প্রতিবাদ

স্বপন রায়
মুক্তগদ্য
Bengali
প্রতিবাদ

শ্রীযুক্ত  বসু – আমরা সবাই জানি, কেন আজ আমরা এই মিটিং-এ বসেছি, কী জানি তো?

শ্রীযুক্ত মুখোপাধ্যায়- জানি। অত্যন্ত বেদনাদায়ক। একজন সৃজনশীল মানুষকে, এক্ষেত্রে তিনি অসম্ভব শক্তিশালী একজন মানবী, আপনারা জানেন তাঁর নাম, পার্বতী লঙ্কেশ, তাঁকে দিনের আলোয় ঘরে ঢুকে খুন করা হয়েছে, ইনফ্যাক্ট পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে গুলি করা হয়েছে!

শ্রীমতী সেনগুপ্ত- ভাবা যায়না। আজ ওঁকে মেরেছে, কাল আমায় মারবে না, গ্যারান্টি কী?

কুমারী চট্টোপাধ্যায়- আপনাকে কেন মারবে? আপনি তো গেরস্থালির গপ্পো লেখেন, পার্বতী অ্যাক্টিভিস্ট ছিল!

শ্রীমতী সেনগুপ্ত- খোঁচাটা নিলাম না। গেরস্থালিও আর নিরাপদ নয় আর গল্প না গপ্পো, এটা নিয়ে পরে কথা হবে…

কুমারী চট্টোপাধ্যায় (মনে মনে)- শ্রীযুক্ত বসু না এলে কী আসতেন দিদি? ( শ্রীমতী সেনগুপ্ত’র দিকে তাকিয়ে)। যদি অ্যাকাডেমির নমিনেশনটা পাওয়া যায়! শ্রীযুক্ত বসু বরাবরই হাস্যময় কিন্তু নির্বিকার। আপাত দৃষ্টিতে। (এবার শ্রীযুক্ত বসুর দিকে তাকিয়ে, আড়চোখে)।

শ্রীযুক্ত রায়- আমায় কেন ডাকা হয়েছে বুঝলাম না। আমি সেলেব্রিটি নই। দুপুরে না লিখলে ভাত ঘুমটা আসেনা, তাই লিখি। আমার লেখার কোনও সামাজিক মূল্য নেই। জীবনে পুরস্কার পাবোনা। তাহলে কেন?

শ্রীযুক্ত দত্ত- আপনি যা লেখেন, সেসব জীবনানন্দের মত আপনি যখন থাকবেন না তখন পাঠকের কাছে প্রিয় হয়ে উঠতে পারে, আপনাকে এই ‘কোটা’য় ডাকা হয়েছে, বলা যেতে পারে ‘বঞ্চিত’ কোটায়

শ্রীযুক্ত রায়- (মনে মনে) বঞ্চিত বাঞ্চোৎ বললেই তো হয়!

শ্রীমতী সেনগুপ্ত- ভাই রায়, আমিও একদিন আপনার মত অখ্যাত ছিলাম, কেই চিনতো না। লেগে থাকতে হবে!

কুমারী চট্টোপাধ্যায়- রায়, আপনার আঠা আছে তো? লেগে থাকতে হবে, বুঝলেন না?

শ্রীযুক্ত বসু- আমরা মূল বিষয়ে আসি। এখন নিজেদের বিভেদ ভুলে আমাদের এই হত্যাকাণ্ডের বিরোধীতা করতে হবে। এই আক্রমণটা যারা করেছে তারা ভারতবর্ষকে হিন্দু রাষ্ট্রে বদলে দিতে চায়। একটা ধর্ম, একটা ভাষা, একইরকম আচার আচরণ। অন্য ধর্মের যাঁরা তাঁদের বেঁধে দিতে চায় দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে। কেড়ে নিতে চায় মত প্রকাশের, কথা বলার, প্রতিবাদ করার স্বাধীনতা। আজ যদি আমরা চুপ করে থাকি তাহলে ইতিহাস ক্ষমা করবে না।

শ্রীযুক্ত মুখোপাধ্যায়- হিন্দু রাষ্ট্র মানে?

শ্রীযুক্ত দত্ত- মনুবাদী সমাজ, বর্ণাশ্রম এসব আরকি!

