প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
– মা আমি বেরুচ্ছি।
– গাড়ি নিয়ে যাবি? তাহলে আমাকে আড়ঙে নামিয়ে দিয়ে যাস!
– নাহ, এমনি বেরুচ্ছি।
– কখন আসবি?
– ঠিক নেই।
– দেরি হলে কল করিস, গাড়ি পাঠিয়ে দেবো।
মাথা নেড়ে নিজের ঘরে ঢুকে যায় ফারহা। রুম থেকে কাপড়ের ব্যাক প্যাকটা নেয় ও। ভেতরের পার্স খুলে দেখে হাজার দুয়েক টাকা আছে। উঁহু চলবে না! মায়ের কাছ থেকে আর হাজার পাঁচেক চেয়ে নিতে হবে। আর ডেবিট ক্রেডিট দুই রকমের কার্ড তো আছেই সাথে।
মাস্টার্সে পড়লেও ফারহার চেহারায় বাচ্চাবাচ্চা একটা ভাব আছে। জীবনের কঠিন দিকগুলো না দেখার সুবিধা সম্ভবত এটাই। চেহারায় অভিজ্ঞতার ছাপ পড়েনা। আবার অসুবিধাও কম নেই, জীবন যখন ঘাড় ধরে কঠোর বাস্তবতার মুখে ঠেলে দেয় তখন স্রেফ পালিয়ে যেতে হয়, নয়তো অন্যকারো মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় উদ্ধার পাওয়ার আশায়।
গল্পটির অডিও শুনুন এইখানে:
কাবার্ডের ভেতর থেকে অর্ধেক বোতল বিফইটার নিয়ে নেয় ব্যাগে। আজ হাসান খৈয়ামকে জিন খাওয়ানোর কথা ওর। হাসান হচ্ছে ওর প্রেমিক। নিম্নবিত্ত পরিবারের এই ছেলেটির মধ্যে আসলে স্পেশাল কিছুই নেই, কবিতা লেখে। অনেকেই প্রশংসা করে ওর কবিতার। কি কি যেন পুরস্কারও পেয়েছে! ফারহার মনে হয়, এগুলো স্রেফ অর্থহীন প্রলাপ। আচ্ছা, একটা লেখা পড়ে যদি কেউ কিছু না-ই বোঝে তাহলে সেটা সাহিত্য হয় কিভাবে! দুর্বোধ্যতাই কি কাব্য! নাকি পাঠক আর বোদ্ধারা কেউ স্বীকার করতে রাজি নয় যে, তারা আসলে কিছুই বোঝেনি!
হাসান ওর দারিদ্র্য নিয়ে খুব গর্ব করে। কৈশোরে বাপের সাথে হালচাষ করেছে এ কথা দিনে কমপক্ষে আড়াইবার করে বলে। হুইচ ইজ গুড, কিন্তু তাতে তো ওর বিনয়ী হওয়ার কথা! অথচ হাসান যে কী পরিমাণ অহংকারী আর উদ্ধত সেটা শুধু ওর আশেপাশের লোকেরাই জানে।
নিজের কামাই নেই, চলে প্রেমিকার বাপের পয়সায়, অথচ পারলে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে এখনই লাঠিসোটা নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে, এমন অবস্থা! তবুও ফারহা যে কেন ওর সাথে জড়িয়েছে, তা কেউই জানে না। হাসান না বললেও অনেকেই বুঝতে পারে ওর উদ্দেশ্যটা কি। পয়সাওয়ালা বান্ধবী থাকার মজাই আলাদা, আর সে যদি ফারহার মতো মহাবেকুব হয়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা! ফারহা বেশ বুঝতে পারে হাসান যে ওকে বোকা ভাবে। ভাবুক!
মায়ের কাছ থেকে আরো পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ও। সিএনজি নিতে হবে একটা। আশেপাশে কয়েকটা রিক্সা ছাড়া আর কিছুই নেই। একটা রিক্সায় উঠে ও সামনে যেতে বলে। দুই মিনিট এগোতেই একটা সিএনজি পেয়ে যায় ফারহা। রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে ও সিএনজি চালককে জিজ্ঞেস করে,
– মামা গুলশান দুই যাবেন?
– হ, মামা যামু। দুইশো ট্যাকা দিবেন।
– মিটারে যাবেন না?
– না, মামা। মিটারে পুষায় না।
ফারহা তর্ক না করে সিএনজিতে উঠে বসে। সিএনজি চালক গাড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে বলে,
– ট্রাফিকে ধরলে কইবেন মিটারে যাইতাছি।
ফারহার মেজাজটা টং করে খারাপ হয়ে যায়। আশি টাকার ভাড়া দুইশো টাকা নিচ্ছে, আবার ওর হয়ে মিথ্যা কথাও বলতে হবে! আজ ধরুক কোনো ট্রাফিক পুলিশ, স্ট্রেইট বলে দেবে! ফাজলামির একটা সীমা থাকা দরকার!
