!
রাবিয়া সুলতানা বললেন, যাক লোকশান হলে আফসার শেখের হোক। তুমি আর ও দোকানে যাবে না।
এবার আফজাল শেখ চোখ বড় করে বললো, ক্যান?
: ওই দোকানে আফসার শেখ বসবে। দোকানে যা কিছু আছে দু’জন কর্মচারিসহ সব তাকে দিয়ে দিতে হবে। সে ওই দোকানের ইনকাম দিয়ে তার সংসার চালাবে। তুমি এখনি দোকানের চাবির ছড়া ওকে দিয়ে দাও। আর তুমি আপাতত বাড়িতে বিশ্রাম নাও। তোমার আরেক ছেলেও লেখাপড়ায় ভাল করছে। তারও ভাল চাকরি হবে ইনশাল্লাহ। তোমাকে আর ওই দোকানে মানায় না!’ স্বামীকে সাহস দিতে কথাগুলো একটু মজা করেই বললেন রাবিয়া সুলতানা। যেন এই সমন্ধটা সবার সয়ে যায়। খবরটা সবাই শুনে যায়। এর ভেতর বৃদ্ধ আলী শেখ তার মেজো ছেলে আর তার বউকে ঘাড় ধরে এনে তার বড় বউমার পায়ের ওপর ফেললো।
রাবিয়া সুলতানা ছিঁটকে সরে গিয়ে বললেন, ওদের সাথে এখন আর পায়ে পড়ার মতো সম্পর্ক নেই আব্বা। তবে এবার তারা নিজেরা নিজেদের শুধরে নিলে সবার রক্ষা হয়।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসে যখন যে যার ঘরে যাবে, তখনি আলী শেখের ছোট দুই ছেলের বউ এসে বড় বউয়ের দু’হাত চেপে ধরে বললো, বুজি, আপনি মাইজে ভাইজানের এতবড় উপকার করলেন। অত্ত বড় দোকানডা দিয়ি দেলেন, আমাগে দুইজনারে কী দেবেন, তা আইজই কবেন! অব্বা-আম্মা সাক্ষী থাকুক।
ছোট এই দুই জায়ের আব্দার তখন মন্দ লাগলো না রাবিয়া সুলতানার। তিনি হেসে বললেন, এই পরামর্শ করতেই বুঝি ঢেঁকিঘরের পিছনে গিয়েছিলে? যাক, এখন যা দেওয়ার মতো আছে তা আমি দেওয়ার মালিক নই। তবে তোমার ভাসুর যদি রাজি থাকেন, বাড়ির এই আমাদের ভাগের জমিটুকু তোমাদের এমনি দিয়ে দেবো। তোমাদের উঠোন বড় হবে। আর আমরা যে আমাদের শ^শুরের থেকে ভাগের ভাগ যে একবিঘে জমি পেয়েছি, সেখানা তো এই কাছেই। সেখানে নতুন করে মাটি কেটে বাড়ি বানাবো। এই ইট-বালি সেখানে টেনে নিয়ে যাবো, কি আর করা। কারণ আমাদের এখন বড় বাড়ির দরকার। আমার শেষ বয়সের জন্য একটা স্কুল বানাতে। যতদিন বাঁচি এই না করে তো থাকতে পারবো না! গ্রামের অধিকাংশ ছেলেমেয়ে লেখাপড়ায় কাঁচা থাকে বলে, বছরের পর বছর ফেল করে লেখাপড়া ছেড়ে দেয়। সামনে এগোতে পারে না।
উপস্থিত সবার মনে হতে লাগলো, আলী শেখের বড় ছেলের বউ যেন আলাউদ্দিনের চেরাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। যে যা চাচ্ছে, সব দিয়ে দিচ্ছে। বউটার হলো কি! সারাজীবন সবাই দেখেছে কেউ তার থেকে খালি হাতে ফেরে না। আবার তার তো কিছু কমেও না। দিনকে দিন একটু একটু করে বাড়ছেই।
ছোট আর সেজো বউ সরে গেলে একমাত্র ননদ রাজিয়া তার ছেলেসহ এসে বড় ভাবির পাশে দাঁড়ালো। বললো, আমারে যা দেয়ার, তাতো আগেই দিছো। আর আমার কিছু লাগবি বড় ভাবি। তুমি যে এই বংশের কপালে রাজটিকা বসাইছো, এতেই আমি খুশি। তুমি খালি আমার ছেইলেডারে মাথায় হাত দিয়ে দোয়া কইরে দেও, সে যেন তার বড় মামা-মামীর ছেইলেমেইয়ের মতো অয়!’ ননদের কথায় রাবিয়া সুলতানা তাকে বুকে টেনে নিলেন।
সেদিনই বিকেল নাগাদ তারেক খুলনা যাওয়ার জন্য তৈরি হতে হতে তার মাকে বললো, তোমাকে একটা কথা বলি মা। ভেবেছিলাম বলবো না…।
: ছেলেমেয়ে বড় হতে হতে তাদেরও কিছু কথা থাকে মা-বাবাকে লুকোতে। না বলতে চাইলে বলো না!’ রাবিয়া সুলতানা বললেন।
কিন্তু তারেকের ভাব দেখে রাবিয়া সুলতানা আবার বললেন, কিন্তু কথাটা কি, তা না শুনতে পারলে তো আবার আমার মন খচখচ করবে, যে ছেলেটা কী কথা বলতে চেয়েছিলো!
: মা, মোসলিমা আমাকে একটা চিঠি লিখেছিলো। সে লিখেছিলো, তার বিয়ের জন্য তোমাকে প্রস্তাব পাঠাতে!
: তাই? তুমি কি লিখেছিলে?
: আমি তো লাভলীর বিষয়টা মনে মনে স্থির করে ফেলেছিলাম। তাই এটা মাথায় রাখিনি। ভুলে গিয়েছিলাম।
: লাভলী মানে, তোমাদের ইÐাষ্ট্রির মালিকের মেয়ে?
: হ্যাঁ মা!
: বাবা রে যা ঘটলো, এটা দেখতে তুচ্ছ হলেও একটা বড় কিছু ঘটলো। এর পুরস্কার আল্লাহ তোমাকে দেবেন। এতবড় কাজের ফলাফল মানুষের হাতে থাকে না। বংশের সবাইকে নিয়ে এগোতে হবে। একা ওপরে ওঠা নয়, সবাইকে নিয়ে উঠতে চাইলে তার ভেতর একটা শান্তি থাকে। তুমি একা ওপরে উঠবে আর তোমার চাচাতো ভাইবোনরা মানুষের ক্ষেত-খামারে কাজ করবে। কুলিগিরি করবে, এর থেকে কতদূরে নিতে পারবে নিজেকে, যেখানে গেলে এসব ঘটনা তোমার কানে যাবে না। চোখে পড়বে না।’
তারেক কিছুটা রুষ্ট চোখে তাকিয়ে মাকে বললো, সব দায় মোচনের দায় এভাবে নিশ্চয় আমার ছিলো না!
: তোমার দাদা-দাদী জীবিত। তারাও যে স্বস্তি পেলেন, তারও তো একটা পুরস্কার আছে! তার সমস্ত জীবনের অবশিষ্ট ভারের কিছুটা আমরা নামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলাম।
: কি জানি মা। আমি এখনো বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছি না।
ছেলের সমস্ত নতুন আশা-ভরসায় আপাতত ছাই ঢেলে রাবিয়া সুলতানা যেন অদৃশ্য শক্তির দিকে সরাসরি তার বরাত ঠেলে দিচ্ছেন। তিনি আরো বললেন, তোমার বাবার পাঁচ ভাইবোনের ভেতর তিনি সবচেয়ে সহজ সরল। কিন্তু তোমার বাবার ছেলেমেয়ে একাই মানুষ হয়েছে। কারণ কি?
: কারণ তুমি শক্ত হাতে তার সংসারের হাল ধরেছো বলে। তুমি নিজে ছাত্রছাত্রি পড়িয়ে বাবার থেকে বেশি রোজগার করেছো বলে! বাবার দোকানটাও তো তোমার দেয়া!
: বেশি রোজগার করলেই সবার ছেলেমেয়ে মানুষ হয় না। যারা অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে, যারা অন্যের দুর্দশায় নিজের করণীয়টুকু না করে, তাদের ছেলেমেয়ে কার কাছ থেকে কী শিখবে? আর আল্লাহই বা কেন তাদের ব্যতিক্রম ফলাফল দেবেন! আমি যুক্তির বাইরেও একটা বিশ^াস রাখি। নাহলে আমিও কি বুঝি না, আমি আমার ছেলেকে কোনখান থেকে কোনখানে নামালাম!
তারেক ছুটি নিয়ে আসেনি। তাই যতটুকু সময় হাতে নিয়ে এসেছিলো, ততোটুকু সময় পর্যন্ত থেকে সে চলে গেলো। বাড়ির পরিবেশ আজ অন্যরকম। মানুষজনের আনাগোনা চলছেই। আজ আর আলী শেখ বাড়ি থেকে বের হয়নি। দোকানে যায়নি চা খেতে। আজ বরং তার মেয়ে রাজিয়াই তার বড় ভাবীর থেকে দায়িত্ব ও উপাত্ত পেয়েছে বড় পাত্র ভরে বাইরের চুলোয় চা বানানোর। বাবার পোতা চাকরি পাওয়ার পর থেকে বাবার চা’য়ের নতুন নেশা হয়েছে জেনে রাজিয়ই আজ মগ ভরে ভরে চা দিচ্ছে। সাথে খড়ির বেড়ার এপাশে আরো চাচীদের সাথে সেঁটে থাকা তার অনভ্যস্ত মা’কেও অভ্যস্ত করার চেষ্টা করছে। বাদ যাচ্ছে না সে চাচীরাও। ওদিকে বড় বউয়ের বারান্দায় বিছানো শীতল পাটিতে গাদাগাদি বসা মুরুব্বিদের হাতেও পৌঁছে যাচ্ছে সে ঘন দুধের চা!
