পেতেছি কাঙাল হাত

শ্রীপর্ণা চট্টোপাধ্যায়
কবিতা
Bengali
পেতেছি কাঙাল হাত

স্বীকারোক্তি

একজন ঘাতকের কাছে জবানবন্দি দিয়েছি
যে আমার মৃত্যুর পর
আত্মজীবনী লিখে দেবে
বাদাম ভেঙে বেরিয়ে যাওয়া সময়ের
অস্তমিত সূর্যকে পণবন্দি করে
গায়ত্রী নদীর কাছে উচ্চারণ করেছি,
গোলাপের পাপড়িতে যে রক্তমাখা ছুরি
তাতে আমারই হাতের ছাপ।

নিষ্পত্র দেবদারু গাছের নীচে
দাঁড়িয়ে বলে এসেছি
ক্ষত বিক্ষত যে নারীকে মধ্যরাতে
ঘুমন্ত বাথটবে অস্থির হতে দেখো
বিরহ নিঃস্ব চৈত্র বাতাসের মতো
সাবান ফেনায় বার হারিয়ে যাবার মৃত্যু পরোয়ানা
আমিই সেই আততায়ী।

অমলিন রাত্রির নীচে অন্ধকার খামচে
জহ্লাদের হাতে স্বাক্ষর দিয়েছি
নিজেরই বেকসুর খালাস নামায়, যদিও
গোলাপের পাপড়িতে যে রক্তমাখা ছুরি
তাতে আমারই হাতের ছাপ।

 

স্বপ্নময় বিস্মরণে

এক আততায়ী প্রিয় মুখ
আমায় হত্যা করে যায় প্রতিরাতে
এক অশরীরী ছায়া ক্রমাগত
আমায় অন্ধকারে নামায়
সূর্যের গর্ভজ্বলা অমল আগুনে
সরে না সেই অন্ধকার
হৃদকমলে সে আলোর কোনো প্রতিভাস নেই

ওপারেই বনটিয়া দ্বীপ
প্রতারক মাছরাঙা শ্যামল গহীনে
ঠোঁটের ভালোবাসা ঢেলে মৌরলা খোঁজে
হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে দেওয়া যায়
তোমার ওষ্ঠপ্রান্তে শ্রাবস্তীর দাগ
ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন, স্বপ্নের মধ্যে তুমি
তুমি এলে বিস্মরণে কোজাগর রাত
শ্রাবণী চাঁদের মতো ঘুমহীন।

পর্ণমোচী অরণ্য প্রান্তরে
বুকের বোতাম খোলা হাওয়া
প্রিয়তম ঋণ হাতড়ায় শরীরের ঘ্রাণ
অলীক আকাশ থেকে নেমে আসা
পার্থিব আলোর চাঁদমালা
তমসার মায়াজাল কাটাতে পারে না
বিস্মরণে তোমায় জাগিয়ে রাখে
ইচ্ছামৃত্যু বেছে নেয়।

পেতেছি কাঙাল হাত

অমরতা চেয়ে মৃত্যুর কাছে
পেতেছি কাঙাল হাত
জীবনের উজ্জ্বলতা, মধুপর্ক, মেওয়া
চটে-পুটে অনেক নিয়েছি।

কবিতায় ঘরবাড়ি তোটকে, পয়ারে
বেঁধেছি যখন যেমন, আজ
মৃত্যুর মুখোমুখি একলা দাঁড়িয়ে
তার কাছেই দুহাত পেতেছি।

নশ্বর জীবনে অমরতা দেবে
মৃত্যুর এমন সাহস নেই,
অমৃত যদি নাই দেবে
বিষ দাও, শোভনসুন্দর।

 

তোমারই মতো

আমিও তোমার মতো
গাছ, নদী, পাথর, অক্ষর হতে চেয়ে
শোকসভার ঘোষকের মতো
চোখের পাতায় চন্দ্রাবলী প্রহর রেখে
বাঙ্ময় শোক প্রস্তাব
তুলে দিই নির্জন বারান্দায়

পাতার প্রহরঝরা রাত্রির বিষণ্ণতায়
মৌলির মতো খুঁজে বেড়াই
মরে যাওয়া পাতার হলুদ
হারিয়ে যাওয়া উজ্জ্বল জোয়ার
নদীতটে রেখে আসা অনাগত ঢেউ

জীবন যন্ত্রণা সব লিখে রাখি
রাতের ক্লান্ত পালকে, জলের অক্ষরে
বিজয়ার মতো ম্লান চোখে
বাঁচিয়ে রেখেছি কিছুটা আগুন
অবশেষে নিজেকে পোড়াব বলে

থাকি না

তুমি এসে ফিরে গেছ ডেকে
ভোরে এসে দাঁড়িয়েছে স্নিগ্ধ হাওয়া
বুকের সিন্দুকে তেমন গোপন কিছু নেই
শুকনো বিশ্বাসে মোড়া সম্পর্কের শিকড় বাকড়

স্বর্গের বাগানে জ্যোৎস্না চুরি করে
রাত্রি ফিরে আসে
অনেকেই এসে ডেকে ডেকে ফিরে গেছে
অবনীর মতো আমিও বাড়িতে থেকেও থাকি না

আজ তোমার জন্যই তুলে রেখেছি রঙতুলি
হিরণ্ময় যত অবসাদ সব তোমাকে ঘিরেই
অবাধ্য রক্তের স্রোত আমাকেই ঠকায় রোজ
তোমায় জানাবার কোন ইচ্ছা হয়নি

 

প্রতীক্ষা

এমন- ই কী হয়
প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হলে
মনমরা গাঙচিল উড়ে যায়
কোটর জঠরে
কুমারী তারার দল
সিঁদুর জলে নেয়ে
হারিয়ে যায় ঢেউয়ের ভিতর

প্রতীক্ষা এমনও হয়
বালি খুঁড়ে খুঁড়ে জল
পাঁজর খুঁড়ে ভালোবাসা
কবর খুঁড়ে কঙ্কাল-করোটি
শতবার হৃদয় খুঁড়েও বেদনা জাগে না আর
কার জন্য জেগে থাকে
অশ্বগন্ধামূলে রাতজাগা চোখ

হয়তো এমনই হয়
জীবন জেগে থাকে
অমলিন কাঙালের মতো, ভালোবাসা
মৃৎপাত্র কাতারে কাতারে
শতাব্দীপ্রাচীন তৃষ্ণা নিয়ে
তোমাকে একবার দেখতে চেয়েছিলাম
একবার, মাত্র একবারই

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ঝরা পাতা

ঝরা পাতা

  চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..