পোষালী রোদ

শ্বেতা সরকার
ছোটগল্প
Bengali
পোষালী রোদ

 

রঞ্জা জামার ছবিগুলো হোয়াটসঅ্যাপে কুহুকে পাঠালো। ভীষন সুন্দর শিফনের জামাগুলো। নীল শিফনের ওপর সোনালী জরির কাজকরা জামাটা খুব পছন্দ হলো কুহুর। বেশ কিছুমাস হলো রঞ্জার কাছ থেকে জামা নিচ্ছে কুহু। অনলাইন ব্যাপারটা খুব একটা বোঝেনা কুহু।ও জামা পছন্দ করে রঞ্জাকে দেয় আর রঞ্জা সেটা অর্ডার দিয়ে দেয়।এরপর জামা এসে কুহুর ঘরে পৌঁছে যায়। পুরোনো পাড়ায় পাশাপাশি ভাড়া থাকতো রঞ্জা আর কুহু। তারপর সময়ের স্রোতে দুজনেই ভেসে গেছে দুদিকে। তখন ঘরে ঘরে এতো ফোনের ছড়াছড়ি ছিলোনা। অনেক চেনা পরিচিতই হারিয়ে যেত চিরতরে। বছর দুয়েক আগে ফেসবুকের দৌলতেই আবার খুঁজে পেয়েছে দুজন দুজনকে।এখন একজন থাকে হালিশহর আর অন্যজন থাকে হালতুতে। দুজনেই ব্যাস্ত গৃহীনি।প্লাবন আর মেয়ে গিনিকে নিয়ে হালিশহরে বাড়ি কুহুর।বিভু আর মেয়ে মিঠিকে নিয়ে হালতুতে সাজানো ফ্ল্যাট রঞ্জার। দুজন দুজনকে খুঁজে পেয়ে খুব খুশি।যদিও এখনো সশরীরে দেখা সাক্ষাৎ হয়নি কিন্তু ভিডিও কলে প্রায়ই বকম বকম চলে।অলস দুপুরের নীরবতা ভাঙে সাংসারী ভালো থাকার অভিমান অভিযোগ অভিনয়ের গল্পের ঝাঁপিতে।ওরা একে অপরকে শোনে বোঝে হাসে কাঁদে বোঝায় ভরসা দেয়।গিনি ক্লাস সিক্সে পড়ে।মিঠি উচ্চমাধ্যমিক দিয়েছে। তাই রঞ্জা অনেকটাই ঝাড়া হাত পা।গত বছর পুজোর কিছুদিন আগে রঞ্জা একদিন বললো,
“জানিস, ভাবছি অনলাইন বিজনেস করবো, জামার বিজনেস।”
“বাহ্ ভালো তো, শুরু করে দে,তুই অনলাইনের অনেক কিছুই বুঝিস, আমাকে কে শেখাবে বল? তাছাড়া ওসব করতে তো আবার নিজের অ্যাকাউন্ট লাগবে, আমার তো নেই সেসব।”
“তুই একটু বলতেতো পারিস তোর নামে আলাদা অ্যাকাউন্ট করে দিতে।”
“বলেছিরে অনেকবার, জয়েন্ট তো আছে আবার আলাদা কি দরকার, সবই তো তোমার, এইসব বলে এড়িয়ে যায় রে, হাতখরচ তো দিই আবার দরকার কি বলবে।”
” যতোসব ছেলে ভুলানো কথা, নিজের দরকারে তুলতে তো পারিসনা, আর ওই হাজার টাকা হাত খরচে কি হয় শুনি, নেহাত তোর পার্লারের ফ্যাসান ‌নেই তাই চলে যায়,‌ সব সময় হাত পাততে ভালো লাগে না রে, বিজনেসটা সত্যিই এবার করবো।”
হাত পাততে কারই বা ভালো লাগে। কুহুরও ‌ভালো লাগেনা।কত কিছুই তো কিনতে ইচ্ছে করে। মাঝে মাঝে একা একা একটু এদিক ওদিক শুধু শুধুই ঘুরে আসতে ইচ্ছে করে। মেয়ে বরের সাথে ঘুরলেও কখনো কখনো তো একা সময় কাটাতেও ইচ্ছে করে।পাশের বাড়ির শুক্লা বৌদিদের বেশ একটা গ্রুপ আছে। ওরা একসাথে হাঁটতে বেরোয়। মাঝে মাঝেই এদিক ওদিক ঘুরে আসে খাওয়া দাওয়া করে।শুক্লা বৌদি অনেকবার ডেকেছে কুহুকে। কিন্তু কুহু জানে হাজার টাকা হাত খরচে ওসব হয়না। চাইলে হয়তো একবার দেবে দুবার দেবে তারপর যদি বলে এসব আদিখ্যেতা কিসের… ঘুরতে তো নিয়ে যাই। তারচেয়ে না চাওয়াই ভালো।