আলী শেখের গল্প যারা রাস্তার পাশে দোকানে বসে শুনতো, আজ তারা সবাই তার বাড়িতে এসে শুনছে। আর জেনে যাচ্ছে, বড় রাস্তার কাছে আলী শেখের যে ফসলি জমি, তাতে তার নাতি বড় করে পাকা বাড়ি তুলবে। তার মা পাকা বাড়িতে গ্রামের ছেলেমেয়ের জন্য সাধ্যমতো একটা পাকা স্কুলও করবে। যে স্কুলে লেখাপড়া করলে আর বাইরে প্রাইভেট পড়তে হয় না। আলী শেখের বড় বউমা যখন মুখ দিয়ে বের করছেন কথাটা, তখন তোমরা মনে করো ও বাড়ি হয়েই গেছে! সাথে স্কুলও।’
এইসব ঘটনার বিশ বছরেরও পরে গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে। সেই তখন অন্ধকার ঘরে জানালার কাছে একা বসেছিলেন মোসলিমা। সেদিন তার মন ভীষণ খারাপ ছিলো। ভাবছিলেন, তারেকদের বাড়িতে আজ যা ঘটলো, আফসার চাচার বিধবা মেয়ে এক সন্তানের মা রমিজার সাথে তারেকের বিয়ে হলো। আর এই তারেককে নিয়ে সে স্বপ্ন দেখে বিভোর হয়েছিলো। মোসলিমা ভেবেছিলেন, তার চিঠি পেয়ে তারেক অভাবনীয় আবেগে ভাসবে। যা সে একা কেন তার বংশের কেউ কল্পনাই করতে পারার কথা নয়। কিন্তু একমাস পার হয়ে গেলো কোনো উত্তরও সে দিলো না! তারপর আবার এমন ঘটনা! রীতিমতো অপমানে জ¦লে যাচ্ছিলেন তিনি।
মোসলিমা জানালার পাশে ওভাবে বসে থাকতে থাকতে পার হওয়া সন্ধ্যায় দেখতে পেলেন, পাটখড়ি জ¦ালিয়ে কে যেন ধীরে ধীরে তাদের বাড়ির দিকে আসছে। তবে কোনো পুরুষ যে নয়, তা বোঝা যাচ্ছে চলার গতি দেখে। আরেকটু পরে তার মনে হলো একজন নয় দু’জন নারী এগিয়ে আসছে। কাছে এলে দেখলেন রাবিয়া সুলতানা চাচী, আর তার মেয়ে সৌমি।
রাবিয়া সুলতানার কন্ঠ শুনে বাড়ির সবাই যে যার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। এলেন মোসলিমার মাও। চাচী কারো বাড়ি খুব একটা আসেন না বলে সবাই তাকে ছেঁকে ধরলো। তারওপর আবার আজকের ঘটনা নিয়ে একেকজন একেকরকম প্রশ্ন করে যেতে লাগলো, তিনি কেন এমন আত্মঘাতী কাজটি করতে গেলেন। কিন্তু রাবিয়া সুলতানা কারো প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলেন না। তিনি কেবলি অন্যান্য প্রসঙ্গ টেনে এনে সবার কৌত‚হলকে চাপা দিতে চাইলেন। এর ভেতর আরেক পাশ থেকে মোসলিমার দাদা খন্দকার জমিরুদ্দিন তাকে ডেকে বললেন, তোমার ছেলের কাছে তার কোম্পনীর মালিক মেয়ে বিয়ে দিয়ে বিদেশে পাঠাতে চেয়েছিলেন বলে। তা তুমি ছেলেটার ভাগ্যটাকে এভাবে কবর দিলে কেন?
রাবিয়া সুলতানা গম্ভির হয়ে মোসলিমার দাদার প্রশ্নের উত্তর দিলেন, আপনি ভুল শুনছেন চাচা। আমার ছেলের সাথে মেয়ে বিয়ে দিয়ে জার্মানিতে পাঠাতে চাননি। ছেলেকে ট্রেনিং দিয়ে আনলে তাদের কোম্পানির উন্নতি করতে পারবে তাই। আর তাদের মেয়েও মেয়ের যোগ্যতায় যাবে। বিয়ে হলে ভাল ছিলো, এই আর কি। হলো না বলে বোধহয় আমার ছেলের বিদেশ যাওয়া ঠেকে থাকবে না। কারণ যোগ্যতা থাকলে অন্য কোম্পানীর মানুষের নজরেও সে পড়বে!
: কিন্তু আলী শেখের পরিবারটা তো তাতে জাতে উঠতো!
: এ আপনি কেমন কথা বললেন, চাচা? একজন কৃষকের যদি জাত না থাকে, তাহলে যারা শুধু ফসল বিক্রি করে খায়, যাদের ছেলেরা রাখি ব্যাবসার মোটা টাকা গোণে, ফড়িয়াগিরি করে চলে, তাদের জাত থাকে কী করে?
: কথাগুলো কি তুমি আমাকে বললে আফসারের বউ?
: না তো চাচা। যারা ওসব করে তাদের বলছি।’ কথাগুলো বলতে বলতে রাবিয়া সুলতানা যে পথে এসেছিলেন, সেই পথের দিকে পা বাড়ালেন। কারো সাহস হয় না খন্দকার জমিরুদ্দিনের মুখের ওপর কথা বলা কাউকে খন্দকারের সামনে টেনে তাকে ঘরে তুলতে। কিন্তু মোসলিমার মনে হয়, রাবিয়া চাচী তাকেই কিছু বলতে এসেছিলেন। তিনি তাই নিজের ঘরে তাকে টেনে নিলেন, তার আপত্তি সত্তে¡ও। রাবিয়া সুলতানা রুষ্টভাব নিয়ে বললেন, আমি তোমার কাছেই এসেছিলাম। কিন্তু আমি যা বলতে এসেছিলাম, এখন আর বলতে ইচ্ছে করছে না। খেই হারিয়ে ফেলেছি। আসলে আজ যা আমি করছি, আমি যে তা জেনেবুঝে করছি, তা নয়। মনে হলো, এইসব আমাকে দিয়ে কেউ করিয়ে নিলো। আমার মাথার ভেতর হাঁটছে আমার আরো অনেক স্বপ্ন। যে স্বপ্নের একটিও আমার নিজের জন্য নয়। তবে আমি জানি না আমি পারবো কি না রমিজাকে যথাযোগ্য শিক্ষিত করে তারেকের যোগ্য করে তুলতে। তার সন্তানটিকে তার ছায়ায় মানুষ হওয়ার সুযোগ দিয়ে পৃথিবীতে অন্তত দুটি প্রাণের হাহাকার রোধ করতে। মনে হয় একটা মানুষ চাইলে সব ভাঙন রোধ করতে পারে না, কিন্তু কিছু তো পারে! আমি অন্তত সেই চেষ্টাটা করেছি রে মা, যেটুকু আমার সাধ্য ছিলো!
: চাচী, আপনি আমার কাছে কেন এসেছিলেন?
: আজ যাই মা। আরেকদিন না হয় গিয়ে শুনিস!
: চাচী, আমি জানি না, আমার কেন এত কষ্ট হচ্ছে! দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমার কষ্টটাই হয়তো আজ আপনাকে টেনে এনেছে!
রাবিয়া সুলতানার দৃষ্টি কেমন গভীর হয়ে ওঠে। তবু তিনি হেসে বলেন, কষ্টটা কি আমার জন্য, যে আমি আসাতে তা লাঘব হবে?
: মনে হয় তাই চাচী। আপনি ছাড়া তো আদর্শ মানবার মতো সামনে কাউকে দেখি না। তাই তো আপনিই জুড়ে আছেন অন্তরের সবটুকু। আমি তো আর কোনো স্বপ্ন দেখেতে শিখিনি। আমি শুধু একজন রাবিয়া সুলতানা হতে চাই! যিনি ভালমন্দ যা-ই বুঝুন, তা তার সবাইকে চাপানোর হিম্মত রাখেন। এখনো তো বিদ্যাটুকু নাড়াচাড়া করতে গেলে আপনিই বিদ্যুতের মতো তাতে চমকে ওঠেন! সব আপনার শেখানো। ক্লাসের পড়া পড়ানোর পরও আপনি বই জোগাড় করে আমাদেরকে পড়তে দিতেন। আপনার সময়ে আপনি কী বই পড়েছেন, সেগুলো পর্যন্ত যতœ করে রেখে আমাদের দিয়েছেন পড়তে। কেন যে বড় হয়ে গেলাম। আর আপনার থেকেও দূরে সরে গেলাম! কেন যে এবাড়ি-ওবাড়ির সেই মধুর দিনগুলো হারিয়ে গেলো। আমাদের এত বড় বাড়িটা আপনার ওই তিন রুমের পুরনো টিনের ঘরের সাথে তুলনা করলে আমাদের বাড়িটাকে আমার খোয়াড় মনে হয়। গতানুগতিকতা থেকে যারা বেরোনোর চেষ্টা করে না! নতুন কোনো কিছুর চর্চা নেই। মান্ধাতার আমলের রীতিনীতি কচলানো ছাড়া।
মোসলিমার সাথে গল্প করতে করতে অনেক রাত হয়ে যায় রাবিয়া সুলতানার। এর ভেতর মোসলিমার মা শ^শুরের ভয়কে তোয়াক্কা না করে তাদের মা মেয়েকে খেতে সেধেছেন। রাবিয়া সুলতানা খাননি। কিন্তু সৌমি পার পায়নি।
রাবিয়া সুলতানা মোসলিমাকে বলেছেন, আজ আমার কোথাও যাওয়ার কথা নয়। কারণ ঝুঁকির ধকলটাতে আমার যে বুক কাঁপছে না, তা নয়। তারওপর মানুষের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মতো রুচি হচ্ছে না। তবু তোমাকে একটা কথা বলতে আসছি। কথাটা হলো, তুমি আবার লেখাপড়া শুরু করো। চারচারটে বছর গ্যাপ দিয়েছো। ক্ষতি বেশ হয়েছে। আমাদের ধারেকাছে কলেজ নেই। প্রতিদিন গোপালগঞ্জ যাওয়া আসা মেয়েদের জন্য অসম্ভব। কারণ যোগাযোগ ব্যাবস্থা ভালো নয়। তুমি হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করো। অথবা কোনো আত্মীয় আছে কি না!
: না চাচী। অতো আপন কেউ নেই। আর বাবা, দাদা দু’জনের কেউই রাজি হবে না। একটা দিনের জন্য পাশের গ্রাম মামাবাড়িতেই যেতে দেয় না মা ছাড়া।
: সৌমি মেট্রিক পাশ করলে আমি তো যেখানে যেভাবেই হোক, ওকে যে কোনো কলেজে ভর্তি করে দেবো। মেয়েদের লেখাপড়া করে স্বাবলম্বী হওয়াটা জরুরী। নাহলে তো তারা মানুষই না। ক্রীতদাসী। উপার্জন না করা বউ আর বাড়ির কাজের লোকের ভেতর আমি তো কোনো তফাৎ দেখি না এবং কাজের লোকেরা একবাড়িতে না পোষালে অন্যবাড়িতে কাজ খোঁজে। কিন্তু বিয়ে করে আনা বউ? তার তো খোয়াড় পছন্দ হোক না হোক, সংসার মনে করে থাকতেই হয়! সবাই চরিত্র চরিত্র করে, অজ্ঞ-অন্ধজনের ধারনায় যে চরিত্র, তা ধুয়ে পানি খাবে! পরিশ্রম যে মেয়ে করতে শেখে, মোটকথা প্রশিক্ষিত যে কোনো মেয়ের সাথে যে কাউকে হিসেব করে কথা বলতে হয়। খালি সার্টিফিকেট দিয়েও কিছু হবে না। অনেক এমএ পাশ মহিলাকে দেখেছি, প্রাইমারিতে পড়া নিজের ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া করানোর যোগ্যতা নেই। তাই অর্জিত বিদ্যাটাকে সব ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে জানতে হবে!
