প্রতিবিম্ব

রুনা লেইস
ছোটগল্প
Bengali
প্রতিবিম্ব

সকালে উঠে হাতমুখ ধুতে গিয়ে বেসিনের আয়নায় চোখ থমকে গেল আরিয়ানার । আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বটি দেখছে না আরিয়ানা। ওখানে তার বদলে একটা ধোঁয়াটে ছায়া। গলা ও বা কানের একাংশ খানিকটা চুল ছাড়া পুরো মুখটাই উধাও। আয়না থেকে চোখ সরিয়ে দ্রুত হাতে দাঁত ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে সে তৈরী হতে শোবার ঘরে এলো।

ওখানে তার স্বামী গভীর ঘুমে। সে শহরের নামকরা জাদুকর। গতরাতে বড়বাজেটের জাদুর শো ছিল। শো শেষ করে পেমেন্টের টাকাসহ বোনাসের প্রচুর টাকাপয়সা নিয়ে অনেক রাতে তারা ঘরে ফিরেছে। এখন নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে বেচারা। আগামী একমাস হেসে খেলে চলে যাবে এই রোজগারে।

আরিয়ানা তার স্বামীর গুরুত্বপূর্ণ তিনটি জাদুর খেলাতে সহকারী হিসেবে থাকে।তারমধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও বিখ্যাত খেলাটি হলো জাদুকরের নিজের স্ত্রীকে টুকরো টুকরো করো জোড়া লাগিয়ে দেখানো। জাদুকরের সাথে বিয়ের পর ও পরিচয়ের প্রথমদিকে ও একাই জাদুকরের সহকারীর কাজ করতো। তখন তেমন একটা পরিচিতি ছিল না জাদুকরের। এখন নামডাক হয়েছে । রোজগার বেড়েছে সহকারী হিসেবে আরো পাঁচ ছ’ জন ছেলেমেয়ে থাকে প্রতিটি শো তে।

আরিয়ানা পোশাক পরে তৈরী হয়ে রান্নাঘরে গিয়ে চা তৈরী করলো। খানিকটা রুটি গরম করে পনির দিয়ে ব্রেকফাস্ট শেষ করলো। তারপর জুতোগুলো পরে ওভারকোট আর লোমশ টুপিটা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।

বাইরে রোদ চকচক করলেও দিনটা বেশ কনকনে ঠান্ডা। এখনো এদিকটাতে বসন্তের ছোঁয়া লাগেনি সেভাবে। দুরে পাহাড়ের বরফ গলতে শুরু করেছে সবে। নতুন ঘাসপাতা গজাচ্ছে পথের পাশে। ঠান্ডা হাওয়াটা বেশ চমৎকার লাগছে এই রোদ্দুরমাখা সকালে। শিশির জমে আছে পুরু হয়ে পথের পাশে ঘাসবনে।

আরিয়ানা আনমনে হাঁটতে লাগলো দক্ষিণে জঙ্গলের দিকে। জঙ্গলের ভেতরে একটা বাড়িতে তাকে এখন যেতে হবে ভাঙ্গা প্রতিবিম্বের খোঁজে ।

আরিয়ানা স্বামীর অনেক নামডাক। সে দারুণ সব জাদুর খেলা দেখাতে পারে। সবচেয়ে আকর্ষনীয় ও ভয়ঙ্কর যে জাদুটিতে অংশ নেয় আরিয়ানা সেটি দেখবার জন্যই দূর দূরান্ত থেকে অনেক লোকজন আসে। এই জাদুটি দেখে সবাই শিহরিত হয়। কেউ কেউ ভয়ে চিৎকার করে, বুড়ো থেকে বাচ্চা অব্দি কেউ আতঙ্কে কাঁদে, কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। তারপর জাদু শেষ হলে ক্রমাগত হাততালি, অভিনন্দন হর্ষধ্বনির বন্যা ছোটে। কেউ কেউ আনন্দিত হয়ে জাদুকরকে টাকার বান্ডিল কিংবা নিজের প্রিয় কোন অলঙ্কার কোমরের দামী বেল্ট, আংটি , ঘড়ি, মালা এসব খুলে উপহার দেয়।

নানান কথায় প্রশংসা বাণীতে স্টেজে দাঁড়ানো অনুষ্টান সঞ্চালকরা জাদুকরের এই বিশেষ জাদুটিকে উপমায় উপমায় আখ্যায়িত করতে থাকে। এটি তার শ্রেষ্ঠ ও মৌলিক জাদু, যে জাদুর খেলাটি আর কোনো জাদুকর দেখাতে পারে না। এ তল্লাটে তাই সে সবচেয়ে বড় জাদুকর।