যাই হোক রঞ্জা অনলাইনে বিজনেসটা শুরু করলো।পুজো আর পয়লা বৈশাখে কুহুও তার আর তার মেয়ের জামাগুলো রঞ্জার কাছ থেকে কিনলো।জামাগুলো সত্যিই খুব সুন্দর।করোনার বাজারে ঘরে বসেই কেনাকাটা হচ্ছে দেখে প্লাবনও টাকা দিয়ে দেয়। রঞ্জা যখনই নতুন আইটেম সিলেক্ট করে সবার আগে কুহুকে পাঠায়। কুহু না নিলেও ডিজাইনগুলো কেমন রং সবার পছন্দ হবে কিনা এসব বলে দেয়। এই সিফনের জামাগুলো অফারে দিচ্ছে দেখে কুহুকে পাঠালো রঞ্জা।
“হেব্বী দেখতে রে জামাগুলো, ওই নীলটা কি সুন্দর! কিন্তু এই জানুয়ারিতে জামা কিনবো বললে রাজি হবেনারে।”
“খুব পছন্দ হলে নিয়ে নে, অফারে দিচ্ছে এই দ্যাখ।”
অফারের স্ক্রীনশট পাঠায় রঞ্জা।
“তোর অনলাইন থাকলে বলতাম আমি দিয়ে দিচ্ছি, তুই সুবিধামত মিটিয়ে দিবি, কিন্তু সেই সুযোগ তো নেই।”
নীল জামাটা ভীষন চোখে লেগে গেছে কুহুর। গিনিকে খুব সুন্দর মানাবে। ওদের ঘরের কাছের মাঠে একটা হস্তশিল্প মেলা আর একটা বইমেলা হয়। টাকা জমিয়ে প্রতিবারই কিছু না কিছু কেনে কুহু। এবার সাড়ে চার হাজার টাকা জমেছে। ইচ্ছে আছে একটা সুন্দর ফ্লাওয়ার ভাস,‌ একটা বড়ো বাঁকুড়ার ঘোড়া, সুন্দর একটা ওয়াল ম্যাট কিনবে।আর বইমেলা থেকে কিনবে গিনির সুকুমার রচনাবলী, কাকাবাবু গল্প আর নিজের জন্য আশাপূর্ণা দেবীর লেখা। এইসবে প্লাবনের ইন্টারেস্ট নেই। নিজের হাত খরচ জমিয়েই কিনতে হয় এসব। ওই নীল জামাটা দেড় হাজার টাকা নিলে কিছু সাধ সামনের বছরের জন্য তুলে রাখতে হবে।শেষ পর্যন্ত জামাটা অর্ডার করেই দিলো আর জামার টাকাটা আলাদা করে সরিয়ে রাখলো।
দিন চারেক হলো হস্তশিল্প মেলা শুরু হয়েছে।আজ গিনির অনলাইন ক্লাস অফ দেখে মেয়েকে নিয়ে বেলা তিনটায় বেরিয়ে পড়লো কুহু। সন্ধ্যার পর ভীড় হবে তাই এখনি দিনের আলোয় ফাঁকায় ফাঁকায় ভালো করে দেখে নিয়ে কিনতে পারবে। সুন্দর দেখে একটা বড়ো বাঁকুড়ার ঘোড়া কিনলো ড্রয়িং রুমের কর্নারে রাখার জন্য। গিনি সেটাকে কোলে তুলে নিলো। এটা তারও খুব পছন্দের। এবার বেডরুমের জন্য একটা ওয়াল ম্যাট কেনার পালা। দাম অনুসারে এবার এই দুটোই কেনা যাবে। বাকিগুলো জন্য সামনের বছরের অপেক্ষায় থাকতে হবে। বেশ বড় একটা স্টলে অনেক ওয়াল ম্যাট আর কাঠের কাজ করা সুন্দর সুন্দর সব জিনিসপত্র। মাটির কাজ করা বোর্ডগুলোও খুব সুন্দর। সেসব দেখতে দেখতেই গিনির চোখ পড়লো বাক্সটা।কি সুন্দর কাজ করা তিনটে ড্রয়ার দেওয়া একটা বাক্স।সাজের জিনিসপত্র রাখার বাক্স।বন্ধুদের বাড়িতে এরকম বাক্স সে দেখেছে। সেগুলো অবশ্য ফাইবারের। কাঠের তৈরি এই প্রথম দেখলো।
“মা দেখো কি সুন্দর!”
