প্যাট্রিওট-প্যাট্রিওট

মাসকাওয়াথ আহসান
ছোটগল্প
Bengali
প্যাট্রিওট-প্যাট্রিওট

ক্যানাডার বেগম পাড়ায় বাংলাদেশের সম্পদ লুন্ঠন করে সেকেন্ড হোম বানিয়েছে দেশপ্রেমিক সাহেবরা। কয়েকদিন মাথায় জাতীয় পতাকা বেঁধে দেশপ্রেম প্যারেড করে, দেশ দেশ করে আলুথালু হয়ে; ডিজিটাল বাংলাদেশের শনৈঃ শনৈঃ উন্নয়ন যাত্রায় স্টার্ট আপ বিজনেস খুলে; দেশপ্রেম-ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে হাপিস করে দিয়ে; বিদেশ থেকে খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানির নামে সে টাকা ক্যানাডায় পাঠিয়ে; গড়ে তোলা হলো এই সেকেন্ড হোমের গুচ্ছগ্রাম।

আশৈশব দারিদ্র্য আর অবহেলার চরম প্রতিশোধ নিয়েছে নয়াদেশপ্রেমিক আবুল ও বাতেন সাহেবেরা। ক্যানাডার সেকেন্ড হোমগুলো প্রাসাদোপম। গাড়ির মডেলও আলিশান। এখন ঢাকার গ্রাম থেকে উঠে এসে টরেন্টোর বিশ্বগ্রামে বেগমেরা ‘আধুনিক’ হবার মরণপণ যুদ্ধে নেমে গেছে।

‘আমার সোনার বাংলা ব্যাংক’ যেহেতু গৌরি সেন; তাই ক্যানাডায় বিলাসী জীবন পেতে কোন সমস্যা হয়নি বেগমদের।

সমস্যা হয়েছে তাদের উঠতি বয়েসের ছেলে মেয়েগুলোকে নিয়ে। সাহেব ও বেগম পাখি পড়ানোর মত বাচ্চাগুলোকে শিখিয়ে দিয়েছে, মাই গ্র্যান্ড-ফাদার ওয়াজ আ ল্যান্ড লর্ড। কিন্তু স্কুলে কেউই জিজ্ঞেস করে না, তোমার দাদা কী করতেন! এরকম করে বাসায় শিখিয়ে দেয়া শঠতাগুলোর কোন প্রয়োগ নেই টরেন্টোর সমাজে।

একদিন স্কুলে টরেন্টোর এক শিশু জুলিয়ান একজন ফায়ার ফাইটারের ছবি এঁকে অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে জানিয়ে দেয়, এটা আমার ফায়ার ফাইটার বাবা। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া এক শিশু স্বদেশ তখন চট করে তার বাবার ছবি এঁকে হাতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ধরিয়ে দিয়ে অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে জানিয়ে দেয়, মাই ফাদার ইজ আ প্যাট্রিওট। সেই থেকে স্কুলে স্বদেশের মর্যাদা বেড়ে যায়।

এক শিক্ষক স্বদেশকে ডেকে বলেন, তোমাকেও তোমার বাবার মতো প্যাট্রিওট হতে হবে। ক্যানাডা তোমার মত প্যাট্রিওটের মাধ্যমে অনেক উপকৃত হতে পারবে। তোমার বাবা-মাকে একটা সেশানে আমন্ত্রণ জানাতে চাই।

স্কুলে বাংলাদেশের প্যাট্রিওট সাহেব ও বেগম আসেন। ইংরেজি উচ্চারণটিকে যথাসম্ভব ক্যানাডিয় করে তারা শিশুদের দেশপ্রেমের গল্প শোনান। স্লাইড শো’তে বাংলাদেশের উন্নয়ন বীরদের সঙ্গে সেলফি আর জিডিপি গ্রোথের পরিসংখ্যান দেখিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করে ফেলে তারা।

বাসায় ফিরে প্যাট্রিয়ট সাহেব ও বেগম তাদের ফেসবুক টাইমলাইনে স্কুল ইভেন্টের ছবি দিয়ে তাক লাগিয়ে দেয়। মন্তব্যে, বাংলাদেশের সুনাম বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দিলেন ভাই, ভাবী আপনারে লাল-সবুজ রং-এর শাড়িতে খুব মানিয়েছে ইত্যাদি স্তুতি উপচে পড়ে।

এসব আদিখ্যেতা দেখে স্বদেশ বিরক্ত হয়। সে তার মাকে বলে, মাম্মি আমার বন্ধু জুলিয়েনের বাবা তো ফায়ার ফাইটার। দেশপ্রেমিক তো তিনি। আমার বাবা মাথায় পতাকা বেঁধে ঘোরা ছাড়া দেশের জন্য ঠিক কী করেছে বলতে পারো!