এই জাদুটিতে জাদুকর রোমহর্ষক ভাবে নিজের স্ত্রীকে শূণ্যে বাতাসের মধ্যে ঘুম পাড়িয়ে দেয় সম্মোহনে তারপর নৃশংসভাবে খন্ড খন্ড করে রক্তাক্ত করে। সবশেষে প্রতিটি খন্ডকে নিপুণ জাদুর কৌশলে আবার জোড়া দিয়ে দেখায় । সবই দর্শকের চোখের সামনে। অন্যদের মত কোনো জাদুর বাক্সের ব্যবহার ছাড়াই। এই খেলায় দুজন সহকারীও থাকে না যে অদলবদল করে কিছু করা হবে। তাই দর্শকরা এতে ফাঁকির মত কিছু পায় না। এজন্য এর কদর সবচেয়ে বেশি। দেখার চাহিদাও বেশি। রোজগারও হয় অনেক।

কিন্তু প্রথমদিন স্টেজে খেলাটা দেখাবার পরেই ঘটলো আরিয়ানার জীবনে চমকে ওঠার মত এক ঘটনা। শো শেষ করে হাতে প্রচুর টাকাপয়সা পেয়েছে।আরিয়ানার তখন নতুন বিয়ে হয়েছে জাদুকরের সঙ্গে।

সেটা ছিল শীতের রাত বরফ ছাওয়া পথঘাট। বাড়ী ফিরবার পথে দুজনে মিলে খাবার খেলো রেস্তোরায়। খানিকটা বিয়ার পান করে উষ্ণ হবে বলে দু গ্লাস বিয়ার অর্ডার করলো দুজনে।কিন্ত ভালো বিয়ার না থাকায় হুইস্কি সার্ভ করলো রেস্তোরাঁর লোকটা। পান শেষে আরিয়ানা বেসিনের দিকে গেল। আয়নায় চেহারা চুল ঠিকঠাক করবে বলে। কিন্তু আয়নাতে সে কপালের ডানপাশ ছাড়া সবকিছু ধোঁয়াটে দেখতে পেল এবং সাথে সাথে চিৎকার করে উঠলো। জাদুকর ছুটে এসে আরিয়ানাকে ধরে নিয়ে এলো টেবিলের কাছে।

রেস্তোরাতে যারা ছিল আশেপাশে সবাই ছুটে আসলো। ততক্ষণে আরিয়ানা ব্যাপারটা সামলে নিয়েছে। ও ভাবলো খানিকটা পান করার কারণেই হয়তো এমনটা ঘটেছে। রেস্তোরাঁর সবাইকে কিছু একটা দেখে ভয় পেয়েছে বলে বেরিয়ে এলো দুজনে।

সে রাতে আবার আয়নাতে নিজের ধোঁয়াটে প্রতিবিম্ব দেখলো আরিয়ানা। স্বামী ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে তাই রাতে কিছুই বললো না সে জাদুকরককে। সে ভাবলো ঠিক হয়ে যাবে ঘুমুলে। কিন্তু সকালেও যখন দেখলো আয়নায় তার কোনো প্রতিবিম্ব নেই , শুধু খানিকটা ধোঁয়ার মত কিছু দেখা যাচ্ছে তখন তার সাথে জাদুকরও ভয়ে চমকে উঠেছিল। আরিয়ানা ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিল।এ সব কি হচ্ছে?

আরিয়ানার জাদুকর স্বামী তাকে অভয় দিল, বললো কিছু ভেবো না সব ঠিক হয়ে যাবে। জাদুর খেলাতে মাঝে মধ্যে একটু আধটু উল্টাপাল্টা হয়ে যায়। আমার গুরু অনেক বড় জাদুকর তিনি সব ঠিক করে দেবেন।

পরদিন সকালে তারা হাজির হলো সেই গুরুর কাছে যেখানে জাদুকর এই জাদুটি শিখেছিল। দক্ষিণের গভীর জঙ্গলের ভেতর সেই জাদুকরের ঘরবাড়ি, বিশাল এলাকা ঘিরে গাছপালার ঘন নির্জনতা।