রাবিয়া সুলতানা দম নিতে থামলেও মোসলিমা কথা খুঁজে পাননি। তাই রাবিয়া সুলতানা আবার শুরু করেন, এই যে চারচারটে বছর ধরে পাশ করে ঘরে বসে আছো, দু’চারটে ছেলেমেয়ে পড়ালেও বিদ্যাটা শান হতো। এটা শুধু টাকার জন্য করে না মানুষ। তাই লজ্জার তো কিছু ছিলো না! ছুরি-কাঁচি ধার দিলে যেমন শান হয়, বিদ্যাও ধার না পেলে মরিচা ধরে…।
: ঠিক বলেছেন চাচী! এখন তো তাই লেখাপড়া সম্পর্কে ভয় ধওে গেছে, আর পারবো কি না!
রাবিয়া সুলতানা বুঝতে পারেন, ওবাড়ির সবাই যে যার মতো শুয়ে পড়েছে। সৌমির খোঁজ নিয়ে দেখলেন সে মোসলিমার বিছানায় ঘুমিয়ে কাদা হয়ে আছে। বাড়ি থেকে বের হতে শাশুড়িকে বলে এসেছেন, খন্দকার বাড়ি যাচ্ছি। দেরি হতে পারে। তবে এতো দেরি হবে তা তিনি ভাবেননি! পাশাপাশি বাড়ি বলে কেউ এগিয়েও নিতে আসেনি।
রাবিয়া সুলতানা এদিক ওদিক চেয়ে বললেন, শোনো মুসলিমা, যা বলতে আসিনি, তা-ই এখন বলা শ্রেয় মনে করছি তোমার দাদার কথার পিঠে। আর যা বলতে এসেছিলাম, তা বলে লাভ হবে না…।
: চাচী, আপনি যা ইচ্ছে বলেন, শুনতে তো পারি!
: বলতে এসেছিলাম, তুমি লেখাপড়া করো। কিন্তু তোমার তো গা ঝাড়া দিয়ে বেরোনো কোনো উপায় দেখি না!
: ঠিক বলেছেন চাচী।
: আচ্ছা, সায়েমকে তোমার কেমন লাগে?
: কোন হিসাবে?
: যদি বলি স্বামী হিসাবে?
: চাচী, সায়েম আমার থেকে এক বছরের ছোট!
: সে আমি জানি। তুমি ভাবো। আর যদি মনে করো ওকে তোমার পছন্দ হয়, তোমাকে একাই আমার শ^শুরের ভিটায় গিয়ে উঠতে হবে! কোনো প্রস্তাব পাঠিয়ে আমরা অপমানিত হতে পারবো না!
: তারেক ভাই আপনাকে কিছু বলেছে?
: বলেছে বলেই তো ছেলের পরকালের দায় মিটাতে আসছি। তাকে তোমার চিঠির উত্তর দেয়া উচিৎ ছিলো। অথবা আমাকে জানানো উচিৎ ছিলো। তুমিও কি আমার পর! চিঠির কথা শোনার পর থেকে মনে হচ্ছে এই অপারগ কষ্টটা যেন আমার আরেকজন সৌমি পেয়েছে! তুমি চিঠিখানা তারেককে না লিখে তারেকের মাকে লিখতে। তাহলে হয়তো আগেই বিহিত হয়ে যেতো। তবে একটা কথা, আমি তো জানি না, এরি ভেতর সায়েম কাউকে পছন্দ করে ফেলেছে কি না! যদি তা না হয়, তাকে বোঝানোর ভার আমার!
: কিন্তু আমি যে ওর বড়, এটা কি সায়েম মেনে নেবে? আর ও তো লেখাপড়ায় এগিয়ে গেছে। আমি তিমিরে…।
: তিমির থেকে আলোতে টেনে নেবো বলেই তো এই পথ ছাড়া আর কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না!
রাবিয়া সুলতানা মোসলিমাদের বাড়ি থেকে যখন বের হলেন, রাত তখন অনেক। তার আসাটা খন্দকার বাড়ির সবাই দেখেছে চলে যাওয়াটা কেউ দেখেনি। তবে মোসলিমাদের বাড়ির সবাই পরে ভাবছে তারেকের মা মোসলিমাকে কী দিয়ে গেল যে সে অমন আনমনা হয়ে গেলো। মোসলিমা ক’দিন নিজের ভেতরে বিষয়টা চেপে রেখে তার মাকে বললেন। মা সব শুনে বললেন, তার বাবাকে। বাবা বললেন, তার বাবাকে। মানে মোসসলিমার দাদাকে। খন্দকার জমিরুদ্দিন তা শুনে সিংহের মতো হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন। বললেন, তোমাদের মাথা খারাপ হয়েছে? আলী শেখ আমার ক্ষেতে কত কাজ করছে। আর তার নাতির সাথে আমার নাতনির বিয়ে?
মোসলিমার দাদি বললেন, বিষয়টা দূরের হলে কথা ছিলো না। কিন্তু বাড়ির কাছে তো। চোখে লাগে। আমাদের ইজ্জত সাতহাত ডেবে যাবে।
মুসলিমার মা বললেন, আম্মা, আপনারা বেঁচে আছেন, তাই আপনাদের ওপর দিয়ে আমার কথা চলে না। তবে মনে হয় সমন্ধ করতে অতীত নয়, ভবিষ্যৎ দেখতে হয়। আব্বাই তো খবর নিয়ে আসতো, তারেকের সাথে তার কোম্পানীর মালিক তার তারেকের সমান সমান লেখাপড়া করা মেয়ে বিয়ে দিতে চায়! সেখানে আমরা কি? আপনারা আপনার ছেলেদের মোটামুটি লেখাপড়া শিখিয়ে আড়ৎদার বানিয়ে খালি বছর বছর টাকা বাড়াতে শিখিয়েছেন। এই প্রজন্মেরও একটা ছেলেমেয়েকে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন আপনারা দেখান না। আপনাদের ছেলেমেয়েগুলোও হয়েছে তেমন। পুরনো গৎবাঁধা নিয়ম ভাঙতে মা-বাবার অবাধ্য হতে হলেও হওয়া উচিৎ।’
মোসলিমার দাদা বড় খন্দকার আবার হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন তার এই বড় পুত্রবঁধুটির ওপর। বললেন, আমি মরলে তোমরা যা খুশি করো। আমি বেঁচে থাকতে আলী শেখ আমার সাখে একপাতে বসতে পারবো না!
মোসলিমার মা মনে মনে বললেন, তা হলে ততদিনই অপেক্ষা করি!
সায়েম ইকোনমিক্সে এম পাশ করলো। বিসিএসেও উত্তীর্ণ হলো। তার আগেই রাবিয়া সুলতানা মুসলিমা সম্পর্কে একটু বলে রেখেছিলেন। কিন্তু সায়েম তাতে সহজে রাজি হয়নি। কারণ দুটো। প্রথমত মুসলিমা তার বড়।
দ্বিতীয়ত সে মেট্রিক পাশ করে আর লেখাপড়া করেনি।
রাবিয়া সুলতানা ছেলেকে বুঝিয়েছেন, মানুষের দ্বারা সবই সম্ভব। আর মোসলিমা তোমার বড় তা কজন মনে রেখেছে! মনে রাখলেই কি, এ বিষয়ে লেখাপড়া করে দেখো, পুরুষের চেয়ে নারী বড় হলেও কোনো অসুবিধে নেই। যদিও তা নারীরা নিজেরাই তাদের শক্তির সন্ধান পায় না। তবে সময় এসেছে মূল্যায়ণের। নিজের থেকে স্ত্রী’র বয়স বেশি এরকম কটা উদাহরণ চাও? সত্যজিৎ রায়ের মতো মহান শিল্প¯্রষ্টার স্ত্রী বিজয়া রায়ও তার থেকে কয়েক বছরের বড় ছিলেন এবং সে বিয়েটি করতে সবার অমতে গিয়ে সত্যজিৎকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। তবু বড় ভালবেসে তিনি সবার অমতে বিজয়াকে বিয়ে করেছিলেন। আরেক কথা, মোসলিমা সব বইপত্র জোগাড় করেছে, সে প্রাইভেট পরীক্ষা দেবে।
: মা বিয়ের বিষয়ে এটা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এটা ব্যাতিক্রম।
: আমি চাই আমার ছেলেমেয়েরাও ব্যতিক্রম হোক!
ঘরে বসে পাড়ার স্কুলপড়–য়া ছেলেমেয়ে পড়াতে পড়াতে স্কুলের লেখাপড়পায় মা-ই বারবার ফার্স্ট হবেন এ বিশ^াস রাবিয়া সুলতানার সব ছেলেমেয়ের থাকলেও, তারা সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রিটি নিয়ে এসে মায়ের ওপর আর সে ভরসা রাখতে পারে না। তারপর রাবিয়া সুলতানাকে বাঁকাপথ ধরতে হয়। বলেন, আমি জানি শহুরে উচ্চবিত্ত পরিবারে বিয়ে করতে পারবে। কিন্তু বাড়িঘরের চেহারা যতই বদল করো, তোমার মাকে তো তারা জানবেন আন্ডার মেট্রিক এক খেটে খাওয়া নারী। যাতে তিনবেলা নাড়ার চুলোয় রান্না করতে হয়। তোমার বাবাকে দোকানদারের আর কি বেশি ভাববেন? কিন্তু খন্দকার তোমার দাদাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলেছেন। তার প্রতিশোধ নেয়াও কি তোমাদের কোনো ভাইয়ের উচিৎ নয়? গ্রামে ভালো পরিবারে সমন্ধ করার ভেতর একটা রাজনীতিও থাকে। দলে ভারী হওয়া। সেইটা না হয় তোমাকে দিয়ে হলো!
সায়েম বেশিক্ষণ চুপ করে থাকতে পারে না। মায়ের ওপর মৃদু চটে উঠে বলে, মা, ভাইকে বিয়ে দিয়ে তুমি যা করলে, তা আত্মঘাতী কাজ করলে!
রাবিয়া সুলতানা ধীরে ধীরে বললেন, আমি গোড়া থেকে সংস্কার চেয়েছি। এর সুফল এক প্রজন্ম পর আসবে। গোড়ার গলদটা আগে সরালাম। আমি তোমার দাদার বড় পুত্রের স্ত্রী হিসাবে এটা আমার কর্তব্য ছিলো তাকে তার মানসিক বিপর্যয়ের থেকে রক্ষা করা। তিনি যেন শান্তিতে মরতে পারেন। তোমার দাদা আমাদের চরম দুরবস্থার ভেতর আমাকে ছেলের বউ করে এনেছিলেন এবং সারাজীবন আমাকে উনি মায়ের মতো সম্মান করেছেন। বড় মানুষকে বড় প্রতিদানই দিতে হয়! আমি যা করেছি, অনেকটা তার জন্যও করেছি!