কুহু তাকালো।স্টলের মিষ্টি মেয়েটি এগিয়ে এলো।
” নিয়ে যান ম্যাম, সাজের জিনিসপত্র রাখবেন। দেখুন অনেক জায়গা আছে।সব জিনিস ধরে যাবে। ভালো পালিশ করা আছে, নষ্ট হবে না ম্যাম।”
কুহু ডালাগুলো টেনে টেনে দেখছিলো।মনের ভিতর একটা আবছা ছবি উঁকি দিচ্ছিলো।কুহুর তখন সেভেন-এইট হবে।রাঙাজেঠুর বাড়িতে এইরকম একটা ছোট্ট প্লাস্টিকের বাক্স দেখেছিলো।দিদি তার টিপ,কাজল পেন্সিল,লিপস্টিক কানের দুল,হার সব এক এক ড্রয়ারে সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছিলো। তারপর ছোট কাকার বাড়িতে বোনুরও ওরকম একটা বাক্স দেখেছিলো। দেড়শো দুশো টাকা দাম ছিল তখন বাক্সগুলোর। কুহু জানতো তাদের চার ভাই বোনের কেরানী বাবাকে এইসব সাধের কথা বলে লাভ নেই। তাই ওরম একটা বাক্সের সাধ মনের ভিতর চিনচিনে ব্যাথার ভাঁজে জমা পড়ে পড়ে হারিয়েই গিয়েছিলো। এখন এই বাক্সটা দেখে স্মৃতি জেগে উঠলো।
“নেবে মা?কি সুন্দর।নাও না।”
“যা দাম বলছে তাতে তোর কাকাবাবু আমার আশাপূর্ণাও চাপা পড়ে যাবে যে।”
“তা হোক, এবার বইমেলায় শুধু সুকুমার রচনাবলীই কিনবো, এটা নিয়ে নাও,নাও না মা।”
কুহু বাক্সটা ভালো করে পরখ করে দেখে নেয়। তারপর দাম মিটিয়ে বাক্সটা কোলে তুলে নেয়। এবার শুধু মেলা দেখার পালা কারণ পকেট ঢুঁ-ঢুঁ। তবে গিনি ভারি খুশি। বাড়িতে এসেই বাক্সটা মোছামুছি করে তার আর মায়ের সব সাজের জিনিস গুছিয়ে রেখেছে। ছবি তুলে সব বন্ধুদের হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছে।কুহুও ছবি তুলে রঞ্জাকে পাঠিয়েছে। বাক্সটা দেখলেই তার‌ কেমন মন ভালো হয়ে যাচ্ছে। রঞ্জাকে বলেছে তার সেই পুরনো সাধের কথা যা এতদিনে মিটলো। রঞ্জা তাকে এ্যাত্তোগুলো হামি পাঠিয়েছে।বসার ঘরের কর্নারে ঘোড়াটাও খুব সুন্দর লাগছে।
পরের দিন দুপুরে কুহুর অর্ডার করা জামাটা এলো।টাকার ঝামেলা মিটিয়ে ঘরে এসে প্যাকেটটা খুলতেই মন খারাপ হয়ে গেল তার। ছবিতে এতো সুন্দর দেখতে জামাটা যে এতো বাজে দেখতে হবে তা সে ভাবতেই পারেনি। কি সুন্দর সুক্ষ জরির কাজ দেখাচ্ছিলো ছবিতে কিন্তু এতো ভীষন রকম মোটা দাগের জরির কাজ। ভাগ্যিস প্লাবন বাড়িতে নেই। থাকলে টাকা বেশি হয়েছে বলে মেজাজ শুনতে হতো। আগের কেনা জামাগুলো এতো ভালো হয়েছে যে কুহু কিভাবে বুঝবে এটা এরম বাজে হবে। এই জন্য অনলাইন ভালো নয় বাপু। জিনিসপত্র হাত ধরে দেখে কেনা যায় না।