কুমারী চট্টোপাধ্যায়- শ্রীযুক্ত মুখোপাধ্যায়, এটাতো আমাদের জন্য ভালোই ,কী বলেন? উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ আমরা। বেশ পায়ের ওপর পা তুলে থাকা যাবে। আর পুরুষরা যত ইচ্ছে বিয়ে করতে পারবে। হয়ত সতীদাহটাও ফিরে আসবে!

শ্রীযুক্ত মুখোপাধ্যায়- আমরা কিন্তু মূল এজেণ্ডা থেকে সরে যাচ্ছি, কাজের কথা কিছুই হচ্ছেনা। এরকম একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল। একজন মহিলা সাংবাদিক, রিনাউন্ড, তাঁর যদি এই অবস্থা হয়…শ্রীযুক্ত বসু আমরা একটা কাজ করতে পারি, লিখিতভাবে একটা তীব্র প্রতিবাদ আমরা করতে পারি। তারপর মোমবাতি নিয়ে শোভাযাত্রা। সাংস্কৃতিক কর্মীদের জমায়েত।

শ্রীযুক্ত রায়- আমি আছি, সই করে দেবো। জমায়েতে যাবো।

কুমারী চট্টোপাধ্যায়-(হেসে) দিও। তবে তোমায় সেভাবে তো কেউ চেনেনা, তবু কোটা বলে কথা, দিও।

শ্রীযুক্ত রায়- আরে দূর, কোটার ইয়ে মারি। আমায় ডাকা হল কেন? যদিও এখানে এসে মিটিং-এর এজেন্ডা দেখে থাকতে ইচ্ছে করল।

শ্রীযুক্ত বসু- ঠিক কথা। এই ইচ্ছেটাই। শ্রীযুক্ত মুখোপাধ্যায় যথার্থ বলেছেন। লিখিত বক্তব্য, জমায়েত সবই হবে। কিন্তু তার আগে আমি ‘জাঁ পল সাঁত্র’র সেই বিখ্যাত উক্তিটি আপনাদের শোনাতে চাই যা তিনি নোবেল প্রাইজ প্রত্যাখান করে বলেছিলেন,

‘a writer must not accept official awards, because to do so would add the influence of the institution that honored his work to the power of his pen. That is not fair to the reader             

শ্রীযুক্ত মুখোপাধ্যায়(মনে মনে)- আরে এই শ্রীযুক্ত বসু তো আচ্ছা ঢ্যামনা, সাঁত্র’র উদ্ধৃতি দিচ্ছে কেন? মতলবটা কী?

শ্রীযুক্ত দত্ত (মনে মনে)- কবিদের এমনিই বাজার খারাপ। একটা পুরস্কারই তো পেয়েছি, তাতেও নজর দেবে নাকি?

শ্রী যুক্ত রায়- সাঁত্র তো কোনও পুরস্কারই নেন নি, তিনি পুরস্কারের বিরোধী ছিলেন, এখানে আমি ছাড়া সবাই কোন না কোন পুরস্কার পেয়েছেন।কেন্দ্রের, রাজ্যের।আমি ঠিক বুঝলাম না এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের উদ্ধৃতি দিয়ে আপনি ঠিক কী বোঝাতে চাইলেন?

শ্রীযুক্ত দত্ত- আপনি ভাই ‘কোটা’র লোক, এত বুঝে আপনি কী করবেন? তবে শ্রীযুক্ত বসু ব্যাপারটা আমার কাছেও ঠিক পরিষ্কার হল না।

শ্রীযুক্ত বসু- আমি সাঁত্র’র উদাহরণ দিলাম আপনাদের এই কথাটা বলার জন্য যে, কেন্দ্রীয় সরকার যে সব পুরস্কার এ বছরে দিয়েছে চলুন আমরা সেগুলো দলবেঁধে প্রত্যাখ্যান করি।

(সবাই চুপ। বেশ কিছুক্ষণ।)

শ্রী যুক্ত মুখোপাধ্যায়- (মনে মনে) যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই, নিজে দু বছর আগে কেন্দ্রের পুরস্কার পেয়েছে, অতএব প্রত্যাখান এ বছর থেকে, নিজেরটা বেঁচে গেল।

কুমারী চট্টোপাধ্যায়- (মনে মনে)  যুব পুরস্কারটা প্রায় ম্যানেজ করে এনেছি, বলে কিনা ফেরত দিতে হবে! মন্নারুগুড়ি মুত্তুকৃষ্ণন মনোহরণ আইয়ার, এখন একাডেমির সচিব। দিল্লীর এক পেইন্টার বন্ধুর মাধ্যমে পরিচয়। মনোহরণ, কিছুদিন পরে মনোহর, পরে এক বিশেষ মুহূর্তে মনো! সব ঠিক হয়ে আছে, মনো কাল জানালো হয়ে যাবে। সেলিব্রেট করবে গুরুগাঁওয়ের কোন এক রিসোর্টে। পুরস্কার ফেরত, যৌথ বিবৃতি, জমায়েত, এসবে আমি নেই বাবা!