ফারহার ইনোসেন্ট চেহারা যে ওর কী পরিমাণে সাহায্য করে তা বলে শেষ করা যাবে না! শুধু বাসায় না, বন্ধুবান্ধব থেকে শুরু করে ভার্সিটির শিক্ষক অব্দি ওর ভেতরের আসল রূপটি কেউই ধরতে পারেনি। ওর ভুলের জন্য আশেপাশের লোকজন দায়ী হয়, ও বাইরে টলটলে স্বচ্ছ চোখে তাকিয়ে থেকে ভেতরে ভেতরে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। যারা বলে চোখ হচ্ছে মনের আয়না, ফারহা ওদের প্রতি করুণা বোধ করে। ওর মুখে একটা তির্যক হাসি খেলে যায়! ধ্রুবসত্য বলে কতো বস্তাপচা চিন্তাভাবনা যে মানুষকে গেলানো হয়, তার ইয়ত্তা নেই!
এতোদিন ধরে হাসান খৈয়ামের সাথে প্রেমের সম্পর্ক রেখে ফারহা ওর আস্থা অর্জন করতে চাইছিল। হাসানের কবিতা বুঝতে পারত না বলে ফারহার নিজেকে অসম্ভব ছোট মনে হতো। মেয়ে ভক্তদের সামনে হাসানের নির্লিপ্ত উদাসীনতা ওকে মুগ্ধ করত। তবে ফারহা জানতো একদিন ওর উদ্দেশ্য সফল হবে।
হাসান খৈয়াম খুব ভালো ভাবেই জানে, মেয়েদের সাথে ছোঁকছোঁক করলে পাত্তা পাওয়া যাবে না। একটা মেয়ের সাথে কেউ যদি একটু ছোঁকছোঁক করে, পরেরদিন সমগ্র নারীকুল সেই খবর জেনে যায়! মেয়েদের মনে হয় গোপন একটা নেটওয়ার্ক আছে, যেটা সম্পর্কে বোকা ছেলেগুলোর কোনো আইডিয়াই নেই। ফারহাকে মনে ধরেছিল হাসানের, কিন্তু খুব সহজে ধরা দিলে মেয়েটার আগ্রহ কর্পূরের মতো উবে যেতে পারে ভেবে, ঝুলিয়ে রেখে দিয়েছিল বেশ অনেকদিন।
হাসান ভাবছে যে, বেশ বড়শি খেলিয়ে পাত্তিওয়ালা বাপের বোকা মেয়েটাকে ও শিকার করবে। আর ফারহা মনে মনে হাসছে, কবি ধরা খাচ্ছে বলে। অহংকারী মানুষগুলোর আত্মপ্রেম এতো প্রবল থাকে যে, এরা নিজেকে ছাড়া অন্যকে মোটেই বুদ্ধিমান ভাবে না। যার জন্য কঠিন সব ধরা খায়, তবুও এদের শিক্ষা হয় না!
হাসানের সাথে দুইদিন ডেইট করার পরেই ফারহা বুঝে গেছে, এই উন্নাসিক লোকটা তাকে ব্যাবহার করতে চাইছে। ও মনেমনে ওর বিখ্যাত তির্যক হাসিটি হাসে আর ভাবে, বেশ বেশ দেখি কে জেতে!
নাহ! প্রেম তো আর যুদ্ধ অথবা প্রতিযোগিতা নয় যে, জয়পরাজয় নির্ধারণ করতে হবে! তবে মানবপ্রেমের জয়জয়কার করে বেড়ানো একজন কবিতা লেখকের অন্তর্গত বোধটা খুব জানার ইচ্ছা ফারহার। সাথে তারচেয়েও বড় একটি কারণ আছে, যা ফারহা ভুলেও কারো কাছে উচ্চারণ করেনি।
তিন বছর আগে একদিন হাসান ওদের বাসায় এসেছিল। কি একটা স্মরণিকার জন্য বাবার কোম্পানির অ্যাড চাইতে। হাসানকে দেখে ফারহাদের কাজের মেয়ে রেহানা দৌড়ে ফারহার রুমে ঢুকে বেশ তীব্রভাবে বলেছিল,
– ও আফা! হাচাইন্যা এই বাড়িত কি চায়?