সায়েম বললো, কিন্তু তুমি তো বাবার চেয়ে বেশি লেখাপড়া জানা!
রাবিয়া সুলতানা বললেন, এ বাড়িতে কম লেখাপড়া জানা ছেলেদের বেশি লেখাপড়া জানা বউ আরো ক’জন আছেন। তা তোমরা ক’জন জানতে পেরেছো? কার কার শ^শুর কাকে কাকে ডেকে সে কথা বলেন?
সায়েম মুসলিমাকে বিয়ে করতে রাজি জেনে খন্দকার বাড়িরই গরজ উপচে পড়তে থাকে। কারণ সে শিক্ষক হিসাবে একটি সরকারি কলেজে নিয়োগ পেয়েছে। তারপর থেকে খন্দকারদের পুকুরে যেদিন জাল ফেলা হয়, অর্ধেক মাছ চলে আসে আলী শেখের বাড়ি। আর সেই মাছ রাবিয়া সুলতানা মধ্য উঠোনে দাঁড়িয়ে তার চার দেবর-ননদের ঘরে যার যার পরিবারের সদস্যানুযায়ী ভাগ করে দেন। নিজে যা রান্না করেন, বাড়ির অন্যসব মুরুব্বিদেও ডেকে শ^শুরের সাথে একসাখে খাওয়ান। দুই পরিবারের ব্যাবধান নিয়ে কথা বলার চেয়ে মানুষ অপেক্ষা করে শুভ কাজটি কবে সম্পন্ন হবে।
মোসলিমাকে বউ করার আগেই রাবিয়া সুলতানা বলেছিলেন, তোমার কাছে আমার একটা শর্ত। আর সেটা তোমাকে পুরণ করতে হবে। তা হলো, বিয়ের পর তুমি সর্ব্বোচ্চ ডিগ্রিটি অর্জন করবে। এর ভেতর ছেলেমেয়ে পেটে এলে তাকেও রাখতে হবে। লেখাপড়া বাদ দেবে না। ছেলেমেয়ে হলে আমি পেলে দেবো। অথবা তোমার রাজিয়া ফুপুকেও পাশে পাবে। লেখাপড়া শিখে সরকারি স্কুল-কলেজে চাকরি না পেলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি তো পাবে! অন্তত কলেজে যেন শিক্ষকতা করতে পারো! মোসলিমা সেদিন রাবিয়া সুলতার কথাগুলো শুনেছিলেন ঠিকই। কিন্তু বিশ^াস করতে পারেননি, তিনি জীবনে তা সফল করতে পারবেন।
মুসলিমা প্রায়ই ভাবেন, দ্বিধা-দ্ব›েদ্ব আকণ্ঠ ডুবে চিঠি লিখেছিলাম তারেককে। উত্তর না পেয়ে অনুশোচনায় মরে যেতে ইচ্ছে করছিলো। ওপরে ওঠার উজ্জ্বল সিঁড়ি ফেলে আমার চিঠিতে তারেক ফিরতো না এটা আমি বুঝতে পারি। কিন্তু তবু যে সে তার মাকে কথাটা বলেছিলো, তাতেই তার মা যে সহমর্মিতা দিয়ে বিষয়টি দেখেছিলেন, নাহলে এরচেয়ে ভাল ঘর-বর দেখে বিয়ে হলেও তার আজকের মোসলিমা খাতুন হয়ে ওঠা হতো না! কে তাকে ইন্টার থেকে লেখাপড়ার সুযোগ দিতো? লেখাপড়ার পরিবেশ তৈরি করা থেকে প্রেরণা যুগিয়ে চলা, এ তো সবার কর্ম নয়! রাবিয়া সুলতানাকে মা বা আম্মা ডাকতেন না মোসলিমা। আগের মতো চাচীই ডাকতেন। সবাই তাতে আপত্তি করলে, রাবিয়া সুলতানা বলেছেন, মায়ের থেকে চাচী আর কতদূরের! ঠিকাছে লিমার যা ইচ্ছে ডাকুক!
মুসলিমা ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে বাংলায় মাস্টার্স করেছিলেন। তবু তার কেবলি মনে হতো, সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রিটি অর্জন করলেও চাচীর মতো আলোকিত হতে পারিনি। চাচীর মতো অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করতে পারিনি। পারিনি জীবনে তেমন একটাও অন্তত মহৎ সিদ্ধান্ত নিতে!
মোসলিমা শাশুড়ির প্রতিটি পদক্ষেপ পর্যলোচনা করে শিউরে ওঠেন। সমাজ-সংসারের সাধারণ নিয়ম টপকে কেমন করে তিনি এই সিদ্ধান্তগুলো নিতেন এবং নিজের ধারণাতে অটল থাকতেন। স্বামীর সরলতা বা একগুঁয়েমি কোনোটা নিয়েই তিনি কখনো কটাক্ষ করে কথা বলেননি বরং বুঝিয়ে নিজের মতে এক করেছেন, এ বিষয়টাও তার কাছ থেকে শিক্ষণীয় ঠেকে।
পুরনো বাড়ি ছেড়ে নিজ তদারকিতে নতুন বাড়ি করলেন। মেয়ে সৌমিকে আমাদের কাছে রেখে বুয়েটে পড়ার সুযোগ দিলেন। তারপর সৌমি নিজে পছন্দ করে বিয়ে করলো। এখন সে চাকরি ও সংসার একসাথে করছে।
রমিজাকে নিয়ে তারেক কানাডায় সেটেরড। রমিজার সেই ছেলে, যে তার মাকে পালকিকে উঠতে দেখে দম বন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছিলো, সে এখন কানাডার একটি নামকরা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং তারেক রমিজার একটি মেয়ে হয়েছে। সেও ওখানে পরিবেশের ওপর লেখাপড়া করেছে।
মোসলিমা ভাবেন, কোনো কাজে আজো চাচীর তাড়াহুড়ো নেই। এই বয়সে এসে এখনো তিনি সব সময় কিছু না কিছু করছেন। রাজিয়া ফুপুকে যখন চাচী শেলাই কাজ শেখাতেন, মুরুব্বিরা কেউ কেউ বলেছিলেন, বড় বউ, তুমি দেখি সব বানাতে পারো। তাহলে কেন, তুমি নিজে শেলাই করো না?’
উত্তরে চাচী বলতেন, আমার মাস্টারি করতেই ভালো লাগে। আমি যখন থাকবো না, তখনও আমার শেখানো বিদ্যা, আমার বুলি, আমার পরামর্শ মানুষ বয়ে বেড়াবে, এটা ভাবতে আমার খুব ভালো লাগে।
রাবিয়া সুলতানা কিছুদিন আগে হঠাৎই মোসলিমাকে আচমকা একটি প্রশ্ন করলেন। যা তার স্বভাবের সাথে যায় না। মোসলিমা একটু বিব্রত বোধ করলেন তাতে! তবু হেসে তিনি বললেন, চাচী, এতো বছর পর আপনার মনে এই প্রশ্ন কেন এলো?
: প্রায়ই মনে হয় আমি সেসব সিদ্ধান্ত আমার ছেলেমেয়ের ওপর চাপিয়েছি, আমি খুব বেশি অন্যায় করে ফেলেছি কি না! বিশেষ করে তুমি তো ভালোবাসতে তারেককে। সেখানে সায়েমের সাথে আমি যে জোড়াটা বেঁধে দিলাম, তুমি এবং সায়েম তোমরা দু’জনকে পেয়ে দুজনই সুখি হতে পেরেছো তো? নিজের ছেলেকে তো এ প্রশ্ন করা যায় না। তাই…।
: এ প্রশ্নটা কি আপনার এখন মনে এলো, না কি আগেও হতো?
: আগেও হতো। কিন্তু পৃথিবীতে সবকিছুরই ক্ষমতা আছে নিজের থেকে ঠিক হয়ে যাওয়া। তাই আমার বিশ^াস ছিলো, তোমরা যে যার মতো মানিয়ে নেবে, সেটা সায়েমের সাথে তুমি। তারেকের সাথে রমিজা! কিন্তু তবু তোমাকে নিয়ে একটা খটকা আমার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তাই জানতে ইচ্ছে করে তোমরা দুজন একে অপরকে নিয়ে সুখি তো?
শাশুড়ির কথায় মোসলিমা ভাবতে লাগলেন, সুখ-দুঃখকে কখনো তো কোনো সংজ্ঞায় ফেলে মাপতে যাইনি! সংসার-সন্তান- লেখাপড়া-চাকরি সব মিলিয়ে জীবনটা তো রেলগাড়ির মতো গড়গড়িয়ে চলছে। তার প্রতি সায়েমের উচ্ছ¡াস যেমন কোনোদিন টের পাননি। তেমনি দায়িত্ব পালন বা মনোযোগেরও অভাব ছিলো না। তারপরও কোথায় যেন আবছায়ার মতো তারেক ছিলো তার মনের কোথাও। বা মোসলিমা নিজেই রেখেছিলেন একটুকরো সোনার কুটোর মতো। সেদিন অতো বছর পর শাশুড়ি প্রশ্নটা করে ভালোই করেছিলেন। সেই তখনি মোসলিমা লেগে থাকা ছায়াটাকে খুব বাহুল্য মনে করে তাড়িয়েছেন। মোসলিমা প্রচÐভাবে বুঝেছিলেন, তার জন্য সায়েমই যথার্থ।
দুইদিন পরে তিনি শাশুড়িকে উত্তর দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, চাচী, ইচ্ছে করে সময় নিলাম যে আপনার প্রশ্নটা নতুন কোনো বোধ সৃষ্টি করে কি না। আমি একটি সত্য উত্তর আপনাকে দিতে চেয়েছিলাম। বিশ^াস করেন, ঘুরেফিরে একটা দৃশ্যই আমাকে একটা কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরিয়ে নেয়।
: যেমন?
: সেই যে বিকেল নাগাদ আপনি আপনার বড় ছেলের সাথে এক সন্তানের মা, দেবরের বিধবা মেয়ে রমিজাকে বিয়ে দিলেন। তারপর জানতে পারলেন আমি তারেককে চিঠি লিখেছিলাম। সে কথা শোনার পর বেলা থাকতে সময় পাননি। রাতে আমাদের বাড়িতে পাটখড়ি জ¦ালিয়ে সৌমিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। পাটখড়ি জ¦ালানো পথের সেই আগুনের আলোটুকুই আমাকে এইখানে নিয়ে এসেছে। বাবা-দাদা আমাকে বড় ঘর-বর দেখেই বিয়ে দিতেন। আমি অবশ্যই বড় ঘরনি হতাম। কিন্তু আমি তো আজকের মোসলিমা খাতুন হতাম না! তাই আমার মনের বাহুল্য আবর্জনা ওই আগুনেই পুড়ে যায়!
রাবিয়া সুলতানা আশ^স্ত হলেন, তার ছোট বউমার কথায়। কিন্তু তাকে কিছু বললেন না!