শ্রীমতী সেনগুপ্ত- (মনে মনে) পিতামহ ভীষ্ম(অর্থাৎ শ্রীযুক্ত বসু)তো ডোবাবেন দেখছি। আমার সাহিত্য একাডেমির প্রতিনিধি হিসেবে ইওরোপ ট্যুর আগামী মাসে, এখন এসবে জড়ালে তো ট্যুরের দফারফা!

শ্রীযুক্ত রায়- সবাই চিন্তায় পড়ে গেছেন মনে হচ্ছে। বাংলা সাহিত্যের আপনারা উজ্বল নক্ষত্র। পার্বতী লঙ্কেশকে তারাই মেরেছে যারা পানসারে, দাভোলকর আর কালবুর্গীকে মেরেছে। এরা হিন্দু ধর্মের নাম নিয়ে একে একে হত্যা করছে মুক্তমনা, যুক্তিবান, বিজ্ঞানমনস্ক, প্রতিবাদী মানুষগুলোকে, আপনারা এখনো ভাবছেন? রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন? জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পরে ‘নাইটহুড’ উপাধি ত্যাগ করার চিঠিতে তিনি তখনকার ভাইসরয়কে লেখেনঃ

the very least that I can do for my country is to take all consequences upon myself in giving voice to the protest of the millions of my countrymen, surprised into a dumb anguish of terror. The time has come when badges of honour make our shame glaring in the incongruous context of humiliation, and I for my part wish to stand, shorn of all special distinctions, by the side of those of my countrymen, who, for their so-called insignificance, are liable to suffer degradation not fit for human beings.

These are the reasons which have painfully compelled me to ask Your Excellency, with due reference and regret, to relieve me of my title of Knighthood, which I had the honour to accept from His Majesty the King at the hands of your predecessor, for whose nobleness of heart I still entertain great admiration…’

চিঠিটার অংশবিশেষ পড়লাম, আমি জানি এই চিঠি আপনাদের পড়া। এটাই আমাদের ঐতিহ্য। আপনারা সিদ্ধান্ত নিন। পুরস্কারগুলো অথবা সুযোগ সুবিধা যদি কিছু নিয়ে থাকেন, ফিরিয়ে দিন। যারা এখন ক্ষমতায় আছে এরা তাদেরই ভাবধারায় গড়ে ওঠা ফাশিস্ত খুনে, এদের কথামত না চললে, না লিখলে এদের হাত থেকে আপনারাও বাঁচবেন না!

(দীর্ঘ নিস্তব্ধতার পরে)

শ্রীযুক্ত দত্ত- এই যে ভাই কোটাকবি, তুমি লেকচার দিওনা। রবীন্দ্রনাথ আমরা তোমার চেয়ে কম জানি নাকি? শ্রীযুক্ত বসু এইসব ‘ননএনটিটি’কে ডাকেন কেন বলুন তো? পুরস্কার কোনও সরকার দেয় না। দেশের মানুষ দেয়। দেশের মানুষ এই সরকারকে নির্বাচিত করেছে। তাদের দেওয়া পুরস্কার হল দেশের মানুষের দেওয়া পুরস্কার। এই সম্মান আমরা ফিরিয়ে দেবো কিনা, ভাবতে হবে। আর রবীন্দ্রনাথ পরাধীন ভারতের লোক, না লোক নয়, ইয়ে ওই আরকি নাগরিক, ব্রিটিশ সরকার আর স্বাধীন দেশ ভারতের সরকার কখনোই এক হতে পারেনা!

শ্রীমতী সেনগুপ্ত- অফ দ্য রেকর্ড একটু মজা করি? রবীন্দ্রনাথ ‘নোবেল প্রাইজ’টা ফেরত দেন নি কিন্তু, হি হি..

কুমারী চট্টোপাধ্যায়- ওটা ব্রিটিশ সরকার ওঁকে দেন নি, এটাও জানেন না?