ক্যাম্পাসে হাসানকে অনেক দেখেছে ফারহা। সবসময় বন্ধু আর ভক্ত পরিবেষ্টিত লম্বা, শ্যামলা, উদাস চোখের একটা ছেলে। মেয়েরা ওর আশেপাশে গেলেই গরমে আইসক্রিমের মতো গলে গলে যেতে থাকে! যে কোনো সাহিত্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা হাসান খৈয়ামকে পেলে বর্তে যায়! সেই কবিকে বাসার কাজের মেয়ে এরকম তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলায় ফারহার ভ্রু কুঁচকে উঠেছিল।
এর পরের ঘটনা শুনে স্তম্ভিত হয়ে যায় ফারহা। রেহানাদের গ্রামেরই হাসান আলিদের বাড়ির অবস্থা ভালো না। তবুও পড়াশোনা করার প্রচণ্ড আগ্রহ আর ভালো ফলাফলের জোরে হাসান কলেজ পর্যন্ত যায়। ওর বাবার পক্ষে আর ওকে পড়ানো সম্ভব নয় বলে গ্রামের এক ধনী লোকের মেয়েকে বিয়ে করবে, এই শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ নিতে থাকে হাসান। সেই মেয়ের সাথে নাকি ওর কাবিনও হয়েছিল। মাস্টার্স পাশ করার পর হাসান সেই স্বল্প শিক্ষিতা মেয়েকে নিজের যোগ্য মনে করেনি, তাই তালাকনামা পাঠিয়ে দিয়েছে, মেয়েটি এই অপমানে কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল, যদিও সময় মতো হাসপাতালে নেওয়ায় ও বেঁচে যায়। মেয়ের বাবা কেইস করতে চাইলে হাসানের বাবা হাতেপায়ে ধরে থামিয়েছে। নিজেদের যৎসামান্য জমি লিখে দিতে হয়েছে সেই লোককে। নিজের বাবা, মা, ছোট দুই বোনের কোনো খোঁজ হাসান রাখে না। ওর বয়স্ক বাবা অন্যের জমিতে কামলা খেটে ওদের সংসার চালাচ্ছেন, আর এদিকে হাসান আলি হাসান খৈয়াম হয়ে, সমাজ পরিবর্তনের নামে আয়েসি জীবন যাপন করছে!
তারপর থেকে ফারহা হাসানকে নজরে রেখেছে, আর দশটা মেয়ের মতো গদগদ না হয়ে ওর কবিতা বুঝতে চেয়েছে। অতীব কঠিন দুই বই ভর্তি কবিতা বুঝতে না পারলেও কয়েক লাইন করে মুখস্থ করেছে, ক্রমে হাসান ওর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। ফারহা বুঝে গিয়েছে এই সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখানো কবি বলে পরিচিত লোকটি প্রচণ্ড কামুক, স্বার্থপর আর সুবিধাবাদী। ভক্তদের কাছ থেকে নানান সুবিধা নিয়ে সে চলে। গুলশান দুইয়ের ওর এই চিলেকোঠাটিও এক ভক্তই নামমাত্র ভাড়ায় ওকে দিয়েছে। ব্যাগের ভেতর ফোন ভাইব্রেট করায় ফারহার চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়। হাসান কল করেছে,
– প্রিয়া তুমি কদ্দূর?
– এইতো প্রায় চলে এসেছি।
– শোনো, আমার সিগারেট ফুরিয়ে গেছে। তুমি নিয়ে এসো, ওকে?
– শিওর।
– আজ আমি মাত্রা ছাড়াবো, তুমি না করতে পারবে না।
একটু হেসে “ওকে” বলে লাইন কেটে দেয় ফারহা।
ফোন রেখে কিছুক্ষণ চুপচাপ ভাবতে থাকে ও, মাথার মধ্যে ঝড়ের গতিতে ক্যালকুলেশন চলছে ফারহার। ব্যাংক থেকে আরো তিন হাজার টাকা উঠিয়ে নেবে। নিজেকে সুপার ক্রাইম ফাইটার বলে মনে হচ্ছে ওর। উফ! কী যে উত্তেজনা! ফাঁকিবাজ, ভণ্ড এই লোকটাকে আজ চরম শিক্ষা দেওয়া যাবে!
জিন খেয়ে ড্রাংক থাকবে। মাত্রাছাড়াতে গিয়ে নির্ঘাত হাসান খৈয়াম ফারহার গায়ে দাগ করে দেবে। হাত খরচের জন্য দশ হাজার টাকা ওকে দিয়ে রাখবে আগেই, মা সাক্ষী পাঁচ হাজার টাকার, ব্যাংক সাক্ষী তিন হাজারের। ফারহার নিরীহ চেহারার বিপক্ষে যাওয়ার ক্ষমতা কারো বাপের নেই! ছলছলে চোখে থানায় ঘটনাটা বলতে হবে, থানা থেকে মাকে কাঁদোকাঁদো কন্ঠে ফোন করে জানাতে হবে। নিজের বাসায় ডেকে নিয়ে ফারহার টাকা কেড়ে নিয়ে ওকে ধর্ষণ করেছে এক কবি। মনে মনে হেসে ভাবে ফারহা, এটা হেডলাইন হিসেবে খারাপ না। পত্রিকায় খবরটা গেলে কি বাবা রাগ করবেন? যাক! সেগুলো পরে দেখা যাবে। ফিজিক্যাল সব এভিডেন্স তো থাকবেই। ফারহার বাবা মা নিশ্চয়ই নিজেদের মান সম্মান রাখতে গিয়ে কাউকে বলবেন না যে, তাদের মেয়ে মানসিকভাবে কিছুটা ভারসাম্যহীন!
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..