প্রতিটা মুহূর্তই কবিতা

সৌরভ বর্ধন
কবিতা, প্রবন্ধ
Bengali
প্রতিটা মুহূর্তই কবিতা
এ প্রশ্নের দুটো উত্তর হয়। এক, লিখতে পারি তাই লিখি; দুই, লিখতে ভালো লাগে তাই লিখি। মানে, কবিতা লেখার পেছনে লিখতে-পারা আর না-পারার একটা হাত চালনা রয়েছে স্পষ্টভাবে কিন্তু আড়ালে। মানিক বন্দোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘লেখা ছাড়া অন্য কোন উপায়েই যে-সব কথা জানানো যায় না, সেই কথাগুলি জানাবার জন্যই আমি লিখি।’ তবে যে কোনো কাজের মতো কবিতা লেখার ক্ষেত্রেও দক্ষতাই আসল। কেননা, আবেগ অনুভূতি এবং ইত্যাদির প্রতিক্রিয়া সকল মানুষের মধ্যেই আছে, কিন্তু সবাই লিখতে পারে না, যেমন সবাই নাচতে গাইতে খেলতে পারে না। শুধু কবিতা নয়, যে কোনো শিল্প নিজ হাতে সৃষ্টি করার পর শিল্পীর মধ্যে একটা অনুভূতি তৈরি হয় যা তাকে পরবর্তী সৃষ্টির দিকে নিয়ে যায় এবং সেই অনুভূতি এতো উচ্চমানের হয় যে শিল্পীর মনে হতে থাকে এর চেয়ে জগতে ভালো কিছু আর হয় না। একজন ক্ষুধার্তের কাছে খাবারের চেয়ে ভালো কিছু আর হতে পারে না। সেটাই তার চরমতম ইপ্সা। এবং ইপ্সিত সেই কারণের দিকেই প্রতিটি প্রাণীর যাত্রা। জীবনানন্দ বলেছিলেন ‘কবিতা সৃষ্টি করে কবির বিবেক সান্ত্বনা পায়, তার কল্পনামনীষা শান্তি বোধ করে, পাঠকের ইমাজিনেশন তৃপ্তি পায়।’ এবার এই ‘কল্পনামনীষা’ শব্দটি যেই আসছে সেই অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ নিভৃতে হাসছে, সে হলো ‘চেতনা’ আর সেই চেতনা রয়েছে যার সেকি পড়ে রয়! না পড়ে থাকে না, ‘যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্য প্রাপ্ত হয়; নানা রকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায়। … জগতের নব নব কাব্য-বিকীরণ তাদের সাহায্য করে।’ তাই কবিতা লেখার পেছনে কারণ হচ্ছে সেসব চমৎকার অভিজ্ঞতা যা ব্যষ্টিগত হয়েও সমষ্টিকে নাড়া দিতে পারে, যা এক থেকে বহুতে বিচ্ছুরিত হতে পারে, যা ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ-এর দিকে ছুটে চলে, যা দর্শন বা ধর্ম বা বিজ্ঞানের রস নয়, যার পাণিগ্রহণ করলে তৃপ্তি আসতে পারে, বিরক্তি আসতে পারে, রাগ হতে পারে, বিহ্বলতা আসতে পারে, আলোও আসতে পারে আবার অন্ধকারও আসতে পারে। তাই একটি কাব্য বা শিল্পকর্ম সম্পন্ন করার পরে বা আগে শিল্পী কখনই ভাবেন না কাজটি আমি কেন করলাম! বলাবাহুল্য, ভাবলে আর কাজটি হতো না। কেন হতো না তা পরে বলছি, তার আগে আরও একবার বলে নিই – কবিতা লেখার কোনো কারণ হয় না, কারণ কবিতা না লিখেও মানুষ বেঁচে থাকে। অর্থাৎ কবিতা