শ্রীমতী সেনগুপ্ত- আমি মজা করলাম, কুমারী চট্টোপাধ্যায় মনে হয় আমায় নিয়ে ইনসিকিউরিটিতে ভোগে। যাইহোক যে যার মত ভাববে। আমি তো কারো ভাবনাকে কন্ট্রোল করতে পারিনা। আর পুরস্কার ফেরত দেওয়া নিয়ে আমাদের আরো ভেবে ডিসিশন নিতে হবে। সময় চাই। শ্রীযুক্ত দত্ত ঠিকই বলেছেন, এটা রবীন্দ্রনাথের সময় নয়। স্বাধীন দেশ। ভাবতে হবে আরো।

শ্রীযুক্ত মুখোপাধ্যায়- রবীন্দ্রনাথকে সবকিছুতে টেনে আনা আমাদের জাতীয় স্বভাব। শ্রীযুক্ত রায়, রবীন্দ্রনাথ থেকে বেরিয়ে আসুন ভাই। আর পুরস্কার যদি ফেরত দিতেই হয়, শ্রীযুক্ত বসু তাহলে এই সরকারের আমলে যারা যে পুরস্কার পেয়েছেন সবই ফেরত দেওয়া উচিত, তাইনা?

(শ্রীযুক্ত বসু হাসলেন। গম্ভীর হয়ে গেলেন। ভাবলেন, কোটার ছেলেটা ছাড়া সবাই সেয়ানা।)

শ্রীযুক্ত বসু- বেশ তাহলে আমরা একটা জোরাদার যৌথ বিবৃতি দিই। মোমবাতি নিয়ে একটা জমায়েতেও হোক। পুরস্কার ফেরত দেওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে আমরা আরো একটু ভাবি, কী বলেন?

সবার মুখে সুরু, চওড়া, মৃদু, আলগা হাসি।

শ্রীযুক্ত রায় উঠে দাঁড়ালেন, লাফিয়ে উঠলেন টেবিলে। বললেন, রবীন্দ্রনাথের চেয়ে ভারী অলঙ্কার আপনাদের কারও ছিলনা। কিছু হাল্কা, ঝুটো গয়না আপনাদের শরীরে, পারলেন না নামিয়ে রাখতে। পার্বতী লঙ্কেশ আপনাদের পুরস্কারগুলোর চেয়ে অনেক হাল্কা, এটা আমি এখানে এসে বুঝেছি। আমি তো শালা ‘কোটা’র মাল। কেন্দ্র বা রাজ্যের পুরস্কার নেই। ইওরোপ ভ্রমণ নেই। যুব পুরস্কার নেই। নিজের জন্য লিখি। লিখে ঘুমিয়ে পড়ি। সমাজের ভার নেওয়ার ক্ষমতাও আমার নেই। আমি বঞ্চিত কোটার বাঞ্চোৎ। আমি যেটা পারি, যে ভারটা নামিয়ে রাখতে পারি, সেটা এবার নামাবো। নিন, হাততালি রেডি রাখুন!

শ্রীযুক্ত রায় এরপর তাঁর টিশার্ট, জিনসের প্যান্ট, অন্তর্বাস ইত্যাদি একে একে খুলে টেবিলের উপর নামিয়ে রাখতে শুরু করলেন।

হৈ হৈ শুরু হল। শ্রীযুক্ত রায়, এটা পাব্লিক নুইসেন্স, এখানে মহিলারা আছেন! শ্রীযুক্ত রায় এটা কী করছেন আপনি? এমা, ছি ছি, কী হচ্ছে এসব? এসব মন্তব্যের মাঝেই স্মিত হাস্যে শ্রীযুক্ত রায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন টেবিলে। মিটিং, বলা বাহুল্য ভেঙে গেল। সবাই চলে গেল একা শ্রীযুক্ত রায়কে রেখে। শ্রীযুক্ত রায়ও এবার চলে যাবেন রাস্তায়, সাধারণের ভীড়ে।

স্বপন রায়। কবি। জন্ম ১৯৫৬। ভারতের দুটো ইস্পাতনগরী জামশেদপুর এবং রাউরকেলা স্বপন রায়ের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। প্রথমটি জন্মসূত্রে। দ্বিতীয়টি বড় হয়ে ওঠার সূত্রে। নব্বই দশকের শুরুতে 'নতুন কবিতা'র ভাবনায় সক্রিয় হয়ে ওঠেন। পুরনো, প্রতিষ্ঠিত ধারাকবিতা ত্যাগ করে কবিতাকে নানাভাবে...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