নতুন বাড়িটাতে স্কুল করে, বাড়ির আরো ক’জন শিক্ষিত মেয়েকে দক্ষভাবে বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখানোর ট্রেনিং দিয়ে রাবিয়া সুলতানা গ্রামেই থাকতেন। তবু মোসলিমার ছেলেমেয়ে হওয়ার পর প্রায়ই সহযোগিতা করতে তার কাছে চলে আসতেন, ওই মেয়েদের ওপর দায়িত্ব দিয়ে। ট্রেনিং দেয়া মেয়েদের একজন আফসার শেখের ছোট মেয়ে রাফেয়া। রমিজার ছোটবোন।
রাবিয়া সুলতানা একাই নন, তিনি কখনো তার ছোটছেলের বউ মোসলিমার কাছে ননদ রাজিয়াকেও পাঠাতেন। কখনো শহুরে বাতাস গায়ে লাগাতে পাঠাতেন স্বামীকেও। মোসলিমা শাশুড়িকে বলতেন, চাচী আমিও তো গ্রামেরই মেয়ে। দৌড়-ঝাঁপ করে বড় হয়েছি। আপনার মতো আমিও সব সামলাতে পারি। আপনি পাশে থাকলে আমার সাহসটা বেড়ে যায় বটে। কিন্তু নিজের কাজের ক্ষতি করে আমার সুবিধা-অসুবিধা বড় করে দেখলে আমার ভালো লাগে না!
সায়েম মহম্মদ ঢাকার বাইরের একটা কলেজের প্রিন্সিপাল। প্রতি সপ্তাহেই তিনি ঢাকাতে আসতে পারেন না। কখনো মাসও পার হয়ে যায়।
মোসলিমার ছেলেমেয়ে দুটিই ডাক্তার। নিজেদের কাজে তারা ব্যস্ত থাকে। শাশুড়ির বয়স হলেও যখনি আসেন, মোসলিমা নিজের সাথে সাথে সবখানে তবু তাকে নিয়ে যান। এমনকি নিজের কর্মক্ষেত্র কলেজে নিয়েও কলিগদের সাথে পরিচয় করিয়েছেন। শাশুড়িকে সামনে রেখে সবার সাথে গল্প করেছেন, কীভাবে তিনি মোসলিমার থেকে একবছরের ছোট সায়েমের সাথে মোসলিমার বিয়ে দিয়েছেন সেই অন্ধকার আমলের গ্রামে। বলছেন, যখন আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ দূরে থাক রাস্তাও ছিলো না। পাশের গ্রামের হাইস্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেছিলাম। তখন বৃষ্টি নামলে হাঁটু সমান কাদা মাড়িয়ে দীর্ঘ পথ যেতে হতো…। সেই তখন আমার শাশুড়ি সত্যজিৎ রায়কে তার ছোট ছেলে সায়েম মহম্মদের সামনে উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরেছিলেন আমার সাথে বিয়েতে রাজি করাতে।
চিঠিখানা লেখা হলে মোসলিমা সায়েমকে ডেকে বললেন, এই নাও চিঠিখানা। আজ তো বৃহস্পতিবার। রোববার, তরশু কলেজে গিয়ে কাউকে দিয়ে পোস্ট করাইও। তার আগে দেখে নিও, কী লিখেছি। কাকে লিখেছি।
সায়েম চিঠিখানার ভাঁজ খুলে বললেন, ও, মা’কে লিখেছো? ত্রিশ সেকেÐে তিনি চিঠিখানা পড়ে শেষ করে মোসলিমাকে পাজাকোলে তুলে চক্কর খেতে খেতে বললেন, ‘তুমি প্রিন্সিপাল হয়েছো! আর আমাকে এখনো বলোনি!’
ভাগ্যিস, বাসার কাজের লোক তখন ছুটিতে ছিলো!
সুপ্ত মনের জাগর ধ্যান
দীলতাজ রহমান
জামিলুর রহমান একটি বড় অফিসের ছোট কর্মকর্তা। ছোট দুটো বোনের বিয়ে দিয়ে মাকে নিয়ে মা-বাবার কেনা ফ্ল্যাটে শান্তিনগর থাকে। জামিল বিয়ে করবে না করবে না বলে বয়স বত্রিশ ছুঁয়েছে। বোন দুটির বিয়ের পর পরিবারের অবশিষ্ট কোনো দায়-দায়িত্ব ছেলের জন্য ছিলো না। তাই মা-বাবা একসাথে তাকে বিয়ের জন্য পীড়াপীড়ি করতে করতে মাত্র ছ’মাস হলো কোনো জটিল রোগ-বালাই ছাড়াই অকস্মাৎ বাবা গত হয়েছেন।
এর ভেতর একসন্ধ্যায় জামিল অফিস থেকে ফিরেই মাকে বললো, আমি একজনকে পছন্দ করেছি। এবার বিয়ে করবো। ‘বত্রিশ পেরুনো, চাকুরিজীবি, তার ওপর মায়ের একমাত্র ছেলে বিয়ে করবে, মায়ের প্রাণ আনন্দে ভরে যাওয়ার কথা। কিন্তু ছেলে যেভাবে বললো, তাতে একজন সাধারণ স্কুল শিক্ষিকা, মধ্যবিত্ত পরিবারের আটপৌরে মা খায়রুন্নাহার অবদমিতই হয়ে গেলেন। যেন ছেলের বিয়েতে পাত্রী সম্পর্কে মায়ের মতামত, দেখাশোনার মতোও কোনো ভ‚মিকা থাকতে নেই।
সেদিন ছেলের এই কথার পর থেকে মা এ-বিষয়ে ঘরে আর কোনো কথা বলেন না। এভাবে ছেলের সাথে কেটে যায় এক সপ্তাহ। কিন্তু খায়রুন্নাহার ছেলের বিয়ের বিষয়ে ছেলের সাথে কথা না বললেও ফোনে ফোনে তার মনের ভাব জাহির করতে থাকেন দু’দিকে দুই মেয়ের কাছে। বলেন, আমার একমাত্র ছেলে বিয়ে করবে এ তো আমার জন্য সবচেয়ে সুখের কথা। ছেলের বউ দেখতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে তোমাদের বাবাকে গত হতে হলো। কিন্তু আমাকে তো জামিল মেয়ের পরিবারের বিষয়ে আগে সবকথা খুলে বলবে, কেমন কি। আমার তো মনে হচ্ছে আমাদের কারো মতামতের কোনো অবকাশ না রেখেই ও একা ওর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে! প্রতিদিন সে মেয়ের সাথে দেখাও করছে বলে মনে হয়।
দুটি বোনই জামিলের ছোট। বড়টির নাম হেনা। ছোটটি হাসনা। জামিলের বোন দুটি একই রকম করে মাকে বোঝায়, ‘মা, বিষয়টা এতো ভারী করে তুলো না তো! ভাইয়া বিয়ে করে একা বউ বাড়িতে নিয়ে এলে সেটা আমাদের জন্য আরো ভালো। কারণ আমরা ঠিক করলে দেখা যেতো ভাইয়া কখন মাঝপথে সটকে পড়ে আমাদের বিপদে ফেলেছে। মনে নেই তোমার, বাবা মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে পাত্রীর বাড়িতে গিয়ে আলোচনার দিন সে পালিয়েছিলো। আমাদের আগে যেতে বলে সে যায়নি। তারপর পাত্রীপক্ষ আমাদের কেমন ধোলাইটা দিলো। বাবাকে বলেছিলো, আপনারা ছেলের মতামত না নিয়ে এতদূর এগিয়েছেন কেন? এই নিয়ে তো তোমার জামাইদের কাছেও আমরা দু’বোন মুখ খুলতে পারি না!’
এক সপ্তাহ পরে একদিন জামিল একটি আঙটি কিনে মাকে বললো, ‘হেনাকে এবং হাসনাকে আগামীকাল ছুটির দিন আসতে বলেছি। ওরা যার যার হাজবেন্ডকে নিয়ে আসবে। দুপুরে আমাদের এখানে খাবে। বিকেল নাগাদ আমরা তাসরিনদের বাসায় যাবো। তুমি আঙটি পরিয়ে বিয়ের দিন ঠিক করে আসবে।’
খায়রুন্নাহারের যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো। মনে মনে ভাবলেন, যাক, ছেলে এটুকু দায়ভাগ না দিলেও তার করার কিছু ছিলো না। পরদিন সবাই হৈচৈ করেই পাত্রী দেখতে গেলো। পাত্রী জাহির করার মতো সুন্দরী না হলেও সবারই পছন্দ হলো। তাসরিনের বাবা-মা দু’জনেই ব্যাংকের উঁচুপদে চাকরি করেন। তিন বোন তারা। এটা দ্বিতীয়। ইডেন থেকে মাস্টার্স করে চাকরির চেষ্টা করছে। বিসিএসের জন্যও প্রস্তুতি চলছে। আপাতত একটি বেসরকারি কলেজে পড়াতে ঢুকেছে। ছোট মেয়ে মাহরিন হলিক্রসে থার্ড ইয়ারে পড়ছে। বড় মেয়ে শারমিন একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করছে। সেখান থেকেই কলিগকে পছন্দ করে বিয়ে করেছে।
গোছানো ড্রয়িং রুমের দরজা গলিয়ে যতদূর দৃষ্টি যেতে পারে, আত্মীয়-স্বজন সম্পর্কে যা শুনে চলেছেন, পুরোটা ভালো লাগছে খায়রুন্নাহারের। কিন্তু খাবার মুখে তুলে তিনি টের পেলেন সব বিস্বাদ লাগছে এবং ক্রমে এও টের পেলেন তার ভেতরটা দমে আসছে। আর তার কারণ এই বিয়ের যিনি ঘটক, ছেলের ইমিডিয়েট বস সাব্বির আদনান। সাব্বির সম্পর্কে কনের বাড়ির কেউ নন। সে কলেজে পড়াকালীন সময় থেকে ওদের তিন বোনকে পড়াতো। পড়াতে পড়াতে সে তাদের বড় ভাইয়ের স্থান অধিকার করে আছে। বাড়ির ছেলের মতোই তার সারাবাড়িময় অবাধে যাতায়াত। কনের মা-বাবা দু’জনই এখনো সাব্বির সম্পর্কে খুবই স্নেহপ্রবণ বুঝলেন খায়রুন্নাহার। তাদের দু’জনেরই যখন অফিস ট্যুর করতে হয়েছে, তখন সাব্বিরই নাকি রাতে এসে এদের বাসায় থেকেছে। মোট কথা সাব্বির তাদের মেয়েদের বড় ভাইয়ের স্থান জুড়ে আছে। আর এই কথাগুলো পাত্রপক্ষের কাছে বলতে তাসরিনের মা-বাবা দুজনেই খুব আত্মপ্রসাদ বোধ করছিলেন। বলেছিলেন, একটা সময় থেকে তাদের মনে হয় না, সাব্বির তাদের ছেলে নয়!