এই একই সময়ে বাংলাদেশের মিডিয়ায় খবর আসে, শুধু ২০১৫ সালেই প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচার হয়েছে; জনগণের দেয়া করের ৩৬ শতাংশই প্রতিবছর পাচার হয়। এছাড়া ব্যাংকের ঋণখেলাপির সংখ্যাও আশংকাজনকভাবে বেড়েছে। দ্রুত ধনী হওয়া যায় এমন দুর্নীতিমুখর দেশগুলোর শীর্ষে বাংলাদেশের অবস্থান। এ অবস্থায় ‘দুর্নীতি দমন অভিযান’ শুরু হয়।

টরেন্টোর প্যাট্রিয়ট সাহেব ও বেগম আর দেরি না করে ‘ওমরাহ’ পালনে মক্কা শরিফে চলে যান। ফেসবুকে সেই ওমরাহ করার ছবি দেখে হুঁ হুঁ করে কেঁদে ওঠে দেশবাসী। “আপনারা একটি আদর্শ পরিবার ভাই; যেমন দেশপ্রেম; তেমনি ধর্মপ্রেম আপনাদের”- এমন স্তুতিতে অশ্রুসিক্ত হয় ‘ওমরাহ’-পালনের ছবির মন্তব্যের ঘরগুলো।

টরেন্টোতে ফিরে প্যাট্রিয়ট সাহেব ও বেগম ‘দেশপ্রেমের সাংস্কৃতিক ওরস’গুলোতে যাওয়া বন্ধ করে বাসায় নিয়মিত মিলাদ-মেহেফিল-দোয়াখায়ের আয়োজন করতে শুরু করে।

স্বদেশ তার বাবা-মায়ের এই ঘন ভোল পাল্টানোর ম্যাজিক দেখে আরো বিরক্ত হয়। বাবা-মায়ের কথোপকথন শুনে সে বুঝতে পারে; তাদের এই সেকেন্ড হোমটি বাংলাদেশের গরিব মানুষের সম্পদ চুরি করে বানানো।

স্বদেশ স্কুলে গিয়ে জুলিয়েনকে বলে, তোমার ফায়ার ফাইটার বাবার সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই।

জুলিয়েন জিজ্ঞেস করে, কেন!

স্বদেশ বলে, আমি একজন প্যাট্রিয়টকে দেখতে চাই; উনাকে দেখে শিখতে চাই।

বাংলাদেশের শিশুটি তার শিক্ষককে গিয়ে অনুরোধ করে, জুলিয়ানের ফায়ার ফাইটার বাবাকে স্কুলের একটি সেশানে আমন্ত্রণ জানাতে।

জুলিয়ানের বাবা ফায়ার ফাইটারের ইউনিফর্ম পরে আসেন। বাচ্চাদের আগুন নেভানোর কৌশল শেখান। বাংলাদেশের শিশু ‘স্বদেশ’ জুলিয়ানের বাবার কর্মীর হাতখানি তার কোমল হাতে ধরে বিড় বিড় করে বলে, প্যাট্রিওট-প্যাট্রিওট।

মাসকাওয়াথ আহসান। লেখক, শিক্ষক ও সাংবাদিক। 'শিল্পের জন্য শিল্প নয়, সমাজ-রাজনৈতিক উত্তরণের জন্য শিল্প' এই ভাবনাটিই মাসকাওয়াথ আহসানের লেখালেখির প্রণোদনা। নাগরিক বিচ্ছিন্নতার বিচূর্ণীভাবনার গদ্য ‘বিষণ্ণতার শহর’-এর মাঝ দিয়েই লেখকের প্রকাশনার অভিষেক ঘটে। একটি পাঠক সমাজ তৈরি হয় যারা নাগরিক জীবনের...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