লেখার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আমি প্রথমেই বলা কারণ দুটোর জন্য কবিতা লিখি। যাদের ওই দুটো কারণ নেই তারা লিখবে কেন। নিজের অনুভূতিকে, চেতনাকে শব্দে বর্ণে রূপান্তরিত করাই হলো কবিতা। বা সত্যকে প্রকাশ করাই হলো কবিতা। যদি প্রশ্ন হয় কোন সত্য, কেমন সত্য? তাহলে বলব সমস্ত সত্যই কবিতা, যে কবি সে প্রতিটা মুহূর্তেই কবি, আর আমরা তো জানিই ‘কবি যা লেখেন তাই কবিতা’। এজন্যই কবিতার কোনো সংজ্ঞাও হয় না। এই যেমন কদিন আগে আমার একটা লাইন মাথায় এলো, মাঝে মাঝে আমার এমন হয় আধো ঘুমে থাকলে এক আধটা লাইন মাথায় আসে, আমি বুঝতে পারি সেগুলো চেতনার আঘাত থেকে আসছে, তো সেদিন লিখলাম ‘মুঠোতে পাখি ধরার সুযোগ যে পেয়েছে সে আর স্তন ছুঁতে চাইবে না’, ফেসবুকে এ লাইন পড়ে বেশিরভাগ লোকে হাসলো, সন্ন্যাসী না হতে পরামর্শ দিলো, কেউ বলল আঙুর ফল টক ইত্যাদি ব্লা ব্লা ব্লা, কিন্তু কেউ ভাবল না ছেলেটা কেন লিখল লাইনটা, ভাবনার সেই মুহূর্তে সে চেতনার কোন স্তরে ছিল। আমার বন্ধু জগন্নাথ খুব ভালো ভাস্কর, অসাধারণ মাটির ভাস্কর্য তৈরি করে, ওর সাথে সন্ধেবেলা মাঝে মাঝে আমি বেরই, সেদিনও বার হলাম, গঙ্গার ধার দিয়ে ঘুরছি, ও আমাকে তখন ওই লাইনটার ব্যাপারে জিগ্যেস করলো। আমি অসংলগ্নভাবে ওকে কিছুটা বললাম, কারণ ‘ব্যক্ত করাই ছবির কাজ, ব্যাখ্যা করা নয়।’ ছ-এর জায়গায় ক বসিয়ে নিন। এবার দেখুন, পরিকল্পনা করেও কবিতা লেখা যায়, কিন্তু ওই লাইনটা আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। ওখানে আমি ভাবছিলাম বা উপলদ্ধি করার চেষ্টা করছিলাম, একটা থরো-থরো-থরো যুবতী-স্তন হাত দিয়ে অনুভব করার ঐশ্বরিক মুহূর্তকে ছাপিয়ে একজন যুবক তার হাতের মুঠোতে একটা ছোট্ট অথচ সমগ্র প্রাণ ছোঁয়ার অনুরণন, আন্দোলন উপভোগ করছে। খুব স্বাভাবিকভাবে সে ওই মুহূর্তে স্তন ছুঁতে চাইবে না। একজন মা তার সন্তানকে দু-হাতে পাওয়ার সময় আর অন্য যেকোন লোভনীয় বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট হয় না, হতে পারে না। জগন্নাথ বলেছিল আমার হাতে মাটি হলো সেই স্তন অথবা সেই পাখি কিংবা তারা দুজনেই। কই এ লাইন লিখতে তো আমার কোনো কারণ দরকার হয়নি, অকারণেই লিখেছি। ‘কেন কবিতা লিখি’ এ প্রশ্ন আমি কখনও নিজেকে করিনি। খুব বোদ্ধা মতন কেউ হয়তো বলবেন যে প্রশ্নটা করা উচিত নিজেকে। কিন্তু তারপর একদিন যখন আধো ঘুমের ভেতর কে যেন আমায় বলল ‘খামারের পাণ্ডুলিপি, এঁকে তুমি মুশকিল হাতে ধরো’, বিশ্বাস করুন সেদিনও আমার মনে হয়নি ‘কবিতা কেন লিখি’, কারণ আমি জানি একজন কবির কাজই হলো কবিতা লেখা। আমার আর এক