কুহু ভারি মুস্কিলে পড়লো। অনলাইন কম বোঝা কুহুর কাছে এটাকে ফেরত পাঠানো আর এক হ্যাপা।দেড় হাজার টাকা জলে গেলো।তার গা কচকচ করছে।বেডরুমের জন্য মাটির বোর্ড কেনা হয়ে যেতো। নিজের মনে গজগজ করতে থাকে কুহু। ফোন বেজে ওঠে। রঞ্জার ফোন।হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে উচ্ছসিত গলায় বকবক করে ওঠে রঞ্জা।
“জানিস কোথা থেকে এলাম।”
“কোথায় গিয়েছিলি সক্কাল সক্কাল?”
“আরে তোকে বলেছিলাম না আমার একটা ব্ল্যাক পার্লের সেটের খুব শখ। কালো বলে কেউ কিনে দেয় না। এই বিজনেসের লাভটা জমিয়ে রেখেছিলাম।আজ একটা ব্ল্যাক পার্লের সেট কিনে আনলাম রে।দাঁড়া তোকে ছবি পাঠাচ্ছি, এই তোর জামাটা পেয়েছিস?”
কুহুর মনে গতকালের খুশির ঝিলিক উপচে পড়লো।কুহু একগাল হেসে বললো,
“বাহ্, তোর এতোদিনের শখ মিটলো,হ্যাঁ রে জামাটা পেয়েছিরে।তবে দাম অনুযায়ী সেরকম ভালো নয় বুঝলি,তুই কারোর কাছ থেকে এই সেটটার অর্ডার নিসনা রে,তোর বাজার খারাপ হবে।”
“ওমা তাই নাকি? তুই তাহলে ফেরত দিয়ে দে।”
“না রে,ফেরত দেওয়ার আর এক হ্যাপা, ওটা তো আর নষ্ট হবে না, এই বছর পুজোয় কাজের মেয়েটাকে দিয়ে দেবো, এরকম ভারি জরির কাজ ওদের খুব পছন্দ হবে,আর আমার টাকাটাও প্লাবনের কাছ থেকে খানিকটা উসুল হবে বুঝলি,হা হা হা, তুই সেটটা পড়ে একটা ছবি পাঠাবি বুঝলি,দেখি কেলে মোতি পড়ে পেঁচিকে কেমন লাগছে, এতোদিনে পেঁচির কেলে মোতির শখ মিটেছে,হা হা হা…।”
খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে দুজনেই।পৌষালী রোদ ছড়িয়ে পড়ে জীবনের ওমে।

শ্বেতা সরকার। জন্ম ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি। স্থান, বাবার কর্মস্থল টিকিয়াপাড়া রেল কোয়াটার, হাওড়া,বাংলা, ভারত। পাড়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে হাওড়া নরসিংহ কলেজ থেকে বায়ো-সায়েন্সে স্নাতক। ছোট বেলা থেকেই নাচ,গান, আবৃত্তি, ছবি আঁকা, ফটোগ্রাফিতে ছিল শখ। বিবাহসূত্রে খড়্গপুরের বাসিন্দা। আঞ্চলিক...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