খায়রুন্নাহার আড়চোখে দেখছেন রসুইঘর থেকে নাস্তা টেনে আনা থেকে পরিবেশন করতেও সাব্বিরই বেশি তৎপর। চৌকশ কর্মকর্তা হিসাবে অফিসেও সাব্বির আদনানের অনেক সুনাম। জামিলের কাছে খায়রুন্নাহার অনেকবার তার নাম শুনেছেন। জামিলকে সাব্বির আদনান পছন্দ করেন খুব। তাই নিশ্চিন্তে ভগ্নিতুল্য তাসরিনের জন্য তাকে মনে ধরেছে।
কিন্তু খেতে খেতে টেবিলের সব সাবাড় হয়ে এলেও খায়রুন্নাহার ছেলের মা হিসাবে তাসরিন বা তার মা-বাবাকে কোনো প্রশ্নই করছেন না। বিয়ে সংক্রান্ত কোনো প্রসঙ্গও তুলছেন না। আর এতে তার দুই মেয়েসহ জামাইয়েরাও বিব্রত বোধ করতে শুরু করলো। যেন তারা খেতেই আসছে। জামিলের তো ধৈর্য বাঁধে এসে ঠেকেছে। কিন্তু মাকে তা বলতে পারছে না কারণ, মায়ের প্রতি তার আচরণের ধরণ দেখে আবার যদি বিয়ে ভেঙে যায়। যদি তাসরিনের মা-বাবা মনে করেন, জামিল একটা বেয়াদব!
সবার খাওয়া শেষ হলে কিছুক্ষণ পর খায়রুন্নাহার তার ভ্যানিটি ব্যাগ খুললেন। এতে সবাই ভেবেছিলো, তিনি আঙটি বের করছেন। কিন্তু আঙটি নয়, তিনি পাঁচ হাজার টাকা তার ব্যাগ থেকে বের করে, আরেক হাতে একটি প্যাকেট খুঁজে বের করে, সবার সামনেই তাতে টাকাটা পুরে সামনে বসা তাসরিনের হাতে দিয়ে, তার মা-বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমরা আজকে যাই। আরেকদিন আপনার মেয়েকে আঙটি পরাতে আসবো’ বলে কাউকে কিছু না বলে খায়রুন্নাহার একাই উঠে পড়লেন। দুইপক্ষের সবার এতক্ষণের উৎফুল্ল মুখ ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া হয়ে গেলো। জামিল একটু সরে দাঁড়িয়ে মাকে ইশারা দিলো তার কাছে যেতে। মা তাকে ঝাড়া কণ্ঠে বললেন, আমরা দুদিন পরে আসি!
খায়রুন্নাহার গাড়িতে উঠতে উঠতে মেয়ে-জামাইদের উদ্দেশ্যে বললেন, তোমাদের তো এখান থেকেই যার যার বাসায় ফেরার কথা। কিন্তু আগে আমাদের বাসায় চলো। আমরা এতবড় সিদ্ধান্তটি নেয়ার আগে, সবাই মিলে আরেকটু আলোচনা করি।
অতএব সবাই যখন যে যার গাড়িতে আগেপরে মালীবাগ থেকে শান্তিনগর খায়রুন্নাহারের ফ্ল্যাটে পৌঁছুলো। খায়রুন্নাহার তখন সবাইকে ড্রইংরুমে বসতে বলে দক্ষ রাঁধুনী প্লাস গৃহকর্মীকে বলে এলেন সবার জন্য ডিনারের আয়োজন করতে। এর ভেতর তিনি জামিলের সাথে একই গাড়িতে এলেও পথে একটি কথাও বলেন নি! জামিল অনবরত ফোঁসফোঁস করেছে। বলেছে, ‘এইজন্য তোমাকে আগে থেকে বলিনি। তুমি আম্মা খুব ঝামেলার মানুষ!’ ছেলের এতো বড় অভিযোগের পরেও খায়রুন্নাহার চুপ করেই ছিলেন।
খায়রুন্নাহার নিজেই চা এনে টেবিলে রেখে বললেন, এই গল্পটা তোমাদের কাছে এভাবে করতে হবে, এই এমন দিন আমার জীবনে আসবে আমি তা কখনো ভাবিনি! বিষয়টা ভুলেও গিয়েছিলাম। ওখানে গিয়ে মনে হলো, ধীরে ধীরে পর্দা সরে নাটকের দৃশ্যের মতো চোখের সামনে পুরনো একটি গল্প ভাসতে লাগলো।
জামিল মাকে ধমকে উঠলো, যা বলতে চাও খোলাশা করে বলো তো আম্মা! এতো ভ‚মিকা করো না!
খায়রুন্নাহার জানেন ছেলের রগচটা স্বভাব। তাই তার কথায় যেন কর্ণপাত করলেন না, এমন ভাবধরে চুপ হয়েই থাকলেন।
কিন্তু বহু পুরনো সে গল্পটা যেন টেপ রেকর্ডার ছেড়ে নিজে আবার শুনছেন। গল্পটা তার স্বামী একরামকে শুনিয়েছিলো তারই একজন বুজম ফ্রেন্ড। খায়রুন্নাহারও বিয়ের আগে একরামুল হকের বন্ধু ছিলেন। একসাথে তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়েছেন। আজীবনই তাদের সম্পর্কটা বন্ধুর মতো করেই দু’জন রেখেছিলেন। তাই স্বামীর বন্ধুদের অনেকেই খায়রুন্নাহারের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। এর ভেতর আনোয়ার ছিলেন কলেজজীবন থেকে একরামুলের বেশি ঘনিষ্ঠ। আনোয়ার দারুণ চৌকশ, দারুণ রোমান্টিক ছিলেন দেখতে। একদিন তিনি একটু বেশিই প্রগলভ হয়ে খাবার টেবিলে খায়রুন্নাহারের সামনে নিজের অতীত জীবনের এক গল্প বলতে শুরু করেছিলেন। গল্পটি এরকম-
কলেজে পড়ার সময় একবাড়ির তিন মেয়েকে পড়াতাম। দীর্ঘদিন পড়াতে পড়াতে ওই বাড়ির ছেলের মতো হয়ে যাই আমি।
মেয়ে তিনটির মা-বাবাও একসময় আমাকে ছেলের মতো দেখতে লাগলেন। কাউকে কোথাও নিয়ে যেতে হলে গার্জিয়ান হিসাবে আমিই যেতাম। বড় মেয়েটার চেহারা অত ভালো ছিলো না। তিন বোনের ভেতর দ্বিতীয়জনকে আমার খুব ভালো লাগতো। আলোতে আঁধার এসে মেশা এক সন্ধ্যায় তাকে তার রুমে একা দেখে আমি ছুটে গিয়ে পিছন থেকে জাপটে ধরলাম। ভাবছিলাম সে ছোটার জন্য ছটফট করবে। এজন্য একটু বেশিই জোরে ধরেছিলাম। কিন্তু সে আমার মুখের দিকে মুখ উঁচু করে আবেশ জড়ানো কণ্ঠে বললো, ‘এতদিনে বুঝলে?’ সে কথা বলাতে বুঝতে পারলাম, মারাত্মক ভুল করেছি। ও দ্বিতীয় নয়। বড়জন!
একরামুল হক কিছু বলেন নি, খায়রুন্নাহারই গায়ে কাঁটা নিয়ে বলেছিলেন, তারপর?
আনোয়ার বলেছিলেন, তারপর আর কি! ধরেছি যখন ছেড়ে তো দিতে পারি না! তাহলে তাকেই আশাহত করা হয়। তারপর একদিন সময় এলো দ্বিতীয়টাকে কব্জার ভেতর পাওয়ার। সেও কোনো বাঁধা দিলো। কিন্তু একটা মুশকিল হয়ে গেলো সেদিন।
আনোয়ার থামলে এবারও খায়রুন্নাহার বললেন, কি মুশকিল হলো?
আনোয়ার তেমনি ফুরফুরে মেজাজে বলে যেতে লাগলেন, দ্বিতীয়টির সাথে যা করেছি, ছোটটা হঠাৎ রুমে এসে দেখে ফেলে। এতে দ্বিতীয় খুব ভয় পেয়ে যায়। সে আমাকে বলে তুমি ওকে বোঝাও ও যেন মা-বাবা, আপা কাউকে এই ঘটনা না বলে! আমি নিজেও খুব ভড়কে গিয়েছিলাম। একটু থিতু হয়ে দোকান থেকে চকলেট এনে ছোটটাকে ডেকে ছাদে নিয়ে গেলাম। তারপর একথা সেকথা বলে তার হাতে চকলেটের আস্ত প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে বলতে লাগলাম, যা দেখেছো, তা কাউকে বলবে না কেমন? কিন্তু বারো-তেরো বছরের ছোট তখন আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো, ‘বলবো না। তবে ছোট আপাকে যা করেছো, আমার সাথেও তোমার তাই করতে হবে!’
তখন মাত্র বছর দুয়েক হয় খায়রুন্নাহারের বিয়ে হয়েছে। যিনি গল্প করছেন, যে দু’জন শুনছেন, সবাই তারা সমবয়সী। আর তাদেরই একজন নিজের জীবনের এমন নিষিদ্ধ বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা কি এক বেঘোরে শোনাচ্ছেন, মানব মনের সব অন্ধি-সন্ধির জট সেদিন আবার নতুন করে কেমন আগলা হয়ে উঠছিলো খায়রুন্নাহারের কাছে। তিনি এতক্ষণ যা রুদ্ধশ্বাসে শুনছিলেন, এবার দম ছেড়ে দিয়ে বললেন, তারপর আপনি কী করলেন?
আনোয়ার হো হো করে হেসে বললেন, তাকেও করলাম! জানো, সেই থেকে আমার নেশা চেপে আছে কোনোখানে মা ও মেয়েকে একসাথে…! এই অভিজ্ঞতাটা আমার হয়নি কখনো!
খায়রুন্নাহার পরে বুঝেছেন, আনোয়ার নামের জানোয়ারটাকে তখনি ঝাড়ু দিয়ে পিটিয়ে বের করে দেয়া উচিৎ ছিলো। কিন্তু তখনি পিটিয়ে না বের করলেও, সেই ডাইনিং টেবিল থেকেই একরামুল ওকে এমন শীতল মনোভাব দেখালেন, যে সেখান থেকেই তিনি উঠে যেতে বাধ্য হলেন। জীবনেও আর তার নাম তারা দু’জন মুখেও আনেননি। কিন্তু আনোয়ার যদি নিজে সেদিন তার ওইসব কথা না বলতেন, তাহলে জানাই হতো না এমন এক হারামজাদা মানুষ ভদ্র বেশে ওদের বন্ধু হয়ে আছেন। আনোয়ার চলে যাওয়া মাত্র একরামুল স্ত্রীকে ধমকে বলেছিলেন, তুমি কেন ওকে থামিয়ে না দিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে আরো উসকে দিয়েছো?