সেখানে গিয়ে আরিয়ানাকে বাইরের একটি গাছের নিচে বেঞ্চে বসিয়ে রেখে জাদুকর তার গুরুর সঙ্গে দেখা করতে গেল। বন্ধ ঘরে অনেকক্ষণ কথা বললো গোপনে।আরিয়ানা সেই জঙ্গলের অদ্ভুত সব ফুল পাখি প্রজাপতি দেখতে লাগলো মুগ্ধ হয়ে। তার স্বামী গুরুর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আরিয়ানাকে ইশারা করে বললো যাও ভেতরে।

ভয়ে ভয়ে ভেতরে ঢুকলো আরিয়ানা। বুড়ো জাদুকরের সব চুল দাড়ি পাকা। মুখে মৃদু হাসি। তাকে দেখে খুব আনন্দিত হয়ে বললেন, এসো এসো আরিয়ানা। বসো, ভয়ের কিছু নেই। তোমার ছোকরা স্বামীটির রক্ত গরম সবকিছুতেই খানিকটা বাড়াবাড়ি। ওকে নিষেধ করেছিলাম এই জাদুটি দেখাতে। বলেই হাত ধরে আরিয়ানাকে নিয়ে গেলেন দেয়ালের দিকে। ওখানে ঝপ করে দেয়ালটা সরে গিয়ে পথ তৈরী হলো, ওরা ভেতরে ঢুকতেই আবার জোড়া লেগে গেল দেয়াল। একটা চমৎকার আলোকোজ্জ্বল ঘর। নরম গদিমোড়া চেয়ারে আরিয়ানাকে বসিয়ে দিয়ে বুড়ো জাদুকর ওর দু চোখে হাত বুলিয়ে দিলেন, তারপর চেয়ারে আঙ্গুলের টোকা দিতেই চেয়ারটা ওকে সহ সবেগে ঘুরতে লাগলো। ঘুরতে ঘুরতে একসময় থামলো, আরিয়ানা চোখ খুলে দেখলো তার সামনে সোনালী ফ্রেমের চমৎকার একটি আয়না। কিন্তু আয়নাটিতে কয়েক টুকরো ফাটল। সেই আলাদা আলাদা টুকরোতে প্রতিবিম্ব ভাসছে সমস্ত ঘরের। সেখানে আরিয়ানার পুরো প্রতিবিম্বের চেহারাটা ভেঙ্গে ভেঙ্গে দেখা যাচ্ছে।ওর পিছনে বুড়ো জাদুকরের হাসিমাখা সৌম প্রতিবিম্বটি কিন্তু সম্পূর্ণ।

জাদুকর বললেন আরিয়ানা, এটা তোমার স্বামীর কাজ, বলে ভাঙ্গা আয়নাটিকে দেখালেন। সে বহুকাল আগের কথা। আমার কাছে জাদু শিখতে এসে এই আয়নাটি ভেঙ্গে তোমার স্বামী তোমার প্রতিবিম্বটিকে আমার কাছ থেকে চুরি করে নিয়ে পালিয়েছিল। এর আগে তুমি এখানে ছিলে। তখন তাকে বলেছিলাম, নিষেধ করেছিলাম এই জাদু দেখাতে। যতবার সে এই জাদু দেখাবে ঠিক ততবার তুমি আমার কাছে ফিরে আসবে তোমার সম্পূর্ণ প্রতিবিম্বটি নিতে। কারণ ভাঙ্গা আয়নায় প্রতিবিম্ব জোড়া দেয়া যায় না। তারপর বুড়ো জাদুকর আঙ্গুলের ইশারায় আয়নার ভেতর আরিয়ানার ভাঙ্গা প্রতিবিম্বটির প্রতিটি টুকরো পরম যত্নে জোড়া লাগিয়ে দিলেন। আরিয়ানা ফিরে এসে দেখলো তার জাদুকর স্বামীটি একা একা বেঞ্চে বসে আছে।

সেই থেকে যতবার জাদুকর এই খেলা দেখায় ততবার আরিয়ানাকে ফিরে যেতে হয় প্রতিবিম্ব জোড়া দিতে বুড়ো জাদুকরের কাছে।

রুনা লেইস। লেখক, চিত্রশিল্পী ও বাচিকশিল্পী। জন্ম ও বসবাস বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ। পড়াশুনা করেছেন গ্রাফিক্স ডিজাইনে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ হতে। বর্তমানে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। অংকন ও আবৃত্তির স্কুল পরিচালনার পাশাপাশি লেখালিখি জারি রেখেছেন। এর বাইরে তিনি সুনামগঞ্জ জেলা...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