বন্ধুকে বললাম এসব কথা, জিগ্যেস করলাম কেন হয় এরকম আমার? ও আমাকে বলল ‘এইটা তো খুব ভালো। বিনয় বলতো, তাঁর নাকি কবিতা অনর্গল আসতো। শুধু বলতো কত লিখতে হবে এখনো। তবে যদি তুমি সত্যিকারের সাহিত্যে ঝাঁপ দিতে চাও সেখানে কিছু পছন্দের দার্শনিকের লেখা এমনি পড়ে নাও। তবে দর্শন নিয়ে বেশী ভাববে না। তখন তোমার যে লীলাটা এভাবে হচ্ছে, সেটা চিন্ময়ী রূপ নিয়ে নেবে। আর রামকৃষ্ণ যেভাবে থাকতেন ঈশ্বর সাধনায়, ওভাবেও হয়। ঐ পথেই তুমি আছো বলে আমার মনে হয়।’ অর্থাৎ স্বতঃস্ফূর্ততা, কবিতায় স্বতঃস্ফূর্ততা খুব ভালো। কিন্তু যদি পরিকল্পনা করে কবিতা নির্মাণ করা হয়? কবিতার তো একটা কাঠামো থাকে, ভাব ভাষা থাকে, তাদের তো নির্মাণ করাই যায়; এখন তো কবিতার ওয়ার্কশপও হয়, কবিতা লেখা শেখানো হয় এবং আগ্রহ থাকলে শেখানো যায়। তাহলে একটা ব্যাপারকে নিয়ে যখন এতো উদ্যোগ এতো কর্মকাণ্ড, তার সৃষ্টির পেছনে কোনো কারণ থাকবে না কেন? মানে, কবিতা কেন লিখি – এ প্রশ্নের উত্তর বেশিরভাগ কবি দিতে চান না বা তাদের অজানা, কেন? কারণটা শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন, ‘যে লেখে সে কিছুই বোঝে না/ যে বোঝে সে কিছুই লেখে না।’ এবার পাঠক আপনি লক্ষ্য করুন – কবি কেন কবিতা লেখেন – এ প্রশ্ন আপনার মনে কখনও আসছে কিনা, যদি আসে তাহলে আপনি একজন নিমগ্ন পাঠক, আর যদি সে প্রশ্ন না আসে তাহলে আমার আপনার কোনো পার্থক্য নেই। এই উত্তর আধুনিক সময়ে যখন প্রতি মুহূর্তে মানুষ নিজের সঙ্গে নিজের দ্বন্দে বিপর্যস্ত, যখন কোনো বাইরের শত্রু নয় বরং নিজেকে মোকাবিলা করাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয়ে পড়ছে তখন ‘কবিতা কেন লিখি’ এ প্রশ্ন নিজেকে করার অর্থ হলো অস্তিত্বের সংকটে আবদ্ধ হয়ে পড়া, নিজের অস্তিত্বকে বারংবার চ্যালেঞ্জ করা, ‘কেন বেঁচে আছি’ এ প্রশ্নের জালে আটকে পড়া। আর এখান থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো কবিতাচর্চা। কারণ, একজন প্রকৃত কবিই পারেন ‘কবিতা কেন লিখি’ এই প্রশ্নকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে কবিতা লিখতে…

সৌরভ বর্ধন। কবি। জন্ম ১৯৯৪ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নদীয়া জেলার শান্তিপুরে। স্কুলবয়স থেকেই কবিতা লেখার শুরু। যদিও সিরিয়াস কবিতাযাপনে অনেক পরে আসা। বর্তমানে বাংলার বিভিন্ন লিটিল ম্যাগ ও ব্লগজিন, ওয়েবজিনের নিয়মিত লেখক।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ঝরা পাতা

ঝরা পাতা

  চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..