খায়রুন্নাহার বলেছিলেন, এটা মানুষের প্রবণতা। তুমি কি মনে করো সুযোগ পেলে তোমার এই আনোয়ারের মতো অন্য কেউও তার সদ্ব্যবহার করবে না? প্রায় সব মানুষই ভালো থাকে সুযোগের অভাবে।
একরামুল হক বললেন, দেখেছো, ব্যাভিচারের প্রভাব? মানুষ একের পর এক যাচ্ছেতাই বিয়ে করেও সে প্রহসনের বউয়ের সাথেও কতকিছু করে, কিন্তু সে ক্ষেত্রে বিছানার গল্প কিন্তু কেউ অন্য কারো সাথে করে না। অথচ বিবাহবহিভর্‚ত সম্পর্ক নিয়ে বলতে কারো ক্লান্তি নেই। লজ্জা নেই। একের পর এক তিন তিনটি মেয়ে ছাড়াও তাদের মা পর্যন্ত সে ভেবেছে! আমি অন্তত এ-গল্প পছন্দ করবো না জেনেও আনোয়ারের রিপু তাকে দিয়ে কী বিচ্ছিরি সত্যিটাকে সেই আমাদের দু’জনের কাছেই প্রকাশ করিয়ে নিলো। আমার এতো দিনের বন্ধু। অথচ জানাই ছিলো না ও এমন একটা জানোয়ার। একসময় জানতাম ও দীর্ঘদিন ধরে একবাড়িতে টিউশানি করে, তারা ওকে ছেলের মতো ভালবাসে। ওকে তারা দামি কাপড় চোপড় কিনে দেয়া ছাড়াও যখন তখন এমনি এমনি বেশ কিছু করে টাকাও দেয়। মফস্বল শহর থেকে আসা ওর ঢাকাতে নিজের ঘনিষ্ঠ কোনো আত্মীয় ছিলো না। ভালোই হলো আজ ও নিজের মুখে এই গল্প বলে, এ বাড়িতে তার আসা বন্ধ হলো।
: জানো, আমার আব্বা আমাদেরকে এতো শাসন করতেন, তখন তাকে খুব অত্যাচারী মনে হতো। কিন্তু বড় হতে হতে বুঝেছি খুব কড়া শাসন না হলেও, মেপে চলা একটা ধারণার ভেতর না থাকলে জীবনের স্বাদটাই নষ্ট হয়ে যায়। কোনো ইচ্ছেতেই আর লাগাম থাকে না। শেষে নিজেকে আর কোনো ছকে বাঁধা যায় না। হিতাহিত জ্ঞান অর্জন না হওয়ায় শেষে সবটাকেই প্রগতির ধব্জা মনে হয়। শুনলে তো আনোয়ারের শেষের কথাটা! তাও তিনি আবার একজন মহিলা কলেজের শিক্ষক। কৃতকর্মের জন্য এতদিনে তার একটু অনুশোচনা পর্যন্ত হয়নি!
: আমাদের বাবা-চাচাকে নিজেদের ছেলে-ভাইদের উদ্দেশ্যে বলতে শুনেছি, যেখানেই বিয়ে ঠিক করবে, খেয়াল করবে সে বাড়ির মেয়েরা মা-বাবা আর নিজের ভাই ছাড়া অন্য কোনো সাথে সিনেমা দেখতে বা বেড়াতে যায় কি না। এমন কি ভগ্নিপতিদের সাথেও চলাফেরা করে কি না। একা একা বা দলবেঁধে চলাফেরাটা কোনো দোষের নয় এবং দেখো তাদের ভেতর বাড়িতে ভাগ্নে-ভাস্তেদের গতি কতদূর! আর এটা শুধু মেয়েদের বেলায়ই একাই বা প্রযোজ্য হতে হবে কেন? ছেলেদেরও একটা সীমা বোঝানো উচিৎ। মূল্যবোধ কি তাদেরও দরকার নয়!
: একটা বাড়িতে দু’জন নরনারী ঘোষণা দিয়ে লিভটুগেদার করুক, সেটা দোষের নয়। কিন্তু জনসমক্ষে মামা-চাচা ডেকে একই ছাদের নিচে থাকা মানুষেরা সমাজ কলুষিত করে এবং যে মা-বাবা এরকম সোমত্ত মেয়েদের ভেতর বাইরের ছেলে ঘুরঘুর করতে দেয় বা রক্ষক হিসাবে রাখে, এদের মা-বাবা হওয়ার যোগ্যতাই নেই! এটা যারা করে, বাঁধা গরুকে ঘাস খাওয়ানোর মতো কাজ করে।
সবার কাপের চা শেষ হয়ে গেলেও খায়রুন্নাহারের মুখে কোনো কথা নেই! একসময় ছোট জামাই বলে উঠলো, ‘আম্মা, আপনি আরেক দফা আমাদের ডাকলেন কি ভুরিভোজন করাতে? আমার অনেক কাজ রেখে চলে এসেছি, শুধু আপনি কী বলেন শুনতে।’
বড় জামাই বললো, ‘আমাদেরও তো একসয় আপনার মতো ভ‚মিকা নিতে হতে পারে, আমাদেরও ছেলেমেয়ে বড় হচ্ছে। তাই আমি এলাম, কী বলেন তার থেকে শিক্ষা নিতে।’
হেনা-হাসনা উসখুস করতে লাগলো। আর জামিল তো মাতৃহত্যার দায়ে এখন ফাঁসিতে ঝুলতে হলেও জানতে আগ্রহী, কেন মা এমন খামখেয়ালি আচরণ করলেন। কিন্তু খায়রুন্নাহার আনোয়ারের মুখ থেকে হুবহু যা তার জীবনের কাহিনী শুনেছিলেন, সে কথা তিনি নিজের ছেলেমেয়ে-জামাইয়ের কাছে বলতে গিয়ে পারলেন না। তার গলায় কাঁটার মতো আটকে থাকলো। তিনি একসময় খালি এটুকুই বললেন, এই বিয়েতে আমার সম্পূর্ণ অমত। তার কারণ ওই সাব্বির আদনান।
সবাই একসাথে বলে উঠলো, সাব্বির আদনান আবার কী করলেন? আপনি কি আগে থেকে চিনতেন তাকে?
খায়রুন্নাহার বললেন, ‘মা-বাবা বাসায় নেই অথচ ছোটবড় তিনটি সোমত্ত মেয়ের ভেতর একটি উঠতি বয়সী ছেলে সারাবাড়ি বিচরণ করছে! দীর্ঘদিন অবাধে বাড়িটিতে থেকেছে।’
হেনা, হাসনা একসাথে বলে উঠলো, মা তুমি স্কুলে শিক্ষকতা করে এইসব ক‚পমÐুকতা আঁকড়ে থাকলে চলবে?
: এটা ক‚পমÐুকতা নয়। এটুকু সীমা লঙ্ঘনই প্রগতির অন্তরায়। বাইরে ছেলেদের সাথে দৌড়-ঝাঁপ, মিটিং-মিছিল, মেধার প্রতিযোগিতায় নামো, শক্তি চর্চায় নামো তাতে অভিনন্দন। কিন্তু সেটা বাড়ির ভেতরে অন্যের ছেলেকে অবাধে থাকতে দেয়া প্রগতির অংশ নয়। এমন কি মা-বাবা দু’জনের কেউই যখন বাসায় নেই, তখন তো আরো নয়। ‘পৃথিবীতে সব অঘটনগুলো সুন্দর ঘেরাটোপের নিচেই ঘটে’ বলে তিনি স্বামীর বন্ধু অনোয়ারের গল্পটি একটু একটু করে রয়েসয়ে ছেলেমেয়ের কাছে বললেন।
জামিল বেশ চটেই মাকে প্রশ্ন করে, তাই বলে, তুমি আমার বসকে আনোয়ার সাহেবের মতো ওইরকম ধুরন্ধর ভাববে?
খায়রুন্নাহার চটলেন না। তিনি শান্তস্বরে বললেন, ভাবছিলাম কই? আনোয়াকে দেখতে সাব্বিরের চেয়ে ইনোসেন্ট লাগতো। এসব কথা নিজে না বললে, পৃথিবীতে অন্য কেউই জানে না! তোমার বস নয়, মনে করো তুমিই ওই তিনটি মেয়ের ভেতর অবাধে বিচরণ করার সুযোগ পেয়েছো একেবারে উঠতি বয়স থেকে। ওদের মা-বাবা ট্যুরে গেলে তুমি তাদের গার্জিয়ান সেজে ওই বাড়িতে থেকেছো। তারপরও কি তুমি তাদের নেহায়েত একজন ভাই হয়েই থাকতে পারবে? এখন বড় হয়েও যদি এসব বিষয় না বোঝো, মা হয়ে মর্মে ঘা দিয়ে হলেও আমার এটা বোঝানো দায়িত্ব বলে আমি মনে করি।
জামিল কিছু বলতে যাচ্ছিলো। খায়রুন্নাহার তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, না, অযথা কথা কাটাকাটি করো না। আর এখনি কোনো উত্তরও দিতে হবে না। সাতদিন তোমরা সবাই ভাবো। ভেবে যা হয়, করো। তবে আমি এর ভেতর আর নেই। আর শোনো, হজরত আয়শা (রা.) তার পিতা হজরত আবু বক্কর রাদিয়াল্লাহ’র সাথে নিরালায় কথা বলছিলেন। রাসুলুল্লাহ সেখানে গিয়ে তা দেখে বললেন, ‘যদিও আপনারা পিতা এবং পুত্রী, তবু আপনাদের ভেতর আরেকজন থাকা উচিৎ ছিলো।’ তাই ক্ষেত্র বিশেষে কিছুটা ধর্মীয় অনুশাসনও মানতেই হবে। কারণ সেগুলোও মানুষের কল্যাণের জন্য তৈরি। এমনকি সব দেশে রাস্তার পাবলিক টয়লেটগুলোও নারী-পুরুষের জন্য আলাদা! যে সব দেশে মেয়েরা ছেলেদের সাথে বিকিনি পরে সমুদ্রে নামে। হাফপ্যান্ট আর ছোট জামা পরে রাস্তায় চলাফেরা করে তাদের দেশেও। তার মানে একটা পর্যায়ে পরস্পরের কাছে গোপনীয়তা বজায় থাকতে হবে। নাহলে সীমারেখা বলতে কিচ্ছুটি থাকলো না। তখন কার বাবা কে সে সার্টিফিকেট গলায় ঝুলিয়ে চলতে হতো।
সাতদিন পর কেউ আর জামিলের বিয়ের বিষয়টি নিয়ে একত্র হলো না। তবে খায়রুন্নাহারের কথা সবাই টায়টায় মানতে না পারলেও, তাদের সবারই মর্মচক্ষুর পর্দায় কমবেশি টান পড়েছে। অবশ্য এর ভেতর একদিন জামিল মায়ের প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে, আমার বস সাব্বির যদি ওদের কারো প্রতি দুর্বল থাকতো, তাহলে, ওদের কাউকে বিয়ে করতো না?
খায়রুন্নাহার বললেন, এর উত্তর দু’টি। সাব্বির যদি আনোয়ারের মতো সব সয়লাব করে ফেলে, তাহলে কাকে বিয়ে করবে? আর সে বয়স অনুসারে বড়মেয়েটিকে বিয়ে করতে পারতো। তাসরিনের মা-বাবা হয়তো সব মিলিয়ে তাকে পাত্র হিসাবে পছন্দ করেননি। অথবা সেই হয়ত কাউকে বিয়ে করতে চায়নি। এসব ক্ষেত্রে তাই হয়।
খায়রুন্নাহার শহরে বড় হলেও তার নানাবিাড়ি-দাদাবাড়ি দুই বাড়িই পাশাপাশি দুই গ্রামে। আর ওই দুই বাড়ি গ্রামে হওয়াতে তিনি দুই জায়গাতেই সমানভাবে গিয়েছেন। সবরকমের মানুষ সম্পর্কে টুকরো-টাকরা অনেক অভিজ্ঞতাই তার আছে। শৈশবে গ্রামে বসবাস করা নিজের কাজিনেরা ছাড়াও যে সব ছেলেমেয়েদের সাথে দেখা হতো, এখনো তারা সবাই মনে ছায়ার মতো মায়া হয়ে মিশে আছে। আজো তাদের কথা মনে হলে অন্তরে টান পড়ে। নানার বাড়িতে খায়রুন্নাহারের থেকে একটু বড় তার এক দুঃসম্পর্কের মামাতো বোন ছিলো। নাম পাপিয়া। একদিন খায়রুন্নাহারের নানার উঠোনের কল থেকে পাপিয়া পানি নিতে এসে, খায়রুন্নাহারকে ইশারায় ডেকে আড়ালে নিয়ে উৎফুল্ল হয়ে বলেছিলো, আমার জীবনে একটা ঘটনা ঘটছে! খায়রুন্নাহারের তখন ফাইভ সিক্সে পড়ার বয়স। পাপিয়ার হয়তো ক্লাস সেভেন। তাই জীবন কি তাই তো খায়রুন্নাহার তখন জানতেন না। তার ওপর আবার ঘটনা! তবু খায়রুন্নাহার উদগ্রীব হয়ে বলেছিলেন, কি ঘটনা?
পাপিয়া খায়রুন্নাহারকে তার নানার বাড়ির শেষ কোনায় মসজিদের কাছে টেনে নিয়ে মসজিদের দেয়ালে ওর হাত নিজের হাতে চেপে বললো, এই যে মসজিদ ছুঁয়ে ক, কেওরে কবি না?
খায়রুন্নাহার বলেছিলেন, না বলবো না!
পাপিয়া বললো, বল, আল্লাহার কিরে, খোদার কিরে, নবী-রসুলের কিরে?
খায়রুন্নাহার এইসব কিরা-কসমের ভার কিছুটা বুঝতে শিখে গিয়েছিলেন তখন। তিনি তাই বিবশ মনে পাপিয়ার সাথে আরো অনেকক্ষণ ধরে আরো সব শর্ত বেকসুর গিললেন, খালি তার সেই কথাটি শোনার জন্য। কারণ নিষিদ্ধ সব বিষয়ের টান তারও বুঝি শরীরে মনে ফুটতে শুরু করেছিলো সেই তখন থেকেই। পাপিয়া বলেছিলো, ওর চাচাতো ভাই কাওসার ওকে…করেছে।
খায়রুন্নাহার ভিরমি খেয়ে বলেছিলেন, কীভাবে?
পাপিয়া খিকখিক হেসে বলেছিলো, মাইজে বুজিগে বাড়ি বেড়াতি গেছিলাম, বাড়িতি ফসল উঠতি শুরু করছে। মেলা কাজ বাইড়ে গেছে না! আব্বা কাওসার ভাইরে কলো, ‘সামিয়াগে বাড়িত্তে পাপিয়ারে আইনে দাও। আমি সুমায় পাচ্ছিনে। তারপর আনার পথে পাটক্ষেতের ভিতর।’
খায়রুন্নাহার শুকনো কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘তোর লজ্জা লাগেনি? ব্যাথা পাসনি?’
পাপিয়া মুখে হাত চেপে হাসতে হাসতে বলেছিলো, ‘নাহ্। তাহলে কি আর তোরে কতাম!’
এখনো সে গ্রামে কলেজ নেই। কাওসার পাশের জেলা পাবনায় লজিং থেকে পড়তো। উঠতি নায়কের মতো ছিলো তার চাল-চলন। চেহারাও। অবশ্য পাপিয়াও সুন্দরী ছিলো। সে তখন আসন্ন কৈশোর ছোঁয়া বলিষ্ঠ শরীরের একটি মেয়ে। তবু খায়রুন্নাহার এখনো ভাবেন, কাওসার এমন অন্যায় করতে পারলো কী করে। পাপিয়ার ঘটনাটি খায়রুন্নাহারের মনে এখনো গভীর দাগ কেটে রেখেছে। ক্রমে তিনি কাওসার ও পাপিয়াকে মন থেকে ক্ষমা করে দিলেও ক্ষমা করতে পারেন নি, পাপিয়ার বাবা আসাদউল্লাহ মামাকে। কোন বিবেচনায় তিনি এমন সোমত্ত ছেলেকে দিয়ে নিজের মেয়েকে আরেক গ্রাম থেকে আনতে পাঠালেন! তা সে মেয়ে যে বয়সেরই হোক। ক’দিন ধরে খায়রুন্নাহার আরো গভীরভাবে ভাবছেন, পাপিয়াদের তিন বোনের বিয়ে হয়ে গেলেও তখন আরো তিন বোনের বিয়ে হতে বাকি ছিলো। কিন্তু তাদের একজনকেও তো কাওসার বিয়ে করেনি! কাওসারদের থেকে পাপিয়াদের পারিবারিক অবস্থা এবং অবস্থান বেশিই ভালো ছিলো।
দিন পনের পরে একদিন জামিল খায়রুন্নাহারকে বললো, সাব্বির সাহেবের ওয়াইফও তো বড়লোকের সুন্দরী মেয়ে। ভীষণ চটপটে। তার একটা বুটিক সপ আছে। তিনিও আত্মীয়ের মতো তাসরীনদের বাড়িতে আসা-যাওয়া করেন। থাকেন। তিনি নিশ্চয় বোকা নন। তিনি তো কোনো গলদ দেখেন না, কেবল তুমিই দেখতে পাও!
দেখতে পাই না। তবে অনুমান করি।
: তোমার অনুমানের ওপর নির্ভর করে একটা বিয়ে ভেঙে যাবে?
: এই জন্যই কোনো বিষয়ে কারো অনুমানের অবকাশ রাখতে নেই। ‘স্বচ্ছতা’ বলে একটা শব্দ আছে, তার শুধু অভিধানে থাকার জন্য জন্ম হয়নি! আমার যদি অমন একটি ঘটনা না জানা থাকতো, আমি হয়তো ওই মেয়েটিকে আঙটি পরিয়ে কাজী ডেকে ওইদিনই বিয়ের কাজটা সেরে আসতাম। কারণ আমার যে ছেলে বিয়ে করতে রাজিই না, সে বিয়ে করতে চাইছে। এর থেকে আর বেশি কোনো চাওয়া আমার জীবনে নেই!
: সাব্বির স্যার যদি তেমন হবেন, তাহলে উনি আমাকে তাসরিনের জন্য নির্বাচন করবেন কেন? চাকরি শুরুর পর থেকে উনি আমার পিছনে লেগে আছেন। ওনার কি দায়? উনি বিয়ে করে এখন ওদের সাথে যোগাযোগ নাও রাখতে পারতেন!
: ওই যে সেই আনোয়ারের কথাই বলি, যদি তার সাথে সেই বাড়ির কোনো মেয়ের ভালবাসার সম্পর্ক হতো, তাহলে বিয়ে না হলে বিবাদ ঘটতো। ও বাড়িতে তার যাওয়া-আসার পথে কাঁটা পড়তো। কিন্তু তাদের কারো সাথে যদি কিছু হয়ে থাকে, সেটা সুযোগের সদ্ব্যবহার মাত্র। তোমার মামাতো ফুপাতো ভাইদের কখনো দেখেছো তোমার বোনদের রুম পর্যন্ত যায়? তোমার স্কুল-কলেজের সব বন্ধুরা কিন্তু আমাদের বাড়িই বেশি আসতো। তোমরা সারারাত হৈচৈ করেছো, সেও ওই ড্রয়িংরুম পর্যন্তই। জীবনে কিছু বীজমন্ত্র, কিছু মূল্যবোধ থাকতে হয়। মা-বাবাকেই তা সন্তানের প্রাণে গেঁথে দিতে হয়। তা যে মা-বাবার জানা নেই, তারা তাদের সন্তানকে কী শেখাবেন? তোমাদের জীবন পড়ে আছে, তাই জেনে রাখা ভালো, কারো ছেলেমেয়ে নাহলে অন্যের সন্তান পালক নিতেও ইসলাম নিরুৎসাহিত করে। স্পষ্ট করে উপদেশ দেয়া আছে, কেউ মেয়ে পালক নিলে, তার পালক বাবার সামনে যেতে সে মেয়ে অতোটাই পর্দা রক্ষা করে যাবে, যতোটা পরপুরুষের সামনে যেতে লাগে। আর ছেলে হলে ঠিক মা সে ছেলের সামনে ওই একইরকম পর্দা মেনে চলবে। তাই অতোট কট্টর না না হলেও অন্তত কিছুটা অন্তরাল যারা মেনে চলে, সেইসব মানুষেরাই বহুদূর যেতে পারে। তাদের জীবন ও সম্পর্ক অন্যদের চেয়ে বেশি নিষ্কন্টক রাখতে পারে। তোমাকে যদি তোমার কোনো বন্ধু আজ বলে, আমি বাসায় থাকবো না, আমার স্ত্রী একা বাসায় ভ‚তের ভয় পায়। তুই শুধু আজ রাতে আমাদের ড্রয়িংরুমে থাকিস্! তুমি নিশ্চয় থাকতে যাবে না। কারণ তোমার অবচেতন মন সেই মূল্যবোধটি ধারণ করে আছে!
অবশেষে জামিলের বিয়েটি তাসরিনের সাথে হয়নি। তবে মায়ের বাঁধানো খটকাটা ষোলোআনা তার মনে শেকড় গাড়তে না পারলেও বাকি বিশ্বাসটুকু নিয়ে আর সে আর এগোতে জোর পেলো না এবং জামিল আর বিয়ের জন্য আগ্রহ না দেখালেও খায়রুন্নাহার এতটুকু অনুতপ্তও হলেন না, যে তিনি ভুল করে সম্ভাব্য বিয়েটি ভেঙে সেদিন কনে বাড়ি থেকে একরোখা মনোভাবে চলে এসেছিলেন।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..